কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬৪    
  

কালিমাটি অনলাইনের ফেব্রুয়ারী সংখ্যা প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে যাবে কলকাতা বইমেলা এবং বাংলাদেশ বইমেলা। আর এই দুটি বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় যে কত কত বই ও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে, তা ভাবলে একটা অনবদ্য সুন্দর সুখের শিহরণ বয়ে যায় সারাটা অন্তরমহল জুড়ে। সত্যি সত্যিই আজ একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ভারতে ও বাংলাদেশে এই দুটি বইমেলা মূলত আমাদের বাঙালি জাতীয় জীবনে উৎসবের রূপ ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় দুর্গোৎসবের ঠিক  পরে পরেই, হেমন্তের হিম প্রকৃতিকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই। প্রস্তুতির আগের প্রস্তুতি অবশ্য শুরু হয়ে যায় আরও অনেক আগেই। শুধুমাত্র সাহিত্যের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং অসংখ্য ছোট ছোট সাহিত্য প্রকাশন এবং অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও লেখকেরা রীতিমতো সক্রিয় হয়ে ওঠেন প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। তারপর যথাসময়ে মেলা বা উৎসব প্রাঙ্গনে উপচে পড়ে সাহিত্য-শস্যের বিশাল ও ব্যাপক সম্ভার।

আমরা এই পর্যায়ে আবার এবং বারবার নিবিড়পাঠ করতে পারি রবীন্দ্রনাথের সেই অনন্য প্রবন্ধ ‘উৎসবের দিন’, যেখানে তিনি খুব সহজ অথচ গভীরভাবে আমাদের জন্য উপস্থাপিত করেছেন উৎসবের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য। তিনি লিখেছেন - “জগতের যেখানে অব্যাহতশক্তির প্রচুর প্রকাশ, সেইখানেই যেন মূর্তিমান উৎসব। সেইজন্য হেমন্তের সূর্যকিরণে অগ্রহায়ণের পক্কশস্যসমূদ্রে সোনার উৎসব হিল্লোলিত হইতে থাকেসেইজন্য আম্রমঞ্জরীর নিবিড় গন্ধে ব্যাকুল নববসন্তে পুষ্পবিচিত্র কুঞ্জবনে উৎসবের উৎসাহ উদ্দাম হইয়া উঠেপ্রকৃতির মধ্যে এইরূপে আমরা নানাস্থানে নানাভাবে শক্তির জয়োৎসব দেখিতে পাই” আর মানুষের উৎসব প্রসঙ্গে লিখেছেন - “মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বারা ক্ষুদ্ধ করি, সেদিন না যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মপরস্পরায় হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না’ প্রসঙ্গত তিনি আরও লিখেছেন – “প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী – কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ”।  

উৎসব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই অমোঘ বিচার ও অভিমত শিরোধার্য। উৎসবের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য পর্যায়ে আমাদের এ ব্যাপারে সব সময় সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে, তবেই আমরা যে কোনো উৎসবকে সার্থক করে তুলতে সক্ষম হব।

সবাই ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন, সৃজনে থাকুন।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :   
        
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


বিকাশ মুখোপাধ্যায়




ইতিহাসের জেরোনিমো


(৩)




লীসেরিয়োঁ জেরোনিমো

ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায়, সাম্রাজ্যবাদ যখনই উপনিবেশীয় জনগণের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে, সাধারণত তখনই দানা বাঁধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন কোনো নির্ভিক বিপ্লবী, যাঁকে সকলে মান্য করে এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে আবালবৃদ্ধবনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহের অনলে। এমনই এক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন লীসেরিয়োঁ জেরোনিমো (Licerio Geronimo)

বহুযুগ ধরেই ফিলিপিন্স ছিল নিষ্ঠুর তথা অত্যাচারী স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদের দখলে। দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদের দাপটে দখলীকৃত দেশগুলি কার্যত হারিয়ে ফেলে তার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বা। স্থান-কাল-পাত্র সর্বক্ষেত্রেই এমনকি নামকরণের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে বিদেশী প্রভাব। এমন ঘটনা ঘটেছিল ফিলিপিন্সেও। সেই মর্মে লীসেরিয়োঁ নামটিও সেই স্পেনীয় সংস্কৃতিরই অবদান।

১৮৫৫ সালের ২৭শে অগাস্ট, ম্যানিলা অন্তর্গত ‘সাম্পালোক’ (Sampaloc) নামে একটি জায়গায় এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে লীসেরিয়োঁ জেরোনিমোর জন্ম। বাবা গ্রেসিয়ানোঁ ও মা ফ্লেবিয়ানা দারিদ্র্যতার কারণে জেরোনিমোকে কোনো বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই ঘাসকাটা, জ্বালানী সংগ্রহ ও ক্ষেতের কাজে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতেন তিনি। কিন্তু বাল্যকাল থেকেই তাঁর মনে ভর করেছিল, কিছু একটা করে দেখাবেন। দুরন্ত ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই কাজের ফাঁকে তিনি স্কুল পড়ুয়াদের কাছ থেকে শিখে নিলেন লেখাপড়া। ১৪ বছর বয়সে তাঁর ঠাকুরদার বাসস্থান বুলাকান-এর সান মিগুয়েল গ্রামে  স্বাধীনভাবে শুরু করলেন চাষাবাদের কাজ। প্রথম স্ত্রী মোডেস্টা ডি লা ত্রুজ-এর অকালমৃত্যুর পর তিনি সান মাটেয়োঁ গ্রামের কায়েটানা লিংকার সাথে পরিণয়  সূত্রে আবদ্ধ হন এবং পাঁচটি সন্তান হয় তাঁদের। পরবর্তীকালে নিজের পরিবার প্রতিপালনের জন্য তিনি যাত্রী খেয়া পারাপারের কাজও শুরু করেন। ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে দানা বেঁধেছে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। কাটিপুনান নামে পরিচিত এক মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন বোনিফেসিয়োঁ তিনি আন্দোলনের একটি শাখা মাল্টানবানে প্রতিষ্ঠা করেন। লীসেরিয়োঁ  জেরোনিমো আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই শাখার সাধারণ সদস্য রূপে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা, দক্ষতা এবং নির্ভীকতা সকলের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। সকলেই তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেন।  

মুক্তি সংগ্রামের নেতা বেনিফেসিয়োঁর নির্দেশমতো ১৮৯৬ সালে জেরোনিমো বালিনটায়ক নামক স্থানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে গঠিত এক সৈন্যদলসহ মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৯৬ সালের ৩০ আগস্ট  সানজুয়াল ডেল মোনটের ঐতিহাসিক সংগ্রাম শুরু হয়। এরপর তিনি মোন্টালবান নামক স্থানে এক নতুন গেরিলা সৈন্যদল গড়ে তোলেন ও মাউন্টপুরের পার্বত্য অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল ফ্রান্সিসকো মাকাবুলস (General Farncisco Maka bulus)এর নেতৃত্বে ফিলিপিন্সে স্পেনীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়। এই লড়াইতে প্রচুর ক্ষতি হয় স্প্যানিশ সৈন্যদের। এই যুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন জেরোনিমো। তাই একদিকে যেমন তাঁর পদোন্নতি ঘটে, অপরদিকে জনপ্রিয়তাও দারুণভাবে বেড়ে যায় তাঁর। ফিলিপিন্সের অধিবাসীরা তাঁকে জেনারেল সেরিয়োঁ (General Cerio) নামে আখ্যায়িত করেন। স্প্যানিশদের সাথে যুদ্ধে জেরোনিমো একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করে সৈন্যদলকে রক্ষা করেছিলেন। পরিকল্পনা মাফিক স্পেনীয় শত্রুদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদের ভান্ডার লুন্ঠন করে সংগ্রামীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় শত্রুপক্ষের উপরে তা প্রয়োগ করার জন্য।
১৮৯৮ সালে মার্কিন সৈন্যদল ফিলিপিন্স আক্রমণ করলে এই পরিস্থিতির  মোকাবিলায় স্পেনীয় সৈন্যদল কিছুটা বাধ্য হয়েই স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে মার্কিনীদের সঙ্গে রণে মেতে ওঠে, কিন্তু স্পেনের সৈন্যসামন্ত ম্যানিলা বে-তে (Manila Bay) মুখ থুবড়ে পড়ে। 


ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে ফিলিপিন্সের আরেক মহান বিদ্রোহী নেতা এগুইনাল্ডো (Aguinaldo) ফিলিপিন্সে ফিরে এসে পুনরায় স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এই সময় জেরোনিমো জেনারেল পিও ডেল পিলর (General Pio Del Pilar)এর নেতৃত্বে গঠিত সৈন্যদলে যোগ দিয়ে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে বছরের (১৮৯৮) নভেম্বর মাসে এগুইনাল্ডো জেরোনিমোকে ডিভিশনাল জেনারেল পদে উন্নীত করে সান মাটিও’রিজাল নামক স্থানে পাঠিয়ে দেন। এরপর যখন  ফিলিপিন্স মুক্তিবাহিনী এবং মার্কিনী সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় তখন ম্যারিকিনার (Marikinar) রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল জেরোনিমোর কাঁধে এবং তিনি তা দুর্দান্তভাবে পালন করেছিলেন। যুদ্ধর জন্য সংগ্রামীদের সংগঠিত করে, ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সানজুয়ান (San Juan) ও ম্যান্ডালুয়াঁয় (Mandaaluyong) অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়। জেরোনিমোর এই নির্ভিকতা ও সফলতার পুরস্কারস্বরূপ অ্যান্টোনিয়োঁ লুনা (Antonio Luna) তাঁকে তৃতীয় মিলিটারি জোনের কমান্ডিং জেনারেল পদে ভূষিত করে ম্যানিলা ও রিজালে যুদ্ধ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব দেন। 


১৮৯৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর সানজুয়ানে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। আগ্রাসী মার্কিন সৈন্যদলের ওপর জেরোনিমো এবং তাঁর হাতে গড়া গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান ১৩জন মার্কিন অফিসার সমেত আমেরিকান জেনারেল হেনরি ডবলু লোটন (General Henry W. Lawton) বলা যেতে পারে, কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে মার্কিনীরা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯০০ সালে জেরোনিমো এবং তাঁর গেরিলাবাহিনী মার্কিনী সৈন্যদের কাছ থেকে এক বিশাল ভূখন্ড ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। চপেটাঘাত খাওয়া এই সমস্ত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরোনিমোকে ঘৃণা করতে শুরু করে এবং এই ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে জেরোনিমোর নাম বা শব্দটি তাদের কাছে হয়ে ওঠে ঘৃণার প্রতীক।

(ক্রমশ)

শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন    


                              
(৫)

'কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ করে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
অমল আয়ত্বাধীন অবশেষে করে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে 'রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।'

অঘ্রাণ যাই যাই, পৌষের প্রথম শিরশির ভোর আমাদের শহরে।বেলা হলেই রোদ ভাসিয়ে দেয়।এখানে গ্রীষ্মঋতু যেন অনন্তভবানী, ভাঁড়ার ফুরোয়না তার সারা বছর।তবে একদেড় মাস যখন তার বিক্রমে ভাঁটা পড়ে তখন  সারা শহরের ফুর্তি আর বাঁধ মানেনা।ভোরের প্রথম আলো, তার ওম, ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে  বলে, তুমি আমায়ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে...

এমনই এক দশ সকালে অফিসে নানা জনতায় ঘেরায়িত হয়ে আছি, দশ দশে একশো রকম ফরমাইশ তাদের। তার মধ্যেই ম্যানেজার সাহেবের খাস আর্দালি এসেবলে, স্যার, বড়ো সাহেব ডাকছেন,
বলো একটু পরে যাচ্ছি,
আপনার ফোন এসেছে...
এই সময়...!

তখন তো জনে জনে ফোন থাকতো না।  সারা অফিসে এক আধটা ফোন। তাতেই সবার কাজ চলে।

ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে ঢুকে বলি,
ফোন এসেছে?

তোর কাছে শুধু মেয়েদের ফোন কেন আসে বলতো?



স্বপনদা, মানে আমাদের ম্যানেজার সাহেব, লাহেরিয়াসরাইয়ের লোক। স্বভাবে পাক্কা মৈথিল। সুদর্শন, সাড়ে ছফুট দীর্ঘ ফ্রেম। বিহার রাজ্য ফুটবল টিমের স্টপারছিলেন একদিন। সারা পৃথিবীটাই খেলার মাঠ তাঁর কাছে। সবার কাছেই ফেয়ার প্লে আশা করেন। কিন্তু আমাদের চাকরিতে এতো আঁকাবাঁকা, তাই মাঝে মাঝেই মনখারাপ। নিজের বাবা ছাড়া বোধ হয় পৃথিবীতে সবার সঙ্গেই তুইতোকারির সম্পর্ক। অবশ্য বৌদি খুব রাশভারি মহিলা, তাঁকে তুমি করেই কথা বলেন। আমরা আড়ালেবলতাম রামকেষ্ট ঠাকুরের অংশ আছে স্বপনদার মধ্যে। ভবতারিণীর সঙ্গেও তুইতোকারি।

কোনও জবাব না দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিই,
এতো দেরি করো কেন...?
হুঁ...
হুঁ মানে?
হুঁ...
সামনে কেউ আছে নাকি?
হুঁ...
আজ বিকেলে একটু আসতে পারবে?
হুঁ...
কখন আসবে?
হুঁ...
ছটা, সাড়ে ছটা....?
হুঁ...
কোথায়?
হুঁ...
ওফ, নিকুচি করেছে...
হুঁ...
আমি মোদি পার্কের গেটে থাকবো...
হুঁ...

ফোনটা  রাখতেই স্বপনদার প্রশ্ন,
কে রে? বৌমা নাকি?
কার বৌ?
তোরই হবে...
জানিনা, যাই অনেক কাজ পড়ে আছে
শোন শোন, এখনই হুঁ হুঁ' স্টক শেষ করে দিসনা, সারা জীবন রয়েছে তার জন্য। আর কোনও কথা তো বাঁচবে না শেষ পর্যন্ত...

সোয়া ছটা নাগাদ কীনান স্টেডিয়ামের দেওয়াল পেরিয়ে মোদি পার্কের দিকে। সন্ধের ঝুঁঝকো আঁধার নেমে গেছে এর মধ্যেই। ফুচকাওয়ালা, ক্যান্ডিফ্লস, বেলুনওয়ালাসবাই খুব ব্যস্ত সমস্ত। ঘরফেরত কারখানার খাটিয়ে লোকেরা বৌ বাচ্চার হাত ধরে বিশাল ফোয়ারাগুলিকে ঘিরে বসে চনাচটপটি খাচ্ছে।

বাইকটা সাইড করে লাগাতেই ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো পর্ণা।

প্রথম বোধ হয় সময়ে এলে...
-বোলো ভাই, কুছ খাস ইত্তিলা হ্যাঁয় ক্যা?
-না... হ্যাঁ... মানে  বইটা
-কোন বইটা?
-ফিরে এসো...
-আরে বাপরে... কবিতা শোনাতে তুমি এভাবে ডাকলে আমায়। ভাবলাম না জানি কী হলো শেষে...
-না, সত্যি, আমি বোধ হয় একটু ওভার রিয়্যাক্ট করছি...
-না, না, বলো বলো, কো  হসিনা জব শয়ের পড়তি হ্যাঁয় তো, অউর ভি হসিন হো জাতি হ্যাঁয়...
-কী চাষাড়ে রিয়্যাক্শন...
- ধন্য আমি ধন্য হে, চাষি তোমার জন্য যে...
-চলো বসি....

-বলো...
ইয়ে, মানে এই 'কবিতা বুঝিনি আমি' কবিতাটা নিয়ে তোমার থেকে কিছু শুনবো ভাবলাম...
দ্যাখো, ইয়ে, মানে, তোমাকে তো বলেছি আগেই, কবিতা ঠিক বোঝার জিনিস নয়। কবিতার শব্দগুলোর একটা স্কিম থাকে। আমাদের দৈনন্দিন যে  বোঝাবুঝিরজগৎ, তা পেরিয়ে যাবার পর যে নিজের সঙ্গে বেঁচে থাকাতার ঠিক কোনও ব্যাকরণ হয়না। দাদু বলেছেন না নিজের অন্তরালের মানুষটিই সব চেয়ে দুর্বোধ্য। যেমনপাথরের আড়ালে জলমানুষটিও জলের মতন। আমরা নিজের চারধারে নানা দরকারি অদরকারি পাথরের বোঝা জমিয়ে তুলি। রক্তমাংসের  অসহায়তা,ভুলভালবোধকে ঘিরে নিরাপত্তার এই পাথুরে ছলনাএই নিয়েই ভাবি ভালো আছিসুখে আছি। অধিকাংশ মানুষই তো স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজেআনন্দ খোঁজেনা। আনন্দ খোঁজারবড়ো বালাই। সংবেদনশীলতা অর্জন করতে হয়অনেক ছোটো ছোট স্বাচ্ছন্দ্যকে জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। এই যে দুর্গম অর্জনের পথসেখানকার পাথরেরবাধাগুলো আমরা কবিতার কাছে গিয়ে সুগম করতে পারি। কবিতা যেন সেই সব জিলেটিন স্টিকযাকে ক্রমশ বিস্ফোরিত করে জীবনের অনন্ত পাথর পর্বতেরভিতর আমরা সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে যাই।  পাথরের ওপারে কী আছেকী পাবো সেখানে?

'...এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট 'রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকাজোনাকিসব;



আমাকে যে আলো দেয় সে মহাজাগতিক অন্তহীন নক্ষত্রমালা হতে পারে বা হতে পারে ক্ষণস্থায়ী ফুরিয়ে যাওয়া জোনাকি। কিন্তু উভয়েরই যৎসামান্য কোমলআলোক আমার কাছে কবিতার মতো শূশ্রূষা বয়ে আনে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশেরঅনন্তের স্বাদমৃদু লবণের মতো জীবনের প্রশান্তিকে আমার কাছে ফিরিয়েদেয়। দ্যাখোএকটা কথা সব সময় মনে রাখবেকবিতা মানে আদালতের কাগজ বা সংবিধানের পাতা নয়। ডোন্ট বী টু সিরিয়াস... টেক ইট ইজি...

জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই দেখিতাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশকতো গাছকতো হাটকতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজকী রঙের ফুলকোন পাখির বাসাবিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুকমানুষগুলি বাইরে থেকে কেমনতার পরকোনোদিন পেরিয়ে যাই  মানুষগুলির অন্দরমহলহেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনাঅজানাঅবুঝ লেগেছিলোসেই অস্বস্তিটা যেকোথায় চলে যায়কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলেতার প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখননিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছিবুঝি নাই বুঝিকবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন...
-যাহ...
-নাহেসকল ছন্দের মধ্যে তুমিই গায়ত্রী...
-এইরেমনে পড়ে গেলো। তুমি বলেছিলে গায়ত্রীকে নিয়ে আমায় কিছু বলবে...
 দ্যাখোআমিও যে খুব কিছু জানি তা নয়তবে যা জানি একদিন বলবো নিশ্চয়
 -আজই বলো...
 নাহ... আজ তোমাকে দেখতে এতো সুন্দর লাগছে নাএক্ষুনি তোমায় হারাতে চাই না...
-আমায় হারাবেকেনকী হয়েছে?

-কী আর হবেগায়ত্রীরা হারিয়ে যেতেই আসেহারিয়ে দিয়েই যায়...
-শুধু আজেবাজে কথা। আমি তোমাকে হারাতে দেবই না...
 -বেঁধে রেখো পর্ণাদুহাত দিয়ে বেঁধে রেখো...

'তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত করে করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
আড়ালে যেও নাআমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটিক্ষিপ্র  হাত দুটি-
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকিসার্থক চক্রের
আশায় পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তারস এসে চাপ দিতে থাকে;
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধু- ঈর্ষিত
স্থান চায়মালিকায় গাঁথা হতে ঘ্রাণ দিতে চায়।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাওনারিক্রমে-ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণেদ্যাখ,উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাতরসপাত ঘটে শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেনঘুম পাড়াবার সাধ করে।'

(ক্রমশ)