কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


মন                                                           

সাইমন বুঝতে পারলো তাদের সংখ্যাও কম নয় যারা যেতে চায়। যাওয়া বললেই যাওয়া! হয় না। চাওয়া বললে চাওয়া! হয়তো যায়, কিন্তু তা অবুঝের ছেলেমানুষী। ভাবতে ভাবতে সাইমনের মন চাওয়া পাওয়া যাওয়ার মধ্যে বিচরণ করতে থাকে। এই একটা জিনিস ‘মন’। যখন তখন  ভাবে আর ভাবনাগুলোকে স্মৃতির লাইব্রেরিতে পরিপাটি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে।। আচ্ছা, মনকে কি জিনিস বলা যায়! মানে বস্তু! ধরা যায়! শুনেছি ‘মন হারলো হারালো মন হারালো’ বলে কবি লিখছেন, গায়ক গাইছেন। মন দেওয়া যায় বলেও শুনেছি! মন তো বায়বিয় সামথিং। বেঁধে রাখাও যায় না। অথচ ধরাবাঁধা জীবনে এই মন বড্ড ঝামেলাদার! যখন যা খুশি ভেবে বসে থাকে। আবার বসে থাকতেও পারে না, এমন উড়ু উড়ু স্বভাব তার। ভাবতে ভাবতেই একটা বেকারির বিজ্ঞাপনের একটা লাইন মনে পড়ে সাইমনের হাসি পেলো, ‘মনের মতো জিনিস, মনজিনিস’। পাশে ক্রিম পেস্তা আমন্ড দিয়ে গার্নিস করা একটা কেক। চার্চে প্রেয়ার করতে  করতেও সেই সাজানো কেকটা ওর মনে এসে যায়। সাথে সাথে চার্চের প্রেয়ার ভুলে সাইমনের মায়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা জোসেফ আঙ্কেলের চোখদুটোও মনে এসে যায়। মুগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে  থেকে সাইমনের মনও ফাদারের সারমন শোনা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলো। চার্চের জিসাস আর কেক আর ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ গানটা আর জোসেফ আঙ্কলের মুখটা একসাথে মিলে মিশে একেবারে একটা  বার্থডে পার্টি হয়ে যায়। সেই পার্টিতে জোসেফ আর তার মা জেসমিনের রিঙ সেরিমনিও। সেখানে  অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেকেও দেখতে পায় মাথায় লাল কাগজের টুপি পরে ঘুরে বেড়াতে। সেখান থেকে ফিরে এসেই মন জোসেফ আঙ্কেলের চোখ মায়ের চোখে মিশে যাওয়া দেখতে দেখতে একটা রিংসেরিমনির কথাও আগাম ভেবে নেয়! একমিনিটের মধ্যে এত জায়গায় ঘুরে নিলো মন! মনের এই ছন্নছাড়া ভাবনার স্পিড সত্যিই ওকে অবাক করে দেয় বারবার। তখনি আবার মনে হয় ছন্নছাড়া ভাবনা মানে কী? লিঙ্ক নেই যে ভাবনার! ছন্ন মানে তাহ’লে ধারাবাহিকতা! প্রথম ভাবনার সাথে ধারাবাহিকতা  রক্ষা করছে না যে ভাবনা-দৃশ্য! নাঃ। কিন্তু আবার ভেবে দেখলো, উহঁ কোন ভাবনাই লিঙ্ক ছাড়া ভাবে না মন! বেশ গুছিয়েই ভাবতে জানে। প্রত্যেক ভাবনাকে টাচ করে দেখো, মন ঠিক তার লাগোয়া ভাবনার লিঙ্ক দেবে, চাই কি স্টোরির ক্লু’ও দেয়ে দেবে!

 

সাইমনের বাবাও যাওয়ার কথা বলতো। বলতো, এবার যাওয়া যাক। বলতো, এবার যেতে হবে। বলতো, এবার যেতেই চাই। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি কোথায়  যাওয়া! আসলে ‘যাওয়া’ শব্দটা দ্ব্যর্থবোধক। সংসারের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ হয়ে আধ্যাত্বিক জগতে সাধুসন্তদের কাছে চলে যাওয়া। অনেকে কাব্য করে একে বলেন মায়াতাড়িত সংসার থেকে মুক্তি  চাওয়া। আরেকটা যাওয়া হচ্ছে, একেবারেই ফুরিয়ে যাওয়া। নিজেকে শেষ করে দিয়ে। প্রথম যাওয়াটা মানুষের নিজের হাতে। ইচ্ছে তীব্র হলে সে যেতেই পারে। দ্বিতীয়টা, কারো নিজের হাতে নয়। এটাও খানিক কাব্য করে বলা হয়! কবিরা বলেন, নিজেকে শেষ করে অশেষ হওয়া। গান  গেয়ে এইকথা প্রতিষ্ঠা করতে চান, বারেবারে নবজন্ম দিয়ে ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি  লীলা তব!’ কিন্তু এই ‘তব’টাকে ব্যাখ্যা করতে বললে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া উত্তর আসে। কেউ তাকে ঈশ্বর পরমেশ্বর বন্ধু প্রেমাস্পদ ইত্যাদি বলেন, আবার কেউ সর্টকাটে বলেন তিনি যমরাজ।  যদিও সবাই ভালোভাবেই জানেন যে এই দুইয়েরই কোনো অস্তিত্বই নেই। যাকে ধরা ছোঁয়া দেখা যায় না  তার কোনও ‘অস্তি’ হয় না। তবুও জানা কথাটাকেই একটা চালাকির আবরণে মুড়ে মাতামাতি কম নয়  মানুষের জগতে। এই মিথ্যে মাতামাতি সেই আদি যুগ থেকে, মানে যখন থেকে মানুষ চোট্টামিকে চালাকি দিয়ে ঢাকতে শিখলো তখন থেকেই…। ‘যম’ লোকটিকেও কেউ দেখেনি, অথচ  তাকে রাজা টাজা বানিয়ে, মৃত্যদূত হিসেবে প্রেজেন্ট করে, বড় তৃপ্তি পায় শোকাকুল মানুষের কাছে। সাধারণ মানুষেরা মনে মনে এসব চালাকি বেশ বোঝে। কারণ তারা দেখেছে, কোনও  কোনও শ্রদ্ধেয় প্রিয় মানুষের শবযাত্রায়  শোকাকুল মানুষেরা তাঁর চুলের গোছা টানাটানি করে ছিঁড়ে নেয় তার জাগতিক জীবনের স্মারক হিসেবে  রাখতে। এসবই হলো মানুষের দু-মুখিপনা।

বাবার মৃতদেহের সামনে দাঁডিয়ে সাইমনের মন এইসব লম্বা ভাবনার প্রসেস চালিয়ে এলো এতক্ষণ।

তো, সাইমনের বাবা অভিজিত ভট্টাচার্য একজন বাঙালি। মা জেসমিনও বাঙালি। মানুষের জাত-বিচারের নোংরামিতে কোনদিন যায়নি এই তথাকথিত ব্রাম্ভণপুত্র অভিজিত ভট্টাচার্য। যায়নি বলেই মেয়েটিকে অযথা শেষ হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচাতে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এর অল্পদিনের মধ্যেই সাইমন জন্মেছিল। নিজেকে অভিজিত ধন্যবাদ দিয়েছিল, এই ভেবে যে, জেসমিনকে সেই বাচ্চাটীকে একা একা মানুষ করতে হয়নি। সে নিজে তার পাশে আছে। কিন্তু  যৌথ-জীবনে অভিজিত বুঝেছিল জাত নয়, মানুষের অন্তর্গত মনের সংস্কৃতির পার্থক্য মানুষের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে দিতে বড় ভুমিকা রাখে। ততদিনে সাইমন বড় হয়ে উঠেছে আর তার মা জেসমিন আবার আগের মত জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে। বড় হতে হতেই সাইমন এই ফাটল দেখতে বা বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পারছিল দুজনে দুজনের কাছ থেকে কেমন ভাবে সরে আসছে। শান্ত ভদ্র বাবাটির কাছে সে তাঁর শুশ্রুষার মতো হয়ে উঠেছিল।

সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অভিজিত একদিন বেরিয়ে পড়েছিল আধ্যাত্মিক জীবনের উদ্দেশে, খালি হাতে। কিন্তু এখানেও বাক্যে সারমনে এই সাধু নামধারিদের বিশাল পার্থক্য আর লুকোছাপা যাপিত জীবন দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে। বিস্মিতও। যারা একইসঙ্গে দুটো পরস্পরবিরোধী জীবন যাপন করে তাদের সাথে অভিজিতের মন আপোষ করতেই পারবে না কোনোদিনও যে! বিভ্রমে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনকে, মানুষের এই ডাব্‌ল আইডেনটিটি! এই সাধু-সন্ত জগতেও দু-নম্বরী বহাল! কোথায় যাবে মানুষ তাহলে? যাবার কোনও দিক খুঁজে পায়নি অভিজিত! ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, হিতোপদেশ, সারমন সবকিছুর থেকে ঘেন্নায় দূরে সরে যেতে চেয়ে জীবন থেকেই চলে যাওয়ার কথা ভেবে নিয়েছে মন! কোনো কোনো সময় চলে যাওয়াই জীবনের সঠিক ডিসিসন বলে মনে হয়েছে অভিজিতের।

সাইমনের মন বুঝতে পেরেছে সঠিক সঙ্গই তবে ‘চলে যাওয়া’ শব্দটাকে সঠিক দিকে বহন করতে পারে! ভয় পেয়েছে তার নিজের নির্বাচিত নারীটির কথা ভেবে…

জীবনকে ভয় পেয়ে ওকেও হয়তো কোনোদিন এমনি করেই যাওয়ার কথা ভাবতে হবে…

থাকা বা চলে্ যাওয়াকে, সোজা কথায় বাঁচা আর মরার প্রশ্নে মনকে তবে এতগুলো প্রসেসের সম্মুখীন হতে হয়! মনের সব সফরই তবে পরস্পর লিঙ্কড!

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন