কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১০৪  

 

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের বর্তমান জুলাই সংখ্যা থেকে একটি নতুন  বিভাগ সংযোজন করা হলো, ‘পাঠক-পাঠিকা’ বিভাগ। মূলত কালিমাটি অনলাইনের যে কোনো পাঠক ও পাঠিকা এই বিভাগে অংশগ্রহণ করতে পারবেন, তাঁদের  ব্যক্তিগত বক্তব্য ও অভিমত প্রকাশ করতে পারবেন, যে-কোনো বস্তু ও বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা করতে পারবেন, অনলাইনে প্রকাশিত লেখাগুলি সম্পর্কে আলোচনা ও সমালোচনা করতে পারবেন। বস্তুত এই বিভাগটি সংযোজিত করা হচ্ছে একটি মুক্ত পরিসর বা ওপেন ফোরামের মতো, যেখানে বাংলাসাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, জীবন-যাপন, বিশ্ববীক্ষণ ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়, মতাদর্শ,  দৃষ্টিকোণ, তর্ক-বিতর্ক উপস্থাপন করা যেতে পারে।

আমরা মনে করি, এই বিশ্বে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের যে কোনো বিষয় ও ভাবনা সম্পর্কিত নিজস্ব কোনো মতামত, বক্তব্য, দৃষ্টিকোণ, বিশ্বাস, যৌক্তিকতা আছে। কেননা, প্রত্যেকের যেমন বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা এবং মানবিকতা আছে, তেমনি প্রত্যেকেরই জীবন ও জগত সম্পর্কে সাধারণ বা মৌলিক কিছু ধারণা আছে এবং নিজস্ব চিন্তাধারায় দিন অতিবাহিত করার অধিকার আছে। তথাকথিত প্রচলিত শিক্ষার মাপকাঠিতে তাঁরা শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত যাই হোন না কেন, তাঁদের কোনো বিষয়ের ওপর চিন্তা-ভাবনা অন্যদের থেকে আলাদা হতেই পারে, এমন কি মৌলিকও হতে পারে। পুরোপুরি স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিবেচনা করতে পারেন। আমরা সেক্ষেত্রে সবার চিন্তা-ভাবনা ও অভিমতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং তা কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনে প্রকাশ করতে আগ্রহী।

এর আগে যদিও ‘পাঠক-পাঠিকা’ বিভাগ শিরোনামে আলাদা করে পাঠক-পাঠিকাদের মন্তব্য বা অভিমত প্রকাশ করার জন্য কোনো বিভাগ ছিল না, কিন্তু ব্লগজিনে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার নিচে একটা কমেন্টবক্স ছিল এবং আছে, যেখানে পাঠক-পাঠিকারা তাঁদের বক্তব্য পোস্ট করতে পারেন। এবং এজন্য আমরা বারবার সবাইকে অনুরোধও জানাতাম। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের বোধের অগম্য, নিতান্তই কয়েকজন মাত্র কমেন্টবক্সে তাঁদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতেন। এ ব্যাপারে সবার এতটা কেন অনীহা, তা আমরা জানি না।

যাইহোক সম্প্রতি ই-মেল যোগে কালিমাটি অনলাইনের নিয়মিত এক পাঠক  স্বপন নন্দী একটি চিঠি পাঠিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এবং বলা যেতে পারে, তাঁর এই চিঠি পড়ে আমরা ‘পাঠক-পাঠিকা’ শিরোনামে এই নতুন বিভাগটি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। আবার এরই প্রাসঙ্গিকতায় যখন আরও একজন কালিমাটি অনলাইনের নিবিষ্ট পাঠিকা শুভ্রা বন্দ্যোপাধ্যের সঙ্গে এই বিষয়ে ফোনে কথা হয়, তখন তিনিও আগ্রহী হন এবং নতুন বিভাগের জন্য তাঁর অভিমত জানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন। আমি তাঁকে স্বাগত জানাই। এবং এই সূত্রেই আপনাদের সবার কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারাও কালিমাটি অনলাইনে প্রকাশিত লেখাগুলি সম্পর্কে আপনাদের ভালোলাগা-খারাপলাগা ব্যক্ত করুন, ব্যক্তিগত মতামত জানান, আলোচনা-সমালোচনা করুন। এছাড়া আপনাদের অন্য কোনো বিষয় বা ভাবনা সম্পর্কে যদি কিছু প্রকাশ করার থাকে, তাও এই বিভাগে প্রকাশ করতে পারেন। নিচে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা আছে, সেই ঠিকানায় কালিমাটি অনলাইন দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। আমরা যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান জানিয়ে তা ‘পাঠক-পাঠিকা’ বিভাগে সবার পড়ার ও জানার জন্য উপস্থাপন করব।

সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।    

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২১




বিশ্বভ্রমণ আপাতত কিছুদিন বন্ধ রেখে আমরা আবার ফিরব হলিউডের রূপোলি  জগতের মোহময় হাতছানিতে। প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীর আলোচনায়। এই লেখা বেশ দীর্ঘ হবে, তাই একে চার টুকরো করে নেব। আজ প্রথমভাগে  এখনকার প্রিয় অভিনেতা। পরের পর্বে প্রিয় অভিনেত্রী। তারপরের দু’পর্বে হলিউডের স্বর্ণালী যুগের কয়েকজন অভিনেতা ও অভিনেত্রী, যারা কেউ আর আজ আমাদের মাঝে নেই।

এখনকার অভিনেতাদের ভেতর জিনি হাকম্যান থেকে শুরু করে টম হ্যাঙ্কস অব্ধি অনেককেই আমার ভাল লাগে। তবে তালিকা বানিয়ে এক-দুই-তিন করে বলতে বললে খানিক ভাবনার পরে মাত্র কয়েকটা নামই উঠে আসবে। সেই তালিকায় আমার প্রথম পছন্দ ডাস্টিন হফম্যান। দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে রাখতে চাই এমন একজনকে যিনি হিরো থেকে ভিলেন সব চরিত্রেই সাবলীল। ফলে একজনকেই রাখতে পারি রবার্ট ডি-নিরো। তৃতীয় স্থানে যুগ্মভাবে রাখতে চাই ড্যানিয়েল ডে-লুইস আর গ্যারি ওল্ডম্যানকে। আর, যাকে অভিনয় দক্ষতার জন্য ওপরের ক’জনের যে কোন একজনের জায়গায় অনায়াসে রাখতে পারতাম, কিন্তু  তার মুখ-চোখ-ভুরুর ভঙ্গি তত পছন্দ করি না বলে রাখলাম না, তার নাম জ্যাক নিকল্‌সন (এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, এর সঙ্গে নিকল্‌সনের অভিনয় দক্ষতার কোন সম্পর্ক নেই)।

ডাস্টিন হফম্যানের ‘দ্য গ্রাজুয়েট’ দেখেছিলাম দুর্গাপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার  সময়। সম্ভবত ১৯৯৫ বা ৯৬। নুন শো হিসেবে দেখতে গেছিলাম। ছবিটা তখন বেশ উত্তেজক মনে হয়েছিল। আজ এসব মনে পড়লে মনে মনে হাসি, সত্যিই খুব অপরিণত ছিলাম সেই বয়সে। হফম্যানের এখন বয়স ৮৪, ক্যান্সার থেকে  মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু হাঁটাচলা আর বিশেষ করতে পারেন না। কিন্তু তার অমূল্য মণিমুক্তোগুলো সেলুলয়েড জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে – দ্য গ্রাজুয়েট (১৯৬৭),  মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯), জন অ্যান্ড মেরি (১৯৬৯), লেনি (১৯৭৪), ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার (১৯৭৯), টুটসি (১৯৮২), রেইনম্যান (১৯৮৮), আউটব্রেক (১৯৯৫), ওয়্যাগ দ্য ডগ (১৯৯৭) ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠকের নিশ্চই মনে আছে যে এই লেখা আমি শুরু করেছিলাম ২০২০ সালে কোভিড আতঙ্কের আবহে এবং ভাইরাসঘটিত প্রথম যে ছবি আমি রিভিউ করেছিলাম, সেটা ছিল ‘আউটব্রেক’। ওনার সম্বন্ধে বলা হয় ‘an actor with the everyman’s face  who embodied the heartbreakingly human’। মানুষের অভিনেতা, মানবিকতার অভিনেতা। এখানে আলোচনা করব ওনার ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ আর ‘রেইনম্যান’ নিয়ে।

‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ সিনেমা হিসেবে খুব একটা মার্কস পাবে না, অনেক  খুঁত আছে। কিন্তু ফুল মার্কস পাবে ডাস্টিন হফম্যান আর মেরিল স্ট্রিপের অভিনয়ের জন্য। এটাকে ডিভোর্স ড্রামা বললেই ভাল হয় যদিও ডিভোর্সের আইনি চর্চা খানিকটা প্রশ্নজনক। হফম্যান আর স্ট্রিপ এখানে এক দম্পতির অভিনয় করেছেন যাদের ডিভোর্স হচ্ছে, তার হফম্যান তাদের স্কুলপড়ুয়া বাচ্চা ছেলেকে নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে। বাচ্চা মানুষ করার কৌশলগুলো আস্তে আস্তে শিখছে। অবশ্য কিছুদিন পরেই স্ট্রিপ আবার কেস করছে ছেলের হেফাজত নেবার জন্য। সিনেমা যত গড়িয়ে চলে, হফম্যান ততই যেন বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া চরিত্র হয়ে উঠতে থাকেন, আর সেখানেই এই ছবি সংবেদনশীল হতে থাকে। কোর্টের ভেতরের লড়াই বাইরের মানুষটাকে মেরে ফেলতে দেয় না। ফলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দর্শকের সহানুভূতি পান। ডায়লগ এবং স্ক্রীন-প্লে যথেষ্ট ভাল বলেই আজো এই ছবি দর্শকের ফেভারিট।

আমার জ্ঞানের গন্ডী অনুযায়ী, ‘রেইনম্যান’ আজ অব্ধি একমাত্র সিনেমা যা  অস্কার আর গোল্ডেন বিয়ার, দুটো পুরস্কারই পেয়েছে। এই সিনেমা শুরু হচ্ছে  গাড়ি কেনাবেচার দালাল ছেলে (টম ক্রুজ) যখন বাবার মৃত্যুর পর জানতে পারছে যে বাবার সমস্ত সম্পত্তির মালিক সে নয়, তার দাদা (ডাস্টিন হফম্যান)। এই দাদার বিষয়ে সে কিছুই জানে না, তাকে কোনদিন দেখেওনি। সেই দাদার খোঁজে টম ক্রুজ এক মানসিক হাসপাতালে যায় এবং আবিষ্কার করে সেখানে তার দাদা এক মানসিক রুগি। বাবার সম্পত্তি নিজে আত্মসাৎ করবে বলে টম ক্রুজ হফম্যানকে নিয়ে সেই হাসপাতাল থেকে পালায়। এবং তার সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক কিছু জানতে পারে। নিজের ছোটবেলা, হফম্যানের অনেক জিনিষ একসঙ্গে মনে রাখার ক্ষমতা, এমনকি তার শিশু বয়সের আবছা স্বপ্নে দেখা ‘রেনম্যান’ যে হফম্যান, সেটাও। জীবন সম্বন্ধে টম ক্রুজের ধারণা বদলাতে   থাকে। ছবির শেষে হফম্যান আবার সেই মানসিক হাসপাতালে ফিরে যায় কিন্তু টম ক্রুজ তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করবে কথা দেয়। এইরকম জটিল এক চরিত্র হফম্যান যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই উপভোগ করার মত।

রবার্ট ডি-নিরোর ‘রেজিং বুল’ আর স্ট্যালোনের ‘রকি’ পরপর দেখেছিলাম।  রেজিং বুল বেশি ভাল লেগেছিল। তার কিছুদিন পরে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’। ডি-নিরোর অভিনয় সেখান থেকেই ভাল লাগতে শুরু করে। ওনার বয়স এখন ৭৮, কিন্তু ওনার যে যে ছবি হিরো বা ভিলেন হিসেবে এখনো চোখে ভাসে – গডফাদার পার্ট টু (১৯৭৪), ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬), নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক (১৯৭৭), দ্য ডিয়ার হান্টার (১৯৭৮), রেজিং বুল (১৯৮০), গুডফেলাজ (১৯৯০), অ্যাওকেনিংস (১৯৯০), কেপ ফিয়ার (১৯৯১), সিলভার লাইনিং প্লেবুক (২০১২) এবং দ্য আইরিশম্যান (২০১৯)। এখানে ওনার হিরো হিসেবে একটা এবং ভিলেন হিসেবে একটা ছবি বেছে নেব - রেজিং বুল এবং কেপ ফিয়ার। বলে রাখা ভাল, এই দুটো ছবির পরিচালকই মার্টিন স্করসেসি। স্করসেসি রবার্ট ডি-নিরোকে নিয়ে মোট ৯টি সিনেমা করেছিলেন। ‘মিন স্ট্রীট’ থেকে শুরু করে ‘দ্য আইরিশম্যান’ অব্ধি। রেজিং বুল এবং কেপ ফিয়ার এই জুড়ির দুই সেরা ফসল।

‘রেজিং বুল’ এক মিডলওয়েট বক্সিং চাম্পিয়নের গল্প। এক সাধারণ বক্সার থেকে  চাম্পিয়ন হয়ে উঠেও নিজের বদমেজাজ আর সন্দেহবাতিক চরিত্রের জন্য সব হারানোর গল্প। নিজের বউ-বাচ্চা তাকে ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ তাকে একসময় গ্রেপ্তার করে এবং জীবনের সায়াহ্নে এসে যে নিজের মনেই বিড়বিড় করে ‘I coulda been a contender’। এখানে ডি-নিরো এক ট্র্যাজিক হিরো। আবার উল্টোদিকে ‘কেপ ফিয়ার’ (১৯৬২ সালের কেপ ফিয়ার ছবির রিমেক) সিনেমায়  ডি-নিরো এক ভিলেন। এক ১৬ বছরের টিনেজ মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে তার  ১৪ বছর জেল হয়। কিন্তু ডি-নিরো মনে করে তার উকিল ইচ্ছাকৃত তাকে এই সাজা দেওয়া করিয়েছে, সে ইচ্ছে করলেই এই সাজা কম হতে পারত। জেল থেকে বেরোনোর পর সে সেই উকিল ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করে। এবং প্রতিশোধের জন্য তাকে ভয় দেখাতে শুরু করে। পরিবারের ভেতরের খবর জোগাড় করার জন্য সেই উকিলের টিনেজ মেয়ের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করে। এমনকি পারিবারিক ভ্রমণে সে তাদের পিছু করে নদীতে বোটের মধ্যে  গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে এক ভয়ঙ্কর মারামারির পর ডি-নিরো জলে ডুবে যায়। অবশ্য এই সিনেমায় আসল হিরো বলতে গেলে ডি-নিরোই। কারণ তার অভিনয় এই ছবির একমাত্র উপজীব্য। সিনেমা হলে বসে চুরুট মুখে অট্টহাসি বা উকিলের মেয়ের সঙ্গে সিরিয়াস প্রেমের সংলাপ বা চোয়ালচাপা খুনি চোখে ডায়লগ - ‘every man has to go through hell to reach paradise’ বা ‘I’m going to chop you into 42 pieces’, বা শেষ দৃশ্যে হাসিমুখে গান গাইতে গাইতে ডুবে যাওয়া – এই সিনেমা দেখে খলনায়কদের অনেক কিছু শেখার আছে।

এ পর্যন্ত ড্যানিয়েল ডে-লুইসের (বয়স ৬৫) মাত্র চারটে ছবি দেখেছি - মাই লেফ্‌ট ফুট (১৯৮৯), দেয়ার উইল বি ব্লাড (২০০৭), লিঙ্কন (২০১২) এবং ফ্যান্টম থ্রেড (২০১৭)। এর ভেতর প্রথম তিনটেই সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার প্রাপ্ত। বেশি ছবি দেখিনি বলে ওনাকে তিন নম্বরে রাখলাম। নইলে ওনাকে এক নম্বরেও রাখা যেত, কারণ এরকম পারফেকশনিস্ট অভিনেতা খুব কম দেখা যায়।

ক্রিস্টি ব্রাউন সেরিব্রাল পালসির রুগি। সে না পারে কথা বলতে, না পারে চলতে। শুধুমাত্র সে তার বাঁ পা নাড়াতে পারে, চালনা করতে পারে, এবং সেই পায়ে সে লিখতে ও আঁকতে পারে। সেই নিয়ে ছবি ‘মাই লেফ্‌ট ফুট’। মুখ্য  চরিত্রে ড্যানিয়েল ডে-লুইস। কোন এক সময় ক্রিস্টি তার বাঁ পায়ে কলম ধরে নিজের জীবনী লিখতে শুরু করে। আমি বলব, এই সিনেমা সবার দেখা উচিৎ। কারণ অভিনয়ের ‘ক্লিনিকাল’ ফিনিশ এখানে প্রধান আকর্ষণ।

গ্যারি ওল্ডম্যানও ডে-লুইসের প্রায় সমসাময়িক। এখন বয়স ৬৪। ওনার ছবি বাছতে হলে আমার তালিকায় এগুলো আসবে- প্রিক আপ ইয়োর ইয়ার্স (১৯৮৭), ড্রাকুলা (১৯৯২), লিও (১৯৯৪), নিল বাই মাউথ (১৯৯৭), টিঙ্কার টেলর সোলজার স্পাই (২০১১), ডার্কেস্ট আওয়ার (২০১৭) ও ম্যাঙ্ক (২০২০)। এবং ওনাকে নিয়ে আমার একটাই বক্তব্য – এত ভাল ভাল অভিনয় থাকা সত্বেও মাত্র একটা অস্কার? অস্কার কমিটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল। এখানে আমি ওনার শেষ ছবি ‘ম্যাঙ্ক’ নিয়ে দু-চার কথা বলব। এই সিনেমা হলিউডের বিখ্যাত  ছবি ‘সিটিজেন কেন’-এর স্ক্রিনপ্লে কিভাবে তৈরি হয়েছিল, সেই নিয়ে তৈরি।  অরসন ওয়েলেসের সেই ছবির স্ক্রিনলেখক হার্মান জে ম্যাঙ্ক কিভাবে সেই অসাধ্যসাধন করেছিলেন, তার ওপর ২০২০-র এই সিনেমা। নামভূমিকায় ওল্ডম্যান। ম্যাঙ্ক বাছলাম বেশ কয়েকটা কারণে। এক, ১৩১ মিনিটের এই সাদা- কালো ছবি তৈরির কথা পরিচালক প্রথম ভেবেছিলেন ১৯৯০ সালে, কিন্তু সেটা আর বানানো হয়নি। এত বছর পরে সেটা বাস্তবায়িত হল। এবং সেই তখন থেকেই পরিচালক নামভূমিকায় ওল্ডম্যানকেই ভেবে রেখেছিলেন। দুই, এত বছর পরেও যে ওল্ডম্যানের অভিনয়ে একটুও মরচে পড়েনি, তার প্রমাণ এই সিনেমা। ৯২ সালে ড্রাকুলাতেও যে রকম চরিত্রের সাথে মানানসই হিমশীতল সংলাপ বলেছিলেন যখন ওনাকে প্রথম ভাল লেগেছিল, এত বছর পর এখানেও চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া জেদি প্রাণবন্ত সংলাপ, রাস্তায় বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে নেচে ওঠা, সিনেমার সেটে দৃপ্ত চলন। ‘you cannot capture a man’s entire life in two hours, all you can hope is to leave the impression of one’ অথবা ‘I won’t work with half the producers on the lot, and the other half won’t work with me’ – সঠিকভাবে ম্যাঙ্কের পাগলামোগুলো সংলাপে উনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিন, সাদা-কালোয় দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি। অদ্ভুত ছায়ার কাজ।

এবার হলিউডের পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর আরো্ চারজন বর্ষীয়ান অভিনেতাকে বেছে নেব আন্তর্জাতিক সিনেমায় তাদের অবদানের জন্য। এখানে একটা প্রশ্ন আপনারা করতেই পারেন, বর্ষীয়ান কেন? তরুণ কেন নয়? আসলে, যারা অনেক  দশক ধরে ভাল অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে এসেছেন, আমার বিচারে তাদের আমি ওপরে রাখতে চাই। যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে ভারতে মুখ্যভূমিকায় কারো নাম  জিজ্ঞেস করলে কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের নাম মুখে আসবে, অন্য কোন তরুণ  নায়কের নয়। তেমনি চরিত্রাভিনেতা বললেও নাসিরুদ্দিন শাহের কথা মাথায় আসবে। অথচ বয়সে দুজনেই আশিতে পৌঁছে গেছেন। সেই হিসেবেই আমি  বেছে নেব ইউরোপ থেকে ম্যাজ মিকেলসেন (ডেনমার্ক), জেভিয়ার বারডেম (স্পেন) এবং এশিয়া থেকে মোহম্মদ আমির নাজি (ইরান) ও মাসাহিরো মোটোকি (জাপান)।

ম্যাজ মিকেলসেন ৫৬ বছরের এমন একজন অভিনেতা যিনি হরেক রকমের ছবিতে অভিনয় করেছেন। পুশার (১৯৯৬)-এ ড্রাগ ডিলার থেকে ব্লিডার (১৯৯৯)-এ মনোরোগে ভোগা পরিচালক, শেক ইট অল অ্যাবাউট (২০০১)-এ সমকামী দম্পতি হওয়ার পাশাপাশি ওপেন হার্টস (২০০২)-এ তরুণ ডাক্তার, জেমস বন্ড সিনেমার ‘ক্যাসিনো রয়েল’ (২০০৬) এর ভিলেন, আবার ২০০৮-এ  ফ্লেম অ্যান্ড সাইট্রন ছবিতে ডেনমার্কের স্বাধীনতা সংগ্রামী, দ্য হান্ট (২০১২) ছবিতে এক স্কুলশিক্ষক, এবং ২০১৮-য় ‘আর্কটিক’ ছবিতে আটকা পড়া এক  অভিযাত্রী। এইরকম ভার্সেটাইল এক অভিনেতার কোন্‌ ছবি ছেড়ে কোন্‌ ছবি নেব?

আমি বেছে নিলাম ওনার শেষ ড্যানিশ ছবি ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ (২০২০)।  চারজন স্কুলশিক্ষক রোজ মদ খায়। নিছক আড্ডায় বসে আনন্দ করার জন্য নয়। তারা দেখতে চায় এই দৈনিক সুরাপান কিভাবে তাদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলছে। ফ্রি স্টাইল অভিনয়। বাকিটা দেখুন, আর বলব না। অস্কার পাওয়া ছবি, ভালই লাগবে।

জেভিয়ার বারডেম স্পেনের ৫৩ বছর বয়সী এক শক্তিশালী অভিনেতা, যার ঝুলিতে জেমন জেমন (১৯৯২), দ্য সি ইনসাইড (২০০৪), নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন (২০০৭), ভিকি ক্রিস্টিনা বার্সেলোনা (২০০৮), স্কাইফল (২০১২), মাদার  (২০১৭), লাভিং পাবলো (২০১৭) এরকম বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বিখ্যাত সিনেমা রয়েছে। অভিনয়ের জন্য প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানত লো টোন চোয়ালচাপা অভিনয় করতে ভালবাসেন। স্ক্রিনে শুনতে ভাললাগে তার হাস্কিং ভয়েস। যে কোন সমালোচককে যদি ওনার সেরা ছবি বাছতে বলা হয়, তাহলে দ্বিধা না করে যে কেউ ওনার হলিউড ছবি ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ বেছে  নেবেন। আমিও একমত। কিন্তু এখানে আলোচনা করব ওনার অন্য এক স্প্যানিশ ছবি নিয়ে, যেহেতু ওনাকে স্পেনের অভিনেতা হিসেবে উপস্থাপিত করেছি।

‘দ্য সি ইনসাইড’ এক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে বানানো অন্যরকম ছবি। বারডেম  এখানে তার যৌবনে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের ফলে অথর্ব হয়ে যাওয়া এক রুগি, যে বিছানা ছেড়ে নড়তে পারে না। প্যারালাইজড। সে চায় আইনসম্মতভাবে তার জীবন শেষ করতে, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ইউথানেশিয়া। সেই নিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরের লড়াই। এবং এই লড়াইয়ে একদিকে যেমন তার পাশে রয়েছে এক মহিলা উকিল যিনি মনে করেন বারডেমের দাবি যুক্তিসঙ্গত, অন্যদিকে তার আরেক প্রতিবেশী মহিলা যিনি মনে করেন বারডেমের বেঁচে থাকা উচিৎ। ১২৫ মিনিটের বেশ ভাল জীবনমুখী ড্রামা। আর এসব ছাড়িয়ে বারডেমের বিছানায় শুয়ে শুধু মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে চালিয়ে যাওয়া লড়াই, যা দেখে দর্শক তারিফ করতে বাধ্য।

মোহম্মদ আমির নাজি বয়সে অমিতাভ বচ্চনের সমসাময়িক, ৭৯ বছর। এবং এইমুহূর্তে ইরানের চরিত্রাভিনয়ের অন্যতম প্রধান মুখ। রিটায়ার্ড আর্মি  অফিসার। সিনেমায় কেরিয়ার শুরু করেছেন দেরিতে, ১৯৯৭ সালে। কিন্তু মজিদ মজিদির বেশিরভাগ সিনেমায় উনি এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যেদিন ইরানের সিনেমা নিয়ে লিখেছিলাম, ওনার ‘চিল্ড্রেন অব হেভেন’ আর ‘বারান’ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, তাই আজ আর ওনার অন্য কোন ছবি আলোচনা করব না।

মাসাহিরো মোটোকি জাপানের ৫৬ বছর বয়সি অভিনেতা, যিনি অভিনয়ের জন্য অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন। সুমো ডু, সুমো ডোন্ট (১৯৯২), গোনিন (১৯৯৫), দ্য বার্ড পিপল ইন চায়না (১৯৯৮), জেমিনি (১৯৯৯), ডিপার্চারস (২০০৮), দ্য এম্পায়ার ইন অগস্ট (২০১৫) এবং দ্য লং এক্সকিউজ (২০১৬) ওনার প্রশংসিত ছবির মধ্যে কয়েকটি। জাপানের সিনেমা প্রসঙ্গে ‘ডিপার্চারস’ নিয়ে  আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। এই সিনেমা ওনাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ওনার আরেকটা ছবি দেখার জন্য আমি সবাইকে অনুরোধ করব- ‘দ্য বার্ড পিপল ইন চায়না’। মনোযোগ দিয়ে দেখুন। অদ্ভুত এক আনন্দ পাবেন।

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – প্রাক-ইতিহাস থেকে ১ম পর্ব





 

আমার ইংরেজী ছবি দেখার প্রাক্-ইতিহাস

 

মা’র লেখা স্মৃতিচারণে দেখছি যে আমায় প্রথম সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া হয় ৩১শে মার্চ ১৯৫৯-এ অর্থাৎ তখনো আমার দু’বছর বয়স পূর্ণ হয়নি। বিরতি অবধি নাকি বেশ খুশীই ছিলাম। বিরতির পর মূল ছবি, ১৯৫৮ সালের Tom Thumb, অভিনয়ে পীটার সেলার্স ও টেরি টমাস, এর দুটি দৃশ্য দেখার পর বাবা আমার অধৈর্য দেখে আমাকে বাইরে ‘লবি’তে এনে বসেন। পরে কাজের লোকের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহ ধর্মতলা-চৌরঙ্গী অঞ্চলের  ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক মেট্রো!

৩১শে জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯৫৫ সালের Lord of the Jungle দেখতে। জনি ওয়াইসমুলারের টার্জান ছবিগুলিতে টার্জানের পালিত পুত্র ‘বয়’ করে বিখ্যাত জনি শেফিল্ড ‘বোম্বা’ নামে এক জংলী ছেলে সেজে যে ‘সিরিজে’ অভিনয় করেছিল, এটি সেই সিরিজেরই একটি। আবার, বিরতি অবধি দেখে আইসক্রীম খাবার বায়না জুড়েছিলাম। প্রেক্ষাগৃহের নামোল্লেখ মা করেননি। জানি না, এই ছবি দেখার সময়েই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম কিনা, “ঐ দেখ, দাদা, ‘নদীজলে ভেসে চলে হিপোপটেমাস’!” এই কীর্তিটিও মা’র মুখে শোনা! চোখের সামনে দিয়ে পর্দায় একটা বড় কুকুরকে চলে যেতে দেখেছিলাম, বাবা বলেছিলেন, “ঐ দেখো, কুকুর নিয়ে গেল!” ভেবেছিলাম কুকুরটি কি যকের ধন-এর বাঘা? বাঘা কিন্তু বিদেশী কুকুর নয়, দেশী, তা’ খেয়াল ছিল না। আর দৃশ্যটিও যে এই ছবিরই, তা’ও জোর গলায় বলতে পারব না!

৬ই ডিসেম্বর ১৯৬০-এ বাবা স্মৃতিচারণের খাতায় লিখছেন যে লাইটহাউস সিনেমায় আমায় ওজন করে দেখা গেছে যে আমি ৩৩ পাউন্ড। ছবির নামের উল্লেখ নেই। হতে পারে ছবি ছিল জুল ভের্নের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৯ সালের Journey to the Center of the Earth, অভিনয়ে জেমস মেসন ও গায়ক প্যাট বুন।

Tom Thumb বা Journey to the Center of the Earth-এর বিন্দুমাত্র কিছু আমার মনের পর্দায় ফুটে ওঠে না।

 

প্রাক্-ইতিহাস থেকে ইতিহাসের প্রথম পর্ব

১৯৬৩-র জানুয়ারিতে আমি কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত সেন্ট লরেন্স স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়তে শুরু করি। স্কুলে প্রতি বছর জুলাই মাসে স্কুলেরই বাসে চাপিয়ে পার্ক স্ট্রীটের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ৩৫ মিমি পর্দা-সম্বলিত প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যাওয়া হতো ‘রেক্টর দিবস’ উপলক্ষে ছবি দেখাতে। ১৮ই জুলাই ১৯৬৩-তে এখানে দেখলাম ইংরেজীতে ‘ডাব’ করা ১৯৫৯ সালের জাপানী ছবি, Magic Boy - কিছু দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ একটি মেয়েকে দুর্বৃত্তরা দু’-হাতে দড়ি বেঁধে খাদের ধার থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে, কাহিনীর নায়ক সারুতোবি সেসুকে তাকে রক্ষা করবে। সেসুকের প্রতিপক্ষ এক প্রবল ক্ষমতাশালী দানবী ইয়াকুসা। এটি নাকি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে আমেরিকায় মুক্তি পাওয়া প্রথম ‘অ্যানিমে’ ছবি। এইরকম সময়েই আরও কিছু বিদেশী ছবির কথা মনে পড়ে। মেট্রোয় রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় বাড়তি একটি শো হতো (সোম থেকে শনি সমস্ত হলেই ৩টি করে প্রদর্শনী চালু ছিলঃ ম্যাটিনি, ইভনিং, ও রাত – ৩টে, ৬টা, ও ৯টার আশে-পাশে। দুপুরের শো কলকাতায় এসেছে বোধহয় ৭০-এর দশকে)। এই সকালে মাঝে-মধ্যেই আসত স্বল্প-দৈর্ঘের একাধিক কার্টুনের সঙ্কলন। প্রথমে দেখেছি Tom and Jerry, তারপর Woody Woodpecker।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার জন্য ১৯৫৯ থেকেই আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ভবানীপুর-কালিঘাট। আর সেখানকার বাংলা ছবির পাড়ায় রবিবার সকালে দেখানো হতো, পূর্ণ আর বসুশ্রীতে, ইংরেজী ছবি, ঊজ্জ্বলায় সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। ব্যতিক্রম-হিসেবে ঊজ্জ্বলা এক রবিবার আনে আমার দেখা প্রথম Western: ১৯৫৮ সালের The Lone Ranger and the Lost City of Gold । ‘লোন রেঞ্জার’-এর কমিক্স বাড়িতে প্রচুর ছিল, দাদা সেগুলোর থেকে ছবি দেখিয়ে  আমায় গল্প বলতেন। তিনিই ছবিটি দেখতে আমায় নিয়ে যান, আমার বয়স তখন ৫ বা ৬। মনে আছে পর্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোন রেঞ্জারের সাদা ঘোড়া ‘সিলভার’ আর নেপথ্যে দরাজ গলায় গান হচ্ছে, “Hi yo Silver Away!” তারপর লোন রেঞ্জার সিলভারের পিঠে চেপে ধাওয়া করেছে আততায়ীদের, বার করেছে তার রূপোর বুলেট-ভরা রিভলভার, দাদা বলছেন, “দেখ, দেখ, লোন রেঞ্জার বন্দুক বার করেছে!” তার পরেই রিভলভারের নল দিয়ে ধোঁয়া আর দুম! কাহিনির মূল প্রতিপক্ষ এক মহিলা, যিনি স্বর্ণনগরের খোঁজে নিজের দলের লোককেও পেছন থেকে pickaxe ছুঁড়ে নির্দ্বিধায় খুন করেন! সবশেষে লোন রেঞ্জার আর তার লাল-মানুষ বন্ধু টোন্টো আবিষ্কার করবে সোনার শহর! এক চমকপ্রদ দৃশ্য!

পূর্ণ-তে (ঊজ্জ্বলার মতো এটিও এখন আর নেই, যদিও বাড়িটি দেখা যায়;  ঊজ্জ্বলার জায়গায় এখন নতুন ইমারত!) যত-না বাংলা ছবি দেখেছি, তার চেয়ে বেশী দেখেছি ইংরেজী! পূর্ণ-র প্রথম স্মৃতিই এক অতি স্নেহপ্রবণ টিকিট-চেকারের, যিনি “এসো ছোট ভাইটি আমার! কী দেখবে?” বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৫৮ সালের Son of Robin Hood[1] গল্পের চমক হলো রবিন হুডের ছেলে নয়, মেয়ে ডিয়ারিং হুড! তরোয়াল খেলা ছিল আমার কাছে ছবির মূল আকর্ষণ! গল্প পরে মা’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

এই পূর্ণতেই দাদা এক রবিবার সকালে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, বাড়িতে যার সম্বন্ধে বই ঠাসা, সেই টার্জানের, আমার কাছে, প্রথম ছবি, ১৯৫৯ সালের  Tarzan’s Greatest Adventure,[2] এবং তার কয়েক রবিবার পরে, ১৯৬০ সালের Tarzan the Magnificent[3] পরে, ৮০-র দশকে, ব্রিটিশ টেলিভিশনে দুটি ছবিই আবার দেখেছি। অবাক হয়েছি যে প্রথমটিতে খলনায়কদের নেতা ‘স্লেড’-এর ভূমিকায় ছিলেন পরবর্তীকালে Operation Crossbow, Lawrence of Arabia, এবং আরও পরে শেক্সপীয়রের রচনার চিত্ররূপে অভিনয়কারী স্যর অ্যান্টনি ক্যোয়েল, আর স্লেডের এক সহকারীর ভূমিকায় শীঘ্রই জেমস বন্ড-রূপে যিনি বিখ্যাত হবেন, সেই শন কনারী! দাদার সঙ্গে আমার প্রথম দুটি টার্জান ছবি দেখি ৬ বছর বয়সে, আর সেই দাদারই মেয়ে, আমার ভাইঝিকে নিয়ে আশির দশকের শুরুতে মিনার্ভা, পরে নাম পালটে যা হয়েছিল ‘চ্যাপলিন’, প্রেক্ষাগৃহে দেখব ১৯৬২ সালের Tarzan goes to India,[4] যাতে Tarzan the Magnificent ছবির খলনায়ক কয় ব্যান্টনের ভূমিকায় অভিনয়-করা জক ম্যাহোনি আবির্ভূত হবেন নায়ক টার্জানের ভূমিকায়!

মোটামুটি এই সময়েই মা আর দাদার কাছে ট্রয় আর গ্রীসের যুদ্ধের গল্প শুনে  ভালো লেগেছিল। দাদা লাইটহাউসে নিয়ে গেলেন ১৯৬১ সালের The Trojan Horse দেখতে। প্রথম দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ অ্যাখিলিস তাঁর রথে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রয়ের মহাযোদ্ধা হেক্টরের মৃতদেহ, কারণ হেক্টরের হাতেই মৃত্যু ঘটেছিল অ্যাখিলিসের প্রাণাধিক সখা প্যাট্রোকোলাসের। প্যারিস, যার অদম্য লালসার জন্য এই বিধ্বংসী যুদ্ধ বাধে বলে মনে করা হয় (এখন পণ্ডিতেরা বলেন হেলেনের প্যারিসের সঙ্গে ট্রয়-পলায়নকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে গ্রীস ঈজিয়ান সাগরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতাকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে!) কি রকম যেন হোঁদল-কুতকুতে, তবে ছবির মূল তারকা ইনিয়াসের ভূমিকায় স্টীভ রিভস (যিনি একাধিক ছবিতে হারকিউলিস-রূপে বিখ্যাত)। এরপর কাঠের ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে গ্রীকেরা ট্রয় নগরে প্রবেশ করে শহর ও সভ্যতা একসঙ্গে ধ্বংস করে। হেলেনের স্বামী মেনেলস প্যারিসের চুলের মুঠি ধরে তার পেটে ঢুকিয়ে দেন তরবারি।

আর মনে আছে, এর অনেক পরে মক্ষমূলার ভবনে দেখা, কিন্তু আগে তোলা, ১৯৫৬ সালের Helen of Troy ছবিতে প্যারিস বারবার রথে-চড়া অ্যাখিলিসের দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন, কিন্তু অ্যাখিলিসের শরীর তো একটি জায়গায় ছাড়া অভেদ্য! শেষে প্যারিস দেবরাজ জিউসকে স্মরণ করে তীর ছোঁড়েন, আর সেই তীর গিয়ে লাগে অ্যাখিলিসের গোড়ালিতে। মা থেটিস যে ওই গোড়ালি ধরেই ছেলেকে স্টিক্স নদীতে ডুবিয়ে তার দেহ অস্ত্রের পক্ষে দুর্ভেদ্য করেছিলেন! অ্যাখিলিসের মৃত্যু হয়।

প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করছি। আপনারা অভয় দিলে আরও লিখব।

 



[1] By Source (WP:NFCC#4), Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=49449467

[2] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26749132

[3] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=43190783

[4] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26745430


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি : ওই আলোকেই বলি, ধন্যবাদ হে




 

প্রতি,

সম্পাদক কাজল সেন-এর তত্ত্বাবধানে সমৃদ্ধ আন্তর্জালিক মাধ্যমে লেখার সুযোগ। তাঁর প্রেরণায় নতুন করে পুরনো সে দিন ফিরে দেখা। মানে ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার। এবং তারই জন্যে খোলা চিঠি পাঠকের সন্ধানে। রথের সময় বলে রথের দিনের একটা বিজ্ঞাপন নিয়েই নাটকের কথা। নাটকের অন্দরমহলের অনেক কথাই লিখেছেন তাত্ত্বিক অরুণিতা রায়চৌধুরী। তাঁর একটি তথ্য পাই এরকম যে, ১৯৯৭ সাল ৫ জুলাই একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকায় ছাপা খবর, আগামী রবিবার রথের দিন খুলছে 'রঙমহল থিয়েটার'। মানে সময়টা বোঝা গেল  তো! এর কিছু আগে থেকেই একের পর এক সব থিয়েটার হল বন্ধ হয়ে  যাচ্ছিল। ১৯৯১ সালে 'স্টার থিয়েটার' ভস্মীভূত। আবছা কথা ঝাপসা স্মৃতি থেকে। যে নাটক দিয়ে সেবারের শোয়ের সূচনা হয়, তা হল 'জয় জগ্ননাথ'। এটা জানানোর নয়। জানানোর হল, এই লেখার কিস্তির সময়টাও উল্টোরথের লগ্নে। পাঁপড়ের গন্ধে তেলে ভেজা ঠোঁটে একটা মেলায় ঘুরছি। চারপাশে যাত্রাপালার ঢঙে গান চলছে। রোশনাই মাটির রঙ বদলে দিতে চাইছে। এরই মধ্যে মনে পড়ল, 'জয় জগ্ননাথ' নাটকের কলাকুশলীদের নামগুলো লেখা যাক। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মণ্ডল, রত্না ঘোষাল, নিমু ভৌমিক, বোধিসত্ত্ব মজুমদার, দেবাশিস রায়চৌধুরী প্রমুখ। এই যে তথ্যগুলো লিখলাম, এসবই অরুণিতা রায়চৌধুরী তাঁর 'রঙমহলের কথা' প্রবন্ধে লিখেছেন। ভাগ্যিস তিনি লিখেছিলেন। নইলে আজ স্মৃতি নাড়া পড়ত না। এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন রত্না ঘোষাল। সেখানে তিনি যা লেখেননি সেটুক লিখি। এই নাটকের মঞ্চসজ্জার একটি বিশেষ দিক লিখেছেন তিনি, মঞ্চে দেখা যাবে সমুদ্র, ঝড় উঠবে, দেবতাদের আগমন ইত্যাদি ব্যাপার। এইখান থেকেই লেখার আমার কথাটি।

যেদিন থিয়েটার দেখতে যাওয়া থাকত, তার আগের দিন রাতে আর ঘুম হত না। এইজন্যে নয় যে কী পরে যাব, কী সাজব! তখন দুধের দাঁত পড়েছে হবে, তাই  সাজগোজের ব্যাপারটায় ঝোঁক আসেনি। মধ্যে যে আলোড়ন চলত তার একটা কারণ আলো আর আলো।  চাদরে মুখ চাপা দিয়ে শুনতাম গল্প। কোন নাটকের টিকিট কেন কাটা হল, তার একটা যুক্তি থাকত বাবার কাছে। বাবা বলত, বাকিরা নাবালক বনে শুনত। আমার ভাল লাগত মঞ্চে যে কতকিছু দেখাত, সেটা দেখে। একটা  নাটকে তো এরোপ্লেন চলে যেত মাথার উপর দিয়ে। তখন কিন্তু বুঝিনি, ওটা সত্যি নয়, পরে বুঝেছি, নকল এরোপ্লেন দিয়ে চমক ছিল। আমার উত্তেজনা খুব। মঞ্চে যাবতীয় কারসাজি দেখতাম। আর ভাবতাম, আলোগুলো একদিক যদি নাড়িয়ে দিতে পারতাম, অভিনয় বা নাটকের গল্প এসব তো বুঝতাম না ওই বয়েসে, কিন্তু একটা আকর্ষণ যেন কথা ছাপিয়ে আলোর ভেতরে টেনে নিয়ে যেত। কী সহজ ছিল আলোর নাড়াচাড়া করার।  একদিন সত্যি সুযোগ এলো, আলোগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর। আর সেটা ছিল পরীক্ষার দিন। এটুক থেকে ফিরে যাই 'জয় জগন্নাথ' নাটকের কথায়। এই নাটকটা দেখিনি। সেটা তো আগেই লিখলাম। কিন্তু এখানে যাঁদের অভিনয় তাঁদের অনেককেই দেখা। অনেকবার। তাঁদের নিয়েই কথা। যেমন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে লিখতে পারি। যেমন, রত্না ঘোষাল, নিমু ভৌমিক, দেবাশিস রায়চৌধুরী, তাঁদের নিয়ে পরে পরে লিখব। অভিনেতাদের যে দেখার অভিজ্ঞতা সেটা পরিণত বয়েসের। যা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পোক্ত হওয়ার। সে বড় শক্ত।

থিয়েটার দেখার একটা মজা ছিল। সেই মজা বইয়ের পড়ায় মেলে না। যখন পাশ-ফেলের ব্যাপারটাই মুখ্য, মুক্যু লাগে নিজেকে। মনে হয় পিঁপড়ে বনে যাই। তাহলে মঞ্চের এই পরীক্ষা থেকে মুক্তি। সিলেবাসের পড়ায় আলো একটি অপরিহার্য পাশ-ফেলের বিষয়। অনেকক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে  চাইছিলাম, কীভাবে রপ্ত করব? জিজ্ঞাসা ঘুরতে ঘুরতে আমাকে নিয়ে এক লাফে  ফেলে দেয় বিছানা থেকে। যাহোক, ওই হালে পরীক্ষা। মঞ্চের আলো। আলো পড়তেই দেখলাম যিনি বসে তিনি… আর কেউই নন, নাট্য ব্যক্তিত্ব জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। ওরে বাবা রে, পালাবার উপায় নেই! শুরুতেই তিনি প্রশ্ন করলেন,  নাটক শুরুর আগে ওই আলোটা কেন দেওয়া হয়?  আমি দাঁড়িয়ে কোথায়, বুঝিয়ে বলি। আমি ওঁর সামনে। উনি বসে রয়েছে আমাদের বিদ্যায়তনের মঞ্চের দর্শকের সিটে। সামনে পরীক্ষার টেবিল, সেখানে খাতা, প্রশ্ন আর একটা হলদে আলোর টেবিল ল্যাম্পও। পাশ দিয়ে কত আলো বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি সচেতনভাবে ওই আলোটার দিকে তাকিয়ে। উত্তর নেওয়ার তাড়া ওঁর ছিল না। এক চুমুক চায়ের শব্দ। তারপর আমার উত্তর? নাহ। এই নাটকের স্ক্রিপ্ট আমার, তাই সংলাপ নড়বড়ে। চরিত্র নড়ে? আর কাহিনি মানে সংলাপ? এর কোন রিহার্সাল তো দেওয়া নেই। প্র্যাক্টিক্যাল যা শেখা, তারই ভিত্তিতে পরীক্ষা। আনাড়ি নাট্যকার সংলাপের অভাবে একমাত্র চরিত্রকে ধরা যাক দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আর সেই চরিত্রটি আমি। বেবাক বনে আরেকটা আলোর জন্যেই হবে অপেক্ষা করছিলাম। নাকি যদি কোন ক্যারেক্টার ঢুকে এসে গোল বাধিয়ে বলে, এই যে পরীক্ষা দিচ্ছ, দেওয়া চলবে না। আমার সংলাপ তোমার বলা চলবে না।  নাহ, কেউই এল না। বুঝলাম, সবাই চরিত্রটি উত্তমরূপে রিহার্সাল করেছেন। শুধু ফাঁকি দিয়েছি আমি।

পরীক্ষক নাট্যব্যাক্তিত্ব জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় আমাকে দেখছেন। আমি হাসলাম।  উনি চায়ের শেষে কাপ নামানোর নিখুঁত শব্দ করলেন। এবারে, বলতেই হয় কিছু। উনি চুপ থেকেই চোখে চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন। আমি লুফলাম। হ্যাঁ, ঝুঁকলাম। এত বড় গুগলি যে! আচ্ছা, পরিবেশের বর্ণনায় আরও যাঁদের নাম  বলতেই হবে, লিখি। ফ্ল্যাশব্যাকে থেকে উঠে আসছেন একে একে। এই নাটকের মতন এত ভারি দর্শক আর কখনও আমার কোন নাটকে হয়নি। হবেও না। তাঁদের নাম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি- নির্দেশক নাট্যকার অভিনেতা মনোজ মিত্র। আলোর প্রবাদপ্রতীম কণিষ্ক সেন। বিভাগের আরও সবাই, আমাদের স্যারেরা, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযূষ চক্রবর্তী, সোমনাথ সিনহা, ধ্রুব মিত্র এবং আরও অনেকেই। তো, এবারে উত্তরের পালা। অনেক ভেবেছি। তারপর বললাম যে, এই আলোটা পর্দায় ফেলা হয় মনঃসংযোগ করার জন্যে, দর্শকের অবশ্যই। এবং, তারপরই শুরু হবে নাটক।

কারণ, দর্শক। আগের পর্বে লিখেছিলাম তো, তাই না! দর্শকই নাটকের সব।  তিনি বা তাঁরা তো ছুটে-ছুটে আসেন। বাস, ট্রাম, গাড়ি। তারপর হুড়োহুড়ি করে ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। থিতু হতেই এই কায়দাটি। এই আলো মঞ্চে থাকলে দেখা যাবে না কিন্তু। আগেই লিখেছি যে, মঞ্চের নাটক সময়েই শুরু হয়। হব্বেই। তাই…।  আলোর প্রসঙ্গে ছিলাম। রেজাল্ট জানতে কিছুক্ষণ আরও। মঞ্চে জ্বলছে হলদে আলো। এদিকে হাউজ কাট করা। কারণ, পরীক্ষা চলছে যে আলোর। পরীক্ষার্থী আর আলোর মধ্যে খুবই মিল পেলাম সেদিন। স্থির থাকার  চেষ্টায় যাঁদের অন্তর অল্প অল্প কাঁপছে, তারা হয় আলো না হয় পরীক্ষা দিচ্ছে। মনে হল, কাছে গিয়ে বলি, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে, দেখুন থিয়েটার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। একটা ধারণা ছিল আবছা মনে থাকার সুবাদে, যে পারব। কিন্তু… মঞ্চে বাঁয়ে একটা আলো পড়েছিল। মনে করার চেষ্টা করছি কী নাম তার। নাম মনে পড়ছে না, সেদিনও পড়েনি নাকি, নাকি পড়েছিল! এতটাই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলে আলোগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। এবারে তাই লিখে ফেললাম। এখান থেকে নাটকের আলোর গতি, তার ইতিহাস কতটা জায়গা নিয়ে থাকে আমার মনে। আর মাস্টারমশাইরাও। কী যত্নে গড়ে তুলেছেন  আমাদের। যে চাইলেও ভুলতে পারার নয়। সবশেষে, আলোর কথা বলি, ওই আলো সেদিন পাশ করিয়ে দিয়েছিল। আর আমি কোনদিনও সেটা ভুলিনি, ভুলব না। আজও দর্শকের আসনে বসার তাড়া থাকে তাই, নাটক শুরুর আগেই পৌঁছে যাই। না হলেই তো মিস।  ওই আলোর দিকে দেখি। বলি, ধন্যবাদ হে। আজ তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে!   

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী

(ক্রমশ)

   


অচিন্ত্য দাশ

 

মসীচিত্র

 

একটি মুক্তার কাহিনী




আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের জলবায়ু ভারি মনোরম। তেমন গরম পড়িতে দেখা যায় না অথচ বেশি শীতও নাই। শুনিয়াছি ইহা প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জলরাশির গভীরে প্রবাহিত উষ্ণস্রোতের কারণে। এই অঞ্চলের প্রদেশটির নাম ক্যালিফোরনিয়া। মানচিত্র দেখিলে ইহাকে আমাদের দক্ষিণদেশের কেরেলার  মতো লাগিতে পারে, যদিও ইহার বিস্তার ও আকার বহুগুণ হইবে। জলবায়ু এবং  মাটির কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর ফল ফলিয়া থাকে। যেমন আঙুর, কমলালেবু, আপেল ইত্যাদি। আঙুর অর্থাৎ দ্রাক্ষার অগুন্তি ক্ষেত রহিয়াছে এবং তাহাতে উৎকৃষ্ট মানের দ্রাক্ষার ফলন হয়। দ্রাক্ষা হইতে দ্রাক্ষারস। দোকানে দোকানে বিভিন্ন প্রকারের ‘ক্যালিফোরনিয়া রেড ওয়াইন’ শোভা পাইতেছে - মূল্য তেমন কিছু নহে, অন্যদেশ এমনকি ভারতভূমি হইতেও কম দামের বোতল থরে থরে তাকের ওপর সজ্জিত। তাহারা যেন আমাকে বলিতেছে – আসিয়াছ যখন স্বাদ লইয়া যাও…

বাড়ির পিছনের খোলা উঠানটি বড় সুন্দর। এই স্থানের জমি সমতল নহে, সারিসারি উপত্যকায় পূর্ণ। তাই এই উঠানটি বারন্দা বা ছাদের মতো মনে হয়,  ইহার পশ্চিম দিকের বেড়ার পর জমি ঢালু হইয়া নামিয়া গিয়াছে। গাছ-গাছালি কিছু পরিচিত, কিছু অপরিচিত। ঝোপঝাড়ে লাল লাল কুলের মতো গুচ্ছগুচ্ছ ফল হইয়াছে। দূরে ঘরবাড়ি ও রাস্তায় মাঝেসাঝে দুএকটি গাড়ি চলিতে দেখা যায়।

বেলা বারোটা নাগাদ গেলাসে দ্রাক্ষারস বা সোজা ভাষায় লাল মদ লইয়া  রৌদ্রস্নাত উঠানে বসিয়াছিলাম। সঙ্গে রেকাবিতে কাঠের আঁচে সেঁকা কাঠবাদাম শোভা পাইতেছে। ভারি সুস্বাদু। কত আর প্রকৃতি দেখিব – তাই একটি চটি-বই আনিয়াছিলাম। বইটি খুলিলাম।

উপন্যাসিকা বলা যাইতে পারে, ইংরাজিতে রচিত। লিখনশৈলী এতই সহজ, সাবলীল এবং আড়ম্বরবিহীন যে পড়িতে হোঁচট খাইতে হয় না। প্রথম কটি পাতা তরতর করিয়া পড়িয়া ফেলিলাম এবং তখনই কিনো নামের লোকটিকে দেখিলাম। ইহার বাস মেক্সিকোর সমুদ্র উপকূলের এক গ্রামে। সে দেশে বা সে অঞ্চলে কখনো যাই নাই, বইতে বা সিনেমাতেও কখনো দেখি নাই। এমনকি আজ হইতে একশতাধিক বৎসর পূর্বে যে কালখণ্ডে কিনো জন্মিয়াছিল সে সময়ও আমার অজানা। তবু কিনো মানুষটিকে ভারি চেনা মনে হইল।

এই অঞ্চলে স্প্যানিশ ভাষার প্রভাব রহিয়াছে। ইংরাজি ‘জে’ অক্ষরটির উচ্চারণ জ নহে হ। তাই কিনোর বৌ হুয়ানার নাম ইংরাজি লিখনে ‘জে’ দিয়া শুরু। যাহা হউক এখন সকালবেলা। দুজনে পাতা-ছাওয়া কুটির দ্বারে তাহাদের তিন-চার মাসের পুত্রসন্তানকে দেখিতেছিল। শিশুটি কুটিরের ছাদ হইতে দড়ি দিয়া ঝোলানো বাক্সে শুইয়া নিজের মনে হাসিতেছে ও হাত-পা ছুঁড়িতেছে। এমন সময় হঠাৎ একটি বৃশ্চিক কোথা হইতে আসিয়া সেই দড়ি বাহিয়া নামিতে লাগিল। প্রভাতের সূর্যালোকে তাহার হুল চকচক করিতেছে। সে মৃত্যুদূত হইতে তাহার সন্তানটিকে রক্ষা করিতে কিনো অতি সাবধানে বৃশ্চিকটিকে ধরিতে পায়ে পায়ে অগ্রসর হইতেছে…

আমি শ্বাস বন্ধ করিয়া বাদাম চিবাইতে লাগিলাম … কী হইবে …

শেষরক্ষা হইল না। কিনোর আঙুলের ফাঁকে পিছলাইয়া বিছাটি শিশুটির গায়ে পড়িল এবং তৎক্ষণাৎ হুল ফুটাইয়া দিল। যন্ত্রণায় শিশুটি উচ্চস্বরে কাঁদিয়া  উঠিল। কিনো ঘাবড়াইয়া গেল। হুয়ানা কিন্তু বুদ্ধিস্থির রাখিয়া জায়গাটি কামড়াইয়া ধরিল এবং মুখ দিয়া বিষ সমেত রক্ত যতটা পারা যায় শুষিয়া লইল। তাহা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল – ডাক্তার ডাকিয়া আনো, ডাক্তার!

লোকজন জড়ো হইয়া গিয়াছিল – কে একজন বলিল ডাক্তার এই স্থানে আসিতে রাজি হইবে না। হুয়ানা বলিল – তাহা হইলে ইহাকে লইয়া এখনি ডাক্তারের কাছে যাইব...

সম্মুখে কিনো এবং শিশুটিকে কোলে লইয়া হুয়ানা। এই গ্রামে ডাক্তারের কাছে যাইবার চল নাই তাই হয়তো কৌতুহলবসত পাড়া-প্রতিবেশি সব পিছনে পিছনে চলিল। অর্ধসমাপ্ত লাল মদ ও বাদাম পড়িয়া রহিল, আমিও ইহাদের পিছনে চলিলাম ডাক্তারের কাছে। শিশুটি বাঁচিবে তো?  

অভিধানে অর্থপিশাচ শব্দটি যাহাদের বুঝাইবার জন্য সংযুক্ত করা হইয়াছিল, এই ডাক্তারটি তাহাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রহিয়াছে। দ্বাররক্ষী মারফত খবর পাইয়া সে রাগত স্বরে বলিল – আরে ইহাদের কি আমার কাছে চিকিৎসা করাইবার মতো অর্থ আছে! ইহাদের কোন এক শিশুকে বৃশ্চিকদংশন করিয়াছে তো আমি কী করিব? আমাকে পশুচিকিৎসক ভাবিয়াছে না কি!”

তাহারা ফিরিয়া আসিল। তবে হুয়ানার উপস্থিত বুদ্ধিতে বিষ অনেকটাই বাহির হইয়া গিয়াছিল, তাই শিশুটি একটু একটু করিয়া সারিয়া উঠিতেছিল। আমি হাঁফ ছাড়িলাম ও গেলাস ইত্যাদি তুলিয়া রাখিয়া রাস্তায় একটু হাঁটিবার জন্য বাহির হইলাম।

নীল আকাশ, রৌদ্র উঠিয়াছে, মৃদু শীতল বাতাস বহিতেছে। রাস্তায় আমি ব্যতীত মানুষ নাই – কেবল হুসহুস করিয়া গাড়ি চলিতেছে। এই শহর সাগর উপকূলের শহর। সামনের টিলা ও ঢালু উপত্যকাসম জমি পার হইয়া মাত্র কয়েক মাইল পশ্চিমে যাইলেই প্রশান্ত মহাসাগরের বালুকাবেলা। এবং সেই উপকূল ধরিয়া সোজা দক্ষিণে চলিলে এক সময় এদেশের সীমা পার হইয়া কিনোদের গ্রাম আসিয়া পড়িবে। আমি মনে মনে এই পথ ধরিয়া পঁচিশ-ত্রিশ মাইল দূরত্ব এবং শতাধিক বৎসর অতীত অতিক্রম করিয়া কিনোদের গ্রামে পৌঁছিয়া গেলাম। কিনো এবং তাহাদের গ্রামের মানুষজন এই অঞ্চলের মূলবাসী। অত্যন্ত গরীব ও সম্বলহীন। ইহাদের জীবিকা মাছধরা এবং সমুদ্রে ডুব দিয়া ঝিনুক হইতে মুক্তা আহরণ।

গরীব বড়লোক শিক্ষিত অশিক্ষিত মূর্খ বা জ্ঞানী – মনুষ্য মাত্রেরই স্বপ্ন থাকে। কিনো ভাবিত - রোজই তো কেবল ছোটছোট মুক্তা হাতে উঠিয়া আসে, বিক্রি করিয়া সামান্যই দাম পাওয়া যায়। ঘোর অনটনে কোনক্রমে তাহাদের দিন কাটে। যদি সে একদিন একটি খুব বড় মুক্তা পাইয়া যায়! তাহা হইলে তাহাদের এরূপ দুর্দিন আর থাকিবে না।

কিনোর নিজস্ব সম্পত্তি বলিতে তাহার মাটির বাড়ি ও একটি ক্যানো বা সরু লম্বা আকারের ডিঙি নৌকা। নৌকা বাহিয়া কিছুটা চলিয়া যাইতে হয়। সঙ্গে থাকে হুয়ানা, বাচ্চাটিকে নৌকাতে কাঁথা পাতিয়া শোয়াইয়া রাখে। সাগরে ডুব দিতে  হইলে বড় একটি পাথর নিজের সঙ্গে বাঁধিয়া দড়ি লইয়া নামিতে হয়। নৌকার উপরে হুয়ানা দড়িদড়া সামলাইয়া রাখে।

সেদিন কিনো সাগরে ডুব দিয়া একটি বড় ঝিনুক দেখিল এবং তাহার ডুবুরি চোখে মনে হইল ইহাতে মুক্তা থাকিতে পারে। তাহা লইয়া সে নৌকাতে উঠিল এবং ঝিনুকটি খুলিয়া দেখা মাত্র তাহার চক্ষু পলক ফেলিতে ভুলিয়া গেল।

সামুদ্রিক চিলের ডিমের মতো বড় গোল বস্তুটি হইতে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় রজতাভা বিচ্ছুরিত হইতেছে।

কিনোর মনে হইল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুক্তাটি তাহার হাতে!

এই অংশটির বিবরণ এতোই জীবন্ত যে আমার মনে হইতেছিল, সত্যই যদি এই অঞ্চলে মুক্তা-ডুবুরিরা আজও মুক্তা আহরণ করিয়া থাকে তাহা হইলে তাহাদের সহিত একটি দিন কাটাইয়া আসিব।

মুক্তাটি পাইতেই কিনোর মনে হইল তাহার জীবন এইবার অন্যখাতে বহিবে। এতদিন সে ও হুয়ানা যে দিবাস্বপ্ন দেখিত তাহা সামনে আসিয়া পড়িয়াছে। হুয়ানা কিন্তু মুক্তাটিতে অমঙ্গলের ছায়া দেখিতেছিল – হয়তো ইহা নারীর স্বাভাবিক দূরদৃষ্টি অথবা সে বিলক্ষণ জানিত গরীবের হাতে এ রত্ন সমাজের মানুষজন মানিয়া লইবে না। কিনো বলিল – দেখ, অমঙ্গল নহে, ইহাই আমাদের জীবনের একমাত্র সুযোগ। এ সুযোগ আর আসিবে না।

এই সময় আমার পড়ার গতি ধীর হইয়া আসিল। কিনো এবং হুয়ানার মনের সযত্ন-লালিত ইচ্ছা ও স্বপ্ন তাহাদের কথোপকথনের মধ্যে প্রকাশ পাইতেছিল। মুক্তা বিক্রি করিয়া তো অনেক টাকা পাওয়া যাইবে। কিনোর প্রথম স্বপ্ন সে তাহার ছেলেকে জামা-জুতা পরাইয়া ইস্কুলে পাঠাইবে। সে পড়িতে শিখিবে! হুয়ানাকে সে বলিল –আমি স্বপ্ন দেখিলাম যে একটি বিশাল অট্টালিকার প্রাচীরে খুব বড় বড় করিয়া লেখা রহিয়াছে। এক-একটি লেখা এই এতো বড়, একটি কুকুরের মতো বড়। কিন্তু আমাদের বালক ছেলে তাহা সব পড়িয়া দিতেছে। ওই অত বড় বড় লেখা – তাহাও!

এক নিরক্ষর আদিবাসী মানুষের এই সরল অভিব্যক্তিটি আমাকে সম্মোহিত করিয়া দিল। মনে পড়িল আমাদের জামশেদপুরের ফ্ল্যাটবাড়ির আদিবাসী ঠিকে-ঝি’টির কথা। সে একবার আমাকে বলিয়াছিল যে তাহার ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি  করাইয়া দিয়াছে। তাহার ছেলে যে পড়িতে এবং লিখিতে পারিবে তাহা বলিতে বলিতে মেয়েটির মুখে অদ্ভুত আনন্দের ছটা দেখিয়াছিলাম। জানিতাম তাহাদের বংশে এই ছেলেটিই প্রথম সাক্ষরতা লাভ করিতে চলিয়াছে।

আর একটি ভারি মধুর স্বপ্নের কথা শুনিলাম। হুয়ানা কিনোর কাছ ঘেঁষিয়া বলিয়াছিল, তাহারা এইবার বিবাহ করিবে। গির্জায় গিয়া পাদ্রীর পৌরোহিত্যে  বিবাহ করিতে কিছু অর্থ খরচ করিতে হয়। সে পরিমাণ অর্থ তাহাদের ছিল না, তাই মনের মিল হইবার পর তাহারা এমনি ঘর করিতেছে। কিনো উৎসাহিত হইয়া বলিল যে বিবাহ হইবে ভালো পোষাক পরিয়া। তাহারা ভালো ভালো পোষাক কিনিবে।

মুক্তাটির খবর গোপন রহিল না এবং নানান গোলোযোগের সূত্রপাত হইল। কিনো মুক্তাটিকে মাটির মেঝেতে গর্ত করিয়া উপরে কিছু চাপাটাপা দিয়া লুকাইয়া রাখিত। কখনো ঘরের কোণে, কখনো শয্যার নিচে। রাত্রিতে দু-তিনটা চোরাগোপ্তা আক্রমণ হইয়া গেল। দেরি না করিয়া পরদিন কিনো, কোলে শিশু লইয়া হুয়ানা মুক্তার বাজারে যাইল। কত দাম ওঠে তাহা দেখিতে বহুলোক পিছন পিছন চলিল।

মুক্তার বাজারটি আমার চেনা লাগিল। অনেক দালাল বসিয়া আছে কিনিবার জন্য, কিন্তু ইহাদের সকলের টিকি একটি বড় ব্যবসায়ীর নিকট বাঁধা। দালালরা নিজেদের ভিতর সাঁট করিয়া অতি কম দামে মুক্তা কিনিয়া লয়। ডুবুরিরা ভাবে যে এতজন যখন একই দর বলিতেছে তখন ইহাই ন্যায্য মূল্য। দালাল ও বড় ব্যবসায়ীর অদৃশ্য একতা বড় মজবুত। এই একবিংশ শতকে ভারতদেশে তো তাহাই দেখিতে পাই।

অদৃশ্য একতার ফলে তিন-তিনটি দালাল অতি কম দাম বলিল। মুক্তাটি নাকি নিকৃষ্ট মানের! তাহারা দেড়-হাজার পেসো (মেক্সিকো মুদ্রা) পর্যন্ত দাম বলিল,  যেখানে দাম পঞ্চাশ হাজার মতো হওয়া উচিত ছিল।

কিনো রাগিয়া বিক্রি করিল না। মনস্থির করিল সে রাজধানী যাইবে এবং তাহা বিক্রি করিবে। কিন্তু সেসব করিবার আগেই পরের পর এমন ঘটনা ঘটিতে লাগিল যে কিনো-হুয়ানার অভাব-অনটনের সংসারে যেটুকু স্বস্তি ও সুখ ছিল তাহা তছনছ হইয়া গেল।

তাহাদের পাতা-ছাওয়া কুটির কে বা কাহারা জ্বালাইয়া দিল। এক অন্ধকার রাত্রিতে চোর আসিয়া ছুরি চালাইল, কিনো আহত হইয়া পড়িয়া গেল। অবশ্য অন্ধকারে কিছু না দেখিয়া সেও ছুরিকা চালাইয়া ছিল। প্রভাতে আলোক ফুটিলে সে সভয়ে দেখিল তাহার ছুরিকাঘাতে একটি তস্কর মারা গিয়াছে। অর্থাৎ সে  খুনি। পুলিস তাহাকে ছাড়িবে না। হুয়ানা ও শিশুপুত্রকে লইয়া সে পলাইল। এই পলায়ন-পর্বের বিবরণে আমার গায়ে কাঁটা দিতেছিল। কোটালের গুলিতে তাহাদের শিশুপুত্রটির মৃত্যু হইল। শেষে তাহারা গ্রামে ফিরিল এবং দুইজনে সাগরের সন্নিকটে আসিয়া  দাঁড়াইল। কী করিবে তাহারা মুক্তা লইয়া? যাহাকে ঘিরিয়া তাহাদের স্বপ্ন পাখা মেলিয়াছিল, সে আর নাই। তাহাদের জীবন এমনভাবে মুচড়াইয়া গিয়াছিল যে মনে হইতেছিল তাহাদের আর কিছুই চাহিবার বা পাইবার নাই। এই সমাজে তাহাদের মত মানুষের কাছে মুক্তা অভিশাপ বিশেষ। সুখের চাবিকাঠি কোথায় থাকে? এই রজতবর্ণা সুন্দরী মুক্তার ভিতরে তো কোনোমতেই নাই! কিনো মুক্তাটি ছুঁড়িয়া সাগর জলে ফেলিয়া দিল।

ঝিনুকের দেহে বালুকণা প্রবেশ করিলে তাহার অস্বস্তি হইতে থাকে ও শরীর হইতে লালারস বাহির হইয়া বালুকণাটিকে ঢাকিয়া ফেলে। কালক্রমে তাহা জমাট বাঁধিয়া মুক্তা হইয়া যায়।

কিনোর সহিত দেখা হইবা মাত্র দেশ-কালের ব্যবধান পার হইয়া যে পরিচিত মুখচ্ছবি আমি দেখিতেছিলাম তাহা বালুকণার মতই আমার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করিতেছিল। ইহার উপর বুঝি কিনো-হুয়ানার “জীবনের মধুমাসে কুসুম দিয়ে গাঁথা মালার শিশিরভেজা” কাহিনী, তাহাদের সরল স্বপ্ন, তাহাদের চারিদিকে হৃদয়হীন পৃথিবীর নাগপাশ, তাহাদের ট্র্যাজিডি – এসমস্ত যেন বালুকণাটির উপর স্তরের পর স্তর ফেলিতেছিল। ঠিক যেমন মুক্তার গঠন হইয়া থাকে।

সাগরের অগাধ জলে কিনোর মুক্তাটি কোন অতল গভীরে ডুবিয়া গেল তাহা কেহ জানে না। কিন্তু আমার মনে যে মুক্তাটি আকার লইল তাহা সম্ভবত রহিয়া যাইবে। কৃষ্ণা-দ্বাদশীর পিঙ্গল চন্দ্রাভার মতো মৃদু রশ্মি বিচ্ছুরণ করিয়া মেক্সিকো হইতে সিংভূমের মানুষজনকে একই আলোকে দেখাইতে থাকিবে।

(জন স্টাইনবেক রচিত ‘দ্য পার্ল’ বইটি পড়িতে পড়িতে লিখিত)