কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৯১


গত শতকে পৃথিবীব্যাপী যাঁদের মহামারী বা অতিমারী দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল, মনে হয়, তাঁদের মধ্যে কেউ আজ আর জীবিত নেই। এই শতকে আমাদের সেই একই দুর্ভাগ্য হলো। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, বিগত কয়েক শতকে যে পৃথিবীব্যাপী মহামারী হয়েছে, তাতে এক মহামারী থেকে পরবর্তী মহামারীর সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় একশ বছর। অর্থাৎ এই পর্যবেক্ষণ যদি মেনে চলতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতবাণী করা যেতে পারে, আগামী শতকে আবার মহামারী দেখা দেবে মোটামুটি একশ বছর পরে। এবং এটাও নিশ্চিত, তখন আমাদের এই প্রজন্মের কেউ আর বেঁচে থাকবে না। অর্থাৎ আগামী মহামারী বা  অতিমারী দেখার দুর্ভাগ্য হতে পারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তান-সন্ততিদের।

কিন্তু আমাদের মনে যে চিন্তাটা এখন ঘাই মারছে, তা হলো, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্ব জুড়ে যে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মানুষের মৃত্যুমিছিল নিয়মিত চলেছে, কর্মহীন মানুষের বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রয়াসে নাভিশ্বাস উঠছে, অর্থনৈতিক মন্দায় বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড বেঁকে যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এই অসহনীয় অবস্থা ও পরিস্থিতি থেকে কবে আমরা মুক্ত হব? আমাদের জীবনকালে আদৌ মুক্ত হতে পারব কি? হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, এর আগেও বারবার পৃথিবীতে এই ধরনের দুর্যোগ নেমে এসেছে, মানুষেরা এইরকমই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে একদিন পৃথিবী আবার শান্ত হয়েছে, মানুষেরা অস্বাভাবিক  জীবনযাপন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রত্যাবর্তন করেছে। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে,  আজকের এই দুর্যোগও একদিন কেটে যাবে। মানুষেরা বর্তমানের অচলাবস্থা থেকে ফিরে আসবে সুস্থ স্বাভাবিকতায়। কিন্তু সেই দিন আসতে এখন কত দেরি হবে? কবে আসবে করোনামুক্ত দিনের পৃথিবী? করোনার ছোবলে যারা ইতিমধ্যেই চিরতরে হারিয়ে গেছে, এবং এখনও যারা প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের কিন্তু সেই সুদিন দেখার আর সুযোগ থাকল না। সেই অনাগত সুদিনে তারা কেউ উপস্থিত থাকতে পারবে না। এবং শুধুমাত্র তারাই নয়, আমাদের মধ্যে যারা, হয়তো করোনায় আক্রান্ত হবে না, অথবা আক্রান্ত  হলেও  আবার সুস্থ হয়ে উঠবে, তারাও সম্ভবত সেই সুদিন দেখার জন্য উপস্থিত থাকতে পা্রবে না। কেননা, করোনায় মৃত্যু না হলেও বয়সের কারণে স্বাভাবিক  মৃত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে। এটা সবার জীবনেরই অনিবার্য পরিণতি। আর তাই মাঝে মাঝে ভেবে খুব হতাশ হয়ে পড়ছি, করোনার কারণে আমরা সবাই যে সুস্থ ও সহনীয় জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে অসুস্থ ও অসহনীয় জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছি, তার মধ্যেই আমাদের অনেকের বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলো অতিবাহিত হবে। বিশেষত এখনও পর্যন্ত যেহেতু করোনামুক্ত আগামী পৃথিবীর দিনক্ষণ ঘোষণা আমরা শুনতে পাইনি।

সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

পায়েল মণ্ডল

 

সিলভিয়া প্লাথ (পর্ব - ১)




()

সিলভিয়া প্লাথ। বিশ্বসাহিত্যের একজন ক্ষণজন্মা প্রখর প্রতিভাবান কবি ও ঔপন্যাসিক, যিনি প্রকারন্তরে অভিমান করেই চলে যান এক ট্রাজিক আত্মহননের  মাঝ দিয়ে। সম্ভবত প্লাথই ছিলেন সেই কবি যাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি ছিলো না  তেমন টান আর তাই একদিন বাসার কোর্টইয়ার্ডে পুড়িয়ে ফেলেন তাঁর অনেক কবিতার স্ক্রিপ্ট।

অভিমানী এই কবি বিয়ে করেন আর একজন বরেণ্য কবি টেড হিউজেসকে। তাঁরা মাত্র বছর আষ্টেক একসাথে বসবাস করেন। আর সেই সময় তাঁর কোল জুড়ে আসে দুটি সন্তান। প্লাথ ছোটবেলা থেকে মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগতেন এবং সেটা তাঁকে শেষদিন পর্যন্ত তাড়া করে ফেরে। প্লাথের কবিতা ও উপন্যাসের মাঝে তাঁর  নোজগতের একটা স্পষ্ট ধারণা আমরা পাই। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই ছিল  আত্মজৈবনিক এবং কনফেশনাল। কবিতা সংকলন ‘কলোসাস এন্ড আদার’ অথবা ‘এরিয়েল’এর প্রতিটি ছত্রে মূর্ত হয়ে ওঠে প্লাথের মনোজগতের ক্রাইসিস।

শিপ ইন ফগ’কে আমরা তাঁর সুইসাইড নোট হিসাবে ধরে নিতে পারি। কবিতাটি তিনি তাঁর আত্মহত্যার মাত্র কিছুদিন আগে লিখেছিলেন। তিনি বলেন-

‘A flower left out

My bones hold a stillness, the far

Fields melt my heat

They threaten

To let me through to a heaven

Starless and fatherless, a dark water.’

এমন ভাবেই প্লাথ আমাদের সূত্র দিয়ে যান যে তিনি এই পৃথিবীতে থাকছেন না। তিনি মৃত্যু পরবর্তী জীবনে কোন আলো দেখতে পাননি, তবুও তিনি প্রস্থান করেন।

২৭শে অক্টোবর ১৯৩২ সালে প্লাথ আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেন স্মিথ এবং নিউহ্যাম কলেজে। প্লাথ কলেজে থাকা অবস্থায় ‘মাদামোয়াজেল’ পত্রিকায় গেস্ট এডিটর হিসাবে কাজ নেন। সেই সময় মাদামোয়াজেল পত্রিকাটির বেশ নামডাক ছিল। সেই সূত্রে তাঁর পদটিও ছিলো  সম্মানজনক। সেই সময় প্লাথ ওয়েলসের কবি ডিলান টমাসের প্রচন্ড ভক্ত ছিলেন। ডিলানের কবিতা প্রকাশ হওয়া মাত্র তিনি তা সংগ্রহ করে পাঠ করতেন। একবার ডিলান মাদামোয়াজেল পত্রিকা অফিসে আসেন এক সৌজন্য সাক্ষাতকারে। প্লাথ  অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন যে সম্পাদক ডিলানকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। যেকোন কারণেই হোক ডিলানের সাথে প্লাথের দেখা হয় না। প্লাথ এতে প্রচন্ড ভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। তিনি ডিলানের হোটেলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন তাঁর সাথে দেখা করার জন্য। প্লাথের জানা ছিলো না যে ডিলান হোটেলে না উঠে সরাসরি তাঁর দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। ডিলানের সাথে দেখা না হওয়া তাঁর মনে এতই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে ঐ ঘটনার ঠিক দু’দিন পরে প্লাথ  নিজের পা কেটে জখম করেন এটা বোঝার জন্য যে তাঁর আত্মহত্যা করার মত যথেষ্ট সাহস আছে কি নেই। সেই গ্রীষ্মে প্লাথের জীবনে আরো অনেক ঘটনা ঘটে যায় যা তিনি তাঁর আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস ‘দ্যা বেলজার’এ বর্ণনা করেছেন। এই সময় প্লাথ হার্ভাডের রাইটিং সেমিনারে ভর্তি হতে অস্বীকার করেন। এসময় তিনি বিষণ্ণতার প্রান্তসীমায় পৌঁছান। প্লাথকে বিষণ্ণতা থেকে সারিয়ে তোলার জন্য ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপী দেয়া হতে থাকে। ১৯৫৩ সালে আগস্টে প্লাথ প্রথম আত্নহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে বাড়ির পাটাতনের নীচে তিনদিন জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে থাকেন। অনেক খুঁজে তাঁকে সেখান থেকে বের করে ম্যাকলেইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মানসিক চিকিৎসার জন্য এবং সেখানে মাস ছয়েক তাঁকে চিকিৎসা করা হয়। প্লাথ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন

 

(২)

জানুয়ারি ২৫, ১৯৫৬। প্লাথের জন্য এটা ছিল একটা বিশেষ দিন। হয়তো এই দিনের মাঝেই লুকিয়ে ছিল তাঁর নিজেকে পুড়িয়ে মারার বীজ। এই দিনটিতে প্লাথের সাথে কবি টেড হিউজেসের প্রথম দেখা হয়। টেড এসেছিলেন কেমব্রিজের একটা পার্টিতে।

প্লাথ ঘটনাটা বর্ণনা করেন এমন ভাবে-

তখন আমি কেমব্রিজে ইউ এস সরকারের একটা স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছিলাম। টেডের দু-একটি কবিতা আমি আগেই পড়েছিলাম। তাঁর কবিতা আমার বেশ ভালো লাগতো। আমি ভাবতাম টেডের সাথে আমার দেখা হওয়া উচিৎ। আমি ভাবতেই পারিনি যে টেডের সাথে আমার কেমব্রিজের পার্টিতে দেখা হয়ে যাবে। আমাদের পরিচয় প্রেম ও তারপর বিয়েতে গড়ায়। আমরা পাগলের মত কবিতা লিখে যাচ্ছিলাম। জীবনে এমন মধুর সময় আর কখনোই আসবে না। ভাবছিলাম অনাদি কাল যদি এমন ভাবে কেটে যেত’।

প্লাথ স্পেন থেকে হানিমুন সেরে নিউহ্যামে ফিরে তাঁর সেকেন্ড সেমিস্টার শেষ করার দিকে মনযোগ দেন। এই সময় প্লাথ ও টেড এ্যাস্ট্রোলজি ও অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সব দিক থেকে এই সময়টাই ছিল প্লাথের জীবনের সবচেয়ে  ভালো সময়।

সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে টেড ও প্লাথ আমেরিকায় আসেন। প্লাথ স্মিথ কলেজে শিক্ষকতার কাজ নেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারেন যে লেখালেখি  আর একাডেমিক কাজ একসঙ্গে তাঁর পক্ষে করা সম্ভব না। শিক্ষকতা ছেড়ে ম্যাসাচুসেটস-এর একটা মানসিক হাসপাতালে রিসেপ্সনিস্ট-এর খন্ডকালীন চাকুরী  নেন। প্লাথ দিনে কাজ করতেন আর সন্ধ্যার পর কবি রবার্ট লোয়েল, এ্যানে সেক্সটন, জর্জ স্টারবাকের মত কবিদের সাথে ধুমিয়ে আড্ডা দিতেন সহিত্য আলোচনায়। এ্যানে সেক্সটন হলেন আর একজন আত্মঘাতী কবি। এই সময় প্লাথ তাঁদের কাছে নিজের বিষণ্ণতা নিয়ে প্রায়ই আলাপ করতেন। তিনি পরিচিত হন আর  এক কবি ডাবলু মারুউইনের সাথে। এই কবির সাথে প্লাথ ও টেডের আজীবন সম্পর্ক ছিলো।

১৯৬০ এপ্রিলে প্লাথের কোল জুড়ে আসে তাঁর প্রথম সন্তান ফ্রিয়েডা। সেই বছরের অক্টোবরে প্লাথ তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন 'দ্যা কলোসাস' প্রকাশ করেন। পরের বছর গর্ভপাতে তাঁর এক বাচ্চা মারা যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা প্লাথকে তাড়িত করে। তিনি একাধিক কবিতার মাঝে তা প্রকাশ করেন। বিশেষ করে তাঁর কবিতা 'পার্লামেন্ট হিল ফিল্ডে'

‘পার্লামেন্ট হিল’ কবিতায় অমর করে রাখেন তাঁর সেই অনাগত বাচ্চাকে –

‘One child drops a barrette of pink plastic;
None of them seem to notice.
Their shrill, gravelly gossip's funneled off.
Now silence after silence offers itself.
The wind stops my breath like a bandage.’

ঐ বছর আগস্টে তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্যা বেলজার’ রচনা করেনবেলজার লেখা শেষ করে কবি দম্পতি ডেভেনের একটা ছোট্ট শহর কোর্ট গ্রীনে চলে আসেন। এখানেই তাঁর দ্বিতীয় সন্তান নিকোলাস জন্মগ্রহণ করে।

টেড তাঁর শার্লট স্কোয়ারের ফ্লাট একজন কানাডিয়ান কবি ও অনুবাদক ডেভিড ওয়েভিল ও তাঁর বান্ধবী আসিয়াকে ভাড়া দেন। এরপর থেকেই টেড আসিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। টেড –আসিয়ার সম্পর্ক ক্রমেই অন্তরঙ্গ হতে থাকে। প্লাথ সম্ভবত তাঁদের সম্পর্কের কথা আঁচ করতে পারেনচরম হীনমন্যতায় ভুগে প্লাথ  স্বেচ্ছায় মোটর এক্সিডেন্ট করেন। ভাগ্যক্রমে প্লাথ সে যাত্রায় বেঁচে যান। বন্ধুদেরকে  তিনি বলতেন যে ঐ এক্সিডেন্টটা আসলে ছিল তাঁর একটা সুইসাইডিয়াল এ্যাটেম্পট। ১৯৬২’র জুলাই মাসে প্লাথ নিশ্চিত হন যে টেড তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে এবং তাঁকে আর ফেরানো সম্ভব নয়। কবি জুটির দাম্পত্য  জীবন আইনগত ভাবে এখানেই শেষ হয়ে যায়।


 


(৩)

সাল ১৯৬২। এই বৎসরে শতাব্দীর ভয়াবহ শীত পড়ে। প্লাথ তাঁর কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে একটা সস্তা ফ্ল্যাটে ওঠেন যেখানে টেলিফোন লাইন পর্যন্ত ছিলো না। প্রাকৃতিক  দূর্যোগ আর টেডের সাথে বিচ্ছিন্নতা এই দুই মিলে প্লাথ যার পর নাই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। আর এমনই বিষণ্ণ অবস্থায় কাব্যদেবী তাঁর প্রতি হন সদয়। প্লাথের কলম দিয়ে স্রোতের মত বের হয় তাঁর কবি জীবনের সবচেয়ে ভালো কবিতাগুলো। একই সময়েই তিনি শেষ করেন তাঁর একটি মাত্র উপন্যাস ‘দ্যা বেলজার’ যা তিনি পেননেম - ভিক্টরিয়া লুকাস-এর নামে প্রকাশ করেন। এই সময়ে তিনি ২৬টি কবিতা লেখেন যা তিনি এরিয়েল অ্যান্ড আদার পয়েমস’ নামে কাব্যগ্রন্থের স্ক্রিপ্ট  রেখে যান।

শিরোনাম কবিতা ‘এরিয়েলে’ প্লাথ তাঁর সেই সময়ের বিষণ্ণতাকে এঁকে ফেলেন এমন ভাবে-

‘The dew that flies

Suicidal, at one with the drive

Into the red

Eye, the cauldron of morning.’

প্লাথ আবারো জানান দেন যে তিনি কী ভয়ংকর কর্মটি করতে যাচ্ছেন। এমন ডার্ক  কাব্য কেউ লিখেছেন কিনা খুঁজে দেখতে হবে!

এরিয়েল’ নামের শিরোনাম কবিতাটিতে প্লাথ নিজেকে একজন অশ্বারোহী হিসাবে চিত্রিত করেন। তিনি কখনো দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার লাগাম ঠিকভাবে ধরে তাকে সঠিক পথে চালনা করছেন আবার কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। এরিয়েল শুধু ঘোড়দৌড়ের স্মৃতিকথা নয় বরং তা প্রকৃতি, জীবন, ভয়, আর মৃত্যুর কোলাজ। এরিয়েলে তিনি ব্যবহার করেন অনিয়মিত ছন্দ, রেপিটেশন এবং ধ্বনি যা চিত্রময়তাকে ছাড়িয়ে কবিতাটিকে শ্রুতিময় করে তোলে।

প্লাথ সংকলনটির নাম দেন ‘এরিয়েল অ্যান্ড আদার পয়েমস।‘ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সত্য যে তাঁর মৃত্যুর দু বছর পরে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় শুধু ‘এরিয়েল’ নামে। আর প্লাথের মনোনীত কবিতাগুলিকে ইচ্ছে মতো বাদ দিয়ে তাঁর অন্য ১৫ টি কবিতা সংযোজন করে বইটি প্রকাশ করেন তাঁর প্রাক্তন স্বামী টেড হিউজেস। প্লাথ তাঁর প্রাক্তন এই কবি স্বামী সম্পর্কে একবার লিখেছিলেন- ‘এই লোকটির প্রতি আমার ঘৃণা ও ক্ষোভ এতটাই প্রবল যে তার সম্পর্কে কোন শব্দ উচ্চারণ করতেও আমার ঘৃণা হয়’।

 

()

‘শিপ ইন ফগ’-এর নোটগুলো দেখলে বোঝা যায় প্লাথ কতখানি মানসিক ভাবে  বিপর্যস্ত ছিলেন। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর চোদ্দ দিন আগে তিনি শিপ ইন ফগের শেষ তিন লাইন বদলে দেন। এই বদলে দেয়া তিন লাইন ছিলো তাঁর বিষণ্ণতার প্লাথিয় সিগনেচার।

তিনি পজিটিভ ইমেজকে বদলে দেন ডার্ক ইমেজ দিয়ে।

‘Heavenly wools’ ‘Clouds with the faces of babies’  লাইন দুটিকে ফেলে  দেন এবং এর বদলে তাঁর মৃত বাবার রেফারেন্স ব্যবহার করেন। টেড প্লাথের মৃত্যুর পরে এই লাইনগুলো বদলে দেয়া সম্পর্কে বলেন, ‘শিপ ইন ফগ-এর শেষ তিন লাইন অবশ্যই প্লাথের আত্মহত্যার আগামবার্তা ছিলো’।

১৯৬২ তে লেখা শিপ ইন ফগ-এর শেষ লাইনগুলো প্লাথ এমন ভাবে লিখেছিলেন –

‘Patriarches till now immobile in heavenly wools

Row of as stones or clouds

With the faces of babies!’

কিন্তু আত্মহত্যার মাত্র চোদ্দ দিনে আগে তিনি লাইনগুলোকে এমন ভাবে বদলে দেন :-

‘They threaten

To let me through to a heaven

Starless and fatherless, a dark water.’

বিশ্বসাহিত্যে এমন ট্রাজিক কবিতার লাইন একটিও নেই যেখানে কবি স্বয়ং তাঁর নিজের শেষ পরিণতি আগাম বয়ান করে যাচ্ছেন।

‘Fatherless’ শব্দটির মাধ্যমে প্লাথ নিজের বিজ্ঞানী বাবা ডক্টর অটোকে বোঝাচ্ছেন যিনি গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং চিকিৎসা না নিয়ে মারা যান। প্লাথ মনে করতেন তাঁর বাবা তাঁকে ইচ্ছে করে ছেড়ে গেছেন। তিনি চিকিৎসা নিলে হয়তো বেঁচে থাকতেন। প্লাথ বাবার এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি। তার লেখায় বারবার এই স্মৃতি কোন না কোন ভাবে এসেছে।

প্লাথের বিষণ্ণতাকে সাইকার্টিস্টরা স্প্লিট পার্সোনালিটি হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাঁরা  ধারণা করেন যে তিনি একিউট স্কেটযোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর এই মানসিক অবস্থার ছায়া তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় তাই হয়তো নিজের অজান্তেই ‘সাইকোটিক’ ইমেজারির ব্যবহার প্রাধান্য পেয়েছে। যে ইমেজারিগুলো দ্বৈত অর্থ বহন করে। একটা প্লাথের কবি সত্তার আর একটা ব্যক্তি প্লাথের মানসিক ফুটপ্রিন্টTwo Sisters of Persephone’ কবিতাটিতে তিনি এমনই একটা আবহ সৃষ্টি করেন।

‘Two Girls there are : with the house

One sits; the other without,

Day long a dust of shade and light

Plays between these.’

এখানে প্লাথ তাঁর দুটি সত্তাকে এঁকেছেন। একজন প্লাথ কবি ও তাঁর কল্পনা আর একজন  ব্যক্তি প্লাথের। কখনো কখনো এই দ্বৈত সত্তা তাঁকে ভীষণ ভাবে তাড়িত করতো। তাঁর মনোজগত আন্দোলিত হতো বাস্তব সত্তা আর কাব্যকল্পনার সত্তার সাথে! তিনি কোনটাকে গ্রহণ করবেন, এই টানাপড়েন তাঁর কবিতায় চলে আসে  অবচেতন মনে। ‘ইন প্লাস্টার’ কবিতায় আমরা তাঁর এই মানসিক দ্বন্দ্বের একটা স্পষ্ট চিত্র দেখি।

‘I Shall never get out of this! There are two of me now

The new absolutely white person and old yellow one,

And white person is certainly the superior one.’

দ্যা আদার’ কবিতায় প্লাথ বাস্তব সত্তাকে অবিনশ্বর আত্মা হিসাবে দেখেন। তিনি কল্পনা করেন তাঁর এই আত্মা আর বাস্তবতা একটা কাচের দেয়াল আলাদা করে রেখেছে। তারা পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পায় অথচ মিলিত হতে পারে না।

প্লাথের কবিতার ভাষায় –

Cold Glass, how you insert yourself

Between myself and myself.’

- The Other

‘Mirror’ শব্দটা প্লাথকে ভীষণ ভাবায়। তিনি তাঁর একাডেমিক থিসিসের নাম দেন ‘The Magic Mirror!’ প্লাথ আলোচনা করেন কেমন ভাবে তাঁর বাস্তব সত্তা আর কল্পনার সত্তা এক হয়ে একটা অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়ে বিলীন হয়ে যায়। এই দুই সত্তার এক হয়ে যাওয়ার মাঝের সময়টা দ্বান্দ্বিক সময় যার মাধ্যমে এই দুই  সত্তা ক্রমবিকাশিত হয়ে একটা সহঅবস্থানে আসে। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে বাস্তব সত্তা হলো কাল্পনিক সত্তার পরিপূরক, আর তাই তিনি লেখেন-

‘Without me, she wouldn’t exist, so of course she was grateful.

I gave her a soul, I bloomed her as a rose.’

-In Plaster!



 

()

সিলভিয়া প্লাথের এ্যাকাডেমিক ও কাব্য প্রেরণার উৎস কী ছিলো তা ট্রেস করতে  গেলে স্যার জেমস ফ্রেজারের নাম না বললে অন্যায় হবে। কেমন ভাবে একটি ভালো বই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কল্পনার জগতকে প্রভাবিত করে এটা তার একটা অনন্য উদাহরণ। ১৯৫৩তে প্লাথের মা কাকতালীয় ভাবে তাঁকে একটা বই উপহার দেন। সেটা হলো জেমস ফ্রেজারের ‘দ্যা গোল্ডেন বাউ’। বইটি প্লাথকে দারুণ ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। তিনি যেন সম্মোহিত হয়ে যান বইটির বিষয়বস্তুতে। মাকে লেখেন-

‘তোমার পাঠানো উপহার দ্যা গোল্ডেন বাউ পড়তে আমার দারুণ লাগছে। বিশেষ  করে ওই অধ্যায়টা যেখানে আত্মাকে বলা হচ্ছে সত্তার ছায়া ও প্রতিফলন’।  প্লাথ বলছিলেন গোল্ডেন বাউ-এর  The Perils of the Soul’  অধ্যায়টির কথা। এই  অধ্যায়টিতে আত্মার দ্বৈততার কথা বলা হয়েছে। প্লাথকে এই ধারণা বুঁদ করে রাখে। তাঁর এ্যাকাডেমিক থিসিসেও এটা প্রতিফলিত হয়।

ফ্রেজার দ্যা গোল্ডেন বাউ-এ এটা প্রকাশ করতে চেয়েছেন যে আত্মা হলো একজন ব্যক্তির পূর্ণ কাঠামো এবং প্রতিটি ব্যক্তি আত্মার দ্বৈততা নিয়ে জন্মায়। ব্যক্তির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আত্মার সুরক্ষা একান্ত প্রয়োজন। আত্মার রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলো ব্যক্তির জৈবিক শরীর যা আত্মার সুরক্ষা দূর্গ। আত্মার সমস্ত কর্ম বাস্তব জগতে সেই জৈবিক শরীরের দ্বারা সম্পাদিত হয়। ফ্রেজার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, আচার আচরণ, লোককথাকে উপস্থাপন করেন গোল্ডেন বাউতে। তার মাঝে একটা বিশ্বাস এমন ছিলো যে আত্মাকে শরীরের মাঝে সুরক্ষিত রাখার উপায় হলো শরীরকে আংটা (Hook) বিঁধিয়ে বন্ধ করে দেয়া যেন আত্মা বের হয়ে না যেতে পারে। অন্যভাবে বলা যায় যে আংটা হলো শরীরের তালা। প্লাথ এই প্রাচীন বিশ্বাসকে তাঁর অবচেতন মনে যেন স্থায়ী ভাবে গেঁথে নিয়েছিলেন আর তাই তাঁর  কাব্যে ওই ইমেজ ঘুরেফিরে এসেছে।

জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা একটা ইতিবাচক বিষয়। প্লাথ বায়োলজিক্যাল শরীরকে ব্যক্তির সত্তার ধারক হিসাবে দেখেন তাঁর কবিতায়। কিন্তু একটা প্রশ্ন তাঁকে দ্বিধায় ফেলে দেয় তা হলো যারা পুনর্জন্ম পেতে চান তাদের কী হবে? এই পয়েন্টে তিনি মনে করেন ব্যক্তির বায়োলজিক্যাল শরীর পুনর্জন্মের পথে একটা বাধা ছাড়া কিছু   নয়। তিনি মনে করেন বায়োলজিক্যাল শরীরের লয়ের পরেই আর একটা শুদ্ধ আত্মার আবির্ভাব হতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘হুকের’ ইমেজ প্লাথের কাছে না-বোধক হয়ে যায়। কারণ প্লাথ তাঁর নিজের শুদ্ধ আত্মার খোঁজে পাগল হয়ে আছেন। আর এখানেই প্লাথের চরম চাওয়া - বায়োলজিকাল শরীর লয়ের সাথে ফ্রেজারের উপস্থাপিত প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের পার্থক্য রচিত হয়। প্লাথ যেন আত্মহত্যাকে (বায়োলজিক্যাল শরীরের লয়) গ্লোরিফাই করেন। তিনি তাঁর পাঠকদের এটা বিশ্বাস করাতে চান যে এই বিধ্বংসী চাওয়া নিহিত আছে একটা গভীর দার্শনিকতার মূলে।

প্লাথ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা এরিয়েলে এই ‘হুক’ কে উপস্থাপন করেন প্রতীকী ভাবে যা পুনর্জন্মের বড় বাধা।

তিনি লেখেন-

‘Nigger- Eye

Berries cast dark

Hooks-

Black sweet blood mouthfuls

Shadows!’

প্লাথের এই উচ্চারণ রীতিমত অশুভ, অন্তত আমাদের মত সাধারণ বাস্তবতায় বসবাসকারী মানুষদের জন্য। কিন্তু প্লাথের মনোজগত ভয়াবহ ভাবে বিষাদগ্রস্থ। তিনি তাঁর বিষণ্ণ মনের শেষ পরিণতিকে (তাঁর আত্মহত্যা) কাব্যদর্শনে ব্যাখ্য দিয়ে  যান যেন আমরা তাঁকে ভুল না বুঝি। প্লাথ যেন একের পর এক তাঁর আসন্ন লয়ের ইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে যাচ্ছেন দার্শনিক যুক্তিতে।

শরীরের তালা বা ‘হুক’ ইমেজটি আর একটি কবিতা ‘Elm’এ এলো এমন ভাবে-

‘I am inhibited by a cry.

Nightly it flaps out

Looking with its hooks, for something to love.’

প্লাথ এখানে ‘Cry’  ইমেজটি ব্যবহার করেন আত্মাকে বোঝানোর জন্য যা তাঁর ধারণায় ‘শুদ্ধ সত্তা।‘ এই শুদ্ধ সত্তা একটা বায়োলজিক্যাল শরীরের খোঁজ করছে যেটা ছাড়া সেই সত্তা অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারবে না। এখানে প্লাথের অস্থির মনোজগতের একটা ৩৬০ ডিগ্রি বাঁক লক্ষ করা যায়! এই ইমেজ 'ইন প্লাস্টার' কবিতার সাথে কন্ট্রাডিক্টরি। ইন প্লাস্টারে প্লাথ মনে করেন শুদ্ধ সত্তা কোন আধার ছাড়াই থাকতে পারে। প্লাথের শেষ ধারণাকেই আমরা গ্রহণ করি। শুদ্ধ সত্তা ও অলীক সত্তা সব সত্তাকে লয় হতে হবে পুনর্জন্মের জন্য। মজার ব্যাপার হলো সময়ের সাথে সাথে প্লাথ এইসব ধারণা থেকে দূরে চলে যেতে থাকেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে পুনর্জন্ম থেকেও দূরে সরে যান। এটা হয়তো এই  অভিমানী কবির এই জগতে আবার না আসার একটা ইচ্ছামৃত্যু!



 

()

প্লাথ যতই তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোর দিকে এগোচ্ছিলেন ততই তাঁর  কবিতাগুলো ডার্ক ইমেজে ভরপুর হচ্ছিল। তিনি তাঁর কবিতার ভাষায় তাঁর আসন্ন  স্বেচ্ছামৃত্যুর একটা শব্দচিত্র আঁকছিলেন যেন। তিনি এঁকে যাচ্ছিলেন টেডের সাথে তাঁর যৌথ জীবনের অন্ধকার সময়গুলোকে। আর তাই ‘The Rabbit Catcher’ কবিতায় উঠে আসে তার ক্লুপ্লাথ তাঁর প্রাক্তন স্বামী টেডকে একজন ধর্ষক হিসাবে  চিত্রিত করেন যে শুধুমাত্র তাকে ধর্ষণই করেননি বরং তাঁর আত্মাকে বন্দি করেছিলেন তাঁকে আত্মিক ভাবে মেরে ফেলার জন্য। তাঁর আর একটি কবিতা ‘The Jailer’ এবং ‘The Rabbit Catcher’এর মত মেটাফোর ব্যবহার করেছেন। এই কবিতায় কবি স্বয়ং তাঁর ভালোবাসার মানুষটির হাতে নিহত হন। তিনি আমাদের আগেই ক্লু দিয়ে যান কেমন ভাবে তাঁর মৃত্যু হবে। তিনি বলেন-

‘I die with variety

Hung, starved, burn!’

তিনি শেষ শব্দটাকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর জন্য। প্লাথ নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মারেন।

আত্মহত্যার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল প্লাথের মনোজগত অস্থিরতায় ভরে যাচ্ছিল। হতাশা, বিষণ্ণতা, জীবনবিমুখ ইমাজারি তাঁর কবিতায় স্থান করে নিচ্ছিল। তিনি  যেন তাঁর আসন্ন মৃত্যর মহাকাব্য লিখছিলেন তাঁর পাঠকদের আগাম জানান দিয়ে।  ঠিক মোৎসার্ট যেমন তাঁর মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ রিকুয়েম –ডি মাইনর কে-৬২৬। তাঁর মৃত্যুদৃশ্য এই অসম্পূর্ণ রিকুয়েমের মাঝ দিয়ে তিনি আগাম  বলে গিয়েছিলেন। প্লাথও যেন তাঁর অনন্ত সময়ের যাত্রার কথা তাঁর কবিতায় আগাম বলে যাচ্ছিলেন।

লেডি ল্যাজারাসে বলছেন ‘done it again।‘  প্রতি দশ বছর পরপর তিনি চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন দেহ থেকে আত্মার মুক্তির। লেডি ল্যাজারাসের বর্ণনাকারী মহিলা তো প্লাথ স্বয়ং। তিনি এঁকেছেন একজন তুষারধবল ত্বকের মহিলাকে। অর্থাৎ যার শরীরের ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল করে না। মৃত। তাঁর মুখ অতিস্বচ্ছ মসলিনের মত -  দৃশ্যমানতায় ধরা পড়ে না। অর্থাৎ পার্থিব দেহ যেন অদৃশ্য হয়ে যায় বাস্তবতার চোখে।

লেডি ল্যাজারাসের প্রতিটি লাইনই যেন প্লাথের তীব্র মৃত্য আকাঙ্ক্ষার কাব্যগাঁথা। তিনি তা ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করেন হলোকাস্ট ইমেজ। ঠিক যেমন তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর আর একটি কবিতা ‘Daddy’তে। ল্যাজারাস শিরোনামটি তিনি নিয়েছেন বাইবেল থেকে। যীশু যাঁকে মৃত্যুর পর ফিরিয়ে আনেন। প্লাথ  চাইছেন পার্থিব মৃত্যু আর বাঁচতে চাইছেন অনন্তে। অর্থাৎ অনন্ত সময়ের ব্যপ্তিতে দেহকে বাদ দিয়ে আত্মায় বেঁচে থাকা। আর এই জগত থেকে বিদায় নেবার প্রচেষ্টাকে গ্লোরিফাই করেন তাঁর সেই বিখ্যাত উচ্চারণে – ‘dying is an art!’ বিশ্বসাহিত্যে আর কেউ মনে হয় নিজের মৃত্যু-আকাঙ্ক্ষাকে এত ক্যাবিকভাবে উপস্থাপন করেননি!

বাবার প্রতি প্লাথের ভালোবাসা ছিলো অপরিসীম। মাত্র দশ বছর বয়েসে তিনি বাবাকে হারান। চিকিৎসা না নিয়ে বাবার চলে যাওয়াটা প্লাথকে আজীবন ভাবিয়েছে। তিনি মনে করতেন বাবা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন প্লাথের ঈশ্বর। তাই প্লাথ নার্সারী রাইমে লেখা ষোল স্টেঞ্জার Daddy কবিতায় উচ্চারণ করেন-

‘Daddy, I have had to kill you

You died before I had time

Marble-heavy a bag full of God.’

বাবাকে নিয়ে তাঁর মনোজগতের ভাঙ্গাগড়ার ধূসর ক্যানভাস আঁকেন তাঁর চিরায়ত ডার্ক ইমেজ দিয়ে। একটা বিষয় না বললেই চলে না, মৃত্যুর খুব খুব কাছে এসে  তিনি কিন্তু তাঁর বাবাকেই স্মরণ করছেন অথচ তাঁর কবিতায় কোথাও তাঁর মায়ের ছায়া নেই। যদিও প্লাথের মা বাবা মারা যাবার পর থেকে তাঁর সব ক্রাইসিম মুহূর্তগুলোতে পাশে থেকেছেন।

‘Daddy’ নিঃসন্দেহে প্লাথের শেষ দিনগুলোতে লেখা একটা অসাধারণ কবিতা। আমরা এক নতুন প্লাথকে আবিস্কার করি। যে প্লাথ তাঁর ব্যাক্তিগত অনুভূতিকে মিশিয়ে দেন রাষ্ট্র, বর্ণ, গোত্র, যুদ্ধে আর এসবের প্রেক্ষাপটে বলে যান তাঁর আত্মজীবনী। কল্পনার রঙে। কবিতায়। আর তা দাঁড় করান প্লাথিয় হলোকাস্ট ইমাজেরি ব্যবহার করে। তিনি পাঠকদের ধন্ধে ফেলে দেন তাঁর পরিচয় নিয়ে।

‘A Jew to Dachau, Auschwitz, Belsen’- বাবাকে তিনি নাজী জার্মানী আর মাকে ইহুদী হিসাবে উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ দুই বিপরীত মেরুর বর্ণের মানব মানবীকে সম্পর্কিত দেখতে চান তাঁর কল্পনায়। বাবাকে চিত্রিত করেন হলোকাস্ট ইমেজারি ব্যবহার করে। কবিতায় মেয়েটির বাবা হল- ‘Panzer-Man!’

এ কবিতাটি সরলরৈখিক ভাবে এগোয় না। বরং মাঝামাঝিতে এসে প্লাথ ফিরে আসেন তাঁর নিজের স্থানে - মনোজগতে। তিনি ফিরে আসেন তাঁর হতাশায়, দুঃস্বপ্নে, আত্মধ্বংসে। প্লাথ কবিতাটি যখন লেখেন তখন টেডের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আর তাই জীবন সম্পর্কে তীব্র না-বোধক ধারণা তাঁকে তাড়িত করে। তিনি বলেন -

‘I was ten when they buried you

At twenty, I tried to die

And get back, back, back to you.’

প্লাথ এই রিয়েলিটিতে এক চরমতম ইনসিকিউরিটিতে ভুগছেন আর তাই তিনি চলে যেতে চান। আর অনন্তলোকে তাঁর বাবার সাথেই থাকতে চান। বাবার কাছেই যেন তাঁর পরম শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ অপেক্ষা করছে। প্লাথের উচ্চারণ একজন ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সে আক্রান্ত মেয়ের মতই শোনায়।



 

()

‘Daddy’ কবিতাটি প্লাথ একজন ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সে আক্রান্ত মেয়েকে দিয়ে বলাচ্ছেন যে মেয়েটি তাঁর বাবাকে ঈশ্বরের স্থান দিয়েছেন তাঁর মনোজগতে। ইলেক্ট্রা মিথ  কবিতাটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কবিতার বিষয়বস্তুর সাথে অটুট ইউনিটি রাখার জন্য। বাবার মৃত্যু প্লাথকে অপরাধবোধে ভোগায়।

তিনি বাবাকে দোষ দে্ন এভাবে যে ্তিনি মাত্র দশ বয়েসী প্লাথকে একা রেখে চলে   যান এই নির্দয় বাস্তবতায়। আর তাই তিনি বাস্তবতাকে ব্যবহার করেন তাঁর আত্মহত্যা করার যথার্থতা প্রমা করার জন্য। কারণ এই বাস্তবতা কোনক্রমেই তাঁর  জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। তাই তিনি যেতে চান তাঁর বাবার কাছে। আর এখানেই কবিতাটি একটা জটিল সাইকোলজিকাল কবিতায় পরিণত হয় যা প্লাথ তাঁর অশান্ত  মনোজগতকে কাব্যের ভাষায় প্রকাশ করেন।

আর অনিবার্য ভাবে এসে যায় তাঁর কবিতায় ফ্রয়েডিয়ান মনোবিশ্লেষণ। একজন উঠতি বয়েসী বালিকা তার বাবাকে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসে। যার স্নেহ, ভালোবাসা আর নিরাপত্তায় বালিকাটি বেড়ে উঠতে চায় অথচ বাস্তবে তা ঘটে না। বাবার মৃত্যু  তার এই ইচ্ছের বিরতিচিহ্ন এঁকে দেয়। এর জন্য প্লাথ জীবনকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করেন। তাঁর এই স্বপ্নের ইচ্ছে পূরণ করতে চান একজন পুরুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে। তিনি আশা করেন তাঁর পুরুষ সঙ্গী হবেন তাঁর  সরোগেট পিতা যিনি তাঁর পিতার অভাবকে পূরণ করবেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা কখনোই ঘটেনি। তাঁর ইচ্ছেটা ভয়াবহ ভাবে মিথ্যেয় পরিণত হয়। আর এই হেরে যাওয়া তাঁকে সম্মোহিতের মত টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর দ্বারে। তিনি বলেন-

‘And When I knew what to do

I made model of you

A man in black with meinkamf look’

প্লাথ তাঁর দাম্পত্য জীবনের ব্যার্থতাকে বর্ণনা করেছেন এমন ডার্ক ইমেজ দিয়ে।

আরো এগিয়ে গিয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেন তাঁর জীবনসাথী একজন ‘Vampire’ যে তাঁর রক্ত ক্রমাগত পান করছে, সে তাঁকে জীবনীশক্তিহীন করে ফেলেছে। তিনি স্মরণ করতে পারছেন না যে তাদের দাম্পত্য জীবনের এমন এক মুহূর্ত যা তাঁর  কাছে সুখকর ছিল। একজন চরম অসুখী স্ত্রী হিসাবে সাতবছর একসাথে কাটিয়েছেন। তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে শুধুই অবহেলা পেয়েছেন যা তাঁর মনকে ভয়াবহ ডার্ক জগতে পরিণত করেছে। তাঁর বিশ্বাসের শেষ সম্পর্কটা টুকরো টুকরো হয়ে যায় যখন তাঁর স্বামী আইনগত বিচ্ছেদের আগেই আর এক জন মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন আর দূরে সরে যান। প্লাথ এই চরম অপমানজনক ঘৃণ্য ঘটনাকে তাঁর কবিতায় এই ভাবে প্রকাশ করেন-

‘The vampire who said he was you

And drank my blood for a year

Seven years, if you want to know’

প্লাথের ব্যক্তি জীবনের ধারাবাহিক বঞ্চনার ঘটনাগুলো তাঁকে বাধ্য করে জীবনবিমুখ হতে। তাঁর দেহের অস্তিত্ব তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে যায়। তিনি তাঁর আত্মার মুক্তির জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েন। তাঁর বাবার মৃত্যুস্মৃতি, ব্যর্থ দাম্পত্য জীবন তাঁকে  মৃত্যুর পথে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যেতে থাকে। তিনি এই ধারণায় পৌঁছান যে মৃত্যুই একমাত্র তাঁর ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতার যাতাকল থেকে মুক্তি দিতে পারে।

প্লাথ তাঁর এই মনোজগতকে কাব্যে চিত্রিত করতে বাইবেলের গল্প এডোপ্ট করেন লেডি ল্যাজারাস কবিতায়। জন ল্যাজারাস যাকে যিশু মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান করেন। তিনি ল্যাজারাসের সাথে তাঁর তুলনা করেন। ল্যাজারাস বেঁচে ওঠার পর জীবনমুখী অথচ প্লাথ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আবারো মৃত্যুর দিকে যেতে চান। প্লাথের কাছে বেঁচে থাকাটা যেন অলীক বাস্তবতা। ল্যাজারাসের সাথে তাঁর একটাই মিল, তা হল ল্যাজারাস আর প্লাথ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন।

প্লাথ স্পষ্টভাবে বলে যাচ্ছেন তাঁর মনের যন্ত্রণা, টানাপড়েন যা তাঁকে একাধিকবার আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিল। তাঁর কাছে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনই মনে হয়েছিল সেফ জোন বসবাস করার জন্য। তাই প্রতি এক দশক পর পর তিনি চলে যেতে  চেয়েছেন এক কষ্টকর বাস্তবতা থেকে যা তাঁর আবাসযোগ্য স্থান মোটেই নয়। তিনি বলেন-

‘I have done it again

One year in every ten

I manage it.’

 

(ক্রমশ)