কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

দীপ্তিরাণী সাহা

 

সমকালীন ছোটগল্প


পান পাতায় ক্ষীর

সাগরের  একেবারে পাড়ে বসেছে ভাসা কারণ এখান দিয়েই স্নান যাত্রীরা ঘরে ফিরছে। সবাই কম বেশি পয়সা দিচ্ছে। সূর্যের তাপ বাড়ার আগেই গলায় ঝুলিয়ে রাখা গামলাটা একবার উপুড় করে সব টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে রহমত সিকদার আবার গামলাটা ভরোভরো হয়ে গিয়েছে নিজের শরীরটার দিকে একবার তাকাল ভাসা দুটো হাত কনুই পর্যন্ত কাটা, একটা চোখ নেই কাঁধে একটা ঝোলা ওতেই মরা মানুষের   ফেলে দেওয়া ছেঁড়া কাঁথা, একটা আধভাঙা সানকি, একটা ঘটি আর একটা চামচ

এই চামচটা তার বড় দরকার প্রতিদিনের খাবারের জন্য হাতের অভাবে বেশির ভাগ কাজ সে পা দিয়েই সারে দূরে ছেঁড়া চটের উপর তারই সাথী প্রকারকে দেখে মনে হল, ওর দুটো হাত দুটো পা একেবারেই কাটা, চোখদুটো থেকেও নেইদূরের কোনকিছুই দেখতে পায় না ভাসা প্রকারের থেকে অনেক সুখী সে   পায়ে হাঁটে, এক চোখে দেখে সে পৃথিবীকে অন্তত উপভোগ করছে কাটা হাতেই না দেখা সেই ভগবানকে একবার প্রণাম করার চেষ্টা করল ভাসা

এক মুহূর্তের জন্য ভাসার একচোখ খুশি আর গর্বে ভরে উঠল কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের মত আবছা জন্মদাতার মুখ মনে পড়ে তিনি তো এই ভারতমাতাকে সাধ্যমত দিয়েছেন ভাসা আরও একবার নিজেকে দেখে নিল মনে পড়লো কাল রাতের ঘটনা সে-ও তো কম কিছু দেয়নি এই ভারত মা-কে কিন্তু এই দেশ এদের মত লক্ষ লক্ষ ভাসা, প্রকার, আরীফ, ফাতিমা, লতা- কথা মনে রাখে না এরা নোংরা, কানা, বোবা   ভিখিরি এরা গলার গামলার, হাতের থালার পয়সায় সুখ ভোগ করতে পারে না পায় শুধু একবেলা ভাত আর নুন-চা এদের তিনবেলা খেতে দিলে খরচ পড়ে যাবে অনেক টাকা তাহলে কি করে তৈরী হবে বহুতল  বাড়ি, কি করে হবে গাড়ি! এসব কথা ভাসা শুনেছে রহমত সিকদারের মুখে

ভাসার গামলায় পয়সা পড়ছে ভাসার সে দিকে খেয়াল- নেই চোখের পাতা ভিজে উঠেছে মনে পড়ল  কত  পুরনো ভালবাসার স্মৃতি মনে পড়ে গেল, চেন্নাই-এর একটি গ্রামের কথা গ্রামের নামটা ভাসা আজ আর মনে করতে পারে না গ্রামটা ছিল নারকেল গাছে ঢাকা পাশেই ছিল উত্তাল সমুদ্র আর বাবা মাধব শেঠ ছিলেন ভারতের সৈনিক

ভাসার যখন চারবছর তখন একদিন কফিনে করে মাধব শেঠের লাশ এলো কার্গিল যুদ্ধে মারা গেছে ভাসার  বাবা সীতা স্বামীকে হারিয়েও শত অভাব কষ্টেও গর্ব বোধ করত ছেলেকে সব সময় বলত, দেশকে ভালবাসবে, দেশবাসীকে ভালবাসবে, তাহলে ঈশ্বর তোমাকে ভালবাসবে ভাসার মনে পড়ে মায়ের কথা মা তাকে রাতের বেলা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখতো মায়ের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ত জল কেরোসিনের আলোয় বাবা মাধবের ছবিখানা দেখতে দেখতে ভাসা ঘুমিয়ে পড়ত  

শীতের সকালে কাজে যাওয়ার আগে সীতা ছেলেকে গুড় আর চালের গুড়ো মিশিয়ে জলের ভাপে সেদ্ধ করে পিঠে তৈরী করে খাওয়াতো উঠানে বসে মাধবের বৃদ্ধা মা সারাদিন নারকেল পাতা থেকে কাঠি বের করে বিকালে হাটে বিক্রি করতো আর ফেরার সময় নিয়ে আসত নারকেল সন্দেশ এই সন্দেশ ছিল সেবকের খুব প্রিয়

প্রতিদিনের মত সেই দিনও সেবক পিঠে খাচ্ছিল ঠাকুমার পাশে বসে সামনে উথালপাথাল সমুদ্র। হঠাৎ সীতা চেঁচিয়ে উঠল, মাইঝি সামাল... বেটা সামাল... ব্যস এক মুহূর্তে সব শেষ দিন পরে সেবকের জ্ঞান ফিরল জানতে পারল, তার হাত দুটো আর নেই একটা চোখ- খোয়া গিয়েছে সব সত্যি জানতে পারল রহমত শিকদারের কাছে আর দেখা হয়নি মা-ঠাকুমার সঙ্গে সুনামী নামের কি একটা ভীষণ ঝড়জল  তার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমন কি নামটাও। জলে ভেসে গিয়েছিল, তাই তার নাম হয়ে গেল ভাসা। ভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল তার নামটাও

কিছুদিন পর হাসপাতাল থেকে ভাসাকে ছেড়ে দিলে রহমত বলল, এই ভাসা, চল তোকে বসিয়ে দিয়ে আসি ইস্টেশনে খুব জোড়ে চিৎকার করে ভিক্ষা চাইবি বুঝতে পারলি?

সেবক বুঝলো।

-এই নে ভাসা, আপেল খা

চমকে উঠল ভাসা

অর্ধেক খাওয়া একটা আপেল ভাসাকে দিল লতা

- অমন হাঁ করে কি ভাবছিলি?

লতার একটা পা নেই, অন্যটিতে আজীবন ঘা লতা ভাসাকে আনন্দে গদগদ হয়ে বলে উঠল, জানিস, আজ শেষ দিন মেলার। আজ যা ভিড় হবে না। হাঁ রে ভাসা, কাল যা কান্ডখানা ঘটালি না! রাতদুপুরে মানুষ ঠেলেও তোকে দেখতে পেনু না বাপরে বাপ কি করে করলি রে!

বলেই পা টেনে টেনে লতা চলে গেল সামনের গুটিকয় স্নানযাত্রীদের কাছে হাত পাততে

ভাসার আবার মনে পড়লো কাল রাতে বোমকাকুদের কথা ভাসা তো জানতই না ওরা বোমকাকু কাল ছিল মকর সংক্রান্তির স্নানের শেষ রাত খুব ভীড়। ভাসা ভিক্ষা করতে করতে মেলার বাইরে চলে এসেছিল ঠান্ডাও পড়েছে ঝাঁপিয়ে একটা গাছের নিচে গোটা চারেক লোক কথা বলছিল ভাসা ভিক্ষা চাইতেই তারা খেঁকিয়ে উঠল কি আর করে! এসবে ভাসার অভ্যাস হয়ে গ্যাছে। ওদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বসে পা দিয়ে গামলার পয়সা গুনতে শুরু করল। পয়সা গুনতে গুনতেই লোকগুলোর কিছু কথা ওর কানে এল। শুনে ভাসা-র শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে এলো। শুনলো, আশ্রমের সামনেই একটা জায়গায় বোমা পোঁতা আছে আর আজ রাতেই ওটা ফাটানো হবে। একটা লোক বলে উঠেছিল, আঃ কি মজা! সব খেলবাজি খতম মানুষগুলো চামচিকের মত মরবে আর তারপরেই সকালে কড়কড়ে দু লাখ।

আর লোকগুলোর সে কি বিচ্ছিরি ভাবে হাসি। ভাসার মনে পড়েছিল মায়ের কথা তুমি সর্বস্ব দিয়ে দেশকে ভালবাসবে এই দেশই তোমার প্রাণ দেশকে রক্ষা করতে যদি মরতেও হয়, তবুও তুমি ভয় পেয় না

ভাসা আস্তে আস্তে একদল পুলিশকাকুর কাছে গিয়ে বলল, কাকু বিপদ, বিপদ, পুলিশকাকু, মহা বিপদ সব মানুষ চামচিকের মত মরবে বাঁচাও, কাকু বাঁচাও

মেলায় এত মাইকের শব্দ যে ভাসার কোন কথায় পাত্তাই দিল না পুলিশরা একজন পুলিশ আবার এক টাকার কয়েন ছুঁড়ে দিল ভাসার মুখের ওপর

ভাসা সাহস করে এগিয়ে গেল আরেক দল পুলিশের দিকে বলল, কাকু বিপদ ভীষণ বিপদ একজন পুলিশ  লাঠি উঁচিয়ে বলল, এই সব ভিখারিদের সাহস দেখ্‌! পুলিশের কাছে ভিক্ষা চাইছে!

ভাসা একটু পিছিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, কাকু বিপদ্... পুলিশ কাকু, বিপদবোম বোমবিপদ! ভীষণ বিপদ!

ভিড় ঠেলে একজন সাদা পোশাকের লোক এগিয়ে এসে ভাসাকে বলল, কি হয়েছে রে? কি বলছিস?

ভাসা বলল, তোমাকে বলব না, পুলিশ কাকুকে বলব

ভদ্রলোক তখন একজন পুলিশ অফিসারকে মোবাইলে ফোন করে ডাকলেন পুলিশকে কাছে পেয়ে ভাসা জানাল, মেলার মধ্যে বোম পোঁতা আছে এবং সে কি ভাবে জানতে পারল, তাও জানাল সঙ্গে সঙ্গে উনি পুলিশ কুকুর আর আরো কিছু পুলিশ দিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারল, সবচেয়ে জনবহুল এলাকা মুনির আশ্রমের পাশেই মাইন পুঁতে রাখা আছেতারপর ধরাও পড়ল বোমকাকুদের সব টা সারা মেলা জুড়ে মহা হট্টগোল।

তারপর গাড়িতে করে ভাসাকে নিয়ে গেল একটা গাড়ি একটা বেশ বড় ঘরে সেখানে নানান ধরনের অনেক কাকু, অনেক ক্যামেরা, অনেক আলোর ঝলকানি ভাসার মুখের ওপর সে আলো যেন আর থামেই না ভোরের আলো ফোটার পর তবে ভাসা-র ছুটি হ অভ্যাসেই সে এসে বসল আবার ভিক্ষার জন্যআজ ভিড়টা তেমন নেই

ক্ষিদে পেতেই ভাসা টের পেল, বেলা হয়েছে বেশ রোদ্দুর, শীতটাও তাই কিছু কম হঠাৎ ভাসা- পিঠের ওপর সজোরে লাঠির বাড়ি পিঠে ছেঁড়া কাঁথা চাপানো থাকলেও ব্যথাটা টের পেল মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল, রহমত সিকদার চোখ পাকিয়ে বলছে, হারামির বাচ্চা, ভিক্ষা না চাইয়া পানির দিকে চাইয়া আছস ক্যান? হানে কি ? যুদ্ধ করতাছে তোর বাপ? ওঠ গাড়ি আইছে এহানকার কাম শেষ কাল থিক্যা আবার ইস্টেশনে বসবি

ভাসা, প্রকার, লতাদের ছোট লরিটা সাগর থেকে দূরে, কুয়াশার মধ্যে, ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে

আবার সেই ইস্টেশন। আবার সেই উঁচু সিঁড়ির এক পাশে।

বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। অসময়ের বৃষ্টি চলছে ক’দিন। সিঁড়ির পাশে ধুলোকাদায় সেঁতিয়ে আছে একটুকরো ঝালমুড়ির পরিত্যক্ত কাগজ কাগজে একটা ছবি। ছবিটা এক চোখ দিয়ে খুব ভালো করে দেখল ভাসা হ্যাঁ, সে ঠিকই চিনতে পেরেছেওটা তার-ই ছবি

লতা তখন একটা লোকের দিকে উঁচু করে ধরেছে তার ভাঙা সানকি।

 


1 কমেন্টস্: