কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১১৮ / একাদশ বর্ষ : অষ্টম সংখ্যা





‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের এবছরের অষ্টম সংখ্যা প্রকাশিত হবার নির্ধারিত সময় ছিল গত অক্টোবর মাস। কিন্তু আমি অপ্রত্যাশিতভাবে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম এবং বেশ কিছুদিন সেখানে আমাকে থাকতে হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেও আরও কিছুদিন ‘বেড
 রেস্ট’এ ছিলাম এবং এই দিনগুলোয় সাহিত্য সম্পর্কিত কোনো কাজই করার অবস্থায় ছিলাম না। আর তাই গত অক্টোবর মাসে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর কোনো সংখ্যা প্রকাশ করতে পারিনি। এখন আমি ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি এবং আশা করছি আর কোনো বিপত্তি না ঘটলে পরবর্তী সংখ্যাগুলো যথাসময়ে প্রকাশ করতে অসুবিধে হবে না।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রচ্ছদ-পৃষ্ঠায় ডানদিকে ওপরে একটি বক্সে আমাদের উপদেষ্টা মন্ডলীর ব্যক্তিদের নাম উল্লেখিত থাকে, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। এই চারজন বাংলাসাহিত্য জগতে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁরা হলেন স্বদেশ সেন, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী ও বারীন ঘোষাল। ‘কালিমাটি অনলাইন’এর প্রথম সংখ্যা থেকে উপদেষ্টা মন্ডলীর ব্যক্তিদের নাম প্রকাশিত হয়ে আসছে। আপনারা জানেন, বিগত প্রায় বারো বছর ধরে আমাদের ব্লগজিন প্রায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে প্রকাশিত ১১৮টি সংখ্যায় তাঁদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই তাঁদের একে একে চলে যেতে হয়েছে আমাদের ছেড়ে। কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন কবি স্বদেশ সেন। তারপর কবি ও সাহিত্যিক সমীর রায়চৌধুরী ও বারীন ঘোষাল। তাঁরা প্রয়াত হবার পরেও আমরা তাঁদের নাম উপদেষ্টা মন্ডলী থেকে সরাইনি। এই তিন সাহিত্য ব্যক্তিত্বের প্রয়াণের পরও আমাদের মধ্যে ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। ‘কালিমাটি অনলাইনে’র প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই প্রকাশিত হচ্ছিল তাঁর লেখা। এই সংখ্যাতেও তাঁর লেখা  পাঠানোর কথা ছিল। আমি গত ২৫ অক্টোবর সকাল ১১টা ১৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, “নভেম্বর সংখ্যা কালিমাটি  অনলাইনের জন্য অবিলম্বে লেখা পাঠিয়ে দিন মলয়দা”। মেসেজ পাঠানোর ঠিক দুমিনিট পরেই ১১টা ২১ মিনিটে  আমার মেসেজের উত্তরে একটা ভিডিও ক্লিপ আসে। দেখি, মলয়দা একটা নার্সিংহোম অথবা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। নাকে অক্সিজেন-নল লাগানো। চোখ সামান্য খোলা। ভিডিও দেখে অবাক হলেও খুব একটা চিন্তিত হলাম না, কেননা আর মাত্র তিনদিন পরে যিনি ৮৪ বছর অতিক্রম করে ৮৫ বছরে পদার্পণ করতে চলেছেন, বয়সের কারণে তাঁর কিছু শারীরিক সমস্যা হতেই পারে, বাড়াবাড়ি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর সকালে সাহিত্যিক রাহুল দাশগুপ্ত আমাকে ফোন করে জানালো, মলয়দা আর নেই। এ যে অবিশ্বাস্য খবর! যে মলয়দা গতকাল আমার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পড়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা জানাতে কারও সাহায্যে ভিডিও করে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তিনি এভাবে চলে যেতে পারেন! ৮৪ বছর বয়সের এক টগবগে দুঃসাহসিক যুবকের এভাবে চলে যাওয়া কি মানায়!

এখন ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের উপদেষ্টা মন্ডলীর চারজনই আর আমাদের মধ্যে নেই, মানে শারীরিকভাবে নেই। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা অনুভব করছি, তাঁরা আমাদের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছেন আমাদের অস্তিত্বে। তাঁদের সাহিত্যভাবনা, বিশ্বভাবনা, সাহিত্যগত আঙ্গিক-শৈলী-ভাষার ভাবনা আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে দীর্ঘদিন জারিত করেছে, নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে, শিক্ষিত করেছে, ঋদ্ধ করেছে, সাবলম্বী হতে সাহস যুগিয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে আমরা বিশ্বাস করি, তাঁদের যাবতীয় সৃজনকর্ম বাংলাসাহিত্য ধারার গতিমুখ বদলে দিয়ে নতুন নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছে, যা এখন বাংলাসাহিত্যের মূল ধারা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই এই চারজন বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যক্তিত্বকে।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৪

 


আজ পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালকদের নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে আমরা লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া আর আফ্রিকার পরিচালকদের নিয়ে কথা বলব। পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই যে, এই ধারাবাহিকের ৯-১০ পর্বে  আফ্রিকা নিয়ে, ২০ নম্বর পর্বে লাতিন আমেরিকা নিয়ে ও ২৫ নম্বর পর্বে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার সেখান থেকে বা আরো কিছু সংযোজন করে নিয়ে পরিচালকদের পাঁচালী। অবশ্য এটা ঠিক, যে যে পরিচালককে আমরা আজ কলমের ডগায় আনব, তাদের সিনেমা নিয়ে কোন না কোন পর্বে আলোচনা হয়ে গেছে। এবং যেহেতু লাতিন আমেরিকা নিয়ে কথা বলব, তামিল সিনেমার বিখ্যাত চিত্র সমালোচক চারু নিবেদিতা-র কথা আসবেই। ওনার বই ‘Towards a third cinema’। সেখানে উনি লাতিন আমেরিকার পাঁচজন অন্যধরনের পরিচালক নিয়ে, গ্লবার রোচা থেকে শুরু করে নেলসন পেরেরা দো স্যান্টোস অব্ধি, দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কেন এদের সিনেমা থার্ড ডাইমেনসন ধরতে পেরেছে। বিদগ্ধ চারু নিবেদিতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি যেহেতু এর আগের পর্বেই উল্লেখ করেছি যে পরিচালকদের নিয়ে আলোচনার সময় স্ট্রেট ব্যাটে খেলব, তাই ওনার বই থেকে কোন পরিচালককে বেছে নিতে পারলাম না। উৎসাহী পাঠককে বলব, বইটা পড়ুন। উনি আশির দশকের শুরুতে ফিল্ম ফেস্টিভালে লাতিন আমেরিকান ছবি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, গোটা হলে মাত্র দুজন দর্শক। আমারও মনে পড়ে গেল, নব্বইয়ের দশকের শেষে, যখন আমি যাদবপুরে মাস্টার্স করছি, গোর্কি সদনে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সিনেমাপ্রেমীর সঙ্গে ‘ইভান দ্য টেরিবল্’‌ দেখা। তো, যাই হোক, আমাদের লিস্টে আসা যাক।

১) লাতিন আমেরিকা - এলিসিও সুবিয়েলা (আর্জেন্টিনা), ফার্নান্দো মিরেলিস (ব্রাজিল), আলফোনসো কোয়ারন (মেক্সিকো), আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ (মেক্সিকো), গিলের্মো ডেল-টোরো (মেক্সিকো) এবং পাবলো ল্যারেন (চিলি)।

২) অস্ট্রেলিয়া - ফিলিপ নয়েস, পিটার অয়্যার, বাজ লারম্যান।

৩) আফ্রিকা - উসমান সামবেনে, সুলেমান সিসে, ডিব্রিল ডায়প মাম্বেতি।

এদের ভেতর উসমান সামবেনে, সুলেমান সিসে, ফার্নান্দো মিরেলিস, পাবলো ল্যারেন এবং ফিলিপ নয়েস তাদের বাস্তববাদী ও নব্য মানবতাবাদী ছবির মধ্যে দিয়ে খুব শক্তিশালী বক্তব্য রাখেন। এদের পরিচালিত যে যে ছবি আলোচনা করেছি, সেগুলো একবার তলিয়ে দেখলেই বুঝবেন। পিটার অয়্যার ও বাজ লারম্যান যে ধরনের ছবি করেন, সেগুলো ড্রামা বললে ভুল হয় না। সুবিয়েলা আদ্যান্ত সুর-রিয়েল। মাম্বেতি নন-লিনিয়ার এবং সিদ্ধান্ত দর্শকের ওপরেই ছেড়ে দেন। ডেল-টোরো দৈত্য-দানব পিশাচ এদের মোটিফ হিসেবে রেখে কাজ করতে ভালবাসেন। কোয়ারন ও আলেহান্দ্রো জটিল গল্প নিয়ে খেলা করতে ভালবাসেন, সিনেমার ক্যানভাসে প্রচুর রং নিয়ে তুলি ধরতে ভালবাসেন।

এই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলার পেছনে কারণ আছে। এদের সবাইকে নিয়ে তো আলোচনা সম্ভব নয়, তাই কয়েকজনকে মাত্র বেছে নেব। এবং আজ কিন্তু পাঠক, আমায় পক্ষপাতিত্বের জন্য ক্ষমা করবেন, এই সমস্ত পরিচালকের ভেতর থেকে আমি যে তিনজনকে বেছে নেব তারা সবাই লাতিন আমেরিকার। হয়ত এর কারণ  এটাই যে লাতিন ছবি অনবদ্য, ক্যানভাসে ফুটে ওঠা ছবির মত, বুদ্ধি দিয়ে ধরতে হয়, ভাল সিনেমাটোগ্রাফি, মোটিফের কাজ এবং গল্প বলার পদ্ধতি এরা জানে। কিন্তু এইসব ছাপিয়েও লাতিন ছবি সাহসী, প্যাশনেট এবং আমি সাহস পছন্দ করি। এই কারণেই পারাজানভ আমার হিরো, মখমলবাফ্‌ আমার হিরো। রাষ্ট্র এদের  ধুয়ে দিয়েছে, কিন্তু এঁরা সিনেমার খুঁটিতে এদের সাহসী হাত রেখে দিয়েছেন, ছাড়েননি। ভালবাসার জন্য, প্যাশনের জন্য যারা জীবনে অনেক কিছু বিসর্জন দেন কিন্তু কম্প্রোমাইজ করেন না, সেই একগুঁয়ে মানুষগুলো আমার খুব প্রিয়। সে যাইহোক, আজ আমি বেছে নেব আলফোনসো কোয়ারন, আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ এবং গিলের্মো ডেল-টোরো। প্রত্যেকেই মেক্সিকোর। এরা কি ধরনের ছবি বানান, সেটা একটু পরেই আমরা দেখব। শুরুর আগে শুধু নেরুদার এই লাইনগুলো মাথায় রাখুন, তাহলেই হবে - I crave your mouth,/ your voice, your hair/ silent and starving, I prowl/ through the streets.

আলফোনসো কোয়ারন (১৯৬১) ছাত্রজীবন থেকেই বিদ্রোহী। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, সেখানে সিনেমা বানানো নিয়ে ঝামেলার জন্য ওনাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তারপর উনি লাতিন আমেরিকা থেকে পাড়ি দেন উত্তর আমেরিকা। সেখানে ড্রামা ছবি দিয়ে হাতেখড়ি। এ লিটল প্রিন্সেস (১৯৯৫), গ্রেট এক্সপেক্টেশনস (১৯৯৮)। আবার ফেরেন লাতিনে। শুরু করেছিলেন ড্রামা দিয়ে, লাতিনে ফিরেই ওনার প্রথম সাহসী যৌন অ্যাডভেঞ্চার ছবি ‘অ্যান্ড ইয়োর মামা টু’ (২০০১)। সেখান থেকে চিল্ড্রেন অব মেন (২০০৬) পেরিয়ে গ্র্যাভিটি (২০১৩) এবং রোমা (২০১৮)। ফিল্ম বোদ্ধারা ওনাকে মূলত গ্র্যাভিটি আর রোমা, এই দুটো ছবির জন্যই চেনেন। আবশ্য হাল্কাচ্ছলে বলতেই হয়, ওনার মা লক্ষ্মীর ভান্ডার কিন্তু অন্য এক ছবি খুলে দিয়েছিল – হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অব আজকাবান (২০০৪)।

কোয়ারনের ক্যামেরার কাজ নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় লং শট, ওয়াইড অ্যাঙ্গল ক্যামেরা এবং ডায়নামিক ক্যামেরা। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে বুঝবেন, ওনার অনেক আউটডোর শট হাতে ধরা ক্যামেরা দিয়ে নেওয়া। এবং কোয়ারনের ছবিতে মোটিফের ব্যবহার অদ্ভুতভাবে আসে। একটা উদাহরণ দিই।  সবাই বলে গ্র্যাভিটি কল্প-বিজ্ঞানের ছবি। আমি নিজে ফলিত বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক-বৈজ্ঞানিক হয়েও সবিনয়ে বলছি, এই ছবি প্রাথমিকভাবে একটা মনস্তাত্তিক ড্রামা। কি করে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা যায়, সেই নিয়ে। মহাকাশের মধ্যে ধবংসস্তূপ আর পাথর দিয়ে তৈরি মোটিফ। মূলত প্রতিকূলতা। মার্ফি’র সূত্র – anything that can go wrong, will go wrong. অনিশ্চয়তা তৈরির জন্য সাবজেক্টিভ আর অবজেক্টিভ ধারণাগুলো উল্টে পাল্টে দেওয়া, পৃথিবীর উষ্ণ নীল আর মহাকাশের ঘন কালো – এই দুয়ের  মিশেল। এবার আসুন ওনার অন্য ছবি রোমা-য়। সাদা কালো এই ছবি নিয়ে আমি ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। তবুও বলি। এর ক্যামেরার কাজ দেখুন। মনে হবে জীবনীশক্তিতে ভরপুর। আবার ক্যামেরা হঠাৎ ফ্রিজ করিয়ে দিয়ে পরিচালক জীবনের স্মৃতির কিছু ফ্রেম যেন বাঁধিয়ে দিলেন। শুধু ভাল গল্প বা ড্রামা বা ইমোশন নয়, মনে হবে ক্যামেরাও যেন ঘুরে ঘুরে জীবন দেখাচ্ছে। এখানেই কোয়ারনের বিশেষত্ব। ক্যামেরাও সজীব, প্রাণবন্ত, আমাদের মতই গতিশীল।

আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু (১৯৬৩) প্রথম তিনটে ছবি নিয়ে ডেথ ট্রিলজি বানিয়েছিলেন – লাভ ইজ আ বিচ, 21 গ্রামস, ব্যাবেল। যেবার লাতিন আমেরিকা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, বলেছিলাম। সেখান থেকে ওনার উত্থান বিউটিফুল (২০১০), বার্ডম্যান (২০১৪) ও রেভেনান্ট (২০১৫) অব্ধি। বাকিগুলো ভুলে গেলেও, শুধুমাত্র বার্ডম্যান সিনেমার জন্য ওনাকে স্মৃতির মনিকোঠায় রাখতেই হবে।

এক বর্ষীয়ান অভিনেতা যখন ব্রডওয়ে থিয়েটারে ‘what we talk about when we talk about love’-র নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করার মধ্যে দিয়ে নিজের কেরিয়ার পুনরুদ্ধার করতে চান, করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ধাক্কা খান, কিন্তু হাল ছাড়েন না, সেই নিয়ে বার্ডম্যান। দু’ঘন্টার সিনেমা। এই ছবি ন’খানা আলাদা বিভাগে অস্কারের নমিনেশন পেয়েছিল। বিভিন্ন দিক থেকেই একে সেরা ছবি বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার সবথেকে ভাল লেগেছে ওপেন এন্ডেড শেষ। যা থেকে দর্শক নিজের মত সাজিয়ে নিতে পারে, নিজের মত ব্যাখ্যা করে নিতে পারে। সেটা আলেহান্দ্রো নিজেও বলেছেন –‘at the ending of the film, it can be interpreted as many ways as there are seats in the theatre’। একটা বিভ্রান্তি, এক বিক্ষিপ্ত ক্যাওস, যা সারা সিনেমা জুড়ে। সেটাই এই ছবির ভারকেন্দ্র। ফলে সিনেমা কখনো বাস্তব ট্র্যাকে, কখনো সুররিয়েল, কখনো ম্যাজিক-রিয়েলিজম। অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবন আর পেশাগত জীবন মিলেমিশে যাচ্ছে। বাবা-মেয়ে, যে দুজন ঐ নাটকের সহ-লেখক, যেভাবে কথা বলছে এবং তাদের অনেকটা একরকম অভিজ্ঞতা তুলে আনছে, পরিচালক দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন, কিন্তু সেটাও বিক্ষিপ্ত। আমার মনে হয়, ভুল হবে না যদি একটা  রেখা আঁকি ফেলিনির ‘8-1/2’ এবং আলেহান্দ্রোর বার্ডম্যানের ভেতর। দুটোই শিল্পীর যন্ত্রণার ক্যানভাস নিয়ে  তৈরি। কিন্তু বার্ডম্যানকে একটু এগিয়ে রাখতে হবে যেহেতু এখানে ক্যানভাসটা জটিল। শিল্পীর স্বপ্ন, উড়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ভাঙা, প্রশংসা, হতাশা, আক্রোশ, এবং পুরটাই বিক্ষিপ্ত। ভাবুন, এক শিল্পীকে ফলো করে ক্যামেরা স্টেজের পেছন দিক থেকে দৌড়ে নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায়, আবার একদৌড়ে স্টেজের পেছনে। অদ্ভুত। পাঠককে বলব, আলেহান্দ্রোর আগের ছবিগুলোও মনোযোগ দিয়ে দেখতে। এই যে ক্যামেরার অস্থিরতা এবং এক বিভ্রান্তি থেকে ছবির ওপেন এন্ডেড হয়ে যাওয়া, এটাই আলেহান্দ্রো। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়।

গিলের্মো ডেল-টোরো (১৯৬৪)–র ফেভারিট বিষয় হল রূপকথা ও ভয়। শুরু করেছিলেন ক্রোনোস (১৯৯৩) দিয়ে, তারপর মিমিক (১৯৯৭), হেলবয় (২০০৪), প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ (২০০৬) –এর মত অদ্ভুত ছবি, প্যাসিফিক রিম (২০১৩), দ্য শেপ অব ওয়াটার (২০১৭) হয়ে পিনোক্কিও (২০২২) অব্ধি। ওনার দৈত্য দানবের প্রতি অবসেশন এতটাই যে তারাই প্রতি ছবিতে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। তাদের কিছু একটা দিয়েই মোটিফ তৈরি হয়। এবং খুব ভাল করে খেয়াল করে দেখবেন, দৈত্যরা সমাজের কোন না কোন এক দিক তুলে ধরে। ওনার স্প্যানিশ ছবি প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ নিয়ে ৬ নম্বর পর্বে লিখেছিলাম। আজ শেপ অব ওয়াটার-কে মাথায় রেখে ওনার বিষয়ে কিছু কথা।

আপনারা এটা জানেন যে শেপ অব ওয়াটার ১৩টা অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল। একটা রূপকথা বা দৈত্য-দানবের গল্প কোন পর্যায়ে গেলে এটা হতে পারে, সেটা নিশ্চয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। এবং ঐ যে একটু আগে বললাম, ডেল-টোরোর নিজের মুখে শুনুন – this movie is a movie about our problems today and about demonizing the other and about fearing or hating the other, and how that is a much more destructive position than learning to love and understand. অর্থাৎ দৈত্য দানব  ভয় অন্ধকার কালো জাদু মায়া... এগুলো সব আসলে মেটাফোর, সমাজের কিছু দিক দেখানোর জন্য। ডেল-টোরোর চুম্বকের মত গল্প বলার ধরন বা স্যালি হকিন্সের দারুন অভিনয়, এগুলো ছাড়িয়েও কিন্তু শেপ অব ওয়াটার আরেক জায়গায় অনবদ্য – প্রতি সিনের ডিটেলিং। এমনভাবে প্রতি সিন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, আপনি বুঝতেই পারবেন না এটা বাস্তব না পরাবাস্তব। আর ঠিক এই ব্যাপারটাই আমি ডেল-টোরোর সব সিনেমায় দেখেছি। শেপ অব ওয়াটার-এর গল্প নিয়ে আমি খুব একটা উৎসাহ দেখাব না, কারণ এক উভচর  প্রাণী যাকে আমাজনের জঙ্গলে দেবতা হিসেবে পূজো করা হত, তাকে ধরে এক ট্যাঙ্কে নিয়ে আসা হয়েছে এক রিসার্চ সেন্টারে, তার ওপর পড়াশোনা করার জন্য। আর তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এক বোবা মেয়ে। দ্য ব্রাইড অব ফ্যাঙ্কেনস্টাইন (১৯৩৫) থেকে শুরু করুন, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৪৬) হয়ে একদম কিং কং (১৯৭৬) অব্ধি। সেই জন্তু আর মানুষের আকর্ষণ। কিন্তু এখানে গল্প বলার ধরনটা ভিন্ন। এবং ভিন্ন  প্রেক্ষিতে। ফলে এখানে স্টিরিওটাইপ ব্যাপারটাকেই চ্যালেঞ্জ করা হল। একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল অনেক রকমের ধারা। এই চুম্বকের নাম ডেল-টোরো। তবে হ্যাঁ, উনি যেহেতু ক্যাথলিক ঠাকুমার কাছে মানুষ হয়েছেন, ওনার প্রায় প্রতি ছবিতেই ক্যাথলিজমের প্রতি একটা টান দেখা যায়। একজন সমালোচক হিসেবে এইসব কুসংস্কার আমি এড়িয়ে চলব। নো কমেন্টস্‌।

সবশেষে বলি, ডেল-টোরোর আরেক বিষয় আমাকে প্রবলভাবে টানে। আপনারাও শুনলে চমকে উঠবেন। ওনার সংগৃহীত বই আর কমিক বইয়ের সংখ্যা এত যে, সেগুলো রাখার জন্য মেক্সিকোয় ওনার একটা আলাদা বাড়ি আছে। এরপরেও আর কিছু?

আজ যদি এদের তিনজনের পর আর কারো ছবি আলোচনায় আনতাম, তিনি ডিব্রিল ডায়প মাম্বেতি। সেলুলয়েডে নন-লিনিয়ার কবিতা এভাবে আর কতজন, মনে করতে পারছি না। দুর্ভাগ্য, মাত্র দুটো পুরো দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়েই উনি ফুসফুসের ক্যানসারে মারা গেলেন (সেই দুটো ছবিই কিন্তু, পাঠক, আমি আগে আলোচনা করেছি)। নইলে, হয়ত, আমরা নেরুদার মত এইরকম আরো কিছু সেলুলয়েড কবিতা ওনার ক্যামেরা থেকে পেতাম – I want to do with you/ what spring does with the cherry trees.

(ক্রমশ)

 

 

 


শিবাংশু দে

 

বাঙালি গণেশ' ও রাজার ইচ্ছে

 


আমাদের বাল্যকালে দেখেছি মূলভূমি বাংলায় গণপতি দেবতার একক পুজো ছিলো বিরল। মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর পুজোই বাংলার লোকের কাছে ছিলো অধিক জনপ্রিয়। এমন কি প্রাচীনকালের কৌমসমাজের প্রজনন-তন্ত্রী সংস্কৃতির প্রতীক 'কলা-বৌ' পুজোর সঙ্গেও গণেশকে যুক্ত করা হয়েছিলো। আমরা প্রবাসী বাঙালি হিসেবে দেখতুম বিহার ও উত্তরপ্রদেশে ন্যূনতম আড়ম্বরের সঙ্গে গণেশপুজো পালিত হতো। বাঙালিদের সরস্বতী পুজোর মতো। দক্ষিণ ভারতে থাকার সময় দেখতে পাই মহারাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে গণপতি পুজোর ধুমধাম বেশ প্রকট। পূর্ব ভারতে যেটা দেখা যেতো না। আমি কলকাতায় এসেছি ২০১৪ সালের পর। তখন থেকেই দেখছি পশ্চিমবঙ্গে এই দেবতার নামে বারোয়ারি উৎসব, যাকে হিন্দিতে বলে 'দিন দুনি, রাত চৌগুনি' মাপে বেড়ে উঠেছে। দেবতা হিসেবে গণেশ আগে ছিলেন গৃহদেবতা। তাঁকে কেন্দ্র করে জনতার উৎসব প্রথম প্রচলিত হয় মহারাষ্ট্রে। বালগঙ্গাধর টিলক ১৮৯৩ সালে মুম্বাইয়ের কেশবজি নাইক চওলে গণপতি উৎসবের সূচনা করেন। এই আয়োজনের মূলে ছিলো রাজনৈতিক রণকৌশল।  মহারাষ্ট্রের তুমুল বর্ণবাদী সমাজে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে লোকমান্য টিলক দেবতা গণপতিকে বেছে নেন। কারণ সমাজের সর্বস্তরেই এই দেবতার স্বীকৃতি দেখা যেতো। ব্রাহ্মণ বা দলিত, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই গণপতির অল্পবিস্তর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। টিলক প্রস্তাবিত এই দেবতার পুজো কালক্রমে হিন্দু মহাসভার প্রযত্নে ‘জাতীয়তাবাদে’র আধার হয়ে দাঁড়ায়। আজ এক বন্ধুর মুখে শুনলুম তিনি জনৈক বাঙালি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে শুধিয়ে ছিলেন, বাঙালিরা কেন দিন দিন এতো বেশি সংখ্যা ও মাত্রায়  গণেশপুজো করছেন? সেই ব্যক্তি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলেন 'কেন? গণেশ কি বাঙালি নন?' প্রশ্নকর্তা এহেন পাল্টা আক্রমণে হকচকিয়ে সরে পড়েন। তিনি হয়তো জানতেন না, এদেশে দেবতাদের রূপ বা জাতিবদল রাজার ইচ্ছেতেই হয়। আজ নয়, গত আড়াই হাজার বছর ধরে 'সেই ট্র্যাডিশন' একই ভাবে চলে আসছে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে জ্ঞানচর্চার একটি শাখা আছে। যার গ্রিক নাম 'Theogony' । বাংলায় যাকে বলা যায় 'দেবতাতত্ত্ব'। তার পরিভাষা হিসেবে বলা হয়েছে,

‘The Theogony, which comes from the Greek word 'theogonia' meaning 'birth [or generations] of the gods' is aptly named since it is primarily concerned with describing how the universe came into being, and the genealogy of the titans, gods, monsters, nymphs, dryads, demigods and everything in-between.’

যাঁরা ভারততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেন, 'দেবতাতত্ত্ব' তাঁদের জন্য একটি জরুরি আলোচ্য বিষয়। এ অধম দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি সন্ধান করে এসেছে। দেবতাকেন্দ্রিক 'দর্শন' চর্চার প্রধান স্তম্ভগুলি হলো ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতি। পূর্ব বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এদেশের আধ্যাত্মিক ও লোকাচারভিত্তিক 'ধর্ম' চর্চায় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থই প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। 'বাঙালি গণেশ'-এর  প্রতি অনুরাগ বা 'ভক্তি' বিশেষ রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই নিকট অতীতে বেড়ে উঠছে এই বাংলায়।

'দেবতাতত্ত্ব'-এর নিরিখে আমাদের ইতিহাস সন্ধান করলে দেখা যাবে ঋগবেদে গণেশ দেবতার উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালের অথর্ব বেদে নামটি ঈষৎ শোনা গেছে। গণেশ এক পৌরাণিক দেবতা। পুরাণ অনুযায়ী শিবের অনুচররা ছিলেন 'গণ'। মানে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। পরে যাঁরা 'গণ'তন্ত্রের গৌরবে 'জনগণ' হয়েছেন। 'গণ'-দের মধ্যে ছিলেন রক্ষ, যক্ষ, ভূত, পিশাচ ইত্যাদি এদেশের আদি আর্যেতর অধিবাসীরা। 'হস্তী' ছিলো তাঁদের প্রিয় টোটেম। পরবর্তীকালে আর্যেতর সমাজ, বহুল মাত্রায় সদ্ধর্মের শরণ নিলে 'হস্তী' ওই সংস্কৃতির পবিত্র প্রতীক হয়ে ওঠে। এই পশুর মহিমা ছিলো আকাশচুম্বী। জাতকের গল্প অনুযায়ী বুদ্ধ স্বয়ং পূর্বজন্মে হস্তী-জাতক ছিলেন। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যখন মহাযানী সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে নেয়,

তখন বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে 'সম্মান' জানাবার জন্য 'হস্তী' প্রতীক এক প্রধান দেবতা হিসেবে ব্রাহ্মণ্য দেবজগতে স্থান করে নিয়েছিলেন। নতুন দেবতা  সঙ্গত ভাবেই আর্যেতর শৈব ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ছিলেন।  তাঁকে দেবাদিদেব শিবের 'যুবরাজ' হিসেবে পিতার অনুচর 'গণ'দের অধিপতি হিসেবে স্বীকৃতিও  দেওয়া হয়েছিলো। সেজন্য তাঁর নাম হয় 'গণপতি' বা 'গণেশ'। তাঁর গুণ সিদ্ধিদান ও বিঘ্ননাশ করা। তিনি পৌরাণিক সব দেবতার মধ্যে প্রথম পূজ্য। সে জন্য তাঁর অন্য নাম 'বিনায়ক'। 'গণেশ পুরাণ'-এ তাঁর একটি অন্য নামও পাওয়া যায়, 'হেরম্ব'। যার অর্থ, দুর্বল ও সৎ মানুষের রক্ষাকর্তা। গণপতির শিরোদেশ, মুখমণ্ডল শুভ্র। যেহেতু বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে শ্বেত হস্তীকে পরম পবিত্র মনে করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর দেহ আর্যেতর মানুষদের মতো পাটল বর্ণ। পৌরাণিক ধ্যানমন্ত্রে তাঁর রূপ সম্বন্ধে বলা হয়েছে,

‘ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরম্,

প্রস্যদন্মদগন্ধলুব্ধমধুপব্যালোলগণ্ড স্থলম্।।

দস্তাঘাত বিদারিতারিরুধিরেঃ সিন্দূরশোভাকরং,

বন্দে শৈলসুতা সুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং কামদম্’।। ইত্যাদি।

এই দেবতাকে নিয়েও কৌতুহল বোধ করেছি।  তবু নানা কারণে মৎপ্রণীত 'হিন্দু দেবতা-এক অনির্বেদ অডিসি' গ্রন্থের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়নি। এদেশে পুরাণযুগের গুপ্তপর্বে প্রাচীনতম যে সব মন্দির এখনও অক্ষত আছে তার থেকে আমার দেখা দুটি মন্দিরের গণেশ বিগ্রহের ছবি থাকলো এখানে। ভূগোল দেখতে গেলে  মন্দির দুটি এদেশের দুই বিপরীত প্রান্তে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বোঝা যায় গুপ্তযুগের দেবতা বিষয়ক অনুশাসন সারা দেশেই সমান রূপে প্রভাবী ছিলো। লক্ষণীয়, উভয় ক্ষেত্রেই গণপতি দ্বিভুজ মূর্তিতে বিরাজমান। পরবর্তী যুগে আমরা চতুর্ভুজ গণেশ মূর্তির অবির্ভাব দেখতে পাই।  ব্যাসদেবের অনুলেখক হিসেবে প্রস্তাবিত গণেশ দেবতার অবয়ব চতুর্ভুজ রূপে কল্পিত হয়েছিলো। তাঁর একহাতে লেখনী শোভা পেতো। মহাভারত লিপিবদ্ধ হবার সময়কাল  চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে বলেই অনুমান করা হয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে কল্পিত গণেশ মূর্তি যদি দ্বিভুজ হয়, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতে পারে গণেশের মহাভারত অনুলিখন কাহিনি, ব্যাসকূট ইত্যাদি তত্ত্ব, হয়তো পরবর্তীকালের পুরাণ সূত্রেই সংযোজিত হয়েছিলো।



ওড়িশার পরশুরামেশ্বর মন্দিরের শিবের রাজসভার যে ছবি কল্পনা করা হয়েছে, সেখানে গণেশ শিবের পদপ্রান্তে বিরাজমান। শৈব সংস্কৃতি অনুযায়ী সেখানে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু উভয়ে শিবকে অর্ঘ্য প্রদান করছেন। ডানদিকে ভৈরব ও পার্বতী ব্যতিরেকে শিবের অনুচরদের দেখা যাবে। যাঁদের আর্যসংস্কৃতি  'গণ' সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করতো। বাদামি গুহার সময় কাল ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ। পরশুরামেশ্বর ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ  পুরাণযুগের শীর্ষকালে দেবতা 'গণপতি' এই রূপেই মানুষের পূজা গ্রহণ করতেন।

এদেশের রাষ্ট্রশক্তি যুগে যুগে দেবতার নামে মানুষের মনোগহনে নিহিত অন্ধকারের শক্তিকে প্ররোচিত করেছে। মানুষের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে এসেছে তা'কে। বিঘ্ননাশী গণপতির কাছে প্রার্থনা থাকবে, এই নিচ কৌশল থেকে তাঁকে যেন অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি উন্মেষকাল থেকেই নিপীড়িত, দরিদ্র সমাজের দেবতা। বণিকের রাজনীতি হয়তো তাঁকে বহুলাংশে অপহরণ করে নিয়েছে। কিন্তু তিনি যেন 'দলবদল' না করেন।

জন-গণেশের জয় হোক….

 


পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

 

বিদ্রোহী মহিলা কবি লাল দেদ


আধুনিক কাশ্মীরি ভাষার রূপকার লাল দেদ আজ এক মহান সাহিত্যিক হিসাবে বিখ্যাত। এছাড়া, তিনি ৭০০ বছর ধরে বহু কাশ্মীরি প্রজন্মের কাছে তাঁর কবিতা বা ভখের জন্য এক আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসাবেও বন্দিত।

বিভক্ত কাশ্মীরি সমাজে তিনি হিন্দু এবং মুসলিমের কাছে সমানভাবে আদরণীয়। দুই ধর্মের মানুষের কাছে তিনি যথাক্রমে লাল্লেশ্বরী এবং লাল্লা আরিফা নামে পরিচিত। কথিত যে তিনি আনুমানিক ১৩০১ থেকে ১৩২০ সালের মধ্যে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তখন কাশ্মীরের রাজনীতিতে বহু উত্থান-পতনের সময়। ১৩২০ সালে মধ্য-এশিয়ার এক সর্দার জুলচু কাশ্মীরের শেষ হিন্দু রাজা সহদেবকে পরাজিত করেন। তিনি হাজার হাজার মানুষকে হত্যা এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মাৎস্যন্যায় চলে। অনতিবিলম্বে সোয়াটের (এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত) এক সর্দার সামস-উদ-দিন শাহ মীর কাশ্মীর আক্রমণ করেন। তিনি সেখানে শাহ মীর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সাম্রাজ্য প্রায় দুই শতক রাজত্ব করে।

এক অশান্ত পরিবেশে লাল দেদ বড় হন। প্রাথমিক শিক্ষার পর তাঁর বিবাহ হয় এবং রীতি অনুযায়ী নতুন নাম হয় ‘পদ্মাবতী’। কিন্তু, শাশুড়ি তাঁর উপর অত্যাচার করতেন এবং তিনি স্বামীর কাছ থেকে সুবিচার পান না। শাশুড়ি দেখতেন লাল দেদ প্রতিদিন সকালে জলের পাত্র নিয়ে নদীতে জল আনতে যেতেন আর সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরতেন। তিনি তাই বধূমাতাকে সন্দেহ করতেন। তিনি জানতেন না যে শিবভক্ত লাল দেদ মাঝের এই সময় নদীর ওপারে এক শিবের মন্দিরে কাটাতেন। অত্যাচার সইতে না পেরে লাল দেদ গৃহত্যাগ করলেন।

তিনি এক ভ্রাম্যমান ভিক্ষাজীবী হিসাবে দিন কাটাতেন। এক সময় তিনি সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিবস্ত্র হয়ে গেলেন। তাঁর রচিত ভখ গেয়ে গেয়ে তিনি পথ পরিক্রমণ করতেন। সেই সময় তিনি গুরু সন্ত শ্রীকান্তের দেখা পেলেন।

লাল দেদের ভখগুলি হলো কাশ্মীরি সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। তাঁর সময়ে কাশ্মীরে বৌদ্ধ, নাথ যোগি, ব্রাহ্মণ, সুফি এবং তান্ত্রিক এমনতর বিবিধ সম্প্রদায়ের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি এই সব ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে বৈচিত্র্যময় শব্দ আহরণ করে কাশ্মীরি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

শ্রীনগরের প্রিয় সন্ত মাখদুম সাহেবের ভাই মুল্লা আলি রায়নার লেখা ‘তধকিরাত উল-আরিফিন’ (১৫৮৭) নামক জীবনী-সঞ্চয়নে লাল দেদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ২৫০এর বেশি লাল দেদের ভখ কাশ্মীরি লোক সংস্কৃতিতে এখনও বিরাজ করছে।

লাল দেদ এক বিদ্রোহী কবি ছিলেন। প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতিকে তিনি ভখের মাধ্যমে আক্রমণ করতেন। তাঁর কবিতা ব্যাপকভাবে অনূদিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যঃ ‘উওমেন ইন প্রেইজ অফ দি স্যাকরেডঃ  ৪৩ সেঞ্চুরিজ অফ স্পিরিচুয়াল পোয়েট্রি বাই উওমেন’ (১৯৯৪) - জেন হার্সফিল্ড; ‘নেকেড সঙঃ লাল্লা’ (১৯৯২) - কোলম্যান বার্কস; ‘লাল্লা ভখিয়ানি’ বা ‘দি ওয়াইজ সেয়িংস অফ লাল-দেদ, এ মিস্টিক পোয়েটেস অফ এনসিয়েন্ট কাশ্মীর’ (১৯২০ )- স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন।

 

লাল দেদের কয়েকটি ভখের অনুবাদঃ

 

(১)

 

শুধিয়েছি গুরুকে হাজার বার,

কী নাম হতে পারে শূন্যতার,

হাল ছেড়েছি আমি অবশেষে;

সব নামের উৎস যিনি

নামে তাঁর কী যায় আসে?

 

(২)

 

তাদের কটূক্তি আর থুতু যেন আমার মুকুট

কুৎসা আমার প্রতি পদক্ষেপকে তাড়া করে

আমি লাল, আমি অবিচলিত থাকি

আমি কি বোকা, ওদের রাখার জায়গা কোথায়?

 

(৩)

 

তোমার প্রতিমার পাথর, তোমার মন্দিরের পাথর

সব পাথর পা থেকে মাথা বাঁধা

বিচিত্র ব্রাহ্মণ, তুমি কাকে পূজা করো?

বদলে আমার নিঃশ্বাসকে বাঁধো।

 

(৪)

 

সর্ববিরাজিত শিব, তাকে সূর্য ভাবো

হিন্দুকে মুসলিমের থেকে আলাদা ভেবো না

যদি জ্ঞানী হও, নিজেকে জানো

তাই হলো সাহেবকে জানার একমাত্র উপায়

 

(৫)

 

খাবারে সংযমী হও, ব্যবহারেও সংযমী হবে

সংযমীদের জন্য সব দরোজা খোলা

শৈত্য বাঁচাতে প্রয়োজনমতোই পরিধান করো

ক্ষুৎনিবৃত্তি করতে প্রয়োজন মতোই খাও

 

(৬)

 

এই জগতে জন্মে কোনো সম্পদ চাইনি

বিলাসিতা আর লোভের আমি পিয়াসি নই

সামান্য আহার আমার পক্ষে যথেষ্ট

দুঃখের ঝড় সামলে নিয়ে আমি ঈশ্বরের সাথে আছি

 

(৭)

 

হাঁপরে চাপ দিয়েছি, ওর নিঃশ্বাস রুদ্ধ করেছি

ক্ষুদ্র শিখায় আমি বিকশিত হয়েছি

অন্তরের আলোকে আমি বিস্ফারিত করেছি

আঁধারে তাঁকে পেয়েছি আর তাঁকে যেতে দিইনি

 

(৮)

 

দেহের কেন্দ্রে আছে জ্বলন্ত সূর্য

মাথার মুকুট বরফশীতল চন্দ্র

কোথা থেকে মৃদু জলধারা আসে

বলো ‘হু’ শীতল আর ‘হা’ গরম

 

(৯)

 

আমার আত্মা, আমি ধীরে কেঁদে যাবো

কারণ এই জগতকেই তুমি ভালোবাসো

তোমার সম্পদের ছায়াও স্থায়ী নয়

কী করে তুমি নিজেকে ভুলবে?

 

 

(১০)

 

আমার পিঠের চিনির ভার ঝুলে পড়েছে

আমার দেহ ধনুকের মতো বেঁকে গেছে।

আমি কী করে সহ্য করবো?

গুরুর বাণী ক্রন্দনরত ফোস্কার মতো আঘাত করে

আমি মেষপালকহীন মেষের দল

কী করে সহ্য করবো?

 

(১১)

 

আমার মন নতুন, চাঁদ নতুন

জগতের সমুদ্রে সব নতুন দেখি

যেহেতু আমি দেহ আর আত্মাকে প্রক্ষালন করেছি

আমি, লাল, চিরনবীন হয়ে বিরাজ করি।

 

(১২)

 

ভালোবাসায় তাড়িত আমি, লাল, ছিটকে পড়েছি

রাতদিনের শেষ পর্যন্ত খুঁজে গেছি

তবে আমার ঘরেই আমি জ্ঞানীকে পেয়েছি

আমি সেই মুহূর্তকে জাপটে ধরেছি - অনুগ্রাহী আমার তারারা!

 

[সূত্রঃ আমার গ্রন্থ ‘বিস্মৃতা অনন্যাঃ যারা কাচের ছাদ মানেনি’।]

 

 

 

 

 

 

 


সুতপা মুখোপাধ্যায়

 

মেয়েদের লেখাপড়া ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ




২৬শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পার হল। নানাদিকে নানা বক্তৃতা, লেখালিখি, বিবিধ অনুষ্ঠান তাঁর জীবন নিয়ে, তাঁর কর্ম নিয়ে। প্রায় প্রতি বছরই মনে হয় কি হত আমাদের, মেয়েদের, তিনি না এলে? বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনের পশ্চাতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় সে তো আমরা জানি। বহুবিবাহ নিবারণ সেও তো বাঙালির ঘূণধরা সমাজের মর্মমূলে দারুণ এক আঘাত। এ সবের জন্য  প্রয়োজন ছিল মেয়েদের লেখাপড়া শেখা যাতে জীবনকে জগতকে ভালোভাবে বুঝতে পারে তারা। উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ের লেখাপড়ার জন্য অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করতে গিয়ে সবসময় ইচ্ছে করে ফিরে দেখতে সেই ইতিহাস। যা আজ অনেক সহজে পাওয়া যায় তাকে অর্জনের জন্য কম কঠিন পথ পার হতে হয়নি মেয়েদের। মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি যেমন সমর্থন গড়ে উঠছিল উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে, তেমনই তার বিরোধিতার করার জন্য ছিল আরও বেশি সংখ্যক মানুষ। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় রামমোহন রায়ের কথা— “স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন, যে অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন?” রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রধান থেকে শুরু করে ইয়ং বেঙ্গল দল এবং সংস্কারবাদী বাঙালি সমাজ মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকে মিশনারি সম্প্রদায় এদেশে সংস্কার কাজে উৎসাহিত হয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখায়। অবশ্য তার মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল অনেকখানি। হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারগুলি, বিশেষত মেয়েদের দমিয়ে রাখার বিষয়গুলিকে চিহ্নিত করে ভারতের পশ্চাদগামী সভ্যতার স্বরূপ উন্মোচন জরুরী হয়ে ওঠে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য। ১৮১৯ সালে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সোসাইটি কলকাতায় মেয়েদের জন্য কয়েকটি স্কুল খোলে। এর মধ্যে ব্রিটেন থেকে আসেন মিস মেরি অ্যান কুক। চার্চ মিশনারি সোসাইটির সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় আটটি বিদ্যালয় খোলেন মেয়েদের জন্য। খ্রিষ্টান মিশনারিরা কলকাতার বাইরে অন্য জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বিদ্যালয়ে প্রধানত সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মেয়েরা পড়তে আসে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার বিষয়টিতে অনেক বাধা রয়ে যায়। কিন্তু, ধীরে ধীরে একটু একটু করে বাঙালি মননে পরিবর্তন আসতে থাকে।

বাঙালি সমাজের ভিতর থেকেই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। গোলাম মুর্শেদ তাঁর Reluctant Debutant গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে বিশ এবং তিরিশের দশকে বাগদি, ব্যাধ, বৈরাগী প্রভৃতি সমাজের নিম্নবর্ণের মেয়েরা এবং বারবনিতাদের মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ছিল। তিরিশের দশকে ভদ্রলোক সমাজের কয়েকজন তাঁদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর বাড়ির মেয়েদের বৈষ্ণবী ও মিশনারিদের সাহায্যে শিক্ষিত করে তোলেন। তাঁর প্রথমা কন্যা সুরসুন্দরী খুবই আগ্রহের সঙ্গে লেখাপড়া শিখেছিলেন অনেকখানি। এমনকি রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি রাধাকান্ত দেবও বাড়ির মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার জন্য বাড়িতেই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ১৮৪৭ সালে নবীনকৃষ্ণ মিত্র, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখের উদ্যোগে বারাসতে একটি মেয়েদের বিদ্যালয় খোলা হয়। অনেক বাধা আসে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। তবুও প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় বালিকা বিদ্যালয়। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও মেয়েদের জন্য অবৈতনিক স্কুল খোলার প্রস্তাব রাখেন সরকারের কাছে। তবে সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া তিনি পান নি। মেয়েদের স্কুল খোলার এইসব চেষ্টার মাঝেই ১৮৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এদেশে এলেন বেথুন সাহেব। মেয়েদের স্কুল খোলার যে প্রবল আগ্রহ তাঁর ছিল, সেখানে পাশে পেলেন অনেক শিক্ষিত বাঙালিকে। তবে বেথুনের এই পদক্ষেপকে সবাই ভালো চোখে নিল না। মেয়েরা যখন বেথুন সাহেবের ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলে যেতে শুরু করল তখন স্কুলের গাড়িতে চেপে, তখন তা দেখার জন্য রাস্তায় লোকে ভিড় করত। অশালীন মন্তব্যও উড়ে আসত। মদনমোহন তর্কালঙ্কার যখন তাঁর দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে ওই স্কুলে পড়তে পাঠালেন তখন অনেকেই সেটা ভাল চোখে দেখে নি। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া জমিতে স্কুলের নিজস্ব বাড়ি তৈরি হল। বিদ্যাসাগরের উপর বেথুন তাঁর স্কুলের বিষয়ে নির্ভর করতে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগর স্কুলের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। বিদ্যাসাগর দেশীয় সমাজকে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য স্কুলের মেয়েদের যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ির দুপাশে “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নত’’ শ্লোকটি লেখার ব্যবস্থা করেন। ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলের নিজস্ব ভবন নির্মাণ সম্পুর্ণ হওয়ার আগেই বেথুন সাহেবের মৃত্যু হয়। বেথুনের মৃত্যু স্কুলকে দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেয়। স্কুলের ছাত্রীসংখ্যাও ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৫৬ সালে  হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের সহায়ক এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শিক্ষিত বাঙালির উদাসীনতা নিয়ে দুঃখ করে। ১৮৬২ সালের বেথুন স্কুলের রিপোর্টে বিদ্যাসাগর কলকাতার শিক্ষিত পরিবারগুলির বাড়ির মেয়েদের পাঠানোর ক্ষেত্রে দ্বিধার উল্লেখ করেন। তবে বেথুন স্কুল বাংলায় মেয়েদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে থাকে। অনেকেই মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। শুধু কলকাতা শহর নয়। বাংলার মফস্বল অঞ্চলেও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়। মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সরকারের সাহায্য পাবেন এই বিশ্বাসে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন জেলায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বর্ধমানের জৌগ্রামে তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলেন ১৮৫৭ সালে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সাধক চরিতমালা তে উল্লেখ আছে যে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়গুলির জন্য মাসে ৮৪৫ টাকা খরচ হত। ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৩০০। হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই কাজে সরকারি সাহায্যের যে আশা বিদ্যাসাগর করেছিলেন তা পাওয়া যায় নি।  তিনি ১৮৫৮ সালে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনকে চিঠি লেখেন যাতে তাঁর হতাশার চিত্রটি স্পষ্ট থাকে। তিনি লেখেন, “হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলার অনেকগুলি গ্রামে বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। বিশ্বাস ছিল, সরকার হইতে মঞ্জুরী পাওয়া যাইবে। স্থানীয় অধিবাসীরা স্কুল-গৃহ তৈয়ারি করাইয়া দিলে সরকার খরচ-পত্র চালাইবেন। ভারত-সরকার কিন্তু ঐ সর্ত্তে সাহায্য করিতে নারাজ, কাজেই স্কুলগুলি তুলিয়া দিতে হইবে... প্রথমে আপনি, অথবা বাংলা সরকার এ বিষয়ে কোনরূপ অমত প্রকাশ করেন নাই; করিলে, এতগুলি বিদ্যালয় খুলিয়া এখন আমাকে এমন বিপদে পড়িতে হয়ত না।” এই চিঠি সরকারের বিভিন্ন মহলে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। তবে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সরকারের নাজেহাল অবস্থার জন্যই হোক বা উদাসীনতার কারণেই হোক বিদ্যাসাগর স্থায়ী সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিতই থাকলেন। ১৮৬৬ সালে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন মেরি কার্পেন্টার। তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগরের কাজের গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৬৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাঁরা উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে বিদ্যাসাগর পথ-দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়াসে তিনি ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অধিকার নিয়ে বাংলার শিক্ষিত গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক জারি থাকল ষাটের দশক থেকেই। স্ত্রীশিক্ষা কেমনভাবে দেওয়া হবে তাই নিয়েও মতান্তর দেখা দিল। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশব চন্দ্র সেন যিনি মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন তিনি ‘স্ত্রীজনোচিত’ শিক্ষার কথা বললেন। ব্রাহ্মসমাজের ভিতরে অনেকেই তাঁর মতকে সমর্থন করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই আবার এই মতের বিরোধিতা করলেন। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখরা মেয়েদের জন্য জ্ঞানচর্চার দরজা খুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বললেন। ১৮৭৩ সালে এঁদের হাত ধরে স্থাপিত হয় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় পরে যার নাম হয় বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে দুর্গামোহন দাসের ভার্যা ব্রহ্মময়ী এই স্কুলটির জন্য মাসে মাসে অর্থ দান করতেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে এই স্কুলের জন্য দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণ করেছেন যিনি শিক্ষক হিসেবে দিনরাত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে ছাত্রীদের লেখাপড়ায় অনুপ্রাণিত করেন। সরকারি রিপোর্টেও স্কুলটি প্রশংসিত হয়। কিন্তু আর্থিক সংকট স্কুলটির অগ্রগতি রোধ করতে থাকে। ১৮৭৮ সালে এই স্কুলটি বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে যায় যা বেথুন স্কুলের অগ্রগতিতে সাহায্য করে, কারণ সরকারি অনুদানের অভাব না থাকলেও বেথুন স্কুলে ছাত্রীর অভাব ছিল। ১৮৭৮ সাল থেকেই মেয়েরা বিভিন্ন পরীক্ষায় বসতে থাকে। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে সমাজের এক অংশের বিরূপতা জারি থাকে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে মুসলমান শিক্ষিত সমাজেও মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয়। বালারঞ্জিকা পত্রিকার সম্পাদক আবদুর রহিম মেয়েদের লেখাপড়ার সমর্থক ছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার জাহিরুদ্দিন আহমেদ তাঁর মেয়েকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির ধর্মের কারণে তাকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। সমকালীন বামাবোধিনী পত্রিকা মুসলমান মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সরকারের কর্তব্য বলে মন্তব্য করে। মুসলমান শিক্ষিত সমাজও মেয়েদের বিদ্যালয়ের দাবি জানায়। ১৮৯৭ সালে মুসলমান মেয়েদের জন্য কলকাতায় আলাদা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মেয়েদের শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে মুসলমান সমাজের মধ্যেও দ্বিধা দেখা যায়। মুসলমানসমাজের মুখপত্র বলে গণ্য হওয়া মিহির ও সুধাকর পত্রিকাটি যদিও প্রথমদিকে মুসলমান মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, পরবর্তীকালে তার মতামত কিছুটা পালটে নেয় পত্রিকাটি। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়া কেমন হবে সেই বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল যে মেয়েদের শিক্ষা হবে এমন যা অন্তঃপুর, সমাজ ও ধর্মের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে না কোনভাবেই। কলকাতার বাইরে বৃহৎ বঙ্গে অবশ্য সত্তরের দশক থেকেই মুসলমান মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল।

দেখে নেওয়া যেতে পারে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার সপক্ষে কী কী বই লেখা হয়েছিল। প্রথমেই মনে আসে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক এর কথা। রচনাকাল ১৮২২। মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে জনমত গঠনে এই বইটির ভূমিকা ছিল অসামান্য। রাধাকান্ত দেব এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল যিনি গৌরমোহনকে এই বইটি লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এই বইটির বিক্রি ছিল চোখে পড়ার মত। পুরাকালের ভারতের শিক্ষিত মেয়েদের কথা তুলে ধরে তিনি লেখেন যে সেইসব মহিলাদের বিদ্যাচর্চার ফলে কোন অখ্যাতি হয়নি। তিনি লেখেন বিদ্যাচর্চা থাকলে পাপকাজে অশ্রদ্ধা জন্মে। তাঁর বই নিয়ে সমাচার দর্পণ সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকাদুটি  পক্ষে বিপক্ষে মতপ্রকাশ করে। ১৮৫০ সালে তারাশঙ্কর তর্করত্ন রচিত ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা প্রকাশিত হয় যা মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করে। ১৮৫১ সালে সম্বাদ ভাস্কর পত্রিকা এই গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করে। ১৮৫৬ সালে হরচন্দ্র ঘোষ লেখেন অ্যান অ্যাড্রেস অন নেটিব ফিমেল এডুকেশন ১৮৫৭ সালে স্ত্রীশিক্ষা বিধান লেখেন দ্বারকানাথ রায়। ১৮৫৯ সালে রামসুন্দর রায় লেখেন স্ত্রীধর্ম বিধায়ক। মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে উনিশ শতকে বিবিধ মতামত প্রকাশিত হতে থাকে। মেয়েরা যে সেইসব তর্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেন না এমনটা কিন্তু নয়। ১৮৬৫ সালে কৈলাসবাসিনী দেবী লিখলেন হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস ও তাহার সনুন্নতি। ১৮৬৩ সালে তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা। মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা ছাড়া মেয়েরা যে দূরবস্থা থেকে উদ্ধার পাবে না এমনই মত ছিল কৈলাসবাসিনীর। তবে মেয়েদের প্রকাশ্য বিদ্যালয় গমনকে তিনি মানতে পারেন নি। মেয়েদের জ্ঞানগর্ভ ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য পড়ানোতেও আপত্তি ছিল তাঁর। তিনিও মেয়েদের সংসারের উপযোগী করে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে ছিলেন। তবে তিনি তাঁর গ্রন্থে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন কীভাবে মেয়েরা লেখাপড়া শেখা থেকে বঞ্চিত হয়ে পশুর মত জীবনযাপন করে।

নানা বিরূপতার মধ্যে দিয়েও স্কুল শিক্ষায় অগ্রগতি ঘটতে থাকে অল্প সংখ্যক মেয়ের। দুজন মেয়ে এনট্রান্স পরীক্ষায় বসার অনুমতি পান। একজন কাদম্বিনী বসু ও অপরজন সরলা দাস। সরলা দাসের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি আর পরীক্ষায় বসেন নি। কাদম্বিনী বসু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নারীশক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক তৈরি করেন। তাঁর উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হয় বেথুন কলেজ। ১২৮৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় বামাবোধিনী পত্রিকা লেখে, “...কুমারী কাদম্বিনী ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করাতে লেপ্টেনান্ট গবর্নর বেথুন স্কুলে কলেজ শ্রেণী খুলিবার ব্যবস্থা করিয়া কটক কলেজের সুযোগ্য অধ্যাপক বাবু শশিভূষণ দত্ত, এম.. কে এখানে আনয়ন করিয়াছেন। বেথুন স্কুলে এখন শিক্ষক প্রভৃতির সুব্যবস্থার জন্য গবর্ণমেন্ট মাসে ৭৫০ টাকা দান করিতেছেন...।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য ফার্স্ট আর্টস এবং বি এ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল পরীক্ষার নিয়মাবলি। কাদম্বিনী বসু এবং দেরাদুনের চন্দ্রমুখী বসু এফ এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৮৮২ সালে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হলেন কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু। এই ঘটনায় সারা দেশে তৈরি হল ঐতিহাসিক নজির। সমাবর্তনে এত ভিড় হল যে সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়েছিল। সংবাদপত্রগুলিতেও কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখীর সাফল্যের সংবাদ ছাপা হতে থাকে।  হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন,  হরিণ নয়না শুন কাদম্বিনী বালা/ শুনও চন্দ্রমুখী, কৌমুদীর মালা/ তোমাদের অগ্রগামী আমি একজন/ এইবেলা ও উপাধি করেছি ধারণ। ... কি আশা জাগালি হৃদে কে আর নিবারে? ভাসিল আনন্দ ভেলা কালের জুয়ারে/ ধন্য বঙ্গনারী ধন্য সাবাসি তুমারে।




নানা কষ্ট, নানা বাধার মধ্যে দিয়ে উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ের লেখাপড়া এগিয়েছে। বিপুল সংখ্যক মেয়ে যে শিক্ষালাভ করতে পেরেছে তেমনটা কখনই নয়। কিন্তু এই যে বাধা ভেঙে এগিয়ে চলার প্রয়াস সেটিই পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল মেয়েদের জীবনে। সেই দ্বন্দ্বপথ ফুলে ঢাকা ছিল না কোনকালেই। তবু চলা থামেনি।


মধুবন চক্রবর্তী

 

ব্রাহ্মসমাজের পুনঃ প্রতিষ্ঠাতা রাজনারায়ণ বসু

 


জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক রাজনারায়ণ বসু একজন যথার্থ সাহিত্য সমালোচক যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন সমাজ সংস্কারক। দুর্গম পথের সাধকও তাঁকে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে বিধবাবিবাহ প্রথাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি বহু প্রতিবন্ধকতা ও অপমানকে অতিক্রম করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আগেও বিধবাবিবাহের প্রচলনের প্রয়াস হয়েছিল, যে প্রয়াসের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নিরলস অবিচ্ছিন্ন চেষ্টার কোন তুলনাই ছিল না। তাঁর হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দুর নারীর সমাজের দুর্গতি দুর্দশায়।

ঠিক সেরকমভাবেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাজের সঙ্গে ছিল হৃদয়ের যোগ রাজনারায়ণ বসুর। পরবর্তী ক্ষেত্রে তাঁর প্রচলিত সেই প্রথাকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসু। সেকালের সমগ্র  হিন্দু নারীদের প্রতি তাঁরও ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান। ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে, তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয়  বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকারাদি সুনির্দিষ্ট করে। আইন বিধিবদ্ধ করার আগে এবং পরে বিধবাবিবাহ প্রচলন করার প্রচেষ্টার জন্য বিদ্যাসাগরকে নিদারুন এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কয়েকজন অসীম সাহসী ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছিলেন, সফল করার ক্ষেত্রে সাহস প্রয়োগ করেছিলেন। তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক আন্দোলন একসময়ে কলকাতায় রীতিমত আলোড়ন তুলেছিল। আর সেই প্রবাহ রাজনারায়ণ বসুর জন্মভূমি মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল গোড়া  হিন্দুসমাজ। উত্তাল হয়ে উঠেছিল গ্রামের মাতব্বররা। ঈশ্বরচন্দ্র বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে যে যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন যে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন, সেই মুক্তচিন্তা রাজনারায়ণ বসুর হৃদয় ছুঁয়েছিল। এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি যে বিদ্যাসাগরের ভাবধারায় দীক্ষিত রাজনারায়ণ বসু সেই সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রাম বোড়ালেও।

বিধবাবিবাহ আইনে পরিণত হলে, প্রথম বিবাহ করলেন কলকাতার শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ১৮৫৬ এর ডিসেম্বর মাসে। এরপর দ্বিতীয় বিবাহটি করলেন পানিহাটির মধুসূদন ঘোষ। তৃতীয় চতুর্থ বিবাহ দানের কৃতিত্ব রাজনারায়ণ বসুর। আদি ব্রাহ্মসমাজের রাজনারায়ণ বসুর 'আত্মচরিত' অনুযায়ী দুটি বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। যে দুটি করেন তাঁর সহোদর মদনমোহন বসু ও জেঠুতুতো ভাই দুর্গানারায়ণ বসু। প্রথম বিবাহ দুটি হিন্দু সমাজের হলেও পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মসমাজে অনুষ্ঠিত হতে থাকে, বিধবাবিবাহ আইনকে তাঁরা হাতিয়ার করতে পেরেছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা জানিয়েছেন, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ সালের মধ্যে মোট সাতটি বিধবাকন্যার বিবাহ হয়েছিল আর এইসব বিয়ের অধিকাংশের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হলেও, সবকটি বিবাহই যে সমাজ সংস্কারের মনোভাব নিয়ে ঘটেছিল তা কিন্তু নয়। বহু ক্ষেত্রেই অর্থের লোভে অথবা অন্য প্রলোভনে এই বিবাহ করা হয়। তার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের মনেও কম তিক্ততার জন্ম হয়নি। যদিও ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর এই কঠিন সংগ্রামের পাশে পেয়েছিলেন একাধিক সমাজ সংস্কারককে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক রাজনারায়ণ  বসু। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সংস্কার তৈরি করতে হয় বাড়িতে থেকেই অর্থাৎ অন্দরমহল থেকেই সেই সংস্কার আন্দোলনের কাছ থেকে তিনি শুরু করেছিলেন। যদিও এর জন্য তাঁকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে  দিয়ে চলতে হয়েছে। পরিবারের চোখে তাঁকে অনেক নিচু হতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে। তাঁর কাকা এবং মা সকলেই খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এই কর্মকাণ্ডে। সবাই তাঁকে দোষারোপ করেছিলেন। কাকা বলেছিলেন, ‘তোমার দ্বারা আমরা কায়স্থকুল হইতে বহিষ্কৃত হইলাম’। গ্রামেও সেই একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসুকে। তাঁরা বলেছিলেন রাজনারায়ণ বসুর গ্রামে আইলে আমরা ইট মারিব। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “তাহা হইলে আমরা খুশি হইবো, আমি বাঙালিকে উদাসীন জাত বলিয়া জানি”।

মেদিনীপুরে শুরু হয়ে গিয়েছিল চরম বিরোধিতা যার ফলে অনেকটাই উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসু। একাধারে সংসারী মানুষ হলেও অন্যদিকে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর তিনি কোনোওদিন রোধ করেননি ভয় পেয়ে, হূমকি হুঁশিয়ারির কাছে কোনদিন মাথা নত করেননি। পিছিয়ে যাননি তাঁর সংকল্প থেকে। যা ভেবেছেন তাই করে দেখিয়েছেন আর এখানেই তার মহত্ব। একসময়ের সরকারি উকিল হরনারায়ণ দত্ত রাজনারায়ণের বিরুদ্ধে লোক খ্যাপাতে শুরু করেছিলেন।। ঘুরিয়ে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গোটা বিষয়টিতেই বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি তিনি। বিভ্রান্ত করতে পারেনি সেই সময়ের পরিস্থিতি। কারণ তিনি ছিলেন চিন্তাবিদ। সুদূর প্রসারী চিন্তাভাবনা করতেন। জানতেন আজকের এই আন্দোলনের জোয়ার ভবিষ্যতে একদিন সুনামিতে রূপান্তরিত হবে। বন্ধু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সবসময়ই পাশে পেয়েছিলেন তিনি এই দুর্দশাগ্রস্ত দিনগুলিতে।

শুধুমাত্র বিধবা বিবাহের মতো সমাজ সংস্কারক আন্দোলনের পাশে থাকাই নয়, একসময় মদ্যপানের তীব্র বিরোধিতাও করেছিলেন। ১৮৬০ সালে তৈরি করেছিলেন নতুন একটি সভা যা বাংলার বুকে এক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। সেই সভার নাম ছিল ‘সুরাপান নির্বাচননী সভা’। মদ্যপানের কুপ্রভাব নিয়ে প্রচার করা হত সেই সভা থেকে। মদ্যপানের বিরোধিতা করে এক সময় বহু গানও রচনা করেছিলেন রাজনারায়ণ। সভার পক্ষ  থেকেও নানান গান রচনা করা হয়েছিল সেইসময়।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে কোন সম্পন্ন আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি পরিবারে কোনও বালকের যেভাবে শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত ঠিক সেভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন রাজনারায়ণ। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর একাগ্রতা ও ভালোবাসা যতটা ছিল, দখলও যতটা ছিল। বিজ্ঞান বা গণিতের প্রতি সেই পক্ষপাত অবশ্য ততটা ছিল না, যে তথ্য পাওয়া যায় তাঁরই উচ্চারিত একটি বাক্য থেকে। হেয়ার স্কুলের হেয়ার সাহেবের প্রবর্তিত বিতর্ক সভায় একবার তিনি whether science is preferable to literature  এই প্রস্তাবের পক্ষে একটি লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন।  লিখেছিলেন, ‘তথাপি আমার প্রবন্ধে আমি তাহাকেই সাহিত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতা দিয়েছি’।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের ভাবধারায় দীক্ষিত ছিলেন। প্রথম জীবনে কিছুদিন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের অধীনে অধ্যাপনা করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে এসে তাঁর রূপান্তর ঘটে, লিখেছিলেন ‘আত্মচরিত’। দেশবাসীকে জাতীয় মন্ত্রে একতাবদ্ধ করে স্বদেশের উন্নতি সাধনে হয়েছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মৌলিক দিকগুলো যাতে বিকশিত হয় সেদিকেও তিনি নজর দিয়েছিলেন। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে যাতে নারীরাও সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে সেদিকে নজর দিয়েছিলেন তিনি। আসলে ব্রাহ্ম আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, নারী জাতের কল্যাণের প্রচেষ্টা। স্ত্রী শিক্ষার প্রসার। সেই আন্দোলনে  ১৮৫৬র পরে বিধবাবিবাহ আইনকে বিশেষভাবে কাজে লাগানো চেষ্টা করা হয়। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর 'আত্মচরিতে' বেশ কয়েকটি বিবাহের সংবাদ পাওয়া যায়। যেমন জানা যায় প্রথম ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেছিলেন ঢাকায় ব্রজসুন্দর মিত্র। তিনি কন্যাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। এবং শিক্ষিত করার পর তাদের (বিধবা কন্যা সহ) ব্রাহ্মমতে বিবাহ দেন।

তবে হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজে কোনও বিধবা বিবাহই কিন্তু একেবারে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। অথবা সুসম্পন্ন হলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে নানান রকম জটিলতা বা গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসুর ক্ষেত্রেও তার  ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সব রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়েও তিনি তাঁর এই সুদূরপ্রসারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।।

বলা যেতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রচলিত বিধবাবিবাহ প্রথাকে পরবর্তী ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধুমাত্র চিন্তাবিদ শিক্ষাবিদ বা একজন সাহিত্যসমালোচক নয়, এক দুর্গম পথের সাধক বলা যায় তাঁকে। সমাজ সংস্কারক আন্দোলনের ধারক ও বাহক রাজনারায়ণ বসু বাঙলা ও বাঙালির গর্ব, অহংকার।

 

 


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি # চিলেকোঠার সেপাই




প্রতি,

পর্দা খুলতেই দেখা যায়, মঞ্চের উপর-নিচ দুই তল। বোঝা যাচ্ছে, কোনও বৃহৎ জায়গাকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে। আর তাই এভাবে অনেকগুলো জায়গাকে একই সহাবস্থানে আনতে চাওয়া হচ্ছে। এ তো চেনা ছক… মঞ্চভাবনার জন্যে। কিন্তু এরমধ্যে দিয়ে একটা গভীর তল তৈরি করে, সেই তলের মধ্যে আনমনা ব্যস্ততম দর্শকের মন টেনে ধরা শক্ত কাজ। নয় কি? তারমধ্যে দিয়ে যখন বিষয়টা একেবারে লঘু তো নয়! তো দর্শকের সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিতেই হবে।

কিছু প্যাকেটের খচরমচর শব্দে দর্শক আসনের আবহ। আজকাল তো সংলাপের সঙ্গে তাল রেখে বেজে ওঠে অথৈ মুষ্টিযন্ত্র। তাতে অভিনয় থামিয়ে যখন বলতে হয় - বাজিয়ে নিন বাজিয়ে নিন… তারপর তো থিয়েটার!

আর ততক্ষণে মঞ্চে আলোতে অভিনয়ে চিলেকোঠায় এক সেপাই। উঁচু থেকে মাপা পায়ে সংলাপে বোঝা যাচ্ছে না এই প্রযোজনার বয়স। ২৬ বছর আগে হয়েছিল। তারপর কল্যাণী নাট্যচর্চা দলের জন্মদিনে ফের হচ্ছে  চিলেকোঠার সেপাই। আমি কি ছাই জানতাম! এক থিয়েটার বিশেষজ্ঞ মনে করিয়ে দিলেন। তিনি আর কেউই নন আমাদের থিয়েটার দলের নির্দেশক সঞ্জীব রায়। বলেন, এটা দেখেননি? তাহলে তো সবটাই বৃথা। ঐ জীবনের ১৬ আনাই ফাঁকির মতন। তাই আগে থেকে আলাপ করে নিয়ে দেখতে আসা। সেকি কাণ্ড! আজকাল তো সেসব পেরিয়েই আসতে যেতে হয়।

সামনে সেলিব্রিটি রূপেন আবির্ভূত এক তারকা অভিনেতা। তাঁকে ঘিরে ফেলেছেন উপস্থিত একাডেমির সামনের জনগণ। আর যেহেতু টিকিট আজও কাউন্টার থেকেই নিই, তাই কাউন্টার এই কাউন্টার কতটা সইতে পারে বুঝতে চাইছিলাম।

হ্যাঁ, ভিড় সরে যেতেই আমরা যারা সরলাম না, তারাই তো থিয়েটার দেখতে আসিয়ে। যেমন করেই হোক ঐ চূড়ান্ত সম্মান-সরিয়ে যারা শুধুই থিয়েটার করেন – তাঁদের জন্যে আসি। আসতেই থাকি নিজেকে প্রসারিত শিক্ষায় রাখার জন্যে। কারণ, থিয়েটারের দীক্ষা তো আত্মগত। এর ভাবনা কোনও গুরুগৃহের প্রাকারে শুরু হয়নি। আবার যস্মিন দেশে যদাচার –এর ছোঁয়া বাঁচিয়েও চলতে থাকতে হয়। তো, এই থিয়েটারের জন্যে ঢুকতে গিয়ে এত…। তারপর যেই না জমিয়ে বসা, অমনি মশার শব্দের মতন পিনপিন করে কথালাপ, দর্শকের ধারণায় বোধহয় পাশের ব্যক্তিরা সব কালা। আর মঞ্চের ব্যাপারটা অভিনয় মাত্র।

কিন্তু কোন নাটকের অভিনয় জেনেছেন?

বললেন, না, এতো সময় নেই বাবা। আগেভাগেই বলি, আমি পড়ি খুব। কিন্তু এটা বাদ চলে গেছে।

কেন হে, হোম ওয়ার্ক করে যে আসার ব্যাপারটা? সেটা? সেটাও ভুলে গিয়েছেন হে দর্শক?

খুব দরকার… প্রশ্ন করলেন। এক ঢোক চা খেয়েনি। এই নিত্য থেকে অনিত্যের যাত্রায়।

তা, কার লেখা উপন্যাস বলুন তো?

সুনীলের?

না

শক্তি তো গল্প-টল্প লেখেন না।

না, ওনার শক্তিতে কুলায়নি হবে।

তবে?

এ তো বড় সাংঘাতিক  ব্যাপার।

ততক্ষণে মঞ্চে সাত-সাতটা সিন হয়ে গেল। মঞ্চের বিচিত্র মায়ায় অভিনেতাদের ওঠাবসা হল। না, মঞ্চে হতে থাকা থিয়েটারের কথা আর লিখতে পারছি কই?

যা দেখি তাই লিখি।

যা লিখি তাইই দেখি।

ওপাশে কথার সঙ্গে প্লাস্টিকের খচলচ আর মচমচ।

কিন্তু এটুক জেনে আসা তো সম্ভব ছিল মাননীয় দর্শকের পক্ষে – নাটকের বিষয়বস্তুটি। সেটা জানতে আবার উপন্যাস পড়তে হবে। একটা থিয়েটার দেখার জন্যে এত ঝক্কি? পোষায়? একে তো থিয়েটার তায় হলের ঐ হাল। তায় পড়ালেখা করে আসতে হবে – তারচেয়ে সপ্তাহান্তের ছুটি সময়টা লঘুমাত্রায় পপকর্নের সঙ্গে হোক না? মন্দ কি? এইজন্যেই তো থিয়েটার থেকে লোক পালায়? সারা সপ্তাহ পেশাযুদ্ধের পর – ফের যদি বলে পড় পড়। কোন মানুষে মেনে নেবে?

আর তাতে আনন্দ বলে কিছু থাকে? বিনোদন ভেবে আসা দর্শকের জন্যে এই থিয়েটার নয়। চিলে কোঠার সেপাই বুঝতে গেলে, আগে টেক্সট পড়ে আসতে হবে।

বটেই তো, দর্শকের রুচি যখন থিয়েটারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাইভ লোকেশন শেয়ার করে থিয়েটার দেখতে এসেছি, তখন চ্যালেঞ্জ তো বটেই। তাও চেষ্টা নিচের ভাগের নিচের তলে খোপ খোপ সেখানে লাগানো ঐ যে রঙিন কাপড়। আর একেবারে উপরে, চিলে কোঠায়? ওসমান? তাই হবে। প্লট অনুসারে তো তাই।

ঐ অন্ত্যজ শ্রেণি। আর তারমধ্যে যে ভাগগুলো করা হয়েছে – যা এই মানুষগুলোর মনের রঙ বোঝায়। যারা লোকের বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বাঁচে, ধার করে বাঁচে। কিন্তু ওদের জীবনের আনন্দ কম নয়। মঞ্চের উপরে দুই ভাগ। যখন ২৬ বছর আগে এই চরিত্র করা হয়, তখন যুবক ওসমান।

কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আত্মপ্রকাশ করেছিল এই প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন দিয়েই। বলতেই হবে সাহস লাগে তো এমন একটি প্রযোজনা নিয়ে থিয়েটার শুরু করতে! তারিখ ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর। চিলেকোঠায় দেখা ওসমান তখন যুবক। আজকের দিনে তিনি আরেকটু পরিণত হয়েছেন। কিন্তু চরিত্রের জন্যে বয়সের দাবি? হ্যাঁ, তাই তো মেকআপ আর্টিস্ট… তার দক্ষতা দেখিয়েছেন।

ঠিক, দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না যে…। শুনেই হেসে ফেললেন। ওটাই তো ম্যাজিক। গোটা দলের সঙ্গে কেমন মানিয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই তো ব্যাপার। নির্মাণের মধ্যে অভিনেতার আত্মনির্মাণ।

নিজেকে সেই চরিত্রে কেমন লাগছিল?

ওসমান আদপে অন্তর্মুখী চরিত্র। যে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। অসম্ভব একটা ব্যাপার। আপনি করলেন। সেই হাতনাড়া। বিড়বিড় করা। একটু কুঁজো হয়ে ঝুঁকে কি যেন চেষ্টা ওসমানকে দর্শকের কাছে তুলে ধরার। আপনি করেছেন সেটা। এত দীর্ঘ চেহারায় কীভাবে ওই বিষয়টায় মিলিয়ে দিলেন? এবং একবারও তো মনে হল না যে আপনি অভিনয় করছেন! অথচ ২৬ বছর…। কম তো নয়। এক মহৎ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া। সেটা অভিনয় করার জন্যে বড় টিম ওয়ার্ক। এই যে চ্যালেঞ্জ… বড় টিম নিয়ে কাজ করা। সঙ্গে কি বিশাল সেট, মানে মঞ্চসজ্জা। হ্যাঁ, তারই প্রতিক্রিয়া নিতে বার্তালাপ।

দলের তরফে অভিনেতা নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের প্রতিক্রিয়া নিই। তিনি জানান যে, ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত নিয়মিত চলেছে প্রযোজনাটি। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, অন্যের রাজ্যেও অভিনয় হয়েছে। ২০২৩ সালের এই প্রযোজনা হল নাটকের পুনর্নির্মাণ।

ভাগ্যিস এবারে দলের জন্মদিনে একাডেমিতে এই নাটক দেখার সুযোগ হল! আগেই বললাম … কী কী করে হল। যেখানে ১৮টি চরিত্র। দলের ৩ জন পুরনো প্রোডাকশনের সঙ্গে বাকি নতুন ১৫ জনের টিম। নবীকৃত  প্রযোজনাটির অভিনয় ২৫ জুন ২০২৩, রবিবার সন্ধে ৬-৩০ একাডেমি প্রেক্ষাগৃহে।




যে দর্শক উপন্যাসটি না-পড়ে এসেছেন তার কথা থাক। যা পড়ার তা হল গিয়ে, মূল উপন্যাস লিখেছেন প্রখ্যাত লেখক আখরোজ্জামান ইলিয়াস। প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের। মূলত ১৯৬৮-৬৯ সাল। যখন বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। নাটকের স্ক্রিপ্ট বা নাট্যরূপ দিয়েছিলেন সমীর দাশগুপ্ত। তিনি প্রয়াত। মঞ্চে নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনের দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে।  উপন্যাসের গতি, তার চরিত্র দিয়ে আন্দোলনের যে গতি, তাই বজায় রাখতে নাটক। একইভাবে সেই গতিই রাখা হয়। মধ্যবিত্ত দোলাচল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, অতি বাম-আন্দোলন থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির আন্দোলন পর্যন্ত এই বিস্তার। একদিকে খিজির, মজলুদের জীবনের লড়াই। অন্যদিকে মঞ্চে একাই সেপাই চিলেকোঠা থেকে নেমে আসা ওসমান। নেমে আসা মানে, ওই যে দুই তল উল্লেখ করেছি। সেটাই। ওসমান থাকে চিলেকোঠায়। আর মঞ্চের নিচের তলে আরও চরিত্ররা। একদিকে শহরকেন্দ্রিক যে  আন্দোলনে ওসমান, খিজিরদের মতন প্রলেতারিয়েত বর্গের প্রতীকরা। অন্যদিকে, গ্রামবাংলার খিজির, এবং তার সমগোত্রীয় চরিত্র চেংটু চরিত্র। একদিকে আনোয়ার যে কিনা অতি বামপন্থী। এবং গ্রামে যাচ্ছে পার্টির নির্দেশে আন্দোলন সংগঠিত করতে। এই যে নগর থেকে একজন লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আন্দোলন করার সুবাদে আনোয়ার চেংটু একত্রিত হয়। বা খাইবার গাজির মতন রহমতুল্লা চরিত্রেরা আরেকদিকে।

হ্যাঁ, এভাবে লিখে গেলে লিখতেই পারা যায়। কিন্তু পাঠকের জন্যে লেখা তো! তাই, পাঠকের জন্যে সহজ করে দেওয়া যে, মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই নাটক। একদিকে বাংলাদেশের ৫০ বছর, আর ভারতের ৭৫ বছর। হ্যাঁ, তাই তো মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে খিজিরদের কথা ভাবতেই হয়। কতটা মুক্তি পেয়েছে খিজিরের দল। যা নাট্যরূপ তাতে তো অনেক অনুচ্চারিত কথাই অভিনেতার বুঝিয়ে দেওয়ার দায়। নাটকের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। যেমন, সময়ের সীমাবদ্ধতা। মোটামুটিভাবে নাটক দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করতে হবে। আগে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার হত, এখন তেমন করলে চলবে না।

হ্যাঁ, ফের এখনের কথায় আসতে হবে।

এখন অর্থাৎ ২০২৩ সালে যিনি খিজির করছেন, তিনি পুরোপুরি এদেশের লোক। মানে আগে যিনি অভিনয় করতেন তিনি বাংলাদেশের? জানা গেল, এর আগের যাঁরা করছিলেন তাঁদের উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার সূত্র ছিল। এখনের খিজির এপারের বেড়ে ওঠা শিল্পী। কিন্তু শিল্পী মানে দুর্দান্ত করেছেন তো? বোঝার উপায় নেই তিনি যে শুধুই ভাষা-শব্দ উচ্চারণ রপ্ত করেছেন। নিখুঁত অভিনয়। আর যা বাকি রইল, তা পরের সংখ্যায় লেখা যাবে।

 _ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী