কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


আয়লার ঝাপটা

আয়লা স্লেটে জল ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে বলছে, জলের পোকা জলে যা, আমার স্লেট শুকিয়ে যা। আর ওমনি শুকনো পাথরের ওপরে আঁকা পাহাড় ঝর্ণা দেবদারু পাইনের বনাঞ্চল জেগে উঠলো। কতোদিন এমন হয়েছে, আয়লা আর আমি, গল্ফ মাঠের পূর্ব দিকের কবরখানার মাটি খুঁড়ে খুদে খুদে পুতুলগুলোকে তুলে এনেছি। পুরুষপুতুল হলে সে আয়লা। আর মেয়েপুতুল হলে রুমাইয়া। তারপর হি হি হি হি...

দাদুকে খুব মনে পরছে। দাদু বলতেন, এ পাথরের নাম গ্রানাইট। মাটির গভীর অন্ধকার খনিতে এ পাথরের জন্ম হলেও এর নাম জ্ঞানপাথর। মানুষের প্রথম শেখা অক্ষরের জন্ম হয় এই পাথরের গায়ে। একজন ঘুমন্ত মানুষ মরা আর জাগ্রত মানুষ গ্রানাইটের স্লেট।

সে আমলে নাক ফুটিয়ে সুতো বেঁধে দেওয়া ছিলো একটা চল। সুতো শুকোলে নিমের কাঠি। এরপর তো নথ! আয়লা সে সময় আমাকে বলেছিলো, রুমাইয়া, তোর নাকে আমার মা-এর মতো পোখরাজের একটা নথ আমি গড়িয়ে দেবো। নিমের কাঠি শুকোলে যেদিন আমি আয়লার সামনে দাঁড়িয়ে নোলক পড়া নাককে মুখ বেঁকিয়ে দেখাচ্ছিলাম, ও আমায় বলেছিলো, তুই জল ন্যাকড়া দিয়ে মোছার পরে স্লেটের আঁকিবুঁকির নদী হয়ে হারিয়ে যাবি না তো! আমি বলেছিলাম, তুই আবার আঁকবি আমাকে! আমাকে আবারও মুছে ফেলবি। জানিস আয়লা, মা বলেছে, মুছে ফেললে মরা। আর নতুন করে আঁকলে জীবন।

সেবার পাহাড়ে আগুন লাগলো। আমাদের ছোটো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেন! আয়লা, মায়লা - এরা গোর্খাজাতি। আর আমাদের পরিচয়? আমরা সেই বাঙালি, যে আজকে যা ভাবে, কালকে তা ভাববে সারা দেশ।

মা বললো, শোনো রুমি, এখন বড় হচ্ছো। আর আদারে বাদারে ঘুরে বেড়ানোর দিন শেষ। পড়াশোনায় মন দাও।

কার্শিয়াং সেন্ট পলস্-এর ক্লাস এইটের সেই মেয়েটাকে আমার ভেতর থেকে মুছে দেবার পরে আবছায়া ছবি  হতে শুরু করেছে।

বাবা অফিস থেকে কোয়ার্টারে ফিরে একদিন বললেন, এভাবে তোমাদেরকে নিয়ে এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। চলো, তোমাদেরকে মালদায় রেখে আসি।

সেদিনের ঘটনাটা একটা দূর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

স্কুলের গাড়ি থেকে নেমে চড়াই-এর পাকদণ্ডী রাস্তায় পা ফেলে ফেলে ঘরে ফিরে আসছি। শুনতে পাচ্ছি আয়লার গলার স্বর, রুমাইয়া সরে যা সরে যা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ওপর থেকে পাথরের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছবিলাল, মনিলালরা ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলছে - হেই বঙালি, পুঁটিমাছের কাঙালি... ঠক্কাস করে একটা পাথর কপালে এসে লাগলো। আর কিছুই মনে নেই। হালকা হালকা জ্ঞান আসলে  দেখলাম, আয়লা আমার কপালের চাপ চাপ রক্তকে রিবন দিয়ে উঁচু করে বাঁধা আমার চুলের ওপরে উঠিয়ে রাখছে, আর ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে কপাল মুছে দিচ্ছে। আয়লার দু'বাহুতে ধরা আমার মাথার দিকে তাকিয়ে আয়লা বলে উঠলো -

জানিস রুমাইয়া, তুই তো তোকে দেখতে পাচ্ছিস না! তোর কপালের ওপর দিয়ে তিস্তা নদী নেমে এসেছে পাহাড় থেকে। আর সেখানে সূর্যাস্তের লাল আলো!

আমার মাথায় আঁকা সেদিনের আয়লার হাত দিয়ে রক্তরাঙা বিষণ্ণ দিনের সিঁন্দুরে মেঘের দাগ কাল্পনিক  একটা যোগ অংকের সমাধান মনে হলেও, আসলে সেটা একটা বিয়োগান্তের অধ্যায়ই ছিলো।

কার্শিয়াং সেনেটেরিয়মের ডাক্তার যোসেফ সেদিন হাঁটতে বেড়িয়ে আমাকে অচৈতন্য অবস্থায় দেখে কাঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন হসপিটালে। সর্বক্ষণ আয়লা ছিলো সাথে। সুস্থ হওয়ার পরে ওর দেখানো পথে সেনেটরিয়ামের লোকেরা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলো কোয়ার্টারে। আয়লাকে দেখে মা বলেছিলেন -

তুই আর কখনো আসবি না আমাদের বাসায়।

এরপর আরও একবার আয়লার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। জর্জিয়ার স্প্রিন্গার পিটারকে বিয়ে করে আমি চিরতরে ফিরে এসেছি দেশে। মা বলেছিলো, মনটা তোর ভালো নেই। যা না, কদিনের জন্য পাহাড় থেকে ঘুরে আয় গে!

শিলিগুড়িতে নেমে একটা ল্যান্ড রোভারে চাপবো। একা, একদম একা একা ওপরে উঠবো, এটা ভেবে গাড়ির সন্ধানে স্ট্যান্ডে পৌঁছাতেই চোখে কালো চশমা পরিহিত একজন আমাকে ডেকে বললো, আসুন ম্যাডাম, আপনি কার্সিয়াং যাবেন তো? আমি তো অবাক! লোকটা কী করে বুঝলো, আমি সত্যিই কার্শিয়াংএ-ই  যাবো? বললো লোকটা, এটা আমার নিজের গাড়ি। যত্ন করে নিয়ে যাবো। ওর মুখে পরিস্কারভাবে বাংলা কথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলে ও জানালো, বাংলাটা ও ভালোই জানে।

গাড়ি চলতে শুরু করলে ওর পেছন ঘুরে বসার ধরন দেখে আমি বলে উঠলাম, আয়লা না? শোন, আমি স্প্রিংগারের হাতে মার খেয়েছি। এরপর আরও অনেক কিছুই খেতাম। তবে, তোর কথা মনে হতেই সোজা প্লেনে চেপে দেশে, আর দেশে ফিরেই -

দুজনে একসাথে হাতে হাতে থাপ্পড় দিয়ে বললাম -

কার্শিয়াং!  এরপর, হা হা হা হা...

রঙ্গিতের কাছে একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা দুজনে নেমে গিয়েছিলাম জঙ্গলের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া তিস্তার দেখা পেতে।

মেঘভাঙা বৃষ্টি আর বরফ গলা বাড়বাড়ন্তে তিস্তার নাম তখন বিভীষিকা ! মানুষের সচলায়তনের কত কিছুই যে সেদিন তিস্তার জলে ভেসে এসেছিলো, বললো, আয়লা।  আরও বললো, জানিস, বোরোলি মাছের মৃতদেহ ভেসে আসছে ক'দিন থেকে নদীর জলে।

আমি ওকে বললাম, আয় -

আজ আমরা দু'জন পুরুষ আর স্ত্রী বোরলি মাছ হয়ে নদীর জলে সাঁতার দিয়ে মাছের জন্ম দিই।

ঝপাং করে শব্দ হলো। আর আমার বহুদিনের নারী কামনার ভিতরে আয়লার শরীর মিশে যেতে যেতে জলের মধ্যে দু'জনে ঝড় তুললাম। আয়লা বলেছিলো, ছেলে হলে রেখে যাবি সেনেটরিয়ামে। সে আমার হবে। আমি নিয়মিত খোঁজ রাখবো, তুই কবে সেই কাজটা করবি! আর মেয়ে হলে? প্রশ্ন করতেই ও বললো, মিস জর্জিয়া? সেটা তোর। আর শোন, আজকের স্মৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমার মা-এর পোখরাজ পাথরের নাকছাবি, তোকে দিলাম। যত্নে রাখিস।

এই বুকাই, তোকে নিয়ে আর পারি না! এটা বৌমার গলার আওয়াজ। এই বৃদ্ধ বয়সে আর এখান সেখান  করতে না পারলেও, রিটায়ারমেন্টের পরে মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় ছেলে বৌমা মালদায় আসে আমাকে দেখতে। ওদের প্রথম সন্তান ছেলের পরে একটি মেয়ে হয়েছে। এবারে সাথে করে নিয়ে এসেছে বাচ্চা ধরার জন্য একটি বাচ্চাকে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে দোতলার বারান্দার রেলিং থেকে দেখলাম,  সেই কামলি মেয়েটির ছ্যাঁদা করা নাকের সাদা সুতোয় টান দিয়েছে বুকাই। আর তাতেই রক্তারক্তি কান্ড।

বৌমা আদর করে গজ তুলো দিয়ে মেয়েটির নাকের রক্ত মুছে দিয়ে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিলেও মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। আর আমার আদরের নাতি বুকাই?

সে তখন আস্ত একটা তিস্তা নদীর বোরলি মাছের বছর বারো'র সংস্করণ।

সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলাম নীচে। আর কামলি মেয়েটির হাতে আমার স্মৃতিমধুর যন্তরমন্তরের সাঁতারের কোর্স করা নাকছাবি তুলে দিয়ে বললাম,

এই নাও। এই পোখরাজ পাথরের নথটা তোমার।

রঙ্গিত ওপর থেকে বলছে, মা ও মা, কোথায় গেলে? এই দেখো, তোমার তিস্তার কান্ড! কার বা ঘরের গয়নার বাক্স ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন