কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

২৪) মৌ দাশগুপ্তা

বার্তা-১

খেয়ালি মেঘবালিকার অকরুণ দান
মাধুকরী ভিক্ষায় ভরায় শুষ্ক আঁচল,
ধরিত্রীমায়ের নরম বুক ভরে ওঠে শস্যের ঘ্রাণে।
লক্ষ্মীপুজোর জলছাপ-আঁকা ডানায়
সাদা পেঁচা সেই শস্যের সুবাস নিয়ে আসে
আমার কাছে, পরবাসে,
আমার ঘরের সীমানায় বিভেদের কাঁটাতার,
লক্ষ্মীপেঁচা রাতের উজ্জ্বল আঁধারে দু’পায়ে ডিঙোয় আঙিনা।
সুগন্ধী ধান্য-আঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে কাঁটাতারের এপারে ওপারে,
পৌষালী শীতে নবান্নের গল্প ভাবতে ভাবতে
নিঃসঙ্গ রাত জেগে আমি ফের বৃষ্টিকথার প্রহর গুনি।


বার্তা-২


দেয়াসিনী আমি, স্বেচ্ছা দেববাসিনী,
মন্দির-দ্বার থেকে সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছি
আদিম গুহাকন্দরে,
এখানে চাঁদ নেই, সূর্য নেই, নেই মদালসা নক্ষত্রের সারি.
আছে কেবল জোনাক নেভা রাতে,
শুধু হেঁটে চলা, পিচ্ছিল রটনার সাথে,
না চিনেই আন্দাজে খুঁজে চলা মানচিত্রবিহীন পথ।
যে পথের শেষ সমাধিভূমির নিঃশঙ্ক, নিঃসঙ্গ ছায়ায়।
অপেক্ষা সময়ের মাত্র,
কবে মায়াবিনী চাঁদ ডেকে যাবে কোজাগরী ডাক,
শুকিয়ে যাওয়া কাদামাটি ছাপের ওপর
পা ফেলে ফেলে পূর্ণিমার আলো ধরে
দহন শেষে ফিরে আসা ফেলে যাওয়া ঘরে,
পায়ের চিহ্ণ যে ঘরপোড়া আর ঘরে ফেরা দুটো কাহিনীই জানে।


বার্তা-৩

জঙ্গলমহলে তুঁতগাছে কুঁড়ি ভরে এলে
বাসা বাঁধে যত মাথামোটা শুঁয়োপোকা,
আসমানী শিশির জলের আলপনায়
কিশলয়ের মায়াবী কোরকে লিখে রেখে যায়
সবুজের সাথে তার ঘনিষ্ঠ পরকীয়া প্রেম,
পলাশগাছেও আগুন লাগে,
বিম্বিত লয়ে আকাশ উজানে হাতছানি দেয়
অনির্দ্দিষ্ট যাযাবরকে,
দক্ষিণাপবন আকাশে নক্ষত্রগাঁথা শাদাসাজ সেজে
মেঘবালিকাদের চোখে চোখে ঈশারায়
কিসের বার্তা যে দেয়, কে জানে!
দিনাবসানে অবাক হয়ে দেখি
রক্ত আর ঘামে ভেজা জীর্ণ ঝরাপাতার ওপর দিয়ে
হেঁটে যাওয়া অ্যানিমেশন বুটের আওয়াজ মিলিয়ে গেলে,
গুলি গোলার আওয়াজ থিতিয়ে পড়লে
শুঁয়োপোকার পরিত্যক্ত খোলস আলো করে
ডানা মেলে আগামীর রঙিন প্রজাপতি।


বার্তা-৪

শীত এসেছে কমলালেবুর রঙে বা নলেন গুড়ের গন্ধে।
শীত এসেছে বাঁধাকপির পাতায় আর গোলাপের কুঁড়িতে,
কফির উষ্ণ আমেজ আর দুপুরের কোল্ড ক্রীমের নরমে।
সদ্যপাট খোলা শীতবস্ত্র থেকে ভেসে আসা ন্যাপথলিনের ঘ্রাণে,
লেপ কম্বলের ফাঁকে শীতকাল এসে উঁকি দিয়ে গেছে বিছানায়।
দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করা দু’টি মানুষের মধ্যবর্তী শৈত্যকে
শারীরিক উষ্ণতার প্রয়োজনে উধাও হবার বার্তা বয়ে এনেছে শীত।


বার্তা-৫


আজকাল আকাশ জুড়ে বৃষ্টি এলেই কথায় কথায় উথলে ওঠে কাব্যের ভূত,
আমার ঘরে অগোছালো বিছানা, একপাশে নিঃসঙ্গ কাঠের টেবিলে
পেপারওয়েট চাপা কাগজ, আধখোলা কলম, ক্ষয়া মোমবাতি,
আলো ঢলতেই রোজ সাদাকালো স্বপ্নে ভরাই রাতবিলাস,
আলো ফুটলেই রোজ লিখি কালকেতু ফুল্লরার বারোমাস্যা।
আনমনে শুনি হাতেগোনা মানুষের শতছিন্ন রূপকথা।
নিঃশব্দ আবেগের টানে ভেসে যায় সব শব্দ,
চুপকথায় ভরে যায় আমার সারাটা আকাশ।
কবিতার বার্তা সেখানে পৌঁছায় না।

আমার আর কবিতা লেখাও হয় না।


বার্তা-৬


তারপর আঙুলে আঙুল ছোঁয়াতেই
বনের পলাশ লালে লাল, ঝরাফুলে লাল মাটি,
এর পরেও আস্কারা দিলে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে ছোঁয়
লুকোনো কৃষ্ণচূড়া মন।
সুখবিলাসে থিরথিরিয়ে কাঁপে রঙিন প্রজাপতি।
আগুনরাঙা বনে ঋতুরাজের আগমনী বার্তা শোনায় বসন্তসখা,
সাঁওতাল ছেলের ঘামেভেজা লবণাক্ত শরীর
আঁচলের আড়ালে ঢেকে নেয় সাঁওতাল মেয়ে,
ঝরাফুল প্রেমফুল হয়ে আলো করে প্রিয়তমার খোঁপা,
নখে শ্বেত আকন্দ, কষ্টিপাথরে খোদাই দেবতনু,
যেন জংলী পাতার আড়ালে মৃগনয়না-বিহারে স্বয়ং রতিদেব।
প্রেয়সীর নীলকন্ঠ পাখির মতো চোখের প্রতিবিম্বে খুঁজে নেয় ভালোবাসা
নীড়গামী পাখির শিস মিশে যায় অরণ্যের মাদলের উৎসবে।
দিনের শেষে সব গল্প রূপকথা সেজে ঘরে ফিরলেও-
ঘরের কোণে, থেমে থাকা দু-একটা স্মৃতিকথা
নিটোল পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ভেঙে কখনো ফেরে না।


বার্তা-৭

অশ্বমেধের ইচ্ছায় বার্তাবাহী করে
মহীনের ঘোড়াদের ছেড়ে দিয়েছি পথে,
সময়ের সাথে তারা ছুটছে প্রিয় থেকে প্রিয়তম নদীর মতোন,
পাথুরে পথের বুকে পা দিয়ে তারা পেরিয়ে যাচ্ছে
জন্মান্তরের স্বপ্ন, মরুবালি আবদার, ঘাম, জমাট বরফ!
মনের ইচ্ছাকে লাগাম করে স্পন্দনময় ভঙ্গিমার সাথে,
ছুটে চলেছে ক্ষুরে ক্ষুরে মনের জমা ধুলো উড়িয়ে পথশ্রান্ত ঘোড়ার দল,
কারো নাম সুখ, কেউ দুঃখ, আছে আনন্দ, ব্যথা, প্রেম, বিরহ,
যূথবদ্ধ জীবনে যদিও একক নামে কাউকে ডাকা হয় না,
ক্লান্ত চোখে দেখছি অস্তরাগ পিছলে যাচ্ছে ওদের ঘর্মাক্ত ত্বকে,
রক্তমাখা ফেনায় ঠিকরাচ্ছে দিনের শেষ আলো,
আলো তো নয়, যেন গোলাপী আগুন,
দিগচক্রবালে আরো নিচে নেমে যেতে যেতে
জলছবির মতো দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে জীবনমুখি আলো,
আলো নেই, নেই পথ, দিশা নেই, নেই কোনো গন্তব্য,
ঘোড়ার যূথ আশা-নিরাশার সীমান্তে ত্রিশঙ্কু,
আমিও ত্রিশঙ্কু আমার আমিত্ব আর নারীত্বের সীমানায়।
জলভরা চোখে দেখছি চাওয়া পাওয়ার সীমানা ছাড়িয়ে
অশ্বমেধের ঘোড়াদের ফেরত আসার পথ
তাই মুছে যাচ্ছে সীমান্তের অন্ধ অভিশাপে।


বার্তা-৮


জানালার বাইরে শিউলীঝরা রাত
আর গরাদ চুঁইয়ে আসা কোজাগরী জ্যোৎস্নায়
মেঘ আকাশের শিয়র জুড়ে শিউরে উঠছে তারা,
মুছে যাওয়া নদীর আলপথ ধরে বইছে মন্দক্রান্তা বাতাস।
আবছা আঙুলে আঙুল স্পর্শ করে শব্দকে অনুভব করছি,
কবিতা লেখার ছলে কালি কলমে এঁকে চলছি
শিউলি দিনের প্রচ্ছদবার্তা।


বার্তা-৯

কতকাল ধরে অবিশ্রান্ত হাঁটছি বিদিশা থেকে বেলপাহাড়,
ভোর থেকে সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা থেকে হয়তো ভোর,
সারাদিন... সারাদিন... হয়তো বা সারারাত… এই আসা যাওয়া
আমার চোখের পাতায় ছায়া ফেলে চন্ডীমঙ্গল, ফুল্লরার বারোমাস্যা,
আমার বোধে সজীব হয়ে ওঠে উপকথার নরনারী, পুরাণের কথা,
শরীর থেকে যেন অকস্মাৎ সরে যায় সব দায়ভার।
বিস্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে
অলীকপদ্মের আড়াল থেকে তুলে আনি সজীবতার বার্তা। 


2 কমেন্টস্: