কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সুষমা ভট্টাচার্য

 


সমকামিতা ও সহমর্মিতা




“দেখ দেখ কেমন কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছে! সত্যি পারেও বটে। আইন হওয়াতে এদের সংখ্যা বেড়ে গেছে”। এই কথা আমরা প্রায়ই মানুষজনকে বলতে শুনি। যাঁদের উদ্দেশ্য বলতে শুনি, তাঁরা হলেন সমকামী। সমকামী অর্থাৎ যাঁরা এক লিঙ্গের পরিচয় নিয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেছেন, কিন্তু তাঁদের মনের গঠন হয় ভিন্ন। ফলে এই ধরনের মানুষরা প্রেমে পড়েন সমলিঙ্গের। অর্থাৎ আরও সহজ করে বলতে গেলে - পুরুষ মনের টান অনুভব করেন পুরুষের জন্য এবং নারীর মনে অনুরাগ জাগায় নারী।

ছোট্টবেলা থেকে আমরা কিছু নিয়ম দেখে আসি যেগুলো আমাদের কাছে  ধ্রুব সত্য। স্বাভাবিকতার বাইরে কিছু ঘটলে আমাদের মনের সেটা মেনে নিতে সময় লাগে। তাই যখনই কেউ প্রথম এসমাজে সমকামীদের উপস্থিতি সম্পর্কে  জানতে পারেন, সেটা মেনে নিতে তাঁর সময় লাগে। এমনকি যাঁরা সমকামী তাঁদের পক্ষেও এই বিষয়টা মেনে নেওয়া কঠিন হয়। অনেক দ্বন্দ্ব চলে তাঁদের মনে। কিন্তু যেটা স্বাভাবিক নয় সেটা হচ্ছে, এই বদ্ধমূল ধারণার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ  যে আচরণ সমকামী মানুষদের সাথে করা হয়, সেই ভয়েই বহু মানুষ তাঁদের যৌনতা নিয়ে স্পষ্টভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন না।

এই ধরনের আচরণের পিছনে বেশ কিছু কারণ থাকে – যেমন শিক্ষার অভাব এই ক্ষেত্রে একটা বড়ো সমস্যা। যখনই কেউ জানতে পারেন তাঁর সন্তান সমকামী, তখনই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মনোচিকিৎসকের কাছে। এক্ষেত্রে জানা দরকার যে, সমকামিতা কোন মানসিক সমস্যা নয়, এটি একটি জিনগত বৈশিষ্ট্য মাত্র। জিনগত বিকার কিন্তু বৈশিষ্ট্য নয়। একথা সত্যি যে অনেকেই শৈশবকালে যৌন হেনস্থার স্বীকার হয়ে নিজেকে সমকামী ভাবেন এবং সেক্ষেত্রে কাউন্সিলিং-এর দ্বারা সেই ব্যক্তিকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু যে মানুষ নিজেকে সমকামী বলছেন, তাঁদের সবারই এই একই উপাচার, এই কথা ধরে নেওয়া ঠিক নয়।

পরের উপায়টি আরও মারাত্মক। এটি এমন এক ব্রক্ষ্মাস্ত্র যেটা প্রয়োগ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যে। এর নাম বিবা। যখনই জানা যায় কেউ  সমকামী, তখনই সহজ সমাধান উপস্থিত, ‘আরে বাবা বিয়ে দিয়ে দাও, বৌ এলে ওসব রোগ ঠিক হয়ে যাবে’। হয়তো মেয়েদের সঙ্গ পায়নি তাই ও এরকম। তাদের উদ্দেশ্যে বলা দরকার, এটা কোনো রোগ নয়, যার ভ্যাকসিন বিয়ে। যেন বিয়ে দিলেই রোগ সেরে যাবে। এই মানসিকতার জন্যই বহু মানুষকে বিয়ের পরে নানান শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বাবা মায়ের কাছে বললে তাঁরা আমল দেন না। রোগ হয়েছে, তেতো লাগলেও ওষুধ তো খেতে হবেই। আর যদি কোনো ছেলে/মেয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলেই সে প্রেমে আঘাত খাওয়া বা সমকামী নয়। অন্য কারণও থাকতে পারে।

কোনো মেয়ের হাঁটাচলা যদি পুরুষালি হয়, বা যদি কোন পুরুষের আচরণ একটু নারীসুলভ হয়, তাহলেই কিন্তু তাঁরা সমকামী নন। আসলে এইসব বদ্ধমূল  ধারণা থেকেই অনেক নিম্নমানের রসিকতার জন্ম হয় যা অপমানজনক ও কুরুচিকর। এমনকি কোনো সিনেমা বা উপন্যাসকে আধুনিক প্রমাণ করতে  হলেও কাহিনীতে এরকম একটা বিষয় নিয়ে কোনো অংশ থাকে। গল্পের সাথে যোগাযোগ থাক আর নাই থাক। আর যারা ড্রইং রুমে এ বিষয়ে কথা বললে না সিটকান, তাঁরাই আবার এই ধরনের সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে দেখতে যা্ন।

এরপর একটি অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দরকার, সেটা হল সমকামীদের  উপস্থাপন যেভাবে করা হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাস্যাস্পদ। বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে দেখা যায়, এই সম্প্রদায়ের মানুষদের উপস্থাপন করা হয় নিতান্তই অবাস্তব ও বিকৃত ভাবে, যা একদমই কাম্য নয়।

দ্বিতীয় যে দৃষ্টিকোণ সেটার ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। আর সেটা হল এই সম্প্রদায়-এর অনেকেই (বিশেষ করে পুরুষরা) এমন সাজসজ্জা করেন যেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোকের নজর কাড়ে। এক্ষেত্রে তাঁরা বোঝাতে চান তাঁরা অন্তরে নারী। তাঁরা ভাবেন যে, মেয়েদের মতো বেশভুষা ধারণা করে  মেকআপ করে নিলে তবেই অন্তরের নারীত্ব প্রকাশ পায়। সাজ বদলে ফেললেই পুরুষ বা নারী হওয়া যায়, ব্যাপারটা বোধহয় এতটা সহজ নয়! ইতিহাসে এমন  অনেক উদাহরণ আছে যাদের বেশভুষা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা সমকামী অথবা উভয়কামী। মালিক কাফুর ও আলাউদ্দিন খিলজি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিজের চলচ্চিত্রে পরিচালক মালিক কাফুরকে অন্যভাবে দেখালেও,  সঞ্জয়লীলা ভনসালির কল্পিত মালিক কাফুর আর ইতিহাসে বর্ণিত কাফুর অনেকটাই আলাদা। ইতিহাসের পাতায় বর্ণিত মালিক কাফুরের প্রতাপ বা তাঁর উপস্থিত দেখে  অনুমান করা কঠিন যে তিনি সমকামী ছিলেন। একই কথা আলাউদ্দিন খিলজির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।



এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে। হলিউডে এমন কিছু তারকা আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে সমকামী, অথচ তাঁরা বিবাহিত ও তাঁদের সন্তান আছে। কিন্তু তাঁরা রুপোলি পর্দায় যখন অভিনয় করেন তখন তাঁরা সব ধরনের ভূমিকায়  স্বচ্ছন্দে অভিনয় করেন  এবং চরিত্র নির্বাচনের সময় তাঁরা দেখেন, তাঁদের চরিত্রটি কেমন। সেই চরিত্রটি gay না  straight, এই নিয়ে মাথা ঘামান না,  যেমন Matt Bomer.

শেষে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, অনেকেই আছেন যাঁরা নিজেদের সমকামী বলে পরিচয় দিয়ে পেশাগত বা মহিলাদের ওপর অবাঞ্ছিত সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে অনেকেরই এই সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ ধারণা  জন্মায়, যেটা একেবারেই কাম্য নয়। তবে কোনো একজনকে দেখে সবাইকে বিচার করা ঠিক নয়।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন