কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

উপল মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


আলমগীর

অন্ধ গাইডটি মকবরার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তার আগে জোড়া তলোয়ার দেখা গেছে। সেই তলোয়ারের ছবিকে যতদূর সম্ভব মোঘল করা হয়েছে। আর দেখা গেছে গোলাপ ফুল। যা পসরা সাজিয়ে বসেছিল দোকানীরা আরঙ্গাবাদ থেকে চব্বিশ কিলোমিটার দূরে দরগা হজরত খওয়াজা মখদুম সৈয়দ শা জয়নুদ্দিন দাউদ হুসেইন সিরাজি উরফ ওয়াইস খওয়াজার আসপাশ। সাদা ফ্লেক্সের বুকে নীল রঙের জমি তৈরি করে হলদে হলদে অক্ষরে লেখা এই দীর্ঘ নাম  যত বড় হবে ফ্লেক্সকেও ততোটাই বাড়তে হবে অবশেষে নাম ও ফ্লেক্স দুটোকেই শেষ হতে দেখা যাবে আর দেখা যাবে শেষ হবার আগে ফ্লেক্সে আরো লেখা হয়েছে মকবরা শাহেনশাহ ঔরঙ্গজেব আলমগীর। সুফি সাধকের সঙ্গে একই ফ্লেক্সে মোঘল শাসকের নাম থাকায় কী বিবাদ হয়েছিল? কেমন সে বিবাদ? বোধহয় সেজন্যই আর একটা ছোট ফ্লেক্স টাঙানো হবে ঠিক তার তলাতেই যাতে লেখা ছিল মকবরা শাহিনশাহ ঔরঙ্গজেব আলমগীর। তবে বোধহয় দৃশ্যমান তলোয়ারের মতো সেই ফ্লেক্স ও লেখাকে মোঘল করার জন্য সবুজ, সাদা ও লাল রঙ ব্যবহৃত হয়। দোকানীর পসরা থেকে একটি দুটি বা আরো বেশি ফুল তোলা যেতে পারে আর দাম চুকিয়ে সেটি নিয়ে অন্ধ গাইডের সামনে গেলে সে কিছুই দেখতে পারছিল না। তবু বলে চলে, “সমাধি কখশা হ্যায়। ইনকে উইল থে কি মেরি কবার ইস দরগা কে অন্দর বনানে কা। তবিজদারি করতে থে। কোরান শরিফ কি লিখাই করতে থে। ইসি পইসে মে করব কা বনায়ে গেয়া। ষোলাশো ষোলামে পয়দা হুয়ে থে। সতরাশো সাত মে উনকা ডাইথ হুয়া এহমদনগর মে। একানইউ বরস কি উনকা উমর থি। পঁচাশ সাল হুকুমৎ করে। ওস সাইট মে উনকি গুরু হ্যায় জয়নুদ্দিন চিস্তি। যো ময়নুদ্দিন চিস্তি আজমের মে না, উনি খানদানকে। এ্যাকচুয়ালি ওরংজেব ডায়েড ইন এহমেদনগর দ্যাট ইজ পুনা। লাসট উইশঃ মাই বডি মাসট ব্রউট হিয়ার। ডায়ড সেভানটিন ওফ সেভান। ওকে।” অন্ধ গাইডটি একাই ঘুরে ঘুরে সব দেখায়। সাদা চাদর দেখা যায় তার মধ্যে লাল লাল গোলাপেরা পড়ে। সেই চাদর চড়ানো থাকে মধ্যিখানে এক কাঁচা মাটির কবরের যার ওপর বেইজিল গাছটি কিছু উঠে থমকেছে।  এ গাছ তুলসি নয়। তবু খুশবু দেয় খানা পাকাতে আর শরবতের সুগন্ধও আনে। কদাপি একে তুলসীর সঙ্গে ভুল করা যাবে না। যেমন যাবে না বোঝা কেনই  বা এই খুলটাবাদে এ কবর থাকবে। যখন এতো প্রমাণিত যে শিরকে পরিবারের বেইমানির ফলে শিবাজির পুত্র সম্ভাজি আর তাঁর কবি সেনাপতি ছন্দোগামাত্য কবি কলসকে সংগামেশ্বরের ছোটখাট লড়ায়ের পর মোগল সেনাপতি মুকারব খান হেফাজতে নিলেন। তারপর মসির ই আলমগিরি বলল, “অতঃপর, বাদশাহ ঔরঙ্গজেব ১৬৮৯য়ের ৩রা মার্চ রবিবার, কোরেগাঁও এলেন আর সম্ভাজি ও কবি কলসকে তলোয়ার দিয়ে মারা হল ১১ই মার্চ সোমবার।” মধ্যের সাত আট দিনে কী কী হয় এসব ইতিহাস আর কথামালা গেঁথে এতোটাই আঁটোসাঁটো এক চেহারা নিল যে সম্ভাজির টুকরো টুকরো শরীর আসলে কে বা কারা জুড়েছে সে নিয়ে ফ্যাসাদ হয়ে যায়। দলিত আর শিভালে পাটিলদের মধ্যে। পাটিলরা দাবি করে চলে তারা জুড়েছে আর দলিতদের আইকন গোবিন্দ মাহার। এইসব জোড়া লাগানো সম্ভাজির শরীরের টুকরোতে কে আগুন লাগিয়েছিল এই ফ্যাসাদে কখন ঔরঙ্গাবাদের নাম সম্ভাজিনগর হওয়ার প্রস্তাব পাস হয় বিধানসভায়। পরে তা বাতিলও হয়ে আবার পেশের অপেক্ষায় থাকে। কদাপি কবি কলসের দেহের টুকরোগুলো নিয়ে কোন ন্যারেটিভ তৈরি হয়নি। সেগুলো যেন শাহী ফরমানে যথার্থই মুদ্দাফরাশের পেটে গেছে। স্থির এক বাদশাহের মতোই খুলটাবাদের মাটির কবরটি বুকে গাছ ও মাটি নিয়ে অপেক্ষা করে। তার শরীরে হাওয়া দেয়। খোলা মকবরার নৈতিক ঔদ্ধত্য দেখে ভাইসরয় লর্ড কার্জন ভয়ে শিউরে ওঠেন। মনে পড়ে যায় ১৬৯০ সালে কোম্পানির  বড়কত্তা জোসায়ায় চাইল্ডকে পিছমোড়া অবস্থায় মোঘল দরবারে আনা হয়েছিল। যার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে  ইংরেজ ক্ষমা চায়, যুদ্ধের ঔদ্ধত্য দেখানোর শাস্তিতে তিনি এই আলমগীরই বটে। কার্জন হায়দরাবাদের নিজামকে নির্দেশ দেন। ঔরঙ্গজেব আলমগীরের টুপি বিক্রির চোদ্দটাকা বারো আনায়  তৈরি মকবরার চারপাশে মার্বেলের আচ্ছাদন হয়, জাফরি বসে। তবে আলমগীরের অন্তিম ইচ্ছাকে ছাদের আকার দিয়ে ঢেকে দেওয়ার সাহস বৃটিশেরও হয় না। তাই এখনও খোলা আকাশের নীচে তার ওপর জলেরা পড়ে। পড়ে গড়িয়ে যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দিক চিহ্নিত হতে থাকে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ সমালোচক যদুনাথ সরকার আসেন, ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ায় নেহেরু ঔরঙ্গজেবকে ঘড়ির কাঁটা পেছনে নেবার দোষ দেন। পঞ্চাশ বছরের শাসনে বাদশাহী ক্ষমতার গুমোর ঠেলে আলমগীরের আদুল গা মকবরায় অন্ধ গাইডটি এক মিশ্রভাবে ও ভাষায় আসলে সেসব কথাই বলছিল, সমস্ত কথা। গাইডদের এরকম করতে হয়। আর অন্ধ হয়েও স্বচ্ছন্দে চলফেরা করছে দেখে তাকে বলা হল, “বড়িয়া।”

—কিঁউ?

—এ্যায়সেহি।

দেখা গেল সে টাকাকড়ি নিখুঁতভাবে  গুনতে পারে। সবকটা নোটকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করছিল সে। মকবরার অলিগলি স্বছন্দে পার হয়ে আবার লাল লাল গোলাপ সাজানো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল অন্য কারো প্রতীক্ষায়। কোথাও আর জোড়া তলোয়ারের চিহ্নটি নেই যে মোঘল আদল আনতে হবে।


5 কমেন্টস্:

  1. দেবাশিস সরকার--বয়ানের কারুকৃতিতে মুঘল স্থাপত্যের চমৎকারিত্ব। দিব্যি ঘোরে ছিলাম! আচমকা গল্প তার প্রার্থিত সমাপ্তি আদায় করে নিল!

    উত্তরমুছুন
  2. চমৎকার টুকুন গল্প। খুব ভালো লাগলো উপলদা।

    উত্তরমুছুন
  3. ভালো ঘোরার সঙ্গে ভালো বর্ণনা।
    শুধু ২৫ নং লাইনে 'করব' শব্দটি 'কবর' হবে।
    যাইহোক চমৎকার !

    উত্তরমুছুন