কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১০৭ 

 

বাঙালি জীবনে শরৎকালীন পুজো তথা উৎসবরের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে শারদ পত্র-পত্রিকা, মূলত শারদ সাহিত্যপত্রিকা। আমার জানা নেই, বাংলাভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা ছাড়া আর কোনো ভাষায় শারদ সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয় কিনা; তবে ঈদ উৎসব উপলক্ষ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয়। এবং তা বাংলা ভাষাতে। আমার মনে পড়ে, আমি যখন শৈশব থেকে কৈশোরে অনুপ্রবেশের সন্ধিপর্বে ছিলাম, আমার আগ্রহ অনুভব করে ‘শুকতারা’ নামে একটি ছোটদের  পত্রিকা নিয়মিত বাড়িতে রাখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন আমার মা-বাবা। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো কলকাতার ঝামাপুকুর লেনের ‘দেব সাহিত্য কুটির’ প্রকাশনা থেকে। আর প্রত্যেক বছর শরৎকালে পুজো উপলক্ষ্যে তাঁরা প্রকাশ করতেন একটি ঢাউস আয়তনের ছোটদের উপযোগী বই। মনে আছে এখনও, সারাটা বছর আমি অপেক্ষা করে থাকতাম, শরতকালের একটি মনোরম সকালে বইটি আমার হস্তগত হবে জেনে। সেই শারদ সাহিত্যপত্রিকার জন্য শুধু আমার  নয়, বরং আমার বয়সের সামান্য কম-বেশি সব বাঙালি ছেলেমেয়েদের যে কী উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে ঐসময়ে ছোটদের জন্য আরও বেশ কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশিত হতো, যেমন সন্দেশ, কিশোরভারতী ইত্যাদি; কিন্তু আমাদের বাড়িতে শুধু ‘শুকতারা’ই আসত এবং  আসত ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত পুজো বার্ষিকী। তারপর যখন কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করলাম, তখন লক্ষ্য করলাম, যেন আমার বড় হবার অপেক্ষাতেই এতদিন উন্মুখ হয়েছিল সারা বছর সাধারণ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত এবং বছরে একবার শারদসংখ্যা রূপে প্রকাশিত বড়দের জন্য অসংখ্য বাংলা পত্র-পত্রিকা। বিশেষত তখনও পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন আজকের মতো এতটা সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি, তাই বিভিন্ন বৃহৎ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্রিকাগুলি, মূলত শারদসংখ্যাগুলি আমরা বুভুক্ষের মতো পড়তাম, গিলতাম এবং আনন্দ উপভোগ করতাম। যেমন শারদসংখ্যা দেশ,  আনন্দবাজার পত্রিকা, বসুমতি, যুগান্তর, নবকল্লোল, ঘরোয়া, জলসা, উল্টোরথ, সিনেমাজগত, বেতারজগত, শিলাদিত্য ইত্যাদি। আর আমাদের অগ্রজদের কাছে শুনতাম, তাঁদের যৌবনকালে প্রকাশিত ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বার্ষিক বসুমতি, সুলভ সমাচার, সাধনা, বঙ্গবাণী ইত্যাদি পত্রিকার কথা। আর এইসব  শারদসাহিত্যে লিখেছেন কোন লেখকেরা – স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরতচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জলধর সেন, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, বনফুল, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, সুবোধ ঘোষ, সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – না, এই তালিকা সম্পূর্ণ করা কখনই সম্ভব নয়। তবে এই অসংখ্য শারদ পত্র-পত্রিকার ভীড়ে যদি কেউ আগ্রহী হন প্রথম প্রকাশিত শারদসংখ্যা পত্রিকাটি সম্পর্কে, তাহলে উল্লেখ করতেই হয় ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার কথা। আজ থেকে প্রায় একশ পঞ্চাশ বছর আগে ব্রাক্ষ্মসমাজের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব কেশবচন্দ্র সেন এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দের শরৎকালীন পুজোর সময় তাঁরই উদ্যোগে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার সঙ্গে একটি ক্রোড়পত্র সংযোজন করা হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ছুটির সুলভ’। পত্রিকাটির বিনিময় মূল্য ছিল মাত্র  এক পয়সা। তবে পরবর্তী সময়ে ১৯১৩ সালে পুজোর সময় জলধর সেনের সম্পাদনায় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার যে সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেটাই ছিল প্রকৃত অর্থে প্রথম বাংলা ভাষার শারদসংখ্যা। দুশো পৃষ্ঠাসংখ্যার এই পত্রিকার জন্য কলম ধরেছিলেন সেই সময়ের দিকপালেরা। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’ প্রকাশনী থেকে।   

 

সবার প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৪   



   

আজ হলিউডের স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনা যারা আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে চলে গেছেন। এখনকার দিনে হলিউডের নায়িকারা চরিত্রাভিনয়ের দিকে বেশি ঝুঁকলেও স্বর্ণযুগে কিন্তু নায়িকাদের ঝাড়াই বাছাই হত প্রাথমিকভাবে তাদের সৌন্দর্য ও গ্ল্যামার সূচক দেখে। যেমন মেরিলিন মনরো। এবং এর আগের পর্বেই বলেছি যে তখনকার দিনে কিন্তু এইসময়ের মত সিনেমা ভিত্তিক চুক্তি হত না - চুক্তি হত প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে, বেশ কয়েক বছরের জন্য। ফলে ইচ্ছে থাকলেও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ঐ সময়ের ভেতর অন্য কোন সিনেমায় কাজ করতে পারতেন না। এবং যে যে নায়িকার অভিনয় দক্ষতা থাকলেও তার সৌন্দর্য ফিকে হয়ে আসত, যে আর দর্শক টানতে পারত না, তার নাম দেওয়া হত ‘বক্স অফিস পয়জন’। আজ কিন্তু আমরা যাকে আমাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে রাখব, তাকেও ‘বক্স অফিস পয়জন’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। যদিও তার অতি বড় নিন্দুকেও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে অভিনয় দক্ষতায় তার নাম একদম ওপরের দিকে রাখতেই হবে।

এই লেখা শুরু করতে গিয়ে অ্যালেন পো-র এক বিখ্যাত কবিতা মনে পড়ে গেল ‘Helen, thy beauty is to me / Like those Nicean barks of yore, / That gently, o’er a perfumed sea, / The weary, way-worn wanderer bore / To his own native shore’ এবং এই কবিতার ছায়ানুসারে বানানো আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা / মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূরে সমুদ্রের পর / হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা / সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর / তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে’। সত্যিই, আজ আমরা যাদের নিয়ে আলোচনা করব, তাদের প্রত্যেকের ছবি দেখে আপনাদেরও এই কবিতা দুটোই মাথায় আসবে। এরা সবাই সেই প্রদীপ যারা নিজের সময়ে গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন। এবং পাঠক, আপনাদের কি ছোটবেলার অরণ্যদেব কমিকের ‘ডায়ানা’ বা ম্যানড্রেকের ‘নার্দা’কে মনে আছে? ড্রিমগার্ল বলতে যা বোঝায়, এরা যেন ঠিক তাই। আজো আমি যখনই ইনগ্রিড বার্গম্যানকে ছবির পর্দায় দেখি, মনে হয় যেন সেইরকম কোন এক ড্রিমগার্লকে চোখের সামনে দেখছি।

তাহলে লিস্ট শুরু করি। আমার বানানো এই লিস্টে প্রথম নামঃ ক্যাথরিন হেপবার্ন। এই নিয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। যদিও ওনাকেও যে ‘বক্স অফিস পয়জন’ তকমা দেওয়া হয়েছিল, সেটা তো একটু আগেই বললাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু আমার পছন্দ অনুযায়ী, দ্বিতীয় ইনগ্রিড বার্গম্যান ও তৃতীয় বেটি ডেভিস। এবং যে দুজনের নাম এদের আশেপাশে উল্লেখ না করলে আমার মাথা-আঙুল-কিবোর্ড থামবে না, তারা হলেন অড্রে হেপবার্ন ও এলিজাবেথ টেলর।

হ্যাঁ, এই প্রসঙ্গে এমন একজন ডাকাবুকো নায়িকার নাম করতেই হবে যাকে অস্কার কমিটি বারবার উপেক্ষা করে ভুল করেছে। সেই ভুল ঠিক করার জন্য অস্কার কমিটি তাকে শেষ জীবনে ১৯৮২ সালে অনারারি অস্কার দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে কি এত বছরের ভুল শোধরায়? বারবারা স্ট্যানউইক। ‘ডবল ইনডেমনিটি’র (১৯৪৪) সেই কুখ্যাত নায়িকা। ‘স্টেলা ডালাস’-এ (১৯৩৭) সীমানার বাইরে থেকে মেয়ের আলো ঝলমলে বিয়ের দিকে চেয়ে থাকা এক অসহায় কিন্তু খুশি মা। ‘সরি, রং নাম্বার’-এর (১৯৪৮) হুইলচেয়ারে বসা এক সন্দিহান প্রতিবন্ধী মহিলা। অস্কার কমিটি আসলে কোনদিন (হয়ত এখনো) বোঝেইনি যে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের চশমা দরকার ছিল। আরেকজন মানসিক সমস্যায় ভোগা নায়িকার কথা না বললে আমার মনের উশ্‌খুশ্‌ থেকে যাবে। ভিভিয়ান লেই। দার্জিলিং-এ জন্ম। সুতরাং জন্মসূত্রে বাঙালি। আর সেজন্যই ওনার নাম এই লিস্টে না রাখলে আমার অধর্ম হবে।

ক্যাথরিন হেপবার্ন (১৯০৭-২০০৩) ছিলেন এক স্বাধীনচেতা মহিলা, যিনি প্রায় ছ’দশক ধরে ৫২টি বিভিন্ন রকমের সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের জন্য সারা জীবনে ৫০টি পুরস্কার জিতেছেন যার ভেতর প্রথমেই বলতে হয় ১২বার অস্কার নমিনেশন, ৪বার বিজয়ী, ৮বার গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন, ৬বার এমি নমিনেশন ও ১বার জয়লাভ এবং ৫বার বাফটা নমিনেশন ও ২বারের বিজয়। এছাড়াও কান ও ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং নিউইয়র্ক ফিল্ম ক্রিটিক সার্কল থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। ওনার যে যে ছবি তালিকার একদম ওপর দিকে থাকবে, সেগুলো হল -  মর্নিং গ্লোরি (১৯৩৩), অ্যালিস অ্যাডামস (১৯৩৫), ফিলাডেলফিয়া স্টোরি (১৯৪০), ওম্যান অব দ্য ইয়ার (১৯৪২), আন্ডারকারেন্ট (১৯৪৬), দ্য আফ্রিকান কুইন (১৯৫১), সামারটাইম (১৯৫৫), দ্য রেইনমেকার (১৯৫৬), লং ডেজ জার্নি ইন্টু নাইট (১৯৬২), গেস হু ইজ কামিং টু ডিনার (১৯৬৭), দ্য লায়ন ইন উইন্টার (১৯৬৮) এবং অন গোল্ডেন পন্ড (১৯৮১)। নিজের কেরিয়ার যখন নিচের দিকে, তখন তা টেনে তোলার জন্য উনি আর-কে-ও থেকে ‘ফিলাডেলফিয়া স্টোরি’র স্বত্ব কিনে নিয়ে আবার বেচে দেন, শুধুমাত্র এই শর্তে যে উনি হবেন সেই ছবির নায়িকা। সেই ছবি দুর্দান্ত হিট হয় এবং ক্যাথরিন আবার হলিউডের এক নম্বর নায়িকার আসনে বসেন। পরিণত  বয়সে উনি অন্যধরনের ছবি করতে শুরু করেন এবং সেখানেও সফল হন। এইরকম এক অ্যাডভেঞ্চার ও প্রেমের কাহিনী ছিল ‘দ্য আফ্রিকান কুইন’ যেটা নিয়ে আমি আগের পর্বে আলোচনা করেছি। হামফ্রে বোগার্ট ছিলেন এই ছবির নায়ক। তাই আজ আর নতুন করে ক্যাথরিনের অন্য কোন সিনেমা নিয়ে লিখব না।

ইনগ্রিড বার্গম্যান (১৯১৫-১৯৮২)–কে নিয়ে আমি কিছু লিখলে তাতে পক্ষপাতিত্বের দোষ থাকতেই পারে কারণ উনি আমার অল টাইম ড্রিমগার্ল।  সৌন্দর্য্য, ব্যক্তিত্ব, হৃদয়ছোঁয়া হাসি, অনবদ্য সংলাপ বলার ক্ষমতা, সোনালি চুল, প্রেমে পড়া চাউনি – কী ছিল না ওনার মধ্যে? জন্মসূত্রে সুইডিশ ইনগ্রিড তিরিশের দশকে আমেরিকায় চলে এসে হলিউডে বিখ্যাত হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে সুইডেন, জার্মান, ফ্রান্স ও ইতালি – সব দেশের ছবিতেই অভিনয় করেছেন। ওনার বিখ্যাত ছবির তালিকায় আছে - কাসাব্লাঙ্কা (১৯৪২), ফর হুম দ্য বেল ট্রোলস (১৯৪৩), গ্যাসলাইট (১৯৪৪), দ্য বেল্‌স অব সেন্ট মেরিজ (১৯৪৫), নটোরিয়াস (১৯৪৬), জোয়ান অব আর্ক (১৯৪৮), জার্নি টু ইতালি (১৯৫৪), অ্যানাস্তাসিয়া (১৯৫৬), মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (১৯৭৪) এবং অটাম সোনাটা (১৯৭৮)। ইনগ্রিড যখন ১৯৮২ সালে ব্রেস্ট ক্যানসারে মারা যান, সেই সময় উনি একটা টিভি সিরিজে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। সেই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য মারা যাবার পর উনি পসথুমাস এমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনবার অস্কার পেয়েছিলেন, যার প্রথমটা এসেছিল ‘গ্যাসলাইট’ ছবির জন্য। এই ছবি নিয়েই  আজ আমাদের অলোচনা। এই ছবির শুরুর নাম ছিল ‘মার্ডার ইন থর্নটন স্কোয়ার’। পরে এম-জি-এম সেটা বদলায়।   

ছবির মুখ্য চরিত্রে ইনগ্রিড বার্গম্যান ও চার্লস বয়ার। যাত্রাপালার বিখ্যাত গায়িকা অ্যালিস তার দামি গয়নাপত্রের জন্য খুন হন। কিন্তু খুনি সেইসব চুরি করার আগেই অ্যালিসের ভাইঝি পওলা সেখানে এসে পড়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনায় পওলা এত আঘাত পায় যে তাকে গান শেখার জন্য ইতালি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক বছর পরে, পওলা (ইনগ্রিড) গ্রেগরি নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে। তারা বিয়ে করে এবং আবার পওলার পিসির বিরাট প্রাসাদে ফিরে আসে। সেখানে এসে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে গ্রেগরি আস্তে আস্তে প্রমাণ করতে চায় যে পওলা মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার মানসিক চিকিৎসা  দরকার। পওলাও সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং গোটা পৃথিবীর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। একদিন ধরা পড়ে যে গ্রেগরিই সেই মানুষ যে অ্যালিসকে খুন করেছিল এবং সে পওলাকে বিয়ে করেছিল তার পিসির সম্পত্তির লোভে। এই সিনেমায় ইনগ্রিডের অভিনয় গায়ে কাঁটা দেওয়া। 

রোমান্স বা কমেডি থেকে শুরু করে ভয়ের সিনেমা বা ঐতিহাসিক ছবি থেকে শুরু করে চোয়ালচাপা দুর্বার চরিত্র, হলিউডে যাকে যে কোন চরিত্রে ভরসা করা হত, তার নাম রুথ এলিজাবেথ ডেভিস (১৯০৮-১৯৮৯)। সংক্ষেপে বেটি ডেভিস। বেটির ঝুলিতে প্রচুর সফল ছবি - অফ হিউম্যান বন্ডেজ (১৯৩৪), ডেঞ্জারাস (১৯৩৫), মার্কড ওম্যান (১৯৩৭), জেজেবেল (১৯৩৮), ডার্ক ভিক্টরি (১৯৩৯), দ্য লেটার (১৯৪০), দ্য লিটল ফক্সেস (১৯৪১), নাউ, ভয়েজার (১৯৪২), অল অ্যাবাউট ইভ (১৯৫০), দ্য স্টার (১৯৫২), হোয়াটেভার হ্যাপেনড টু বেবি জেন (১৯৬২), দ্য হোয়েলস অব অগস্ট (১৯৮৭) ইত্যাদি। জেজেবেল ছবির জন্য ১৯৩৮ সালে উনি দ্বিতীয় অস্কার পেয়েছিলেন এবং ১৯৩৮-৪২, পরপর পাঁচবার অস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিলেন। এখানে কিন্তু আমরা ওনার এই পাঁচটা ছবির কোনোটা নিয়েই আলোচনা করব না। ওনার প্রথম অস্কার পাওয়া ‘ডেঞ্জারাস’ নিয়েও নয়। আমরা দেখব ওনার অস্কার না  পাওয়া (এমনকি নমিনেশন-ও না পাওয়া) ‘অফ হিউম্যান বন্ডেজ’।

লেসলি হাওয়ার্ড ও বেটি অভিনীত এই সিনেমা থেকেই বেটি স্টার হয়ে ওঠেন। এখানে লেসলি এক ডাক্তারি ছাত্র এবং বেটি এক ওয়েট্রেস যার প্রতি লেসলি আকৃষ্ট কিন্তু বেটি তাকে পাত্তা দেয় না। লেসলি তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে সে প্রত্যাখ্যান করে। তার অন্য এক প্রেমিকের কাছে চলে যায়। কিন্তু কয়েক বছর পরে সে লেসলির কাছে গর্ভাবস্থায় ফিরে আসে ও আশ্রয় চায়। বাচ্চার জন্ম দেবার পরে সে সেই বাচ্চা এক নার্সের হাতে তুলে দিয়ে একজনের সাথে প্যারিস চলে যায়। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। লেসলি এরপর ডাক্তারি পড়া শেষ করে, কিন্তু বেটি তদ্দিনে টিবি-তে আক্রান্ত, তার বাচ্চা মারা গেছে। সমারসেট মমের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি সেই সময়ের ব্লকবাস্টার। 

ধরুন, আপনাকে যদি একটা সহজ প্রশ্ন করা হয়, বাংলা ছবিতে স্টাইল আইকন হিসেবে আপনি কাকে সবার ওপরে রাখবেন? এর উত্তর, মনে হয়, নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসবে যে অপর্ণা সেন। তেমনি বিশ্ব সিনেমায় কাউকে যদি  সত্যিকারের স্টাইল আইকন বলতে হয়, তিনি একজনই- অড্রে ক্যাথলিন হেপবার্ন রাস্টন (১৯২৯-১৯৯৩) বা অড্রে হেপবার্ন। ইনগ্রিড যেমন আমার ড্রিমগার্ল, তেমনি পৃথিবীতে এখনো অগণিত সিনেমাপ্রেমী ও সমালোচক  আছেন, যাদের ড্রিমগার্ল অড্রে। ভীষণ মিষ্টি চাউনি ও হাসি। জন্মসূত্রে বেলজিয়ান এই ব্রিটিশ অভিনেত্রীর বিখ্যাত ছবির তালিকাও বেশ বড়- রোমান হলিডে (১৯৫৩), সাব্রিনা (১৯৫৪), ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ (১৯৬১), শ্যারাড (১৯৬৩), মাই ফেয়ার লেডি (১৯৬৪), ওয়েট আনটিল ডার্ক (১৯৬৭),  রবিন অ্যান্ড মারিয়ন (১৯৭৬) ইত্যাদি। শেষ বয়সে উনি সিনেমা ছেড়ে দিয়ে আফ্রিকার গরীব দেশগুলোয় সেখানকার লোকেদের জন্য ইউনিসেফের অ্যাম্বাস্যাডর হিসেবে রয়ে গেছিলেন। উনিও ইনগ্রিডের মত কম বয়সেই অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারে মারা যান। অড্রের একটাই ছবি আমরা বেছে নেব যার জন্য উনি একসঙ্গে অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব ও বাফটা পেয়েছিলেন। গ্রেগরি পেকের সঙ্গে সেই বিখ্যাত রোমান্টিক ছবি ‘রোমান হলিডে’।

অ্যান, এক ইউরোপিয় রাজকুমারী, রোম ঘুরবে বলে এসেছে। কিন্তু সিকিওরিটির এত কড়াকড়ি যে বিরক্ত হয়ে সে পালিয়ে যায় এবং এক বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ে। এক তরুণ রিপোর্টার জো তাকে দেখতে পেয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। যদিও  জো জানত না সে আসলে কে। পরেরদিন জো নিজের অফিসে গিয়ে বুঝতে পারে নিজের ফ্ল্যাটে সে যাকে রেখে এসেছে, সে একজন রাজকুমারী। জো তার এক বন্ধুকে ভাড়া করে লুকিয়ে তার ও রাজকুমারীর ফটো তোলার জন্য। এবং সেই রাজকুমারী অ্যানকে নিয়ে এক ভেসপা স্কুটারে রোম ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। একদিনের রোমান্স ও ঘোরা। পরেরদিন অ্যান আবার নিজের জায়গায় ফিরে যায়, জো নিজের অফিসে। এবং প্রেস মিট করার সময় সে অ্যানের হাতে লুকিয়ে তোলা সব ফটো তুলে দিয়ে বলে সেগুলো সে ছাপেনি, সেগুলো নিয়ে অ্যান যা খুশি করতে পারে। দুর্দান্ত। অ্যানের ভূমিকায় অড্রে এবং জো-এর চরিত্রে গ্রেগরি পেক অনবদ্য। ফটোগ্রাফি সুন্দর, যার ভেতর দিয়ে গোটা রোম চেনা যায়। রোমান্টিক ছবি বললে আজো সবাই রোমান হলিডে-র উদাহরণ দেয়।

ডেম এলিজাবেথ রোজমন্ড টেলর (১৯৩২-২০১১), আমাদের সবার পরিচিত লিজ টেলর, পঞ্চাশের দশকে প্রোডাকশন হাউজের চুক্তিতে বিরক্ত হয়ে সিনেমা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই লিজ আবার ষাটের দশকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। লিজ বোল্ড রোলে অভিনয় করতে পছন্দ করতেন এবং ততোধিক রঙিন ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন – আটবার বিয়ে করেছিলেন। তার অভিনয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - ফাদার অব দ্য ব্রাইড (১৯৫০), এ প্লেস ইন দ্য সান (১৯৫১), জায়ান্ট (১৯৫৬), ক্যাট অন আ হট টিন রুফ (১৯৫৮), সাডেনলি, লাস্ট সামার (১৯৫৯), বাটারফিল্ড এইট (১৯৬০), ক্লিওপেট্রা (১৯৬৩), দ্য স্যান্ডপাইপার (১৯৬৫) এবং হু ইজ অ্যাফ্রেড অব ভার্জিনিয়া উল্‌ফ? (১৯৬৬)। এখানে লিজের ১৯৬৬ সালের এই ছবি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

জর্জ (রিচার্ড বার্টন) এবং মার্থা (লিজ টেলর) এক শিক্ষিত দম্পতি। জর্জ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং মার্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের মেয়ে। তাদের বাড়িতে তারা এক গভীর রাতের পার্টিতে আরেক অধ্যাপক দম্পতিকে ডাকে। সেই রাতের ঘটনা নিয়েই এই ছবি। মাঝরাতে মদ্যপ অবস্থায় জর্জ ও মার্থার ফাটাফাটি ঝগড়া, সেই ঝগড়ায় অতিথিদের যোগদান, সারারাত পার্টির পর শেষরাতে তাদের ছেড়ে আসা, এবং ভোরবেলা জর্জ ও মার্থার আবার হাত ধরে গান গেয়ে ওঠা – জীবনের এক বিশেষ দিক ফুটিয়ে তোলে। উপরি পাওনা লিজের কমেডি অভিনয়। এই ছবি ১৩টা অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল - অস্কারের যা যা বিভাগ হয়, সেই সবকটায়।

ভিভিয়ান হার্টলে (১৯১৩-১৯৬৭) জন্মেছিলেন দার্জিলিং-এর সেন্ট পল্‌স স্কুলে। পরে উনি লন্ডন চলে গিয়ে পড়াশোনা করেন এবং হারবার্ট লেই-কে বিয়ে করে ভিভিয়ান লেই হিসেবে পরিচিত হন। অবশ্য পরবর্তীকালে উনি লরেন্স অলিভিয়ার-কে বিয়ে করার পর লেডি অলিভিয়ার হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়েছিলেন। ভিভিয়ানের বিখ্যাত ছবিগুলো হল - ফায়ার ওভার ইংল্যান্ড (১৯৩৭), গন উইথ দ্য উইন্ড (১৯৩৯), আনা কারেনিনা (১৯৪৮), এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার (১৯৫১), দ্য ডিপ ব্লু সি (১৯৫৫) ও শিপ অব ফুলস (১৯৬৫)। ভিভিয়ান বিখ্যাত ছিলেন ওনার দুটো ছবির জন্য – গন উইথ দ্য উইন্ড এবং এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার। উনি পরিণত বয়সে একধরনের মানসিক সমস্যা ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’-এ ভুগতেন। এবং শেষ জীবনে টিবি হয়ে মাত্র ৫৩ বছর  বয়সেই মারা যান। ওনার ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ নিয়ে যেহেতু আমরা চার নম্বর  পর্বে আলোচনা করেছি, তাই আজ ওনার অন্য কোন ছবি নিয়ে লিখব না।

এইসব সোনালি দিনের বিখ্যাত হলি-নায়িকাদের পাশাপাশি যদি পৃথিবীর দিকে সার্চলাইটটা ঘোরাই, তাহলে এমন কিছু অতীত অভিনেত্রীদের ছবি ভেসে উঠবে যারা সেই সময়ে তাদের দেশে বা কখনো-সখনো হলিউডে রানির মতই রাজত্ব করেছেন। যেমন জার্মানির মার্লিন ডিট্রিচ, মেক্সিকোর ডোলোরেজ ডেল রিও, জাপানের সেতসুকো হারা, ফ্রান্সের জান মরো, ইতালির মোনিকা ভিটি, রাশিয়ার তাতিয়ানা সময়লোভা। এবং এদের বাইরেও আরো অনেকে।

মার্লিন ডিট্রিচ (১৯০১-১৯৯২) জার্মানিতে খ্যাতিলাভ করার পর হলিউডে পাড়ি দেন। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বেশ কয়েক দশক স্টেজ আর্টিস্ট হিসেবেই বেশি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। এমনকি স্টেজে উঠে উনি পিট সিগারের গানও গাইতেন। ওনার উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হল - দ্য ব্লু অ্যাঞ্জেল (১৯৩০), মরক্কো (১৯৩০), ডিজঅনার্ড (১৯৩১), সাংহাই এক্সপ্রেস (১৯৩২), দ্য স্কারলেট এমপ্রেস (১৯৩৪), ডেভিল ইজ আ ওম্যান (১৯৩৫), ডিজায়ার (১৯৩৬), স্টেজ ফ্রাইট (১৯৫০), উইটনেস ফর দ্য প্রসিকিউশন (১৯৫৭), টাচ অব এভিল (১৯৫৮) ও জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ (১৯৬১)। যেহেতু ওনাকে আমি জার্মানির তারকা হিসেবে দেখিয়েছি, অতএব এখানে ওনার জার্মান ছবি ‘দ্য ব্লু অ্যাঞ্জেল’ নিয়ে লিখব।

‘ব্লু অ্যাঞ্জেল’ ডান্সবারের ক্যাবারে ডান্সার লোলা-র (মার্লিন) প্রেমে পড়েন স্থানীয়  এক শিক্ষক রাথ। শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে লোলার জন্য একসময় তিনি এক সার্কাসের জোকার হিসেব নাম লেখান। লোলাকে কাজের খাতিরে অনেকের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হত, যেটা নিয়ে রাথ আরো রেগে উঠতে থাকেন। কোন এক রাত্রে রাথ কয়েকজনের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। তাকে আটকে রাখা হয়। ছাড়া পাবার পর উনি সেই ক্লাসরুমে এসে আত্মহত্যা করেন যেখানে উনি একসময় বহুবছর শিক্ষকতা করতেন। এই সিনেমায় মার্লিনের ক্যাবারে এতই খ্যাতি পেয়েছিল যে উনি হলিউড থেকে একে একে প্রস্তাব পেতে শুরু করেন। ওনাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 

মারিয়া দে লো ডোলোরেজ আসুনসোলো লোপেজ নেগ্রেতে (১৯০৪-১৯৮৩), সংক্ষেপে ডোলোরেজ ডেল রিও ছিলেন হলিউডের প্রাক স্বর্ণযুগের প্রথম লাতিন  আমেরিকান স্টার যিনি মেক্সিকো ও হলিউড, দু’জায়গাতেই রাজত্ব করেছেন।  তার মনে রাখার মত ছবিগুলো হল - রিসারেকশন (১৯২৭), রামোনা (১৯২৮), ইভাঞ্জেলিন (১৯২৯), বার্ড অব প্যারাডাইজ (১৯৩২), ফ্লাইং ডাউন টু রিও (১৯৩৩), মাদাম দু’বেরি (১৯৩৪), মারিয়া ক্যান্ডেলারিয়া (১৯৪৩), দ্য  অ্যাবানডান্ড (১৯৪৫), দ্য ফিউজিটিভ (১৯৪৭), ডোনা পারফক্টা (১৯৫১) ইত্যাদি। এছাড়াও উনি থিয়েটার ও টিভি সিরিজেও চুটিয়ে অভিনয় করতেন। স্বীকার করে নিই যে আমি ওনার মাত্র দুটো ছবি দেখেছি। তার ভেতর যেটা বেশি ভাল লেগেছিল, ‘দ্য অ্যাবানডান্ড’, সেটা নিয়েই লিখি।

এই ছবিতে ডেলোরেজ এক অসহায় কুমারী মা যার প্রেমিক তাকে ছেড়ে অন্য এক মহিলার সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে। নিজের সন্তানকে আগলে রাখা ও মানুষ করার সাথে সাথে সে বিশ শতকের শুরুর দিকে মেক্সিকোর রক্ষণশীল সমাজের  খোঁচা, ঝড়-ঝাপ্টা ও অত্যাচার চোয়াল চেপে সহ্য করে চলেছে। থিম সাদামাটা, কিন্তু ডেলোরেজের আপরাইট অভিনয় এখানে চোখে পড়ার মত।  

সেতসুকো হারা (১৯২০-২০১৫) ছিলেন ৬৭টা ছবিতে অভিনয় করা জাপানের মেনস্ট্রিম ছবির এক নম্বর নায়িকা যখন উনি ১৯৪৯ সালে ওজু-র ‘লেট স্প্রিং ছবিতে অভিনয় করেন এবং গোটা পৃথিবীর নজরে আসেন। এ যেন অনেকটা উত্তমকুমার ও সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার মত! ওনার উল্লেখযোগ্য  ছবিগুলো – লেট স্প্রিং (১৯৪৯), ব্লু মাউন্টেন রেঞ্জ (১৯৪৯), আর্লি সামার (১৯৫১), টোকিও স্টোরি (১৯৫৩), টোকিও টুইলাইট (১৯৫৭), দ্য ইডিয়ট (১৯৫৮), লেট অটাম (১৯৬০), দ্য এন্ড অব সামার (১৯৬১) ইত্যাদি। সেতসুকোর সঙ্গে সেই সময়ের হিরো তোশিরো মিফুনের (আগের পর্বে যাকে নিয়ে লিখেছিলাম) বেশ কয়েকটা ছবি আছে, যার ভেতর উল্লেখযোগ্য হল ‘দ্য ইডিয়ট’। মনে রাখার মত কমেডি। সেতসুকোর প্রধান গুণ ছিল ওনার নিখুঁত  অভিনয়, যে কারণে ওজুর মত খুঁতখুঁতে পরিচালকও সেতসুকোর প্রশংসা  করতেন। ওজু লিখেছিলেন – ‘In fact, without flattery, I think she is the best Japanese film actress’। বিয়ে করেননি বলে জাপানে ওনাকে ‘the eternal virgin’ নামে ডাকা হয়। প্রায় ১০০র ওপর ছবিতে অভিনয় করেছেন। অদ্ভুতভাবে ১৯৬২ সালে ‘স্টোরি অব ফ্লাওয়ার, স্টোরি অব স্নো’ ছবিতে  অভিনয়ের পর আমৃত্যু সেতসুকো নিজেকে গোটা বিশ্ব থেকে গুটিয়ে নেন। আজ ওনার কোন ছবি নিয়েই লিখব না।

জান মরো (১৯২৮-২০১৭) এমন এক নায়িকা যিনি ত্রুফো-র ‘400 ব্লোজ’-এ  এক ছোট্ট রোলে ছিলেন, এমনকি গোদারের ‘এ ওম্যান ইজ আ ওম্যান’ ছবিতেও একটা সিনে, কিন্তু আমরা কেউ তাকে লক্ষ্য করিনি। আমরা তার অভিনয় দেখে চুপ হয়ে গেছি ‘সেভেন ডেজ...সেভেন নাইটস’ ছবিতে, তারিফ করেছি অ্যান্তনিয়নির ‘দ্য নাইট’ ছবিতে তার চরিত্র এবং মুগ্ধ হয়ে গেছি ত্রুফোর  ‘জুলস অ্যান্ড জিম’ আর ওয়েলেসের ‘দ্য ট্রায়াল’ ছবিতে তাকে দেখে। এই হলেন  ফ্রেঞ্চ নায়িকা জান মরো, অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতেন, ছোট-বড় রোল দেখতেন না। ফ্রান্সের থিয়েটার থেকে উঠে আসা নায়িকাকে নিয়ে অরসন ওয়েলেস বলেছিলেন ‘the greatest actress in the world’। মরোর মনে রাখার মত সিনেমা বললে যে নামগুলো আসবে - এলিভেটর টু দ্য গ্যালোজ (১৯৫৮), দ্য লাভার্স (১৯৫৮), সেভেন ডেজ...সেভেন নাইটস (১৯৬০), দ্য নাইট (১৯৬১), জুলস অ্যান্ড জিম (১৯৬২), দ্য ট্রায়াল (১৯৬২), দ্য ট্রেন (১৯৬৪), ভিভা মারিয়া (১৯৬৫), দ্য ওল্ড লেডি হু ওয়াকড ইন দ্য সি (১৯৯২)।

মরোর যে কোন সিনেমা নিয়েই লেখা যায়, কিন্তু আজ ওনার নব্য-বাস্তব ছবি ‘জুলস অ্যান্ড জিম’ নিয়ে কিছু বলা দরকার। এই ছবি শুধু যে ত্রুফোর অন্যতম  সেরা ছবি, তা নয়, এই ছবি ফ্রান্সের নব্য-বাস্তবতার এক সাহসী দলিল। এক ত্রিকোণ ভালবাসা, যার দু’দিকে এক বোহেমিয়ান জিম ও লাজুক লেখক জুলস,  এবং অন্যদিকে এদের দুজনের বান্ধবী ক্যাথরিন (জান মরো), যে পরবর্তীকালে জুলসের স্ত্রী হয়ে ওঠে। এরমধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় এবং জিম ও জুলস আলাদা দলের হয়ে লড়তে চলে যায়। যুদ্ধশেষে জিম তাদের কাছে ফিরে আসে। তদ্দিনে ক্যাথরিন ও জুলসের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের এক ছোট্ট মেয়ে আছে। জিমকে দেখে ক্যাথরিন তার সঙ্গে থাকতে চায়। স্ত্রী ও সন্তানকে হারানোর ভয়ে জুলস তাতেই রাজী হয়ে যায়। যদিও জিম তাদের ছেড়ে চলে যায়। আবারো। এবং আবারো। এই ছবির প্রতি সিনে ত্রুফো চমক আর উৎকন্ঠা লুকিয়ে রেখেছেন। সেটা নিজে দেখুন। ভাল লাগবে। 

মোনিকা ভিটি (১৯৩১-২০২২)-কে বলা হয় ‘কুইন অব ইতালিয়ান সিনেমা’।  বিশেষ করে মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্তনিয়নির ছবি বললেই যেন মোনিকার নাম ভেসে ওঠে। অবশ্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মোনিকা আরেক পরিচালক মারসেলো মোনিসেলি-র কমেডি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ওনার সফল ছবিগুলোর মধ্যে - দ্য অ্যাডভেঞ্চার (১৯৬০), দ্য নাইট (১৯৬১), দ্য একলিপ্স (১৯৬২), সুইট অ্যান্ড সাওয়ার (১৯৬৩), রেড ডেসার্ট (১৯৬৪), দ্য গার্ল উইথ আ পিস্তল (১৯৬৮) এবং জেলাসি, ইতালিয়ান স্টাইল (১৯৭০)। তবে হ্যাঁ, যেটা বলতেই হয়, উনি সুযোগ পেয়েও হলিউড যাননি দুটো কারণে। এক, উনি দীর্ঘ  আকাশযাত্রা পছন্দ করতেন না। দুই, উনি মনে করতেন ওনার ইংরাজি কথায় কিছু সমস্যা আছে। ফলে উনি সারাজীবন ইতালিতেই থেকেছেন ও সিনেমা করেছেন। এবং আমি এটা স্বীকার করে নিই যে সমালোচক হিসেবে কিন্তু আমার কোথাও কোথাও মনে হয়েছে যে ওনার অভিনয় স্টিফ। যাইহোক, ২০০২ সালে ওনার অ্যালঝেইমার ধরা পরে, সেই থেকে উনি গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং এ’বছরের গোড়ায় উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেড ডেসার্ট নিয়ে  আমি আগেই আলোচনা করেছি, সুতরাং আজ আর মোনিকা-র অন্য ছবি নিয়ে কিছু বলব না।

তাতিয়ানা সময়লোভা (১৯৩৪-২০১৪) প্রথম যে সিনেমা করেছিলেন, যা করে উনি সারা পৃথিবীর নজরে চলে আসেন, সেই ছবির নাম ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’।  এই ছবির জন্য কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ওনাকে বলা হয়েছিল ‘most modest and charming actress’। হলিউড থেকে অনেক অফার এসেছিল। কিন্তু ওনার দুর্ভাগ্য, তৎকালীন সোভিয়েত সরকার ওনাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। উনি এরপর রাশিয়াতেই ছবি করার দিকে মন দেন। ওনার বিখ্যাত ছবিগুলো – দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং (১৯৫৭), আনা কারেনিনা (১৯৬৭), লেটার নেভার সেন্ট  (১৯৬০), আলবা রেজিয়া (১৯৬১), অ্যাটাক অ্যান্ড রিট্রিট (১৯৬৪) ইত্যাদি। খুব বেশি ছবিতে উনি অভিনয় করেননি। যদিও ওনাকে রাশিয়াতে ড্রিমগার্ল হিসেবেই দেখা হত। এবং ষাটের দশকের পর উনি হঠাৎ ছায়াছবি জগৎ থেকে এবং লোকচক্ষু থেকে উধাও হয়ে যান। আবার ওনাকে দেখা যায় বহু বছর পর, নয়ের দশকে। ১৯৯৩ সালে ওনাকে ‘পিপল’স আর্টিস্ট অব রাশিয়া’ উপাধি দেওয়া হয়। এবং ২০০৭এ মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’  পুরস্কার। ওনার ছবি নিয়েও আজ কিছুই লিখব না কারণ ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’  নিয়ে আমি পরে একদিন বলব। 

তাহলে স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেত্রীদের নিয়ে আজ এই অব্ধিই। এদের সবার আত্মা শান্তিতে থাকুক। কিন্তু একটা রহস্য আমার কাছে আজো রয়ে গেল। গ্রেটা গার্বো (১৯০৫-১৯৯০), সেতসুকো হারা, সুচিত্রা সেন (১৯৩১-২০১৪), তাতিয়ানা সময়লোভা... নিজের সময়ে যারা তাদের জগতে সিনেমার মহারানী ছিলেন, তারা একে একে হঠাৎ কেন নিজেদের গোটা পৃথিবী থেকে গুটিয়ে নিয়ে আড়ালে চলে গেছিলেন? কী কারণে?

(ক্রমশ)

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি : তৃতীয় পর্ব




১৯৬৪-তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি দেখেছিলাম। সেই যে প্রতি বছর জুলাই মাসে ‘রেক্টর দিবস’ উপলক্ষে আমাদের সেন্ট জেভিয়ার্সে নিয়ে গিয়ে ছবি দেখানো হতো। প্রথম শ্রেণীতে দেখেছিলাম Magic Boy, যে কথা প্রথম কিস্তিতেই বলেছি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে দেখলাম ১৯৬১ সালের The Absent-minded Professor,[1] আমার প্রথম ওয়াল্ট ডিজনি-ছবি! আমার সারা জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছবি Mary Poppins এই ভদ্রলোকের প্রযোজনা-সংস্থা থেকেই বেরোবে ঠিক এই ১৯৬৪ বছরেই, যদিও এই দেশে সেটি আসবে আরো চারবছর পর! কিন্তু এই প্রথম-দেখা ছবিটি কিছুই বুঝিনি এবং একেবারেই ভাল লাগেনি! পরে অবশ্য দেখে উড়ন্ত মোটর গাড়ির গল্প উপভোগই করেছি। এই ব্যাপারটি পরে এই ১৯৬৪-র কিশোরকুমার-অভিনীত হিন্দী ছবি Mr X in Bombay-তে টুকে বসানো হয়েছিল।[2] অনেক পরে আরেক ম্যাজিক মোটর গাড়ির ছবি আমায় অভিভূত করবে – তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে ১৯৭০-এর বড়দিনের ছুটি অবধি!

এরপর বাবা আমাদের নিয়ে নিয়মত ছবি দেখা শুরু করলেন। ১৯৬৪/৬৫-তে নিউ এম্পায়ারে, সম্ভবত ম্যাটিনি শোয়ে দেখা হল ‘থ্রী মাস্কেটিয়ার্স’-খ্যাত পোর্থস ও তার কনিষ্ঠ সাগরেদ D’Artagnan-এর নতুন কীর্তি, ১৯৬২ সালের ছবি, The Secret Mark of D’Artagnan, যার ঘটনাকাল এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস থ্রী মাস্কেটিয়ার্স এবং দ্বিতীয় উপন্যাস টোয়েন্টি ইয়ার্স আফটার-এর মধ্যবর্তী সময়ে। প্রথম উপন্যাসে চার নায়কের প্রতিপক্ষ কার্ডিনাল রিশলু এই ছবিতে পোর্থস আর D’Artagnan-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজা ত্রয়োদশ লুইকে সিংহাসন-চ্যুত করার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করছেন। খলনায়কদের D’Artagnan চিহ্নিত করবে তরোয়াল-যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করে তার নিজের তরবারি দিয়ে তাদের প্রত্যেকের কপালে x এঁকে দিয়ে। এটাই তার secret mark। মূল খলনায়ককে খুবই হিংস্র লেগেছিল। নায়িকা তার বিরোধিতা করাতে সে মহিলার একটি হাতের চেটো লোহার যন্ত্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়! কিন্তু সেই একের পর এক অস্বস্তিকর চুম্বন দৃশ্য! মা’ বুঝিয়ে বললেন, “আহা, D’Artagnan কত বীর, মেয়েটিকে কতভাবে সাহায্য করছে, তাই আর কি!”

অবশেষে আবার মেট্রোতে! পুরনো দিনের হাসির ছবি থেকে দৃশ্য নিয়ে ১৯৬৪ সালের সঙ্কলন The Big Parade of Comedy। প্রথমেই এক কাণ্ড ঘটালাম আমি! গাড়ি থেকে দেখছি মেট্রোর ঢোকবার মুখে লেখা রয়েছে, আমার চোখে,  NO SHOWING! সেটা উচ্চকণ্ঠে বলতে বাবা তো চমকে উঠলেন, “সে কি!” তারপর আমাকে বললেন, “ভালো করে দেখোঃ N O W মানে NOW SHOWING! ভেবেছিলাম শো বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে!” হলে ঢুকে আবার নতুন চমক! দেখি পর্দা দু-দিকে ভাগ হয়ে সরে না গিয়ে সম্পূর্ণভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে! অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠতে দাদা আমায় নিরস্ত করেন। অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কৌতুক অভিনয়ের এই সমাহারে আমার মনে আছে যে দুজন আমার সবচেয়ে প্রিয় জুটি হয়ে উঠবেন, সেই লরেল-হার্ডি, আর The Three Stooges-দের।

এইরকম সময়েই পূর্ণতে পুনর্মুক্তি পায় চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত ছবি The Kid (১৯২১), সম্ভবত আমার দেখা একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘের নির্বাক ছবি। এর সঙ্গে দেখানো হচ্ছিল লরেল-হার্ডির স্বল্পদৈর্ঘের, কিন্তু সবাক, The Chimp (১৯৩২)। মনে নেই এই যুগলকে পূর্ণতে প্রথম দেখেছিলাম না মেট্রোতে। কিছুদিন পরে দাদার সঙ্গে সিনেমা দেখার অভ্যস্ত এলাকা ছেড়ে জীবনে প্রথম শেয়ালদায় যাই আরেক ঐতিহ্যশালী প্রেক্ষাগৃহ প্রাচীতে চ্যাপলিনের The Gold Rush (১৯২৫)-এর সবাক ভার্সান দেখতে। মা’র স্মৃতিচারণ অনুযায়ী সময় ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাস।

এরপর আসব একটি বিশেষ প্রেক্ষাগৃহের প্রসঙ্গে। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে কলকাতায় ৭০ মিমি প্রোজেকসানে ছবি দেখার প্রেক্ষাগৃহ একটাই ছিল। তখনকার ‘ধর্মতলা স্ট্রীট’, এখনকার লেনিন সরণীতে ‘জ্যোতি’। এখানে মূলত হিন্দী ছবিই আসত, শুধু, সাধারণত মেট্রোতেই আসার কথা (কারণ ‘মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়র’ প্রযোজিত) কোন ছবির প্রকাণ্ড পর্দা প্রয়োজন হলে, সেই ছবি মুক্তি পেত জ্যোতিতে। জ্যোতিতে এর আগে যখন হিন্দী ছবি দেখেছি, দাদা দেখিয়েছিলেন কিভাবে সাদা স্ক্রীন-ঢাকা ধূসর পর্দা পুরোপুরি দু-দিকে সরে যাচ্ছে না, অর্ধেক সরছে, কারণ হিন্দী ছবি, বাংলার মতই, ৩৫ মিমি প্রোজেকসানেই দেখানো হত (প্রথম ৭০ মিমি হিন্দী ছবি হয় ১৯৬৭ সালে)।

পর্দা পুরো সরে গেল ১৯৬৪/৬৫-তে, যে ছবির ট্রেলর দেখেছিলাম মেট্রোতে, তার জন্যঃ তিনজন স্বনামধন্য পরিচালকের (জন ফোর্ড, হেনরি হ্যাথাওয়ে, জর্জ মার্শাল) তৈরী ১৯৬২-র ছবি How the West was Won, যাতে একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিম আমেরিকার ইতিহাস। প্রথমে পর্দা সরে গিয়েও হল অন্ধকার রেখে কিছুক্ষণ ধরে শোনানো হলো ছবির গান ও আবহ সঙ্গীত। এরপর তারকা-খচিত মূল ছবি। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম খরস্রোতা নদীতে পড়ে হারিয়ে গেল বাবা (অভিনয়ে কার্ল মালডেন)-মা কে নিয়ে প্রেসকট পরিবারের প্রথম প্রজন্মের ভেলা। দুই বোন দ্বিতীয় প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে চলল, বড় বোন ইভ (অভিনয়ে ক্যারল বেকার) ভালোবাসার মানুষ লিনাস রলিংস (জেমস স্টুয়ার্ট)-কে - যে তাদের সবাইকে (বাবা-মাকে নদী তখনো গ্রাস করে নি) রক্ষা করেছিল একদল খুনে ডাকাতদলের হাত থেকে - বিয়ে করে সংসার পাতে। ছোটবোন লিলিথ (ডেবি রেনল্ডস) ভাল গান গায়, তার অন্য উচ্চাশা আছে, সে সেইদিকেই পা বাড়ালো। তাকে যে পছন্দ করল (গ্রেগরি পেক) তার সঙ্গে ছোটবোন লিলিথ এগিয়ে চলল পশ্চিমের অভ্যন্তরে একটি বৃহৎ দলের সঙ্গে, যাদের ওপর নেমে এল আমেরিকার আদি বাসিন্দা লাল মানুষদের আক্রমণ। তৃতীয় প্রজন্মে, বড় বোন ইভের বড় ছেলে জেব (জর্জ পেপার্ড) যোগ দিল গৃহযুদ্ধে, দাসপ্রথা বিলুপ্তির পক্ষে, এব্রাহাম লিঙ্কনের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে তার পরিচয় হল বিপক্ষের এক সমবয়সীর সঙ্গে, যার পিস্তলের গুলি থেকে কথোপকথনরত জেনারেল শার্মানকে (জন ওয়েন) রক্ষা করতে গিয়ে জেব তাকে হত্যা করতে বাধ্য হল। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জেব বাড়ি  ফিরে দেখে শান্ত প্রকৃতির ছোট ভাই চাষবাস চালাচ্ছে, কিন্তু অনেকদিন আগে প্রয়াত বাবার কবরের পাশে আরেকটি সমাধি – তার মা ইভের! আবার প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে জেব এবার যোগ দিল গঠনমূলক কাজের রক্ষণাবেক্ষণেঃ পশ্চিম আমেরিকার বুকের ওপর দিয়ে তৈরী হচ্ছে সুদীর্ঘ রেলপথ। কিন্তু সেই রেলপথ ব্যবহার করে হানা দিচ্ছে শ্বেতাঙ্গ মোষ-শিকারীর দল, লাল মানুষদের অন্যতম খাদ্যের উৎসে ভাগ বসাতে। এর জবাবে লাল মানুষরা নির্মীয়মাণ রেললাইনের ওপর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে ক্ষ্যাপা মোষদের দল। দম-আটকে যাওয়া দৃশ্য! তাদের পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাবে অনেকে, তার মধ্যে এক শিশুর বাবা-মা। কেঁদে-কেঁদে বাচ্চাটি ছুটে বেড়াবে রেললাইনের চারদিকে। তাই দেখে মুহ্যমান জেবকে রেলপথ তৈরির কর্তা মাইক কিং (রিচার্ড উইডমার্ক) বলবেন, “এটা শেষ নয়, এটা নতুন জীবনের সূচনা!” আর ঠিক সেই মুহূর্তে অসহায় শিশুটিকে বুকে তুলে নেবেন আরেক মহিলা!

জেব অবশেষে বিয়ে করে সংসার পাতবে। সেখানে এসে পৌঁছবেন তার সেই মাসীমা লিলিথ। ছবির অন্তিম অংশে জেবের সঙ্গে টক্কর দেবে একদল রেল-ডাকাত, চলন্ত রেলগাড়ী আক্রমণ করে। সবশেষে ভাষ্যকার স্পেন্সার ট্রেসী বর্ণনা দেবেন আধুনিক পশ্চিম আমেরিকার, বর্তমানের দৃশ্যসহ, যা সম্ভব করেছিল এই প্রেস্কট-রলিংসদের মতো পথিকৃৎ পরিবারসমূহ।

৬৪ সালে ‘হাটারি’তে মন কেড়েছিলেন জন ওয়েন ও দুটি গণ্ডার। এখানেও জন ওয়েন, যদিও একেবারেই অতিথি শিল্পী হিসেবে কয়েক মিনিটের একটি দৃশ্যে, আর একপাল ক্ষ্যাপা মোষ! ছোট পিসেমশাই বললেন, “তা এখন অবধি তোমার সবচেয়ে ভালো-লাগা ছবি তো ‘হাটারি’ই?” ছিটকে উঠে উত্তর দিলাম, “আরে দূর! কোথায় লাগে ‘হাটারি’ এর কাছে!” How the West was Won বড় পর্দায় আরও ২ বার দেখব। প্রথমবার সঙ্গে ছিলেন দাদা। ৭০-এর দশকে ঐ জ্যোতিতেই ছবিটি পুনর্মুক্তি পায়, দেখি বাবা, মা, আর এক খুড়তুতো দাদাকে নিয়ে। সবাইয়েরই খুব ভাল লাগে। কয়েক বছর পরে আবার মিনার্ভায় (পরে ‘চ্যাপলিন’) ছবিটি এলে বাবাই আমাকে আর মা’কে নিয়ে আবার যান। তবে মিনার্ভায় ছিল ৩৫ মিমির ‘সিনেমাস্কোপ’ প্রোজেকশান।

জ্যোতিতে এরপর মূলত ৭০ মিমির ইংরেজী ছবিই দেখেছি। ১৯৬৫/৬৬-তে ডেভিড লীনের Lawrence of Arabia (১৯৬২), সঙ্গে বাবা , মা, আর দাদা (দাদা ইতিমধ্যে বোধহয় ছবিটি একবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখে নিয়েছিলেন)। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কালের এক কিংবদন্তী চরিত্রকে নিয়ে ছবি, তবে ঐ ৮/৯ বছর বয়সে যুদ্ধের রূঢ় নৃশংসতা নিতে পারি নি, ছবি শেষের দিকে এগোচ্ছে বুঝে মনে-মনে স্বস্তি উপলব্ধি করেছিলাম। এরপর ১৯৬৭ মধ্যযুগের জার্মান মহাকাব্য Nibelungenlied অবলম্বনে Whom the Gods wish to Destroy (ছবিটি ২ পর্যায়ে জার্মান ভাষায় ১৯৬৬-৬৭-তে তৈরী হয়ে ইংরেজীতে কিছুটা সংক্ষেপিত করে ‘ডাব’ করা হয়)। ড্রাগন-বধকারী মহাবীর সীগফ্রীডের কীর্তি, এবং তারপর তাঁর বিধবা স্ত্রী ক্রীমহীল্ডের স্বামীর হত্যাকারী এবং ক্রীমহীল্ডের ভাই, বার্গান্ডির রাজা গুন্থেরের অনুগত হাগেনের ওপর নির্মম প্রতিশোধের বিয়োগান্ত গাথা, যে প্রতিহিংসার আগুন থেকে রক্ষা পান না ক্রীমহীল্ডের ভাইও! উত্তর ইউরোপের পৌরাণিক চরিত্রগুলির পাশাপাশি ক্রীমহীল্ডের দ্বিতীয় স্বামীর চরিত্রে আছেন ইতিহাসের অ্যাটিলা, হূনদের রাজা। ছবিটি দেখতে আমার সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল বাড়ির অবাঙালী কাজের লোককে।

১৯৬৮-তে পুনর্মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালের The Bridge on the River Kwai। জ্যোতিতে সপরিবারে যাওয়া হলো। চমকে উঠে দেখলাম যে পর্দা আর দু-দিকে ভাগ হয়ে সরছে না, মেট্রোর মতো সবটাই ওপরে উঠে যাচ্ছে। ছবিটি তো একেবারে সীটের ধারে এগিয়ে বসে দেখার মতো। স্যর অ্যালেক গিনেসের অভিনয় প্রশংসার অনেক ঊর্দ্ধে। তাঁর কর্নেল নিকলসন এবং তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা সেতুটি, মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম, মিত্রপক্ষের সৈন্যরা যেন ভাঙতে না পারে!

১৯৬৯-এ নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অ্যাল্ড্রিন অ্যাপোলো ১১-য় পাড়ি দিয়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখার কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যোতিতে দেখি দুর্বোধ্য কিন্তু পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে না দেওয়া 2001: A Space Odyssey। ভিন-গ্রহের মানুষ দেখার আশা কিন্তু মেটে নি! সে সাধ পূরণ করলো ঐ একই বছরে পূর্ণ সিনেমা! রবিবার সকালে নিয়ে এল ১৯৬৪ সালের ছবি, এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাস অবলম্বনে First Men in the Moon। বাবা সঙ্গে গিয়েছিলাম, চমৎকৃত হয়েছিলাম। Dynamation – Miracle of the Screen-এ তোলা এই ছবিতে শুধু চাঁদের মানুষই দেখলাম না, ছিল প্রকাণ্ড শুঁয়োপোকা!

এর পর সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ/আশির দশকের গোড়ায় জ্যোতিতে দেখতে পেলাম স্পিলবার্গের ১৯৭৭ সালে আমেরিকায় মুক্তিপ্রাপ্ত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী Close Encounters of the Third Kind। এতদিনে আমার সিনেমা দেখার সঙ্গী হয়েছেন আমার মা। কিছুদিন আগেই এই জ্যোতিতেই তাঁর সঙ্গে দেখতে এসেছিলাম  আরব্য রজনীর গল্পের নাবিক সিন্দবাদকে নিয়ে ছবি, ঐ ১৯৭৭ সালের Sinbad and the Eye of the Tiger। ছবিটি ৭০ মিমির ছিল না, যদিও রে হ্যারিহাউজেনের সৃষ্ট special effects ছিল দেখার মতো, যার মধ্যে ছিল একটি প্রাগৈতিহাসিক খাঁড়া-দেঁতো বাঘ, গ্রীক পুরাণ থেকে মোষের  আর মানুষের দেহ নিয়ে ‘মিনোটর’, প্রকাণ্ড সিন্ধুঘোটক প্রভৃতি। সিন্দবাদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমার অতিপ্রিয় জন ওয়েনের পুত্র প্যাট্রিক ওয়েন। তখনই স্পিলবার্গের ছবির ট্রেলর দেখানো হয়েছিলআর আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ছবিটি এলেই দেখব। স্পিলবার্গ ছবির শেষ অবধি অপেক্ষা করিয়ে কিন্তু নিরাশ করেন নি। অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে যে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে গিয়েছিল, তাকে, এবং অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের ফিরিয়ে দিয়ে সাদরে ডেকে নিল কাহিনীর অন্যতম মুখ্য চরিত্র নেরিকে (অভিনয়ে রিচার্ড ড্রেফুস)। ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে ছবিটিতে একাধিক আছে এবং শিশুদের এমন অসাধারণ অভিনয় – অভিনয় বলে মনেই হয় না – ওয়াল্ট ডিজনির ছবির বাইরে খুব একটা দেখা যায় না। তবে স্পিলবার্গের বেশ কিছু ছবি ডিজনিকে মনে করায়, যেমন ১৯৮২ সালের E. T. the Extra-Terrestrial।

স্পিলবার্গ একাধিকবার গ্রহান্তরের জীবদের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দের গল্প চিত্রায়িত করেছেন। এর বিপরীত ধারার গল্প, যা হয়তো শুরু হয় ঔপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলসের The War of the Worlds (১৮৯৭)-এ মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের পৃথিবী-আক্রমণ দিয়ে, দেখলাম ঐ জ্যোতিতে, ১৯৮৯ সালের Alien-এ। মহাশূন্যে যাত্রা করতে-করতে মহাকাশযান ‘নস্ট্রোমো’ অবতরণ করে একটি উপগ্রহে। এখানে এক পরক মহাকাশযানের মধ্যে তারা পায় পরপর ডিম্বাকৃতি বস্তু। এই ডিম থেকেই তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে এক হিংস্র জীব, যার পরবর্তীকালে নামকরণ হয়েছে Xenomorph। হাড়-হিম করা, দম-বন্ধ করা ছবি, যার পোস্টারে লেখা ছিলঃ ‘মহাশূন্যে কেউ তোমার আর্তনাদ শুনতে পাবে না!’

এই ছবির আগেই আরেকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীচিত্রের ট্রেলর দেখানো হয়েছিলঃ ডিজনি সংস্থার The Black Hole (১৯৭৯) । সেটিও যথাসময়ে জ্যোতিতে মুক্তি পায়, এবং মা আর আমি, আগের দুটি কল্পবিজ্ঞান ছবির মতো সেটিও দেখি। ছবির সবচেয়ে বড় চমক কাহিনীর শীর্ষবিন্দুতে মহাকাশযানে করে মূল চরিত্রের কয়েকজনের কৃষ্ণ গহ্বর অতিক্রম করে এক শ্বেত গহ্বর দিয়ে কোন এক নতুন বিশ্বে বেরিয়ে আসা। অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন Psycho-(কু?)খ্যাত অ্যান্টনি পার্কিন্স!

৭০ মিমির বিদেশী ছবি জ্যোতিতে আর একটিই দেখেছি বলে মনে পড়ছে। স্নাত্তকোত্তর শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৭৯/৮০ সালে অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যের কথা শুনে – তিনি শেক্সপীয়রের ‘রাজা লিয়ার’ পড়াতেন – রাশিয়ান ভাষায় ‘ডাক্তার জিভাগো’-খ্যাত বরিস প্যাস্টারন্যাকের অনুবাদ-আধারিত কোজিন্টসেভ পরিচালিত ১৯৭১ সালে তৈরী King Lear। এ ছিল আক্ষরিক অর্থে ‘জ্যোতির নির্দেশে জ্যোতির্গমন’! নিজেকে কখনই চলচ্চিত্রের ‘বোদ্ধা’ দর্শকদের দলে ফেলি নি, তাই বলতে দ্বিধা নেই যে নমস্য অধ্যাপকের প্রশংসা সত্বেও আমি আজও মনে করি যে শেক্সপীয়রের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত নাটক কলেজ স্ট্রীটের শ্রেণীকক্ষে যেভাবে তিনি জীবন্ত করে তুলতেন, উক্ত ছবি, আমার ক্ষেত্রে, তা করতে পারেনি!

জ্যোতিতে আর যেসব বিদেশী ছবি দেখেছি, সবই ৩৫ মিমির। সত্তর দশকের গোড়ায় দাদা এবং হবু-বৌদির সঙ্গে দেখি লরেল-হার্ডির দমফাটা হাসির ছবি, ১৯৩৩ সালের Sons of the Desert, ও তার সঙ্গে ঐ জুটিরই স্বল্প-দৈর্ঘের Another Fine Mess (১৯৩০)। মা’র সঙ্গে দেখেছি কবীর বেদী, রডি ম্যাকডাওয়েল, পীটার ইউস্টিনভ, ও টেরেন্স স্ট্যাম্প অভিনীত রূপকথা The Thief of Baghdad (১৯৭৮)। আর সবশেষে, ১৯৮৮ সালে বিদেশ থেকে ফিরে একদিন ধর্মতলা অঞ্চলে ঘুরতে-ঘুরতে দেখা হয়ে গেল বয়ঃজ্যেষ্ঠা এক ইংরেজীর অধ্যাপিকার সঙ্গে। তাঁকে রাজী করালাম আমার সঙ্গে জ্যোতিতে ঢুকে জন মাল্কোভিচ, মিশেল ফেইফার, ও গ্লেন ক্লোজ অভিনীত ১৯৮৮ সালের Dangerous Liaisons ছবিটি দেখতে। এটি ১৭৮২ সালে Pierre Choderlos de Laclos রচিত ফরাসী উপন্যাস থেকে ১৯৮৫ সালের ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন-কৃত নাট্যরূপের চলচ্চিত্রায়ণ। বিলেতে থাকাকালীন এর নাট্যাভিনয়ের টিকিট পাওয়া ছিল দুষ্কর।

অন্তর্জালে জ্যোতির ছবি খুঁজতে গিয়ে দেখি সিনেমা হলটি নাকি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একি কলকাতার জ্যোতি না অন্য কোন শহরে ঐ নামের কোন প্রেক্ষাগৃহ? চন্দননগরেই তো এককালে ‘জ্যোতি’ নামের সিনেমা হল ছিল!

 



[1] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=29108868

[2] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=59481381


শিবাংশু দে

 

সুনীল গাঙ্গুলি ভেবেছে সারারাত




দশ বছর আগে। তখন থাকতুম ভুবনেশ্বরে। পুজোর ঠিক আগে যাচ্ছিলুম বনারস। বেলা হয়েছে। কোডার্মা পেরিয়ে গাড়ি তখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেছে। পাগলের মতো ছুটছে এক্সপ্রেস গাড়ি। চারদিকে বর্ষা পেরিয়ে আসা দামাল সবুজ অরণ্যে শরতের রোদ পড়ে হলদে-সবুজ প্রাণ উচাটন। একটা ফোন এলো। কলকাতা থেকে এক নবীন বন্ধু ফোন করছিলেন। বললেন, 'পারিজাত' থেকে ফিরছি। সুনীলদা আর নেই।

সেই মুহূর্তে ঠিক কী মনে হলো, ভুলে গেছি। মনে পড়ছিলো বছর খানেক তাঁর সঙ্গে হায়দরাবাদে কমলকুমারকে নিয়ে খুনসুটি, ছদ্ম বিতণ্ডা। তিনি কখনই আমার প্রিয়তম লেখক ছিলেন না। কিন্তু তাও তো ঠিক কসম খেয়ে বলা যায়  না! আমি তাঁর অনুগত পাঠক ছিলুম না। যা ছিলুম, সেটা হলো ওস্তাদ মিস্ত্রির আনাড়ি হেল্পারের মতো তাঁর লেখা দেখে শিখছি। তাঁর লেখা পড়ে বাংলা লিখতে শিখেছি লম্বা সময় ধরে। তাঁর কবিতা নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু  বলবো না। প্রসঙ্গ, তাঁর গদ্য। বিশেষত ফিকশন। 'প্রিয়' লেখক না হলেও, বাংলা লেখার গাইড তো ছিলেনই। 'গুরু'? হয়তো বলা যায়।

প্রিয় লেখককে নিয়ে মুগ্ধতা খুব স্বাভাবিক। যেমন প্রিয় নায়ক বা প্রিয় খেলোয়াড়। এই 'প্রেয়তা' আসলে কাঁচের দেওয়াল, চোখের কাছে স্পষ্ট, বাধাহীন, স্পর্শসম্ভব। কিন্তু ঘটনাটা সেভাবে ঘটে না। চোখ ছুটে চলে, মনটাও; কিন্তু ছোঁয়া যায় না। কবি বা লেখকরা যে চরিত্র বা অলীকজগতকে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন, তাঁরা নিজেরা কিন্তু সেই জগতের অধিবাসী ন'ন। ধরা যাক, সেই কিংবদন্তি সময়ের শীর্ষেন্দু। সদ্য কলেজে গিয়েছি তখন। প্রতি সপ্তাহে 'যাও পাখি' ছিলো আমাদের বন্ধুদের আকাঙ্ক্ষার ঘর। আমি হয়তো তার  আগে 'পারাপার' বা 'ঘুণপোকা' পড়ে ফেলেছি, অনেকেই তখনো তা পড়েনি। 'যাও পাখি' আসছে একটা প্রজন্মের ভালোবাসার গীতগোবিন্দম। আবার বিচ্ছেদের মাথুরকীর্তনের মতো অমোঘ অভিঘাত নিয়ে। শীর্ষেন্দু পরবর্তীকালের ‘আশ্চর্যভ্রমণ' ছাড়া আর কোনও গল্প-উপন্যাস উত্তমপুরুষে লেখেননি। ফলে তিনি নায়ক বা মূলচরিত্র ন'ন। তিনি কৃত্তিবাস ওঝার মতো একটা কথকতা করে যাচ্ছেন। কিছু চরিত্র, বেশিটাই চেনা, আবার অনেকটা অচেনা স্বভাবের কোণ নিয়ে তাঁর অননুকরণীয় বাংলা গদ্য। পাঠক একেকবার একেকটা চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছে। বহরু, সোমেন, রিখিয়া, নিশ্চুপ কুকুরটি বা নিষ্প্রাণ আসাহি পেনট্যাক্সের মৌন লেন্স। একটা শাদা কাগজে প্রিয় সম্বোধনটুকু শুধু লেখা রয়ে গেলো। চিঠিটা আর লেখা হলো না। আমার এক বন্ধু, সেই বয়সে এতোটা পড়ে শ্বসিত আক্ষেপে বলে উঠলো, আর পারছি না। সেকালে ফিকশন পাঠককে এভাবেই নাড়িয়ে যেতো।

লেখক যখন আঙুল রাখেন পাঠকের নাড়িতে, তখন  তিনি পাঠক ন'ন। তিনি শীতল সতর্ক এক ডাক্তার। নিদান খুঁজে বেড়াচ্ছেন মানুষের ভালোবাসা-আনন্দ-বেদনার পাশে শুয়ে থাকা অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষার শরীরটিকে কিছু শুশ্রূষা এনে  দিতে। কিছু উপশম, কোনও আশ্বাস, কিয়ৎ পূর্ণতার প্রতিশ্রুতি, পাঠক তো লেখকের কাছে এটুকুই চায়। রক্তমাংসের লেখকটি যখন সামনে আসেন, তখন তিনি সুঠাম, দীঘল শরীরের এক প্রত্যয়ী মানুষ। যিনি হতে পারতেন ময়ূরাক্ষী ব্যারেজের একজন ইঞ্জিনিয়র অথবা ওষুধ কোমপানির সফল বিক্রয় অধিকারী। কিছু আতিশয্যও আছে তাঁর। সদব্রাহ্মণ ছাড়া কারোর হাতের রান্না খান না। এক ধর্মসাম্রাজ্যের সামন্তপ্রধান ঐশীগুরুকে তাঁর সব সৃষ্টি উৎসর্গ করে যান। বাংলাসাহিত্যে তার আগে কখনও এরকম সৃষ্টিছাড়া নিরেট ধর্মীয় আনুগত্যের কোনও নিদর্শন কেউ স্থাপন করেননি। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে, পাতি ছাপোষা বাঙালি পেটরোগা মধ্যবিত্ত মানুষদের মতো প্রেডিক্টেবল। যাঁরা পঞ্চাশ বছর বয়স হলে কোনও প্রেসিডেন্ট মহারাজের খোঁজ করেন। এবার তো একটা দীক্ষা নিতে হবে। দিন ফুরালো, হে সংসারী। এমন লোক 'যাও পাখি', 'মানবজমিন', 'দূরবীন' লেখেন। সাধারণ পাঠকের অবিশ্বাস্য লাগে। আসল অস্তিত্ত্ব কোনটা? ব্যক্তি লেখক, না তাঁর লেখা?

তর্কে ছিন্নভিন্ন করতে চাই তাঁকে। চায়ের দোকানের আড্ডায় কিশোর আমিকে দেখিয়ে বলেন, আমার এই ভাইটি এতো মন দিয়ে আমার লেখা পড়ে, অবাক হয়ে যাই। তবে আমার গুরুপ্রসঙ্গ নিয়ে আমি কিছু বলবো না, একেবারে।

কিন্তু আজ তো আমি তাঁর কথা নিয়ে লিখছি না। তিনি এই লেখায় আসছেন শুধু একটি প্রেক্ষাপট হয়ে। একটা বিশেষ প্রজন্মের প্রধান সাহিত্যজীবীদের অন্যতম প্রতিভূ হিসেবে। যাতে, যাঁকে নিয়ে এই মূহূর্তে লেখার কথা ভাবছি, তাঁর  প্রতিবিম্বটি সমকালীন প্রসঙ্গবিন্দুর ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসতে পারে। লিখছি তো অন্যজনের কথা। একটি ব্যবসায়িক সংবাদপ্রতিষ্ঠানে তাঁর পাশের চেয়ার টেবিলটিতে বসে যে অপর বাঙালি নিরন্তর, নিশ্ছিদ্র নিষ্ঠায় সহস্র সহস্র পৃষ্ঠা বাংলা উপাখ্যান লিখে রেখে গেছেন। দু'জনে মিলে বাংলা গদ্যের একটা সময়কে শাসন করেছেন অবিসম্বাদী প্রতাপে। মিল বলতে দুজনেই মিতবাক, সুভদ্র, কেতাবি বাঙালি 'ভদ্রলোক'। অমিল কিন্তু অনেক। তাতে কীই বা এসে যায়। বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলেন পরিচীয়তে।

সুনীল কিন্তু শুধু একজন লেখক ন'ন। তিনি রবীন্দ্রউত্তর বাংলাসাহিত্যের, প্রথম, সম্ভবত একমাত্র বহুমুখী উৎপাদনশীল ভারি শিল্প। এ পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু লেখা আমি পড়েছি বা আলোচনা শুনেছি, কোনটা দিয়েই তাঁর সামগ্রিক রূপটি ধরা যায় না। তাঁকে বাংলাসাহিত্যের অমিতাভ বচ্চন বলা যায় বা ওয়ারেন বাফেট। নিজেকে 'নিছক পেশাদারি' আখ্যা দিয়ে একজন প্রধান বাংলা লেখক প্রথম গেম চেঞ্জিং-এর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। নাম, সমরেশ বসু। সুনীলের ধরনটা ওরকম ছিলো না। নিজের 'সাহিত্য-আদর্শ' নিয়ে তিনি কদাপি কোনও রকম উচ্চকিত ধ্যানধারণার বিপণন করতেন না। তা সত্ত্বেও  সত্তর দশক থেকেই সুনীলের 'সাহিত্য' সমরেশের 'সাহিত্য'কে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিলো। বাণিজ্যিক সাফল্যের বিচারে বা জনমনোহরণের নিরিখে সুনীল সমরেশকে বেশ খানিকটা দূরে ফেলে দিয়েছিলেন। অন্তহীন লেখার তাগিদে উৎসারিত মন্থিত বর্জ্য রচনার মাপেও তিনি হয়তো প্রথম স্থানে থাকবেন। কিন্তু যতো নগণ্য গদ্য-পদ্যই হোক না কেন, তিনি রচনায় নিজের ব্র্যান্ড চিহ্নটি অনায়াসে মুদ্রিত করে দিতে পারতেন। অনেকেই তা পারেন না।

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় 'আত্মপ্রকাশ' পড়ার সূত্রে। সুনীলের একটা প্রধান লক্ষণ উত্তমপুরুষে ন্যারেটিভ তৈরি করা, গদ্য-পদ্য উভয়তঃ। যেটা শীর্ষেন্দুর ক্ষেত্র নয়। তাই যেসব উপন্যাসে সুনীল কথকমাত্র, যেমন 'একা এবং কয়েকজন, 'সেই সময়', 'প্রথম আলো, 'পূর্ব-পশ্চিম' ইত্যাদি, সেখানে তিনি সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমের মাস্টারদের নভেল নির্মাণের কৌশলটি প্রয়োগ করছেন। উদ্দেশ্য, পাঠকদের গল্প, গল্প এবং গল্পের অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখে পড়ার রস উপভোগ করানো। পাঠকদের নিজেদের চিন্তার অবসর, বিশ্লেষণের খরতা, নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করার পরিসর, তিনি কিছুই দিতে চাইছেন না। পাঠক নেশাগ্রস্তের মতো পড়ে যাবে, মুগ্ধ হবে। দীর্ঘপরিসরে হয়তো মোহগ্রস্তও হয়ে পড়বে। কিন্তু অন্যপক্ষে যখনই তিনি উত্তমপুরুষ, তাঁর লেখক-ব্যক্তিত্বটি সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ অন্য অবতারে তিনি আবির্ভূত হচ্ছেন ঐ রচনাটিতে। খুব ক্লিশে, অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান? কিন্তু সযত্নরচিত, কৌশলী বন্ধন তার। যাবতীয় মধ্যবিত্ত ছাঁচের বাইরে গিয়ে 'লন্ডভন্ড' খেলার হিসেবি কথাপাঠ। সাধারণ বাংলা পাঠক সপ্রশ্রয়ে, হয়তো সস্নেহে তাঁকে এই রূপটিতে গ্রহণ করেছিলো। ফলতঃ দেখি অরিজিন্যাল 'রাগী যুবক' মলয় রায়চৌধুরিকে পাঠক বাংলা মূলস্রোতে স্থান দিলো না। 'আত্মপ্রকাশ' তাই সুনীল'কে বোঝার জন্য একটি জরুরি বই। আমার কিশোরবয়সে এই বই পড়া, পরবর্তীকালে সুনীলের গতিপ্রকৃতির নেভিগেশন বুঝতে খুব সাহায্য করেছিলো। শীর্ষেন্দু যেমন 'সোমেন' বা 'দীপ' ন'ন, সুনীলও 'নীলু' বা 'সুনীল' ন'ন। কিন্তু সঙ্ঘারামের পাঠক সে রকমটা ভাবতেই ভালবাসে।

একটু অধিক দীক্ষিত পাঠক আরেক পথে সুনীলকে খোঁজে, যার একটি নির্দিষ্ট অক্ষরেখা রয়েছে। সেটি হলো 'আত্মপ্রকাশ', 'সুদূর ঝর্ণার জলে' এবং 'অর্ধেক জীবনে'এর সরলরৈখিক প্রতিপাদ্য। কিন্তু সুনীল অতো সহজে ধরা দেবার মানুষ ছিলেন না। তাঁর পদ্য, গদ্য, বর্ণনাপদ্ধতি, উপাখ্যান, প্রতীকসম্মিলন, রসবোধ,  নাটকীয়তা, সব কিছুর মধ্যে আমরা একটা অনাবিল, স্বচ্ছল, সহজতা দেখতে পাই। এটাই ছিলো তাঁর ক্র্যাফটের সিদ্ধি। পাঠককে লুকিয়ে শটকে শিখিয়ে দেবার বিরল ক্ষমতা। ফলে সংখ্যাগুরু পাঠকসমাজ নিজের অজান্তেই লেখার কোন পর্যায় থেকে সতর্ক 'পাঠক' থেকে মুগ্ধ 'ভক্ত' হয়ে পড়ছে, তার সীমারেখাটুকু ঠাহর করা যায় না। এটা সুনীলের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সাফল্য, সাহিত্যিক সিদ্ধি কি না জানি না।

সুনীল নীরা'র ন'ন, মার্গারিটেরও ন'ন, স্বাতীর তো ন'নই। এঁরা সবাই তাঁর চালচিত্রের পিছনে ব্যাকস্টেজ স্ট্রোভের আলো। পাঠক যখন যেমনভাবে তাঁকে চিনতে চায় বা বুঝতে চায়, পিছনের আলোর রং, তার গাঢ়তা নিজেদের বদলে ফেলে, যাতে সুনীলের প্রতিবিম্বিত মহিমাটি আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্পটলাইটের সমস্ত স্রোত যেন তাঁর শরীরেই কেন্দ্রিত থাকে। তিনিও হয়তো সেটাই চাইতেন, যেহেতু তাঁর অনুগত পাঠকসমাজও তা অত্যন্ত অধিক মাত্রায় চেয়ে থাকে। বাংলা লেখক হিসেবে সুনীলের বন্ধহীন জনপ্রিয়তা, তাঁর রচনার সুচতুর বিপণন, গণমাধ্যমে তাঁর ভাবমূর্তির কুশল কুমারটুলি, সব মিলিয়ে আজও তাঁর চারধারে ঘিরে আছে অস্পষ্ট মায়াবী ধোঁয়ার আবরণ। তন্নিষ্ঠ পাঠক, সতর্ক পাঠক, বিশ্লেষক পাঠকের মোহমুদ্গর, এখনও তেমনভাবে তাঁর নসিব হয়নি। যা হয়েছে, তা ঈর্ষাপর, নিন্দক প্রতিঘাতী আক্রমণ। সেগুলো কালের বিচারে হয়তো টিকবে না। আসলে সুনীলের কিছু গদ্য নতুন করে পাঠ করা দরকার। প্রকৃত প্রস্তাবে 'সুনীল'কে পড়ার যে ধারাটি তাঁর জীবৎকালে বলবৎ ছিলো, সেটা কিছু পুনর্বিবেচনা দাবি করে। তিনি দেবেশ রায় ন'ন। সতীনাথ ভাদুড়ী বা অমিয়ভূষণ মজুমদারও ন'ন। এমন কি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ও ন'ন। কিন্তু তাঁকে বাতিল করা যায় না। সুনীলের নতুনপাঠ শুরু করার সময় বোধহয় এসে গেছে। একটা প্রজন্মের প্রধান লেখককে মেঘলা মুগ্ধতা ও আসক্ত আবিলতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যাঁরা তাঁর গল্পকথনের ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে চান, তাঁর অতিপ্রজতাকে হেয় করতে চান, নিন্দারবের প্রতি তাঁর নির্লিপ্তিকে ঈর্ষা করতে চান, তাঁরা তাই করুন। কিন্তু তিনি যে বাংলা গদ্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন, সেটা আর অস্বীকার করা যায় না। সবজান্তা সমালোচকদের প্ররোচনা তুচ্ছ করে তিনি 'সাধারণ' পাঠককে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন, সেটাও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাঁকে আরও একবার  'নিজের' করে নেওয়ার খেলা আবার শুরু করা যায়। তাঁর খেলা এখনও ফুরোয়নি। চলছে।

এমাসেই তাঁর চলে যাওয়ার দশ বছর পূর্ণ হবে। ভাবা যায় না!


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি : রঙ্গনা




 

প্রতি,

বঙ্গের পুজোর থিয়েটার হল আরেকরকম আকর্ষণ। শহর জুড়ে কাশের গোছায় ঢাকির দল ইতিউতি বাদ্যি বাজাচ্ছেন। নীল আকাশে সাদা মেঘ। বোঝাই যাচ্ছে শরৎ আগত। এবং শারদীয়ার ধুম লেগেছে। আবার নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে অনেক নতুন মানুষের শহরে পুজো দেখতে আসা। শুধু পুজো নয়, মেলা, কেনাকাটা এবং শহরের থিয়েটার দেখতে পাওয়া। যখন যা থিয়েটার চলছে তাই। শারদীয়া কেন্দ্রিক উৎসবের বিশেষ প্রস্তুতি শুধুমাত্র পোশাক, সাজগোজ বিপণনে চলে না। চলে থিয়েটারের চলমান দলেও। থিয়েটার পাড়ার গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী প্রযোজনা হবে তারই তোড়জোড় শুরু করে দেয়। নতুন নাটক নামে।  আবার তৈরি হয়ে যায় নতুন থিয়েটার। যেখানে বাংলা সংস্কৃতির বিশেষত্বে থিয়েটার পাড়া। একদিকে ঢিল ছোঁয়া দূরে কত হল মানে থিয়েটার বা মঞ্চ। তারই মধ্যে নতুন একটা মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা যেন জোয়ার আনে ফ্ল্যাশব্যাকের থিয়েটার পাড়ায়। কলকাতা জুড়ে তখনো সিনেমা এবং থিয়েটারের দুনিয়ায় অ্যাডভান্স বুকিংয়ের রমরমা। হলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে পুজোর আনন্দ দ্বিগুণ। উত্তর কলকাতার এমনই দর্শক দুনিয়ায় থিয়েটারের বাজারও কিছু পিছিয়ে ছিল না। শহরের বাইরের দর্শকে ভরে উঠত কলকাতার হাতিবাগান পাড়া। লম্বা রাস্তা পেরিয়ে প্যান্ডেলে ঘুরে বেরান যেমন। পাশাপাশি তেমন চলত নাটক দেখা। এবং শারদ উৎসবের জন্যে থিয়েটারের শো বাড়িয়েও দেওয়া হত। আর এই কাণ্ড শুধুমাত্র পেশাদারি মঞ্চে নয়, চলত গ্রুপ থিয়েটারেও। দর্শক-ইথারে গুঞ্জিত হত প্রেক্ষাগৃহের আসন। মুখর সেই আসরে অভিনয় মানে মাচান শোয়ের মতন নাচাগানা কেবলই নয়। সেই থিয়েটার নাটক ছিল দর্শকের জন্যে বিশেষভাবে ভেবে করা। হ্যাঁ, একুশ  শতকের দিক থেকে ভাবলে বিষম লাগে ঠিকই। এও কি সম্ভব! হ্যাঁ, বিশ শতকের কলকাতায় পুজো মানে থিয়েটারের মেলা। সেই থিয়েটার মানে নাটক, মঞ্চনাটক। পুজোয় চলে ডাবল শো। পুজো কেন্দ্র করে শহরমুখী মানুষের ভিড়ে জমে উঠত প্রেক্ষাগৃহ। সেকালের হাতিবাগান পাড়ার ক্ষেত্রসমীক্ষায় একালের হারিয়ে যাওয়া  থিয়েটার, জমে ক্ষীর হয়ে ওঠা। একদিকে মহালয়ার সেই সুর। তার সঙ্গে নাটকের রিহার্সাল তুঙ্গে। এই নাটক বাংলা নাটক, মানে প্রফেশনাল থিয়েটার, মানে স্পষ্ট  করে বললে কলকাতার সম্পন্ন সংস্কৃতি হল পেশাদারি থিয়েটার। যে পেশাদার মঞ্চ কত শিল্পীর সংস্থান চালিয়েছে একসময়। যেই থিয়েটারে অভিনয় করেছেন তাবড় গ্রুপ থিয়েটার-শিল্পী থেকে সিনেমার শিল্পীরা। হাতিবাগান বাজারের অনতিদূরে জমজমাট ভিড়ে এক অনির্ণীত সমাধানে হাতছানি দেয় থিয়েটারের পাড়া। যে আবছা স্মৃতির সৌধ নেই। নেই মঞ্চগুলো আর। শুধু রয়েছে ইতিহাস। অথচ এই তো সেদিনের কথা। পিঠোপিঠি কত মঞ্চ কত থিয়েটার। সেবার এমনই শারদীয়  পুজো-পঞ্চমী। কলকাতায় খুলবে নতুন এক পেশাদারি থিয়েটার। বাংলা সন ১৩৭৭। ইংরেজী ১৯৭০ সাল। সেবার পুজোর পঞ্চমী ছিল ৫ অক্টোবর। ২০২২ সালে পঞ্চমীর  থেকে মাত্র ৫ দিন আগে। বাংলার থিয়েটারের বিচিত্র জগতের খুব চেনা নাম রঙ্গনা। এর সূচনা হয়েছিল দেবীপক্ষে।

ফিরে দেখা বা ফ্ল্যাশব্যাক থিয়েটারের হারিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির বাহক এক নামী প্রেক্ষাগৃহ। রঙ্গনা থিয়েটার। ডাকনাম রঙ্গনা। সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙ্গালিয়ানা যত বিশ্বায়ন পরিচিতি পেয়েছে, তার সঙ্গে দ্রুতগামী অনুচ্ছেদে হারিয়েছে বাংলার পেশাদারি মঞ্চের ঐতিহ্য। কারণ, বাঙালি ইতিহাস ধরে রাখতে পারে না। থিয়েটারের বাণিজ্যে বাঙালি ব্যবসাদারের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে না। কেবলই  মালিকানার লড়াই, মকদ্দমায় অর্থ ব্যয়। যা থিয়েটারের অবলুপ্তির কারণ। তাও তোড়জোড় কত না। রঙ্গনার প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘নট-নটী’। প্রথমে এর আসন সংখ্যা ছিল ৮৫০টি। পরে বেড়ে যায় ৯০৫টি। তবে, শুরুর কথাই আগে। মঞ্চের নাম দিয়েছিলেন নাট্যাচার্য অহীন্দ্র চৌধুরী। তাঁকে কে না চেনেন! মঞ্চের উদ্বোধনের তারিখে ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে উজ্জ্বল ইতিহাস। ওই লগ্নে মঞ্চের শুরুর দিনে এসেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। যিনি একদা আগ্রহী ছিলেন নাটক লেখায়। ছিলেন সংবাদজগতের বিশিষ্টজন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। এবং বাংলা নাটকের বিশেষ গবেষক শিক্ষক আলোচক অজিতকুমার ঘোষ। প্রথমদিনের অভিনয়ের গল্পও অন্যরকম। যে দুটো নাটক অভিনীত হয়। এক, ‘বিনি পয়সার ভোজ’। দুই, ‘য়্যায়সা যা ত্যায়সা’। দ্বিতীয় নাটকটি আগেই  অভিনীত হত শ্রীমঞ্চে। এবং সেদিনের মঞ্চায়নের ইতিহাসে বন্ধু-মঞ্চ হিসেবে রয়েছে শ্রীমঞ্চ। শুধু নাটকটিই নয়, সেটের পর্দা, কাঠের পাটাতন সহ কিছু মঞ্চ-উপস্থাপনের সাজসজ্জার উপকরণ এসেছিল শ্রীমঞ্চ থেকেই। সাধারণভাবে যে কোন নাট্যমঞ্চের নিজের বোর্ড করেই নাটক হয়ে থাকে। কিন্তু রঙ্গনার প্রথম দিকের নাটক ছিল গ্রুপ থিয়েটারের নাটক। উদ্বোধনের পরও রঙ্গনা নিজের নাটক প্রযোজনা করতে সমর্থ হয় না। এরজন্যে অপেক্ষা করতে হয় তারিখকে। ১৯৭৫ সাল থেকে ‘নট নটী’ নাটক দিয়েই এর চলা শুরু। পরে নাটকটির অভিনয় চলতে থাকে  নিয়মিত। তবে নতুন মঞ্চের নতুন পরিকাঠামোয় ধীরে ধীরে সপ্তাহে তিনদিন চলল নাটকের শো। সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী চলচ্চিত্রজগতের অতি পরিচিত মলিনা দেবী। সঙ্গের সহ-শিল্পীরাও একেকজন দিকপাল ও বিখ্যাত অভিনেতা। যথা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, চেনামুখ জটায়ু-চরিত্রের সন্তোষ দত্ত। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল দেব। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন দীপিকা, বাসন্তী, মমতা, হিমানী প্রমুখ। শোয়ের সময় ছিল শুক্রবার সাড়ে ছটা। আর শনিবার বেলা তিনটেয়। এবং রবিবার সকাল দশটায়। প্রথম নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন অভিনেতা গণেশ মুখোপাধ্যায়। যিনি একাধারে নাটকের শিক্ষকও। তিনি শিক্ষকতা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের নাটক বিভাগে। এক অর্থে তিনিই এই মঞ্চের জন্মদাতার এক প্রাণপুরুষ। যিনি প্রথম ভেবেছিলেন নাটকের জন্যে আরেকটি মঞ্চ চাই। উক্ত নাটকের শোয়ের সংখ্যা প্রথমদিকে আনুমানিক ও পাওয়া হিসেবে ৪৫ রজনী। যদিও, রজনী বলে উল্লিখিত, তবে রবিবারের শোয়ের সময় ছিল সকাল দশটা। বিচিত্র এই রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উল্লেখের সময়ও গতে বাঁধা। নিজের বিশ্লেষণে তাই পৃথক করে উল্লেখ করার যে, রজনী অভিনয় কিন্তু পেশাদারিত্বে এক প্রকাশ। এরসঙ্গে যাত্রাপালার অভিনয়ের যোগ বেশি। শব্দটি থিয়েটার প্রিয় বাঙালির সাধারণ রঙ্গালয়ের পরের ইতিহাসেও সংযোজিত হয়ে যায়। এবং, থিয়েটারের পরিক্রমায় একটি বিশেষ যোগসূত্র হয়ে মৌলিকত্বের দাবি রাখে। যা একদিকে ইংরেজি ভাষার 'নাইটস' থেকে প্রাপ্ত হলেও, এর বাংলা শব্দটিও বেশ মানানসই। থিয়েটারের অনেক বৈশিষ্ট্যের মতন ঢেঁকুর তোলে না ইতিহাস অজীর্ণ বাঙালির। ফলে, ইতিহাসে রজনী বৃদ্ধি পেল। আর ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটারের কথা তৈরি হতে থাকল।  উক্ত নাটকের শোয়ের সংখ্যা আনুমানিক ও পাওয়া হিসেবে ৪৫৫ রজনীতে পৌছায়। যা তারিখে জনপ্রিয়তায় ইতিহাস। এমনভাবে চলতে পারা থিয়েটারকে বলা যায় বাণিজ্য সফল। অর্থাৎ, প্রথম থিয়েটার চলেছিল এক বছরেরও বেশি। ভাবা যায় না। এই তথ্য অভ্রান্ত, দু-একটি সংখ্যা রজনীর পার্থক্য হলেও হতে পারে। তবে, তা নিশ্চিতভাবে তথ্য সারণিসূত্রে বিশেষজ্ঞ মতামতনির্ভর।

আলোচনা সূত্রে পরের প্রযোজনা  ‘বহ্নি’, ১৯৭৮ সালে। রচনা সাহিত্যিক বলাইচাঁদ  মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল। এখানেই ইতিহাস হয়ে ওঠে। এবং ইতিহাস মানেই ফ্ল্যাশব্যাক। যেমন, দেবনারায়ণ গুপ্ত, তাঁর পরিচালনা গুচ্ছ নাটক নিয়ে আসেন নব নির্মিত নাট্যমঞ্চায়নে। সঙ্গে তিনি নিজেই নাট্যকার এবং থিয়েটারের বোদ্ধা। তাঁর একাধিক থিয়েটারের লেখা, আলোচনা কালানুক্রমিক ব্যাপ্ত। সঙ্গে তিনি রঙ্গনার ইতিহাসেরও এক পালক। যথাক্রমে তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘চন্দ্রনাথ’, ‘জয় মাকালী বোর্ডিং’, ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’, ‘অঘটন’-এর মতন বহুজন আলোচিত ও প্রশংসিত নাটক। এইসময়ে তাঁর সঙ্গে প্রযোজক ছিলেন হরিদাস সান্যাল।

বিশ শতকের কলকাতার বাজার-অর্থনীতিতে থিয়েটারের মুনাফায় তখনও। নাটকের দ্বারা উপার্জন হত বলেই না, ওখানে অভিনয়ে যুক্ত হতেন শিল্পীরা। যাঁরা এই সিরিজের নিয়মিত পাঠক, তাঁদের আর বলে দিতে হয় না যে, নাটক থিয়েটার নিয়ে তখন কত মাতামাতি চলত। একদিকে প্যান্ডেলে ঘোরা, অন্যদিকে কলকাতার থিয়েটার দেখতে পারা দর্শক। যাঁদের দৌলতে শারদীয়ার নাটক বা থিয়েটার। আগের কিস্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, দর্শক নাটকের তিন মাত্রার এক মাত্রা। তাহলে এত এত রজনী অতিক্রান্ত হল। এত হিট নাটক সত্ত্বেও আবার প্রশ্ন তো ওঠে, রঙ্গনা থিয়েটার কেন চলল না? হিট মানে মুনাফা। কিন্তু বাংলার থিয়েটার শুধু যে  লোকসানে ডুবে যায় তাও নয়। অনেক সময় সাফল্যের সুফল সত্ত্বেও হারিয়ে যায়। তবে এর সমসাময়িক কাল পেরিয়েও প্রবন্ধে উঠে আসা মানে কি হারিয়ে যাওয়া?  নাকি চতুর্থ মাত্রার অর্থ বহন করে থিয়েটারের জন্যে উঠে আসা গবেষণার বিষয় হয়ে? ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার মাননীয় সম্পাদক কাজল সেন-এর সস্নেহ লৌকিক  উপস্থাপন। তিনি থিয়েটার পিপাসু। তিনি মান্য সাহিত্যিক, যিনি অতীত হতে থাকা থিয়েটারকে তুলে আনতে প্রয়াসী একুশের চলমান মাধ্যমে। তাঁকে এবং পাঠককূলকে জানাই থিয়েটারের বর্ণব্যঞ্জনে উৎসব শুভেচ্ছা। যেখানে এক নটী সংলাপ বলছেন, "মাননীয় একুশ শতকের উপস্থিতজন, শুভেচ্ছা জানবেন। থিয়েটার পাড়ার পক্ষ থেকে ডাবল শোয়ের আয়োজন সার্থক করে তোলার এককে, আপনিও একজন। তাই আপনিও আজ থেকে রইলেন পেশাদারি রঙ্গালয়ের ইতিহাসে। 

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী