কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৭৫   



কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২০




এবছর ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স  গিল্ড’ আয়োজিত কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ছিল, চুয়াল্লিশতম বইমেলা। বিগত শতাব্দীর ১৯৭৬ সাল থেকে যাত্রা  শুরু করে, ভবঘুরের মতো শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করে, গত তিন বছর যাবৎ সল্ট লেকের করুণাময়ীর সেন্ট্রাল পার্কে সাময়িক ভাবে থিতু হয়ে বসার ভাবনায় ছিল; যদিও বিশ্বস্ত সূত্রে খবর, আগামী বছর তার আগের ঠিকানা মিলন মেলায় আবার ফিরে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর, হয়তো বা স্থায়ীভাবে থিতু হবার বাসনায়। সে যাইহোক, বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে ভবঘুরের মতো উৎখাতের যাবতীয় যন্ত্রণা ও অবমাননা সহ্য করেও এখনও নিজের ‘মেলা’ এবং ‘উৎসবের’ বৈশিষ্ট্যকে সযত্নে বুকে ধরে রেখেছে, তার অদম্য প্রাণশক্তিতে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি হতাশা ও ক্লান্তির আঁচড়, এটা সত্যি সত্যিই বুক ফুলিয়ে বলার মতো একটা কথা। বিশেষত চুয়াল্লিশ বছর অতিক্রম করেও সে যে এখনও প্রবীণ হলো না, বরং আরও আরও নবীন হয়ে উঠল, দিনে দিনে তার রঙবাজি গেল বেড়ে, সে কথা তো অতি নিন্দুকও স্বীকার করতে বাধ্য। আরও বড় কথা হচ্ছে, মেলার বয়স যত বেড়েছে, বড় বড় মাপের প্রকাশনীর পাশাপাশি মাঝারি এবং ছোট ছোট মাপের প্রকাশনীও মাথা তোলার সাহস অর্জন করেছে, তাদের উচ্চতা ক্রমেই উচ্চতর হয়েছে। আবার এরই পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা দামামা বাজিয়ে ঘোষণা করেছে অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন; নির্ভেজাল সততা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে দাবি করেছে, সাহিত্যের মূল  ধারাকে বহন করে চলেছে তারাই।  


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের গত সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে। কথা ছিল, তার পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হবে যথারীতি ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু বস্তুত কলকাতা বইমেলায় ব্যস্ততার কারণে তা সম্ভব হয়নি। অনেকটা দেরি করে আজ প্রকাশিত হলো এই প্রত্যাশিত সংখ্যাটি, যদিও নিয়মিত বিভাগগুলি প্রকাশ করা হলো না, বরং তার পরিবর্তে সদ্য সমাপ্ত এ বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাকে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হলো। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন বন্ধুকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম এই বিষয়ে মুক্তগদ্য লিখে পাঠানোর জন্য। আমার অনুরোধে তাঁদের মধ্যে অনেকেই লেখা পাঠিয়েছেন, কেউ কেউ বিভিন্ন কারণে লেখা পাঠাতে পারেননি, যদিও সবাই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হবে আগামী মার্চ মাসের শেষে। এবং বলা বাহুল্য, সেই সংখ্যা থেকে যথারীতি নিয়মিত বিভাগগুলি প্রকাশ করা হবে।

শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানাই সবাইকে।





আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.


<<<< মুক্তগদ্য >>>>


অগ্নি রায়




অলৌকিক পার্চমেন্টের ঘ্নাণ





তোমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে আমার বরাবরই দেরি হয়ে যায়। হাজার বছরের মনীষার আলো অন্ধকার টানেল পার হয়ে অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে যাওয়া তো! একটি অক্ষর থেকে অন্য অক্ষরে পা দিয়ে, বড় সাবধানে চলার এই  টানেলের পাশে জংলা ঘাসের মত প্রতিষ্ঠানের প্রমাদ। পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যেই মিশে থাকে অচেনা হাতের বরাভয়। উতরোল এই উৎসবের মধ্যে চা রঙের বিকেল হল। ক্লান্ত অ্যানাউন্সমেন্ট থেকে উড়ে যাচ্ছে সুসংবাদ। যত ভিড় ততোই নাছোড় হয়ে চেপে বসছে এই আকেলাপন। তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এসে একশো বিয়াল্লিশ নম্বর স্টল পার হলেই দেখবো তুমি বাইরে বসে আছো। সেলফিপ্রাণ মানুষ ঘিরে রেখেছে তোমার আভাতিবেলা লবণাম্বুরাশে!  লাতিন আমেরিকার স্টলে কলঙ্করেখার মত জেগে উঠছে জাদুবাস্তবতার রাত। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে অ্যাপ বিক্রি করছে ডেনিম যুবতী।     

এ সবের মধ্যে শৈশবের বই কেনার রোমাঞ্চ নিয়ে ফিরে এলে তো পারো পতঙ্গপ্রাণ! মৃত কবিরা তাকিয়ে আছেন টের পাই। পিঠের কাছে কার যেন হাত। শিরশির করে স্নায়ুকলকারখানায়। মায়াকুচির মত শীত লেগে থাকা বাতাসে ঝরা ফুলের মত পংক্তিমালা ছুঁড়ে মারছেন তাঁরা। কোথাও ধুলোশিশির আড্ডা চলছে। মাটি ফুঁড়ে উঠছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুমুখ। কোথাও নতুন টেরাকোটা কানের দুল অথবা কাঁধে বিড়ম্বিত ট্যাটু-র উৎকন্ঠা। কোথাও কেউ আজ যেন মেরুন বাইলুম হয়ে আকাশে বইয়ে দিয়েছে আঁচল। গিল্ডের সামনে কেউ কি আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল? জানা যাবে না কখনই।

বই-শিকারিদের সঙ্গে ভিড়ে স্টলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে জানি বাবার হাত ফিরে আসবে কখনও। অন্তত একবার। ইতস্তত আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে মলাট। নাগরদোলার মতন সময়ের এ এক বৃত্তপাক যেন। মেলা তো কখনও একা আসে না। তোমাকে নিয়ে আসে। আনে অসুখ আর ক্লান্তি, বিপণন, মস্করা, বিরহ-বিপ্লব, কফি সভ্যতা, পায়ের ব্যথা আর অলৌকিক পার্চমেন্টের গন্ধ। পান্ডুলিপির ধার ঘেঁষে আমাকে পাহারায় বসিয়ে চলে গেছে বসন্ত সময়, রচনাকৌশল, গিটারের নীল রিড। আমি হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কোথাও পৌঁছাতে পারছি না। কোথাও কি পৌঁছানোর ছিল? এই মেলা আমাকে পুরোপুরি আত্মস্মাৎ করে ফেলার আগেই আমি তাকে বোতলের লিমকায় মিশিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকি।

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




       বইমেলা মইমেলা  





     
        
বইবইমেলায় প্রথম যাই ১৯৭৬ সালে, যদিও তার আগেই বইমেলা বসেছিল। ১৯৭৪ সালে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে গুটিকয়েক তরুণ প্রকাশক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ঢঙে একটি বইয়ের মেলা করার কথা ভাবলেন, আর প্রবীণদের আপত্তি (‘বই কি কাপড় নাকি, যে তাকে মেলা হবে, বা তার মেলা হবে?’) যথারীতিএতে জল ঢেলে দিলেও ১৯৭৫ সালে পাবলিশার্স অ্যাণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড প্রতিষ্ঠিত হলো, আর ৫৬টি স্টল ও ৩৪টি প্রকাশক নিয়ে আফা গ্যালারির উলটো দিকের মাঠে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে, ১৯৭৬ সালের ৫ই মার্চ গিল্ড বইমেলা বসিয়ে দিলো। উদ্বোধন করলেন যাকে বলে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোক হাওড়ায় থাকতেন, আম্মো তখন। আমি একটু দোনোমোনো ক’রে কলেজস্থল কাটোয়া থেকে এসে ঘণ্টাখানেক বা দুয়েক নাকি তিনেক (অত মনে থাকে?) মুক্তকচ্ছ, বিমূর্ত, প্লেটোনিক আত্মার মতো ঘুরে, ফেবার থেকে বেরোন সার্ভান্তেসের ডন কিহ্বোতে-র পূর্ণাঙ্গ ইংরিজি অনুবাদ কিনে (একটাই! অসময়ে বে’ করায় পয়সা ছিলো না।ডন কিহ্বোতে, আগে পড়েছি, কিন্তু ওইটা এখনও পড়া হয়নি! অনুবাদে ক্যান? আমি পি. ভি. নরসিমা রাও নাকি, যে সব সাহিত্যের বই সেই ভাষায় পড়বো, প’ড়ে গান্ধী ফ্যামিলির… যাক্ গে! আমি সুরেন  বাঁড়ুজ্জ্যের জেতের লোক, যাঁকে কবি মনমোহন ঘোষের সামনে মাইকেল ‘কুলিকাবাডি’ বলেছিলেন,  ক্যালইউ তথা আজকের ক.বি. থেকে ইংরিজি সাহিত্যে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া সত্ত্বেও, সব ভাষার সাহিত্য ইংরিজিতে পড়ার জন্যে; আর যাঁদের সম্পক্কে বিদ্যাসাগর আরো খারাপ কথা বলতেন, বলতেই চাঁটগার  ভাষায় ‘আত্তে হারাপ লাগে’)  নিউ জলপাইগুইড়ি প্যাসেঞ্জারে  কাটোয়া ফিরে গেলাম। পরদিন কলেজ ছিল। টিকিট হলো পঞ্চাশ পয়সা। ১৯৭৯ সালে বাঙলা ভাষায় প্রকাশের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা ১০ই ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রসদনের উল্টো দিকের মাঠে বইয়ের প্রদর্শনী-কাম-মেলা বসালো। তার পরে আশির দশকের প্রথম দিক থেকেই বইমেলা্র গেটগুলো প্রখ্যাত সব বিদেশী আন্তর্জাতিক স্থাপত্যের মডেলে বানানো হ’তে লাগলো (হ্যাঁ দিদির আমলে কলকাতাকে লণ্ডন, বাংলাকে বিশ্ববাংলা, আর ইকো পার্ককে গ্রিসিজিপ্টফ্রাঁসিংল্যাণ্ডভারতমেলানোনবম আশ্চর্য করার আগেই!)। ১৯৮২ সালের বইমেলায় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরিচালক পিটার উইদার্স এলেন; আর সোনায় সোহাগা, ১৯৮৩ সালে জেনিভাস্থ আন্তর্জাতিক প্রকাশক সমিতির সাধারণ সচিব শ্রীযুত্ কৌট্‌কৌমৌ (Koutcowmow) যাকে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপুস্থিত হলেন। ফলে, অশোক ঘোষ মশায় কলকাতা বইমেলাকে আন্তর্জাতিক শংসায়ন পাইয়ে দিলেন। তার পর থেকে বইমেলা হৈহৈ ক’রে বাড়তে থাকায় রবীন্দ্রসদন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশেপাশে আর আঁটানো গেল না। ফলে বইমেলা গড়াতে গড়াতে গেল  পার্ক স্ট্রিট আর আউটরাম ঘাটের মধ্যেকার গড়ের মাঠে। নতুন ভেন্যু! একবারই গেছিলাম সেবার। রজনী কোঠারির সম্পাদিত Caste in Indian Politics কিনে ফিরে এলাম।

       ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমলার অনুকরণে কলকাতা বইমেলা ১৯৯১ সাল থেকে একটা ফোক্যাল থিম করা শুরু করলো আসাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা, এমনকি পঃবঙ্গ (‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’-অর্ধ) এই সব রাজ্যের শিল্প (কারখানা অর্থে নয়, কোনোটাতেই বেশি কারখানা ছিলও না, হতোও না), সাহিত্য, সংস্কৃতি সব তুলেটুলে ধ’রে (বাকি রাজ্যগুলো গব্বের ছাদ্দে গেল), ১৯৯৭ সাল থেকে বিদেশকে পাকড়ানো শুরু হলো। ১৯৯৭-এ ফ্রান্স, আটানব্বইয়ে ব্রিটেন, নিরানব্বইয়ে বাংলাদেশ, দু’হাজার ছয়ে স্পেন, সাতে অস্ট্রেলিয়া, আটে আমেরিকা, নয়ে স্কটল্যান্ড, দশে আবার আমেরিকা, এগারোয় মেক্সিকো, আঠারোয় আবার ফ্রান্স, উনিশে গুয়াতেমালা, এই বিশে রাশিয়া। আবার   সাতানব্বইয়ে ফ্রান্স ফোক্যাল থিম হওয়াতেই বোধহয় ফ্রান্সের মমার্তের ঢঙে খোলা আঁকার জায়গা করা হলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেক খাওয়ার দোকানও ছিল, আর সেখানে রান্নার ব্যবস্থাও ছিল। বইপ্রেমিকরা খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে ফুঁকছিলেনও বটেই; হয়তো জলও লেস্‌ড ছিল। ফলে, জানা নেই কেন, বইমেলা দাউদাউ পুড়ে গেলো, যদিও তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী, বাংলায় এমএ, সাহিত্যিক, বুদ্ধদেব  ভট্টাচার্য তিনদিনের মধ্যে ফিনিক্স পাখির মতো বইমেলাকে আবার খাড়া করে দিলেন (নরনোক ঠিকমতোই ভুলে গেছে। বাসব বসাক ছাড়া)। আমি জলে ভেজা Eric Bronner সম্পাদিত Twentieth Century Political Theory জলের দরেই কিনলাম। বইমেলায় আমার প্রথম ফায়দা! নইলে সারা বছর কলেজ স্ট্রিটে কুড়ি পারসেণ্ট পাওয়া, বিদেশি পাবলিশার্সের নিজেদের হাউসে তেত্রিশ পারসেণ্ট পাওয়া, বই সাপ্পলায়ারের কাছে ধারে পঁচিশ পারসেণ্ট পাওয়া মাল দশ পারসেণ্টে বইমেলায় বই কিনবে?

       তো, ২০০৬ সালে স্পেনকে ফোক্যাল থিম ক’রে বইমেলা শেষবারের মতো গড়ের মাঠে হলো। তার পরেই পরিবেশবাদী সুভাষ দত্ত বইমেলাকে গড়ের মাঠ থেকে বাদ্যি বাজিয়ে উৎখাত করে দিলেন। গিল্ডের আড়া কাজ বাড়া হলো। গড়ের মাঠে আদ্ধেক তৈরি কাঠামো ভেঙে দিয়ে বইমেলাকে ২০০৭ সালে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে আসতে হলো সল্টলেক স্টেডিয়ামে। ময়দানের তেইশ একরের জায়গায় স্টেডিয়ামের দশ একরে গাদাগাদি ক’রে। একে অল্প জায়গা। তায় অস্ট্রেলিয়া ফোক্যাল থিম! একেবারে কেরাসিন জ্যাম! ২০০৮ সালে বইমেলা হবার কথা পার্ক সার্কাস ময়দানে হবার কথা! ফোক্যাল থিম আমেরিকা। তার সাতষট্টি জন ডেলিগেট উপুস্থিত। কিন্তু আবার পিল গিলতে হলো বইমেলাকে। ফলে গিল্ডের অধিকাংশ সদস্য তেত্রিশ নম্বর বইমেলাকে একবছর স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এমনটা হয়েই থাকে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ অলিম্পিকই তো হয়নি (হয়েছে কি? মনে থাকে না আজকাল, বা বর্তমান বা আনন্দবাজার যাই বলুন! যুগান্তর বা অমৃত তো আর নেই এই দেশ-এ, বলুন!)।

      সে যাই হোক! শক্তির ভাষায় বইমেলা তখন ‘কলকাতার প্রকৃতির অশ্লীল তদন্তে চমৎকার,/ পোঁদের জ্বালায় হু-হু করতে করতে দিক্ বিদিক হারা’। এই কবিতাটা অবশ্য বইমেলায় বেরোয়নি। বেরিয়েছিল মুক্তমেলায়, প্রকাশ কর্মকারের ছবির সঙ্গে। দেহেন, আমি পলিটিক্যাল সায়েন্সের মাস্টার, এইসব লিখতাসি। কার কর্ম কে করে, কে করায়, কালিই জানে, ছাপার কালি  নয়, গডেস ভেকেণ্ট, নবদ্বীপ হালদার উবাচ। লোকজনও ভাবছে, বইমেলা উঠলো, কলকাতার কী হবে? বিভ্রান্ত হয়ে লোক শক্তির কবিতাই আউড়ে যাচ্ছে —‘তবে নাকি কলকাতায় নিরঙ্কুশ প্রাণিহত্যা হবে?/ শিল্প হবে? তেজারতি কারবার খাওয়াবে ভিখিরিরে?/ মাঙ্গল্য বিদেশ থেকে আনা হবে, হে শিক্ষানবিশ/ ন্যূনতম টেলিফোন পোঁতা হবে পাহাড়ের শিরে-!’ (কী খেয়ে যে লিখতে গুরু! আম্মো তো খাই! কিন্তু মাল তো বেরোয় না! ইন্সিডেন্ট্যালি, মাঙ্গল্য কী হে, মাঙ্গলিক নাকি? উইন্ডোজ দীর্ঘ ঈ দিলেই ঝামেলা করে! যাক, মাঙ্গলিক সে তো মুন্নাভাই এমবিবিএস-এ আছে, বাইরে একমাত্র বচ্চনজীর পুত্রবধূর! তাও বে’ দিয়েছে ছেলের সঙ্গে! হেব্বি পগতিশীল! কিন্তু ছেলের ছবি করা তো ঘেঁটে ঘ! বইমেলায় যাবে এইবার?)।

        কিন্তু আসল কথায় আসি। বইমেলা না হ’লে কলকাতার কিচ্ছু ছেঁড়া যেত না। কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট আছে, যার বাস শিবের ত্রিশূলের উপরে (তৌসিফের ছবিতে আছে তো ত্রিশূল? নইলে বিপদ!)। কিন্তু তার পর থেকে বইমেলা তেত্রিশ নম্বর মানে ২০০৯ সাল থেকে মিলন মেলায়! তখন আমি কাটোয়া, কলেজ থেকে লেখালেখির সূত্রে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ২০১০ সালে পেসমেকার লাগানোর পরেও মেয়ে গাড়ি কিনে দিলেও, আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাস থেকে সল্ট লেকের আড়িতে (বাড়িতে লিখিনি) ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ পড়লেও, কেবল পার্কিং-এর সমস্যার কারণে নামতে পারি না। গাড়ি ছাড়া যাওয়াই যায়। কিন্তু গিয়ে আসার সময় ছোট (AS-1) বাসে ওঠা যায় না! সে কারণে বেশি যাইনি। একবারই দেখতে গেছিলাম ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বেরোন রবীন্দ্রনাথের উপরে লেখা আমার তেইশ জোয়ান গাব্দা বইকে ওদের স্টলে সেজেগুজে কেমন   দেখাচ্ছে দেখতে। ২০১৪-তেও গেলাম মনোহর বুক্স থেকে বেরোন আমার ২০১৩ সালেই রুশ ওরিয়েণ্টালিজম-এর উপরে গাব্দা বাইশ জোয়ান বই কেমন দেখাচ্ছে ওদের স্টলে সেজেগুজে, দেখতে। স্বার্থপর বলবেন তো? কিন্তু বই বইমেলায় বা অন্যত্র রিলিজ করাইনি, প্রচার করিনি ফেবুতে। একটু দেখতে চাইবো না, নিজের সন্তানকে বিশ্বলোকের মধ্যে?

       ইতিমধ্যে কালিমাটির কাজলবাবু তাঁর কাজলচোখে আমায় মেয়ের সূত্রে চিনে নিয়েছেন, আর ঐহিকের তমালবাবুও ওই ভূমিকালিপি পূর্ববৎ। ফলে বোধহয় ২০১৬ তে একবার গিয়ে পড়েছি, দেখে তমালবাবু মঞ্চে উঠিয়ে নিয়ে বক্তৃতা দিইয়ে নিলেন। অতি ভদ্র লোক, সজ্জন, কৌরবের প্রতিষ্ঠাতা কবি, গদ্যকার,  ভালোপাহাড় নির্মাতাশ্রী বারীন ঘোষাল বিস্মিত হ’লেও কিচ্ছু বললেন না, মনে আছে (অভ্রয় টাইপ করতে গিয়ে নিচে সবুজ লাইন এলে আর টাইপ করবেন না, আগেরক্ষর পরেরক্ষর জুড়ে যাবে)। এক প্রবাসিনী তমালবাবুর কথায় গ্যাস খেয়ে গিয়ে আমাকে কৌরবের স্টলে নিয়ে গিয়ে নিজের দুটি কবিতার বই  উপহার দিয়ে দিলেন। কী ভালো ভালো কবিতা! মনে আছে। পরের বছরই আমাদের অনেককে কাঁদিয়ে বারীনবাবু চলে গেলেন। 

তবু ‘মন চাঙ্গা তো কেঠোয় গঙ্গা’ এই আপ্তবাক্য প্রমাণ ক’রে বইমেলা গত তিন বছর ধ’রে, ২০১৮ সাল থেকে বাড়ির কাছে উঠে এসেছে। সল্ট লেকের সেন্ট্রাল পার্কে। ২০১৮-য় গেলাম, কারণ Sage Publishers-এর জন্যে একটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কটকটে বই লিখছি ছয় বছর ধ’রে। Sage-এর ডাইরেক্টর পাবলিশিং আর্‌তি ডেভিড, আর কমিশনিং এডিটর টেক্সবুক অমিত কুমার ডাকলেন দেখা করতে। এই বছরই বেরোবে। আর ছাত্র কেশব মণ্ডলের বই রিলিজ হলো। তাতে বলতে গেলাম। ২০১৯-এ  ঐহিকের তমালবাবু (তমাল রায়, ইতিমধ্যে তমাল হয়ে গেছেন) ডেকে পাঠালেন। ওদের পুরস্কারপ্রাপ্তদের পুরস্কার টুরস্কার হাতে তুলে দিলাম। মাননীয় সৌরীন ভট্টাচার্য বারীনবাবুর মতোই অবাক হয়ে তাকালেন। কিচ্ছুটি প্রকাশ করেন নি অবাকভাব। আর ২০২০-তে মেয়ে ‘বহতার ঠুং শব্দ হলেই কবিতা’ নামের বই বেরোল। ঐহিক থেকে। নাতির সেথো হিসেবে যেতে হ’লো কবার। আর একবার তো ঐহিকের কাছ থেকে সম্বর্ধনা নিতে। তাতে আবার বললেন কাজলবাবু! কী কাণ্ড। সবাই বেশ অবাকই হলো। চোখ ভর্তি কেন? কিন্তু মুখে কেউ কিচ্ছুটি বললো না; সজ্জন!

 কিন্তু থাকলাম লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নেই বেশি। ওর কাছেই অনেক খাবার দোকান। আর সেখানে তেপান্তর নামের একটি দোকানে ফিশফ্রাই, ব্যাম্বু বিরিয়ানি থেকে গুগলীর কাবাব অবধি পাওয়া যায়। দূরে পরিযায়ী রাজহাঁসের মতো বড়বড় সাদা তাঁবুর মধ্যে অজস্র স্বদেশী, আর বিদেশী দোকানে যাই নি। কলেজ স্ট্রিট, ফ্লিপকার্ট, আমাজন, কিন্ড্ল, এই সবেই দিব্যি চলে যাবে। শুনছি পরের বছর থেকেই বইমেলা আবার মিলন মেলায়। আর কত ঘুরবি গুরু, রামনাথ বিশ্বাসের মতো? নখের নিচে ডুডুপোকা ঢুকে যাবে যে!

 আচ্ছা এই যেটা পড়লেন, মুক্তগদ্য কি একেই বলে? জানি, না হলেও কিছু আসে যাবে না। কাজলবাবু ছাড়া আমার লেখা কেউ পড়েন না। সেটাই ভালো।  

ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়




বসন্ত যে রঙিন বেশে ধরায় সেদিন অবতীর্ণ




বইমেলায় এবার আমি মাত্র একদিন গিয়েছি। তাও যে খুব মন চেয়েছিল তা নয়। কিছুটা জোর করে, বন্ধুর আন্তরিক আমন্ত্রণেই গিয়েছিলাম। কবি বন্ধুদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি সম্মানিত। ব্যাস, এই পর্যন্তই। 

না, বইমেলা নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই নেতি নেতি কথা দিয়ে শুরু করে দিলাম। অনেকেরই ভালো লাগবে না ‌। কথাও নয়। কিন্তু কী করি? আমি নাচার।
আমার সত্যি বইমেলায় যেতে ভালো লাগে না। অশিক্ষিত, বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন মনে হলে হোক। বইমেলায় চেয়ে আরো সারা বছর ধরে যেসব মেলা হয়, সে বরং ঢের ভালো। দূর দূর থেকে শিল্পীরা তাদের হাতে তৈরি সামগ্রী নিয়ে আসে, মুগ্ধ হয়ে কিনি, গ্রামের দিকে মেলায় বনবন করে নাগরদোলা চড়ি, আচার খাই, একনাগাড়ে ভেঁপুর আওয়াজ শুনতে শুনতে ফিরি। এর এক নিজস্বতা আছে। যা ভিতরে তাই বাইরে। 

আমরা যে পথ ধরেছি সেখানে মন আর মুখ এক থাকছে না। অনেকটাই দূরত্ব মন আর মুখের মধ্যে। সত্যি বলতে কি, ইদানিং বইমেলায় গেলে এই অনুভূতিটাই বেশি করে হয়। আর যত এটা হয়, আরও বেশি করে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। না, ভৌগলিক স্মৃতিচারণ নয়। ময়দানে কি ছিল, মিলন মেলা কেমন ছিল, সল্টলেক কতটা আলাদা, কিচ্ছু এসে যায় না তাতে। আসল হল অন্তরে তুমি কত বদলেছো বইমেলা! অনেকটাই। বদলে গেছে বই ? না। বদলে গেছে শুধু মানুষ। মেলার মানুষ আর মেলা মানুষের যেখানে তফাৎ সেখানেই হঠাৎ করে মনে হয়, কিছু নেই, সব কেমন ফাঁকা, অন্তঃসারশূন্য। 

অনেকে দেখি বলছেন, বইমেলায় বই কেনার চেয়ে খাবার কেনার বেশি হুজুগ। 
আমি মনে করি, বেশ করবে খাবে। কেন খাবে না? মেলার মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে এটা ওটা মুখে চালান করতে করতে কলেজ বেলার অকারণ তর্কগুলো খুব মনে পড়ে। আজ যেগুলো অকারণ মনে হচ্ছে, তখন সেগুলো নিয়ে কী ভয়ানক সিরিয়াস। হাওয়ায় ধুলো মাখা। সন্ধ্যের পর চোখ ঝাপসা। মেলায় ফিরতি ভিড়ের টান। তখনো মনে হায় হায়। এটা কেনা হল না, ঐ স্টলে যাওয়া হল না। পকেট ঢু ঢু। মনে মনে প্রতিজ্ঞা, কাল আরও তাড়াতাড়ি আসবো। মাত্র ক’টাদিন। দেখতে দেখতে চলে যাবে। গান বাজে, আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা। পায়ে পায়ে ধুলো পথে হাঁটছেন শংকর, ঐ যে নীললোহিত, জয় গোস্বামী, বুদ্ধদেব গুহ। 

বইমেলায় বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার এক মজা, বাবার সঙ্গে যাওয়ার আরেক মজা।  বাবা সঙ্গে থাকলে আবার কিনা পকেটের চিন্তা নেই। একবাক্স রবীন্দ্র রচনাবলী কিনে শিয়ালদায় লোকাল ট্রেনে উঠেছি। দুজন মিলে হাঁস ফাঁস করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। বইগুলোর গায়ে বাবার গন্ধ এখনো লেগে আছে। কলেজের প্রফেসর ভয়ঙ্কর পড়ুয়া  মাসীর সঙ্গে আবার মেলায় গেলে ‘বোরে’র একশেষ। সে  সব মাথাভারি স্টলে ঢুকবে আর ধ্যানস্থ হয়ে যাবে। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পা যায় যায়। কিছু খাওয়াবেও না।  শুধু কঠিন কঠিন কথা বলে যাবে। 

হিংসুটেমি, খুনসুটিও কি কম? 
ওমাআআআ! এই বইটা তুই কোথায় পেলি?
বন্ধুবর মুখ টিপে বসে থাকে। কিছুতেই ফাঁস করবে না। 
একবার দে না! পড়েই ফেরত।
তারপর সে সেই যে গেল, গেল তো গেল। 
তৌহিদ আমার ‘ন হন্যতে’ আজো ফেরত দেয়নি। 

না বাবা, আমার মেলার আনন্দ চাই। গোল করে ভিড় করে প্রতুলদা গেয়ে ওঠেন, আমি বাংলায় গান গাই। সবাই হাততালি দিয়ে সঙ্গত করি। সামনে একুশে। বসন্ত যে রঙিন বেশে ধরায় সেদিন অবতীর্ণ! লিটল ম্যাগাজিন স্টল  ঘুরে, বড় বড় নামকরা স্টল দেখে তারপর আনাচকানাচ। একটা  অলিখিত কম্পিটিশন চলত। কে কত রেয়ার বই খুঁজে বের করবে। তারপর শুধু বিস্ময় বিস্ময় আর বিস্ময়...


একবার মমার্ত থেকে লেখা পাঠ করার ডাক এলো। তখন আবার বিয়ে হয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠান। আমি সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন  লাইব্রেরির সঙ্গে বহুদিন যুক্ত। এমফিল-এর পড়াশোনা চলছে। কল্লোলদা বললেন, তোমার লেখা পড়ো। নতুন বর চলেছে সঙ্গে। কী লজ্জার কথা। কোনোমতে ঝরঝর করে পড়ে নিয়েই স্টেজ থেকে ঝাঁপ। 

একটাও ছবি নেই সেসব দিনের। মোবাইল ফোন ছিল? ছিল না। ক্যামেরা তো  ছিলই। একেবারের জন্য মনে হয়নি নীললোহিতকে পাকড়াও করে একখানা ছবি তুলি। মমার্তের স্টেজে দাঁড়িয়ে কিছু পোজ দিই। নীললোহিত একটা বুকলিস্ট-এর পিছনে লিখে দিলেন, "প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাকে..." অটোগ্রাফ তো চেয়ে  ফেলেছি। সঙ্গে না কাগজ না কলম। 
এমনই ছিলাম আমরা। এক একটা খাঁটি আবেগ। আমার বইমেলা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যুগের হিসেব নিয়ে। বইমেলা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে এখনো চোখে ভাসে ধুলো ধুলো সন্ধ্যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গান। 

এখন বইমেলায় বই আছে। আর কিছু নেই। শুনে হয়তো বলবেন, বইমেলা তো বই-এরই! হ্যাঁ, বই তো থাকবেই। সে তো কলেজ স্ট্রিট-এও আছে। আমাদের  একজন স্যার শিখিয়েছিলেন, বইমেলা ঘুরে ঘুরে যত পারবে বুকলিস্ট যোগাড় করবে। আজও যতটুকু যাই, বই-এর খবর পেতেই যাই। খুঁজে খুঁজে তেলচিটে  পোকা ধরা পুরনো বই বের করি, যার ঐ একটি মাত্র কপি। 

কিন্তু বাদবাকি পরিবেশ কোথায়? এত আত্মকেন্দ্রিক বইমেলা আগে কখনও দেখিনি। সবাই বলছে, আমায় দেখো, আমার বই কেনো, আমার সঙ্গে ছবি তোলো, আমার প্রচার করো... আমি আমি আমি...
‘আমি’ আছে কিন্তু ‘তুমি’ নেই। পারস্পরিক সম্মান নেই। সবাই সবাইকে দেখছে  আড়চোখে। কে কতটা এগোলো, কতটা পিছোলো, কে কোন পথ অবলম্বন করল, কার ডাকে কতজন সেলেব এলেন, তারসঙ্গে বুটিকের শাড়ি, ব্যাগ, গয়নার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি... 
‘আজি’ নয়, ‘আমি’ই এই আনন্দসন্ধ্যা। 

সেলিব্রিটি শিকারে যান কেউ কেউ। একমাত্র উদ্দেশ্য তাঁদের সঙ্গে সেলফি নেওয়া। কে কার লেখা পড়ছে তার চেয়ে কে কত কিনছে, তার হিসেব বেশি।  আমি সত্যি ভয়ে ভয়ে থাকি।  পকেট তো চিরকালই ঢু ঢু। তারপর যখন লেখক কাম বিক্রেতারা আক্রমণ করেন, ভারি বিপন্ন বোধ করি। 

বইমেলায় বই আছে, মেলা নেই।  মেলা মানে ডানা মেলবার স্বাধীনতা। আমার সেই স্বাধীনতাই অবর্ষিত। ভয়ে ভয়ে চলি। এই বুঝি কেউ খপ করে পাকড়াও করেন। আমার আর সেই শেষ কপির বইগুলোর খোঁজ নেওয়া হয় না। নানা কাজের ফাঁকে কোনোমতে সময় বের করে বইমেলার জন্য রাখি। উদ্বৃত্ত তেমন নেই। তাই আর ভালো লাগে না। যেতে হয়।  যেতে পারি। কিন্তু কেন যাব, বুঝতে পারি না আজকাল।

সেদিন সন্ধে উৎরে ফিরছি। এক যুগল হুস হুস করে ঝালমুড়ি খেয়ে ভারি  বেকায়দায়। চারপাশের জগত সংসার তখন কিছু নেই। এক অদৃশ্য আলোর বৃত্ত তাদের ঘিরে। 
এ বরং বেশ। বই তো খোলা আকাশের নাম। মেলাও তাই। প্রেমও...


উল্কা




আগ বাড়িয়ে




ডেল্টা। একটা বদ্বীপের মতোই দেখতে লাগছে ঘটনাটা, তির্যক কিংবা যাহোক  একটা কিছু অ্যাঙ্গেলে। উঁকি দিতে ইচ্ছা করছে না - একটুও। তাও… আগ বাড়িয়ে দিলাম। কলকাতা বইমেলার ট্যাগে কোনো কোয়ালিটি মার্কার বালাই নেই। তাই পাঠক থেকে লেখকের ‘আগ’-এর প্রতি বিশেষ আগ্রহ নজরে পড়ল না। বহুদিন পর এত বইয়ের মাঝে ঢুকলে শব্দের সাথে শব্দের বেমালুম ধাক্কাগুলো বড্ড বিরক্তিকর মনে হয়। স্ক্যান মেশিনে ফেলে দেখছি বিস্ফোরক সিম্ফনিগুলো যদি একটু এড়িয়ে চলতে পারি। এসব কাণ্ডের মধ্যেই ধাক্কা খেলাম সদ্য বিবাহিত কবিতার সাথে। আগ বাড়িয়ে চোখ মিচকে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘জোরদার?’ ম্লেচ্ছ নজরে এক ঝলক দিয়ে বেচারি পাশ কাটিয়ে গেল। গেল তো গেল, বয়েই গেল… এখানে গঙ্গা থুড়ি হুগলী নদী নামক বৃহদাকার ইয়ে বেশ  ক্ষমতাময়ী - ভাসিয়ে এবং খসিয়ে দেওয়ায়। তাই বেশি আমল না দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের পাশ দিয়ে এগোলাম যেদিকে দু’চোখ যায়, আর তক্ষুনি অনধিকার প্রবেশ - আগ বাড়িয়ে তুলে ফেললাম লোরকা! আমি নিজের বাড়ির হিসুখানায় যেখানে স্কোয়াট করায় বিশ্বাসী সেখানে এসব কী কচ্ছি, অ্যাঁ! মনে  পড়ল একটু আগেই সুলভ হিসুখানার বাইরে দেখা হল কার্ট কোবেনের সাথে। বেচারার এক হাতে লাইট সিগারেট অন্য হাতে লাইটার। বুঝতে পারছে না হিসু কোন হাতে করবে। তাই আগ বাড়িয়ে…! ওটা কোন লেভেলের আঁতলামি সেটা কোবেন বোঝাবার আগেই ফায়ার ব্রিগেড জ্ঞান ঝেড়ে দিল - ‘আগ কে এক চিঙ্গারি সে…’! সে যাইহোক হতাশাগ্রস্তের মতো বসে আছেন ভদ্রলোক সামনে লোরকা! নাহ বাপু, এ তল্লাট ছাড়াই বাঞ্ছনীয়। নয় তো যে কোনো মুহূর্তে গাঁজার কল্কে বা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোকা বোতল জাপটে ধরে বলতে পারি, ‘ওগো তোমরা বুকুস্কি-কে বোলো আমায় যেন একটা প্রেমের গল্প লিখেই প্রপোজ করে…’ 
বাই দ্য ওয়ে। 

‘আনন্দ’ বা ‘দে’-র পাঠকের মতো আমি ভিড় করে লাইন দিলাম যেখানে ভূতের  গল্পের বই কিনলেই দশ টাকায় মিলছে হাওয়ায় পেন ভাসিয়ে টেনে টেনে অটোগ্রাফ। আগ বাড়িয়ে বললাম, একটা ইয়ে মানে সেলফি নিতাম স্যার… কিন্তু  ধাক্কা ধাক্কিতে সে আর হল কই! তবে হ্যাঁ, বইমেলায় এসে আমি একখানা বই  শেষমেশ কিনেছি! এবার একটু গুগলি পাকোড়া আর কফি! আহ…   

এই মাত্তর নতুন নিয়ম ধরিয়ে দিল কেউ! 
আবার নিয়ম! আমি কিন্তু এবার অনশনে বসবো বলে দিচ্ছি!  
গলাটা খুব শুকিয়ে গেছে।



কৌশিক দত্ত




স্বপ্নমেলা 





আনপড় মানুষ। দৈনন্দিনতায় ব্যস্ত গুটিসুটি লুকিয়ে থাকা অনুজ্জ্বল মানুষ। বইমেলা তবু মানে না। বইমেলা নাছোড়। টানাটানি করে। বইয়ের রঙ টানে, গন্ধ টানে, লেখা টানে। যেন টেবিল থেকে, তাক থেকে চেয়ে আছে মায়াবী ময়ালেরা, চোখ মেলালেই টেনে নেবে অমোঘ। বইমেলা গোলকধাঁধা। ঢুকে পড়লে খেই হারিয়ে যায়। আর বেরোনো যায় না, যতক্ষণ না ঘাড় ধরে বের করে দেয় শেষের বাঁশি।  

বইমেলায় তাই আর যাব না ভাবি। মেলা খরচ হয়ে যায় এবং হাতে-কাঁধে ব্যথা। বেশি পড়াশোনা না জানলে যা হয়, যে বই দেখি, তাই চমকপ্রদ লাগে। একটু নেড়েচেড়ে দেখলেই অচেনা বিষয়, অজানা কথা। আফসোস হয়। কত কিছু জানি না, জানা হল না! কলুর বলদের জীবনে কী অর্জিত হল? কতটুকু? অনেক অনেক বই কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে, পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কেনা হয়ে যায় বেশ কিছু। পড়া হয়ে ওঠে না। বাড়ি হয়ে ওঠে লাইব্রেরি আর আমি থেকে যাই আনপড়। পরবর্তী বইমেলায় একইরকম মূর্খ, অদীক্ষিত; একইরকম চমকিত, চমৎকৃত। এগোনো হয় না। গতানুগতিক অ্যানাকোন্ডা রোজ সকালে গিলে ফেলে, রাতে উগড়ে দেয় ক্লান্ত। লালায় মাখামাখি। বইয়ের আলমারির পাশে খাট পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্নে বই দেখি না। অন্যরকম রাক্ষসেরা আসে, অথবা ফুল-টুল বা আলতো পিকনিক। 

বইমেলায় তাই আর যাব না ভাবি। মেলা স্বপ্ন এসে যায় দিনমানে। আর আফসোস, হীনম্মন্যতা। তার চেয়েও বড় কথা, সারাবছর পড়াশোনা না করে বইমেলায় কদিন বই ভর্তি থলে হাতে ঘোরাঘুরি করে, দৈবাৎ দেখা পাওয়া (বাস্তবে বহুদিন হারিয়ে যাওয়া) সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে হাসি বিনিময় করে আর রোল-চাওমিনের দোকানে ভিড় করা পারবারিক মানুষদের উদরকেন্দ্রিকতার উদ্দেশে খ্যাঁদা নাকটাকে যথাসাধ্য সিঁটকে এই যে সংস্কৃতিবান শিক্ষিতবাবু বাঙালি সাজার চেষ্টা সস্তা যাত্রাপালার সঙের মতন, এই বাৎসরিক মিথ্যাচার নিজের, এই মুখোশ, আর সহ্য হচ্ছিল না। নিজেকে থামানো জরুরি ছিল। তিন বছর সত্যিই যাইনি বইমেলায়। আরও অনেকদিন না যাবার কথা ছিল। 

কথা রাখতে পারিনি। এবার আবার গেলাম। কলেজ জীবনের মতো আনন্দ নিয়ে গেলাম। বইমেলা টানছিল। কিছু ব্যক্তিগত কারণে এই বইমেলা ছিল আমার জন্য বিশেষ। যখন মেলায় যাওয়া বন্ধ করেছিলাম, তখন ছিলাম বেঘর একাকী। ইতোমধ্যে বাঁধা পড়েছি এবং ঘর বেঁধেছি। আমার স্ত্রী একনিষ্ঠ পাঠিকা। আমার না পড়া বইগুলো তিনি পড়ে ফেলছেন এক এক করে। সুতরাং আত্মহারা হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে বই কিনে ফেলা আজ আর ততখানি মূর্খামি নয়। আগামী এক বছরের মধ্যে বাড়িতে আনা বইগুলো অন্তত একজন পড়ে ফেলবেন নিশ্চিতভাবে। তিনিই আমার লাইসেন্স। 

উপরন্তু তিনি সুলেখিকা। একথা আমার বলা উচিত নয় দুই কারণে। প্রথমত ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলে নিরপেক্ষ বিচারের যোগ্যতা নষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত সাহিত্যগুণ বিচারের যোগ্যতা বা সেই বিষয়ে কোনো শিক্ষা আমার কোনোকালেই ছিল না। পরিচিত কিছু পাঠক তাঁর সম্বন্ধে এরকম বলেন এবং বেশ কিছু সম্পাদক ও প্রকাশক তাঁর লেখা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন দেখে  এরকম ধারণা করেছি। সে যাইহোক, এবছর বইমেলায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হল। প্রথমটি ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনী থেকে ‘নারীবাদী চিঠি ও অন্যান্য’ নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন। দ্বিতীয়টি 'ঐহিক' থেকে একটি ছোটগল্পের বই, ‘অনান্দনিক গল্প সংকলন’ নামে। তিন নম্বরটি তাঁর একার লেখা নয়, তাঁর  সম্পাদিত। 'লিরিকাল বুকস'-এর উদ্যোগে গার্হস্থ্য হিংসা ও মহিলাদের ওপর তার প্রভাব নিয়ে দেশের ও বিদেশের বেশ কয়েকজন বাঙলাভাষী নারীবাদী তাত্ত্বিক ও সমাজকর্মীর লেখা প্রবন্ধের সংকলন ‘খাদের ধারে ঘর’।            

অস্বীকার করব না, এই বইগুলোর কারণে বেশ খানিকটা উজ্জীবিত আর উৎফুল্ল ছিলাম। আবার চিন্তাতেও ছিলাম, নতুন বই প্রকাশের সময় লেখকের সঙ্গে জড়িত সকলেই যেমন থাকে। প্রতিজ্ঞা ভেঙে প্রায় রোজ বইমেলায় যাবার পিছনে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি সম্ভবত ছিল এই বই তিনটিই। অন্য কয়েকজন বন্ধুর নতুন বই ঘিরেও উৎসাহ ছিল। আজকাল পুস্তক চয়নেও মুখপুস্তকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, বিশেষত আমাদের মতো নষ্ট ভ্রষ্ট যারা বুকের ওপর খোলা বুক রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর ফেসবুকে ফেস গুঁজে রাত জাগে, তাদের ওপর এর প্রভাব বিপুল। নানাজনের লেখা বিভিন্ন রিভিউ দেখে ইচ্ছে-নদী ঝিরঝিরিয়ে বয়। দীর্ঘ হয় উইশ লিস্ট। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে নতুন উইশ জেগে উঠে হুশ করে বেহুঁশ করে দেয়। বইমেলা ফুরোতে টের পেলাম সাতান্নটা বই কিনে ফেলেছি, পত্র-পত্রিকা বাদ দিয়ে। আমার কেনা বইগুলো পড়ার দায়িত্ব শেষ অব্দি যাঁর, তাঁকে অতএব সপ্তাহে একটার বেশি বই শেষ করতে হবে, নইলে আমার আর পরের বছর যাওয়া হবে না মেলায়।              

কিছু লেখকের জোর করে বই গছানোর অভ্যাস নিয়ে অনেকেরই অস্বস্তি আছে। অনেকে এ নিয়ে সোচ্চারে নিন্দা করেন। আমি তেমন রূঢ় হতে পারি না। দেখা হলেই "আমার বইটা নাও এক কপি, আশি টাকা মাত্র", বললে কিনে ফেলি চক্ষুলজ্জায়। গোপনে জানাই, সেভাবে কেনা অধিকাংশ বই পড়া হয় না, কারণ ইচ্ছেটা মরে যায় শুরুতেই। দেখা হলে ভদ্রতা করি, কিন্তু দেখা না হলে খুশি হই মনে মনে। এবার ঠিক করেছিলাম, এসব এড়িয়ে চলব। চেনা মুখ এড়ানো সহজ, অপরিচিতের পানে ফিরে তাকাতেই হয়, কবি বলেছেন। মিডিয়া সেন্টারে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের শেষে সবে বেরোচ্ছি সপরিবারে, এমন সময় এক মধ্যবয়স্ক কৃশকায় ভদ্রলোক নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষণের মতো প্রায় মাটি ফুঁড়ে উদিত হলেন। হাতে তিনখানা বই। "নিন না, দেখুন বা।" "না, নেব না।" "না না, বিক্রি করছি না, এমনি দিচ্ছি পড়ানোর জন্য, পড়ুন," বলে আমার সাত বছরের মেয়ের হাতে একটা গছিয়ে দিলেন। বইটির নাম, ‘রচনা সংকলন’, তা তখন  খেয়াল করিনি। আরও একটা দিতে চাইছিলেন। ফ্রিতে অত বই নেওয়া উচিত নয় বলে বারণ করলাম এবার। তিনি আমার দিকে ঘুরে বললেন, " কষ্ট করে লিখেছি, একশোটা টাকা দিন।" দিলাম। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল সাহিত্যিকের এই করুণ পরিস্থিতি দেখে। কেন এভাবে পথে বই ফেরি করতে বাধ্য হন আমাদের লেখকেরা? আমরা পাঠকেরা, প্রকাশকেরা তাঁদের আরেকটু সম্মানজনক জীবন দিতে পারলাম না! বাড়ি ফিরে কষ্ট খানিক কমল বইটা নেড়েচেড়ে। না, ইনি সাহিত্যিক নন। নিতান্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় স্তরের কিছু রচনা, ‘একটি বিকেলের বর্ণনা’ গোছের। এতদিন আমার গর্ব ছিল যে আমার চেয়ে খারাপ কেউ লিখতে  পারে না। সেই অহংকারটাও চূর্ণ হল একশ টাকার বিনিময়ে। এখন আর কী প্রত্যয় নিয়ে বাঁচব?                   

বইমেলার আরেক আকর্ষণ আড্ডা। সাহিত্যিক মহলে আমাকে কেউ চেনেন না, তবু নানা সময়ে নানাভাবে আলাপ হয়ে গেছে নানা জনের সঙ্গে। দিল্লিতে থাকার সময় সৌরাংশু আর শৌভকে পেয়েছিলাম উপরওয়ালার উপহারের মতো। বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন বা কনট প্লেসের কফি হাউজে আড্ডা হত। ওরা নানা বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলত, কবিতা গল্প পড়ে শোনাতো। আমি শুনতাম। মাঝেমাঝে বেকুবের মতো ফোড়ন কাটতাম, যাতে ব্যাপারটা দেখতে আড্ডার মতো লাগে। এখন দেখা হয় ওরা কলকাতায় এলে। স্ত্রীর সূত্রে আলাপ অনিমিখ, বহতা, সৌমিতদের মতো প্রতিভাবান কবি-লেখকদের সঙ্গে। বইমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে ওরা গল্প করে, আমি শুনি আর শিখি। লিটল ম্যাগাজিনের তাঁবুতে জড়ো হয় যেসব অভিযাত্রী, তাদের মধ্যে এখনও আছে বহুযুগের ওপার হতে ভেসে আসা কিছু চেনা চেনা ঝোড়ো মুখ। কেমন আছ? এই তো এবারের সংখ্যাটা। বাহ! দেখি। যারা হেরে যায়নি, ভেসে যায়নি ঘোলা স্রোতে, যারা এখনো সাঁতার কাটছে উজান বেয়ে, তাদের দেখে শান্তি পাই… তাদের জন্য গর্ব বোধ করি দু'দণ্ড, আবার প্রাত্যহিকতায় ডুবে যাবার আগে। যে বাতাসে তারা স্বাস নিচ্ছে, সেই বাতাস টেনে নিই বুক ভরে। সেও এক বাৎসরিক সঞ্চয়।           

গর্ব বোধ করানোর ষড়যন্ত্র করে তৈরি ছিল আরও কিছু তরুণ-তরুণী। বুড়ো হতে হতে চোখে চালসে পড়ে বলেই হয়ত আমরা তরুণদের ভালো ঠাহর করতে পারি না। অহেতুক সন্দেহ জন্মায় পরবর্তী প্রজন্ম সম্বন্ধে। তাদের কাছ থেকে যা শিক্ষণীয়, তা শিখতে পারি না। পিছিয়ে পড়ি। অগ্রগামী তরুণদের সঙ্গে স্থবির আমাদের এই ব্যবধানকে  ইংরেজিতে বলে 'জেনারেশন গ্যাপ'। আসলে বয়সের ফারাকটা বড় কথা নয়। আমরা আমাদের গুদামঘরে তালা দিয়ে চাবি হারিয়ে ফেলেছি। নইলে আনাদের চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা নিজেদের দরজা জানালা খোলা রেখেছেন সযত্নে, তাঁরা তো দিব্বি তরতর করে হেঁটে চলেছেন ওদের মিছিলে পা মিলিয়ে।      

মিছিল। মিছিলেই মানুষ বড় হয়। মিছিলেই বৃদ্ধ তরুণ হয়। বইমেলায় তরুণেরা এবার এনেছিল মিছিল। দিচ্ছিল বিনে পয়সায়। এনআরসির বিরোধিতায় সোচ্চার ও উজ্জ্বল ছিল তারা। বইমেলায় রাজনীতি হওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে তখন সুশীল মহলে জোর বিতর্ক। বই মানুষকে ঘুমন্ত অরাজনৈতিক থাকতে দেয় কিনা, সেই প্রশ্ন বরং আমাকে তাড়িত করে। যথেষ্ট পড়াশোনা করিনি বলেই আত্মসুখী অলস জীবন কাটাতে পারছি, এমনটাই আমার ধারণা। যাদের মন খুলে গেছে, তারা আর একা বাঁচতে পারে না। সমষ্টির প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের একা একা সুখী হতে দেয় না। তাদের হাঁটাচলা মিছিল হয়ে ওঠে। বইমেলায় চিকেন পকোড়া খেতে যখন আপত্তি নেই, বাইবেল-কোরান-গীতা-হন্যমান চালিশা বিলিতে আপত্তি নেই, তখন ক’টা ছেলেমেয়ে নিজ বিশ্বাস অনুসারে  রাজনৈতিক লিফলেট বিলি করলে আপত্তি কেন?   

রাজনীতিতে যারা এদের বিপক্ষ, তাদের আপত্তি থাকতেই পারে। কেন্দ্রীয় সরকারি দলের সমর্থকরা এদের কাজকর্ম পছন্দ করবেন না, তা প্রত্যাশিত। সেই দলের সমর্থকদের মধ্যে যারা গুণ্ডা প্রকৃতির, তারা এই ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করায় তাই আশ্চর্য হইনি। সেই আক্রমণের ফাঁকে ছাত্রীদের যৌন  নিগ্রহও করা হয়েছে শুনে ব্যথিত হয়েছি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্দশা দেখে। অবাক হয়েছি কলকাতার বুকে বইমেলাতেও এরকম কাজ হতে পারে দেখে। তবে স্তম্ভিত হয়েছি পুলিশের আচরণ দেখে। শান্তিরক্ষা যাঁদের কাজ, তাঁরা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা না করে, আক্রমণকারীদের বিন্দুমাত্র বাধা না দিয়ে আক্রান্তদের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাদের কিল-চড় মেরে কলার ধরে তুলে নিয়ে গেলেন, যখন বইমেলার মাইকে বাজছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে এনআরসি বিরোধী বক্তৃতা ও স্লোগান! প্যারাডক্স! গোঁজামিল! তারপর থানায় আরেক কাণ্ড, কিন্তু সেসব বইমেলার বাইরে, তাই এখানে নয়।          

উচ্ছেটা শেষ পাতে পরিবেশিত হলেও ভোজটা একেবারে মাটি হয়নি। বরং সুস্বাদ লেগে আছে মুখে। এই বইমেলা অনেককিছু দিল। বই, বন্ধু, শিক্ষা, গতি… কত কী! এখন এসব সঞ্চয় নেড়েচেড়ে দেখছি আর ভাবছি, আবার বাঁচা যায় কিনা।                                                                            





জয়া চৌধুরী




বইমেলার ঘুঘনি






বইমেলা শব্দটা কানে এলেই আমার চোখে কেমন আঁতেল শব্দটি ফুটে ওঠে। মানে বইমেলা হল ইন্টেলেকচুয়ালদের জায়গা। আশ্চর্য! বই ও মেলা দুটো শব্দ কেমন উল্টো রকম না! বই মানে নিবিড় আর মেলা মানে ছড়িয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী ভাবের মিলন এই বইমেলা। ইদানীং কয়েকবছর বইমেলায় যাওয়া কমে গেছিল। তবে এবারে কিঞ্চিত অধিক যেতে পারলাম। আসলে এবার আবার দুটো বই প্রকাশ পেল আমার ‘ম্যাজিক রিয়ালিজমের গল্প’  নামের একটি গল্প সঙ্কলন আর ‘কামিলার তিনটি মৃত্যু’ নামের একটি উপন্যাস। সে কারণেই এবং কিছু উদ্বোধনের আমন্ত্রণে যেতে হয়েছিল। এই লেখাটি যখন  লিখছি তখন বাংলাদেশের বইমেলা শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তা রমরম করে চলছে। প্রতিদিন ফেসবুকে টের পাচ্ছি নানান বই উদ্বোধন, আলোচনা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি নানান ঘটনা। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়ও এমন নানান অনুষ্ঠান হতে থাকে। এবারে দেখলাম একটি মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় মঞ্চ। এটি একটি খোলা মঞ্চ যা গিল্ড বিনা ভাড়ায় দিয়েছেন। শুধু উৎসাহীদের নিজেদের নামটি নথিভুক্ত করে যেতে হয়েছিল। সই সংগঠনের একটি অনুষ্ঠান ছিল সেখানে। আমরা কজন সই সেখানে নিজেদের কবিতা বা অনুবাদ কবিতা পাঠ করলাম, কিছু বইয়ের উদ্বোধনও হল। সঙ্গে গান তো  ছিলই। সেখানেই শুনলাম এই মঞ্চটি বাংলাদেশের বইমেলাতে গিয়ে দেখে এসে এখানকার মেলাতেও করবার ইচ্ছা করেন গিল্ড সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। আশা করছি পরের বছর আরো ভিড় বাড়বে মঞ্চটি পাবার আশায়। কপাল গুণে বিশিষ্ট মানুষজনকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম।  চুমকী চট্টোপাধ্যায় শাহজাদ ফিরদউসেরা সেখানে ছিলেন।

লাতিন আমেরিকার স্টলে গত কয়েক বছরের মত এবারেও ভিড় পেলাম। প্রতিদিন সেখানে বই প্রকাশ, গল্পপাঠ ইত্যাদি লেগেই ছিল। আর্জেন্টিনা থেকে একদল সাহিত্যিক এসেছিলেন এবার মেলায়। তাঁদের কয়েকটি বই প্রকাশ পেল।  একদিন আমার স্প্যানিশ থেকে অনূদিত নতুন উপন্যাসটিও প্রকাশ করলেন আর্জেন্টিনার সাহিত্যিকেরা। লেখিকা গ্লাদিস মেরসেদেস আসেভেদো নিজে উপস্থিত ছিলেন। গ্লাদিস এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সাহিত্যিক। বাংলা ভাষায় হিসাপানিক দুনিয়ার ক’জন নারীর লেখাই বা অনুবাদ হয়েছে  এতাবৎ! বড় কাজ বলতে ২০১৬ সালে গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিতা ও গদ্য অনুবাদ করেছিলাম। এবার করলাম গ্লাদিসের উপন্যাস। মাঝে ইসাবেল আইয়েন্দে সহ কজনের লেখা করেছি, তবে এত বড় কাজ সেগুলি নয়।  এমনিতেও স্প্যানিশ ভাষা থেকে ক’জনই বা সরাসরি অনুবাদ করেন! যাইহোক মজার একটা ব্যাপার হয়েছে। একটি কবিতা পাঠের আসর চলছিল স্টলে। হঠাৎ আমি গিয়ে পড়েছি। তো দোভাষী হিসেবে আমাকেই বসিয়ে দেওয়া হল কবি এস্থের সিমোনের সঙ্গে। তিনি আর্জেন্টিনার কবি। বিশেষত কেচুয়া গাউচো এদের নিয়েই কবিতা লেখেন তিনি এবং পরিবেশ। সেদিন দুম করে গিয়ে কবিতা অনুবাদ করে পড়াতে পেরে খুব আনন্দই হয়েছিল। এস্থের সিমোন স্প্যানিশ আর আমি কলাইন বাংলা - সমান্তরাল ভাবে। মনে হয় উপস্থিত দর্শকেরা বেশ উপভোগ করেছিল। প্রথম নবনীতা দেবসেন মেমোরিয়াল লেকচার শুনলাম একদিন। দিলেন নন্দনা দেব সেন। তবে ওঁর সেদিনের পাঠের কেন্দ্রে নবনীতাদির শিশু সাহিত্যের উপরেই ফোকাস ছিল। মর্মস্পর্শী একটি পাঠ করেছিলেন তিনি।

জনস্বার্থ বার্তার স্টলে দেখি সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। আশ্চর্য সব লেখা লিখে ফেলেছেন ইনি। সেই সুযোগে বইয়ের ওপর স্বাক্ষর ও সেলফি তুলে নিলাম সাগ্রহে। সেদিন অনুবাদ সাহিত্য পাঠ ছিল কলকাতা ট্রান্সলেটারস ফোরাম ও জনস্বার্থ বার্তার যৌথ আয়োজনে। সাহিত্য আকাদেমী বিজেতা শ্যামল ভট্টাচার্য, বাংলা আকাদেমী সহ কাঁড়ি কাঁড়ি পুরষ্কার বিজয়িনী তৃষ্ণা বসাক, নন্দিতা ভট্টাচার্য, শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্ত, তন্ময় বীর, নবনীতা সেনগুপ্ত, বাপ্পাদিত্য রায় বিশ্বাস  সহ অনেকেই পড়লাম লেখা। পাঞ্জাবী লেখিকা মিনু আসর জমিয়ে দিলেন।  মোদ্দা ব্যাপার হল নানান ভাষার অনুবাদ সাহিত্য পাঠের অনুষ্ঠান দারুণ জমেছিল। বেশ লোকজন দাঁড়িয়ে শুনছিল। 

কথা ছিল অনুবাদ পত্রিকার স্টলেও  সাহিত্য পাঠ হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ওলোট পালটে সেটি হল না। ব্যাস আমাদের সকলের মন খারাপ। শেষ দিনে মাঠে গিয়ে আগেই চলে গেলাম সাহিত্যিক বিতস্তা ঘোষালের ভাষা সংসদের স্টলে। ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে এরা অনুবাদের পৃষ্ঠপোষক। একটা চমৎকার বই কিনলাম মকবুল ফিদা হোসেনের উপর সে স্টল থেকেই। আর চার পাঁচ দিনের বইমেলা সফরের এবারের সবচেয়ে মজা পেয়েছি সৃষ্টি সুখের স্টলে যেতে। ওখান থেকেই তো বেরোল আমার নতুন বই ম্যাজিক রিয়ালিজমের গল্প। আরেব্বাস! যখনই স্টলে উঁকি দিলাম, এ কদিনের সব সময়েই দেখি সরোজ   রসিদ কাটছেন বইয়ের। মানে বিক্রিবাটা টুকটাক হয়েছে। তবে মানুষ পড়েছে  কিনা বলতে পারছি না। একবছরে আগেও তো বই বেরিয়েছে। কিন্তু এমন হাতে গরম বিক্রি হতে আমার বই আগে দেখি নি। মনে হচ্ছে ঠিক পথেই চেষ্টা চালাচ্ছি। অনুবাদে আবার পাঠকের মন ফিরছে। তা বলে ডারটি পিকচারের সেলভা গণেশের মত পাবলিক যা চায় তাই দিতে পারব কিনা জানি না। ভরসা একটাই, পাঠকও তো নানান কিসিমের! আর পাঠকই জনার্দন।

তবে আর কি একবছর ফের কলম শানাই। আসছে বছর ফির সে বইমেলা। জয় তারা।  

তৃপ্তি সান্ত্রা



মেলায় zaইরে




কবিতা, গপ্পো, উপন্যাস, মুক্তগদ্য, অনুবাদ গ্রন্থ, গবেষণা ভিত্তিক বই... অনেক ক’টিই হল। হইচই করে উদযাপন হয়নি। 'চুড়েইল' উপন্যাসটির মোড়ক খোলার অনুষ্ঠান করেছিল ঐহিকের তমাল, মফ:স্বলের লেখকের সেটা বড়ো পাওয়া।

নতুন বই  পার্সেলে এসেছে, মুখ দেখেছি, এই রকম অভিজ্ঞতাই বেশি।
আলপথ,সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন প্রকাশনা থেকে গল্প সিরিজ বেরিয়েছে তিন ফেব্রুয়ারি... আম্মোও সেই সিরিজে আছি। ফেবুতে প্রচ্ছদ দেখা সারা, তবু একটা উত্তেজনা থাকে। মালদা থেকে চার তারিখ রওনা হয়ে পাঁচ তারিখে এসেছি। সংগীতা পোস্ট দিয়েছিল, বেলা দুটো অব্দি মাঠে থাকবে। হুড়ুম দুড়ুম করে আমি আর পিন্টু ছুটেছি। বাসে বিল্ডিং মোড়। ক্রসিং পেরিয়ে অটো। এবিপির অভিজিৎ ফোন করেছে, কলকাতা বইমেলায়, মালদার লেখকদের কার কার বই বেরোচ্ছে,জানতে চায়। কি হবে ?কাল উত্তরবঙ্গের কড়চায় খবর করতে হবে। ম্যাডাম আপনি একটু ছবিটবি দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ করুন। আমার বই ছাড়া বেরোচ্ছে অনুরাধা কুন্ডার গল্প বই, দিবারাত্রির কাব্য থেকে। দাঁড়াও, মেলায় ঢুকি সব পাঠাচ্ছি, এটাই আমার হোয়াটসঅ্যাপ নং। এবং প্রয়াস থেকে শতানীক রায়ের সম্পাদনায় মলয়দার একটা অনুবাদ বেরোবে শার্ল বোদলেয়রের... সব ছবিটবি তোলার উত্তেজনা, নয় নম্বর গেট খুঁজে পাওয়া, দেখলে হবে খরচা আছে...

বইমেলায় এলেই স্মৃতি কাতর  হই। অমৃতলোকের টেবিল খুঁজি। সমীরণ মজুমদার, অমিতাভ সমাজপতিকে খুঁজি... কত স্মৃতি, আড্ডা, কাজ।
লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে আগের মতো ঠাসাঠাসি নেই, স্পেস আছে, এটা ভালো।
এবং প্র‍্য়াসের টেবিলে সেলিম, শতানীক,তিতিরের টেবিলে সঞ্জয়... এদের এড়িয়ে আগে তো অনুরাধার বইয়ের একটা ছবি তুলি, বইমেলার কিছু স্টলের ছবি, পাঠাই, অভিজিতের আজকেই লাগবে। তো মেলায় নেটওয়ার্ক পালায়, যোগাযোগ হয় না। শুধু বিঘে দুই, আলপথও খোলেনি তখনও... আমি তিতিরের স্টলে নিত্যদার  চালাঘরে বসি... তাঁকে নিয়ে কত জন লিখেছেন-প্রবন্ধ, স্মৃতি, কবিতা... আমি লিখতে পারিনি। বইয়ের পিছন পাতায় নিত্যদার সেই আন্তরিক  ছবি। যেন খুব মৃদু গলায় বলছেন, হবে হবে,তাড়া কী!

এক বসন্তে মাথাভাঙায় উনার বাড়িতে ছিলাম। দালানে বৌদি, মিতু থাকে। খাওয়াদাওয়া সেখানেই। তবে কবির নিভৃত যাপন উঠোনের  টিনের চালায়। গুটিকয় বই, ডায়েরি, খাতা... মদ্যপান কমে এসেছে, কিন্তু সিগারেট ছাড়তে পারেন নি। কেন অতো অত্যাচার করেন শরীরের? ছবিটা এমন জীবন্ত, যেন প্রশ্ন করা যায়। ধমক দিলেন, এই উত্তরের লোকের গেয়োমি। আটকে যায় বড়ো! আগে মেলা ঘুরে এসো। এক জায়গায় আটকে গেলে চলে?

সে চলে না। লিটল ম্যাগাজিনে বসার জায়গা নেই। দেড়মাস আগে অপারেশন হয়েছে, ক্ষিধে পায়। পিন্টুর সুগার, সে বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে না। ৩/২এ মালদা শহরে  CAA, NRC, NPR নিয়ে এপিডিয়ারের বিরাট মিছিল। রতুয়া, কালিয়াচক, গাজোল... সব প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছেন। উৎসাহে সারা শহর  চক্কর  দিয়েছি। কোমর, পা সবাই ধর্নায় উৎসাহী মিছিলে নয়।

ফেবুর মনস্ক পাঠকদের থেকে অবশ্য পাঠ্য বইয়ের তালিকা পেয়েছি। সে সব নিতে হবে। মেয়ের একটি বইয়েরই দাবি ছিল। সে বইয়ের সম্পর্কে অভিষেক ও পোস্ট দিয়েছে... এই যুবকের পঠন প্রতিভা ঈর্ষণীয়। শ্রদ্ধা  জাগায়। জয়াদি, যশোধরা, জয়া চৌধুরির পোস্টে প্রচুর বইয়ের খবর। খুঁজে পেতে হ্যালাকান হই।
কিছু লিটল ম্যাগাজিন তালিকায় আছে। তো আল্পনা ঘোষ সংখ্যার জন্য 'শহর' খুঁজতে  ‘আয়না নগর’ আর ‘আরশিনগর’ হারিয়ে ফেলি। 'নিরন্তর' কোন স্টলে পাওয়া যাবে? তটিনী দত্তকে ফোন করে পাই না। খাওয়ার জন্য মুড়িও পাই না।
তাড়াহুড়োয় বিস্কূটের প্যাকেট  ফেলে এসেছি। অবশেষে  প্রাণের টোস্ট প্রাণ বাঁচায়। ফিরে আসার তাড়া। বাসের লাইন। সাড়ে সাতটার মধ্যেই মেলা ছাড়ি।

আমার 'মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং, শরীর ও অন্যান্য আলাপ' বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য অনুমতি চেয়ে ফোন করেছিলেন কারিগরের দেবাশিস সাউ। এর চেয়ে আনন্দের খবর হয় না। গেল বছর বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হতে পারেনি, প্রকাশ হয়েছে পরে। এত তাড়াতাড়ি আবার ছাপতে হবে তার মানে বিতর্কিত এই বইটির বিষয়কে গ্রহণ করার মতো বাঙালি পাঠক সাবালক হয়েছেন। বিদুষী নামে এক পাঠিকা ফোন করেছিলেন, এই বই নিয়ে খুব উৎসাহী, আলাপ করতে চান। শুভংকর গুহর সাথে দেখা হবে। দেখা হবে আমার নতুন বইয়ের সাথে। এতো ভিড় এতো ভিড় কারিগরে পরে যাব করে যেতে পারলাম না। শুভংকরের সাথে কথোপকথন হল না। বিদুষীকেও খুঁজে পেলাম না। কমলদার কৌরব দেখে পালিয়ে যাচ্ছি। ভালোপাহাড় গিয়েছিলাম। উনার বই নিয়ে লিখতে বলেছিলেন। তো সেখান থেকে ফিরেই তো নার্সিং হোমে। আর সুদেষ্ণা নেই দোকানে, ভালো লাগে না... 'দমদম জংশন'এর বৈদ্যনাথ মিশ্র ও মালদার। উনার পত্রিকা শূদ্রকে প্রথম গল্প লিখেছি। ভিড়ে কথা হল না। পুনশ্চর স্টল বড়ো। বসার জায়গা আছে। চা, বিস্কুট আড্ডা সবই দেদার। এবার সন্দীপ, শক্তিসাধনদা, উৎপলদা কারো সাথেই দেখা হল না।

সাত তারিখ ঐহিকের সম্মাননা অনুসঠান। অভিজিৎ সেনকে লাইফটাইম সম্মাননা দেওয়া হবে। থাকতে হবে। প্রিয় লেখক। প্রিয় মানুষ। তমাল রায় বড়ো যত্ন করে এই কাজটা করেন। অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আড্ডা হয় না। ওকে নিয়ে কনিষ্ক ভট্রাচার্য চমৎকার বললেন। বাংলাদেশের জুয়েল মাজাহারকে নিয়ে বললেন কবি সৌমনা দাশগুপ্ত। কী গভীর ভাবে ভাবতে পারে মেয়েটা। মেয়েদেরই বই কিনেছি বেশি। কত অন্য রকম লিখছে তারা, কেমন অন্য লিখছে... জানতে হবে না? পত্রিকা, প্রকাশনা সবই করছে, মুগ্ধ হয়ে যাই। ভূমধ্যসাগর, লিরিক্যাল, কাগজের ঠোঙা, পদ্য, অহল্যার পাশাপাশি এবার খুঁজে পেলাম অনুষা প্রকাশনী। সেই যে বিদুষী আলাপ করতে চাইছিল, ওদেরই কর্মকান্ড। শুক্তি রায়ের প্রতিষ্ঠান না বলে সংসার বলা যায়। স্প্যানিশ থেকে সরাসরি অনুবাদ করেন এঁরা। এরেন্দিরা,প্লাতেরো... শুক্তির অনুবাদে চমৎকার! 

ছবি তোলার কথা না বললে পাপ হবে। প্রথম দিনই বইমেলা যাচ্ছি শুনে জয় পুরিয়া কলেজ থেকে বর্ণালি পাইন এসেছিলেন, দু’ কপি নিলেন। আমার গভীর পাঠক, ভয়ে ভয়ে থাকি ওর মতামতের জন্য, কিন্তু ফটো সেসনে হাসিহাসি মুখ দিই। আলপথ স্টলে সঙ্গীতার সাথেও বই হাতে ছবি। পীযূষ বিশ্বাস -দিল্লীর, দীপায়ন কোচবিহারের, মাঝ মাঠে হঠাৎ ঝলক তৃষ্ণা, যশোধরা... প্রিয় লেখক, প্রিয় মুখ। তণ্বীর সাথে দেখা হল না। রিমির সাথেও না। সৌমনার মাসান নিয়েছি, শতাব্দী আর বিতস্তার সাথেও ছবি। আর 'অনুষা'য় পিন্টু, মঞ্জিরার সাথে সব্বার ছবি। জলপাইগুড়ির তনুশ্রীর নতুন বই গাংচিল থেকে। কিন্তু ও আসেনি। জলপাইগুড়ির অলোক গোস্বামীর সাথেও ছবি হল।

বই কি কিনেছি তার ফিরিস্তি দিচ্ছি না। বই টেনে নিয়ে যেতে হবে। শহরের প্রীতমের পুনশ্চই বেশি স্টেডি আমার জন্য। বই উপহার পেলাম অনেকগুলো। তরুণ কবিরা পাঠ প্রতিক্রিয়া চায়। বাংলা দেশের মেঘ অদিতির 'উপসংহারে অন্য সকাল'এর কী চমৎকার প্রচ্ছদ। বইগুলো পড়ার উত্তেজনায় টানটান আছি। এই সব ছবি তোলা, বই কেনা, বই দেখার মাঝে স্টল নং ভুল করে ঘুরপাক। হারিয়ে যাওয়া। কবিতা পাক্ষিকের স্টলে মাত্র একশো টাকায় মলয়দার আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবার্তার সাথে সমীরদা, প্রভাতদার উত্তর আধুনিক বই। কী চমতকার রবি ঠাকুরের বইগুলো, একটু রঙিন। ছোটোদের ভালো লাগার মতোই। 'আমার পটল ডাঙার বাড়ি যাবে তৃপ্তি, সকালে যাবে’ প্রভাতদাই এইরকম সাদর আহ্বান করতে জানেন। 

তিন নং গেটের পাশে আমরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলের বাইরে গন্ডগোলের খবর পাই। এপিডারের মিছিল নিয়ে এবিভিপির ঝামেলা। আরেস্ট, মেয়েদের সাথে অশোভনীয় আচরণ, মারধোর আর যা যা করতে পারে একটি ফ্যাসিস্ট দল।

আমাদের ফিরতে হয়। লম্বা লাইন বাসের। সিটের পাশে লাগেজ রাখার জায়গায় বসে, দাঁড়িয়ে। নিশ্চিত জানি, তরুণদের সাথে প্রবীণ প্রতিবাদীরাও আছেন। আমরাও আছি অক্ষর নিয়ে। কত ছোটো পত্রিকা। নিজ নিজ শৈলিতে স্থানিকতা, আঞ্চলিকতা, পান গান ধান, রন্ধনশিল্প কারুশিল্পের বৈচিত্র নিয়ে কী ভাবে ছুঁয়ে থাকতে চান মাটিকে ভাষাকে।

হাইলাকান্দির কমলেন্দু ভট্রাচার্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন লুৎফর রহমানের বই 'বিশ্বনাথ মাঝি ও বিভূতিভূষণের গ্রাম', হেঁসেল হারিয়ে, মাটি হারিয়ে বাঙালি খুঁজছে 'বাজার ভ্রমণ', 'ছাদ পেটানোর গান', ভিল মহাভারত, জলবনের কাব্য, 'মোমেনশাহী উপাখ্যান'...

‌আমাদের মফ:স্বলের বাদিয়া মিছিল, মহানগরীর বইমেলার মিছিল, পার্ক সার্কাস, শাহীনবাগের লাগাতর অবস্থান, প্রতিবাদ সব সেই রুটি, ভাত আর ভাষার স্বপ্নে। 'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন, / পরম শান্তির মন্ত্রে গেয়ে উঠো শ্রেণির উচ্ছেদ / এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী কর উচ্চারণ / যেন না লোকধর্মে আর ভেদাভেদ'।

অমর একুশে এই আমাদের দৃপ্ত উচ্চারণ... মেলা শেষ হলে আবা