কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

প্রণব চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


জীবকের ডাইরী থেকে

ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিলো রিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তার সেলফ-অপারেটেড ব্যবস্থাপনায়। এই সেলফ-অপারেটেড ব্যাপারটিকে আগে একটু ফাকাফাকি করে নেয়া দরকার। কিছু কিছু মানুষ দেখবেন যারা নির্দিষ্ট রুটিনের বাইরে একপা ফেলবার আগে ১৪৩ বার ভাবতে থাকে। তাদের খাওয়া ঘুম তৃষ্ণানিবারণ ঘড়ির কাঁটা এবং মিলিলিটার, ক্যালোরি ইত্যাদি দিয়ে বেঁধে রাখা। বিনোদন, বায়োস্কোপ, হিক্কা ও হপিং সবজুড়ে কোথাও কোনো তছনছ নেই। কখনও কোথাও হাসবার প্রয়োজন হলে চারপাশ ভালো কোরে মেপে নিয়ে একঢোঁক ফিক। ব্যাস। হাসি এবার গলতা ধরে নষ্টমেয়েদের পাড়ায় "আয়না বাবু, বউ বকবে বুঝি, হিহিহিহিহিহি"! তো এই সেলফ-অপারেটেড বায়োস্কোপটির সঙ্গে 'দশচক্রে ভগবান ভুত' হওয়ার মত অদৃশ্য পাণ্ডুলিপি অনুসরণে আমারও পরিচয় ঘটে গেলো এই জগৎ রঙ্গমঞ্চে। তো চল বেহারা বনপথে আঁধার ধরি  ধরি চল। তারপর সেই আঁধারে ফেলে রেখে পলায়ে যেতি মন চাইলে, কেটে পড় শালা। আঁধারেই সাপটা-সাপটি ঘাপটা-ঘুপ্টি করে যে চুলোয় যেতে চায় পাণ্ডুলিপি সেই গোল্লায় চলে যাওয়া যাবে। এইসব ভেবে, কাণায় কাণায় ডোববার আগে মনস্থির করে নেয়া গেলো যে, ঘেঁটি ধরে তার সেলফ-অপারেটেড থেকে 'সেলফ'টিকে খুলে ফেলে দিতে হবে, তারপর অপারেটেড-এর ইয়েতে ১৩ বার ইয়ে কোরে বিশুদ্ধ এক নাবাল মানবশিশু, অসহায় দাঁড় করাতে হবে শূন্যে ভাসমান ও নিরন্তর ঘূর্ণায়মান এই নীল গ্রহটির পিঠে। দ্যাখ ক্যামন লাগে, লক্ষ কোটি বছরের এই অর্থহীন আসা-যাওয়ার গোলকধাঁধায় বেশি কেতাগিরি করতে গেলেই গোবর্ধন। মানে পেছনে বাম্বু হাতে দাঁড়ায়ে রয়েছে মহাকাল, মোছামুছি শেষ কোরে দাঁতকেলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলবে "অনেক করেছিস, এবার খোঁদলে আয় বাছা"! তারপর যা পড়ে থাকে তাকে চরণামৃত বলে কেউ কেউ ঢোকে ঢোকে গিলে সামনে পেছনে শুদ্ধ রাখার বায়না ফাঁদিয়ে বসে। সুতরাং আয়, আগে তোর সেলফ-অপারেটেড অহঙ্কারটাকে চেটেপুটে খাই, তারপর তোকে নিয়ে খেলব কাদায়, কাঁকড়ে, কাশবনে যেখানে যেমন পাব উল্টে-পাল্টে-সাল্টে ইত্যাদি। আমার উঁ, আমার ইঁ, আমার উঁহু, আমার আঃ... এইসব। তো এখন "মিশন রিনরিন চিনচিন খুলুখুলু ফাঃ"!

পরিচিত হওয়ার তি্নদিন পরে, এক জঙ্গলী দুপুরে, কারণ তখন এক জঙ্গলে তিনদিন শেয়ালের ডাক শুনতে ঘাঁটি গেড়েছিলেম। তো দুপুরেই নিজেকে ভিজিয়ে বসে আছি। গোপনে বলি ছিলিমে তেমন যৌন-আকর্ষণ টানেনা বিশেষ যতটা টের পাই কর্পোরেট গরু মার্কা চকচকে বোতলে। অফ-শপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেই বেল্টের নীচে বিলবিল করতে থাকে ঢাকুচুকু ঢাকুচুকু ঢিপ। যেমন বুক বাজছে তেমন চুকচুক। তো সে সব থাক, গল্পে ফিরি। শুনেছিলাম সে বনে নাকি চিতাবাঘ আছে এবং সুযোগ পেলেই পাশের বনবস্তীতে হামলা কোরে ছাগল শুয়োর তুলে নিয়ে আসে। মানুষও দু-একজন তার থাবা খেয়েছে তবে সবাই তারা মেয়েছেলে বা নারীপ্রজাতির মানুষী। নরম মাংসে বাঘেরও খুব লোভ, আমাদের মত ব্যাটাছেলেগুলো তো কোন ছাড়! কিন্তু তাদের আশেপাশে মানে সেই মেয়েলোকদের আশপাশ থেকে তাদের ঘরের অন্য মানুষেরা দলবেঁধে তেড়ে আসায়, থাবা মেরেই পালিয়েছে, টুঁটি ছেঁড়ার সুযোগ পায়নি। শরীর কেবল বাঘদাঁতের দাগ নিয়েই রোজ রাতে ঘুমোতে যায় নিজের বাঁধা খাঁচায়। সেই বনে এসে আমার ভাগ্যে এখনও হুক্কাহুয়া ছাড়া কিছুই জোটেনি। তাই নেই-তহবিলের সুযোগে কর্পোরেট গরুমার্কা চকচকে লেবেলবাজিতে না গিয়ে, সরাসরি বনবস্তি থেকে জুটিয়ে আনা ঘরে তৈরি পচাই হেব্বী চিতিয়ে রেখেছে। এখন চিতা দেখলেও সেটা শেয়াল ছাড়া আমার কাছে তার  কোনও গুরুত্ব নেই। দেখা পেলে খুব বেশি হলে একভাঁড় অফার কোরেই নাক ভরে তার গায়ের গন্ধ নেব, তারপর সে আমাকে খাক বা আমি তাকে যা ইচ্ছে করি, করে দেখা যাবে। এখন ভাবনা ধরেছে সেলফ-অপারেটেড রিন। অপারেশন রিনরিন চিনচিন খুলুখুলু ফাঃ-- 

ভাবনা ধরতেই টিপে দিলুম হাতের পাঁচ। দবদবে সিগন্যাল। এক টেপাতেই ক্যাচ। হুমহুম বেজে উঠলো ভবের সংসার। ওপারের বায়ু এলো-- ব্যস্ত আছি, পরে আসছি। আসুক, বরং এই অবসরে একটা বনের ঠেক মোবাইল ক্যাচ মেরে ঠেলে দিলুম গলতায়। এক ছবিতেই ম্যাজিক। দুদ্দার ফোন এলো--

    -- এখন কোথায়?

    -- জঙ্গলে। চিতাবাঘ ঘুরছে চারপাশে। আমার গন্ধপেয়ে ঝোপে এসে লুকিয়ে বসে আছে, যে কোন সময় ঝাঁপ দিয়েই আমার টুঁটি ...

    -- এই শুনুন

    -- না শুনব না। আগে বলো শোনো!

    -- ঠিক আছে, শোনো, তুমি ঘরে ঢুকে ভালো কোরে দরজা লাগিয়ে দাও। একদম রিস্ক নেবেনা।

    -- পাগলী বলছে কী? একা একা এই ঝকঝকে আলোয় ঘরে ঢুকে দরজায় আগল? নেভার। তুমি সাথে থাকলে, ঘর থেকে তো বাইরেই বেরোতাম না।

    -- খুব অসভ্য।

    -- এই, প্লীজ, চলে এসো না!

    টের পেলাম রোদের তাত পেয়ে পচাইয়ের ধুনকি একেবারে খোলা হাতে ব্যাট করছে।

    -- উঁম, আমার বুঙ্কু টুঙ্কু চুঙ্কু, এসোনা, সামনে চিতাটাকে বসিয়ে রেখে তোমাকে কড়মড় কোরে চিবিয়ে চুষে চেটে একেবারে তুমি ইভ আমি আদম হয়ে যাব।

    -- তুমি নেশা করেছ

    -- করেছি তো, তোমার নেশা! সামনে তোমায় না পেয়ে হাতের কাছে পচাই পেলাম খেয়ে নিয়েছি!

    -- এই শোনো, তুমি আমাকে নিয়ে যা যা করতে চাও, সব কোরো, আমি একদম বাধা দেব না, কিন্তু আপাতত প্লীজ ঘরে ঢুকে যাও। চিতাগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না। তারপর... কি যে করি আমি এখন...

    -- রুটম্যাপ মোবাইলে দিচ্ছি, এখন আসা শুরু করলে সন্ধ্যার মধ্যেই ঢুকে যাবে। এসে আমাকে ফোন করবে। বাহাদুরকে বলে তোমাকে নিরাপদে ঢুকিয়ে নেব। আর যদি তুমি না আসো, আমি অনেক নেশা করব, মাতাল হয়ে জঙ্গলের গভীরে চলে যাব আর চিতা আমাকে নিয়ে...

    -- নাঃ-- (মোবাইল ফাটিয়ে একটা চিৎকার এসে কানের গোড়ায় হামলে পড়ে। তারপরেই একটা গোঙানি এবং) আমি আসছি।

পাঠক বিশ্বাস করুন, ব্যক্তিগত গাড়িভ্রমণ যেহেতু তাদের প্রথম পছন্দ, রিন একটু  রাত হলেও এসেছিলো, তাকে পচাই দিয়েই আমি অভ্যর্থনা জানিয়েছি, সে গ্রহণ করেছে, আমাকে স্থির থাকতে দেখে সে নিজেই খুলে ফেলেছে সমস্ত পোষাক, খুলেছে আমারও এবং জড়তাহীন আমার শরীরে শরীর রেখে প্রতীক্ষা করেছে আমার চিতা হয়ে ওঠার।

না, পরফিরিয়াস লাভারের সেই পরিণতি অনুসরণ কোরে আমি তার মাথার চুল তারই গলায় জড়িয়ে সেই সমর্পণকে অর্থহীন করবার জন্য আওড়ে উঠিনি-- I strangled three times her little throat around এবং এমনকি ঘরের ঘড়ি বা ঈশ্বর এমন সমর্পণে মুগ্ধ হয়ে সারারাত দাঁড়িয়েছিলো সে ঘরে নিশ্চল, নিশ্চুপ--  না, তেমন কিছু নয়। বরং মৃদু আদরের শেষে আমি তার নগ্নতা থেকে আপ্রাণ মোছাতে চেয়েছি নিয়মতান্ত্রিক বাঁধনের দাগ, ক্ষত। দুহাতে তার শরীরটাকে কোলে তুলে নিয়ে কুটীরের বাইরে এসে দাঁড় করিয়েছি ফরেস্টের ঘাসে। দূরে জ্বলা আলোয় আমরা দুজন নগ্নচারী। বৃক্ষসকল এবং অন্ধকার আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। রিন তার ফিকে হওয়া নেশার মধ্যেই শুধু হাসছে, মাঝে মাঝেই আমাকে তীব্র জড়িয়ে কলকল নদীর স্রোতের মত হেসে যাচ্ছে খুব। এ যেন মুক্তির হাসি, সভ্যতার সাজিয়ে রাখা অনন্ত ফাঁস-- সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয়, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, অক্ষমতা কেমন ঝুরঝুর কোরে ঝরে পড়েছে তার পায়ের পাতায়।  

এভাবে বেশ কিছুটা সময় আমরা বাইরে এদিক ওদিক ঘুরে নেশা যখন ঝিমিয়ে এসেছে অনেকটাই, আলতো তার কানের কাছে ফিস্ফিস করে বলি, 'রিন, কেমন লাগছে?' সে যেন কিছু বলতেই চাইছিলো। আমাকে জড়িয়ে প্রায় ঠোঁটের কাছে ঠোঁট রেখে বলে, খুশি, খুশি, ভীষণ আনন্দ লাগছে জীবক! এ জীবন আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি, স্বপ্নেও না। এর পরের চুমুদৃশ্য থেকে নজর সরিয়ে রাখার যেহেতু কোনও দায় নেই কারও, ক্যামেরা বরং চরিত্রদের সাথেই ঢুকে যাক কটেজের ভেতর পাথর ছিটকে পড়া প্রপাতের মতো জীবক ও রিনের আদিম বন্যতায়। পাঠক শুধু মনে রাখবেন গভীর নিয়মতান্ত্রিকতার গভীরেও নিয়ত যে ক্ষরণ, প্রতীক্ষায় থাকে কিছু মুক্ত সংবেদনের। হ্যাঁ, মানবিক কোনও হাত, কোনও আহ্বান, শর্তহীন সাঁতারের দিকে তুলে দেয় পাল...

 


1 কমেন্টস্: