ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩১)
দিল্লী এয়ারপোর্টের মা-বাবার অপেক্ষা করছিল বাবুল। বেশ আগেই সে ক্যাব নিয়ে চলে এসেছে। সন্ধের ফ্লাইট, মা একা সব সামলে আসছে তার কাছে। মা-র জন্য গর্ব হয়, বাবার জন্য একবুক মায়া। বাবার যে কী সমস্যা, মা-ও বুঝে উঠতে পারছে না। ফ্লাইট ল্যাণ্ড করার সময়ে মা ফোন করেছিল। দেরি হচ্ছে, হয়ত কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মালপত্রের অপেক্ষায়। বিশাল এয়ারপোর্ট, আসতেও সময় কম লাগে না। আর একবার ফোন করা যায়, বাবুল মা-কে ব্যতিব্যস্ত করতে চাইছে না। অপেক্ষা করছে, ওদের দেখা গেলে ক্যাব বুক করে দেবে তক্ষুনি। খারাপ লাগা বেড়ে ওঠে, মা-কে সাহায্য করা যাচ্ছে না! খানিক অধৈর্য আনমনাভাবে সামনে তাকায়। পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে মানুষের ঢল, কত উৎসুক দৃষ্টি চেনা মুখ খুঁজছে। অস্থিরতা চেপে অন্যদিকে তাকাতে গিয়ে চোখ আটকে যায়, বুকের মধ্যে গরম চায়ের মতো ছলাৎ শব্দে রক্ত উথলায়, অজ্ঞাতে উত্থিত হয় পুরুষাঙ্গ—এই প্রথমবার। অদূরে অদিতি! সামনের দিকে চেয়ে ট্রলি ঠেলে বিরসমুখে এগিয়ে আসছে। পাশে জনৈক বয়স্ক ভদ্রলোক হাত নেড়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। বিমূঢ় লাগে, কী করা উচিত ভেবে পায় না হর্ষ, ইচ্ছে করে ঠিক বিপরীতে এসে দাঁড়ায় যাতে অদিতি তাকে একবার অন্তত দেখতে পায়। কয়েক মুহূর্তে একেবারে মুখোমুখি দু-জন, অদিতির চোখ তার দিকে, স্থির রাখে একটুক্ষণ তারপর মাথা নীচু করে অন্যদিকে গতি বদলায়। সুখের মতো ব্যথা হর্ষর বুকে – ওই ম্লানমুখ, অনুজ্জ্বল চোখ, কেমন যে তোলপাড় লাগতে থাকে হর্ষর। এদিক-ওদিক থেকে লাগেজের পাহাড়প্রমাণ ট্রলি নিয়ে লোক তাকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে যায়, বিরক্তি প্রকাশ করে। সে ‘স্যরি’ বলে সামান্য সরে দাঁড়ায়।
বেশী লাগেজ আনেনি লিপিকা, সপ্তাহ দুই থাকার প্ল্যান করে এসেছে। কোথাও যাওয়ার কথা হলে প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অ্যাকোয়ারিয়াম। আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে মোটামুটি হৃদ্যতা আছে, তা বলে মাছের বাক্সের দায়িত্ব কারো ওপর চাপিয়ে আসা অসম্ভব। বাজারের কাছাকাছি নন্দন নামে একটি ছেলে শৌখিন মাছের ব্যবসা করে। বলেছিল ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে গেলে সময় করে মাছেদের দেখভাল করে আসতে পারে। এভাবে ফ্ল্যাটের চাবি অপরিচিত হাতে দিয়ে আসা লিপিকার মনঃপুত নয়, অতএব ভেবে-চিন্তে প্যাকেটে ভরে নন্দনের কাছে শুধু মাছগুলো পৌঁছে দিয়ে এসেছে। একটা ছোটো খালি বাক্সে ওদের রাখা হয়েছে, এটুকু সে নিশ্চিত করে এসেছে। বাকি মাছেদের আর তার ভাগ্য। বেরোনোর সময়ে ঘরের কোণে শূন্য এবং জলশূন্য অ্যাকোরিয়াম দেখে মনখারাপ লাগছিল, বারবার সলমনকে মনে পড়েছে। শান্তচোখে বোবা প্রাণীটি যেন বলছিল, ‘আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ? ফিরে এসে যদি দেখতে না পাও?’
অজান্তে
ফ্লাইটে বসে কতবার বোকার মতো চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে, অথচ অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করার
দিনগুলো এত বিরক্তিময় ক্লান্তিকর। ক্যাবে বসে কী যেন বলল বাবুল, লিপিকা অন্যমনস্ক দু-একটা
‘হুঁ-হাঁ’ করল। বাবুল জোরে ডাকল,
“মা,
কী ভাবছ?”
লিপিকা
তাকিয়ে ঈষৎ হেসে মাথা নাড়ল, যা ভাবছে তা বলার যোগ্য নয়। এতদিন পরে বাবুলের কাছে, ছেলে
এখনও যেন ছেলেমানুষ – ‘মা-মা’ করে অস্থির করে দেয়। বাবুল বলে,
“পনেরো
দিন কেন? টিকিট ক্যান্সেল করে দাও, আমি ফ্রেশ করে কেটে দেবো”।
একটু
আঁতকে উঠল লিপিকা,
“না
রে বাবা, এতদিন ঘর ছেড়ে থাকা মুশকিল, বুঝিস তো! তোর বাবার ডাক্তার, ওষুধ—,”
“এখানে
যেন ডাক্তার পাওয়া যায় না?”
খুশি-খুশি গলায় শোভন বলে, বেড়াতে এসে ভারী আনন্দ।
কমপ্লেক্সে ঢুকে একটা বিল্ডিং-এর সামনে ক্যাব ডিকি থেকে লাগেজ নামিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। বেশ পুরনো কমপ্লেক্স, ব্লকগুলোতে লিফটের বন্দোবস্ত নেই। গাছে ভরা চারপাশ, ওপেন গ্যারাজে সার দিয়ে দামী-দামী চারচাকা। বাবুল হেসে চারতলায় আঙুল দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের জানালা নির্দেশ করে। চারতলা ওঠানামা এমনিতে সমস্যাজনক নয়, কিন্তু সঙ্গে ভারী স্যুটকেস দুখানা। চিন্তিতমুখে লিপিকা বলে,
“হ্যাঁরে
কাউকে টাকা দিলে লাগেজ তুলে দেবে না?”
স্যুটকেসদুটো
টানতে টানতে হাসিমুখে এগোয় বাবুল,
“এসো
না আমার পেছন পেছন—
“ফ্ল্যাটে
উঠবি না?”
“না—!”
মিনিটখানেক
হেঁটে এক বিল্ডিং-এ একতলা ফ্ল্যাটের সামনে থামে, পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে,
ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে ডাকে,
“মা
এসো, বাবা—
টেবিলে ঢাকা-দেওয়া খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম বসিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখে লিপিকা। ফার্নিশড্ টু বি-এইচ-কে, দু-ঘরের সঙ্গে দুটো অ্যাটাচড ব্যালকনি ও টয়লেট, এক লম্বাটে কিচেন, কমন লিভিং রুম। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওদের এখানে রেখে বাবুল নিজের ফ্ল্যাটে গেছে। লিপিকা প্রথমে আপত্তি করেছিল,
“এ
আবার কার ফ্ল্যাট? কেমন অ্যারেঞ্জমেন্ট করলি বাবুল?”
বাবুল
নিজের ছোট্ট অগোছালো ফ্ল্যাটে মা-বাবাকে তুলতে চায়নি। হাসিমুখে বলে,
“এটা
একজন পঞ্জাবি লেডির ফ্ল্যাট, গেস্ট-হাউস হিসেবে রেখেছে। দু-টো ফ্যামিলিকে একসাথে গেস্ট রাখে অনেক সময়ে। সেজন্য
পুরোটা বুক করে নিয়েছি, যদিও একটা ঘর লকড্ রেখেছে। বাকিটা তোমরা ব্যবহার করো, দেখো
অসুবিধা হবে না। আমি তো পাশের ব্লকে আছি। টপফ্লোর তো, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামাতে বাবার কষ্ট
হবে। আর আগে অর্ডার করলে এরা খাবারও দিয়ে যাবে। আজকের ডিনার নিয়ে নিয়েছি।”
ছেলে
নিজের বুদ্ধিমতো বাবা-মাকে আরামে রাখার আয়োজন করেছে। খুব পছন্দ না হলেও মেনে নেয় লিপিকা।
একটু পরে বাবুল ফ্রেশ হয়ে আসে। লিপিকা কিচেন থেকে প্লেট বের করে ডাইনিং টেবিল সাজায়,
রুটি, আতপচালের সুগন্ধি ভাত, ছোলার ডাল, আলু-বিন-ক্যাপসিকাম-পেঁয়াজ ভাজা সবজি, স্যালাদ।
আবার
অনেকদিন পরে একসাথে বসে তিনজনে খাওয়া। বেশ রান্না, ঝাল-ঝাল মুখে ভালো লাগে। বাবুল বলে,
“তোমরা
গরম জামা দু-একটা এনেছ তো? এবার কিন্তু শীত পড়তে শুরু করবে”।
“কাল
সানডে, তোর ছুটি না? কোথাও বেরোনো যায়?”
শোভনের
স্বরে খুশী ফুটছে, এতটা পাড়ি দিয়ে এসেছে, ছেলের মুখখানা দেখছে – ক্লান্তি, অবসাদ মুছে
যাচ্ছে।
অভ্যেসমতো ভোরবেলা ঘুম ভেঙে স্টোল গায়ে জানালার পাশে দাঁড়ায় লিপিকা, বাইরে কুয়াশা এখনও। পাখিদের ঘুম ভেঙেছে আরো আগে, অজস্র গাছ এখানে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাখিদের চেঁচামিচি শোনে। শোভন ওষুধ ছাড়া রাতে অঘোরে ঘুমিয়েছে, সব মিলিয়ে মন ভালো লাগছে। বাবুলের একটা দিন ছুটি, মায়া হয়, আহা ঘুমোক – হয়ত দেরীতে উঠবে। ধীরেসুস্থে বেরোনো যাবে, অবশ্য শোভন কেমন থাকে তার ওপরে নির্ভর করে। কাচ দিয়ে দেখা যায় স্বাস্থান্বেষেণে বেরিয়ে পড়েছে অল্প কয়েকজন, দ্রুত পায়ে হাঁটছে। লিপিকার হঠাৎ তীব্র ইচ্ছে করে অমনি বেরিয়ে পড়তে। শোভনের দিকে তাকায় একবার, মোটা পর্দা টানা আবছা অন্ধকারে এখনও গাঢ় ঘুমে।
ভেতরে
অস্থিরতা জাগে, আপাত কোনও বাধা না থাকা সত্বেও কতদিক দিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের স্রোতে
বাঁধ দিতে হয় নিজেকে, খুদে-খুদে ইচ্ছেগুলো ছেঁটে ফেলতে হয়। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা,
আধঘন্টা হেঁটে আসাই যায়। স্যুটকেস খুলে জামাকাপড় বের করে লিপিকা, মোবাইল বেজে ওঠে।
অচেনা নম্বর থেকে খসখসে মহিলা কণ্ঠ বলে,
“গুড
মর্নিং। আর ইউ হর্ষজ্ মম্?”
“ইয়েস।
মর্নিং!”
“আয়্যাম
মিসেস ভাসিন, ওউনার অফ দিস ফ্ল্যাট।”
“ও-কে!
নাইস টু হিয়ার ইউ।”
“স্যরি
টু ডিস্টার্ব সো আর্লি। অ্যাকচুয়েলি মুঝে পুছনা থা, আপলোগ ব্রেকফাস্ট লোগে ক্যায়া? অভি বতানেসে বাই নাইন-ও-ক্লক ইট উড
বী রেডি।”
ছোট্ট
নিঃশ্বাস ফেলে লিপিকা, বাঃ বেশ তো! মেনু শুনে সে তিনপ্লেট খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। তারপর ভাবে কেমন চমৎকার ব্যবসা
করছেন একা মহিলা। এমন এক্সট্রা ইনকাম তো সে-ও করতে পারে। পোশাক পরে তৈরি হতে হতে দেখে
শোভন চোখ খুলেছে। লিপিকা কিছু না ভেবে বলে,
“শুয়ে
থাকো, আমি আধঘন্টা হেঁটে আসছি। মোবাইল নিয়ে বেরোলাম।”
(ক্রমশঃ)
খুব খুশী হলাম
উত্তরমুছুনপড়লাম, খুব মনগ্রাহী লেখার ভঙ্গি....পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি.....অমৃতা
উত্তরমুছুন