কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১২

সম্পাদকীয়



‘কালিমাটি’ পত্রিকা (মুদ্রিত) বিগত ৩৫ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকার ১০০তম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার আন্তর্জাল সংস্করণ অবশ্য শুরু হয়েছে অনেক পরে। প্রথমে আমরা আন্তর্জাল বা ইন্টারনেট সংস্করণ রূপে প্রকাশ করেছিলাম একটি ব্লগজিন ‘কবিতার কালিমাটি’। ১লা জানুয়ারী ২০১১। ঠিক তার পরের বছর ‘কবিতার কালিমাটি’র পাশাপাশি শুরু করি আর একটি ব্লগজিন ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ৩রা মার্চ ২০১২। আবার তার ঠিক পরের বছর এই দুটি ব্লগজিনকে একসঙ্গে রেখে এবং আরও কয়েকটি নতুন বিভাগ সংযোজন করে আমরা শুরু করি আরও একটি নতুন ব্লগজিন ‘কালিমাটি অনলাইন’। ‘কালিমাটি অনলাইন’এর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৪ই মার্চ। তারপর প্রতি মাসে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে এই ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম বছরের শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হলো। মাত্র এক বছরের এই হ্রস্ব যাত্রায় কিন্তু আমরা পেয়েছি অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার সহযোগিতা, উৎসাহ, প্রেরণা ও ভালোবাসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী অনেক গুণীজন পাঠিয়েছেন আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা। কবিতা, ঝুরোগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, অণু নাটক, চিত্রশিল্প ও আলোকচিত্র পাঠিয়ে ‘কালিমাটি অনলাইন’কে মননশীল এবং সমৃদ্ধ করেছেন শ্রদ্ধেয় লেখক ও শিল্পীরা। বিশেষত তরুণ ও তরুণতর কবি, গল্পকার, প্রবন্ধ-নিবন্ধকার এবং শিল্পীদের টাটকা ও তরতাজা সৃজনশীলতায় ‘কালিমাটি অনলাইন’ এক স্বতন্ত্র উচ্চতা ও মাত্রা অর্জন করেছে। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রথম বর্ষ পূর্তিতে সবার প্রতি জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

প্রসঙ্গত ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগটি সম্পর্কে দু’একটি কথা বলার আছে। ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সপ্তম সংখ্যা থেকে এই বিভাগে অণুনাটক নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি নাটক প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পাঠক-পাঠিকাদের অভিমত আমরা আদৌ জানতে পারিনি। বস্তুতপক্ষে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এই বিভাগটি শুরু করেছি, তা আপনাদের জানানো প্রয়োজন মনে করছি। আমরা সবাই জানি যে, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ কবিতা ইত্যাদির মতোই নাটক একসময় বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল। সেই লেবেডফ, ক্ষীরোদপ্রসাদ, মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, অমৃতলাল বসু থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের মন্মথ রায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেক অনেক নাট্যকারের রচিত নাটক একদিকে যেমন রঙ্গালয়ে অভিনীত হয়ে মানুষকে মুগ্ধ করেছিল, অন্যদিকে তেমনি পাঠ্য রূপেও যথেষ্ঠ সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু ইদানীংকালে বাংলা নাটক রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন ও অভিনন্দন লাভ করলেও, শুধুমাত্র পাঠ করে তার সাহিত্যগত নাট্যরস আহরণের জন্য কোনো পাঠক-পাঠিকাকে আগ্রহী হতে দেখা যায় না। এবং তাই সাহিত্যের অন্তর্গত এই বিভাগের সাহিত্যমূল্য বিশ্লেষণেরও কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। আর ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগটি শুরু করেছি, যাতে বাংলা নাটক পাঠের পুরনো অভ্যাস ফিরিয়ে আনা যায়। বহু দর্শকের মধ্যে বসে নাটকের অভিনয় দেখার যেমন এক ধরনের উন্মাদনা থাকে, ঠিক তেমনি একান্তে বসে নাটক পড়ারও একটা অন্য ধরনের রসস্বাদনের আনন্দ থাকে। সাম্প্রতিক কালে যে নাট্যকাররা বাংলা নাটকের প্রতি দায়বদ্ধতায় নাটক রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন, তাঁদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, আপনারা ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগের জন্য অণুনাটক পাঠান। এবং সেইসঙ্গে শ্রদ্ধেয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন, আপনারা প্রকাশিত নাটকগুলি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত জানান। গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ কবিতার মতোই নাটক পড়াও যে একান্ত জরুরি, একথা আমরা যেন মনে রাখি।

এই সংখ্যার ‘স্লাইড শো’তে যে পাঁচটি ছবি আছে, সেটি একটি সিরিজের অন্তর্ভুক্ত – জন্ম থেকে জীবনের অবসর পর্যন্ত; যথাক্রমে জন্ম, স্বপ্নময় কৈশোর, দুরন্ত যৌবন, প্রৌঢ়তার টানাপড়েন এবং অবসর। এই অনন্য সিরিজের শিল্পী রূপক। তাঁকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।



আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kalimationline100@gmail.com
kajalsen1952@gmail.com


প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675


অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India


<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) সমীর রায়চৌধুরী ও নাসের হোসেন


কালিমাটি ১০০ সংখ্যা



ভূদেব ভকতের করা এমন রঙিন ব্রাশের স্ট্রোক আগে দেখিনি। কালিমাটি ১০০ সংখ্যার প্রচ্ছদে এই ছবি দেখে মন প্রাণ আনন্দে ভরে যায়। সম্পাদক কাজল সেনের লেখা সম্পাদকীয়র প্রথম প্যারাগ্রাফটি এখানে উদ্ধৃত করতে লোভ হচ্ছে –

‘কালিমাটি’র ১০০তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এটা একটা ম্যাজিক সংখ্যা। একটা মাইলস্টোনও বলা যেতে পারে। এই ম্যাজিক সংখ্যা বা মাইলস্টোনকে ছুঁতে পঁয়ত্রিশটা বছর লেগে গেল আমাদের। সময়টা নেহাৎ কম নয়। ‘কালিমাটি’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩৮৬ সালের বৈশাখ মাসে। আজ পঁয়ত্রিশ বছর পিছিয়ে গিয়ে যখন সেই সংখ্যাটির পাতা ওল্টাই, তখন সত্যি সত্যি ভেবে আশ্চর্য হই, এটা কীভাবে সম্ভব হলো! স্বপ্ন দেখছি না তো! বহির্বঙ্গে বসবাস ক’রে, যেখানে প্রতিদিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বাংলা ভাষার প্রসার, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিকে সমানেই গুটিয়ে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে, ভাষা শিক্ষার অভাবে ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য পড়ার কোনো প্রস্তুতি নিতে পারছে না নতুন প্রজন্ম, সেখানে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের এত বছর ধরে বেঁচে থাকা, আমাদের মনেও এনে দেয় এক আশ্চর্য চমক, মুগ্ধতা। আমরা উপলব্ধি করি, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে আমরা কখনও বিচ্যুত হইনি। এবং সেইসঙ্গে আমরা চেষ্টা ক’রে এসেছি, ‘কালিমাটি’কে কীভাবে আরও মননশীল ক’রে তোলা যায়, কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায় বৃহত্তর বৃত্তের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে”।

প্রথমেই যে কবিতা, সেটি স্বদেশ সেনের। ‘দারুবসন্ত’ কবিতাটিতে মদ্যপানরত নাটুবুড়োর থলি ভরেনি, পাহাড় চেয়ে পাথরে মিটে গেছে সাধ এবং ধানজমিকে প্রণাম, “সস্তায় গান বাজছে বাহারে”। প্রভাত চক্রবর্তীর ‘দ্রোহ’ কবিতায় “মরশুমি হাওয়ায় মাথা নাড়ে সবুজ পাতারা / - চলবে না, চলবে না”। ভূমেন্দ্র গুহ’র ‘তিন বার’ কবিতাটিতে “অভিশপ্ত শরীরের অভিশাপ শোক হচ্ছে আগুনের পবিত্র নির্মোকে”। সুবীর সরকার তাঁর ‘আখ্যান’ কবিতায় লিখেছেন – “রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিদের ডানার নিচে কাচপোকা, ফড়িং”। বারীন ঘোষালের ‘তরীভাস’ কবিতায় – “মানুষমারা জঙ্গলের ওপর দিয়ে / বিলিয়ে মধুবিষের স্মৃতি / মৌমাছির ডেডবডি দেখে মনে পড়ে গেল”। সুকুমার চৌধুরীর ‘মহিমা’ কবিতায় – “কাদাবিছানায় পদ্মকে প্রতিষ্ঠা করে / সে কোন্‌ মুক্তির কথা বলে?” অনিন্দ্য ঘোষের ‘অন্ধকারে আগ্নেয়’ – “দেখেছি এক শীর্ণ কিশোর মৎসকন্যার সমাধিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে জলের অন্ধকার...”। রত্নদীপা দে ঘোষের ‘কবিতাওয়ালা’য় – “একটি গাছ যেন উপরে ফেলে দিল চুনরির গায়ে স্টেপল করা হাজারখানেক উশ্রী। পাঠক ভুল বুঝবেন না। উশ্রী নদী নয় কোনো, শিরীষের সালোয়ারে অন্য কামিজের ঘোরানো সিঁড়ি...”। দেবযানী বসুর ‘ইউবাঁক’ শীর্ষক প্রথম কবিতায় – “ঢিপিরা অনাথ... চিরকাল ন্যাড়ামাথা”। দ্বিতীয় কবিতায় – “আমরা কেউ কেউ নন্দনের মুক্তপীঠে ছড়ানো চায়ের ভাঁড়”। অলোক বিশ্বাসের ‘সম্পর্ক’ কবিতায় – “ট্রলারগুলো ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে নার্ভ সিস্টেম ও উচ্চফলনশীল ফসলের সম্পর্ক রচিত হয়”। তন্ময় ভট্টাচার্যের ‘বিপন্ন সভ্যতা’ – “সেই বিংশ শতাব্দীর বর্ষাতি, সেই / সভ্যতার ছাউনির তলায় হয়েছিল / আমাদের প্রথম সহবাস”। সাঁঝবাতির কবিতা ‘দহনের দিন’ – “চুম্বন দূরত্ব জমে থাকে তোর / ঠোঁটের ওপর। নরম ঘাম”। দেবরাজ চক্রবর্তীর ‘মানুষ পাখির মতোন উড়তে পারে না’ কবিতাটিতে – “পুরুষদের দল, সন্তানের গালে চুমু খেয়ে / লাল বাতিওয়ালা কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়ে”। রমিত দে’র ‘অনুসরণ’ কবিতা – “এ পর্যন্ত জেনেই লাফিয়ে ধানক্ষেতে নামলাম / এখন আমরা দেখব কেঁচোর দেহে মাটি কেমন ঘুমোয়”। রঞ্জন মৈত্রর ‘মেসেজ’ – “আর পথগুলি ওহো বৃষ্টি নোকিয়া”। দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ শীর্ষক প্রথম কবিতায় – “এখন বালিতে কোনো ঘোড়া নেই”। দ্বিতীয় কবিতায় – “দূর থেকে, ভাটিয়ালি গেয়ে ওঠে / রক্ত-মাংসহীন চাঁদের নাবিক”। বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের ‘আলস্যের দিন’ – “আলস্য যে সম্পূর্ণ আকাশ, বিস্তীর্ণ বাতাস, আর”। উমাপদ কর-এর ‘যখন আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা’ কবিতায় – “নিজেকে এক নির্জনতায় ফাগুন নির্ভরতা দেওয়া”। প্রণব পালের ‘ফাইনিজের ধুন’ কবিতায় – “গৃহপালিত নিসর্গের ব্যক্তিগত সর্বনাশ জুড়ে”। অনুপম গুপ্ত-র ‘নীললোহিতের চোখের সামনে’ কবিতায় – “এখনো ছায়াঘন পৃথিবীর বুকে”। স্বপন রায়ের ‘আবহাওয়া’ কবিতাটিতে – “রঙ এক ধারণায় এসে জিরোন”। শংকর লাহিড়ীর ‘সেই বাড়িটার রঙ’ – “কেননা শব্দই আমাদের ধারণ করেছে সেই”। অমিতাভ মৈত্র’র ‘ইস্কাপনের রাজা’ কবিতায় – “আমার হেরে যাওয়া যুদ্ধমোরগ লাল হয়ে যায়”। দেবরাজ রায়চৌধুরীর ‘স্বীকারোক্তি’ – “যদিও কবিতা না লেখা সময় থেকে / কবিতা লেখা সময় পর্যন্ত”। প্রভাত মিত্র’র কবিতা ‘মানচিত্র’ – “আঁকাবাঁকা গন্ডির মাঝে, এই অনুরতি”। অজিত বাইরীর ‘অসতী’ – “আর হিলহিলিয়ে সাপের মতো কাঁপে বাঁশপাতা”। ধীমান চক্রবর্তীর ‘যাত্রা’ কবিতায় – “বই না খুলেও আলুথালু জলের জন্মদিন”। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অশেষ’ কবিতাটিতে – “ফুরায় না কোনো অন্ধকারে”। দ্বিতীয় কবিতা ‘সরল’ – “শহরও ফুরিয়ে যায় এইখানে, শেষে”। উদয় চট্টোপাধ্যায়ের ‘উত্তর সত্তর’ কবিতায় – “আউটার ইলেক্ট্রন হয়ে বসে থাকি”। নবেন্দুবিকাশ রায়ের প্রথম কবিতা ‘ল্যান্ডস্কেপ’ – “একটাও পাখি শব্দ করছে না...”। দ্বিতীয় কবিতা ‘একটি স্টুপিড সন্ধ্যায়’ – “বেদনার গন্ধ বোরোলিনের মতো”। তৃতীয় কবিতা ‘ফেব্রুয়ারীর তিন তারিখে দেওয়াল যেরকম থাকে’তে আমাদের প্রাপ্তি – “সম্ভবত গুপ্তপ্রেম ও বাজেট”। ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর ‘বৃষ্টি’ – “একটা ঘাসের জন্ম”। সুমিতরঞ্জন দাশ’এর ‘সুইসাইডাল’ কবিতায় – “রক্তে মিশে আছে সব সমানুপাতিক হারে...”। ঊষসী ভট্টাচার্য’র ‘আত্মজ’ কবিতায় – “আজ তোমায় ডাকছি”। সোনালি বেগমের ‘জ্বালানি’ কবিতায় – “মহাবিস্ময় উন্মুক্ত দরজার কপাট খন্ডিত পরিণতি”। শমীক ষান্নিগ্রাহীর ‘পরিচিয়’ কবিতায় – “আনুষঙ্গিক নদী রং বদলালো”। তানিয়া চক্রবর্তীর ‘দূষণ’ কবিতায় – “কিছু আলো কিছুদূর অবধি তোমাকে দেখায়”। মধুছন্দা মিত্র ঘোষ-এর ‘কলাবতী’ – “দীর্ঘ ভণিতায় কলাবতী আদলে / চিহ্নিত ছিল অভিমান”। উল্কার ‘ডটস্‌’ কবিতায় – “ষোড়শী প্রেরণা / বিছানা রোমিং / ও টয়ট্রেন / পেরোচ্ছে মহারাষ্ট্র / মাড়ওয়ার / মহেঞ্জোদারো!” অরূপরতন ঘোষ-এর ‘মাথানগুড়ি’ – “দেখা গিয়েছিল রঙের প্রাচুর্য, ক্রমিক নদীতীর”। প্রণব বসু রায়-এর ‘ঘন ঘুম’ – “নক্ষত্রের হিসেব জানা নেই, কৃষ্ণরাত্রির যামে”। বিশ্বজিৎ-এর ‘ওরিজিনাল’ – “ঘোড়ার শব্দে হুমড়ি খাওয়া বত্রিশটা সিংহাসন”। সব্যসাচী চন্দ’র ‘দেহ ভেসে যায় উৎসবে’ – “আলপথ পেরিয়ে আসা জন্মান্তরের আবহ”। রোশনি ইসলাম-এর ‘ছুটির শৃঙ্খলে’ কবিতায় – “মুঠোফোন বিদেশী বন্ধু আত্মীয়স্বজন”। সব্যসাচী হাজরা-র দীর্ঘ কবিতা ‘ক্রস ও খৃষ্টবীণা’ – “ডোরাকাটা মানুষের বেদানা বাগান”।

প্রতিটি কবিতাতেই অনুভবের মণিমুক্তো ছড়ানো আছে। তাঁরা প্রকৃতির নিহিত সত্তাকে সংযুক্ত করেছেন, আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন রকম দ্যোতনা ও দিকচিহ্ন।




এবার আসা যাক গল্পে। অসাধারণ সব গল্পের কিছু স্পর্শ তো উচ্চারণ করতেই হবে এই অনতিদীর্ঘ প্রতিবেদনে। বাংলাভাষা এবং বাংলাকবিতা সম্পর্কিত গল্প, তাই সমীর রায়চৌধুরী তাঁর গল্পের নাম দিয়েছেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। সেখানে ফার্সি শব্দের প্রসঙ্গ, গণিতজ্ঞ মিহির চক্রবর্তীর গণিতচর্চা, শব্দের ম্যাজিক এবং অধুনান্তিকতা। গল্পের শেষ দুটি বাক্য লক্ষ্যণীয় – “প্রত্যেক মানুষ কি তাহলে মানুষিক শব্দের মতো নিজেই জাদুকর! রেলিং-এর ওপারে মাইম-অভিনয়, মানে মূকাভিনয় শেখানো হচ্ছে”। মলয় রায়চৌধুরীর ‘পৌঁছে-যাওয়া মানুষ’ আসলে এমন এক মানুষ, যিনি “পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয়”। মলয় জানিয়েছেন, “মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে। সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে”। আসলে সেই সাধু সন্তটি হলো বুন্দেলখন্ডের এক ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার তার মাথার দাম রেখেছে এক লক্ষ টাকা। সরকারী কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাজে পরিদর্শনে গিয়ে এই ডাকাত সর্দারের সঙ্গে দেখা হয় লেখকের। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘অথ মানুষ-কথা’ গল্পটি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজ দৈনিকের সংবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। হুবহু খবরটির ভাষান্তর ঘটানো হয়েছে। ১লা জুলাই ১৯১৩, সোমবার, জনৈক মার্কিন ডাক্তার জানালেন, কয়েক যুগ ধরে যত্নে রাখা একটি কাটা হাত আসল মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। একজন ভিয়েৎকং গেরিলাযোদ্ধার হাত। প্রায় চল্লিশ বছর আগে, ভিয়েৎনামের রণক্ষেত্রে এই হাতটির জরুরি ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্র গুহ’র ‘জাফর আলি ফুট ফুট কর রোঁয়ে’ গল্পে অসুস্থ জাফর আলিকে আরোগ্যলাভের নিদান দিয়েছে এক ফকির – তিনকুড়ি মুরগি হালাল করনি পড়েগি। জাফর আলির বিবি এককুড়ি মুরগি জোটালো। এক মাস পর মুরগিরা আন্ডা দিল। বাচ্চা হলো। দিন যায় মাস যায়। আবার মুরগিরা আন্ডা দিল। বাচ্চা হলো। বাচ্চাগুলো জাফর আলির দিকে আড়ে আড়ে তাকায়। যথা সময়ে তিনকুড়ি মুরগি হালাল করার জন্য যখন চাকু হাতে তিনজন যুবক তৈরি, জাফর আলি নিষেধ করলো মুরগিগুলোকে মারতে। রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মালিকানা’ গল্পে বিতান ও অঞ্জু লিভটুগেদার থেকে পৌঁছে গেছে শুভবিবাহে। মানসিক পরিবর্তনগুলো চমৎকার ফুটেছে। শ্রাবণী দাশগুপ্ত’র ‘জনাদুই নিঃসঙ্গ’ গল্পে – “নিশিগন্ধা এবং ধীমানের সহসম্মতিতে আইনি বিচ্ছেদের পর নাবালক রিদমের অধিকার রইল তার মায়ের”। উইলহেম এবং ধীমান – দু’জনেরই একসময় পরিবার ছিল, বিচ্ছেদের পর নিঃসঙ্গ। অলোকপর্ণার ‘মনে মনে’ গল্পে – “সুদিনের কোনো অসাধারণত্ব নেই। তাই নেই কোনো গল্পও। সে তার সাধারণ জীবনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে”। লিপিকা ঘোষ-এর ‘উড়ান’ গল্পে সাহারুলের আব্বা জীবন্নেষার সঙ্গে সাহারুলের বিয়েতে মত দেয়নি। ফলে জীবন্নেষার ফুফাতো বহিন রোশনারার সঙ্গে নিকাহ করলো সাহারুল। চার বছর পর দেখা। ততদিনে পঞ্চায়েত অ্যন্ড রুরাল ডেভলপমেন্টে চাকরি করছে জীবন্নেষা। এবার সরকারি উদ্যোগে জীবন্নেষাকে পাঠানো হবে বিশ্বের দরবারে। অনিশ্চয় চক্রবর্তী’র ‘এক স্বকীয়া প্রেমের গল্প’তে চিঠির আকারে এক পুরুষ আর এক পুরুষকে জানাচ্ছে – ‘তোমার দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনো পরকীয়ার নয়, বরং গভীর এক স্বকীয়ার। তার সঙ্গে আমার জীবনচেতনা ও বোধ, অনুভব, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সৌজন্য, শরীর ও মনের সাহচর্যের, বিনিময়ের যে অসাধারণ মিল, সেই মিলনকে কিছুতেই পরকীয়া বলা যায় না”। অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘ইন্দ্রযোনি’ গল্পে – “হেম... বলতেই পারি তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এক কলোনিয়াল নাম। ঢের বেশি শ্যামলীর চেয়ে। শ্যামলী নাম্নী মেয়ে বিধবা হয় না। হেম-রা হয়”। অচিন্ত্য দাশের ‘পাঁঠার মাংস’ গল্পে, সত্তর বছর বয়সী সাধারণ মধ্যবিত্ত রাখালবাবুর জীবন ও ভাবনাপ্রবাহের কিয়দংশ। সুপ্রিয় বাগচীর ‘থ্রি ডাইমেনশনাল ভীমরতি’ গল্পে অনুপম, অনিন্দ্য, উপমা – এই তিন চরিত্র নিয়ে মৃত্যুযোগের খেলা। নীতা বিশ্বাসের ‘কিছু পলাশের নেশা’ গল্পে তমাল, অনন্যা এবং একটি বাথটব, গল্প বয়ে গেছে অজানা এক পরিণতিতে। ভূদেব ভকতের ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়াক’ গল্পটি শেষ হয়েছে এইভাবে – “নাতি রুহান একছুটে বিয়ের কার্ডখানা নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে উদগ্রীব চোখে চেয়ে থাকলো শেষটুকু শোনার জন্য। আমি বললাম, সেই যে ফুলদানির সঙ্গে সন্দীপনের শিশুকন্যা বসুন্ধরার ছবি তুলেছিলাম, সেই বসুন্ধরা বড় হয়েছে। আজই তার বিয়ে। এবার সময় এসেছে ঐ ফুলদানির নিজের ঘরে ফিরে যাবার। সুন্দর এক রঙিন কাগজে মুড়ে আজ সন্ধ্যায় বসুন্ধরার হাতে তুলে দেব তারই মায়ের বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া সেই সোনালি ড্রাগন আঁকা লালরঙের ফুলদানিটি”। সুবিমল বসাকের ‘আধিব্যধি সংক্রান্ত’ গল্পে বিহারীদের চোখ ওঠা ‘আঁখ আনা’য় ছটপট করছে বাচ্চারা আর চলছে তাদের চিকিৎসা। তেমনি খোস-পাঁচড়া-খুজলি, তারও চিকিৎসা। বড়দের দাদ ও চুলকানি – তারও চিকিৎসা। আম-বিহারীদের জীবনের এক অন্যদিক তুলে ধরেছেন লেখক তাঁর গল্পে। কাজল সেনের ‘খেলা’ গল্পে – রণজয় ও চন্দ্রিমার একটা গোপন খেলা আছে, আজ রণজয় অপেক্ষা করছে সেই খেলায় একটা অন্য রঙ আনার জন্য। কিন্তু চন্দ্রিমা আসছে না। হরনাথবাবু ইদানীং অদ্ভুত একটা খেলায় মেতেছেন। ছেলেবেলা খুঁজে দেখা। পুরনো পাড়ায় পৌঁছে দেখলেন সব বদলে গেছে। রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কর্ণার্জুন’ গল্পে – কর্ণ এবং অর্জুনকে পৃথক চিঠি বা আত্মগত চিঠিতে প্রণিপাত আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন কৃষ্ণা বা দ্রৌপদী।

প্রতিটি গল্পই বিভিন্ন মানসিক এলাকা থেকে উদ্ভূত ও নিজস্ব পরিসরে পরিবেশিত হয়েছে।



বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়


প্রভাতরঞ্জন রায় প্রণীত ‘বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়’ পুস্তিকাটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে – উত্তর ভারতীয় কথাসাহিত্য সম্মেলন ১৯২৩ সালে বারানসীতে হয়েছিল ৩ থেকে ৫ মার্চ। এবং এরকম নানা তথ্য। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক-প্রস্তাবিত বর্ণ-সংক্ষেপ বিন্যস্ত রয়েছে। পরের পৃষ্ঠাতেও রয়েছে তাঁর আর একটি প্রস্তাব, নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কিত। পরবর্তীতে বিবৃত করা হয়েছে ১৯২৩ সালের প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্যগুলি। ১৯২৩ সালের উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য প্রথম সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বছরেই ডিসেম্বর ২৬-২৭ যে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন এলাহাবাদে হয়েছিল, সেখানে সভাপতি ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়; কিন্তু তাঁর অসুস্থতাহেতু এসেছিলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ।

UNESCO-র বার্ষিক অধিবেশনে সমাগত সুধী-সান্নিধ্য লাভের জন্য ১৯৫৬ সালের ১-৩ নভেম্বর ৩২তম অধিবেশন হয় আগ্রায়। সেখানে সভাপতি হুমায়ুন কবীর তাঁর ভাষণে বলেছিলেন – “আকবরের দরবারে নানা দেশের নানা ধর্মের নানা ভাষাভাষী সুধী ও পন্ডিত ধর্ম ও দর্শন নিয়ে বিচার করেছেন – আমাদের এই সাহিত্য সম্মেলনও তাই...”। শ্রীমতি আলভা মার্দেল (সুইডেন) বলেছিলেন – “একদা যৌবনকালে আমার বাগদত্তা প্রণয়ীকে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’ উপহার দিই, তার বদলে তিনি ‘চিত্রা’ উপহার দিয়েছিলেন। দুটিই ছিল সুইডিশ তর্জমায়”।

প্রভাতরঞ্জন জানিয়েছেন – “বাংলাসাহিত্য ও বাঙালির জীবনবোধে নিহিত সাংস্কৃতিক চেতনায় বিশ্বমানবতাবোধের উপস্থিতি স্বীকৃত সত্য। সাত দশক আগে গৃহীত সম্মেলনের উদ্দেশ্য উক্ত বোধের দ্বারা প্রাণীত বলেই এখনও সমান প্রাসঙ্গিক”। প্রাসঙ্গিক সংযোজনে শ্রীরায় জানিয়েছেন – “ভাষা বংশলতিকা এবং ইতিবাচক বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর কোনো ভাষাকেই বিদেশি ভাষা বলবার যুক্তি খুঁজে পাই না”।

এই পুস্তিকায় শ্রীরায় ভারতীয় ভাষার উৎস ও বিকাশ সম্পর্কে যেমন জানিয়েছেন, তেমনি বাঙালি জাতির উদ্ভব বিষয়টিকেও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন, সেইসঙ্গে জানিয়েছেন সংস্কৃতি বলতে আসলে কী বোঝায়।

০২) রমিত দে


গখ ও গঁগ্যা : একটি আততায়ী আত্মীয়তা


ছবিটা ছিল একটা কাঠের আর্মচেয়ারের। বাদামি আর গাঢ় লাল। সবুজ খড়ের বসার জায়গায় লোকটি নেই শুধু। লোকটির থাকার কথা ছিল অথচ লোকটি নেই
, আর তার অনুপস্থি্তির জায়গায় বসানো মোমদানে একটি মোমবাতি; পাশে কয়েকটি জেগে থাকা উপন্যাস। শূন্যতা সুস্পষ্ট অথচ আলোয় কি দেখানো হলো রিক্ত প্রখর এক   শুন্যতার মাঝেও কোনো এক প্রাণ ও প্রজ্ঞার আশ্চর্য সমুচ্চয়! ১৮৮৮তে ভান গখ এমনই একটি ছবি এঁকেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন গঁগ্যাস আর্মচেয়ার স্যাঁ রেমির উন্মাদআশ্রম থেকে অসুস্থ নিঃসঙ্গ গখ  আলব্যের অ্যরিয়েরককে চিঠিতে লিখেছিলেন --“গঁগ্যা, সে এক বিচিত্র শিল্পী, এক আশ্চর্য মানুষ, যার চেহারা আর চালচলন দেখলে গালেরি লাকাজ-এ রেমব্রান্টের পোর্ট্রেট অফ আ ম্যানএর কথা আবছা মনে পড়ে। সে এক অদ্ভুত বন্ধু, যে অন্যদের এই কথা অনুভব করাতে চায় যে, একটা ভালো ছবি আর একটা মানবিক সুকৃতি প্রায় সমার্থক। এ যে শুধু মুখের কথা তা নয়, বস্তুত তার সঙ্গে থাকলে এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে উদাসীন থাকা অসম্ভব।আমাদের বিচ্ছেদ ঘটার কিছু দিন আগে, যখন অসুস্থতার কারণে আমি উন্মাদাশ্রমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম ওর শূন্যস্থানটা আঁকার এ কোন শূণ্যস্থান? একজন শিল্পীর ফেলে রাখা অনুভূতি ও জীবন, নাকি অন্যজনের খুঁজে না পাওয়া আত্মসমীক্ষণ! গঁগ্যার ছেড়ে যাওয়া চেয়ার আঁকার মধ্য দিয়ে আমরা জানি না নিজেরই রক্তপাত মোছার চেষ্টা করলেন কিনা গখ, কিন্তু এ যেন চেনা  অচেনার মধ্যে দিয়েও  আমাদের নিয়ে চলল শিল্পীর ভেতরের জীবনের দিকে, বিশাল এক প্যারাডক্সের দিকে, হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকা অ্যান্টিক এক আঁধার-মানুষের দিকে। মানুষের মন - সে সীমিত নয় বরং স্বচ্ছন্দচারী, দর্পনের মতো সে নিজেকেই  পড়তে চায় বারবার আর প্রতি মুহূর্তেই আঁকড়ে ধর আরো কিছু কুয়াশাময় মানুষের  হাত পা তথ্যচিত্র। আর গখের মতো শিল্পী হলে তো কথাই নেই, যিনি জন্মের মুহূর্ত  থেকে তীব্র চিৎকার করে উঠছেন বঞ্চিত পৃথিবীর দিকে, একজন শিল্পী যেন গতজন্মের রাস্তায় এসে পড়ছেন আর সেখান থেকে বর্হিগমণের পথ খুঁজে চলেছেন। যতক্ষণ এই খোঁজ ততক্ষণই সে এক জীবিত রহস্য। এক অরচিত ফর্মূলা শিল্পী শিল্পীকেই নিয়ন্ত্র করতে চায়, আবার কালো গর্তে ফেলে দিয়ে নিজেকেই হাত ধরে টেনে তুলতে চায় শিল্পী। এই অতীন্দ্রীয় রহস্যময় এলাকাই তার নিজস্ব মুক্ত এলাকা। এখানে এসে সে পাগল, সে প্যারানইয়াক, সে পর্যটক। শিল্পী আসলে এক ইমমর্টাল  বার্ডযার কাছে কোনো রওনা নেই, কেবল অপর্যাপ্ত এক রানওয়ে আছে, সেখানে দৌড় জন্মাচ্ছে উড়ন জন্মাচ্ছে গা ঘেঁটে শুয়ে আছে একটা নেইজগত। জীবন ও  মৃত্যুর পাঁজর ফাটানো আঁশটে আছেগন্ধের মধ্যে এই নেইযেন স্পষ্ট করে তুলছে শিল্পীর ক্রমবিবর্তকে, প্রকট করে তুলছে নিজেকে ঘিরে নিজেরই নৈঃশব্দ পাহারাকে। ১৮৮৯এ আরও একটা শূন্য চেয়ার আঁকলেন গখ। তবে এবার বিন্যাসে বর্ণে কিছুটা মলিন ও নির্লিপ্ততা। নাম দিলেনভিনসেন্ট চেয়ার উইথ হিজ পাইপ কেবল আঙ্গিক আলাদা। তেরছা সীমিত আলোময় বাদামী টাইলসের ওপর হলুদ রঙের চেয়ার। সামান্য কাঠের এবং মোটা হাতলের। ছোট্ট রান্নাঘর আর তার নীল ভঙ্গুর দরজার সামনে রাখা সামান্য চেয়ারে কিছু ধূসর কোঁচকানো তামাকপাতা আর একটি ধূলো রঙের নীরব পাইপ। ছবিটার সারা শরীরে দূরবীন কষে কোনো নিরীক্ষা নেই কোনো গথিক কারুকাজ  নেই, কেবল খুব তাড়াতাড়ি রং ঢেলে দেওয়ার নিঃশব্দ তর্জনী। কি আঁকতে চাইলেন গখ? অস্বীকার করতে চাইলেন কোনো একটা স্থানের শূন্যতাকে,  নাকি ভরাতে চাইলেন মিথ্যে আরও একটা মিথ্যে ভরের বিলাস দিয়ে, আর্তি দিয়ে? আসলে ক্ষুধা দারিদ্র্য ব্যর্থতার মতো একাধিক শূন্যের ওজনে গখের শিরদাঁড়া কোথাও  আগেই ভেঙে গেছিল, তিনি রং দিয়ে ভরাট করতে চাইছিলেন দোসরশূন্য  কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। জীবনের শেষ দিন অবধি গঁগ্যাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন গখ, হয়তো কাউকে বলেননি,য়তো সূর্যমুখী আর সাইপ্রেস দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন তাঁর  যন্ত্রণা তাঁর বিচ্ছিন্নতার কাহিনী। কেবলই কি বিচ্ছিন্নতার নাকি শিল্পীর অন্তর্লীন একাকীত্বের কাহিনীও? আর্লে গঁগ্যার সাথে গখের মাত্র আট সপ্তাহের যে নিরুপম প্রেম ও পুড়ে যাওয়া তার শুরু শিল্পের জন্য স্বপ্নের জন্য তাঁদের যৌথ বানানো হলুদ বাড়ি(yellow house)র মিলিত আনন্দ দিয়ে, আর তার সরকারী পরিসমাপ্তি বলতে  গখের কান কেটে ফেলা এবং স্যাঁ রেমির অ্যাসাইলমে দাখিলার মতো মলিন দীনতা  দিয়ে। কিন্তু পরিসমাপ্তিই বা বলি কী করে? বন্ধুত্বে ছেদ পড়লেও জীবনের শেষদিন  অবধি গঁগ্যার শিল্পভাবনাকে আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন ভিনসেন্ট। অ্যাসাইলামে থেকেও ভাই থিওর মাধ্যমে গঁগ্যার ছবি নিয়ে চিত্রকল্প নিয়ে বিচলিত থেকেছেন। ভ্যান গখের নাকি মানসিক অস্থিরতা ছিল, ডিপ্রেশন ছিল, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন একাধিকবার। কিন্তু কেন? আসলে গখের জীবন সরলরখায় মেলানো সম্ভবপর নয়। তার জীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একাধিক মানুষ যাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গখ ভারসাম্য খুঁজেছেন আশ্রয় খুঁজেছেন আর বারবার প্রত্যাখাত হয়েছেন কালো অন্ধকার প্লাস্টারে ঢাকা এই পৃথিবীর কাছে। সংসারে থেকেও হয়ে উঠেছেন অন্ত্যেবাসী। জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা   ছিল নরম ডালের মতো, যা জানতেন না তা হলো ডাল ভাঙলে সাদা কষও বেরোবে। না হলে তিনি গৃহকর্ত্রী কন্যা উশুলের প্রেমে কেন পড়বেন? যে প্রেম উদাসীন, অপাংক্তেয়, বাতিল। কেনই বা সদ্য বিধবা সম্পর্কিত বোন কীভোসকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন, যা সে মুহূর্তে চূড়ান্ত ছেলেমানুষি! আর কেনই বা গখ গঁগ্যাকে  তাঁর নির্বান্ধব আত্মানুসন্ধানের নায়ক করে তুলবেন মাত্র কয়েক মাসে! বোঝা যায় না যাপনের অফুরান সমারোহে শুকিয়ে আসা রক্তের দাগটা ঠিক কোথায়! জীবন আসলে এক ফাঁকা মাঠ, সেখানে হিম পড়ে যাবেই, পাখিরা তুলে নিয়ে যাবে প্রকৃত শস্য। কাঁটালতা জড়িয়ে ধরবে জীবনের ঐশী সংগীতগুলোকে। অথচ পূর্ণাঙ্গ জীবনের খোঁজে  প্রতিদ্বেষ রেখে দিয়ে হাড় রাস্তার দূরত্বে হাতগুলো আমরা আবার জড়িয়ে ধরব। মিথ্যে, মিথ্যে জেনেও এই অনেকটা জায়গা আমাদের আত্মসমর্পণের, সম্ভাব্য অনেকটা অধরার। প্রায় একই সময় একই শিল্পীর আঁকা ছবি দুটোকে পাশাপাশি রাখলে অর্থাৎ ভিনসেন্ট চেয়ারকে বাঁদিকে আর গঁগ্যাস চেয়ারকে ডানদিকে রাখলে সম্পূর্ণ ফ্রেমে  ভেসে ওঠে মুখোমুখি বসে থাকা সাবধানী স্নেহের সংকেত, যেন নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে একগোছা সখ্যতা। অথচ এই একই ছবি কেবল দিক বদল করে দিলেই(অর্থাৎ গঁগ্যাস চেয়ারকে বাঁদিকে আর ভিনসেন্ট চেয়ারকে ডানদিকে) মনে হবে এ ছবি কি তবে পলায়নের ভূমি? স্বপ্ন থেকে সখ্য থেকে বোধ থেকে বেড়া থেকে রোজ রোজ নিজেকে নির্বাসিত করার ভয়ংকর ভাঙা দেওয়াল! বাঁদিকে গঁগ্যাস চেয়ার ও ডানদিকে ভিনসেন্ট চেয়ার রাখলে আশ্চর্যভাবে ভেসে উঠবে একটি নিঁখুত বন্ধুত্বের ধীর মৃত্যু, একটি দেহাতি আত্মহত্যা, সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত, ঠিক যেমন অ্যবের-এর কাছে শালগম আর সাইপ্রেসের কোনো সাহজিক গাঁয়ে খড়ের গাদায় ঠেস দিয়ে ইজেল রেখে বুলেট শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন গখ, ঠিক যেমন হৃপিন্ড থেকে সাঁতার কেটে বেরিয়ে  গেল হেরে যাওয়া এক মানুষের সামগ্রিক গাঁথুনি, মশলা, সিথি কেটে আছড়ানো বন্ধুত্ব কবুল করতে করতে উড়ে গেল আর বলে গেল তুমি একা, একা, স্বেচ্ছানিবার্সিত, এক জীবন থেকে আরেক জীবন ধরে চিরবন্ধুর মিলনে অপারগ।

কিন্তু বন্ধুত্ব কি? মৃত্যুর পরও গখের পাইপ থেকে ধোঁওয়া উঠছিল, নিভতে চাইছিল না আগুন, ঠিক সেভাবেই বন্ধুত্বও কি আত্মপ্রতিষ্ঠ! যেমনি সে প্রাণে প্রবেশ করল ওমনি উঠে দাঁড়াল আর রয়ে গেল? সুখ দুঃখ আনন্দ রতি থেকে তাকে বারংবার চিৎকারের বাইরে যাওয়ার পথ দেখালেও মৃত্যুবধি শরীর থেকে প্রাণ থেকে তার উৎক্রমণ কি আদৌ সম্ভব? শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে সে তো কেবল তার খিদে বাড়িয়ে চলেছে, এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে ঘুরে ঘুরে শাদা হাড়ে সান্ত্বনার জানালা বসাতে চাইছে। সেই সমস্ত খিদে যা কোনোদিনও মিটবে না সে সমস্ত জানালা যা   কোনোদিনও খোলা যাবে না সেই না পাওয়াকে নিয়েই এক নির্জন আমোদে মেতেছে বন্ধুতা। যা থেকে একা হতে পারেননি গখও। কোনোদিনও উচ্চারণ করতে পারেননি –“আত্মৈব হি আত্মনোবন্ধুঃ কেন বলতে পারলেন না, তুমি তোমার তুমি তোমার নিজের গখ! ভিনসেন্ট নিজেকে পাগল মনে করতেন, খুঁজ়ে ফিরতেন মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে, দুমড়ে মুড়ে যাওয়া একটা শরীরকে দেখতে চাইতেন গখ।  তাঁর জীবনব্যাপী দারিদ্র্য যন্ত্রণা বেড়ে ওঠার রুগ্ন কাঠামো তাকে কোনোভাবে একা  করে দিয়েছিল আর এই পলাতক জীবন প্রতি মুহূর্ত ভাসতে থাকা এই প্রবহমান  যাপনই অভ্যেস করে ফেলেছিল কিছু নিঃশঙ্ক হাতের উষ্ণতার অপেক্ষা, যার প্রতিটা  উষ্ণতাই ঢালু পাড় বেয়ে নামতে নামতে তাকে সূর্যাস্তের সম্ভাবনার কথা শুনিয়েছে। এমনকি নিজেকে এক এক সময়ে অসুস্থ শিল্পী হুগো ভ্যান ডারগোজের সাথেও তুলনা করতেন গখ- "I myself have become haggard of late, almost like Hugo van Goes in the picture by Emil Wauters." বেঁচে থাকার বিবিধ পরিস্থিতি সত্ত্বাদ্বৈধের অনিশ্চয়তা আদতে আত্মপ্রবঞ্চনার পথকেই নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে, যা শেষ অবধি ভারসাম্যহীনতা আর স্নায়ুপীড়ার‌ চরম আকার নেয়। অথচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গখ বা গঁগ্যা দুজনেই সম্পর্কের স্থূলকায়া কাঠোমোয় দাঁড়িয়েও আওড়ে গেছেন সমপ্রাণঃ সখা মতঃ! সমপ্রাণ সখা মতঃ! কানাঘুষো হয়েছে তাদেরকে  নিয়ে তাদের সম্পর্ককে নিয়ে গখের কান  কেটে ফেলা এবং স্থানীয় বারবণিতাকে রক্তাক্ত কাটা কান উপহার দেওয়া নিয়ে, অথচ  কেউ একটিবারের জন্যও কারোকে দোষারোপ করেননি, এমনকি গখ বারংবার ভাই  থিওকে পত্রপাঠ জানতে চেয়েছেন গঁগ্যার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, গঁগ্যার কুশল। আসলে জীবন  যখন হাতের মুঠো থেকে আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়ছে তখনই গখ খুঁজেছেন গঁগ্যার শিল্পসান্নিধ্য, আত্মিক সংকটে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন হোয়ার ডু উই কাম ফ্রম? হোয়ার আর উই? হোয়ার আর উই গোয়িং টু?”এর স্রষ্টাকে। গঁগ্যার বহুপরিচিত একটি মন্তব্য ছিল- “A deep feeling can be interpreted instantly, dream over it, seek its simplest shape”-, আর গখের মতো জীর্ণ নিঃসঙ্গ মানুষটার কাছে গঁগ্যাই ছিলেন এমনই এক স্বপ্ন অবধি পৌঁছানোর  মীড়টুকু। গখ ও গঁগ্যার সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল সে প্রসঙ্গে শেষ অবধি যে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় সেটাই স্বাভাবিক, কারণ বন্ধুত্বের বোঁটাগুলো ঝুলে  আছে বিস্মরণের দিকে, সেখানে সমপর্ণের গল্পটা গলায় কুয়াশার স্কার্ফ জড়ানো একটা  মিথ, দুটি মানুষকে যা নিয়ে চলেছে স্বপ্নের দিকে সংগীতের দিকে, মৃতসঞ্জীবনীর মতো  মিথ্যেই হয়তো তাকে হাতছানি দিচ্ছে তবু কাকে সংজ্ঞায়িত করবে এ অমোঘ  যাত্রাসূচী? কে জানে মহাকালের মাঝে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা এতসব অজানা হল্ট!  Nancy Mowll Mathews তাঁর নতুন বই Paul Gauguin: An Erotic Lifeএ গঁগ্যার  সমকামীতা ও বাইসেক্সুয়ালিটির প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং তাঁর একাধিক ছবির ব্যাখ্যায় তুলে এনেছেন যৌনতার প্রতি তাঁর কালচে হিংস্র মনোভাব। স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য এবং বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে গঁগ্যার লস অফ ভিরজিনিটি বা ম্যান উইথ অ্যাক্স এর মতো ছবিগুলোতে স্বীকৃত যৌনতার বাইরে এক ধরনের উন্মুক্ত যৌনবিকারই প্রতিনিধিত্ব করছে বলে ম্যাথিউ মোওলের ধারণা তাঁর মতে, বন্ধুত্বের নার্সিসাসের  থেকে বন্ধুত্বের স্থূল নগ্নতায় ছিল গঁগ্যার অবাধ অনুষঙ্গ এবং গখের ধীর আকর্ষণে  অন্যতম কারণও হয়তো এই ছন্নছাড়া মায়াবী যাপন, পাঁচ বছরের বড় একটা উঁচু নিচু বুকে নিশ্চিত মাথা রাখা। তবে এসবই ধারণা, বিমূর্তন, যা বন্ধুত্বকে ছুঁতে গিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ব্যথা অবধি ব্যর্থতা অবধি। কেবলই কি সমকামী সম্পর্কে বেঁধে রাখা যায় এমন একটা সম্পর্ক? বোধহয় না। হলুদ বাড়িছিল গখের স্বপ্নের টুকরি, মানুষ যেভাবে বাড়ি ফেরে তাঁর স্বপ্ন তাঁর সম্ভাবনা ক্ষুদ্র আলো ধরে, ছবিকে নিয়ে তাঁর নিত্য নতুন উদ্বিগ্নতা, ঠিক তেমনি মাটির পোকার মতো ফিরে ফিরে আসত ওই  রংপুরীতে। বৈষয়িক ছিলেনা গখ, জীবন সম্পর্কে গখের ধারণা ছিল তাই  ময়নাবনের মতো টিয়াবনের মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া-- রং কিনতেন প্রয়োজনের  তুলনায় অনেক বেশি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেন প্যালেট আর তুলি। আর গঁগ্যা এসে গুছিয়ে রাখতেন সমস্ত কিছু। কোথাও নিজের অজান্তেই গঁগ্যার ভেতর গখ খুঁজে নিয়েছিলেন এক ধরনের আশ্রয়ী মানসিকতা, মিথোজীবিতা। দীনতা আর অভাবের থেকে বেরিয়ে এসে অপরিচিত আবশ্যিক এক থাকা। বাবার সাথে কোনোদিনই বনত না গখের, আর তাই গঁগ্যার অভিভাবকত্ব গখের সামনে খুলে   দিয়েছিল একজন মাস্টারফুল ম্যান-এর পরিপাটি মিউজিক রুম। এমনকি হলুদ  বাড়িতে চিত্রভাবনা সম্পর্কিত মনোভাবের বাইরেও তাদের পারস্পরিক বন্ধুতা বিশ্বাস আর নির্ভরতা ফুটে ওঠে গখের লেখা ছোট ছোট অমূল্য চিঠিগুলোতে। বার্ণাডকে গখ লেখেন- “Gauguin interested me much as a man-much. It has seemed to me for a long time that in our dirty job as painters we have the greatest need of people with the hands and stomachs of workmen and with more natural tastes-and temperaments more loving and charitable-than the decadent and dandified men of the Paris boulevards. Now here without the slightest doubt one finds oneself in the presence of a virgin-being with the instincts of a savage. In Gauguin blood and sex prevail over ambition”জীবনভর শিল্পী হিসেবে মানুষ হিসেবে যে সামান্যতম স্বীকৃতির ীৎকার, ভিখিরির মতো মনের কাছে নাড়ীর কাছে যে বারবার আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়া, তাই যেন গঁগ্যার কাছে এসে হলুদ বাড়ির কাছে এসে খুঁজে পাচ্ছিলেন ভিনসেন্ট। এসময় গঁগ্যা তাঁর কাছে একজন পেন্টার থেকে প্রোটেকটর হয়ে উঠেছিলেন। আসলে সম্পর্কের সাথে আমাদের নিরন্তর লড়াই। যা নেই তাকে আমরা খুঁজছি ঘনিষ্ঠ কোনো থাকাতে। যা আছে তার ভেতর ঘু ধরছে, পাতা ঝরছে, মাটি তুলে তুলে কী ভয়াবহ ফাঁক করে দিচ্ছে রংচটা চেতনা।  

অ্যারিস্টটল থেকে দেরিদা, অথবা রবীন্দ্রনাথ থেকে আয়ুব-সখ্যতা প্রসঙ্গে বন্ধুতা প্রসঙ্গে চূড়ান্ত শান্তির পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে অন্তঃর্নিসহয়তার কথাও। একদিকে দেরিদাকে বলতে শুনি-“O my friend,  there is no friend”, আবার অন্যদিকে গালিব বলে ওঠেন-“লমহা লমহা করকে জিন্দেগী বানায়ি/জিন্দেগী বানায়ি তো দোস্তি কি ইয়াদ আয়ি/দোস্তি কো ঢুন্ডা
তো তুমকো পায়া--দোস্ত/অউর তব সে ইয়ে জিন্দেগী তুঝমে সিমট গায়ি/” -যেন বেড়ার গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে বন্ধুত্বের হাতছানি। কিন্তু বন্ধুত্ব কি! কোথায় বা লেগে থাকে এমন এক বেকুব ভাষা, এমন এক বৃহৎ জিজ্ঞাসা! শিল্পী বরাবরই অভিমানী, আত্মবোধে কিছুটা হলেও অহংকারীও। ফলে শিল্পের বন্ধ্যা কালিকে পেরিয়ে আসতে যেমন তার বন্ধু হয়, তেমনি তার স্বাধিকার কখনও কখনও অতিক্রম করে সখ্যতার সান্নিধ্য। শরীর তো একই থাকে।  চোখ দিয়ে দেখে বাক দিয়ে কথা কয় কান দিয়ে শোনে, তবে কোন্‌ দাবীতে গোঁসা করে ঝুঁটি নাড়াতে নাড়াতে বন্ধু ফিরে যায়? যে  নিঃসঙ্গ শরীর শাশ্বত সখ্যের কথা  বলে, সেই আবার স্বাতন্ত্র্যময় হতে চায়। অ্যারিস্টটলের Nicomachean Ethics যে তিন রকমের সখ্যতার কথা বলে, অর্থাৎ প্রয়োজনের বন্ধু, সখের বন্ধু আর প্রকৃত ভালোবাসার বন্ধু তাদের শরীরী ভাষা পৃথক এবং মানসিক পিপাসাও পৃথক। আর তিন বন্ধুতার শুরুয়াৎও পৃথক। আর্লে গখ এসেছিলেন শিল্পের নতুনের খোঁজে। চেয়েছিলেন নিভৃতে শিল্পচর্চার জন্য সমমনোভাবাপন্ন আরও কিছু সখ্য বন্ধু, বাঁচার পরিসরটিকে তীব্রভাবে সুস্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন গখ আর সেখানে তাঁর ও ভাই থিওর বন্ধু গঁগ্যা হয়ে উঠেছিলেন সেই সুবিবেচিত কান্ডারী। যার সাথে দ্বিধা ও সংকোচ পেরিয়ে মনের কথা বলা যায়, ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পের উৎস থেকে বুৎপন্নে পৌঁছানো যায়। দিনের পর দিন গঁগ্যার সান্নিধ্যে নিজেকে খুঁজেছেন গখ, তাঁদের হলুদ বাড়িতে মদ্যপান করেছেন দুজনে একসাথে, রঙ আর প্যালেটে  নিজেকে নিজের সৃজনী অনুভূতিকে গুলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের যাবতীয় সম্পর্কেই এমন কিছু সুগভীর লেগে থাকে, যা এক থেকে তাকে বয়ে নিয়ে চলে সফেন বহুধায়। শিল্পের লালা দিয়ে জুড়তে চাওয়া সম্পর্ক গখকে ছেড়ে দিয়ে গেল সখ্যতার গভীর বনে। অথচ গঁগ্যা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন ইম্প্রেশনিজমে তাঁর মৌলিক শিল্প প্রতিষ্ঠিত নয়, শিল্পী এমিল বার্ণাডের সংস্পর্শ তাকে শিল্পের আরও সরলীকৃত স্বরূপটির দিকে নিয়ে চলে; বস্তুকে বস্তুর বাইরে ছবিকে ছায়ার বাইরে নিয়ে আসাতেই পথ খুঁজে পায় তাঁর মুক্তির উল্লাস। তিনি আকারের বাইরে বেরোতে চাইলেন রঙ-এর নিটোল শরীরের বাইরে। গখের সানফ্লাওয়ার-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন গঁগ্যা, এমনকি মানের   সানফ্লাওয়ারের থেকেও কিছুটা এগিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বারংবার ছবিতে ছবির  উপস্থিতি তিনি মানতে পারেননি, গখের তুলিকে তিনি চাইছিলেন প্রতীকের  বাইরে অপেক্ষারত আরও কিছু একটা প্রতিন্যাসের ভূমিকা হিসেবে দেখতে, আরও কিছুটা বেহিসেবী কল্পনায় বোনা কিন্তু গখ ছবিতে অস্তিত্বের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আকাশকে আকাশের রঙে গমখেতকে গমখেতের রঙে নির্বাচনই ছিল তাঁর ছবির ঘরানা। হলুদ বাড়িথেকে গঁগ্যার বেরিয়ে আসার আগে ভাই থিওকে লেখা গখের একটি চিঠিই যথেষ্ট প্রামাণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যেখানে গঁগ্যার শিক্ষকতায়  ব্যক্তিসত্তায় কীভাবে আত্মস্থ হয়ে উঠছিলেন গখ, আবার সাথে সাথে সম্পূর্ণ সহমতও  হয়ে উঠতে পারছিলেন, না মেনে নিতে পারছিলেন না প্রতীকিনির্ভর চক্ষুগ্রাহ্য রূপকল্পের  বাইরের সবটুক নির্যাস।–“ Gauguin has brought me to see that it’s about time I varied my work… Now I work from memory. Gauguin gives me courage to use my imagination, and it’s true enough that paintings of this kind have something mysterious about them… Gauguin and Bernard don’t ask what the exact shape of a tree is, but they do insist that one should be clear whether the shape is round or square, and they’re right. They are fed up with the photographic but empty perfection of certain painters. They don’t ask what the exact shade of the mountains is-they say, ‘By God, the mountains were blue, weren’t they? All right, then chuck on some blue and don’t bother to tell me that the blue was rather like this or that. Make the mountains blue and that’s enough….” গঁগ্যাস চেয়ার ভিনসেন্ট চেয়ার এর দিকে লক্ষ্য করলেও দেখা যাবে, কিছুটা  ইচ্ছাকৃতভাবেই রং তুলির টান এবং ফর্মে পার্থক্য রেখেছেন গখ, দুটি মানুষের দুটি শিল্পীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য বোঝাতেই কি? ‘গঁগ্যাস চেয়ারে রয়েছে পারফেকশন, ভিরিলিটি, স্ট্রেন্থ আর ফ্ল্যাশিনেশ যেখানে ভিনসেন্ট চেয়ার সাদামাটা অনুজ্জ্বল যেন  এক সামান্য ছাত্র তাঁর দীর্ঘদেহী শিক্ষকের নাগাল পেতে ডুবসাঁতার কাটছে উচ্চতার সামনে। গখের কিছু ছবিতে প্রতীকি ব্যাখ্যা ছবির ওয়াইড স্প্রেক্ট্রাম জুড়ে রয়ে গেছে। যেমন Still life with the bible-যা ১৮৮৫তে বাবার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরেই আঁকা। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠায় শেষের দিকে বাবার সাথে তাঁর মানসিক বিরোধ চরমে পৌঁছয়; ছবিতে বাইবেল গ্রন্থটি রূপকার্থে আসলে তাঁর বাবা এবং বাবার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে রিপ্রেজেন্ট করছে, আর তার  পাশে থাকা ছোট হলুদ বইটা যা কিনা জোলার La Joie de Vivre বারবার  বাইবেলকে অমান্য করার অনুকৃতি হয়ে উঠছে, উঠছে ভিনসেন্টের স্বরূপ। একইভাবে ভিনসেন্টের আঁকা চেয়ার দুটিও কোথাও যেন বন্ধুত্বের পাশাপাশি দুটো স্বতন্ত্র্ ব্যক্তিত্বকে বেছে নিয়েছে, যেখানে বন্ধুতাও স্বতন্ত্র, বিনিময়ের ট্রাপিজের খেলা শেষ হলে রেশনাল শব্দটাকে যেখানে হয়তো শেষমেশ চয়েস করা যায় না।

হলুদ বাড়িতে তাঁদের দ্বৈত যাপনের প্রথম ক-মাস ভাই থিওকে লেখা চিঠি থেকে  স্পষ্ট বোঝা যায়, কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গময় ছিলেন গখ। সেসময়কার প্রতিটা চিঠিই যেন গঁগ্যা নামের একটি মুখের সমগ্রতায় ভরপুর। কীভাবে আঙুরখেতের মেয়েদের তিনি আঁকেন, কিংবা ধোপার মেয়েদের আঁকতে তাঁর তুলিরা রঙের মাঝে খুঁজে নেয় নিঃশব্দ বিরল। আগামী ছমাসের মধ্যেই হলুদ বাড়িতে তাঁদের স্বপ্নের স্টুডিও নিয়ে  তীব্র আশাবাদীও ছিলেন গখ। আজীবন আপসহীন প্রতিবাদী গখ জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিলেন, ইন্ধন খুঁজে পেয়েছিলেন নতুন সৃজনীর। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাদেই যে গঁগ্যার সাথে তাঁর ঐতিহাসিক মনোমালিন্য, রক্তিম বিচ্ছেদ হতে চলেছে, সেই গঁগ্যাকেই  তিনি বিশ্বাসের দোহাট দরজা খুলে দিয়েছেন, উল্লেখ করেছেন- “Gauguin, a very great artist and  a friend in a million… a very, very interesting man, and I’m sure that with him about we shall do heaps of good things”গঁগ্যার প্রতি গখের ছিল একজাতীয় অন্ধ হিরো-ওরসিপ। গখ তাঁর অন্ধ চোখ দিয়ে হড়হড়ে শীতলতায় খুঁজে ফিরছিলেন সপ্রাণ বন্ধু। অথচ এ যে শীতল স্বর্গ, দুবোর্ধ্য পচা মাংসে  ভরা মানুষের নির্মোহ অনুসন্ধান শুধু; শুরু হলো প্রিন্সিপালস আর পেনটিংস নিয়ে তাঁদের অসহিষ্ণুতা আর ধৈর্যহীনতার আঁশটে অধ্যায়। ছবির ফর্ম নিয়ে ধারাবাহিক মতান্তর গঁগ্যাকেও  কোথাও তিতিবিরক্ত করে তুলেছিল ভিনসেন্টের মানসিক অস্থিরতা আর নিতান্ত শিশুর মতো তাঁর নিজস্ব সৃজনাবেগের কাছে। গখ খুঁজছিলেন বেড়া আর গঁগ্যা একটা চওড়া বারান্দা। গখ ধরা পড়তে চাইছিলেন সামান্য আলোর বিনিময়ে যেখানে গঁগ্যার উদ্দাম জীবন আলো থেকে ছিটকে যেতে অভ্যস্ত ছিল নতুন আলোর দিকে। ছোটোবেলা থেকে সঙ্গবিমুখতা গখের চেতনায় ইন্ধন যুগিয়েছিল প্রবল মানসিক বৈকল্যের, যা প্রায়শঃই ধ্বংসের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে দিত গখকে। জান্তব অভিমানে একাধিকবার গঁগ্যার প্রতি সশস্ত্র প্রতিবাদে সামিল হওয়ায় বন্ধু থিওকে গঁগ্যা লিখে ছিলেন ভিনসেন্ট তাঁর খুব প্রিয় এবং তাঁর শিল্পের প্রতিও তিনি সমান সশ্রদ্ধ, কিন্তু   তাদের মানসিক দলিল কোনোভাবেই একে অপরের পরিপূরক নয় এবং থিও যেন তাঁর প্যারিসে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। 

জীবনের মাঝে দরজা খোলাই থাকে। অনুভবের বধিরতা আর শূন্যতা শুধু আমাদের এগিয়ে দেয় বিচ্ছেদের মতো এক দূরারোগ্য অসুখের দিকে। প্রতিদিনই আমরা অপেক্ষা  করি কিছু স্থুল আশাবাদ নিয়ে, যেন এক ঝটকায় সব ঠিক হয়ে যাবে, চূর্ণ বিচূর্ণ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। অথচ হয় না। দুটি ফুল দুটি পাতা যেমন কেবল মাথা ছুঁয়ে মিলিয়ে দেয় তাদের রেণু আর ফল পাড়তে গিয়ে মিশে যায় বিশ্বব্রহ্মান্ডের  ভবঘুরে ফুসফুসে, সম্পর্কও ঠিক তেমন, কোথাও কেবল চেনা মানুষ চেনা ছবির মাঝে ছেড়ে যায় উড়ে যাওয়ার বিন্যাস। এ এক ভৌতিক  নেশা। ভূগোলের মাঝেই বন্ধুত্বের মতো কিছু একটা মৌলিক সেঁধিয়ে আছে ক্ষুধা তৃষ্ণার মতো যৌগিক হয়ে বেড়ে আরও বেড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। আর আমরা বুঝতে পারছি চলে এসেছি, দূর, এতদূর, যোগ আর বিয়োগের থেকে কেবল ফলাফলে ফসিলে হয়ে উঠেছি একটিমাত্র স্মৃতি। সম্পর্কের স্মৃতি। গঁগ্যাও নাগরিক হট্টগোল থেকে পালাতে চাইলেন আত্মবৃত নির্জনতায়। রুদ্ধদ্বার থেকে উড়ে যেতে চাইলেন নির্ভার সাঁতারের দিকে। সিদ্ধান্ত নিলেন প্যারিসে চলে যাওয়ার। এবং বন্ধুত্বের ওপর মুহূর্তেই নেমে এলো সদ্য আবিষ্কৃত বিরাগের এক নতুন মুখ।

এই অনাবিষ্কারও কি সখ্যতা? যেখানে নিরুপায় শিল্পী কেবলমাত্র একটি মানুষকে ধরে একটি স্বল্পস্থায়ী মানবিক ধারণাকে ধরে বাঁচতে চাইছে, তর্কাতীত এক আমিকে অনুমান করতে চাইছে, আত্মগুপ্তির অসহয়তার তার একান্ত আশ্রয়ের পথটা খুঁজে পেতে চাইছে! শেষমেশ ২৩ শে ডিসেম্বর ১৯৮৮, গঁগ্যা তাঁর হলুদ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার  কথা জানিয়ে দিলেন ভিনসেন্টকে। নিজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পতনশীল মানুষ শূন্যতাকে বাজিয়ে বাজিয়ে কী বলতে পারত সে মুহূর্তে? রক্তমাংসের জন্য প্রার্থনা  করতে পারত? একরকম অনন্ত জেগে থাকার ভেতর হাত দুলিয়ে দুলিয়ে দেখাতে পারত হেরে যাওয়া সীসার শরীর থেকে কীভাবে গড়িয়ে আসছে রক্ত! যে রক্ত বইছে যে রক্ত বহন করা যাচ্ছে না যে রক্ত বনগর্ভের আঁধার নিয়ে বিনীতভাবে নিজ হাতে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে সম্পর্কের প্রতিটা ঘরের! সে সব মুহূর্ত সত্যিই কি গখ দেখাতে  পারত যাপনের মধ্যবর্তী শূন্যতাগুলো, স্বপ্নদের হারিয়ে যাওয়াগুলো! নাকি স্রেফ যন্ত্রণা  পেরিয়ে যেতে যেতে অসহায় নিরুত্তাপ গলা শান্তভাবে ঢেলে দিত - 

 I heard the roar of a wave that could drown the whole world
  I heard one hundred drummers whose hands were a-blazing
  I heard ten thousand whispering and nobody listening
  I heard one person starve, I heard many people laughing
  Heard the song of a poet who died in the gutter
  Heard the sound of a clown who cried in the alley
  And it's a hard, it's a hard, it's a hard, it's a hard
  And it's a hard rain's a-gonna fall…”

না এসব বৃষ্টি দেখা যায় না, ধরা যায় না পলকা জালে। ক্ষণকালের মাঝে আমরা ফাঁক করে দেখি জল-জল-জলের ভাষা নিয়েই ভেসে চলেছি মানুষের মতো প্রান্তীয়  পাখিরা। গঁগ্যার চলে যাওয়ার মুহূর্তে বিশেষ কিছুই করেননি গখ, হয়তো রাগে হতাশায় কিছু করারও ছিল না। কেবল সামনে পড়ে থাকা প্রাত্যহিক খবরের কাগজ থেকে একটি টুকরো কেটে ধরিয়ে দিয়েছিলেন গঁগ্যার হাতে। তাতে লেখা ছিল –“The Murderer Took flight”এ কেমন আততায়ী? আসলে গঁগ্যা শব্দটির মধ্যে নিজেরই অচিরে ঢুকে পড়েছিলেন গখ, সে যেন বেঁচে থাকার এক বুঁদ, নতুনের এক চিলতে রঙ। হলুদ বাড়িতে বসে বসে সারাজীবন যে নতুনের খোঁজ করতে চেয়েছিলেন  ভিনসেন্ট, তার স্থির স্তব্ধ অনড় দেওয়াল দরজা জানালায় ইজেলে অতিজীবিত আনন্দই ছিল গঁগ্যা। আসলে প্রয়োজনের সাথে গখের ভালোবাসা এখানে একাকার, প্রীতির সাথে একাকার সম্মোহ। গঁগ্যার পেছন পেছন দৌড়ে এসেছিলেন গখ, দৌড়ে এসেছিলেন সারাজীবনের এক দুর্বোধ্য স্বপ্ন দুর্বধ্য শ্বাসকষ্টের পেছন পেছন। কিন্তু মৃত সম্পর্কের  কাছে এ দৌড় যে সামান্য এক ফাঁকির সমান! রাগে হতাশায় পাগল গখ নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন বারবনিতা Rachelকে। আসলে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর নিজের ব্যর্থতা ,যন্ত্রণায় নুয়ে পড়া তাঁর অসহনীয় জীবনপিপাসাকে। হলুদ বাড়ির বিছানায় অচৈতন্য গখের কান বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল লাল থকথকে রক্ত, যা আসলে হয়তো রক্ত নয়, কেবলমাত্র অস্তিত্বের হেরে যাওয়া রোদ্দুর। গখের কান কাটা নিয়ে শিল্পইতিহাস আর তাত্ত্বিকদের মধ্যে হাজার মতবিরোধ থাকলেও এবং গখের মানসিক উন্মাদনাকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, যা বারবার  অন্ধকারে থেকে গেছে তা হলো গখের নিজের অস্তিত্বকেই আক্রমণের প্রশ্নটি। সম্পর্কের চোরাবালিতে একাধিকবার ডুবতে ডুবতে গখ কোথাও ভেসে ওঠার প্রয়োজনীয়তাই হয়তো স্বীকার করতে চাননি, সহসা মুখগুলো মানুষের উত্তাপগুলো তার হাত পিছলে  চলে যেতে যেতে তাকে নিজের কাছে, সুস্থ জীবনের কাছে অপারগ প্রমাণ করে  গেছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে তিনি কোথাও নিজেকেই দায়ী করছিলেন হয়তো, আত্মকেন্দ্রিক গ্লানি থেকে প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন নিজেরই বিরুদ্ধে, শাস্তি  দিতে চাইছিলেন স্ব-কে। গখের তীব্র ধর্মীয় চেতনাও হয়তো কিছুটা হলে এক্ষেত্রে সজাগ। যিশুর প্রতি জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার পর যেমন মৌলিক পতনের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে রোমান সেনার কান কেটে নিয়েছিল পিটার, কিম্বা ১৮৮৮এর ঘটনার কয়েকমাস আগেই জ্যাক দ্য রিপার যেমন কান কেটে নেন এক মহিলার, হয়তো তেমনই এক ভ্রষ্ট ধারণাকে পূর্বকৃত পাপের সাজা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন গখ। সর্বব্যাপী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে খুঁজে ফিরছিলেন আপতিত আলোর পথ, অথচ এ পথ  নঞ্ছর্থক শূন্যের পথ। এ পথ সাদা নিস্তরঙ্গ চির নিভৃত অভিশাপের পথ।

ভিনসেন্ট গখের মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত শিল্পী জীবন আমাদের একাধিক প্রশ্নের সন্মুখীন করে যায়। ঠিক কতখানি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন গখ? তাঁর মানসিক অস্থিরতাকে আমরা কি কেবল মনোবিকলনে আবদ্ধ রাখতে পারি, নাকি তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর নতুনের খোঁজে ক্রমাগত পিষে যাওয়া শিল্পীর অপ্রদর্শিত চেহারাটাও! গখ যেতে চেয়েছিলেন শিল্পের কেন্দ্র অব্দি,  চোলাই হতে চেয়েছিলেন মৌলিক সৃষ্টির শরীরে ও মনে। ভাই থিওকে লেখা অজস্র চিঠি তাঁর শৈল্পিক উদ্ভাসনকেই বারবার বাজিয়ে তোলে, বাজিয়ে তোলে অপ্রাপ্তি আত্মবিরোধিতা আর অতিক্রমের আসক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিল্পীকে। জীবদ্দশায় যে একটিমাত্র  ছবি ভিনসেন্টের বিক্রী হয় তার নাম রেড ভিনায়ার্ড কিনেছিলেন মিস আন্না বোক। ক্রিমসন লাল আঙুর খেত, আর হলুদ সূর্য, দীর্ঘ ঘাসজমি পেরিয়ে  ধূসর হয়ে যাচ্ছে মানুষের গল্প। কেবল রাস্তা ফুরোচ্ছে না। গোটা ছবি জুড়ে ফেলে আসা একটা ভারী বাতাস যেন প্রতিনিয়ত জীবনব্যাপী এক দহনের সাথে ভিনসেন্টের সহবাসের আদর্শ অবস্থাকেই চিহ্নিত করে যায়। ছবির জন্য জীবনকে দাওয়ে লাগিয়েছিলেন তিনি। আত্মপ্রতিষ্ঠার সীমানা পেরিয়ে সেখানে কেবল এক দীক্ষিত শিল্পীর আত্মহনন-ক্ষুধা দারিদ্র্য নিঃসঙ্গ লড়াইয়ের সাথে সাথে প্রকৃতিকে মন্থন করতে চেয়েছিলেন গখ আর হতাশ আর নিষ্ফলের মতো বারবার মুখোমুখি হয়েছেন স্ববিরোধিতায়। জিংক হোয়াইট, কোবাল্ট, ম্যালকাইট গ্রিন, ক্রিমসন লেক, ক্রোম, এমারাল্ড গ্রিনের মতো  একাধিক রঙের অভাবের কথা ভাই থিওকে লিখলেও তাঁর ছবি ছিল জীবনের রঙে পরিপূর্ণ। সে এক মোটা রঙ, শুকিয়ে গেলে সেখানে আত্মনিরীক্ষিত শিল্পীর ধ্রুবপথটি, পরিক্রমিত ফসলটিই ভেসে ওঠে। বাহ্যাড়ম্বরের বাইরের শিল্পী গখ, যিনি বলেন-“I have a terrible lucidity at moments when nature is so beautiful, I am not conscious of myself any more,and the pictures come to me as if in a dream…   

সত্যিই তো চেতনা থাকলে বারবার কেন বন্ধুত্ব? নাকি চেতনা আছে বলেই সখা আছে সখ্যতা আছে সখ্যচ্ছেদ আছে? সম্পর্কের ঠিক কোন্‌ ঘাসের বাগান জমি  পেরোলে মানুষ একটি ঠান্ডা অনুভব পায়! কোন্‌ দিব্যতাময় নদীর বুকে ভাসিয়ে  দিতে পারে বিচ্ছেদের বৃষ্টি! নাকি মেঘ থাকবেই ঘূর্ণি ধরে ধরে ঘাম ধরে ধরে কেবলমাত্র বৃষ্টি আসবে বলে বন্ধু আসবে বলে নুন ধোবে বলে! জানি না ঠিক কোন্‌  প্রত্যাবর্তনের আশা থেকে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সন্ধিক্ষণের মানুষের হাত ধরে চলেছে  এমন এক ফাঁসুড়ে অস্তিত্ব! যে অস্তিত্ব মৃত্যুর শেষদিন অবধি গঁগ্যাকে খোঁজায়, যে অস্তিত্ব গখকে কোনোদিনও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না, যে অস্তিত্ব স্বপ্নময় মানুষকে  বিশ্বাস করায় জড়জগতে সে একা নয়, আবার যে অস্তিত্ব মাংসের ভেতরেও রেখে যায় মানুষটিকে একা। ২৭ জুলাই ১৮৯০-এ এক অসহনীয় নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি  পেতে নিজেরই গুলিতে আত্মহত্যা করেন গখ। নিজেরই হাতে এক অগ্রজ অন্ধকারের দিকে নিজের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহকে উসকে দেওয়ার আগে ২৩ জুলাই ১৮৯০তে ভাই থিওকে লেখা তার শেষ চিঠিতেও গঁগ্যার প্রশংসায় আপ্লুত গখ লেখে– “I noted with pleasure that the Gauguin from Brittany I saw is very beautiful, and it seems to me that the others he has done will probably be so as well.”…                                         

রঙ এর মতো জীবনের রসায়ন আমরা কেই বা জানি! কেবল অনুসরণ করতে পারি খুব লম্বা একটা সাইপ্রেস, হলুদ একটা ঘোড়ায় টানায় গাড়ি কিংবা পুরনো আড়াআড়ি একটা মেঘের আনাগোনা। নতুন একটা রং ততক্ষণ অবধি আবিষ্কার করতে পারব না যতক্ষ অবধি সে জেগে থাকা মানুষকে ঘুমের আকার দিচ্ছে, যতক্ষ অবধি না সে  গুলিয়ে দিচ্ছে আলোর মাঝে জেগে থাকা সখ্যতার সম্পর্কের কিছু স্টারি নাইট। কখনও কখনও মনে হয়, জীবনের সংশ্লেষণ সত্যিই বড় স্বল্পজলের পুকুর, ছিপ ফেললে ছিপছিপে এক ফালি আনন্দ উঠে আসে, অগাধ ওঠে না, ফাতনা ডুবে যায় ফুস করে আর জলের ওপরে অপেক্ষা করে ভুলযাত্রা।