ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য
পূর্বকথা
সুদূর প্রাচ্যের
ভারতবর্ষের মতো একটি দেশে বসে ইউরোপীয় শিল্পকলা নিয়ে বিশ্ময় জাগার অন্যতম প্রধাণ
সূত্রগুলি ছিলো ছোটবেলায় বইমেলায় ন্যাশনাল বুকসের নীল রঙের ত্রিপলে হাত-পা ছড়িয়ে
বসে দুপুর থেকে সন্ধে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত পেল্লায় সাইজের বইগুলোকে নিজের ইচ্ছেমতো
নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখার স্বাধীনতা। যতদূর মনে পড়ে সেখান থেকেই শুরু... তারপর যতদিন
গড়িয়েছে ততো বেশী করে নানান দরজা খুলেছে চোখের সামনে, কখনো আকশ্মিকভাবে আবার কখনো
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে... সেসব অন্যকথা। কিন্তু এই সুদীর্ঘ দিনের নিয়মিত দেখাগুলোর
মধ্যে দিয়ে যে অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে সেখান থেকেই খুব প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছে
চিত্রশিল্পের কিছু সময়, কিছু পট পরিবর্তন, কিছু অনিবার্য ইতিহাসের মোড়ক।
বিশ্বের
চিত্রকলার ইতিহাসে ইউরোপের শিল্প ও তার শৈল্পিক সংবেদনশীলতার বহুমাত্রিকতাকে এই
সময়ে দাঁড়িয়ে পর্যালোচনা করাও একইরকমভাবে ছোটবেলার শিহরণকেই জাগিয়ে তুলেছে বারবার।
ইউরোপীয় চিত্রকলার ইতিহাসের নানান দিকের আগ্রহ মেটাতে একের পর এক লাইব্রেরী ঘুরে
ঘুরে কাটিয়েছি। প্রয়োজনীয় সকল বই কেনা সম্ভব না হওয়ায় অবিবেচকের মতো জেরক্স করে দুর্মূল্য
বইয়ের লেখাগুলোর কাছে পৌঁছাতে চেয়েছি শুধু। আর এই সকল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার
মাধ্যমে কেবলমাত্র এটুকুই উপলদ্ধি করেছি যে ছবির ফর্ম বা কন্টেন্টকে সমৃদ্ধ করতে প্রকৃত মালমশলার সঠিক মিশ্রণ ঐ
হদ্য শীতের দেশগুলিতে কিভাবে হয়েছে তা হাজার পাঁয়তারা করেও এখানে বসে অনুধাবন করা
সম্ভব হলেও অনুভব করা যায় না। ফলত একথা প্রকৃতই সত্য যে প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক
পরিসর ও সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় চিত্রকলার অবজেক্টিভিটিকে যেমন যথার্থভাবে
উপলদ্ধি করা বা আত্মস্থ করা সম্ভব নয় তেমনি ইউরোপীয় চিত্রকলার আলোচনায় ঠিক এ
কারণেই প্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গির অবজাক্টিভিটির ব্যাখ্যা ও অনুসন্ধান প্রাধাণ্য
পেয়েছে সর্বাপেক্ষা বেশী, তুলনায় অন্যান্য দিকগুলো থেকে গিয়েছে উপেক্ষিত।
পাশ্চাত্য চিত্রকলার ইতিহাস বরাবরই অনেক বেশী প্রযুক্তি নির্ভর, শৈলীর ব্যবহারে
যুক্তি ও বাস্তবতা প্রাধাণ্য পেয়েছে সর্বাধিক।
ইউরোপীয়
চিত্রকলার অস্তিত্ব ৩৫০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে সীমাইটদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিলো। যা
পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়ানদের হাত থেকে পারস্য, বাইজানটাইন, গ্রীক ও রোমানদের মধ্যে
বিস্তারিত হয়। ইউরোপে রোমানদের প্রতিপত্তি কমে যখন খ্রীষ্ট ধর্ম প্রাধাণ্য পায় ও
সূচনা হয় মধ্যযুগের, যা বাড়িয়ে তোলে ধর্মীয় উত্তেজনা ঠিক সেই সময় হতেই ধর্মীয়
প্রচারের হাত ধরে চার্চগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মোজাইক, রঙিন কাঁচ ও
ক্যাটাকম্ব ফেস্কোর কাজ। ক্রসেডকে কেন্দ্র
করে চর্তুদশ শতাব্দীতে ইউরোপে সাংস্কৃতিক ব্যাপন প্রাচ্য পাশ্চ্যাত্যের
মিলনের পাশাপাশি একধিক মহামারী, দুর্ভিক্ষ আবার অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ
চিত্রকলাতে গভীর প্রভাব ছড়িয়ে ছিলো। রোমের পূর্ববর্তী চিত্র শৈলীকে ছাপিয়ে সাধারণ
জনজীবনের কথাকে কেন্দ্র করে নেদারল্যান্ডে আত্মপ্রকাশ করে গথিক শৈলী।
ইউরোপীয়
চিত্রকলার মজাদার জায়গাটাই হলো এই যে যত কোনো কিছুর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা
যায় ততো যেন সরে সরে যায় ভরকেন্দ্র। প্রকৃত সচল এক শিল্পের দেশ। মধ্যযুগের অচলায়তন
কাটিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে যে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ তা নবজাগরণ নামে
সর্বজনবিদিত। আর এই পঞ্চদশ শতাব্দীর অভিনবত্ব বিশ্বের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে
সর্বক্ষেত্রে। অটোমান তুর্কীদের ১৪৫৩ খ্রীঃ-এ কনস্টান্টিনেপল অধিগ্রহণ তথা
রাজনৈতিক একাধিক নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ায় শিল্প সংস্কৃতির
পীঠস্থান হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে ইতালী। ইতালীর বিভিন্ন শহর যথা ভেনিস, ফ্লোরেন্স,
জেনোয়া চার্চের দুর্বলতার পাশাপাশি বাইরের বিশ্বের হাতছানি ও নতুন নতুন আবিষ্কারের
মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করে। “brought back new ideas, as well as spices, perfumes and other luxuries” – আরব ট্রেডার্সদের
সঙ্গে স ম্প র্কের এই প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। যা জন্ম দেয় চিন্তা চর্চা,
ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতা, দৃশ্যমান বাস্তবতার প্রবণতা।
সময়ের চরিত্রই এই যে তা জড়িয়ে থাকে নানান দিক হতে আরো আরো নানা সময়বন্ধকে নিয়ে। আর এইভাবেই ইউরোপীয় ছবির যে সময় নিয়ে নাড়াচাড়া তার ব্যাপ্তি, মূল্যায়ণ সমস্তটাই রেনেসাঁ চিত্রকলার সঙ্গে যুক্ত ওতোপ্রতোভাবে। যে রেনেসাঁ যুগের ঐতিহ্য তার বহুমুখী শিল্প আঙ্গিকে। তা প্রকৃতই রোমহর্ষক, প্রতিটি পরতে যেখানে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার কথা। পূর্ববর্তী রোমান শিল্পের প্রতি আস্থা আবার একই সঙ্গে ধর্মীয় প্রভাব ও সাধারণ জীবন সকল কিছুই যেখানে এসে একাত্ম। আর তাই বিশ্বের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা আলোচিত সময় হলো এই রেনেসাঁ।
ইতালীকে কেন্দ্র করে ধর্মীয়, সামাজিক যে সকল পরিবর্তন হয় চিন্তার জগতে তার সরাসরি ছায়া পড়ে ছবিতে। এয়োদশ শতাব্দী হতে পুর্নজাগরণের সময়কাল- চিত্রকলাকে নতুন রূপে তুলে আনে। এই সময়ের ক্রম পরিনতিগুলো কিন্তু লক্ষ্য করার মতো, পর্যায়ান্বিত। প্রারম্ভিক রেনেসাঁর মধ্যে দিয়ে যার যাত্রা আদর্শবাদী ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো, পাওলো উসেল্লা, সান্দ্রো বতেচেল্লী, ফ্রা ফিলিপ্পো লিপ্পি প্রমুখ শিল্পীদের মাধ্যমে। ধর্মীয় প্রভাব হতে কিন্তু তখনও সম্পূর্ণভাবে ছবির ভাবনা জগত মুক্তি লাভ করেনি। ফ্রা ফিলিপ্পো লিপ্পির ম্যাদোনা সিরিজের ‘ম্যাদোনা ইন দ্যা ফরেস্ট’ বা ‘ম্যাদোনা অ্যান্ড চাইল্ড ইউথ টু অ্যাঞ্জেলস্’ ছবির পাশাপাশি যদি তাঁরই ছাত্র বতিচেল্লীর কাজগুলোকে রাখা যায়, দেখা যাবে বতিচেল্লীর কাজ আদর্শবাদ থেকে সরে ক্রমশ মানবতাবাদী বাস্তববাদের দিকে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় অনুসঙ্গ বিঘ্নিত হয় নি কোথাও। আবার বতিচেল্লীর কাজের উত্তরণ তথা রেনেসাঁর পটপরিবর্তনটা ধরা পড়ে বতিচেল্লীর ম্যাদোনার কাজগুলোর পাশাপাশি যখন পরবর্তী সময়ে আঁকা তাঁরই ‘জুডিথ’, বা ‘ভেনাসের জন্ম’-কে রাখা হয়।
প্রাসঙ্গিক ও অভিনন্দন যোগ্য লেখা। ধারাবাহিক ভাবে শিল্পকলা বিষয়ক এইপ্রকার লেখা প্রকাশিত হলে ভালো হয়।
উত্তরমুছুন