সমকালীন ছোটগল্প |
কাক, না কাউয়া
“কাউয়া আবার পক্ষী হইল
কবে?”
“ক্যান, কাউয়া পক্ষী না!”
“না। কাউয়া তো কাউয়াই”।
“ক্যান, শুনস নাই
মাইনষেরা অগো পোলাদের কয়, ঐ দেখ চড়ুই পাখি, ঐ দেখ শালিকপাখি, কিন্তু কাউরে শুনছস কাক পাখি বা কাউয়া পাখি কইতে। তাই কাউয়ারে কাউয়াই কয়”।
“কিন্তু অরে আমার খুবই
ভাল লাগে”।
“তর ভাল্লাগার কারণখান
শুইনতে পারি কি?”
“কাউয়ারে ভাল্লাগার এক নম্বর
কারণ হইল গিয়া উয়ার বুদ্ধি। খুব চালাক পক্ষী। আর দুই নম্বর কারণ হইল গিয়া কি সন্দর
এক দ্যাশ হইতে অন্য দ্যাশে উইড়া যায়। অগো পাসপোর্ট-ভিসার বালাই নাই। গুলি খাইবার
ভয় নাই। আমি কিন্তু কাউরে কাউয়া মাইরতে দেখি নাই। তুমি দ্যাখছ নাকি আম্মি?”
“হ, দ্যাখছি। তহন আমি
ছুট ছিলাম। একদিন আমার বন্ধুরা আইয়া কইল আমাগো গেরামের পূব ডাঙায় নাকি কাগমারির দল
আইসে। চল দেইখা আসি”।
“তা, তুমি কি গেছিলা?
তুমারে নানা-নানী কিছু কয় নাই?”
“ট্যার পাইলে তো কবে। তা
গিয়া দেখি একদল লোক পূব ডাঙায় যে বড় বট গাছখানা আছে তার নীচে বইয়া উপরে চাইয়া
নিজেদের লগে কথা কইতেছে। অগো ভাষা বুঝি নাই। ঐ গাছখানায় অনেক পক্ষীর বাসা আছিল।
কিন্তু বেশি আছিল কাউয়া আর বগার বাসা। তা সেদিন অগো কাজ কারবার দেইখা আমার তো
চক্ষু চড়কগাছ! অরা এক এক কইরা বাঁশের নলরে জোড়া দিয়া ইয়া লম্বা একখান লাগি বানাইল।
আর আগায় দিল একখান লোহার শলা। তহন ঐ গাছখানায় কাউয়া আর বগারা জিরাইতেছিল। তিনজন লোক তিনখান লগি নিয়া খুব আইস্তে আইস্তে পক্ষীদের
পিছনে গিয়া অগো প্যাটে ঐ শলাখান বেবাক ঢুকাইয়া দেয়। তাইতো তরে কই আমি নিজের চোক্ষে
কাউয়া মাইরতে দ্যাখছি। তবে ঐ একবারই দ্যাখছিলাম। পরে অগো আর আমাগো গেরামে আইতে
দেখি নাই”।
“আহারে! অগো শরীলে কি
কুন দয়া-মায়া নাই!”
“তা থাইকবে না ক্যান।
কিন্তু কাউয়া আর বগাদের গোস্ত অরা খায় বইলাই তো অগো মারে। এতে কুন দোষ নাই। আমরা
খাইনা, তাই মারিনা”।
“আম্মি, তুমি দ্যাখছিলা
না যহন আমরা বেনাপোল পার হইয়া ভারতে আসি তহন কত্ত কাউয়া উইড়া আমাগো দ্যাশের দিকে
যাইতেছিল। সেদিন অগো দেইখা মনখান খুব খারাপ হইয়া গেছিল। অগো জিগাইতে সাধ করতেছিল
যে অরা কুন গেরামের কাউয়া। আমাগো গেরামের কুন কাউয়ারে অরা চেনে কিনা”।
“শুন আমার মাইয়ার কথা! কাউয়া আবার ভিন গেরামের কাউয়ারে
চেনে নাকি! অরা কি আর আমাগো মতন মানুষ নাকি!”
“ক্যান আম্মি, না চিনার
কী আছে। দেখ নাই যহন একখান কাউয়া চিল্লায় তহন হাজার কাউয়াও চিল্লায়। না চিনলে কি
আর অমন কইরা চিল্লাইত! অগো ভাষায় অরা কথা কয়”।
আম্মি মেয়ের কথার কোন উত্তর
না দিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকে। অনেক বেলা হয়ে গেল অথচ এখনও নাস্তা তৈরি হয়নি। এখনই বাড়িতে
হুলুস্থুলু শুরু হয়ে যাবে।
(দুই)
বদিরুদ্দিন মিঞাই বোধহয় শেষ ব্যক্তি যিনি তার ওপারের সব সম্পত্তি এপারের বীরভূম নিবাসী বাসব কুন্ডুর সম্পত্তির সাথে এক্সচেঞ্জ করেছেন। দুজনেরই কাপড়ের ব্যবসা ছিল। একজনের ছিল সাতক্ষীরায় আর একজনের কিন্নাহারে। ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু দুটি পরিবারেরই নিজের নিজের জন্মভূমিতে ইদানীং বাস করতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল! যেমন বসিরুদ্দিন মিঞার মনে হচ্ছিল ইদানীং যেন হিন্দুরা বেশি করে নাম সংকীর্ত্তন শুরু করেছে। বেশি বেশি করে ঢাক ঢোল বাজাতে শুরু করেছে! কোথা থেকে যেন হিন্দুরা এসে এই পাড়াটাকেই বেছে নিয়ে একটা করে ঘর তুলে ফেলছে! এটা শুধু তার একার ভাবনা নয়। এই পাড়ায় যত ঘর মুসলমান রয়েছে তারাও কম বেশি ভূক্তভোগী! প্রতিবাদ করেও কোন কাজ হয়নি। অনেকে নিজের গ্রামের পাশেই বা জেলার মধ্যেই মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিন্তু বসির মিঞা তা করে উঠতে পারেন নি। তার একমাত্র কারণ হল তার দীর্ঘদিনের কাপড়ের দোকানের তেমন সঠিক দাম পাচ্ছিলেন না।
অন্যদিকে বাসব কুন্ডুরও
প্রায় একই অবস্থা! যদিও তাদের গ্রামটা চিরকালই হিন্দু-মুসলমানের গ্রাম ছিল। সবার
সাথেই সবার একটা ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ইদানীং রাজনীতিই বোধহয় ক্রমশই সেই শান্তি
বিঘ্নিত করছে। এক সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায়ের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে! যেন
তাকে সে জীবনে এই প্রথম দেখল! হিন্দু পাড়ায় গরিবদের বাড়ি চড়া দামে কিনে নিয়ে
মুসলমানেরা বেশ বড় পাকা বাড়ি তৈরি করে নিচ্ছে! ফলে ছড়ানো পাড়াটাই কয়েক বছরের মধ্যে
যেন ভীষণ আঁটোসাঁটো হয়ে গেল! ক্রমশই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এসব না হয় মানিয়ে
নেওয়া যেত। কিন্তু সব থেকে বেশি অসুবিধা হচ্ছিল বাসবের বিধবা মা চন্দ্রাবতীর। রোজই
যখন তুলসী তলার আসে পাশে মুরগির পালক বা ঠ্যাং পড়ে থাকতে দেখা গেল তখন তা সহ্যের
সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য এ ব্যাপারে কাউকে একক ভাবে দোষও দেওয়া যাচ্ছিল না। কারণ
এ তো কোন দুষ্ট মানুষের কাজ নয়, এ হল কুকুর-বেড়াল বা কাকের কাজ। তাই নিজের পোড়াকপাল ছাড়া আর কাকেই বা দোষ দেবে।
নিত্যদিনের এমন উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাসবও খোঁজ খবর শুরু করে দিল। কিন্তু বসতবাড়ি আর দোকান সমেত কেনার মতো কাউকে পাওয়া গেল না।
যাও বা একজনকে পাওয়া গেল কিন্তু সে যে দাম দিতে চাইল তাতে অন্য কোথাও হয়তো মাথা
গোঁজার ঠাঁই হবে কিন্তু কাপড়ের দোকান হবে না। আর ব্যবসাই যদি না করতে পারে তাহলে
সংসারই বা চলবে কী করে!
ঠিক এমন সময় এই সুযোগটা
হাতে চলে এল। কিন্তু আজও বাসব কুন্ডু একে ঠিক সুযোগ বলতে রাজি নন। তিনি একে বলেন
কপাল লিখন। তা না হলে এত কাল পরে কেউ কখনও নিজের জন্মভিটা ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে
বাধ্য হয়! অবশ্য মা এতে মোটেই অখুশি নন। কারণ খুব কাছেই তার বাপের বাড়ি। বাবা-মা
নাই বা থাকল, এখনও ছোট ভাইটাতো আছে। সেই বাড়িটাতো আছে। তাতেই হবে। মাঝে মাঝে তো
বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে। এটাই বা কম কি! বিশেষ করে জীবনের শেষ সময়ে এসে এমন সুযোগ
কয়জনের কপালেই বা জোটে! তাই এমন প্রস্তাবে চন্দ্রাবতীর আপত্তির বদলে উৎসাহই বেশি
দেখা গেল। বাসব কুন্ডুর স্ত্রী জয়া রাত-দিন চোখের জলে ভাসতে লাগল! একমাত্র ছেলে
শুভম সব শুনে শুধু বলল, “তোমরা
যেখানেই যাও, চাকরীটাতো আমি এই দেশেই করব”।
এভাবেই একদিন অনেক
মতানৈক্য ও মন খারাপ নিয়ে দুটো পরিবার ছিন্নমূল হয়ে এক অপরিচিত জায়গায় গিয়ে বাসা
বাঁধল। দুটো জন্মভূমির মধ্যে অনেক অমিল
থাকলেও সবচেয়ে বড় মিল হল মুখের ভাষা ছিল ‘বাংলা’ আর দুটো দেশই হল বাঙালীদের দেশ। কাজেই প্রথমে ধাক্কাটা
তেমন ভাবে কাউকেই স্পর্শ করতে পারে নি। যেখানে ভাষা ও সংস্কৃতি এক, সেখানে অন্য
অসুবিধাগুলো গৌণ হয়ে যায়। হাজার হোক দুজনেই তো বাঙালী আর দুজনেরই গঙ্গা-পদ্মা এবং রবীন্দ্র–নজরুল। তাই
ধীরে ধীরে একদিন বদিরুদ্দিন মিঞা আর বাসব কুন্ডুর পরিবার দু দেশের জল হাওয়ায়
নিজেদের মানিয়ে নিল। আর মনে মনে ভাবল ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়!’
(তিন)
বায়স-কাক-কাউয়া-পাতিকাক-দাঁড়কাক সবই এক। শুধু নামের হেরফের। যে দেশে যেমন চলে আর কি! তাই স্বভাবটাও এক। আবার আমাদের এদেশের দাঁড়কাকের মতো হিমাচল প্রদেশে যে কাক রয়েছে তাদের ঠোঁটটা আবার টুকটুকে হলুদ। এরাও পাহাড়ি কাক। এদেরই বোধহয় ইংরেজীতে বলা হয় ‘ইয়েলো বিল্ড শাফ’। সে যাই হোক না কেন কাক তো বটে! এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর সব কাকেরাই ‘কাউয়া’। যেমন এই কিছুক্ষণ আগেই সবনম জলি আর তার আম্মি নুসরতের মধ্যে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল।
বিকালের ঝিরঝিরে হাওয়ার
স্বাদ পাওয়ার জন্য শুভম ওর ল্যাবের জানলাটা খুলে দিল। আর সাথে সাথে অপেক্ষমান এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস
শুভমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! শুভম ওর চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, ‘আঃ! তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি!’
অবশ্য তার এই আমেজটা মনে
থিতু হতে না হতেই “আজ দখিন দুয়ার খোলা” রিং টোনটা বেজে উঠে যেন সব আনন্দটাই হঠাৎ করে চেটেপুটে খেয়ে নিল! শুভম বিরক্ত
হয়ে কিছুটা সময় মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকল। নম্বরটা একেবারেই অচেনা। এমন অচেনা
কেউ ফোন করলে তার অসহ্য মনে হয়। সে ফোনটা ধরল না। এক মুহূর্তের নীরবতা! তারপর আবার
বেজে উঠল। শুভম একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা রিসিভ করল।
যদি অচেনা কেউ ফোন করে
থাকে তাহলে বরাবরই শুভম বলে, “আপনি কি শুভমের সাথে কথা বলতে চাইছেন?”
“জি হ্যাঁ”।
এমন সম্ভাষণে শুভম
প্রথমেই একটু হকচকিয়ে যায়। ভাষাটা যে বাঙাল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বাংলা
দেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বভারতীতে পড়ে। তারা যখন নিজেরা কথা বলে তখন এমন ভাষাতেই
বলে। তাই শুভমের এই ভাষা এবং বলার ঢংটা একেবারেই চেনা। কিন্তু নম্বরটাতো এ দেশের!
কি আশ্চর্য! তাহলে এ ফোনটা কার! শুভম উদ্বিগ্ন গলায় বলে, “আপনি কে বলছেন?”
আবার সামান্য নিস্তদ্ধতা!
তারপর সেই মিহি সুরেলা গলায়, “জি, আমি
সবনম জলি বলতেছি”।
কে সবনম জলি! নামটা এমন
অদ্ভুতই বা কেন! জলি কি কারোর পদবী হতে পারে! তাছাড়া এমন নামের কাউকে দেখা তো
দূরের কথা কোনদিন শোনেও নি। কিছুতেই মনে না পড়ায় শুভম একটু বিরক্ত হয়ে বলে, “কিছু মনে করবেন না। আমি কি
আপনাকে চিনি?”
“জি না”। সবনম জলি সত্যি কথাটাই বলে।
“আপনি কি কখনও আমাকে
দেখেছেন?” শুভম বিস্মিত হয়ে জানতে চায়।
“জি এক্কেবারেই দেখি
নাই। কিন্তু আমি আপনারে অনুভব করতি পারি”। সবনম জলির গলায় সামান্য হাসি খেলে যায়।
“দেখেননি অথচ অনুভব করতে
পারেন কীভাবে! তাছাড়া আমার সেল নম্বরটা আপনাকে কে দিল বলুন তো?” শুভমের গলাটা একটু
কর্কশ শোনায়।
“কেউ দেয় নাই তো। আপনিই
তো লিইখা রাখছিলেন”। সবনম
জলি এবার খিল খিল করে হাসে।
শুভম আরো অবাক হয়ে বলে ,
“আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?
আমার তো মাথা খারাপ হয়নি যে আমার সেল নম্বর সবাইকে বিলিয়ে দেব বা দেয়ালে দেয়ালে
লিখে রাখব। কেউ এমনটা করে বলেও শুনিনি”।
“না, এমনটা কেউ করে না! কিন্তু আপনি করছেন। আর তাই তো
আমি আপনার লগে কথা কইতে পারতেছি। ভাগ্যিস আপনি লিখছিলেন”। সবনম জলি আবার হেসে ওঠে।
এবার শুভম সত্যিই রেগে
গিয়ে গলায় ঝাঁঝ এনে বলে, “এবার
ভনিতা না করে বলুন তো কোন পাড়ার দেয়ালে আপনি
আমার এই নম্বরটা পেলেন?”
“ওমা, পাড়ার দেয়ালে
পাইতে যাব ক্যান! আপনিই তো ঘরের ক্যালেন্ডারে নিজের মোবাইল নম্বরটা লিইখা রাখছেন। কি
ঠিক কই নাই?”
শুভম ভাবে এর মধ্যেই কি
মা পাড়ার লোকদের ডাকতে শুরু করেছে! নাকি এই মেয়েটি ওর কোন আত্মীয়ের বন্ধু! মা
কিন্তু কাজটা ঠিক করে নি। রাতে বরং মাকে ফোনে বলে দেব। কিন্তু কোনটা যে তার ঘর তা বোধহয়
এখনও ঠিক হয় নি। যদিও সে মাত্র দু দিনের জন্য গিয়েছিল। ভাল করে বাড়ি আর গ্রামটাও
ঘুরে দেখা হয়নি। তবে উপরে যে ঘরটা রয়েছে আর তার সাথে রয়েছে টানা বারান্দা। সেই ঘরটা যেন তাকে দেওয়া হয় তা অবশ্য মাকে বলে এসেছে। শুভম
জানে জোছনা রাতে উপরের ঐ ঘরটা যে কাউকে পাগল করে দেবে। ছাদের সব জোছনাই বন্যার
ঢেউয়ের মতো ঐ ঘরটা ভাসিয়ে দেবে। এবার থিসিসটা জমা দিয়ে বরং কিছুদিন বাংলাদেশ ঘুরে
আসা যাবে। শুভমের একবারও মনে হল না যে এবার থেকে বাংলা দেশটাই তার দেশ। আর ভারতটা
বিদেশ বিভূঁই! বড় অদ্ভুত এই রসায়ন!
শুভমের এই ভাবনাটা একটু
বেশি সময় নিয়ে ফেলেছে। এতে ফোনের ওপারে অপেক্ষমান সবনম জলির ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সে
বলে, “কি ঘুমায় পরলেন নাকি?”
শুভম চমকে ওঠে। ও লজ্জা
পেয়ে বলে, “কই না তো। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। আপনি কি এখন আমাদের বাড়ি থেকে কথা
বলছেন?”
“হ, অহন তো এহানেই আছি”।
“তাহলে কাইন্ডলি মাকে একবার
ফোনটা দেবেন। জরুরি কথা আছে”।
এবার সবনম জলি ফিক করে
হেসে বলে, “এবার কিন্তু আপনিই আমার লগে মস্করা করতেছেন। আপনার মায়েরে আমি পামু
কনে! তিনি কি আমার নাগালে আছেন”।
“না, মানে আপনি বললেন না যে আমাদের
বাড়ি থেকে কথা বলছেন। তাই ডেকে দিতে বললাম। ঠিক আছে, আপনি মাকে বলবেন যে আমি রাতে
ফোন করব”।
“ঠিক আছে তা না হয় ফোন
করবেন। তার আগে আপনারে একখান কথা জিগাই। আপনার ঘর খান কিন্তু ভারি সুন্দর। চারদিকে কত্ত জানালা। আলো আইয়া ঘরটারে ভাসাইয়া দেয়। আমি কিন্তু আপনার ঘরখানাই নিছি”। সবনম জলি নিঃশব্দে হাসে।
“তার মানে! নিয়েছেন মানেটা
কী? আমি কিন্তু দোতলার ঐ ঘরটাই নেব। আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে ঐ ঘরে থাকতে দিল কে!
তাছাড়া আপনি আমাদের কোন আত্মীয় নন। ঠিক আছে, আমি রাতে মায়ের সাথে কথা বলে নিচ্ছি”। শুভম রাগে কাঁপতে থাকে।
সবনম জলি তার রিনরিনে
গলাটাকে আরো খাদে নামিয়ে বলল, “খামকা আপনি আমার উপর রাগ করতেছেন। আপনার আব্বুই তো আমাগো দিছে। ক্যান আপনি কি
কিছুই জানেন না!”
হঠাৎ শুভমের মনে হল এই
মেয়েটি কি তাহলে বদিরুদ্দিন মিঞার মেয়ে। আসলে এদের সাথে আগে কোনদিনই দেখা হওয়া তো
দূরের কথা সামান্য কথাও হয়নি। শুধু বাবার মুখে শুনেছে যে যিনি আমাদের বাড়িটি
নিয়েছেন তার নাম বদিরুদ্দিন। ব্যস! এর বেশি নয়। ভাবলে অবাক লাগে যে তারা এখন বাংলাদেশী
আর এই সবনম জলিরা হল ভারতীয়! এত সহজেই কি সব পালটে যায়! অন্য দেশের
নাগরিক হলেও জন্মভূমি তো
কেউ পাল্টাতে পারবে না। জন্মদাত্রী মা যেমন একজনই। একে ভাগ করা যায় না। শুভম আজো বুঝতে পারে না
বাবা শুধু মাত্র ঠাকুমার অসুবিধার কথা ভেবে কেন দেশ ত্যাগ করল! বাড়ির আর কারোর কি
কোন অসুবিধা থাকতে পারে না। কিন্তু এভাবে বাবা কার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইল!
নিরাপত্তা যদি নিজের মাটিতে না পাওয়া যায় তাহলে কি তা অন্য মাটিতে পাওয়া যাবে! কিন্তু এখন আর কিছুই করার
নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী তারাই বোধহয় ভারত থেকে বাংলাদেশে যাওয়া শেষ পরিবার! তাই এবার
থেকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, বাড়ি কোথায়?
সে কী বলবে, ভারত, নাকি বাংলাদেশ! শরীরের মধ্যে রাঢ় দেশের উষ্ণ রক্তের প্রবাহ অথচ
তারা কিনা নদী মাতৃকা বাংলাদেশের নাগরিক!
“আবার কি আপনি বোবা হইয়া
গেলেন?” সবনম জলি হাসতে হাসতে বলে।
শুভম বুঝতে পারেনা আজ ওর
কি হয়েছে। ও তাড়াতাড়ি জড়তা কাটিয়ে বলে, “না, না তা
হবে কেন। আসলে আপনি যে বদিরুদ্দিন
সাহেবের মেয়ে আর আমাদের কিন্নাহারের বাড়ি থেকেই বলছেন,
তা আমি বুঝতে পারি নি। তাছাড়া এই প্রথম কথা হল কিনা!”
“তাই তো কই একদিন সময়
কইরা চইলা আসেন। দ্যাখবেন ঘরের আনাচ-কানাচগুলান পুরানা স্মৃতি দিয়া আপনারে ক্যামনে
বিবশ কইরা রাখে। অহন তো আমার লগে কথা হইয়া গেল। তা কবে আইবেন কন!”
শুভম আমতা আমতা করে বলে,
“এখনই হবে না জানেন। গবেষণাপত্র জমা না দিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না। তা আপনি কী করেন?”
শুভম আন্দাজ করতে পারে যে এই মেয়েটি তার থেকে বেশ ছোটই হবে। কিন্তু তবু প্রথমেই
তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। অথচ শান্তিনিকেতনে প্রায় সবাই
বড়দের ‘দাদা’ ও ‘তুমি’ বলে ডাকতে অভ্যস্ত।
“আমি তো আমাগো দ্যাশ থেইকাই
বিএ পাস করছি। অহন ভাবতেছি আপনাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে ভর্ত্তি হইয়া গান
নিয়া পড়ি। একখান কথা কন তো! এই
বিভাগে ভর্ত্তি হইতে গেলে কি কাওরে ধরনের ব্যাপার আছে? আমার কিন্তু এক্কেবারেই কুন
খুঁটি নাই”।
“আসলে এ ব্যাপারে আমার
কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই।
তবে আমার মনে হয় গানের উপর ভাল দখল থাকলে সুযোগ না
পাওয়ার কোন কারণ নেই। তাহলে আপনি নিশ্চয়ই গান জানেন?”
“হ, জানিতো। দশ বছর বয়স
থেইকাই দুই জন আপার লগে গান শিখছি। তারাই কইছে আমারে বিশ্বভারতীতে ভর্ত্তি হইয়া
গান শিখতে। কিন্তু আমাগো তো কুন পরিচিতি নাই”। সবনম জলির গলায় একরাশ হতাশা ঝরে পড়ে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে
শুভম বলে, “ না, না তা কেন হবে। আপনার তো হয়ে
যেতেই পারে। তাছাড়া গান নিয়েই যদি পড়তে হয় তাহলে শান্তিনিকেতনেই যে পড়তে হবে তার কোন মানে নেই। রবীন্দ্রভারতীতেও
সব গুণিজনেরা
গান শেখান। আপনি সেখানেও চেষ্টা করতে পারেন”।
“ঠিক আছে। দেখি কোথায়
চান্স পাই। তবে একদিন কিন্তু নিজের বাড়ি
মনে কইরা আইবেন। অনেকের লগেই আলাপ হইব”।
(চার)
শুভম কুন্ডু এবং সবনম জলি। দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত। একজনের দীর্ঘদিনের প্রয়াসের প্রায় অন্তিম লগ্ন। আর একজনের নতুন জীবনে প্রবেশের জন্য তৎপরতা। কখনও কোন অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলেই শুভম ভেবেছে এ নিশ্চয়ই জলির ফোন। কিন্তু তা না হলে সামান্য দুঃখ পাওয়া এবং পরমুহূর্তে তা আবার ভুলে যাওয়া।
বেশ কয়েক মাস পরে হঠাৎ একদিন ঘন ঘোর বর্ষার দুপুরে জলির ফোন আসে। শুভমের ঘরের জানলা খোলা ছিল। জানলার নীচেই কচু গাছের ঝোপ। সেখান থেকে ব্যাঙেদের একটানা ডাক ভেসে আসছে। সেই সাথে দরজার উপরে দেওয়া টিনের শেডে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। এ সময় শান্তিনিকেতনে থাকলে বোঝা যায় প্রকৃতি কত ঝকঝকে ও সুন্দর। শুভম ফোনটা হাতে নিয়ে বলে, “হ্যালো। শুভম বলছি”।
“আমি জলি কইতেছি। আমি তো
এক্কেবারে আপনাগো চত্বরে আইয়া পড়ছি। একবার কি আপনার লগে দেখা করা যায়? হাতে সময়
থাইকলে একবার কালোদার দুকানে আইয়া পড়েন”।
শুভম জলির কথা শুনে খুব
খুশি হয়ে বলে, “শুভ
খবরটা দিতে এত দিন লাগল! ভালই হয়েছে। আপনি
তাহলে শান্তিনিকেতনেই চান্স পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও আমার এখন যাওয়া হবেনা!”
“ক্যান, শরীর ঠিক নাই
বুঝি?” জলির গলায় উদ্বেগ ধরা পড়ে।
“না, না তা ঠিকই আছে। আসলে আমি তো
এখন বাড়িতে রয়েছি”।
“আরে, ও দ্যাশে গেলেন
কবে?” জলির গলা থেকে একরাশ আনন্দ ঝরে পড়ে।
শুভম জলির কথা শুনে ভীষণ
অবাক হয়। জলি এইমাত্র বলল ‘ও দ্যাশ’ অথচ এই কিছুদিন আগেও যে দেশটা ছিল তার জন্মভূমি, যেখানে আজও তার নাড়ি পোঁতা
আছে! আর আজ
কিনা তা অন্য দেশ হয়ে গেল! এ কি করে সম্ভব! এত তাড়াতাড়ি নিজের দেশকে ‘ও দ্যাশ’
বলতে কি তার একবারও কুন্ঠা বোধ হল না! মানুষ কি এত তাড়াতাড়ি নিজের দেশকে ভুলে যেতে
পারে! কিন্তু কই সে তো পারছে না! যদিও সে কোনদিনও চাইবে না যে ভারতটা তার কাছে
বিদেশ হয়ে যাক।
“কই কলেন না তো ও দ্যাশে
কবে গেলেন?” জলির যেন তর সইছে না।
“হ্যাঁ, মানে এই দিন
পনের হল”।
“তা ক্যামন দ্যাখতেছেন?”
“ঠিক বুঝলাম না কি জানতে
চাইছেন”।
“আরে আমি আমাগো বাড়ি
খানার কথা, আমাগো গেরামের কথা, মানুষজনের কথা জিগাই”।
“ও, তাই বলুন। ভাল, বেশ
ভাল। সব থেকে ভাল লেগেছে বাড়ির খোলা ছাদটা। ওটা ঘরের সাথে থাকায় অসাধারণ লাগছে। আর
ছাদে দাঁড়িয়ে নারকেল গাছের ছোট ছোট ডাবগুলোকে আদর করতে খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু-
“ক্যান, থামলেন ক্যান।
আমি চোক্ষের সামনে সব দ্যাখতে পাইতেছি। আপনি কইয়া যান। আমার কালি-কালুয়ার লগে
আপনার দ্যাখা হইছে?”
“না। বাড়িতে তো কুকুর-বেড়াল
তেমন কিছু দেখলাম না!” শুভম অবাক হয়ে বলে।
“আরে অরা কুত্তা–বিল্লি
হইতে যাবে ক্যান! অরা তো আমার পোষ্য। ঐ গাছেই থাকে”।
“সেকি! আপনার পোষ্য আর
সে কিনা থাকে গাছে! এ আবার কেমন পোষ্য! তবে একবার আন্দামানের নীল দ্বীপে একজনের
বাড়িতে দেখেছিলাম যে বাড়ির সব মুরগিগুলো সারাদিন যত্র তত্র চরে বেড়াচ্ছে কিন্তু
রাত হতেই ওরা সব কটা মিলে গাছে গিয়ে উঠে বসে। গাছেই রাত কাটায়! ব্যাপারটা আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিল”।
“কিন্তু আপনি গাছের আসে
পাশে দু’খান কাউয়ারে দ্যাখেন নাই?”
“সে আবার কী?”
“আচ্ছা জ্বালা হইল তো। আপনি
কি কাউয়া বোঝেন না? কোনদিন দ্যাখেন নাই? আরে বাবা কাক দ্যাখছেন তো, নাকি তাও
দ্যাখেন নাই!”
“সে আবার দেখব না কেন! কাক তো জন্ম থেকেই দেখে আসছি। কিন্তু আমাদের দেশের কাক যে আপনাদের দেশে গিয়ে ‘কাউয়া’ হয়ে গেছে তা জানা ছিল না। আর আপনার কাউয়াকে শুধু দেখেছি বললে ভুল বলা হবে। ওর ঠোক্করও খেয়েছি। অবশ্য দোষটা আমারই। ওর বাসায় উঁকি মারতে গিয়েছিলাম। আর এমনই ঠোঁটের জোর যে এখনও বেশ ব্যথা করছে”।
শুভমের কথা শুনে একচোট হেসে নিয়ে জলি বলে, “এক্কেবারে ভয় পাইবেন না। আসলে অগো কুন দোষ নাই। অচেনা মাইনষেরে দ্যাখছে তো, তাই অরাও ভয় পাইয়া গ্যাছে। আপনারে চিইনা গেলে অরা আর কিছু করবে না। আপনি কি উপরের ঘরখানাতেই আছেন?”
“হ্যাঁ”।
“জানেন ওই ঘরখানা আমার
ছিল। জোছনা রাইতে সামনের ছাদে বইয়া গান গাইতাম। মনখান ভইরা যাইত”।
“আমি তো আর গান গাইতে
পারিনা। তবু শুধু মাত্র ঘন অন্ধকার আর জোছনা দেখার জন্য ঐ ঘরটা নিয়েছি”।
“ঘরের দেয়ালগুলান ভাল
কইরা ঝাইড়া নেবেন। অনেকদিন হইল তো তাই দেয়ালের রং চইটা গ্যাছে”।
“বাবা সারা বাড়িটাই
চুনকাম করে রঙ করে নিয়েছেন। আমার ঘরের দেয়ালে তিনটি রঙ। আর নীচের ঘরে দুটো করে রং।
এখন খুব সুন্দর লাগছে”।
“একখান কথা বলি?”
“হ্যাঁ, বলুন!”
“কইকি সব স্মৃতিই তো
মুইছা ফ্যালাইছেন। অহন বুঝতে পারতেছি ঐ বাড়িখান ছাড়া আর কুন স্মৃতিই বাঁইচা নাই।
সব কিছুই সাফ হইয়া গ্যাছে। আমাগো পশ্চিমের ঘরের এক কোণে একখান জায়নামাজ আছিল।
আম্মি ভুল কইরা রাইখা আইসে। চারদিকে শাড়ির পাড় দিয়া সিলাই করা। তাই খুব মজবুত ছিল।
তা ঐখান আবর্জনা ভাইবা ফেইলা দিছেন, না রাখছেন?”
“আপনি ঠিক কী জানতে
চাইছেন বলুন তো। আগে কখনও ‘জায়নামাজ’ বলে কিছু শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না !”
“শোনেন নাই!” জলি এক
মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলে, “আপনি হিন্দু হইয়া শুইনবেন ক্যামনে। অবশ্য
মুসলমান হইয়া সব্বাই ‘জায়নামাজ’-এর মানে জানে না! এটা হইল গিয়া নমাজ পড়ার মাদুর। ঘরের
কোণায় দ্যাখেন নাই?”
এবার শুভমের মনে পড়ে মা
একটা লালপাড় দিয়ে চারদিকে সেলাই করা মাদুর কাগজে মুড়িয়ে সিলিংএ তুলে রেখেছে।
সত্যিই মাদুরটা দেখতে ভারি সুন্দর। শুভম তাড়াতাড়ি বলে, “আপনি কি একটা সুন্দর
মাদুরের কথা জানতে চাইছেন? ওটা আমরা ফেলিনি। মা যত্ন করে তুলে রেখেছে। আর ঐ ঘরের
দেয়ালে ঝোলান ছিল কাবা মসজিদের একটা বাঁধানো ছবি। সেটাও তুলে রাখা হয়েছে”।
জলির গলায় এক রাশ
উচ্ছ্বাস ঝনঝন করে বেজে ওঠে। “ওসব রাইখা ভাল করছেন। ওসব ফ্যালতে নাই। কোনদিন আপনাগো
দ্যাশে গেলে ঠিকই নিয়া আসুম। তবে আপনাগো বাড়ির কিছু স্মৃতি আমরাও ফেলি নাই।“
“কি জিনিস বলুন তো!
শুনেছিলাম মা নাকি ভাঙা কুলোটা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে”।
জলি খিলখিল করে হেসে
ওঠে। ঐ হাসির রেশ ধরেই বলে, “মাসীমা ঠিক কামই করছেন। ভাঙা কুলাখানও অসময়ে কামে লাগে। পুরুষ মাইনষেরা তা
বোঝে না। তবে সব কি আর সাথে নিয়া যাওয়া যায়! কিছু না কিছু তো পইড়া থাকবই। অন্তত
ভিটাখানতো থাকবই। তাছাড়া আগে যারা অবাঞ্ছিত ছিল তাগো কথাও বারবার মনে পড়ে। যেমন আপনার
ঘরের দেয়ালে যে ক্যালেন্ডারখান। বারো পাতায় বারোখান
ঠাকুরের ছবি! সবগুলানরে আগে আমি দেখি নাই! শুইনছিলাম আপনাগো নাকি অগুন্তি দেবতা আছে!
আপনি কি সবগুলানরে দ্যাখছেন! হকলের নাম জানেন কি?”
এবার জলির কথায় শুভম
হাসতে হাসতে বলে, “আমি তো
কোন ছাড়,বড় বড় পন্ডিতেরাও সব দেবতাদের নাম জানেন না। সেই সাথে এদের আকৃতি কেমন তাও
জানা নেই। আসলে যে সব দেবতারা ঘরে ঘরে পূজা পেয়ে থাকেন আমরা শুধু তাদেরই নাম জানি
এবং দেখতে পাই। তবে ঐ ক্যালেন্ডারটাতো আপনার কোন কাজে লাগবে না। বরং রোজ সকালে
হিন্দুদের অত দেবতার ছবি দেখলে তো আল্লা আপনাকে দোজখে পাঠাবেন। সেটা ভেবে দেখেছেন
কি?”
“সেটা তো আল্লার মর্জি।
তবে হিন্দুদের দেবতা দেখলে আল্লা নিশ্চয়ই নারাজ হন না। আমি মুসলমান হইয়া তো আর
দেবতা পূজা করতেছি না। তাইলে দ্যাখনে আর দোষটা কোথায়!”
শুভম একটু চুপ করে থেকে
বলে, “তা অবশ্য ঠিক। দেখতে আর দোষ কোথায়। তবে হ্যাঁ, ঐ ক্যালেন্ডারের প্রত্যেকটি ছবিই খুব সুন্দর। এছাড়া আর কোন মূল্যবান জিনিস আছে কি যা আমরা ফেলে এসেছি?”
“আছে তো বটেই। ঐ
জিনিসখানরে নিয়া যাওয়ার উপায় ছিল না বইলাই বোধহয় রাইখা গ্যাছেন। অথচ বাংলাদ্যাশের
হিন্দুগোর বাড়িতে আমি অরে দ্যাখছি। তারা রোজ সিনান কইরা তাতে পানি দেয় আর রাইতে
দীপ জ্বালে”।
“কিসের কথা বলছেন বলুন
তো!” শুভম অবাক হয়ে জানতে চায়।
“ক্যান, বুঝলেন না! আমি
তো আপনাগো আঙিনার কোণায় যে তুলসী গাছ সমেত বেদীখান আছে তার কথা কই। অনেকে কইছিল অর গোড়া সমেত উপড়াইয়া ফ্যালতে। আমরা তা করি নাই।
মুসলমানের বাড়িতে তুলসী গাছ থাকে না ঠিক। কিন্তু
আম্মিজানের মতে ঐ গাছে তো হিন্দু-মুসলমান লিখা নাই। বরং ঐ গাছের পাতা শরীরের পক্ষে
খুব উপকারি। আমরা তারে জিয়ান রাখার জন্যি গোড়ায় রোজ পানি দেই। তবে সন্ধ্যা বাতি
দেই না। অহন তো অনেকেই তাগো পোলাপানের
জন্যি তুলসী গাছের পাতা নিয়া যায়। কামখান ঠিক করি নাই?”
“হ্যাঁ, আপনারা ভাল কাজই
করেছেন। এতে পাড়ার কত লোকের উপকার হচ্ছে বলুন তো!”
“অহন তো তাই দ্যাখতেছি। আপনারে একখান কথা কই। আপনি কি
আমাগো কাউয়ারে এদিক পানে আইতে দ্যাখেন?”
শুভম হাসতে হাসতে বলে, “এটা বেশ মজার কথা বললেন বটে! ওরা কি আমাকে বলে যাচ্ছে যে
কোথায় যাচ্ছে! তাছাড়া ওদের আদিগন্ত বিস্তৃত গতিবিধি। এ মুহূর্তে এদেশে, তো পর
মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে! কি সুন্দর চলাচল। তবে শুধু ওরাই নয়। অন্য পাখিরাও রয়েছে।
“না, না। অন্য পক্ষীরা বেশি দূরে যায়
না। অরা বাসার নিকটেই ঘুরঘুর করে। তবে কাউয়া আর বগারা কোন সীমানা মানে না। তাই তো
আমার কাউয়ারে খুব ভাল লাগে”।
“ছিঃ! আর কোন পাখি পেলেন
না! শেষে কিনা কাককে ভাল লাগল!”
“ক্যান, কাউয়া মন্দ কিসে!
তবে হ্যাঁ, অরা একটু মন্দ জিনিস খায় বটে। অবশ্য
তাতে আমাগো উপকারই হয়। অদের গায়ের রঙ আর গলার আওয়াজ শুইনা অদের বিচার করবেন না।
অরা যে এক গেরাম থেকি আরেক গেরামে আবার এক দ্যাশ থেকি অন্য দ্যাশে ভাইসা যায় তাতেই
আমার খুব মজা হয়। আপনার ভাল লাগে না?”
“তাহলে তো একটা পাতি বা
দাঁড় কাক পুষলেই পারেন। ওরা কিন্তু খুব চতুর”। শুভম হাসে ।
“মাইনষে কুনদিন কাঊয়া
পুষে না। তবে আদর কইরা অগো রোজ ভাত
খাওয়ায়”।
“আপনি সত্যজিৎ রায়ের
প্রফেসর শংকু পড়েছেন? তাতে
বিজ্ঞানী শংকু একটা বুদ্ধিমান কাক পুষতেন। তার নাম
ছিল ‘করভাস’। তাহলে আপনার কাক পুষতে অসুবিধা কোথায়!”
জলি প্রফেসর শুঙ্কুর নাম
শোনেনি। তাই এ প্রসংগে আর কথা না বাড়িয়ে বলে, “ছাড়ান দ্যান ওসব কথা। আপনি এদিক পানে কবে
আইবেন কন। তহন দ্যাখা করুম”।
“এবার বসন্ত উৎসবে
যাওয়ার ইচ্ছে আছে। তবে মাত্র দু’দিনের জন্য”।
“ক্যান, মাত্র দু’দিন
ক্যান!”
“দিল্লিতে একটা
ইন্টারভিউ আছে। তাই বুড়ি ছোঁয়ার মতোই যাব”।
“ঠিক আছে। তাইলে তাই
আসেন। এবার বসন্ত উৎসবে কিন্তু আমার গান আছে। শুইনা আমার লগে দ্যাখা কইরা তারপর যাবেন”।
“বাঃ! এতো দারুণ খবর! অগ্রিম শুভেচ্ছা রইল। গেলে অবশ্যই দেখা হবে”।
(পাঁচ)
শুভম প্রথমে ভেবেছিল সে একেবারে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট ধরে সোজা দিল্লি চলে যাবে। কিন্তু মনের মধ্যে যে অদেখা-অচেনা মুখাবয়বটা বারবার তাকে এক রাতের জন্য হলেও শান্তিনিকেতনে থেকে যেতে তাড়িত করছিল, তাকে সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারল না। যার গলার স্বরে এমন এক মাদকতা রয়েছে, সে সুন্দর না হয়ে যায় না! তাই সবনম জলিকে দেখা এবং আলাপ করার জন্য শুভম এক রাত শান্তিনিকেতনে থেকে যাবে ঠিক করল।
আজ শান্তিনিকতনের কোন
রাস্তা ঘাট বা মাঠ নিজেদের রঙকে ধরে রাখতে পারেনি। সবাই আবীরের বিভিন্ন রঙে রেঙে উঠেছে । আকাশে বাতাসেও যেন আবীরের ছোঁয়া! গাছের সাদা ফুলগুলো আজ
নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। শুভমের কাছে এসব নতুন নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই তো এসব
দেখে আসছে। তবু আজকের দিনটি তার কাছে বহু প্রতীক্ষিত দিন। এ যেন কিছুতেই পুরনো হয় না।
বিকালে শুভম একবার জলিকে ফোন করেছিল। সুইচ অফ ছিল। ঘন্টা খানেক পরে সে নিজে রিং ব্যাক করে বলে যে, সে এখন রিহার্সালে ব্যস্ত। অনুষ্ঠানে দেখা হবে।
সন্ধ্যা থেকেই শান্তিনিকেতনের আকাশ-বাতাস রবীন্দ্র সংগীতে
ছেয়ে রয়েছে। কারোর মুখেই অন্য কোন গান নেই। যারা হাঁটতে হাঁটতে গুন গুন করছে , তারা
রবীন্দ্র সংগীতই গাইছে। মাঠে থোকা থোকা জটলায়, গাছের নীচে হেলান দেওয়া জটলায়, সবাই
গানেই মগ্ন! তাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচা! এ এক অদ্ভুত মাদকতা, এক অমোঘ টান! শুভম এভাবেই সবার সাথে ভাসতে ভাসতে একবার
অনুষ্ঠান দেখে এসেছে। তখনও জলির গান হয়নি। কখন হবে তা জানা নেই। এ এক অসহ্য সময়!
শুভম এবার রতন পল্লীতে কালোদার দোকানের উদ্দেশে রওনা দেয়। এখান থেকে সবই শোনা
যাচ্ছে। শুভম চা আর খাবারের অর্ডার দিয়ে কান খাড়া করে থাকে।
শুভম সবে মাত্র খেতে
যাবে এমন সময় বাতাসে ভেসে এল যে এবার সবনম জলি গান গাইবে। শুভম তাড়াতাড়ি হাত
চালায়। ওদিকে জলির গলা থেকে যেন মধু ঝরে পড়ছে। একেবারে তৈরি গলা। শুভম সবটা না
খেয়ে প্লেটটা সরিয়ে রাখে এবং প্লেটে চা ঢেলে বার দুয়েক সুরুৎ সুরুৎ করে যতটুকু চা
খাওয়া যায় খেয়ে প্রায় উর্দ্ধশ্বাসে মঞ্চের দিকে ছুটতে থাকে। আজ সবনম জলিকে বলতেই
হবে যে এর মধ্যেই তার গায়কীতে শান্তিনিকেতনের একটা ছাপ পড়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে
শুনলেই বলে দেওয়া যায় যে এই গায়িকা শান্তিনিকেতনের ছাত্রী।
মাঠের মধ্যে ঢুকতেই সবনম জলির গান শেষ হয়ে গেল! শুভম কিছুটা অভদ্রের মতো ভিড় ঠেলে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ততক্ষণে মঞ্চে অন্য একজন উঠে গাইতে শুরু করেছেন। শুভম তাড়াতাড়ি জলিকে ফোন করে। ফোন ব্যস্ত। শুভম আবার বার দুয়েক ফোন করে শেষে যখন হতাশ হয়ে পড়ে ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে ওঠে। জলি একটু রাগত গলায় বলে, “আপনি ক্যামন মানুষ কন তো! ফোনখানরে পর্যন্ত আটকাইয়া রাখছেন! কখন থেকি ট্রাই করতেছি অথচ আপনার নাগাল পাই না। কার লগে অত কথা কইতেছিলেন! মায়ের লগে কি?”
শুভম বলতে পারে না যে সে
এতক্ষণ তাকেই ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কোন মতে বলে, “ঠিক আছে আপনি এখুনি মঞ্চের
পেছনে চলে আসুন। আপনি কী রঙের শাড়ি পরেছেন বলুন তো?”
“ জি, বাসন্তী রঙের”।
“আর খোঁপায় নিশ্চয়ই পলাশ
ফুলের মালা পরেছেন?”
“ঠিকই ধরছেন। তবে শুধু
খোঁপায় দেই নাই। গলায় পলাশ ফুলের মালাও পরছি”।
“ঠিক আছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। দেখি আপনাকে চিনতে পারি কিনা!”
“কিন্তু আমি অহন যাই
ক্যামনে? আমি
তো গাড়িতে”।
“গাড়িতে মানে! সামান্য
দূরেই তো হস্টেল। সেখান থেকে কেউ গাড়িতে আসে নাকি!”
“আরে তা হইব ক্যান! আমি
তো অহন বাড়ি ফিরতেছি। কাল আমার ফুফুর মাইয়ার সাদি। তাই বাড়ি ফিরতেছি। আপনি বরং কাল
একবার কষ্ট কইরা আমাগো বাড়ি আহেন। নিজের জন্ম ভিটাখানরে দুই চক্ষু মেইলা দেখেন।
একই আছে, না
বদলাইছে তা নিজের চক্ষেই দেইখা যাবেন। আমরা আপনাগো ভিটারে কষ্ট দিই নাই”।
জলি হয়তো আরো অনেক কিছু বলল
কিন্তু শুভম তা শুনতে পেল না। সে শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলল, “আমি কাল সকালের ফ্লাইটে দিল্লি চলে যাচ্ছি
জলি। হয়তো আর কোনদিনই আমাদের দেখা হবে না!”
জলিও বড় অস্পষ্ট স্বরে
বলল, “তা
কখনও হয় নাকি! আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন আমাগো দ্যাখা হইবই। তাছাড়া কাকের মুখে
খবর পাঠাইলেই আমি পাইয়া যাব”।
শুভম হঠাৎ চমকে ওঠে! সেকি!
ও কাউয়া না বলে কাক বলল কেন! তাই তাড়াতাড়ি শুভম বলল, “আরে আপনি কাউয়াকে ‘কাক’ বললেন কেন?”
জলি হাল্কা হেসে বলল, “দুটাই যহন একই তহন কাকই কমু। বরং আমাগো ‘কাউয়া’ আপনাগো দ্যাশেই থাউক। আমার পষ্যিগুলানরে
যত্ন কইরা রাইখবেন। আমি জানি আমাগো কাউয়ারা সীমানা পার হইয়াই কাক হইয়া যায়। তাই
রোজ বিকাল বেলায় ছাদে উইঠা যহন আপনাগো আম গাছটায় লক্ষ্য করি, তহন বেবাক কাকেরা ঐ
গাছে বইয়া জিরান নেয়। আলাদা কইরা এদেশ-ওদেশের
কাকরে আর চিনতে পারি না। সব একাকার হইয়া যায়! তা না হইলে আমি জিগাইতাম অরা আমাগো
গেরামটারে চেনে কিনা!” জলি একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, “আমাগো
দ্যাশে আইলে আপনার ভিটায় আইবেন। দাওয়াত রইল। ভুলবেন না য্যান!”
শুভম বোধহয় আর জলির শেষ কথাগুলো শুনতে পায় না। রাত বাড়তে থাকে। অনুষ্ঠানের মাঠটা ক্রমশই একা হয়ে যায়! চারদিকের আলোগুলো নিভে গেলে মাঠটা একাই ঘন জোছনায় ভাসতে থাকে। অথচ আজ এমন জোছনা রাতে যখন একে একে সবাই এই আম্রকুঞ্জ থেকে নিজের নিজের বাড়ি ফিরে গেছে, তখন শুভম তার ক্লান্ত শরীর আর মনটাকে নিয়ে নিজের আস্তানার দিকে পা বাড়ায়। আর ঠিক তখনই গাছের নীচের ঝুপ ঝুপে জোছনার মধ্যে কোন এক ডাল থেকে একটা ভীরু কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে। শুভম হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সে বোঝার চেষ্টা করে এটা ‘কাক’ না ‘কাউয়া’! কিন্তু সে পার্থক্য করতে পারে না। সত্যিই সব একাকার হয়ে যায়। শুভম হাঁটতে হাঁটতে ভাবে বাংলাদেশে তার ঘরটাও নির্ঘাৎ আজ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে! সেখানেও কি জলির পোষ্যগুলো হঠাৎ এভাবেই ডেকে উঠেছে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন