কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

অম্লান বোস

 

সৌমিত্রদা, তুমি চলেই গেলে?




আমার সব প্রকাশনার চেস্টার মধ্যেই এক মহামানবের বার্তা একটা দু:সহ আবেগে ঝমঝমিয়ে ওঠে এবং অনিবার্য ভাবেই, এই লেখাটা আরম্ভ করার মুহূর্ত থেকেই তানপুরাতে একটা বিশেষ রাগিনীর মূর্ছনা শুরু হয়ে গেছে -

হঠাৎ খেলার শেষে আজ কি দেখি ছবি

স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশীi

“তোমায় স্মরণ করে”, নয়ন করি নত

ভূবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত

আমার “দেখা যেদিন হল” তোমার সনে

তখন “কি” তুমি তা কে জানতো -

ক্ষমা করবেন রবীন্দ্র অনুরাগীরা, আমার এই দুর্বল প্রতিস্হাপনের মধ্যে সত্যিই কোন নীচ উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু ন-দশ হাজার মাইল দূর থেকে কলকাতার পনেরোই নভেম্বরের নিস্তব্ধ বিষণ্ণতার মুহূর্তটা বুকের ভিতর অমৃতের উৎস মুচড়ে, নিংড়ে নীরস করে দিয়েছিল - ওপরে লেখা ঠিক ঐ (পরিবর্তিত) অনুভূতির ছায়াতে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন - রেখে গেলেন অপুর অবুঝ সংসারটা, সোনার কেল্লার দূর্গপ্রাকার, হীরকরাজার ভগ্নাংশ, ময়ূরবাহনের শানিত ক্রুরতা, অরণ্যের দিনরাত্রির মদির মুহূর্ত, চারুলতার বিষণ্ণ একাকীত্ব আর অনেক অনেক কবিতাগুচ্ছ, নাটক, আবৃত্তি, রাশি রাশি পুরস্কার, অসামান্য জনপ্রিয়তা আর ওনার সহাস্য উপস্হিতি, যেটা এখন আপামর চিত্র এবং সাহিত্যপ্রেমীদের চিরসাথী হয়ে থাকবে।

দশমীর ঢাকের শেষ রেশটুকুও মিলিয়ে গেল। বিগত আলো ঝলমল সান্ধ্য পূজামন্ডপের কল্লোলিত বিলাসিতা, রোশনাই আর রঙীন বাতাবরণ এখন বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, অবয়বহীন, অর্থহীন। আমাদের আনন্দময়ীর আগমনী উৎসবের ঘোর কাটিয়ে আমরা প্রতিবছর মঙ্গলারতি দিয়ে বারবার মাকে আবাহন করি - এটাই শাশ্বত, তাই মায়ের জন্যে বিষাদটা ক্ষণস্হায়ী। কিন্তু … এই চলে যাওয়াটা? কোন বিকল্প ভাবা যায়?

কেউ হিমালয়ের চূড়াকে ধরণীর ধূলোয় নামতে দেখেছে ? অচঞ্চল ধ্রুবতারাকে কখনও দেখেছে ঘাসের আগায় হীরের ঝলকানিকে ম্রিয়মান করে চিরকালীন পায়ের ছাপ ফেলতে?

আমি দেখেছি, কিন্তু তিনি তখন বুঝতে দেন নি - তিনি কত অসাধারণ ঐতিহ্য সৃষ্টির নায়ক, তাঁর দীর্ঘ শরীরটা কত যুগের সম্পদ অলঙ্কার বহন করে চলেছে বা  কত লক্ষ মানুষের “হৃদয়বসন্তবনে মাধুরী বিকশিত” করে চলেছেন তিনি - নিরহঙ্কারে, একবিন্দু আতিশয্যের দম্ভ ছাড়াই।

জামশেদপুরে তখন শীতের আলতো মেজাজ উশখুশ করছে। ইস্পাতনগরীর সন্ধ্যেটা কারখানার ধোঁয়া আর হাল্কা হিমের আড়ালে ম্রিয়মান। বসুভবনে চায়ের আসরটা সবে জমে ওঠার মুখে। আমার মায়ের অতি আদরের ছোটভাই, আদ্যন্ত পরপোকার, অত্যন্ত জনপ্রিয়, আপাদমস্তক সাহেবী কেতায় পরিচিত আমাদের ব্যাচেলর মামা, আপামর জনসাধারণের ‘পেরুদা’, কয়েকটা দেশলাইকাঠি নষ্ট করে বিলিতী কায়দায় ইটালিয়ন পাইপটা দাঁতে চেপে এসে বললেন, “স্টেশনে যাবি নাকি? গেস্ট আসছে।” আমার সাগ্রহ সম্মতিটা অবশ্যই ওঁর জানা ছিল।

কলকাতার ট্রেনটা একটা সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশ্চল হল, শুধু শত শত মানুষের মিছিল উগরে দেবার অপেক্ষা। হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, অকারণ ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। আমরা একটু দূরে, প্রথম শ্রেণীর দরজায় দৃষ্টি আটকে আমার অজানা অতিথিদের দেখার আগ্রহে।

ছিপছিপে শ্যামলা এক তরুণী, হাতে স্পোর্টস কিট, প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়ল, পেছনেই একটা সটান ঋজু শরীর, দৃপ্ত উন্নত অবয়ব আর সুদর্শন মুখ ঐ আলো আঁধারির মধ্যে দপদপ করে জ্বলে উঠলো। হাতে স্যুটকেশ আর সাইড ব্যাগ। দীপা চ্যাটার্জি - বাংলার ব্যাডমিন্টন জগতে শীর্ষস্হানীয়, সঙ্গে স্বামী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জানতাম না তখন। ‘পেরুদা পেরুদা’ বলে দীপা এসে মামাকে জড়িয়ে ধরে ফেলল - সৌমিত্র পেছনে, ছোটখাটো উৎসাহী ভীড় সামলাতে ব্যস্ত।

বসুভবনের দোতলায় সেদিন কিছু গুণী মানুষের সমাবেশ হয়েছিল, তার মধ্যে ছিলেন মেয়েদের মিডিল স্কুলের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষিকা অরুণাদি, স্বল্পভাষিণী  কড়া নিয়মশৃঙ্ক্ষলায় বিশ্বাসী, রাশভারী, শিক্ষাজগতে সমাদৃতা এবং মায়ের একান্ত অনুরাগিনী। আয়তনটা যথেষ্ট ভারীর দিকেই। কবিতা আবৃত্তি, গল্প, হাসিঠাট্টার মধ্যে আড্ডা এগোচ্ছে, নায়ক নিজের বৈশিষ্ট্যে ততক্ষণে কিন্তু ‘সৌমিত্রদা’ আর ‘সৌমিত্র তুমি’ হয়ে উঠেছেন, কোন জড়তা ছাড়া, অনাবিল স্বাচ্ছন্দ।

“উফ্ মাসীমা, এটা ঢাকাই পরোটা? আমার জন্যে ক’টা আর দীপার জন্যে ক’টা? এই যে কানুবাবু, (পারিবারিক আলাপের মধ্যে একটু মিচকি হাসির ফাঁক দিয়ে আমার ডাকনামটা ধরেই প্রথম ঠাট্টার ধাক্কাটা এলো) আপনারা তো এইসব অসামান্য কম্বিনেশনের সঙ্গে খুবই পরিচিত, কাজেই আমরাই আপাতত এদের নিয়ে একটু মাখামাখি করি? আচ্ছা দীপা -

“তুমি খাও না, খাও!” মা দীপ্তমুখে ভরসা দিলেন - “দীপাকেও দিয়েছি, ওর জন্যে ভেবো না”।

“মাসীমা - ওর তো খেলাধূলোর ব্যাপার। লোভে পড়ে খেয়ে নেবে আর কালকের ম্যাচে ডোবাবে। না না মাসীমা, ওর ভাগটা আমাকেই দিয়ে দিন।” তামাশাটা কিন্তু কোন ছায়াছবির বাঁধানো ডায়ালগ নয়, নিছক পেছনে লাগা। বিশেষ করে মহিলামহলে হাসির ফোয়ারা তোলার জন্যে যথেষ্ট  উপযোগী। আড্ডা এগোচ্ছে, স্বভাবতই গানবাজনার কথা উঠলো - আমাদের নিজেদের ইন-হাউস জারিজুরি সযত্নে জাহির করিয়ে দেবার পর মামা ধরে পড়লেন - “সৌমিত্র, এবার তো তোমার পালা, একটা গান হতেই হবে।”

মা’র সামনে মামা “ধূম্রপান স্বাস্হ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক” আপ্তবাক্যটি মেনে চলেন।

“আচ্ছা পেরুদা, সবাই মিলে গাইলে হয় না - অনেকেই তো আছেন। কী বলো সবাই - কোন গানটা হতে পারে?”

আগুনের পরশমণিতেই বেশী ভোট পড়ল, সৌমিত্রদা আমাদের বিলিতী  পিয়ানোটার সামনে বসে পড়ে সুর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত কন্ঠে গানটা আরম্ভ হল, লিড গায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুরে তালে গানটা ভালই এগোচ্ছিল, কিন্তু বিপত্তিটা নামলো – ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো’তেই।  পিয়ানো ছেড়ে হঠাৎই হাতজোড় করে অরুণাদির সামনে বসে পড়ে কেঁদে ফেললেন সৌমিত্র  - “মাফ করবেন দিদিমনি, আপনার এ ভার আমি কিছুতেই তুলে ধরতে পারব না, কিছুতেই না”। পরের কয়েকটা মিনিটের বেসামাল হাসির  ফোয়ারার মধ্যেই মুখে আঁচল দিয়ে দ্রুত প্রস্হান আমার মা’য়ের।

“তোমার একেবারে প্রথমদিকের - মানে কীভাবে ছবিতে এলে সৌমিত্র? কবিতা, আবৃত্তি, নাটকে তোমার পপুলারিটি তো জানি আমরা”। সুষমা মাসিমার সাদামাটা প্রশ্ন।

“ওরে বাবা, সে তো অনেক ঘটনা। আসলে কি জানেন মাসীমা, সিনেমার থেকে ঐ সাহিত্য, পত্রিকা সম্পাদনা, কবিতা, রাজনীতি, যোগ ব্যায়াম, খেলাধূলোর দিকটাই আমাকে বেশী টানতো। আমার প্রথম স্ক্রীন টেস্টই বলতে পারেন - ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’, আমি তো ডাহা ফেল করেছিলাম”। অত্যন্ত সাধারণ ভাবেই স্বভাবসিদ্ধ স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে দিলেন, যেন খুবই মজার কথা। “আর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে? ওখানে ঘোষকের চাকরীটা পেতাম না কি? পেলাম তো অনিলদার (চ্যাটার্জি) ছবিতে ডাক পেয়ে চলে যাবার পরে”। অননুকরণীয় বিনয় - মানুষের হৃদয় গলাতে আর কতটা প্রাণের উত্তাপ লাগে?



পরের দিন ভোরসকালে রোজকার মতই আমি টু-ইন-ওয়ানটা নিয়ে দক্ষিণ খোলা বারান্দাতে চায়ের আমেজে - সৌমিত্রদা এসে বসলেন, হাল্কা হলুদ টি শার্টে সেই তরোয়াল চেহারা আমার আজও মনে গেঁথে আছে। চায়ের কাপে কথাবার্তা চলছে। সামনে আমাদের লনের বাইরেই রাস্তাঘাট দিয়ে লোক চলাচল হচ্ছে - বুঝতেই পারছি বাড়ির সামনে সবারই গতি থমকে যাচ্ছে, দৃষ্টি আমাদের দোতালার বারান্দায়। সাহস, উৎসাহী স্কুল কলেজের মেয়েরা হাসিমুখে হাতও নাড়াচ্ছে। অলস দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে সোজা চোখ রেখে আজকের কিংবদন্তী  স্বাভাবিক স্বরেই বললেন - “অম্লান, জামশেদপুরে তোমার ফ্যানসংখ্যা তো কম নয় দেখছি!” কার মুখে কী ঠাট্টা শুনছি! তখন আপামর বাঙালি - অপুর সংসার, সমাপ্তির আবেশ, সাত পাকে বাঁধার দাম্পত্য কলহের রেশ আর দেবীর আবেগের রসে মিলে মিশে জবজবে হয়ে গেছে - সেই অপু, এবারে আমার মুখের দিকে সরল  মুখভঙ্গি করে একবার তাকিয়েই সিলিংএর দিক দুষ্টুমির চাপা হাসিটা মুক্ত করে দিলেন। আমার হাতের গরম চা’টা ছলকে উঠে টেবিলক্লথটাকে জবজবে করে দিল।

এবারে কিন্তু কয়েকটা বছর একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড না করলে একঘেয়েমির দোষে পাঠকদের রোষে পড়তে হবেই। জাভা সুমাত্রার দূর দ্বীপবাসিনী সুমন্দ্রদভাষিণীদের দেশে প্রায় দুই দশক কাজের ঘোরে কাটিয়ে কলকাতায় নোঙর করেছি বছর দুয়েক। ফোনে হঠাৎ আমার স্কুলের বন্ধু, ইংল্যান্ড প্রবাসী ডাক্তার শান্তিপ্রিয় মিত্রের গলা - “কী রে ব্যাটা, কী করছিস বাড়িতে? কোন রিহার্সাল বা সাহিত্যসভা চলছে না কি?” সত্যিই আমি ওসব নিয়েই বেশ ব্যস্ত থাকতাম কলকাতায় এলে।

“না না, আপাতত…

“চলে আয়, চলে আয় - সৌমিত্রদা আসছেন”। সৌমিত্রদার সঙ্গে শান্তি আর গোপার (সেও ওখানে ডাক্তার) ঘনিষ্ঠতা ছিল লন্ডনে - নাটক, ছায়াছবি, ওয়ার্কশপ এসব নিয়ে, সেই সূত্রেই কলকাতায় ওনার সঙ্গে দেখাশোনা ওদের। প্রতিবছরের মতো শীতের আগে ওরা কলকাতায় এসেছে।

সৌমিত্রদা? ঢেউটা চোখের পলকেই পঞ্চাশ বছরের সীমারেখা ভেঙ্গেচুরে গুড়িঁয়ে দিয়ে সপাটে বসুভবনের আলোকোজ্জ্বল ঝলমলে সেই সন্ধ্যের চালচিত্রের মধ্যে আছাড়ে ফেললো। মনের আলোয় ভেসে এলো ছিপছিপে অপু, হাফশার্ট আর ধুতি।

“সৌমিত্রদা কেমন আছো? চিনতে পারছো?” ঘরে ঢুকে দরজার পাশের সোফাটাতে বসে গৌরকান্তি, পরিণত, সৌম্যদর্শন, সফল, সার্থক এক কিংবদন্তী।  খ্যাতির শিখরে শিখরে অনায়াস পদক্ষেপে বহু চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে ফুলেভরা রঙীন দ্বীপে - সোনার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত প্রশান্ত ছবি। চিনবেন আশা করাটা একেবারেই বাতুলতা।

চেনা অচেনার দোলায়িত চাউনি দেখেই বুঝলাম মিথ্যে মিষ্টি বলে কথা ঘোরাবার লোক নন্ উনি।

মনে পড়াটা সম্ভব না জানি - অনেক বছর তো হল! ‘জামশেদপুর, পেরুদা?’  হাল্কা ভুরুদুটো উঠলো আকাশপথে, সুপরিচিত চোখের অতল দৃষ্টিতে স্মরণের আলো জ্বালিয়ে অবিস্মরণীয় হাসিভেজা গলা ছলকে বেরিয়ে এলো – “ও - ও, বসুভবন? নীহার মাসীমা?”

দীপার সাগ্রহ সংযোজন - “পেরুদা? পেরুদা কেমন আছেন?”

শুরু হল আমাদের নতুন করে যোগাযোগের অধ্যায়। লেকগার্ডেনস্, সল্টলেক, গল্ফক্লাব, আমাদের বালীগঞ্জ প্লেসের সীমিত আবাসে অথবা উপছে পড়া কোন  প্রেক্ষামঞ্চের সাজঘরে কখনো কখনো দেখা এবং গল্পগুজব চলতো - ছায়াছবি বা  নাটক সম্পর্কিত আলোচনাকে খুব একটা প্রাধান্য না দিয়েই। এসবের মধ্যে, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সৌমিত্রদার খুব একটা অগ্রাধিকার দেখি নি কখনও - বাঙালি ভাত মাছের ঝোলই মনে হয় বেশী আকর্ষণীয় ছিল। সেদিন শান্তিদের বাড়িতে খেতে বসেছি - রীতা আমাকে বললো, “ছ্যাঁচড়াটা খেয়েছ? একটু নাও, খুব ভাল হয়েছে”। পাশেই সৌমিত্রদা, রীতাকে বললাম, “আগে সৌমিত্রদাকেই ছ্যাঁচড়া দাও না!” খাওয়া থামিয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, “না না অম্লান, আমি জাতপাতে বিশ্বাসী নই, তবু নিজের জাত আমি পাতে নিই না।” মানে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘ছ্যাঁচড়া’ সম্প্রদায়ের মানুষ? হাসির হিল্লোল সেদিন নিশ্চয়ই লেক গার্ডেন্সের রাস্তায় এলোপাথাড়ি ঢেউ তুলেছিল!

আর একদিন। বিজ্ঞাপন সংস্কৃতির কথা চলছিল। উনি বিশেষ কোম্পানীর একটা হিয়ারিংএড-এ যুক্ত ছিলেন। যথাসম্ভব খোঁজখবর নিয়েই বললেন - “অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন,  ‘সৌমিত্রবাবু, আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই  ভালই হবে, আমার বয়স্ক বাবার জন্যে নেওয়া যাবে তো?’ আমি বলতাম - দেখুন মশাই, বাজারে তো অনেক রকমের মডেলই বেরিয়েছে, আপনি বরং আপনার ডাক্তারের সঙ্গে কন্সাল্ট করে নিন!”

“আরেক দিন এক ভদ্রমহিলা, হাইলি সোফিস্টিকেট স্বর, ‘মি: চ্যাটার্জি, কী বলে  যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব! আপনার কথামত ঐ যন্ত্রটা কিনে আমার স্বামীর  যে কী উপকার হয়েছে - সব কথা এখন পরিস্কার শুনতে পাচ্ছেন’। আমার যে   এটাতে কোন হাতই নেই সেটা বললে তো উনি বিশ্বাস করবেন না, আমি ভগবানকেই ধন্যবাদ জানাতে বললাম। কেউ কেউ আবার সেরকম চটজলদি কাজ না হওয়াতে আমাকে শাসানীও দিয়েছেন। কোর্ট কাছারীর ভয় দেখিয়েছেন অনেকে।”

শোনার ব্যাপারে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদিকের কানে ওনার শোনার একটু সমস্যা ছিল। খোলাখুলিভাবে উনি বলতেন, “আমি তো স্টুডিওতে সব কলাকুশলীদের বলে দিই - এই শোন, তোমরা যা বলবে এদিকে এসে বলবে, না হলে আমি কিন্তু বুঝতে পারব না।”

বন্ডেল রোডে এক বাড়িতে নৈশভোজন, বেশ কয়েকজন আমন্ত্রিত। একটা ফোন কল নিতে নিতে দরজা দিয়ে ঢুকতেই শংকরদার গলা (সবার প্রিয় মণিশংকর মুখোপাধ্যায়  - আমাদের খুবই কাছের মানুষ, রঙ্গরসিকতায় বেশ দক্ষ) শুনলাম,  “এই যে, সদাব্যস্ত কর্পোরেট সি ই ও সাহেব এলেন। ফোন আর অতি ব্যস্ততা ছাড়া তো এনাকে দেখাই যায় না!” খাঁটি, অকৃত্রিম লজ্জার হাসি হেসে ফোনটা পকেটে নিয়েই বসে পড়লাম। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সৌমিত্রদাকে বললাম, “আজ তাড়াতাড়ি এলে কী করে - শ্যুটিংওয়ালারা ছেড়ে দিল?” তিনটে চেয়ার দূর থেকে গোলমালের মধ্যে বোধহয় একটু অস্পষ্ট শুনলেন। একেবারে সাদামাটা মানুষের মতই চেয়ারটা ছেড়ে সামনে থেকে আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সোজা আমার পাশেই বসে পড়লেন -  “হ্যাঁ, এবার বলো - ওখান থেকে ঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম না।”

উফ্ কী অসাধারণ সাধারণ মানুষ! কত সহজে কত নীচে এসে আমার মত একটা ধূলিকণার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন! লজ্জায় আমি মাটিতে মিশে গেলাম। পূর্ণ শ্রদ্ধা মাথায় রেখেই বলছি - ভাবুন তো একবার - উত্তমকুমার, অমিতাভ, সলমন, বসন্ত, শাহরুখ বা শর্মিলাদের কথা! এত সরল, নিরহঙ্কার, নম্র, বিনয়ী প্রতিভা ভাবতে পারা যায়?

একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সৌমিত্রদা, অনেকেই নিশ্চয়ই জানে, তবু - সত্যজিৎ রায় তোমার ওপর এত ভরসা করেন, তা ‘নায়ক’এর মত একটা নায়কপ্রধান চরিত্রে তোমাকে নিলেন না কেন?”

একটু আশ্চর্য হয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে নি:সংকোচে বললেন, “আরে অম্লান - জানো না? বাংলাদেশে ‘নায়ক’ বললে লোকে একজনকেই বোঝে”। একটু থেমে নাটকীয় উচ্চারণে শেষ করলেন – ‘উত্তমকুমার’। কোন অশ্রদ্ধা নয়, জেলাসী বা বিদ্রূপ নয়, নেই একবিন্দু কুন্ঠার রেশ ।

“আমি তো গুপীর চরিত্রেও বাদ পড়েছি। আমার চেহারা চাষার ছেলের চরিত্রে একেবারেই মানাবে না। আমার বন্ধু সুবীর হাজরা ওনার খুবই প্রিয় ছিল। সে আগ বাড়িয়ে বলেছিল, ‘কেন, মেকআপ করিয়ে নিন না মাণিকদা!’ মুখে কোনরকম ভাঁজ না ফেলে সোজা ওর দিকে তাকিয়ে মাণিকদা বলেছিলেন,  ‘আমাদের এখানে বড়সড় কোন মেক আপ হয় না - জানো না?’ চরিত্রের ন্যাচারাল অ্যাপিয়ারেন্সের ব্যাপারে উনি ভীষণ চুজি ছিলেন।”

“আচ্ছা - ওঁর সঙ্গে তোমার প্রথম দিককার কথা তোমার মুখ থেকে খুব শুনতে ইচ্ছে করে সৌমিত্রদা”।

“হ্যাঁ, ওনার সঙ্গে আগে একবার দেখা হয়েছিল ছোট অপুর ব্যাপারে। কিছুদিন পর একদিন সুবীর কফি হাউসের আড্ডায় এসে বললো – ‘তোকে মাণিকদা একবার যেতে বলেছেন, কিছু ভাবছেন বোধহয় তোকে নিয়ে’। গেলাম, নানা রকম কথাবার্তা হল - ইংরাজী বাংলা ছবি, নাটক, শিশির ভাদুডী, সাহিত্য, সমকালীন উপন্যাস -  পরে বুঝেছিলাম, সেটাই বলতে গেলে আমার স্ক্রীন টেস্ট ছিল। তখন উনি জলসাঘর, পরশপাথর নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন একদিন। বোধহয় চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার জন্যেই। আমি তখন বিভোর হয়ে ছবি বিশ্বাসকে চোখ দিয়ে গিলছি। শ্যুটিঙের ফাঁকে মাণিকদা আমাকে ছবি বিশ্বাসের বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে নিয়ে বলে বসলেন – ‘এই যে, এ সৌমিত্র চ্যাটার্জি, আমার পরের ছবি অপুর সংসারের অপু”।

আমার সেই মুহূর্তের মনের অবস্হা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। চোখে কাঁপছে ইন্দ্রলোকের স্বপ্ন, নিষ্কম্প আলোর হাতছান। কী করে যে স্প্রিং-এর মতো সপ্তমস্বর্গে লাফিয়ে ওঠার চাপটাকে দমন করেছি, ভাবতে পারবে না!”

আড্ডায় থাকলে মাঝে মাঝে দীপাও কুট্টুস কাটুস করে ফুট কাটতো। একদিন আমাকে লোকজনের সামনে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল।

“সতেরো তারিখে এলে না কেন? তোমাকে মিস্ করেছি দীপা!” বলেছিলাম আমি।

ফট করে বলে বসল, “আমাকে তো আর পারসোনালি ডাকো নি অম্লান, তোমাদের তো শুধু দাদাকে হলেই চলে যায়!”

কিম্বা, ওদের বিয়ের আগে দেখাশোনার ব্যাপারে মেজদি জিজ্ঞেস করেছিল,  “আচ্ছা দীপা, তুমি সৌমিত্রকে নেট করলে কী করে - ব্যাডমিন্টন কোর্টে?

“কে, আমি? জিজ্ঞেস করো তো ওকে, কে লেডি ব্রাবোর্ণের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো বিকেল থেকে? আর দেওঘরে কেন ছুটেছিল আমরা যখন সপরিবারে ওখানে গিয়েছিলাম?” এসব অবশ্য আগেকার কথা, তখনও দীপা চ্যাটার্জি অনেক সচল ছিলেন।




মধ্যে একবার সৌমিত্রদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সত্যজিতবাবুর চরিত্র নির্বাচনে তোমার কখনও কোন প্রশ্ন ছিল না সৌমিত্রদা?” উত্তরটা তো মোটামুটি জানাই আমার। সজোরে একটা ধাক্কা অসহায়ভাবে সামলে ওঠার অভিনয় করে বললেন, “বলো কী, ওনার ভাবনার ওপরে কথা?” একটু চুপ করে থেকে, বোধহয় বলাটা উচিত কি না ভেবে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, একবার বলেই ফেলেছিলাম ‘ঘরে বাইরে’তে আমাকে নিখিলেশের চরিত্রটা না দিয়ে সন্দীপের  মত একটা সেমি-ভিলেন করলেন মাণিকদা?” ওনার কাছে চরিত্রানুযায়ী একটা  ভদ্রগোছের এক্সপ্লোশন আশা করছিলাম। না, বরং একটু হেসে সিগারেটে একটা  মাপা টান দিয়ে বললেন, ঠাট্টা করেই কিনা জানি না, “দেখো, তুমি হচ্ছো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় - দর্শকেরা তোমাকে একটা অনায়কোচিত চরিত্রে নেবে?   ওনার মনের আসল ভাবটা কিন্তু আমি জানতে পারি নি, আর চেষ্টাও করি নি কখনও।”

আর এখন আমরা চেষ্টা করলেও পাবো না তোমার ঐ উজ্জ্বল প্রাণবন্ত নির্ভীক  অসাধারণ হয়েও সাধারণ শিল্পীসত্ত্বাকে, যার অশেষ সৃষ্টি তো অবশ্যই, আমি আরো হারালাম বিশেষ কিছু মুহূর্তে সঙ্গে থাকা এক অকপট সাথী - আমাদের সৌমিত্রদাক। আজ বিষাদের পাহাড় ফাটিয়ে নামছে একটা একটা করে হীরের  টুকরো, কাচকাটার তীব্রতা নিয়ে স্মৃতির পর্দা বেয়ে। উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মহাশূন্যে মিলিয়ে গেলেন, ক্ষণিকের দ্যূতিতে আমাদের প্লাবিত, আন্দোলিত, সন্মোহিত করে। সামনে নয়নজলে ধোয়া মহাকালের পটভূমিতে  পড়ে থাকলো অনন্তের উদ্দেশ্যে তাঁর নিষ্ক্রমণের পদচিহ্ন - বুকের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যাচ্ছেন দূরে, দূর, আরো দূরে, বহুদূরে…

এই শুকতারা মুহূর্তগুলি এক আলোর মালায় গেঁথে মণিকোঠায় তুলে না রাখার অপরাধে আজ প্রতিটি ক্ষত আঁচড়াচ্ছে আমায়।

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন