কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

বিদ্যুৎলেখা ঘোষ




বই তো নয়




ঘোর লাগার ঘুরঘুরে পোকা যাদের মাথায় ঘুরছে ছটফট করাচ্ছে অবিরত তাদের কাছে সাদা পাতায় কালো অক্ষরগুলো সেই ঘোর লাগানো পোকাদের পুষ্টি। নানা ভাবের নানা স্বাদের সেই ঝিম অক্ষরমালা পাঠকদের বুঁদ করে নিয়ে যায় এক অনুভব থেকে অনন্য অনুভবের আকাশে। চরম প্রেমাস্পদের মতো সেই আকর্ষণ। বই তাই বই শুধুমাত্র তো নয়, বইভরা বইমেলা সে যে বিচিত্র অনুভবের রসো বৈ সঃ ভুবনডাঙা। গ্রস্ত করে দেবার এই তাগিদটা যখন থেকে গুটিকয়েক চিন্তাশীল সুধীজনদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে তখন থেকেই বস্তুত বইমেলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই আয়োজন করা এবং জন্মের পর থেকে পায়ে পায়ে কলকাতা বইমেলা ২০২০এ বছর ৪৪টা বসন্তের আলাপ শোনালো।  

ঠিক কোন বছর থেকে প্রতিবছর যাওয়া শুরু করেছি মনে করতে গেলে বাবার কথা চলে আসে। প্রথম বইমেলায় যাওয়া বাবার হাত ধরেই। প্রায় প্রতিটি বছর একদিন হলেও উপস্থিত হয়ে পছন্দমতো বই কেনা, যার মধ্যে অবশ্যই থাকতো রঙিন ছবি ভরা রাশিয়ান রূপকথা কিংবা ছড়ার বই বাংলা অনুবাদে। তারপর বাইরে সামান্য ছোলা বাদাম ভাজা কিংবা মুড়িমাখা খেয়ে বাড়ি ফেরার পালা। এত খাবারের স্টল কিংবা জগঝম্প তো ছিলো না। বাবার দুই হাতে বই আর বই ভর্তি ব্যাগ। তার মধ্যেও একটা আঙ্গুল আমার ধরে থাকার জন্য বরাদ্দ।

প্রধানশিক্ষক ছিলেন বলে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও চাহিদা ছিল বিস্তৃত। ফলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে রামায়ণ মহাভারত মঙ্গলকাব্য গীতা কোরআন জাতকের গল্প বৃত্রসংহার ভারতের সাধক চিরঞ্জীব বনৌষধি ভারতচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্ত পৌরাণিক অভিধান চলন্তিকা রবীন্দ্রনাথ শরৎ বঙ্কিম মাণিক শরদিন্দু বিভুতি জীবনানন্দ বিষ্ণু দে কিরিটি অমনিবাস ত্রিদিবা অস্কার ওয়াইল্ড অমনিবাস মার্কস লেনিন রচনাবলী, এছাড়া আর বলতে গেলে অসংখ্য কবি ও কবিতার  গল্প প্রবন্ধকারের বইয়েরা আছেন ও আছে যার তালিকা ফুরোবার নয়। এঁদের সঙ্গে আলাপ ক্রমবর্ধমান...। যতক্ষণ সাধারণ ছাত্র তথা পড়ুয়া হিসেবে বইমেলায় গিয়েছি লিটল ম্যাগাজিন প‍্যাভেলিয়ন তখন চোখেই পড়তো না। হয়তো জানতাম না বলে পড়তো না। ২০১২ সালের শেষ দিকে ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সংস্পর্শে এসেছি। স্কুলবেলা থেকে খাতায় মলাটের ভেতরে যেসব কবিতারা তারা যেন কানীনই থেকে গেল। কলেজ ইউনিভারসিটির দেওয়াল পত্রিকায় ছিটেফোঁটা কিছু। তারপর লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির সূত্রে বারো সাল থেকেই বলা যায় নিয়মিত বইমেলায় দশ বারোটা দিন অধিকাংশ সময় লিটল ম্যাগাজিন প‍্যাভেলিয়নে ঘাঁটি গেড়ে থাকা।  

প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়ার পরিধিও অন্তর্জালে জড়িয়েছে ছড়িয়েছে। ই-বুক, ওয়েব পত্রিকা, ব্লগ জায়গা দখল করছে সাদা কাগজের উপর কালো হরফে ছাপা বইপত্রের। বইপত্রের পাঠক কমছে, বাড়ছে নাকি ই-পড়ুয়াদের সংখ্যা এই নিয়ে প্রকাশকদের মাথায় হাত। বইমেলা স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মেলার চরিত্র। টিভি চ্যানেল, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও খাবার দাবারের স্টলগুলো হয়ে উঠছে মেলার থিম কান্ট্রির প্যাভিলিয়নের চেয়েও লোভনীয়। বর্তমানের পাঠকের কাছে এ যেন এক কঠিন তপস্যা, এতসব ইশারা পেরিয়ে বিশুদ্ধ অনুভবের ভুবনে প্রবেশ করার।

অঘোর কলোনি এই লিটল ম্যাগাজিন প‍্যাভেলিয়ন যেখানে বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিকতম পরীক্ষা নিরীক্ষার তন্ত্র মন্ত্রগুপ্তি চলছে। পুরনো থেকে নবীনতম প্রায় সমস্ত লেখকের এই লিটল ম্যাগাজিন প‍্যাভেলিয়নই হল বছরকার সাধনপীঠ। কার কলমের ধুনীতে আগুনতাত কী ধারা তা পরীক্ষিত হয়। নবীন প্রবীণ লিটল ম্যাগাজিনের লেখক-পাঠক লক্ষ্য করেন আর নতুনতর ধারা তৈরি হয়, যে ধারাটায় নাইতে নামেন তেমনি অঘোরি লেখক-পাঠক যা গতানুগতিক থেকে স্বতন্ত্র।

এতরকম চরিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ২০২০ বইমেলাতে সকলকে অবাক করে চলতি ধারার বইয়ের মধ্যে দেদার বিক্রি হয়েছে ফেলুদা ব্যোমকেশ হেমেন রায় এখনও রবিঠাকুর সবাইকে পিছনে ফেলে ‌এগিয়ে চলেছেন। সদ্য প্রয়াতা নবনীতা  দেবসেনের লেখালেখির মধ্যে পাঠক খুঁজে খুঁজে যাচ্ছেন ভালোবাসার বারান্দা। নতুন প্রজন্মকে বইপত্র আর টানছে না - এইসব নাকিসুরকে নস্যাৎ করে কচিকাঁচা থেকে কিশোর তরুণদের ভিড় ছিল নজরে পড়ার মতো। এবারের মেলার শুরুতে অসময়ের বৃষ্টিতে বেশকিছু স্টল বইপত্র ভিজে একাকার। ফেসবুকে তার সচিত্র বিবরণের সাথে আবেদন ছিল যারা মেলায় আসছেন তারা যেন একটা হলেও বই কেনেন। এবারের থিম কান্ট্রি রাশিয়ার প্যাভিলিয়নে দর্শকদের ভিড় উপচে পড়েছিলো। রুশ ভাষায় কবিতা পাঠ করেন তরুণ তরুণী কবি। তুষারের দেশ থেকে তারা এসেছেন আমাদের কবিতা শোনাতে। এ যে মহামিলনের উৎসব! আর অবশ্যই থাকে আমাদের বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন সজল শ্যামল পুরনো নতুন অনুভবের ডালি সাজিয়ে। বইমেলা ছাড়া যার কোমল  স্পর্শ পাওয়া সকলের পক্ষে যে সম্ভব নয় ।

পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ বইমেলায় বিক্রি হয়েছে ২৩ কোটি টাকারও বেশি বইপত্র। ই-বুক পিডিএফ প্রভৃতি যাবতীয় প্যাপিরাসহীন অনুসঙ্গকে সরিয়ে রেখে সাগ্রহে কাগজে ছাপা বইমুখী হয়ে উঠছেন আবার পাঠক। এর চেয়ে স্বস্তির বিষয় আর কী হতে পারে!

তার মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একার বই বিক্রি হয়েছে ৩ লক্ষ টাকার বেশি। রাজনীতি সচেতন সাহিত্যের বইপত্র রাজনীতি সচেতন মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষও প্রচুর কিনেছেন। দেশের তথা পশ্চিমবঙ্গের উথালপাথাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই খবর কিছু নতুন ইঙ্গিত করছে কি? 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন