বইমেলার শেষ রাতে এক নিটোল গোল চাঁদ উঠেছিল, আমার মতো একা। ভিড়ের আমিকে নিভৃত পাঠকের কাছে ফিরতে বলেছিল সে, চোখ পাকিয়ে।
একালে মেলা শুরুর
বহু আগেই মেলা শুরু হয়ে যায় ভার্চুয়ালে। সেখানে নিত্য বিজ্ঞাপন নতুন বই-এর। তরুণ
ভাষাকর্মীরা নিয়ম করে সকাল বিকেল প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য বইটির কথা মনে করিয়ে
দ্যান প্রচ্ছদ সমেত। কিছু আন্তরিক আকুতি থাকে তাতে, কিছু প্রকাশকের প্রতি
কর্তব্যবোধ। মুখরতার এই সংস্কৃতি নিয়ে ঠোঁট বাঁকানোও ক্লিশে হয়ে গেছে এখন৷ বইমেলা
সারা বছরের সৃষ্টিশ্রম শেষে ঘরে ফসল ঘরে তোলার সময় তাঁদের৷ উদযাপন হলই না হয়
খানিক।
ময়দান থেকে
রবীন্দ্রসদন, পার্কস্ট্রীট থেকে যুবভারতী, মিলনমেলা থেকে সল্টলেক – বইমেলার
পরিবর্তনশীল ভৌগোলিকতার সঙ্গে যেন বা তার চরিত্রবদলও ঘটেছে স্বাভাবিক নিয়মে। আবার
বদলায়নিও অনেক কিছু।
যা কিছু নতুন আর যা
যা কিছু শাশ্বত, তাদের সবাইকে নিয়েই স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যত জুড়ে এক আবহমান মেলা।
বইমেলায় এত
বান্ধবযোগ শুনি, তাও একাই যেতে ইচ্ছে করত চিরকাল। অন্তত একদিন, সবার অলক্ষ্যে পাতা
ওল্টানো। সময় কমেছে, ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই বই-এর
সঙ্গে নিভৃতি আরওই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এক কালে লেখকদের ভিনগ্রহী মনে হত। তারপর
বন্ধুদের বই সাজানো থাকত, হাতের ওমে চেপে ধরতাম তাদের।
তবু মাঠে একাই ভালো লাগত। এ বছর নিজের বই হল খান তিনেক। এ কর্মকাণ্ডের সূচনাও গত
বইমেলা থেকে। আগের বছর, এমনই একলাটি
লুকিয়ে উবুদশ-এর টেবিলে, মনে হয়, পাতা ওল্টাচ্ছি। এমন সময় পিছনে ডাক, নাম ধরে।
সরোজ। আলাপ হল। কিছুদিন পরে তার ফোন এল।
বই-এর প্রস্তাব সহ।
এবছর পেরেক ঠকাঠক
প্রথম দুইদিন গেলুম না, যাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ
সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব মিটিয়ে যেতে পারেন সুষ্ঠুভাবে। সরোজ ছবি পাঠালো, তাদের
তাকে আমার বই। প্রথম বই, কাঁপন খানিক লাগল বটে। ইতোমধ্যে অকালবর্ষায় বই গেল ভেসে।
বড় অনাদরে তৈরি এসব বই-এর খুপরি বিপণি, জলের তোড় বাধ মানবে কেন? প্রকাশকেরা হায় হায় করলেন।
প্রথম সপ্তাহান্তে
তবু জনস্রোত, তবু বিকিকিনি। অতঃপর ভিড়ের মেলায় মানিয়ে নেওয়ার পালা। প্রথম গল্প
সংকলন তথা দ্বিতীয় বইটিও একই মেলায় প্রকাশ পেল। ক্ষণিকের জন্য একটা নাড়িছেঁড়া
অনুভূতি হল। যন্ত্রণা, যা প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ-কালে হয়নি। যেন অনেক ব্যক্তিগত
সবার সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। নিভৃতের আমির দিন ফুরোলো।
বইমেলায় রাইস-মাইস,
বইমেলায় ফিসফ্রাই, বইমেলায় টিভি চ্যানেল। মেলা যে শুধু বই-এর নয়, তাও চির-জানা।
ছোটবেলা থেকে শোনা, মেলায় গিয়ে ফিশফ্রাই খেলে নিজেকে পড়াকু সাব্যস্ত করা যায় না।
অথচ খিদে পায় ভরপুর আর লিটলম্যাগের ঠিক পিছনে বেনফিশ আশ্বস্ত করে। মেলায় যা কিছু
বই-রহিত, তাদেরও খুঁজি এখানে ওখানে। বইমেলার বিস্ময় সেই পোট্রেট-আঁকিয়েরা, আছেন।
রণ-পা পরা বই-বিক্রেতাকে খুঁজি… নেই। সেই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে পাওয়া যায়, যার বই
এক মিনিট পড়লে পাঁচমিনিট হাসতেই হবে নাকি। তার বই কোনওদিন কিনলাম না, কিন্তু তাকে
বুড়ো হতে দেখলাম চোখের সামনে। লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের পাশে ফাঁকা জায়গাটুকু চিরায়ত।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা আড্ডা-গানের গোল ঠেক একই, মুখ বদলে যায়। বইমেলা
হাঁদা-ভোঁদা-নন্টে-ফন্টের কাট আউটেরও। সংবাদপত্রের স্টলে অমিতাভ বচ্চন বা সৌরভ
গাঙ্গুলির ঢাউস ছবি দেখতে ভিড় করা জনতারও। বিদঘুটে থিম সং।
ঘোষণা। বিজ্ঞাপনী-টুপি। ‘সব আমাদের জন্য’। কিছু আলো-আলো নতুন চোখ, কিছু মাঝবয়সি
পুরনো ক্ষ্যাপামি। যে ঘাড়-ত্যাড়া ছেলে কিছুতেই পুশ সেল করবে না, যে গায়ে-পড়া
মেয়েটি বই বেচবেই বেচবে — ভালো লাগে তাদের দুজনকেই।
পুরনো বন্ধুরা
অনেকদিন পরে চিনে ফ্যালে। এমনকী, অচেনা বন্ধুরাও। এ এমন এক সময়, যখন রিয়ালের সঙ্গে
একটি ভার্চুয়াল মুখও সকলের আছে। ভার্চুয়ালে যাঁকে চেনেন, তিনি সশরীরে এসে দাঁড়ান।
আপনি আপনার মানসমূর্তির সঙ্গে মিলিয়ে নেন, তিনিও মেলান তাঁরটির সাথে। কিছু মেলে,
কিছু মেলে না। বন্ধু বা বন্ধু-সম্ভাবনার মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে মেলা।
ফোনের টাওয়ার ছুটি নিয়েছিল। হারিয়ে তো যাওয়াই
যেত প্রতিবারের মতো। হারানো হয় না। ভিড়ের নেশা লেগে যায়। বইমেলা পিডিএফ আর ই-লাইব্রেরির জনহীন কূপ
থেকে বর্ষারম্ভে আলোয় ফেরা। আমার শুধু নয়, দুঃখিনী বর্ণমালারও।
একই মেলায় তৃতীয়
বইটি (এটির আমি সম্পাদক মাত্র, লেখক অনেকে) যতদিনে প্রকাশ পেল, ততদিনে মানিয়ে নিয়েছি।
সারস্বতমহলে অপর হলেও ততদিনে খানিক আলাপ-পরিচয় ঘটেছে এ পৃথিবীর লোকজনের সঙ্গে। শেষ
ক’দিনে তাঁরাও বোধ করি অন্য পৃথিবীটার খানিক আঁচ গায়ে মাখলেন। দুটো বৃত্ত মিলল কি কোথাও?
কয়েকবছর ধরে শোনা
যাচ্ছিল, বইমেলায় জমায়েত পুলিশ বড় একটা বরদাস্ত করছে না। তবু আড্ডা, গান, প্রতিবাদ
বন্ধ হয়নি। কলকাতা বইমেলাকে দিল্লী বা ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার থেকে আলাদা করে
চেনায় এসব 'অরাজকতা'-ই। কিন্তু এবার বইমেলার শেষ তিনদিন অভূতপূর্ব তিক্ততা নিয়ে
এল। পুলিশ-র্যাফে মেলামাঠের অবরুদ্ধ দশা প্রায়। কন্ট্রোল রুমের সামনে
হুড়োহুড়ি, গ্রেপ্তার। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর জায়গা নাকি
বইমেলা নয়। নয়? সে সংস্কৃতির তবে কি প্রয়োজন, যা সমাজবাস্তবতা থেকে বিচ্যুত করে?
ভিড়ের আমি যদি কোথাও হাঁফ ছাড়তে পারে, তবে তা এই সমষ্টিগত প্রতিরোধের উদযাপনেই। লিটলম্যাগের
সামনে রবিবারের জমায়েত বইমেলার নিরাজনীতিকরণের
সুচারু বন্দোবস্তে জল ঢেলে দিল ভালো মতো। মিছিল, স্লোগান কিছুই বাকি থাকল না।
আশ্বস্ত হলাম। একাত্ম হলাম৷
কিন্তু পরিশেষে যা
হল... ভিড়, কোলাহল, প্রতিরোধ, বন্ধুসমারোহ - 'এইসব সারেগামা পেরিয়ে' বই-এর কাছে
দু'দণ্ড বসা হল না বোধহয়। সে কথাই মনে করিয়ে দিল শেষ রাতের নিটোল, গোল, একাকী চাঁদ। নিভৃত পাঠকের
কাছে ফেরার জন্য একটি বছর হাতে তুলে দিল সে।
‘করুণাময়ী’ মেলাকে
ফেলে আসি। গর্ভগৃহে ফিরি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন