কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


রেস

শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার। এখানে ওখানে কালশিটে আর নখের দাগ। আস্তে আস্তে টাটানো শরীর থেকে নিষ্ক্রমণ হচ্ছে জল। স্তনবৃন্তে দাঁতের দাগ গাঢ় হয়ে আছে। হাত বোলায় সে কলতলায় গিয়ে।

বীথির আজ গা ম্যাজম্যাজ করছে। দেরি হয়ে গেছে সকালে বিছানা ছাড়তে। পাশের ঘরে ঠাকুমার কাছে শুয়ে বছর দশেকের ছেলে। তবু দিনটা এমন কালো হবে ভাবেনি বীথি। টুক করে ছায়া সরে যায় এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে।

একটানা কান্না। বীথির এলোথেলো চুল পিঠে ছড়িয়ে। খায়নি সে দুপুরে, সূর্য এসে ফিরে গেলো জানলা থেকে। এখন তারও মুখ ম্লান। প্রিয়জনের লম্বা ছায়া নিম গাছের সামনে, দীর্ঘতর হচ্ছে, দু’একটা পাতা ঝরে যাচ্ছে স্বপ্নের মতো, এলোমেলো ব্যর্থতায়। রান্না করতে দেরি হয়ে গেছিলো। অফিসের আগে দুটো ভাজা ডাল আর মাছ সব করতে করতে ঘাম। মাছের ঝোলে নুন নেই। খেতে বসে সাধন থালা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ডাল ভাত মেঝেতে গড়াগড়ি, এমন অকর্মা বউকে বাপের বাড়িতে রেখে আসা সমীচীন, তেমন নিদান শাশুড়ি ও পুত্র দুজনেরই।

গাল বেয়ে জল এখন শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়া নদীর ম্লান দাগ। বীথি ত্রিশ ছুঁই ছুঁই তবু আতংকে থাকেন। নবদ্বীপে তাদের শরিকি বাড়ি তিন’শ বছর। আট ভাইবোনের সংসারে অভাব নিত্য। যদি রেখে আসে? সমাজে ছিছিক্কার। ভাইয়েরা ভাত দেবে না।

দিনরাত চেষ্টা করতে করতে কখনো ভুল হয়ে যায় তবু। স্বামী খুব আহামরি কিছু নয়, কিন্তু কলকাতায় এক’শ বছরের পুরনো বাড়ি এক ঐতিহ্য, বৃষ্টি হলে এখান সেখান থেকে যতই চুঁইয়ে পড়ুক জল। সন্ধ্যাবেলা রেডি রাখতে হবে চা জলখাবার, সুন্দর করে সেজে থাকতে হবে আর রাত হলে... বীথি ভুলতে চায়  রাতের কথা। ইচ্ছে করুক বা না করুক বীথি এই কারাগারকেই সিঁদুর আলতা  সহযোগে পরিবেশন করেন বাপের বাড়িতে একমুখ হাসি নিয়ে। নিষিদ্ধ উল্লাসের মতো শরীর জুড়ে তৃপ্তি ভাসে। ঘরের মেয়েছেলেকে তাঁবে রাখতে হয়, কজন পারে! হাতের মুঠো যেটুকু খুলবেন ততটুকুই তার ক্ষমতা। বউয়ের আজও এত সাহস নেই তাঁর মুখের ওপর কথা বলে!

এই তৃপ্তি ঢেকে দেয় রোজ বড় সাহেবের জুতো পালিশ করার স্মৃতি। ম্যানেজার স্যরের গালাগালি, সেও হজম করে সাধন নিশ্চুপে।

ছায়াও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। ছায়া লিখে রাখে কথা।

এক কথায় বরখাস্ত করে দেবার, এক একটা পরিবারের হাসি মুছে দেবার, দ্বিগুণ শিক্ষিত আমলাদের অবনত প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যান মানুষের নেত্রী। এই আনন্দ শুধু তাঁর একার। শুধু এই তৃপ্তির জন্য প্রেমকেও হত্যা করে হেঁটে এসেছেন একা এতটা পথ।

শয়ে শয়ে এইসব প্রজারা এখন কেবল তাঁর। তারা তাঁর কথায় ওঠে বসে। কেবল তাঁর মুখটি দেখে প্রত্যন্ত কোণের মানুষটিও ভোট দেয় এই তৃপ্তি কোনো  কিছুতেই নেই। মনে মনে হাসেন বিতস্তা সেনগুপ্তা। একচ্ছত্র আধিপত্যের লোভ মানুষের শিরায় ও ধমনীতে।

টাকা পয়সা নয় লোভ তাঁর অগণিত হেঁটমুণ্ডে। সেই ছোটোবেলার স্মৃতি ঢুকে গেছে রক্তে তাঁর। এক ক্লাস ছেলেমেয়ে মাথা নিচু করে বসে বেঞ্চে, সামনে কামাক্ষ্যা স্যর দাঁড়িয়ে হাতে বেত। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য রক্ত, মুখ হয়ে যাচ্ছে নেকড়ের মতো। নিষ্পাপ ফুল ফুল বালকদের বিদ্রুপ করছেন বাপ তুলে, যাকে তাকে নিষ্ঠুর শাস্তি দিচ্ছেন কামাখ্যা স্যর। সারা ক্লাস মাথা হেঁট করে ভয়ে কাঁপছে। মাথা নিচু কিন্তু চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ক্রোধ। কামাখ্যা খুশি হন ক্লাশে এলে। এই তাঁর সাম্রাজ্য।

ছায়া লিখে রাখছে প্রতিশোধের বিকল্প প্রতিশোধের হাত পাল্টানো গল্প।

কামাক্ষ্যা স্যরের লাশ মিলেছে বছর খানেক আগে হাইরোডের ধারে।

বিতস্তা দেবীর হাত থেকে পিছলে পড়ে যাওয়া রিলে রেসের ব্যাটম তুলে নিচ্ছে বিরোধী নেতা। আলোর ঠিক নিচে দোল খাচ্ছে কালো মথ।

ছায়া সরে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে।





1 কমেন্টস্: