কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জি

 

সমকালীন ছোটগল্প


তোমার ধুলার 'পরে

রমাকে আমি প্রথম যখন দেখি, আমার বয়স তখন দশ। ও সেদিন প্রথম আমাদের বাড়ি এসেছিল। কেমন করে মনে আছে বয়সটা? আমার জন্মদিনের কেক কাটা চলছিল তখন। প্রায় ষোল বছর আগে। কেক-এ বয়সটা লেখা ছিল।

এখন আর কেক-এ বয়স লেখা থাকে না। এখন একটা মোমবাতি, হ্যাপি বার্থডে' লেখা ট্যাগ, অনেক ক্রিম এসব দিয়ে সাজানো থাকে। মা বেকারিতে সব বুঝিয়ে দেয়। তরল ক্রিম দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে বলে।

কিন্তু আমি ওই ক্রিমের মধ্যে কিসের যেন ছাপ দেখতে পাই। চাপ-চাপ অন্ধকারের ছাপ। কেকের উপর মোমবাতি। তাও অন্ধকারটা স্পষ্ট। আমি ভয় পাই। কেকটা একটু দাঁতে ঠেকিয়েই রেখে দিই। মা তখন ব্যস্ত অতিথিদের নিয়ে। রমা কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেয়ে বলে 'কী সুন্দর দিদি'। মা ওকে দু'টুকরো দেয়। ও একটা টুকরো ওর ভাইয়ের জন্য বাড়ি নিয়ে যায়। আমার দাদা  হাক্সলে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সোশ্যাল স্টাডিজ' পড়তে গেছে। আমার জন্মদিনে উইশ ভিডিও পাঠিয়েছে ওখান থেকে। মা সকলকে দেখাচ্ছে। আমার এখনো দেখা হয়নি। আমি আলোর ভিড়ে অন্ধকার নিয়ে বসে থাকি।

রমা বৃন্তি মাসির মেয়ে। বৃন্তি মাসি ঠাম্মার সর্বক্ষণের সাহায্যকারী। মা মহিলা সমিতিতে অন্তত তাই বলেছে। আসলে সহজ ভাষায় আয়া।

ঠাম্মা বড় মানুষ ভালোবাসতো। 'মুনিয়া আমার কাছে বোস না'! আমি তখন সাঁতার আর ক্যারাটে ক্লাসের মাঝের সময়ে যুঝছি। আত্মরক্ষার সকল কৌশল শিখেছিল বাবা-মা। কিন্তু আত্মার রক্ষা? কেউ ভেবেছিল?

রমাকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিল ঠাম্মা। বদলে রমা নিয়েছিল ঠাম্মার মানুষ ভালোবাসার ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব। রমা বাড়িতে এলে মেঝেটা নাকি বড্ড ধুলো হয়। 'বৃন্তি ঝাঁট দিয়ে ঘর মুছিস'! মা বলতো। আমিও নাকি ছোটবেলায় খুব ধুলো ভালবাসতাম। আনন্দপুরের বাড়ির মেঝেতে দৌড়ে বেড়াতাম।

আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম, রমা বসে আছে ঠাম্মার ঘরের টেবিলে। সামনে একটা লাল রঙের বই। "এই কী পড়ছিলি রে"? আমায় দুধের গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলতো, "শরদিন্দু অমনিবাস, ঐতিহাসিক গল্পগুলো আজ বোঝাচ্ছিল  দিদা"। রমার চোখগুলোয় কী আছে? কোনো চকমকি পাথর নাকি? কথা বলার সময় এমন উজ্জ্বল হয় কী করে?

"প্রতিদিন অন্তত আটঘণ্টা ঘুম দরকারী", ডাক্তার বলেছিল মা'কে। আমার নাকি 'লেজি আইজ' হয়ে যাচ্ছে। মা রোজ নিয়ম করে ১১টা বাজলেই ঘরের আলো বন্ধ করে দিয়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করি। স্বপ্ন দেখি। লাল বই, উজ্জ্বল চোখ। আমার ঘুম ভেঙে যায়। রমা কত ঘন্টা ঘুমোয় রাতে?

ঠাম্মা যতদিন বেঁচেছিল রমা রোজ আসত, ঠাম্মার কাছে। বৃন্তি মাসির হাতে হাতে কাজ করতো। আমার মাঝে মাঝে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করত ওদের সঙ্গে। বাবা-মায়ের সঙ্গেও ইচ্ছে করতো। কিন্তু মা ক্লান্ত, বাবা ট্যুরে। মা ডিসিপ্লিন পছন্দ করে। "অকারণ বকবক করার অভ্যেস আনস্মার্ট", মা বলে।

আমি নাকি ছোটবেলায় ভীষণ আনস্মার্ট ছিলাম। ধুলো মাখতাম, মুড়ি কুড়িয়ে খেতাম। ঠাম্মার কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতাম।

মা তড়িঘড়ি আমায় কলকাতায় নিয়ে চলে আসে। আমায় স্মার্ট আর ডিসিপ্লিনড করতে। শৃঙ্খলার শৃঙ্খলের ঝনঝন আজও শুনতে পাই আমি।

পরে ঠাম্মাও এখানে এল। বৃন্তি মাসি এল। রমা এল। রমা মাঝে মাঝেই ওর সরু লিকলিকে হাত নিয়ে আমায় খাবার এগিয়ে দেয়। ওকে কেমন অবাক চোখে দেখি আমি। দেখার কিছুই নেই। তবুও অনেক কিছু লুকোনো আছে... খুব সাধারণ চেহারা। প্রসাধনের বালাই নেই। শুধু চোখদুটোয় যেন 'অতল জলের আহ্বান'। কোনোদিন হয়ত ওকে জিজ্ঞেস করি, 'খেয়েছিস'? ও বলত, ''তুমি খেয়ে নাও, আমি খেয়ে এসেছি''। আমি দেখতে পেতাম, ওর পায়ে ধুলোর দাগ, মাটির দাগ।

শেষদিকে ঠাম্মার সবকিছুতেই অসুবিধা হতো। বাথরুম, পায়খানা, স্নান, খাওয়া।  এই প্রথম রমার প্রয়োজন বাড়লো বাড়িতে। ঠাম্মার ঘরে খুব গন্ধ। 'আন-হাইজিনিক', বেশি যেওনা' মা বলে। মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ফিরে ঠাম্মার ঘরের বাইরে দাঁড়াতাম। সব কেমন ঠান্ডা মনে হতো। কিসের শীতলতা যেন! অনাত্মীয়তার! একটা গন্ধ পেতাম ওই ঘরে। মায়ের বলা 'আন-হাইজিনিক' গন্ধ নয়। স্নেহ আর বরফ মেশানো গন্ধ। আমি ঘরের বাইরে দাঁড়ালেই রমা ডাকত। "দিদি এসো না"! আমি কি তবে অতিথি এখানে? আমি দেখতে পেতাম, রমা একটা মাদুর পেতে মেঝেতে শুয়ে আছে। একটা অদৃশ্য হাত। রমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। কোঁচকানো চামড়ার নরম হাত। আমি নিজের ঘরে চলে যেতাম।

ঠাম্মা যেদিন চলে গেল, আমার জি.আর.ই পরীক্ষার ভাইভা ছিল। "গ্রেট লস, এত ভালো স্কোর ওর, পরীক্ষাটা দিতে পারবে না"! বাবার আক্ষেপ। কোনটা লস? ঠাম্মার চলে যাওয়া? নাকি আমার পরীক্ষা দিতে না পারা?

"আমি পরীক্ষা দিতে যাব'', জানিয়ে দিলাম। "কিন্তু লোকে কী বলবে"! মা  একবার অস্ফুটে বলল। আমার সেসব শোনার কান ছিল না। আমায় যে এখন পাথর গলাতে হবে। বাড়িতে সেই জায়গা নেই।

পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় রমার দিকে তাকালাম। ওর চোখে জল। ঠাম্মার হাতের ওপর ওর হাত। ওর গায়ে যেন ভালোবাসার একটা চাদর জড়ানো। ঠাম্মা কি ওই চাদরটা দেখতে পেয়েছিল?

আমারও কি কান্না পাচ্ছে? একটা বড় পাথর জমে রয়েছে! তাই কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি? হঠাৎ সব ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতিরা এরকম হুড়মুড়িয়ে ভিড় করছে কেন?

সেই আনন্দপুরের উঠোন, ঠাম্মার কোল, চুলে বিলি কেটে দেওয়া। বাবার নতুন ব্যবসা। আনন্দপুরের বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। ঝড়ের মত ক্রেনগুলো এসে বাড়িটা ভেঙ্গে দিল। এখানে এসেও আমায় আদর করতে চাইত ঠাম্মা। আমি যেন হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম। ফুসমন্তরগুলো এসে আমার সময় কেড়ে নিল। ঠাম্মার আদর, আবদার, রূপকথার ডানাগুলো রমার গায়ে লাগলো। আমি তখন আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট হয়ে পাতার মতো এই হাত থেকে ও হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এদিকে আমার ভেতরে একটা পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। তারপর কখন যেন অন্ধকারে সে মরে গেল।

ব্যস্ততা, স্ট্যেটাস, প্রতিযোগিতা আমায় লুফে নিল। আমার বুকের ভিতর এখন যেন হাপর পিটছে। যন্ত্রণা হচ্ছে!

এসব থেকে মুক্তি পেতেই আমি জি.আর.ইর ভাইভা দিতে গিয়েছিলাম। আমায় পরীক্ষক প্রশ্ন করছিলেন। নাম, পড়াশোনা, আরো কত কী... কিন্তু আমার কথা  কোথায়! উত্তর দিতে পারছিলাম না! উত্তর, কেরিয়ার, অ্যাম্বিশান সব কি ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল? পরীক্ষকের একটা কথাই কানে আসছিলো শুধু। ‘হোয়াই আর ইউ  ক্রাইং? হোয়াট হ্যাপেন্ড?’ আমার উত্তর ধূলোয় মিশে যাচ্ছিলো, আনন্দপুরের  বাড়ির মেঝে, উঠোনের ধুলো, আর ঠাম্মার কোলের সঙ্গে সব উত্তর মিশে গিয়েছিল সেদিন।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন