কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

অবলা নারী : এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র




 

(৩)

 

জানি, এই অব্দি পড়ে পাঠকদের কেউ কেউ বলবেন যে ওই ধরনের খেলায় মেয়েদের শরীরে আঘাত লাগতে পারে বলবেন, মেয়েরা তো এমনিতেই দুর্বল  তার ওপরে আবার মেয়ে সন্তানের জন্মই তো পরের ঘরে যাওয়ার জন্য, মাতৃত্বেই নারী জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে যদি সেটা তার পরবর্তী জীবনে কোন সমস্যা তৈরী করে? যারা উপরোক্ত যুক্তির অবতারণা করেন, তাদের জন্য বলি, জন্মের পর থেকে শৈশবস্থা অব্দি শক্তি ও  বুদ্ধির নিরিখে ছেলেদের আর মেয়েদের শরীরে তেমন কোন পার্থক্য থাকে না খেলাধূলার মধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে আমরা যদি তেমন কোন বৈষম্য তৈরী না করি, তাহলে দেখা যাবে মেয়েরা শক্তির দৌড়ে ছেলেদের থেকে খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না আমাদের দেশের তথা পৃথিবীর যত মহিলা  খেলোয়া আছেন, তাদের দেখলেই সেটা দিব্যি বোধগম্য হয় আর খেলতে গিয়ে যদি মেয়েদের শরীরে কোথাও আঘাত লাগে, তাহলে সেটা একটা অ্যাক্সিডেন্টের বেশী কিছু তো নয়! ঠিক যেমনটা কিনা ছেলেদের জীবনেও হরবখত ঘটে থাকে তাই জীবনে অ্যাক্সিডেন্টকে আমরা যেভাবে গ্রহ করি, আঘাতের ঘটনাকেও সেভাবেই গ্রহ করা উচিত তাছাড়া আজকালকার দিনে  ধর্ষণের ঘটনা যে হারে বেড়েছে, তাতে করে যে কারোর জীবনেই যে কোন ঘটনা ঘটতে পারে আবার বিয়ে দিলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তেমনটাও নয় ২০১২তে ঘটা দিল্লী গণধর্ষণ বা নির্ভয়াকান্ড ঘটার সময় মেয়েটির পুরুষবন্ধুটি সঙ্গে থাকা স্বত্বেও সেই অমানুষিক পৈশাচিক কান্ডটা ঘটেছিল, যেটা পরে গোটা বিশ্বের নজরে এসেছিল শুধু নয়, গোটা বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলনের চতুর্থ ধারার বিকাশের ক্ষেত্রেও যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।  বিবাহিত হলে যে স্বামী বাঁচাবে বা আদৌ বাঁচাতে পারবে, ঘটনাটা আদৌ এমন নয় বরং বিয়ের পরে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে মারা যায় অনেক সংখ্যক মেয়ে অন্য কেউ নারীকে রক্ষা করবেএই পরের ভরসায় পুকুরকাটা ছেলে বা মেয়ে কারোর জন্যই কোন সমাধান নিয়ে আসতে পারে না কখনই যার জীবন, যার সমস্যা, তাকেই মোকাবিলা করতে হয় তাই স্বাবলম্বন প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই ভীষণভাবে জরুরী

আদিম যাযাবর জীবনে নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানবসভ্যতার একটু একটু করে চৌহদ্দি বাড়ানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই সময় ও পরিস্থিতি ছিল আজকের তুলনায় সম্পূর্ণ অন্যরকম সে সময় মনুষ্যত্বের বিকাশ তো হয়নি বরং মানুষ তখন আর দশপাঁচটা অন্যান্য জীবগুলোর মত নিছকই একটা জীব হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল মাত্র তাই সেই সময় মনুষ্য নামক জীবের প্রজনন ক্ষমতার ওপরে নির্ভর করে বংশবৃদ্ধি ছিল একান্তই একটা জৈব ব্যাপার আজ সভ্যতা যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যে স্তরে এসে পৌঁছেছে,  সেদিন তা ছিল না তাই আজকে সভ্যতার এই পর্যায়ে পৌঁছে আমাদের সবার আগে নারীকে সন্তান উৎপাদনের একটা যন্ত্র হিসেবে ভাবাটা বন্ধ করতে হবে একজন নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে ভোগ করা, দখল করা যেমন এবং যতটা অন্যায়, ঠিক সেইরকমই একজন নারীকে সন্তান উৎপাদনে জোর করাটাও ততধিক অন্যায় এই সহজ কথাটা এবার মেনে নেবার সময় এসেছে যে নারী কোন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র যেমন  নয়, ঠিক সেই একইরকমভাবে তার স্বাধীন সত্বাকে পৃথিবীর নানা উন্নয়নমূলক কাজে লাগানোটাও সভ্যতারই এক অর্জিত শিক্ষা সেই শিক্ষাকে যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারাটাও মানুষকে মানবিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির একটা স্তরে পৌঁছে দেয় বা দেবে নিঃসন্দেহে আজ আমরা সভ্যতার যে বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি, সেখানে একজন নারী মানেই সে মা নয় বরং একজন নারী  মানে সবার আগে সে একজন মানুষ, যার অসীম সম্ভাবনা আছে নারীর শরীরে যে শুধুই একটা জরায়ু আছে এমনটা নয় বরং তার আছে মেধা, কর্মদক্ষতা, আছে সেই বোধ যে একটা পুরো দল, গোষ্ঠী বা জাতিকে পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে, ক্ষমতা রাখে সভ্যতাকে এক নতুন দিশা দেখানোর, উদ্ঘাটন করতে পারে প্রকৃতির মধ্যেকার এক অনাবিষ্কৃত সত্যকে,  চালনা করতে পারে তাবৎ মানবসভ্যতাকে এক বিস্ময়কর সাফল্যের দিকে, তুচ্ছ  করে হেলায় হারিয়ে দিতে পারে পুরুষের ক্ষমতার পরম্পরা ও আধিপত্যবাদকে, ন্নীত করতে পারে এই বিশ্বকে ও তার  মধ্যেকার নানা সম্পর্ককে অভিনব  উপায়ে

গোটা পৃথিবী জুড়েই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ক্রমবর্ধমান সংখ্যাই আমাদের খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয় এই সভ্যতায় নারীর মূল্য আসলে ঠিক কতটা অন্যদিকে পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব ঘাড়ে নিয়ে পুরুষ প্রতিষ্ঠা করেছে এক আধিপত্যবাদের পরম্পরা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবিক প্রায় সব দিকে সেই  ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদের ফলে আজ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক  চূড়ান্ত বৈরীতায় আচ্ছন্ন দেশে দেশে যুদ্ধ যে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ রচনা করেছে, পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা গোটা বিশ্ববাসীকে যে ভয়ংকর খাদের কিনারায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে, তাতে এই মানবসভ্যতা যে কোন দিন যে কোন মুহূর্তে  ধ্বংস  হয়ে আবার ফিরে যাবে সেই আদিম প্রস্তর যুগে তার থেকে কি এইটাই ভালো নয় যে আমরা সময় থাকতে থাকতেই নারীর মনন ও মেধাকে ব্যবহার করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ক্ষেত্রকে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে, বিচার করতে ও সমাধান করতে শুরু করি এখনই?

যে কথা বলছিলাম, প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের শৈশব থেকেই যে এমনভাবে তৈরী করা হয়, তার পেছনে থাকে একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত সেই চক্রান্তটা হল শৈশব থেকেই আদরে সমাদরে  লালিত পালিত হওয়া ছেলেরা  যাতে বড় হয়েও পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বিনা পরিশ্রমে পরিবারের বাইরে থেকে আনা বা কখন কখন পরিবারের মধ্যেই অন্য কারো পরিশ্রমে নিজেদের দৈনিক প্রয়োজন শুধু মেটাতেই পারে না, সেইসঙ্গে সার্বক্ষণিক যৌন চাহিদা মেটাবার একজন বিনা পয়সার কাজের লোকও পেয়ে যায়, শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্যে

কিন্তু চক্রান্তটা শুধু এই কারণেই বললে সত্যের অপলাপ হবে ছেলেরা নারীর যৌনতাকে, যৌন ইচ্ছেকে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে তার জন্য কোথাও কোথাও, পৃথিবীর কোন কোন দেশে জেনিটাল মিউটেলেশনের মত নির্মম বিধি এখনও বর্তমান রাষ্ট্রসংঘ বা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশানালের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শত প্রচেষ্টা-প্রতিবাদ স্বত্বেও কোন কোন দেশে নারীর যোনির ভগাঙ্কুর কেটে ফেলার মত প্রথাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না একজন গৃহস্থ পুরুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার নারী সঙ্গীটিকে নিয়ে সবসময়ই চিন্তিত থাকে যাতে সেই নারী কোনভাবেই তার সঙ্গে সঙ্গমে অতৃপ্ত হয়ে অন্যত্র গম না  করে এই ২০২২এ এসেও আমাদের দেশের তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজে অসংখ্য পুরুষরা সবসময় চায় তাদের পরিবারের মেয়েরা যেন চাকরী করতে বাইরে না যায়, গৃহকর্মেই নিজেদের জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখে খেলাধুলা বা শরীরচর্চার মত বিষয়গুলো তো অনেক দূরের বিষয় নারীদের অবলা করে না  রাখলে বিনা পয়সার এই আদিমতম দাসপ্রথা চলবে কী করে?

পরিশেষে একটা কথা বলি, আমাদের সমাজে প্রতি পদে পদে আমরা মা! এসব কথা, এসব কাজ ছেলেদের করতে, বলতে আছে নাকি’! বা মা মেয়ে হয়ে জন্মেছ, ঘরের কাজকর্ম কিছু জানো না?’ এইসব কথাবার্তার ও ধ্যান ধারণার আদানপ্রদান যতদিন না বন্ধ হবে, ‘নারীর সব কাজ গৃহে ঘর সংসারের কাজ থেকে ছেলেমেয়ে মানুষ করা সবকছুই মেয়েদের কর্তব্য ছেলেদের সব কাজ বাইরে’ – এই ধারণা বা পুরুষদের সুবিধেজনক অবস্থানে বসিয়ে তাদের তোল্লাই দেওয়া যতদিন না বন্ধ হবে, ততদিন পুরুষরাও নিজেদের নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবাটা বন্ধ করতে শিখবে না শিখবে না মেরুদন্ডহীন, সুবিধেভোগী, বাপমায়ের আদরের ছেলে থেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে আর সেটা না হলে রাষ্ট্রসংঘ যতই সিডও গাইডলাইন তৈরী করুক না কেন, পুরুষরা নারীদের ধর্ষণ করাটাও নিজেদের অধিকার বলে কায়েম করাটাও বন্ধ করবে না আরঅবলানারীরা নিজেদের সবলা করে তোলার বদলে পিতৃতন্ত্রের ছাতার তলায় নিরন্তর ধর্ষিত হতেই থাকবে কেননা এই সব কিছুই আসলে চক্রাকারে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা থাকলে অন্যটা বন্ধ হবার প্রশ্নই আসে না এবার নারীদেরকেই ভেবে দেখতে হবে তারা ঘুরে দাঁড়াবে কি না!

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন