কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

শ্রাবণী দাশগুপ্ত




ফ্রেমে মুখ

  
দিনের আলোয় ফ্রিজ্শট্‌! আটকে গেঁথে গেছে গোটাকয় মুহূর্ত। পরিচিত কারো সঙ্গে
মিল-টিল নেই অথচ—! সময়ের চলতিতে আচমকা থমকে যাওয়া ঝলক। লম্বা শিক-গাঁথা
কাঠের জানালা, ওপরে নিচে দু’পাল্লায় খোলা যায় ইচ্ছেমতো। চারপাল্লাই খোলা ছিল।
নিচের খোলা অংশে গরাদের ফাঁকে মুখ, অচেনা বয়স্ক ঠোঁটে ঝুলন্ত সিগেরেট।
রোহিত মামুলি এই ছবি থেকে বেরোতে পারছে না।  

ছুটি কাটাতে এখানে এসেছে, ঐতিহাসিক ভ্রমণ। একসঙ্গে থেকেও বরাবর রোহিত দলছুট
অন্যমনস্ক। পাশের হাসাহাসি খাস্তাখিস্তি কানে ঢোকেনা। বড় গাড়ি, স্টিয়ারিং সায়নের
হাতে। চিড়বিড় করে উঠছে সায়ন, 
-শালা এখানে লুঙ্গি, হাওয়াই চটি পরে আসা উচিত!
সরু ঘিঞ্জি রাস্তা প্রায় অলিগলি। গরু থেকে বাস পাশাপাশি। রাস্তার একদিকে বাজার,
ছত্রাকার জঞ্জাল। ফুটপাথ ঘিরে ধুলোমলিন নীল-সাদা গ্রিল। অন্যদিকে আদ্যিকেলে রং-চটা
বসত বাড়িসব, একতলা, দোতলা। ছাতে শায়া, লুঙ্গি বা বাচ্চার জামা। এখানে ঠাকুর্দার
ক্যামেরায় তোলা কলকাতার সাদাকালো টুকরো রঙিন চেহারা নিয়ে। রোহিতের পায়ের
কাছে এস-এল-আর ক্যামেরা, গোটানো ট্রাইপডের বড় ব্যাগ। নির্বিকার চোখ বাইরে।
আচমকা কোমরে খোঁচা মারল জগ্দীপ,    
-কা বে, খণ্ডহ্রমেঁ হারেম ঢুঁড়তা হ্যায়? মিল গয়া? ক্যামেরা নিকাল দুঁ?
ব্যথা পেয়ে রক্তচোখে ঘুরে দেখল রোহিত। 

রোহিত হাত পাকানোর সময়ে অজস্র এলোমেলো ফোটো তুলত। এখনও জাল ফেলার
মতো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছে। নেই তেমন কিছু। খাপছাড়াভাবে আধুনিক হওয়ার কৃপণ চেষ্টায়
মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের শহর নিঃশ্বাস ফেলল রোহিত,
-স্পট্‌- গিয়েই তুলতে হবে।
ঠিক তখনই গাড়ি জানালার পাশ কাটিয়ে গেল। অন্ধকার একতলা বাড়ির জানালায় মুখ,
ঠোঁটে সিগারেট। চশমা ছিল, না ছিলনা? যেন মনে হল, আগে দেখেছে। বয়স্ক মুখে চিন্তা,
বিরক্তি, বিস্ময়, ঔদাসীন্যের কোনটা ছিল? কিম্বা বাড়ির বাইরে সিগেরেটের ধোঁয়া উড়িয়ে
দিচ্ছে, হয়ত বাড়িতে ধূমপান নিয়ে অশান্তি হয়। 
রোহিতের কাছে ছবির অবজেক্টের তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। 
চিন্তার সমাধান হওয়ার আগে দ্বিতীয়টি ঢুকেছে মগজে, কোথায় দেখেছে?

আধঘন্টার মধ্যে গাড়ি সরকারি গেস্ট হাউসের গেটে। সায়ন পার্কিং প্লেসে ঢোকাচ্ছে।
রোহিত নিজের প্রশ্নের জবাব খুঁজছিল, কথা বলছিল না। ব্যাকপ্যাকগুলো নামিয়ে
ক্যামেরার ব্যাগ সামনে রাখল রূপম,
-ধর এটা। কী ব্যাপার তোর?
-কিসের?
রোহিত রিসেপশনের সোফায় বসল। বাকিরা কাউন্টারে। গৈরিক এসে দাঁড়াল,
-ডাউন যাচ্ছিস মনে হচ্ছে? চল রুমগুলো দেখে নিই।
-আচ্ছা—?
রূপম বলল, মৃণাল সেন এক্সপায়ার করলেন।
-ডিরেক্টর মৃণাল সেন? খুব এজেড্ বাবা বলত খুব, সত্যজিৎ রে, মৃণাল সেন--
-প্রিভিয়াস জেনারেশনের জিনিয়াস। আরো ছিলেন কয়েকজন। 
-হৃতিক না কে যেনও?
-হৃতিক নয়, ঋত্বিক ঘটক

করিডর ধরে রোহিত দু’কাঁধে ব্যাগদুখানা বয়ে বন্ধুদের ছাড়িয়ে সামান্য এগিয়ে গেল।  
চোখের সামনে থেমে থাকা সেই থমকানো জানালাদৃশ্য। বাবা ফিল্ম ম্যাগাজিন রাখে,
দেশী-বিদেশী ফিল্মের বই। সেখানে সাদাকালো, গভীর চোখে মোটা চশমা, অপাট
কাঁচাপাকা চুল, ঋদ্ধ, চিন্তাশীল মুখের রেখা। 
কোন এ্যাঙ্গেলে, শাটার স্পিডে নিলে আজ ছবিটা বেশী জীবন্ত হত? আফশোষে পুড়ছে
রোহিত। অযথা রাগ হচ্ছে সায়নের ওপরে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন