কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

তথাগত চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৯


আবেশ

জাতীয় সড়কের উপরেই বটতলা বাসস্ট্যান্ড। মস্ত বটগাছের নিচে চায়ের দোকান, রিক্সাস্ট্যান্ড, মনিহারির দোকান। চায়ের দোকানের সামনে ছোটো ছোট দুটো বেঞ্চি পাতা। গ্রাহক, খদ্দেরদের আড্ডা মারার সুবন্দোবস্ত। রিক্সা স্ট্যান্ডের অদূরে শিবমন্দির। শোনা যায় ঘন্টাধ্বনি। ভক্ত মানুষের আগমনে জমজমাট জায়গা। মন্দিরে প্রণাম করেই উঠে পড়লাম রিক্সায়। গন্তব্য আনন্দ বাউলের বাড়ি। বাতাসে হেমন্তঋতুর স্পষ্ট উপস্থিতি। আসি আসি করে শীত উঁকি দেওয়া শুরু করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমভাব উধাও। বটতলা থেকে রিক্সায় আনন্দ বাউলের বাড়ি যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। রাস্তা তো সব জায়গায় সমান নয়! কোথাও কাঁচা আবার কোথাও পাকা রাস্তাও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে গত বর্ষার পর। এরই মধ্যে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছি। কখনও সোজা নাক বরাবর আবার কখনও বাঁক নিয়েছে পথ।

আনন্দ আমার পুরনো বন্ধু। আলাপ হয়েছিল বাউলগানের মেলায়। সেও তো প্রায় বছর পাঁচ-ছয় আগে। মেলার পর পরই সেবার গিয়েছিলাম ওর বাড়ি। মেঠো পথ,  বাড়ির খুব কাছেই বহমান নদী। পাড়ে ঠেকিয়ে রাখা নৌকা। নদী নিঃশব্দে বয়ে চলে নিজের পথ ধরে। আনন্দর বাড়ির দাওয়ায় বসে অনেক গান শুনেছিলাম সেবার। সেখানেই আবার যাচ্ছি। শহরের রোজকার কর্মময় একঘেয়ে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে।

পৌঁছে দেখি পাল্টায়নি কিছুই। বাড়ির অদূরেই তেমাথার মোড়। সেখানে কয়েকঘর তাঁতির বাস। কান পাতলেই শোনা যায় তাঁত বোনার অবিচ্ছিন্ন শব্দ। পাশেই পরিষ্কার টলটলে জলের পুকুর। পুকুরের ঘাট বাঁধানো। তেমাথা থেকে বাঁধাঘাট অবধি যাওয়ার রাস্তা আগে মোরামের ছিল, এখন দেখি পিচ ঢালা পাকা রাস্তা হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে চান করলাম পুকুরে। উল্টোদিকের জমি বুনো ঝোপঝাড়ে ঠাসা। হঠাৎ দেখি একটা বড় গো-সাপ, চমকে উঠি। ঘুঘু পাখির একটানা ডাক ভেসে আসছে যেন কোথা থেকে।

চান করে ফিরে একদফা গান শোনালো আনন্দ। বাড়ির উঠোনে বসে। বিহ্বল হয়ে পড়ি। একতারার বোলে, বাউল গানের সুরে আবিষ্ট হয়ে যাই। উঠোনের লম্বা আমলকী গাছে কাঠবেড়ালির আনাগোনা। পাশেই বেগুন গাছে ধবধবে সাদা বেগুন। চেয়ে দেখি চারপাশের গ্রামীণ দৃশ্য। মনে পড়ে যায় আগেরবারের আসার কথা। বেগুন গাছের ঠিক উল্টো দিকেই দেখেছিলাম করমচা, সবেদা আর ডালিম গাছ। এখনও আছে। আনন্দ বাউলের ঘরের উঠোন যেন ছোটখাটো  ফলের বাগান। ও বলল, সবেদা গাছটা কোনোদিন ফল দেয়নি। প্রতিবছর গাছে ফুল আসে আর ঝরে যায়। কী জানি প্রকৃতির এ কেমন খেয়াল!

শুনে অবাক হই। সত্যি এমনও হয়! তাকিয়ে দেখি আমলকী, বেল, বেলীফুল, জুঁই, বাসকপাতার গাছের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবেদাগাছের পাতা হাওয়ায় নড়ছে।

দুপুরের খাবার মাছভাত, ডাল, আলুপোস্ত। শহুরে আদব কায়দায় নয়। পিড়ি পেতে, কাঁসার থালায়। জলও ভারি কাঁসার গ্লাসে।

বিকেলে আবার গান, একতারার বোল। আবার আচ্ছন্নতা, ভালো লাগা। এসবের মধ্যেই কখন যেন কমে আসে আলো। সন্ধা নেমে আসার প্রস্তুতি।

ফিরে আসার সময় হয় আমার। কিন্তু মন চায় না ফিরতে। জানি ফিরতে হবেই। প্রতিদিনের কর্মে, যাপনে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন