কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 


ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 (৫)           

হৃদয়ের মধ্যে তখন নেশা চেপে গেছে। ফুলের নেশা। জীবন ও জগতের সমস্ত রহস্য যেন কেন্দ্রীভূত হয়েছে ওই একটি শব্দে। এই নেশার ঝোঁকেই আগ্নেয়কে একের পর এক ছাড় দিয়ে চলেছে সে। আগ্নেয়র মধ্য দিয়েই যেন একটা পরীক্ষা করে চলেছে। এই সময়ই একদিন কথাটা মনে হলো প্রয়োজন। আচ্ছা, আমরা দুজনে মিলেই একটা ফুলের বাগান করতে পারি না?

আগ্নেয় সানন্দে রাজি হল। তারপর বলল, কোথায় পাবি ফুল?

বিদেশ থেকে আনব। অন্যান্য দ্বীপ থেকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসব। এই দেশের অনেক দ্বীপেই এখনও দুর্লভ, সুগন্ধী, চমৎকার সব ফুল ফোটে। তাদের এই বাগানে নিয়ে এসে এক জায়গায় জড়ো করব।

তার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। অনেক খোঁজের দরকার। তাছাড়া ফুল এনেই বা কী হবে? এখানে এই হৃদয়পুরে ওরা টিকবে না। মরে যাবে।

না, মরবে না। আমি একটা জায়গা জানি।

তাই নাকি? কীরকম?

হৃদয়পুর দ্বীপের সবচেয়ে পুরোনো ক্যাথিড্রাল। তুই জানিস জায়গাটা। বহুদিন পরিত্যক্ত। বহু জায়গায় ভেঙেচুরে গেছে। তার পিছনদিকে অনেকটা ফাঁকা জমি আছে। ওখানে আমরা ফুলের বাগান করব।

অনেকদিন ওখানে ফুলের চাষ হয় না। আমরা করব। একসময় ওখানে প্রচুর ফুল হতো। আমি বইতে পড়েছি। ছবিও দেখেছি। ক্যাথিড্রালটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ওদিকে আর বিশেষ কেউ যায় না। আমরা যাব। ওখানে ফুল বাঁচবে।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। জায়গাটা সত্যিই চমৎকার। ঠিক পিছন থেকেই উঠে গেছে পাহাড়। সামনে ক্যাথিড্রাল। একদিকে জঙ্গল। অন্যদিকে নদী। কিন্তু শুধু তুই আর আমি মিলে পারব কেন?

একদম খাঁটি কথা। তাই একে একে ওদের সঙ্গে জুটে গেল বিশ্রুত, নির্মাল্য, অনির্বেদ, অতলান্ত, শ্রমণ, বিহান, সমধা, সাঁঝ, দিশারী, আরো কেউ কেউ। পুরোদমে ফুলের বাগান তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল। চারিদিকে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সবাই যে যার সাধ্যমতো পরিশ্রম করে। অর্থ জোগাড় করে আনে। আর তা নিয়েই একদিন অশান্তি হয়ে গেল। অতি তুচ্ছ কারণ।আগ্নেয় সবার সামনে রাগ দেখিয়ে বাগান ছেড়ে চলে গেল।

আগ্নেয়কে খুঁজতে গেল হৃদয়। সমুদ্রের ধারে একটি নারকেল গাছের নীচে তাকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। তাকে অনেক করে বোঝালো হৃদয়। আগ্নেয় মুখ ভার করে বসে আছে। এরকম প্রায়ই হয় তার। এখন আর তারা দুজন নেই। আরও ছেলেমেয়ে আছে। তাদের সামনে হঠাৎ হঠাৎ সে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। হৃদয়ের সঙ্গে মতের অমিল হলেই এটা হয়। আর সেটা এখন প্রায়ই হয়। আগের মতো কেন জানিনা ওদের আর মতের মিল হয় না। তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারে হৃদয়ের বিরোধিতা করে আগ্নেয়। মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। তখন তাকে সামলানোর দায়িত্ব নিতে হয় হৃদয়কেই।

অর্ডারটা কে দিয়েছিল? আগ্নেয় জানতে চাইল।

আমি।

কিন্তু এই ফুলটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমি তো অন্য একটা বেছে ছিলাম।

ঠিক আছে, সেটাও আনা হবে।

আনা হবে? কেন? তোর পছন্দের ফুল আনা হল। আমারটা আনা হবে কেন?

শেষপর্যন্ত অবশ্য আগ্নেয় ফিরতে রাজি হল। তবে আধ ঘন্টা পরে।

আগ্নেয়কে ফিরতে দেখে হৃদয়ের যেন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। তার প্রিয় বন্ধু ফিরে এসেছে। আগ্নেয়কে জড়িয়ে ধরে তার গালে সে একটা চুমুই খেয়ে বসল। সেদিন সবাই বুঝতে পারল এই বাগানে আগ্নেয় কতটা অপরিহার্য। হৃদয় তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি। সে ফিরেছে নিজের ইচ্ছায়। বন্ধুর সেই সদিচ্ছায় হৃদয় যেন কৃতার্থ হয়ে গেছে। চুমু খেয়েছে তাকে। আগ্নেয়র মেজাজ কোনও তুচ্ছ মানুষের মেজাজ নয়। সেদিন সবাই সেই মেজাজের দাম বুঝতে পারল।

হৃদয় একটা দুর্লভ ফুল খুঁজছে। কয়েকদিন পর এক সকালে হৃদয় সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ কে একজন পিছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। পিছন ফিরতেই দেখল, আগ্নেয় দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খুব চেনা দুষ্টুমির হাসি। হাতে সেই দুর্লভ ফুল।

কোথায় পেলি? খুব খুশি হয়ে হৃদয় জানতে চাইল। 

আমার এক দাদাকে দিয়ে আনিয়েছি। গতকালই সে বিদেশ থেকে ফিরেছে। ফোন করে দিয়েছিলাম।

এইভাবে আগ্নেয় হৃদয়ের সেই চুমুর প্রতিদান দিল।

হৃদয় সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শুনিয়ে বলল, এভাবেই ফুল জীবনকে সুন্দর করে।

আগ্নেয় কিন্তু পালটে যাচ্ছিল। সারা সপ্তাহ ধরেই ওদের ফুলের বাগান নিয়ে নানা কাজকর্ম হতো। রোববার বিকেলে সমুদ্রের ধারে ওরা জড়ো হতো। তখন কে কী কাজ করছে, কে কী কাজ করার কথা ভাবছে বা করতে চায়, এইসব নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো। অনেক রাত পর্যন্ত এইসব চলত। সঙ্গে থাকত মুড়ি আর তেলেভাজা।

সবার মধ্যে যখন আগ্নেয় থাকত, ও যেন একেবারে পালটে যেত। হৃদয় কথা বলত উদ্দীপ্ত হয়ে, ভেতরের গভীর প্রেরণায়, প্রচণ্ড আবেগতাড়িতের মতো। তখন অন্য কারো অমনোযোগ সে সহ্য করতে পারত না। আগ্নেয়কে দেখে কিন্তু একটু অন্যমনস্কই মনে হতো। সে কখনই হৃদয়ের মুখোমুখি বসত না। নিজেকে একটু আড়ালে বা অন্ধকারে রাখত। আর অবিরাম অতলান্ত, অনির্বেদ, সমিধা বা বিহাবের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে যেত। ওর মুখে সবসময়েই লেগে থাকত কেমন একটা বাঁকা হাসি। অনেক সময় ওদের নিজেদের মধ্যেও হাসাহাসি হতো। হৃদয়ের এতে অস্বস্তি হতো। অনেক সময় সে বাকিদের মত জানতে চাইত। আগ্নেয় তখন বেশ ভেবেচিন্তেই মত জানাত। বেশ একটা গুরুগম্ভীর ভাব আনত কণ্ঠস্বরে। বোঝা যেত, হৃদয়ের কথাগুলো সবই সে শুনেছে। কিন্তু কীভাবে, কতটা গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোকে গ্রহণ করেছে, তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা যেন থেকেই যেত।

বিশ্রুতের সঙ্গে হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। একদিন মাকে সেকথাই বলছিল হৃদয়। তার মা জানতে চাইলেন, কিন্তু তুই তো বলতি, আগ্নেয় যে ফুলদানিটা আনিয়েছে...

আগ্নেয় অনেক পালটে গেছে মা। আগের সেই আগ্নেয় আর নেই। ওকে নিয়ে এখন কেমন আমার অস্বস্তিই হয়। বরং বিশ্রুত অনেক স্পষ্ট, পরিষ্কার, সমর্পিত। আমার স্বপ্নটাকে ও অনেক বেশি নিজের করে নিয়েছে। ওর কাছে যে ফুলদানিটা রয়েছে, সেটাই আমার বেশি প্রিয়...

ঠিক সেই সময় আগ্নেয় ঘরে ঢুকছিল। হৃদয় বুঝতে পেরেছিল, সে সবই শুনেছে। আগ্নেয় কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্যই করল না।

এরপর থেকেই আগ্নেয় বিশ্রুতের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। দুজনে সব সময় কেমন একসঙ্গে থাকে, নিজেদের মধ্যে গোপনতা বিনিময় করে, ফিসফিস করে কথা বলে, হাসাহাসি করে, কোনও কারণ ছাড়াই একে অপরের সঙ্গে দেখা করে। দুই প্রিয় বন্ধুর মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা হৃদয়ের খুব ভালো লাগছিল। ওরা যেন ওকে দেখিয়েই, ওকে সাক্ষী রেখেই, নিজেদের বন্ধুত্বকে একটা দর্শনীয় ব্যাপার করে তুলেছিল।

হৃদয় তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শুনিয়ে বলত, দুটি প্রিয় আত্মা, আমার খুব কাছের, এ আমার চোখে কাম্য, সুন্দর, হিতকারী ও সমর্থনযোগ্য।

তিন বন্ধু মিলে একটা দূরের দ্বীপে যাবে বলে রওয়ানা হল। এই দ্বীপটি আকারে ছোটো হলেও প্রকৃতি যেন উজাড় করে নিজেকে মেলে ধরেছে এখানে। তাছাড়া এখানে রয়েছে দৃষ্টীনন্দন, দুর্লভ, নয়নাভিরাম সব ফুল। আর নৌকায় যেতে যেতে সে কথাই বলছিল হৃদয়। আবেগে তখন সে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। কীভাবে ওরা সারাদিন সেই দ্বীপে কাটাবে, খুঁজে খুঁজে বার করবে সেইসব ফুল, তারপর তাদের নিয়ে এসে নিজেদের বাগানে সাজাবে, এসব নিয়েই নিজের নানা পরিকল্পনার কথা বলে চলেছিল সে। সঙ্গে দুই প্রিয় বন্ধু। মন খুলে কথা বলার এই তো সময়।

কিন্তু দুই বন্ধু যেন ওর কথা শুনছেই না। ওরা রয়েছে সম্পূর্ণ অন্য মুডে। হালকা মেজাজে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসিঠাট্টা করছে, নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে, ওর অস্তিত্বকেই যেন অস্বীকার করতে চাইছে। ওর কথায় ওদের কোনও মনোযোগই নেই, ওর আবেগ ও উত্তেজনার ব্যাপারে ওরা সম্পূর্ণ উদাসীন। ওদের যে কোনও দূরভিসন্ধি আছে, সেটা তখনও টের পায়নি হৃদয়। টের পেল সেই ছোট্ট, সুন্দর দ্বীপটায় পৌঁছানোর পর।

(ক্রমশঃ)  

 

 

 

 

 

   


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন