কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

সুতপা মুখোপাধ্যায়

 

মেয়েদের লেখাপড়া ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ




২৬শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পার হল। নানাদিকে নানা বক্তৃতা, লেখালিখি, বিবিধ অনুষ্ঠান তাঁর জীবন নিয়ে, তাঁর কর্ম নিয়ে। প্রায় প্রতি বছরই মনে হয় কি হত আমাদের, মেয়েদের, তিনি না এলে? বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনের পশ্চাতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় সে তো আমরা জানি। বহুবিবাহ নিবারণ সেও তো বাঙালির ঘূণধরা সমাজের মর্মমূলে দারুণ এক আঘাত। এ সবের জন্য  প্রয়োজন ছিল মেয়েদের লেখাপড়া শেখা যাতে জীবনকে জগতকে ভালোভাবে বুঝতে পারে তারা। উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ের লেখাপড়ার জন্য অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করতে গিয়ে সবসময় ইচ্ছে করে ফিরে দেখতে সেই ইতিহাস। যা আজ অনেক সহজে পাওয়া যায় তাকে অর্জনের জন্য কম কঠিন পথ পার হতে হয়নি মেয়েদের। মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি যেমন সমর্থন গড়ে উঠছিল উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে, তেমনই তার বিরোধিতার করার জন্য ছিল আরও বেশি সংখ্যক মানুষ। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় রামমোহন রায়ের কথা— “স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন, যে অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন?” রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রধান থেকে শুরু করে ইয়ং বেঙ্গল দল এবং সংস্কারবাদী বাঙালি সমাজ মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকে মিশনারি সম্প্রদায় এদেশে সংস্কার কাজে উৎসাহিত হয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখায়। অবশ্য তার মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল অনেকখানি। হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারগুলি, বিশেষত মেয়েদের দমিয়ে রাখার বিষয়গুলিকে চিহ্নিত করে ভারতের পশ্চাদগামী সভ্যতার স্বরূপ উন্মোচন জরুরী হয়ে ওঠে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য। ১৮১৯ সালে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সোসাইটি কলকাতায় মেয়েদের জন্য কয়েকটি স্কুল খোলে। এর মধ্যে ব্রিটেন থেকে আসেন মিস মেরি অ্যান কুক। চার্চ মিশনারি সোসাইটির সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় আটটি বিদ্যালয় খোলেন মেয়েদের জন্য। খ্রিষ্টান মিশনারিরা কলকাতার বাইরে অন্য জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বিদ্যালয়ে প্রধানত সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মেয়েরা পড়তে আসে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার বিষয়টিতে অনেক বাধা রয়ে যায়। কিন্তু, ধীরে ধীরে একটু একটু করে বাঙালি মননে পরিবর্তন আসতে থাকে।

বাঙালি সমাজের ভিতর থেকেই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। গোলাম মুর্শেদ তাঁর Reluctant Debutant গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে বিশ এবং তিরিশের দশকে বাগদি, ব্যাধ, বৈরাগী প্রভৃতি সমাজের নিম্নবর্ণের মেয়েরা এবং বারবনিতাদের মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ছিল। তিরিশের দশকে ভদ্রলোক সমাজের কয়েকজন তাঁদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর বাড়ির মেয়েদের বৈষ্ণবী ও মিশনারিদের সাহায্যে শিক্ষিত করে তোলেন। তাঁর প্রথমা কন্যা সুরসুন্দরী খুবই আগ্রহের সঙ্গে লেখাপড়া শিখেছিলেন অনেকখানি। এমনকি রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি রাধাকান্ত দেবও বাড়ির মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার জন্য বাড়িতেই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ১৮৪৭ সালে নবীনকৃষ্ণ মিত্র, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখের উদ্যোগে বারাসতে একটি মেয়েদের বিদ্যালয় খোলা হয়। অনেক বাধা আসে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। তবুও প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় বালিকা বিদ্যালয়। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও মেয়েদের জন্য অবৈতনিক স্কুল খোলার প্রস্তাব রাখেন সরকারের কাছে। তবে সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া তিনি পান নি। মেয়েদের স্কুল খোলার এইসব চেষ্টার মাঝেই ১৮৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এদেশে এলেন বেথুন সাহেব। মেয়েদের স্কুল খোলার যে প্রবল আগ্রহ তাঁর ছিল, সেখানে পাশে পেলেন অনেক শিক্ষিত বাঙালিকে। তবে বেথুনের এই পদক্ষেপকে সবাই ভালো চোখে নিল না। মেয়েরা যখন বেথুন সাহেবের ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলে যেতে শুরু করল তখন স্কুলের গাড়িতে চেপে, তখন তা দেখার জন্য রাস্তায় লোকে ভিড় করত। অশালীন মন্তব্যও উড়ে আসত। মদনমোহন তর্কালঙ্কার যখন তাঁর দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে ওই স্কুলে পড়তে পাঠালেন তখন অনেকেই সেটা ভাল চোখে দেখে নি। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া জমিতে স্কুলের নিজস্ব বাড়ি তৈরি হল। বিদ্যাসাগরের উপর বেথুন তাঁর স্কুলের বিষয়ে নির্ভর করতে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগর স্কুলের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। বিদ্যাসাগর দেশীয় সমাজকে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য স্কুলের মেয়েদের যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ির দুপাশে “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নত’’ শ্লোকটি লেখার ব্যবস্থা করেন। ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলের নিজস্ব ভবন নির্মাণ সম্পুর্ণ হওয়ার আগেই বেথুন সাহেবের মৃত্যু হয়। বেথুনের মৃত্যু স্কুলকে দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেয়। স্কুলের ছাত্রীসংখ্যাও ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৫৬ সালে  হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের সহায়ক এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শিক্ষিত বাঙালির উদাসীনতা নিয়ে দুঃখ করে। ১৮৬২ সালের বেথুন স্কুলের রিপোর্টে বিদ্যাসাগর কলকাতার শিক্ষিত পরিবারগুলির বাড়ির মেয়েদের পাঠানোর ক্ষেত্রে দ্বিধার উল্লেখ করেন। তবে বেথুন স্কুল বাংলায় মেয়েদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে থাকে। অনেকেই মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। শুধু কলকাতা শহর নয়। বাংলার মফস্বল অঞ্চলেও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়। মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সরকারের সাহায্য পাবেন এই বিশ্বাসে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন জেলায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বর্ধমানের জৌগ্রামে তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলেন ১৮৫৭ সালে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সাধক চরিতমালা তে উল্লেখ আছে যে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়গুলির জন্য মাসে ৮৪৫ টাকা খরচ হত। ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৩০০। হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই কাজে সরকারি সাহায্যের যে আশা বিদ্যাসাগর করেছিলেন তা পাওয়া যায় নি।  তিনি ১৮৫৮ সালে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনকে চিঠি লেখেন যাতে তাঁর হতাশার চিত্রটি স্পষ্ট থাকে। তিনি লেখেন, “হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলার অনেকগুলি গ্রামে বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। বিশ্বাস ছিল, সরকার হইতে মঞ্জুরী পাওয়া যাইবে। স্থানীয় অধিবাসীরা স্কুল-গৃহ তৈয়ারি করাইয়া দিলে সরকার খরচ-পত্র চালাইবেন। ভারত-সরকার কিন্তু ঐ সর্ত্তে সাহায্য করিতে নারাজ, কাজেই স্কুলগুলি তুলিয়া দিতে হইবে... প্রথমে আপনি, অথবা বাংলা সরকার এ বিষয়ে কোনরূপ অমত প্রকাশ করেন নাই; করিলে, এতগুলি বিদ্যালয় খুলিয়া এখন আমাকে এমন বিপদে পড়িতে হয়ত না।” এই চিঠি সরকারের বিভিন্ন মহলে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। তবে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সরকারের নাজেহাল অবস্থার জন্যই হোক বা উদাসীনতার কারণেই হোক বিদ্যাসাগর স্থায়ী সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিতই থাকলেন। ১৮৬৬ সালে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন মেরি কার্পেন্টার। তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগরের কাজের গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৬৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাঁরা উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে বিদ্যাসাগর পথ-দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়াসে তিনি ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অধিকার নিয়ে বাংলার শিক্ষিত গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক জারি থাকল ষাটের দশক থেকেই। স্ত্রীশিক্ষা কেমনভাবে দেওয়া হবে তাই নিয়েও মতান্তর দেখা দিল। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশব চন্দ্র সেন যিনি মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন তিনি ‘স্ত্রীজনোচিত’ শিক্ষার কথা বললেন। ব্রাহ্মসমাজের ভিতরে অনেকেই তাঁর মতকে সমর্থন করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই আবার এই মতের বিরোধিতা করলেন। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখরা মেয়েদের জন্য জ্ঞানচর্চার দরজা খুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বললেন। ১৮৭৩ সালে এঁদের হাত ধরে স্থাপিত হয় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় পরে যার নাম হয় বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে দুর্গামোহন দাসের ভার্যা ব্রহ্মময়ী এই স্কুলটির জন্য মাসে মাসে অর্থ দান করতেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে এই স্কুলের জন্য দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণ করেছেন যিনি শিক্ষক হিসেবে দিনরাত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে ছাত্রীদের লেখাপড়ায় অনুপ্রাণিত করেন। সরকারি রিপোর্টেও স্কুলটি প্রশংসিত হয়। কিন্তু আর্থিক সংকট স্কুলটির অগ্রগতি রোধ করতে থাকে। ১৮৭৮ সালে এই স্কুলটি বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে যায় যা বেথুন স্কুলের অগ্রগতিতে সাহায্য করে, কারণ সরকারি অনুদানের অভাব না থাকলেও বেথুন স্কুলে ছাত্রীর অভাব ছিল। ১৮৭৮ সাল থেকেই মেয়েরা বিভিন্ন পরীক্ষায় বসতে থাকে। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে সমাজের এক অংশের বিরূপতা জারি থাকে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে মুসলমান শিক্ষিত সমাজেও মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয়। বালারঞ্জিকা পত্রিকার সম্পাদক আবদুর রহিম মেয়েদের লেখাপড়ার সমর্থক ছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার জাহিরুদ্দিন আহমেদ তাঁর মেয়েকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির ধর্মের কারণে তাকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। সমকালীন বামাবোধিনী পত্রিকা মুসলমান মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সরকারের কর্তব্য বলে মন্তব্য করে। মুসলমান শিক্ষিত সমাজও মেয়েদের বিদ্যালয়ের দাবি জানায়। ১৮৯৭ সালে মুসলমান মেয়েদের জন্য কলকাতায় আলাদা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মেয়েদের শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে মুসলমান সমাজের মধ্যেও দ্বিধা দেখা যায়। মুসলমানসমাজের মুখপত্র বলে গণ্য হওয়া মিহির ও সুধাকর পত্রিকাটি যদিও প্রথমদিকে মুসলমান মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, পরবর্তীকালে তার মতামত কিছুটা পালটে নেয় পত্রিকাটি। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়া কেমন হবে সেই বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল যে মেয়েদের শিক্ষা হবে এমন যা অন্তঃপুর, সমাজ ও ধর্মের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে না কোনভাবেই। কলকাতার বাইরে বৃহৎ বঙ্গে অবশ্য সত্তরের দশক থেকেই মুসলমান মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল।

দেখে নেওয়া যেতে পারে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার সপক্ষে কী কী বই লেখা হয়েছিল। প্রথমেই মনে আসে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক এর কথা। রচনাকাল ১৮২২। মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে জনমত গঠনে এই বইটির ভূমিকা ছিল অসামান্য। রাধাকান্ত দেব এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল যিনি গৌরমোহনকে এই বইটি লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এই বইটির বিক্রি ছিল চোখে পড়ার মত। পুরাকালের ভারতের শিক্ষিত মেয়েদের কথা তুলে ধরে তিনি লেখেন যে সেইসব মহিলাদের বিদ্যাচর্চার ফলে কোন অখ্যাতি হয়নি। তিনি লেখেন বিদ্যাচর্চা থাকলে পাপকাজে অশ্রদ্ধা জন্মে। তাঁর বই নিয়ে সমাচার দর্পণ সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকাদুটি  পক্ষে বিপক্ষে মতপ্রকাশ করে। ১৮৫০ সালে তারাশঙ্কর তর্করত্ন রচিত ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা প্রকাশিত হয় যা মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করে। ১৮৫১ সালে সম্বাদ ভাস্কর পত্রিকা এই গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করে। ১৮৫৬ সালে হরচন্দ্র ঘোষ লেখেন অ্যান অ্যাড্রেস অন নেটিব ফিমেল এডুকেশন ১৮৫৭ সালে স্ত্রীশিক্ষা বিধান লেখেন দ্বারকানাথ রায়। ১৮৫৯ সালে রামসুন্দর রায় লেখেন স্ত্রীধর্ম বিধায়ক। মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে উনিশ শতকে বিবিধ মতামত প্রকাশিত হতে থাকে। মেয়েরা যে সেইসব তর্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেন না এমনটা কিন্তু নয়। ১৮৬৫ সালে কৈলাসবাসিনী দেবী লিখলেন হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস ও তাহার সনুন্নতি। ১৮৬৩ সালে তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা। মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা ছাড়া মেয়েরা যে দূরবস্থা থেকে উদ্ধার পাবে না এমনই মত ছিল কৈলাসবাসিনীর। তবে মেয়েদের প্রকাশ্য বিদ্যালয় গমনকে তিনি মানতে পারেন নি। মেয়েদের জ্ঞানগর্ভ ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য পড়ানোতেও আপত্তি ছিল তাঁর। তিনিও মেয়েদের সংসারের উপযোগী করে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে ছিলেন। তবে তিনি তাঁর গ্রন্থে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন কীভাবে মেয়েরা লেখাপড়া শেখা থেকে বঞ্চিত হয়ে পশুর মত জীবনযাপন করে।

নানা বিরূপতার মধ্যে দিয়েও স্কুল শিক্ষায় অগ্রগতি ঘটতে থাকে অল্প সংখ্যক মেয়ের। দুজন মেয়ে এনট্রান্স পরীক্ষায় বসার অনুমতি পান। একজন কাদম্বিনী বসু ও অপরজন সরলা দাস। সরলা দাসের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি আর পরীক্ষায় বসেন নি। কাদম্বিনী বসু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নারীশক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক তৈরি করেন। তাঁর উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি হয় বেথুন কলেজ। ১২৮৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় বামাবোধিনী পত্রিকা লেখে, “...কুমারী কাদম্বিনী ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করাতে লেপ্টেনান্ট গবর্নর বেথুন স্কুলে কলেজ শ্রেণী খুলিবার ব্যবস্থা করিয়া কটক কলেজের সুযোগ্য অধ্যাপক বাবু শশিভূষণ দত্ত, এম.. কে এখানে আনয়ন করিয়াছেন। বেথুন স্কুলে এখন শিক্ষক প্রভৃতির সুব্যবস্থার জন্য গবর্ণমেন্ট মাসে ৭৫০ টাকা দান করিতেছেন...।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য ফার্স্ট আর্টস এবং বি এ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল পরীক্ষার নিয়মাবলি। কাদম্বিনী বসু এবং দেরাদুনের চন্দ্রমুখী বসু এফ এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৮৮২ সালে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হলেন কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু। এই ঘটনায় সারা দেশে তৈরি হল ঐতিহাসিক নজির। সমাবর্তনে এত ভিড় হল যে সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়েছিল। সংবাদপত্রগুলিতেও কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখীর সাফল্যের সংবাদ ছাপা হতে থাকে।  হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন,  হরিণ নয়না শুন কাদম্বিনী বালা/ শুনও চন্দ্রমুখী, কৌমুদীর মালা/ তোমাদের অগ্রগামী আমি একজন/ এইবেলা ও উপাধি করেছি ধারণ। ... কি আশা জাগালি হৃদে কে আর নিবারে? ভাসিল আনন্দ ভেলা কালের জুয়ারে/ ধন্য বঙ্গনারী ধন্য সাবাসি তুমারে।




নানা কষ্ট, নানা বাধার মধ্যে দিয়ে উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ের লেখাপড়া এগিয়েছে। বিপুল সংখ্যক মেয়ে যে শিক্ষালাভ করতে পেরেছে তেমনটা কখনই নয়। কিন্তু এই যে বাধা ভেঙে এগিয়ে চলার প্রয়াস সেটিই পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল মেয়েদের জীবনে। সেই দ্বন্দ্বপথ ফুলে ঢাকা ছিল না কোনকালেই। তবু চলা থামেনি।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন