কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৮৭

 

আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে বৈশাখে ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর কেটে গেছে এতগুলো বছর। কোনো বছরই ‘কালিমাটি’ নিষ্ফলা থাকেনি। সেই সময় ঘোষিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা হিসেবে কোনো কোনো বছরে প্রতিশ্রুত চারটি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি ঠিকই, কিন্তু তার যাত্রায় কখনও ছেদ পড়েনি। বিগত ১০০তম সংখ্যা পর্যন্ত ‘কালিমাটি’ পত্রিকা ত্রৈমাসিক পর্যায়ে ছিল, ১০১তম সংখ্যা থেকে ‘কালিমাটি’ বার্ষিক সংখ্যা রূপে তার নতুন যাত্রা শুরু করে। এখানে আরও একটি ব্যাপার উল্লেখ করা যেতে পারে, ১০০তম সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকা ছিল গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধের সাধারণ পত্রিকা। তার মধ্যে মাত্র চারটি সংখ্যা ছিল নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা, কিন্তু ১০১তম সংখ্যা থেকে প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে। যেমন এবছরে সদ্য প্রকাশিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০৭তম সংখ্যার বিষয় ‘মহামারী’। আবার বিষয় ‘অতিমারী’ বললেও ভুল হবে না। সম্প্রতি সারা বিশ্ব এই মহামারী তথা অতিমারীতে আক্রান্ত হয়েছিল, যা এখনও নির্মূল হয়নি। কবে এই ভয়ংকর আক্রমণ থেকে বিশ্ব সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত হবে, কবে মৃত্যু মিছিলের পরিসমাপ্তি ঘটবে, কারও জানা নেই। করোনা-মুক্ত বাতাসে আবার কবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সম্ভব হবে, তাও অনুমান করা মুশকিল। তবু এই চরম বিপর্যয়ের দুঃসময়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েও সৃষ্টি তার সৃজনশীলতা থেকে কখনও বিচ্যুত হয় না, তার নিরন্তর চলার পথে কোনো বিপত্তিই তার গতিরোধ করতে পারে না। ‘কালিমাটি’ পত্রিকাও তাই নির্দিষ্ট সময়েই প্রকাশিত হলো তার নিরবচ্ছিন্নতাকে অব্যাহত রেখে।

‘কালিমাটি’ পত্রিকার ‘মহামারী’ সংখ্যায় আমরা বিষয়ভিত্তিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছি বিভিন্ন গুণীজনের, যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য এবং মহামারী তথা অতিমারী বিষয়ে যথার্থ বিশেষজ্ঞ। এরই পাশাপাশি অত্যন্ত দক্ষ ও   মননশীল কথাশিল্পীদের ছোটগল্পে মহামারীর প্রেক্ষাপট সাবলীলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া একটি কবিতার আঙ্গিকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মহামারীর বিমূর্ত রূপ।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আজও আতঙ্কিত সারা বিশ্বের মানুষ। যদিও  একদিন এই দুর্যোগ কেটে যাবে। সুস্থ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আবহাওয়া আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আজ এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যখন সাধারণ মানুষের শারীরিক সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক সংক্রমণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তখন যথার্থই আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত হতেই হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক আচার-আচরণ, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, মানসিক দূরত্ব, অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ ক্রমশই  যেন তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। প্রশ্ন জাগে, বিশ্ব করোনামুক্ত হবার পরেও  মানুষের মন কতটা আবর্জনা মুক্ত হবে? জীবনচর্যা কতটা স্বাভাবিক হবে?

কামনা করি সবার সুস্থ ও সুন্দর জীবন। সৃজনশীল যাপন।

 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব 

পায়েল মণ্ডল

 

ফুডিস অফ ইউলিসিস এবং বাণিজ্য




                                             

‘God made food, the devil the coocks!’ James Joyce

 

১৯০২। প্যারিস। মাকে লেখা একটি চিঠি-

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৩

প্রিয় মা,

তোমার পাঠানো ৩ শিলিং মানিঅর্ডার মারফত কাল পেলাম। জানো মা, গত ৪২ ঘন্টা টানা না খেয়েছিলাম। আজকেও টানা ২০ ঘন্টা না খেয়ে। না খেয়ে থাকাটা এখন যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। অর্থ হাতে আসলে খিদে চেপে রাখতে পারি না মা, কোয়াটার শিলিং-এর খাবার খেয়ে ফেলি। আশাকরি এই নতুন নিয়মের খাদ্যাভাস আমার পাকস্থলীর কোন ক্ষতি করবে না। ‘Speaker’ কিংবা ‘Express‘  থেকে এখনো কোন খবর এলো না। জানো মা, আমার হাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা থাকলে একটা ছোট্ট স্টোভ কিনতাম আর ঐ স্টোভে ম্যকারনি রান্না করে রুটির সাথে খেতাম। আশাকরি আমি যেমনটা স্টানির ব্যপারে বলেছিলাম তেমনটা করছো, কিন্তু কেন যেন মনে হয় করছো না। আচ্ছা যে কার্পেটটা তুমি বিক্রি করে আমার খাবারের টাকা পাঠালে সেটা নিশ্চয় নতুন কার্পেটটা নয়! নতুন কার্পেটটা বিক্রি করে যদি এই টাকা পাঠিয়ে থাকো তা হলে রিটার্ন পোষ্টে টাকা ফেরত পাঠাবো। এখানে আমি সাধ্যমত সব চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কোন এক অশুভ শক্তি পেছন থেকে টেনে ধরে আছে, সামনে এগোতে দিচ্ছে না।

এক অদ্ভুত সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি মা। সারারাত খিদেয় ঘুম হয় না। খুব ভোরে বিছানা থেকে উঠে পোস্টবক্স খুলে দেখি পত্রিকা অফিস থেকে ভালো সংবাদ নিয়ে কোন চিঠি এসেছে কী না। এখন পর্যন্ত কোন ভালো খবর নেই আমার জন্য। আবার বিছানায় যাই, আধোতন্দ্রার মাঝে। মিস গোনের সাথে দেখা হয়নি, তাঁর  কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না। মা, তোমার পাঠানো শেষ মানিঅর্ডার দিয়ে সোমবার পর্যন্ত চলতে পারবো। আর পরে আবার সেই উপবাস। ইশ, যদি মঙ্গলবার পর্যন্ত এই টাকায় চলতে পারতাম, মঙ্গলবারে প্যারিস মেতে উঠবে কার্নিভ্যালের আনন্দে, পানাহারে, সমস্ত প্যারিসে বোধহয় আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে সেদিন টাকার অভাবে না খেয়ে থাকবে...’

১৯০২ সালে প্যারিস থেকে প্লানেট আর্থের ‘জিনিয়াসদের জিনিয়াস’ এমন ভাবেই মা’কে চিঠি লিখে নিজের ক্ষুধার জ্বালার কথা জানিয়েছিলেন। সে যাত্রায় মেডিসিন  পড়তে প্যারিসে এসেছিলেন। অর্থের অভাবে দিনের পর দিন না খেয়ে এমন ভাবে কাটাতে হয়েছিল। মৃত্যুর পরে এই ‘কোয়ার্কি জিনিয়াস’এর যার ইন্টেলেকচুয়াল  ভ্যালু ভাঙ্গিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য, মদ,  সিগার, ক্লথিং, প্রকাশনা, এক্সেসরিজ, পোর্টারি, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পাব, বার, ট্যুরিজম, কী নয়! যাকে ঘিরে এত কিছু সেই জিনিয়াসের জিনিয়াসটি আর কেউ নয় আইরিশ লিখিয়ে জেমস জয়েস। অর্থাভাব এই মদ্যপ লিখিয়ের পিছু ছাড়েনি। বেঁচে থাকতে যদি নূন্যতম আর্থিক সঙ্গতি থাকতো, কে বলতে পারে তাঁর কাছ থেকে আরও একটি মনুমেন্টাল উপন্যাস বিশ্বসাহিত্য পেলেও পেতে পারতো!

ক্ষুধার জ্বালার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে বলেই  জয়েসের অবচেতন মন তাঁর মহান উপন্যাসে অনবদ্য সব খাবারের দৃশ্যেকে লিখিয়ে নিয়েছে। বলা যায় ইচ্ছে পূরণের দৃশ্য।  জয়েস তাঁর ন্যারেশনে পাঠকদের চোখ,  কান নাক সমান ভাবে ব্যস্ত রাখেন সেই সব দৃশ্যের রসাস্বদন করার জন্য। মনে হয় জয়েসের চরিত্রদের সাথে একই সাথে খাদ্য গ্রহণ করছি আমরা পাঠকেরাও। জয়েস তাঁর শব্দের মেসমেরিক আবেশে  তৈরি করে দেন এমন স্পেল। বিশ্বসাহিত্যে খাবারে দৃশ্য এত সুন্দর করে বর্ণনা কম লেখকই করতে পেরেছেন যা পাঠ করে দর্শকরা যেন খাবারে গন্ধ পান, খাবারের স্বাদ পান। জয়েসের ন্যারেশন এমনই অসাধারণ। ব্লুম আগাগোড়া একজন খাদ্যরসিক মানুষ আর তাই মহান উপন্যাস ইউলিসিসের চব্বিশ ঘন্টার ঘটনায় ব্লুমের একাধিক খাদ্যগ্রহণের বর্ণনা আমরা পাই।

ইউলিসিসের প্রোটাগোনিস্টের দেখা পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এপিসোড চার পর্যন্ত। এপিসোড চারে জয়েস তাঁর প্রটাগোনিস্ট লিপোল্ড ব্লুমকে আমাদের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন! প্রথম পরিচয়টা হয় ব্লুমের চেতনা প্রবাহের সাথে খাদ্যের চিন্তায়। চার এপিসোডের প্রথম বাক্য থেকে আমরা ব্লুমের খাদ্যাভ্যাসের সাথে জয়েস পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন।

‘Mr Leopold Bloom ate with relish the inner organs of beasts and fowls. He liked thick giblet soup, nutty gizzards, a stuffed roast heart, liverslices fried with crustcrumbs, fried hencods roes. Most of all he liked grilled mutton kidneys which gave to his palate a fine tang of faintly scented urine.’

-Ulysses, Episode-4

ব্লুমের প্রিয় খাদ্যের তালিকায় মাংস সবার উপরে। নাস্তায় খাসির কিডনি তাঁর প্রিয় মেনু। জয়েস অনবদ্য ভাষায় এর বর্ণনা দেন-

‘Kidneys were in his mind as he moved about the

kitchen softly!’

কিডনি কিনতে কসাইখানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ব্লুম। খাসির কিডনি না পেয়ে শুকুরের কিডনি কিনে বাসায় ফেরে।  স্ত্রী মলির জন্য নাস্তা বানায়, নিজের নাস্তা,  অর্থাৎ বাজার থেকে কেনা কিডনি ভাজি করতে প্যানে বসিয়ে স্ত্রী মলির নাস্তা নিয়ে তাকে পরিবেশন করতে যায়। ভুলে যায় ব্লুম চুলোয় বসানো কিডনির কথা। পোড়া গন্ধ নাকে এসে পৌঁছলে মনে পড়ে চুলোয় বসানো কিডনির কথা। জয়েস অসাধারণ ন্যারেশনে এই রন্ধন প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন-

Pungent smoke shot up in an angry jet from a side of the pan. By prodding a prong of the fork under the kidney he detached it and turned it turtle on its back. Only a little burnt. He tossed it off the pan on to a plate and let the scanty brown gravy trickle over it.

 

শব্দ দিয়ে জয়েস যেন নির্মাণ করছেন এক ইলিউসিভ রিয়েলিটি। পাঠকদের টেনে নিয়ে যান ব্লুমের কিচেনে। পাঠকদের অভিজ্ঞতা –

Pungent smoke shot up in an angry jet from a side of the pan. – ঘ্রাণেন্দ্রিয় উজ্জিবিত করে দেয় জয়েসের এই শব্দসমাহার। কিডনি পোড়ার গন্ধ  এসে ধাক্কা দিয়ে যায় নাকে যা পৌঁছে যায় মস্তিস্কের গন্ধস্মৃতির অংশে।

By prodding a prong of the fork under the kidney he detached it and turned it turtle on its back. Only a little burnt. – পাঠকদের ভিজুয়াল ফ্যাকাল্টি খুলে দেয়। স্পষ্ট যেন চোখে ভাসে আধোপোড়া কিডনি।

মাস্টার ইমাজিস্ট জয়েস, পার এক্সসেলেন্স ইমেজিস্ট স্টাইলে ভিজুয়াল ন্যারেশন করেন জয়েস। ছোট্ট একটি দৃশ্যপট অথচ সেটার উপস্থাপনায় কী অসম্ভব পারফেকশন!

এমন ভাবে ব্লুমের সাথে আমাদের পরিচয় হয় খাদ্যচিন্তা, খাদ্যসংগ্রহ, খাদ্যপ্রস্তুত এবং খাদ্য গ্রহণের দৃশ্যে। ব্লুম খাদ্য প্রস্তুতকারক ও খাদকও বটে। এপিসোড চারে জয়েস ব্লুমের খাদ্যপ্রিয়তার মধ্যদিয়ে ‘Scatology’ কেমন ভাবে বায়োলজিক্যাল মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার একটা দৃশ্যপট রচনা করেন। বেঁচে থাকার জন্য যে  বায়োলজিক্যাল এ্যাক্ট প্রটোমানব থেকে আজ অব্দি করে আসছে সেই খাদ্য, খাদ্যপ্রস্তুত এবং খাদ্যবন্দনা দিয়েই জয়েস পরিচয় করান তাঁর প্রটাগোনিস্ট ব্লুমের সাথে।

 

ল্যাস্ট্রোগনিয়ান কান্ডে জয়েস খাদ্যকে উপস্থাপন করেন ভিন্ন মাত্রায়। ব্লুম নিঃসন্দেহে একজন খাদ্যরসিক মানুষ। তবে খাবারের সাথে সাথে তার উপযুক্ত পরিবেশও এবং পরিবেশনাও চাই, আর তাই সে বার্টনে লাঞ্চ না করে ডেভ  ব্রাইয়ান্সে লাঞ্চ করতে যায়। বার্টনের উশৃঙ্খল পরিবেশ ব্লুমকে বাধ্য করে বার্টন ছেড়ে ডেভিতে লাঞ্চ করার জন্য। মাংসপ্রেমী ব্লুম ব্জি দিয়ে দুপুরের খাবার সারে।

একটা ক্যান্ডির দোকানের সামনে এই এপিসোডে গল্প শুরু হয়। ক্যান্ডির গন্ধ ব্লুমের মনে প্রভাব বিস্তার করে মুখরোচক খাবারের জন্য। খাদ্যচিত্রের এক চক্রব্যূহ রচনা করেন জয়েস। সাধারণ শব্দের ব্যবহারে অসাধারণ দৃশ্যপট রচিত হয় জয়েসের কলমে।

Pineapple rock, lemon platt, butter scotch. A sugarsticky girl shovelling scoopfuls of creams for a christian brother. Some school treat. Bad for their tummies. Lozenge and comfit manufacturer to His Majesty the King. God. Save. Our. Sitting on his throne sucking rejujubes white.

ব্লুমের চোখে মলির মুখ ভেসে উঠে। মলি যখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলো তখন সে বিশেষ কিছু খাবার খেতে পছন্দ করতো। মিনা পুরফয় কি মলির মত বিশেষ কিছু খেতে পছন্দ করে? খাদ্যের সাথে যৌনতার সংযোগ দেখান জয়েস। পাহাড়ে খোলা আকাশের নীচে  ব্লুম ও মলির যৌনক্রিয়ার সময় তারা দুজন সিড কেক একে অপরের মুখ থেকে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। যৌনক্রিয়ার সময়ে এই খাদ্য গ্রহণকেএ্যাফ্রোডাইসিয়ালফুডিং বলে।

Glowing wine on his palate lingered swallowed.

Crushing in the winepress grapes of Burgundy. Sun’s heat it is. Seems to a secret touch telling me memory. Touched his sense moistened remembered. Hidden under wild ferns on Howth below us bay sleeping: sky. No sound. The sky. The bay purple by the Lion’s head. Green by Drumleck. Yellowgreen towards Sutton. Fields of undersea, the lines faint brown in grass, buried cities. Pillowed on my coat she had her hair, earwigs in the heather scrub my hand under her nape, you’ll toss me all. O wonder! Coolsoft with ointments her hand touched me, caressed: her eyes upon me did not turn away. Ravished over her I lay, full lips full open, kissed her mouth. Yum. Softly she gave me in my mouth the seedcake warm and chewed. Mawkish pulp her mouth had mumbled sweetsour of her spittle.

Joy: I ate it: joy. Young life, her lips that gave me pouting.

Soft warm sticky gumjelly lips. Flowers her eyes were, take me, willing eyes. Pebbles fell. She lay still. A goat. No-one. High on Ben Howth rhododendrons a nannygoat walking surefooted, dropping currants. Screened under ferns she laughed warmfolded. Wildly I lay on her, kissed her: eyes, her lips, her stretched neck beating, woman’s breasts full in her blouse of nun’s

veiling, fat nipples upright. Hot I tongued her. She kissed me. I was kissed. All yielding she tossed my hair. Kissed, she kissed me.

Me. And me now. Stuck, the flies buzzed.

 

ব্লুমের ভাবনায় খাদ্য শুধু যৌনতার সাথে সম্পর্কিত না বরং রাজনীতির সাথেও সম্পর্কিত। পুঁজিবাদি সমাজের অঢেল ও প্রয়োজনের অধিক খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা কমিউনাল সমাজে সেটা রীতিমত স্বপ্ন। ব্লুমের খাদ্যের ভাবনার মধ্য দিয়ে দুই  সমাজের খাদ্য বৈষম্য তুলে ধরেন।

খাদ্য মানুষের সৃজনশীলতার সাথেও জড়িত। ব্লুম ভাবে এ.. ও অন্য কবিরা কি খায় এবং সেই খাবার তাদের কবিতায় কি প্রভাব ফেলে। ব্লুমের ভাবনা অন্যদিকে শিফট করে। সে ভাবে খাদ্যের সাথে বাড়ির একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ব্লুম সকালে দেখা [এপিসোড--] একটা বিজ্ঞাপন মনে মনে উচ্চারণ করে যেটা - “What is a home without Plumtree’s potted meat? Incomplete. With it an abode of bliss.”

ধর্মের সাথে খাদ্যের সম্পর্ক খুঁজে পায় ব্লুম। রাস্তায় যখন তার হাতে পতাকা গুঁজে দেয় একজন পথচারী, সে ভাবে পতাকায় তার নাম লেখা আছে। ব্লুম দেখতে পায়  সেখানে লেখা ‘blood of the lamb’। জয়েস ব্লুমকে যেন যীশুর কষ্টের প্রতীকী  রূপে আঁকেন। হাতে ধরা পতাকা ক্রুশের প্রতীক আর সেখানে লেখা রক্ত যেন তারই যার মন প্রতিনিয়ত রকাক্ত হচ্ছে ক্যাথোলিক সমাজ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায়।

ব্লুমের লাঞ্চ দৃশ্য এমন ভাবে ন্যারেট করেন জয়েস

'Mr Bloom ate his strips of sandwich, fresh clean bread, with relish of disgust, pungent mustard, the feety savour of green cheese. Sips of his wine soothed his palate. Not logwood that. Tastes fuller this weather with the chill off.  Nice quiet bar. Nice piece of wood in that counter. Nicely planed. Like the way it curves there.....'

ডেভি ব্রায়েন্স পাবে আয়েস করে ব্লুমের ওয়াইন পান নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ পান বর্ণনা।

পারফেক্ট আর্টিস্ট জেমস জয়েস নিজেকে অমর করতে চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে এবং সেটা করেছেনও। নিজের সাথে সাথে তাঁর উপন্যাসের স্থান কাল  পাত্রকেও অমরত্ব দিয়েছেন। জয়েসের উপন্যাস ইউলিসিসের কল্পরাজ্য থেকে আজ অনেক স্থান যেন রিয়েল টাইম লাইফে জায়গা করে নিয়েছে। জয়েস সৃষ্ট এই চরিত্রের টাইম এন্ড স্পেস আজ আগ্রাসী কর্পোরেট বণিকের রগরগা পুঁজি।

প্রতি বছর জয়েসপ্রেমীরা ব্লুমস ডে’তে এই ডাবলিনের এই পাবে একত্রিত হন  ব্লুমের পান স্মরণে পান করার জন্য। ঠিক উপন্যাস ইউলিসিসে বর্ণিত বারগেন্ডি সার্ভ করা হয় ডেভি ব্রায়েন্স পাবে জুলাই ১৬ তারিখে ‘ব্লুমসডেতে!’  জয়েস বলে কথা তাকে ঘিরে লিকার কোম্পানীরা মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বিস্তার করেছে এমনভাবে। মজার ব্যাপার হলো জয়েস কিন্তু বার্গেন্ডি পছন্দ করতেন না অথচ তাঁর অমর চরিত্র ব্লুমসের পছন্দের তালিকায় ধরিয়ে দিয়েছেন ‘বারগেন্ডি!’  আজ বারগ্যান্ডির ব্যবসা রমরমা। জয়েসের চরিত্রের পছন্দের লিকার যদি এমন জনপ্রিয় হয় তাঁর স্রষ্ঠার পছন্দের লিকার কোথায় অবস্থান করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেটা নিয়েও বাণিজ্য।

ইউলিসিসের নায়ক ব্লুমস বার্গেন্ডি পছন্দ করলেও তাঁর স্রষ্ঠা জেমস জয়েস বার্গেন্ডি পছন্দ করতেন না। একদিন জয়েসের এক বান্ধবী ক্যারোলা তাঁকে জানান যে তিনি বার্গেন্ডি পছন্দ করেন, জয়েস জিজ্ঞাসা করেন ‘তুমি কি বিফস্টেক পান করো নাকি?’

জয়েসের ওয়াইন প্রীতি নিয়েও আছে বিস্তর গবেষণা আর তাঁর প্রিয় ওয়াইন নিয়ে আছে বাণিজ্যবিস্তার। জানা যায় তিনি ওয়াইন পান করলে হোয়াইট ওয়াইনের নিতেন। সুইস ওয়াইন তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল। ওয়াইনের নাম ‘ফেনড্যান্ট দ্যা সিওন!’ জয়েস এই ওয়াইন আবিষ্কার করেছিলেন এমনভাবে। জয়েস সন্ধে হলেই পাবে বসে বিভিন্ন হোয়াইট ওয়াইন চেখে দেখতেন।  ১৯১৯ সালের জানুয়ারির এক রাতে বন্ধু ওয়েসের সাথে এক পাবে বসে ধুমিয়ে পান করছিলেন জয়েস। পানীয়ের নাম ‘ফেন্ড্যান্ট দ্যা সিওন!’ এই লিকার জয়েস খুব মজা করে পান করছিলেন। এক সময় অর্ধেক পান করা গ্লাস উঁচিয়ে ওয়েইসকে প্রশ্ন করেন, গ্লাসের দিকে তাকালে  কী মনে হয় তার। ওয়েস হালকা সোনালী রঙের ওয়েসের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করেন-‘ওরিনা!’ যার অর্থ হলো ‘মূত্র!’ জয়েস বন্ধুর মন্তব্য শুনে তৎক্ষণাৎ হাসতে-হাসতে বলে ওঠেন – ‘মা দি আন আর্চি ডাসে!’ অর্থাৎ হ্যাঁ কিন্তু এটা আর্কডাসেস!’ ‘আজ থেকে এই ওয়াইনকে আর্চডাসেস নামে ডাকবো!’ জয়েস যে সময়টাতে পাবে বসে বন্ধু ওয়েসের সাথে পান করছিলেন আর ওয়াইনের নাম ‘আর্ক ডাসেস’ দিচ্ছিলেন সে সময় জুরিখ ছিল অনেক আর্কডাসেসের আগমনে মূখরিত। জয়েস হোয়াইট ও রেড ওয়াইন নিয়ে মন্তব্য এই মন্তব্য করেন - 'White wine is like electricity. Red wine looks and tastes like a liquefied beefsteak.'

জয়েসের এই প্রিয় ওয়াইন ব্রান্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে জয়েসপ্রেমীদের কাছে। লিকার ম্যানুফ্যাকচারারে ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। কিন্তু এই রমরমা লিকার ব্যবসায় বাদসাধে জয়েসের পৌত্র স্টেফান জয়েস। আশির দশকে জয়েসের প্রিয় ওয়াইন নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ে তাঁর পৌত্র স্টেফান জয়েস।  ১৯৮৫ সালে বার্সেলোনাতে এক প্রেস ব্রিফিং-এ তিনি বলেন যে, তাঁর দাদা জেমস জয়েস ‘ফেন্ডান্ড দ্যা  সিওয়েনের’ ভক্ত ছিলেন না।  তাঁর পছন্দের ওয়াইন ছিলো ‘নিউশ্যাতে ভ্যারিয়ে!’ তিনি ২০০৪ সালে দাদা জেমস জয়েসের জন্মদিনে জুরিখের ‘জেমস জয়েস পাবে’ প্রেস কনফারেন্সে আবারো বলেন যে,  ‘নিউশ্যাতে’-ই হলো জয়েসের ওয়াইনের  প্রিয় ব্রান্ড।  তিনি আরো জানান যে, দাদা জয়েসের অপারেশনের সময় নিউশ্যাতে  পানকারীরা ছিলেন ব্লাড ডনার।

জয়েসকে নিয়ে তর্কের যেন শেষ নেই। তিনি যেন তাঁর মহান উপন্যাসের মতই দূর্বোধ্য যাকে মানুষ আবিষ্কার করছে শত বছর ধরে। জীবদ্দশায় যিনি ধার করেও  মদ্যপান করেছেন তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির কথা বাদ দিলে শুধু তাঁর পছন্দকে ব্যাপারীরা মাল্টিমিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে রুপান্তর করেছে। জানি না এমন কোন লেখক আছেন কিনা যার মৃত্যুর পরে তাঁর সবকিছু ঘিরে এমন বাণিজ্যবিস্তার ঘটেছে।

 

 

 

 

 

 

 

 


ফারহানা রহমান

 

সৃষ্টিশীলতায় গভীর অনুরাগী বব ডিলান




 

প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীক মহাকবি হোমার তার হোমারির স্তোত্রাবলি বা ইলিয়াড ও অডিসিতে যে গীতিকাব্যরসের মাদকতা সৃষ্টি করেছিলেন। অথবা ধরা যেতে পারে ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বে জন্মানো লেসবস দ্বীপের গ্রীক গীতিকাব্য রচয়িতা রহস্যময়ী কবি স্যাফোর কথা যাদেরকে এতো যুগ পরেও মানুষ মনে রেখেছে শুধুমাত্র তাদের সৃষ্ট ধ্রুপদী সাহিত্যের জন্য  যাতে আছে গীতিকাব্যরসের গভীর মাদকতা। ঠিক একই কারণেই বাঙ্গালীরা ভুলতে পারেনা ময়মন্সিংহ গীতিকা, অথবা লালনগীতি বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকাব্য।

সারা দুনিয়ার বহুবিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকদের পিছনে ফেলে ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন প্রখ্যাত মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান। এবং তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন  মূলত তার গীতিকাব্যের জন্যই। যদিও তিনি একাধারে গীতিকার, কবি, লেখক, সুরকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা ও ডিস্ক জকি। বব ডিলানের অসামান্য গীতিকাব্য ও অনবদ্য গায়কী ও তাঁর যুদ্ধবিরোধী  অবস্থান বিশ্বব্যাপী গত পাঁচ দশক থেকে প্রতিনিয়ত শান্তি ও শক্তির যে বাণী প্রচার করে চলেছে তার অসামান্য অবদান হিসেবেই তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানীত করা হলো বলেই মনে করা হচ্ছে। তাঁর গানের কথায় যে  গীতিকাব্যরস ও ব্যঞ্জনা বিদ্যমান, সেটাই তাঁকে গণমানুষের কাছে গানের কবি হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।    

মহাকবি হোমারের ইলিয়াড-এ আমরা যে ছবি দেখতে পাই, সেই সময় কালের মানুষের যে সমস্ত  সমাস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হতে দেখি, একইভাবে হুবহু মিলে যায় আজকের দিনের আমাদের এই আধুনিক সমাজ, সময়ের সঙ্গেও। যুদ্ধ ও যুদ্ধের দামামা চারদিকে। ক্রোধ, কাপুরুষতা, কাম, প্রতিশোধস্পৃহা, বীরত্বের প্রতি মোহ এসবই আজও বিদ্যমান আমাদের সমাজে। হোমার যেমন ঐশ্বরিক দেবদেবীদের বিশাল ও নির্দয় ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ইলিয়াড গেয়েছেন পরম মায়া ও মানবিকতা দিয়ে, সেই একই গীতিকাব্যের ছায়া আমরা দেখতে পাই বব ডিলানের “ The times they are changin” গানটিতেও। 

“The line it is draw/ The curse it is cast/  The slow one now/  Will later be fast/ As the present now/ Will later be past/ The order is/ Rapidly fadin/ And the first one now/ Will later be fast/  For the times they are changin” [The times they are changing]

ডিলান একের পর এক দুর্দান্ত সব গীতিকাবিতা সৃষ্টি করেছেন অগণিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য যেখানে মানুষের কথা আছে, আছে জীবনের জয়গান। তার এসব গীতিময় কাব্যিকসুধারস সমৃদ্ধ শান্তির গান মানুষের হানাহানি, হিংসা ও যুদ্ধবিগ্রহ ভুলিয়ে দিয়ে একটি শান্তিময় পৃথিবী সৃষ্টির আবেদন নিয়ে এসেছে নিষ্পেষিত প্রান্তিক জনগণের কাছে। 

রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও সমাজের নানা নিয়ম বহির্ভূত বিষয় নিয়েই ডিলান তার গায়ক জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এসবই ছিল জনপ্রিয় ধারার বিপরীত স্রোতে গাওয়া।  ১৯৫৯  সালে মিনেসোটার এক কফিহাউসে ডিলান তার গানের ক্যারিয়ার শুরু করেন। একদিকে  ব্যালেড গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞ উডি গুথরির অ্যামেরিকান ট্র্যাডিশনাল ফোক বা লোকসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ  কিশোর ডিলান তার অনুসারী হয়ে ওঠেন এবং গুথরির স্টাইলে এক্যুস্টিক গীটার বাজিয়ে ব্লুজ ও ফোক গাওয়া শুরু করেন। তিনি তার জীবনে গুথরির প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে  বলেছেন, “The song themselves had the infinite sweep of humanity in them….said to myself I was going to be Guthrie’s greatest disciple” অন্যদিকে অ্যামেরিকার লোকসঙ্গীতের রানী  হিসেবে খ্যাত ওডেত্তা হোমস (Odetta Homes) এর লোকসঙ্গীতের রেকর্ড  শুনে তিনি সর্বপ্রথম ফোক সঙ্গিতের উপর আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলেও স্বীকার করেন। তিনি বলেন যে তিনি ওডেত্তার ফোক শুনে এতোই মোহাচ্ছিন্ন হয়েছিলেন যে তিনি  তার ইলেকট্রিক গীটার ও  অ্যামপ্লিফায়ার বদলে ফেলে  এক্যুস্টিক গীটারের মাধ্যমে লোকসঙ্গীত গেতে শুরু করেন। ডিলান নামটিও তিনি গ্রহণ করেন ওয়েলসের জনপ্রিয় লেখক ও কবি ডিলান থমাসের “Under Milk Wood” “A Child’s Christmas in Wales” প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ও মুগ্ধ হয়ে। তিনি তার নিজের প্রকৃত নাম রবার্ট আল্যান জিমারম্যান  নামটি বদল করে বেছে নেন বব  ডিলান নামটি।

বব ডিলানের প্রকৃত নাম রবার্ট আল্যান জিমারম্যান। ১৯৪১ সালের ২৪ মে তিনি অ্যামেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের ডুলুথ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মার নাম বিটি স্টোন ও বাবার নাম আব্রাহাম জিমারম্যান। শৈশব থেকেই ডিলান গানের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতো। দিনের বেশীরভাগ সময় তিনি রেডিওতে গান শুনে কাটাতেন।  ব্লুজ ও কান্ট্রিজ মিউজিক ছিল তার  প্রিয় বিষয়। তবে পরবর্তীতে তিনি রক এন্ড রোলের দিকেও ঝুঁকে পড়েন। এসময় তিনি বেশ কিছু ব্যান্ডও গঠন করার চেষ্টা করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিনোসোটাতে ভর্তি হন  যদিও তার লেখাপরা এরপর আর খুব বেশী এগোয়নি। এসময় তিনি পাশের শহরের ডিংকেটাউনের কফিশপে ফোক গান গাওয়া শুরু করেন।এরপর ডিলান ১৯৬১ সালে নিউ   ইয়র্কের পথে যাত্রা শুরু করেন এবং তার পরের বছরে ১৯৬২ সালের ১৯ মার্চ ‘কলোম্বিয়া রেকর্ডস’  থেকে তার প্রথম এ্যালবাম “বব ডিলান” প্রকাশ পায় এবং  এ্যালবামটি প্রথম বছরেই ৫০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়।  ষাট দশকের শুরু থেকেই ডিলান খ্যাতির তুঙ্গে অবস্থান করতে থাকেন। সে সময় তার গাওয়া গান “ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড”, “দ্য টাইমস দে আর আ চেইঞ্জিং” হয়ে  ওঠে ত্রুন সমাজের গণসংগীত যা যুদ্ধবিরোধী গান হিসেবেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করতে থাকে। ডিলানের হাতের এক্যুস্টিক গীটার ও গলায় ঝোলান হারমোনিকা হয়ে ওঠে তার  ট্রেডমার্ক। আর তিনি হয়ে ওঠেন তারুণ্যের অস্থিরতার প্রতীক, তার গান হয়ে ওঠে  নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রেরণা।   তিনি তার স্বরচিত গীতিকবিতা গাওয়া  ছাড়াও গেয়েছেন অ্যামেরিকান কান্ট্রি সং, ফোক, ব্লুজ,  ইংলিশ, স্কটিশ, আইরিশ লোকগীতি, জ্যাজ মিউজিক, গসেপল এমন কি হার্ডরকও। তার গানের  লিরিকের আবেদন নিজ দেশ ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। তার শক্তিশালী কাব্যিক গীতিকার সামাজিক আবেদন ও মূল্য সেই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতিতে অপরিসীম হয়ে উঠে।  তিনি হয়ে উঠেন দ্রোহ ও যন্ত্রণার প্রতীক!  প্রেমিককবি ও গায়ক। তার যুদ্ধবিরোধী ও   শান্তিকামী গানের প্রতিটি পঙত্তি মানুষের মনে আশার উদ্বেল জাগায় আর তাই তার গান হয়ে উঠে অনন্য, অসাধারণ। তিনি শুধুমাত্র একজন গায়ক হয়ে না থেকে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন  একজন সাধকপুরুষ। তার গীতিকবিতাতে  দর্শন, সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতি একাকার হয়ে মিশে গেছে। আর তাই সাহিত্যে ১১৩তম নোবেল  বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করার সময়  সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা দানিউস বলেন যে ‘গত পাঁচ দশক ধরে অ্যামেরিকার সঙ্গীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক মূর্ছনা সৃষ্টির জন্য তারা ৭৫ বছর বয়সী সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলানকে তারা বেছে নিয়েছেন।  

ডিলান তার ৭৫ বছর জীবদ্দশায় রচনা করেছেন ছয়শ’র বেশী গীতিকাব্য আর তাতে দিয়েছেন সুর, গেয়েছেন নিজের সৃষ্টি করার সেসব মৌলিক গান। তিনি তার গানের সুরের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন তার লক্ষ কোটি শ্রোতাদের যারা আজ তার নোবেল প্রাপ্তিতে গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করছে।  

একজন মহৎ গায়ক হিসেবে মানব সমাজে ডিলানের অবদান অনস্বীকার্য । তিনি তার প্রতিবাদ ও নিপীড়নবিরোধী গান রচনা করে মানবাধিকার কর্মীদের মনে সব সময় সাহস যুগিয়েছেন। তার গানের কথায় যে তীব্র দ্যোতনা সৃষ্টি হয় তাতে শ্রোতার হৃদয়ে এক বিস্ময়কর চাঞ্চল্য তৈরি হয়। আর তাই তিনি হয়ে উঠেছেন সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী। নিপীড়িত জনতাকে  তিনি শিখিয়েছেন কি করে কঠিন পরিস্থিতে লড়তে হয় ও সাহস ধরে রাখতে হয়। তিনি তার সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন অ্যামেরিকার লোকসঙ্গীত, গসেপল ব্লুজ, লোকগাঁথার উপর গবেষণামূলক গীতিকাব্য রচনা করে। আর তাই তিনি নিজেকে প্রথমে কবি ও পরে সঙ্গীতশিল্পী ভাবেন।

বব ডিলান নিজেকে সবসময় নিপীড়িত জনতার পরম বন্ধু , তিনি বাঙালী জাতিরও পরম বন্ধু  হিসেবে  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ‘এ বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্যাটারসন ও রিঙ্গো  স্টারের সাথে এদেশের মানুষকে বাঁচাতে, জনমত সৃষ্টি করার জন্য গান গেয়েছেন। এভাবে যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। ডিলান ভিয়েতনাম সহ পৃথিবীর অন্য সব দেশের সংগ্রামী জনতার  মুক্তির কথা অবিরত বলে গেছেন।  সারা পৃথিবীর যুদ্ধবিরোধী ও সংগ্রামী মানুষ তার  “ এ হার্ড রেইনস এগনা ফল”, “ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড” “জাস্ট লাইক এ ওমেন” “ইট টেকস এ লট টু লাফ” গানগুলো শুনে প্রতিমুহূর্তে সংগ্রামে উদবুদ্ধ হয়েছে।

“Then I’ll stand on the ocean until I start sinkin/ But I’ll know my song well before I start singin/ And it’s a hard , it’s a hard, it’s a hard/ it’s a hard rain’s a gonna fall/ it’s a hard rain’s a gonna fall/ it’s a hard rain’s a gonna fall.” [A hard rain’s a-gonna fall]

ব্যক্তিগতভাবে ডিলান সবসময়ই বিশ্বাস করেছেন যে পৃথিবীতে যা কিছু সম্পদ আছে তার অংশীদার সমানভাবে প্রত্যেকটি মানুষ। বিশ্বের পুঁজিবাদের প্রতি তার প্রবল ঘৃণা আর বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিও রয়েছে তার ঘোরতর আপত্তি। তাইতো মাত্র ২২ বছর বয়সেই কালো মানুষের অধিকার আদায়ের অবিসংবাদিত নেতা ড. মারটিন লুথার কিং এর বিখ্যাত ভাষণ “আই হেভ এ ড্রিম” দেবার আগে তার বান্ধবী ও পরবর্তী সময়ের এডভোকেট জোয়ান বায়েজ এর সাথে “হোয়েন দ্য শিপ কামস ইন”  এবং “ওনলি আপন ইন দেয়ার গেইম” গানদুটো গেয়েছিলেন  এবং মিছিলের প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ডিলানের প্রথম দিককার গানগুলোতে  জোয়ান বায়েজের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ডিলানের গান পাশ্চাত্যের তরুণসমাজে তথা সমগ্র  পৃথিবীর তরুণ সমাজকেই গত পাঁচ দশক থেকে সমানভাবে আলোড়িত করে রেখেছে। “An informal historian of America’s troubles” নামে খ্যাত লিজেন্ড বব ডিলান সঙ্গীত জগতের এক অসাধারণ চেতনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্ব জুড়ে তার ভক্ত কোটি কোটি শ্রোতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের চিন্তায় গভীর চেতনায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। 

ডিলানের স্বরচিত গানগুলো বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠকমহলে তুমুল জনপ্রিয়।  এছাড়াও তিনি ট্যারানটুলা নামে একটি গীতিকাব্যের নিরীক্ষাধর্মী বই ও “ক্রনিকলস” নামক একটি আত্মজীবনীমুলক বই বের করেছেন। লেখক ছাড়াও ডিলান একজন সক্রিয় আঁকিয়ে, অভিনেতা ও চলচিত্র পরিচালকও বটে।


এ পর্যন্ত ডিলানের ঝুড়িতে যোগ হয়েছে ১১টি গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ড, ১টি গোল্ডেন গ্লোব, ১টি একাডেমি পুরস্কার সহ ১৯৯১ সালে তিনি “গ্র্যামি লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও ২০০০  সালের মে মাসে তিনি পোলার  মিউজিক প্রাইজ ও তার বিখ্যাত গান “থিংগস হ্যাভ চেঞ্জড”এর জন্য অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনের বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির  তালিকায় রয়েছে তার নাম। ২০০৭ সালে তাকে সংস্কৃতিতে “প্রিন্স অফ অস্ট্রিয়াস” পুরস্কার ও ২০০৮ সালে পুলিৎজার কমিটি সঙ্গীতকর্ম ও সমাজের প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ  তাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেন। তিনি সঙ্গীত লেখক হিসেবে ২০১২ সালে অ্যামেরিকার  প্রেসিডেন্ট বারেক ওবামার হাত থেকে গ্রহণ করেন অ্যামেরিকার সর্বোচ্চ পুরস্কার “প্রেসিডেন্ট মেডেল অফ ফ্রিডম” পদক। বিশ্বব্যাপী বহুল স্বীকৃত ও আলোচিত কবি ও সঙ্গীতশিল্পী বব  ডিলানের গানের বিক্রীত রেকর্ডের সংখ্যা ১০ কোটিরও অধিক। এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর বব ডিলান সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত হয়ে হলেন নোবেল লোরিয়েট। তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। 

তিনি বহু বিখ্যাত উক্তি রচনা করেছেন যা পাঠকের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। তার লেখা একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি 

“DESTINY is a feeling you have that you know something about yourself nobody else dose. The picture you have in your own mind of what you’re about WILL COME TRUE. It’s kind of a thing you kind of have to keep to your own self, because it’s a fragile feeling, and you put it out there, then someone will kill it. It’s best to keep that all inside.”

-Bob Dylan, [The Bob Dylan Scrapbook; 1956-1966]