কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

অচিন্ত্য দাশ

 

মসীচিত্র

 

একটি মুক্তার কাহিনী




আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের জলবায়ু ভারি মনোরম। তেমন গরম পড়িতে দেখা যায় না অথচ বেশি শীতও নাই। শুনিয়াছি ইহা প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জলরাশির গভীরে প্রবাহিত উষ্ণস্রোতের কারণে। এই অঞ্চলের প্রদেশটির নাম ক্যালিফোরনিয়া। মানচিত্র দেখিলে ইহাকে আমাদের দক্ষিণদেশের কেরেলার  মতো লাগিতে পারে, যদিও ইহার বিস্তার ও আকার বহুগুণ হইবে। জলবায়ু এবং  মাটির কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর ফল ফলিয়া থাকে। যেমন আঙুর, কমলালেবু, আপেল ইত্যাদি। আঙুর অর্থাৎ দ্রাক্ষার অগুন্তি ক্ষেত রহিয়াছে এবং তাহাতে উৎকৃষ্ট মানের দ্রাক্ষার ফলন হয়। দ্রাক্ষা হইতে দ্রাক্ষারস। দোকানে দোকানে বিভিন্ন প্রকারের ‘ক্যালিফোরনিয়া রেড ওয়াইন’ শোভা পাইতেছে - মূল্য তেমন কিছু নহে, অন্যদেশ এমনকি ভারতভূমি হইতেও কম দামের বোতল থরে থরে তাকের ওপর সজ্জিত। তাহারা যেন আমাকে বলিতেছে – আসিয়াছ যখন স্বাদ লইয়া যাও…

বাড়ির পিছনের খোলা উঠানটি বড় সুন্দর। এই স্থানের জমি সমতল নহে, সারিসারি উপত্যকায় পূর্ণ। তাই এই উঠানটি বারন্দা বা ছাদের মতো মনে হয়,  ইহার পশ্চিম দিকের বেড়ার পর জমি ঢালু হইয়া নামিয়া গিয়াছে। গাছ-গাছালি কিছু পরিচিত, কিছু অপরিচিত। ঝোপঝাড়ে লাল লাল কুলের মতো গুচ্ছগুচ্ছ ফল হইয়াছে। দূরে ঘরবাড়ি ও রাস্তায় মাঝেসাঝে দুএকটি গাড়ি চলিতে দেখা যায়।

বেলা বারোটা নাগাদ গেলাসে দ্রাক্ষারস বা সোজা ভাষায় লাল মদ লইয়া  রৌদ্রস্নাত উঠানে বসিয়াছিলাম। সঙ্গে রেকাবিতে কাঠের আঁচে সেঁকা কাঠবাদাম শোভা পাইতেছে। ভারি সুস্বাদু। কত আর প্রকৃতি দেখিব – তাই একটি চটি-বই আনিয়াছিলাম। বইটি খুলিলাম।

উপন্যাসিকা বলা যাইতে পারে, ইংরাজিতে রচিত। লিখনশৈলী এতই সহজ, সাবলীল এবং আড়ম্বরবিহীন যে পড়িতে হোঁচট খাইতে হয় না। প্রথম কটি পাতা তরতর করিয়া পড়িয়া ফেলিলাম এবং তখনই কিনো নামের লোকটিকে দেখিলাম। ইহার বাস মেক্সিকোর সমুদ্র উপকূলের এক গ্রামে। সে দেশে বা সে অঞ্চলে কখনো যাই নাই, বইতে বা সিনেমাতেও কখনো দেখি নাই। এমনকি আজ হইতে একশতাধিক বৎসর পূর্বে যে কালখণ্ডে কিনো জন্মিয়াছিল সে সময়ও আমার অজানা। তবু কিনো মানুষটিকে ভারি চেনা মনে হইল।

এই অঞ্চলে স্প্যানিশ ভাষার প্রভাব রহিয়াছে। ইংরাজি ‘জে’ অক্ষরটির উচ্চারণ জ নহে হ। তাই কিনোর বৌ হুয়ানার নাম ইংরাজি লিখনে ‘জে’ দিয়া শুরু। যাহা হউক এখন সকালবেলা। দুজনে পাতা-ছাওয়া কুটির দ্বারে তাহাদের তিন-চার মাসের পুত্রসন্তানকে দেখিতেছিল। শিশুটি কুটিরের ছাদ হইতে দড়ি দিয়া ঝোলানো বাক্সে শুইয়া নিজের মনে হাসিতেছে ও হাত-পা ছুঁড়িতেছে। এমন সময় হঠাৎ একটি বৃশ্চিক কোথা হইতে আসিয়া সেই দড়ি বাহিয়া নামিতে লাগিল। প্রভাতের সূর্যালোকে তাহার হুল চকচক করিতেছে। সে মৃত্যুদূত হইতে তাহার সন্তানটিকে রক্ষা করিতে কিনো অতি সাবধানে বৃশ্চিকটিকে ধরিতে পায়ে পায়ে অগ্রসর হইতেছে…

আমি শ্বাস বন্ধ করিয়া বাদাম চিবাইতে লাগিলাম … কী হইবে …

শেষরক্ষা হইল না। কিনোর আঙুলের ফাঁকে পিছলাইয়া বিছাটি শিশুটির গায়ে পড়িল এবং তৎক্ষণাৎ হুল ফুটাইয়া দিল। যন্ত্রণায় শিশুটি উচ্চস্বরে কাঁদিয়া  উঠিল। কিনো ঘাবড়াইয়া গেল। হুয়ানা কিন্তু বুদ্ধিস্থির রাখিয়া জায়গাটি কামড়াইয়া ধরিল এবং মুখ দিয়া বিষ সমেত রক্ত যতটা পারা যায় শুষিয়া লইল। তাহা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল – ডাক্তার ডাকিয়া আনো, ডাক্তার!

লোকজন জড়ো হইয়া গিয়াছিল – কে একজন বলিল ডাক্তার এই স্থানে আসিতে রাজি হইবে না। হুয়ানা বলিল – তাহা হইলে ইহাকে লইয়া এখনি ডাক্তারের কাছে যাইব...

সম্মুখে কিনো এবং শিশুটিকে কোলে লইয়া হুয়ানা। এই গ্রামে ডাক্তারের কাছে যাইবার চল নাই তাই হয়তো কৌতুহলবসত পাড়া-প্রতিবেশি সব পিছনে পিছনে চলিল। অর্ধসমাপ্ত লাল মদ ও বাদাম পড়িয়া রহিল, আমিও ইহাদের পিছনে চলিলাম ডাক্তারের কাছে। শিশুটি বাঁচিবে তো?  

অভিধানে অর্থপিশাচ শব্দটি যাহাদের বুঝাইবার জন্য সংযুক্ত করা হইয়াছিল, এই ডাক্তারটি তাহাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রহিয়াছে। দ্বাররক্ষী মারফত খবর পাইয়া সে রাগত স্বরে বলিল – আরে ইহাদের কি আমার কাছে চিকিৎসা করাইবার মতো অর্থ আছে! ইহাদের কোন এক শিশুকে বৃশ্চিকদংশন করিয়াছে তো আমি কী করিব? আমাকে পশুচিকিৎসক ভাবিয়াছে না কি!”

তাহারা ফিরিয়া আসিল। তবে হুয়ানার উপস্থিত বুদ্ধিতে বিষ অনেকটাই বাহির হইয়া গিয়াছিল, তাই শিশুটি একটু একটু করিয়া সারিয়া উঠিতেছিল। আমি হাঁফ ছাড়িলাম ও গেলাস ইত্যাদি তুলিয়া রাখিয়া রাস্তায় একটু হাঁটিবার জন্য বাহির হইলাম।

নীল আকাশ, রৌদ্র উঠিয়াছে, মৃদু শীতল বাতাস বহিতেছে। রাস্তায় আমি ব্যতীত মানুষ নাই – কেবল হুসহুস করিয়া গাড়ি চলিতেছে। এই শহর সাগর উপকূলের শহর। সামনের টিলা ও ঢালু উপত্যকাসম জমি পার হইয়া মাত্র কয়েক মাইল পশ্চিমে যাইলেই প্রশান্ত মহাসাগরের বালুকাবেলা। এবং সেই উপকূল ধরিয়া সোজা দক্ষিণে চলিলে এক সময় এদেশের সীমা পার হইয়া কিনোদের গ্রাম আসিয়া পড়িবে। আমি মনে মনে এই পথ ধরিয়া পঁচিশ-ত্রিশ মাইল দূরত্ব এবং শতাধিক বৎসর অতীত অতিক্রম করিয়া কিনোদের গ্রামে পৌঁছিয়া গেলাম। কিনো এবং তাহাদের গ্রামের মানুষজন এই অঞ্চলের মূলবাসী। অত্যন্ত গরীব ও সম্বলহীন। ইহাদের জীবিকা মাছধরা এবং সমুদ্রে ডুব দিয়া ঝিনুক হইতে মুক্তা আহরণ।

গরীব বড়লোক শিক্ষিত অশিক্ষিত মূর্খ বা জ্ঞানী – মনুষ্য মাত্রেরই স্বপ্ন থাকে। কিনো ভাবিত - রোজই তো কেবল ছোটছোট মুক্তা হাতে উঠিয়া আসে, বিক্রি করিয়া সামান্যই দাম পাওয়া যায়। ঘোর অনটনে কোনক্রমে তাহাদের দিন কাটে। যদি সে একদিন একটি খুব বড় মুক্তা পাইয়া যায়! তাহা হইলে তাহাদের এরূপ দুর্দিন আর থাকিবে না।

কিনোর নিজস্ব সম্পত্তি বলিতে তাহার মাটির বাড়ি ও একটি ক্যানো বা সরু লম্বা আকারের ডিঙি নৌকা। নৌকা বাহিয়া কিছুটা চলিয়া যাইতে হয়। সঙ্গে থাকে হুয়ানা, বাচ্চাটিকে নৌকাতে কাঁথা পাতিয়া শোয়াইয়া রাখে। সাগরে ডুব দিতে  হইলে বড় একটি পাথর নিজের সঙ্গে বাঁধিয়া দড়ি লইয়া নামিতে হয়। নৌকার উপরে হুয়ানা দড়িদড়া সামলাইয়া রাখে।

সেদিন কিনো সাগরে ডুব দিয়া একটি বড় ঝিনুক দেখিল এবং তাহার ডুবুরি চোখে মনে হইল ইহাতে মুক্তা থাকিতে পারে। তাহা লইয়া সে নৌকাতে উঠিল এবং ঝিনুকটি খুলিয়া দেখা মাত্র তাহার চক্ষু পলক ফেলিতে ভুলিয়া গেল।

সামুদ্রিক চিলের ডিমের মতো বড় গোল বস্তুটি হইতে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় রজতাভা বিচ্ছুরিত হইতেছে।

কিনোর মনে হইল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুক্তাটি তাহার হাতে!

এই অংশটির বিবরণ এতোই জীবন্ত যে আমার মনে হইতেছিল, সত্যই যদি এই অঞ্চলে মুক্তা-ডুবুরিরা আজও মুক্তা আহরণ করিয়া থাকে তাহা হইলে তাহাদের সহিত একটি দিন কাটাইয়া আসিব।

মুক্তাটি পাইতেই কিনোর মনে হইল তাহার জীবন এইবার অন্যখাতে বহিবে। এতদিন সে ও হুয়ানা যে দিবাস্বপ্ন দেখিত তাহা সামনে আসিয়া পড়িয়াছে। হুয়ানা কিন্তু মুক্তাটিতে অমঙ্গলের ছায়া দেখিতেছিল – হয়তো ইহা নারীর স্বাভাবিক দূরদৃষ্টি অথবা সে বিলক্ষণ জানিত গরীবের হাতে এ রত্ন সমাজের মানুষজন মানিয়া লইবে না। কিনো বলিল – দেখ, অমঙ্গল নহে, ইহাই আমাদের জীবনের একমাত্র সুযোগ। এ সুযোগ আর আসিবে না।

এই সময় আমার পড়ার গতি ধীর হইয়া আসিল। কিনো এবং হুয়ানার মনের সযত্ন-লালিত ইচ্ছা ও স্বপ্ন তাহাদের কথোপকথনের মধ্যে প্রকাশ পাইতেছিল। মুক্তা বিক্রি করিয়া তো অনেক টাকা পাওয়া যাইবে। কিনোর প্রথম স্বপ্ন সে তাহার ছেলেকে জামা-জুতা পরাইয়া ইস্কুলে পাঠাইবে। সে পড়িতে শিখিবে! হুয়ানাকে সে বলিল –আমি স্বপ্ন দেখিলাম যে একটি বিশাল অট্টালিকার প্রাচীরে খুব বড় বড় করিয়া লেখা রহিয়াছে। এক-একটি লেখা এই এতো বড়, একটি কুকুরের মতো বড়। কিন্তু আমাদের বালক ছেলে তাহা সব পড়িয়া দিতেছে। ওই অত বড় বড় লেখা – তাহাও!

এক নিরক্ষর আদিবাসী মানুষের এই সরল অভিব্যক্তিটি আমাকে সম্মোহিত করিয়া দিল। মনে পড়িল আমাদের জামশেদপুরের ফ্ল্যাটবাড়ির আদিবাসী ঠিকে-ঝি’টির কথা। সে একবার আমাকে বলিয়াছিল যে তাহার ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি  করাইয়া দিয়াছে। তাহার ছেলে যে পড়িতে এবং লিখিতে পারিবে তাহা বলিতে বলিতে মেয়েটির মুখে অদ্ভুত আনন্দের ছটা দেখিয়াছিলাম। জানিতাম তাহাদের বংশে এই ছেলেটিই প্রথম সাক্ষরতা লাভ করিতে চলিয়াছে।

আর একটি ভারি মধুর স্বপ্নের কথা শুনিলাম। হুয়ানা কিনোর কাছ ঘেঁষিয়া বলিয়াছিল, তাহারা এইবার বিবাহ করিবে। গির্জায় গিয়া পাদ্রীর পৌরোহিত্যে  বিবাহ করিতে কিছু অর্থ খরচ করিতে হয়। সে পরিমাণ অর্থ তাহাদের ছিল না, তাই মনের মিল হইবার পর তাহারা এমনি ঘর করিতেছে। কিনো উৎসাহিত হইয়া বলিল যে বিবাহ হইবে ভালো পোষাক পরিয়া। তাহারা ভালো ভালো পোষাক কিনিবে।

মুক্তাটির খবর গোপন রহিল না এবং নানান গোলোযোগের সূত্রপাত হইল। কিনো মুক্তাটিকে মাটির মেঝেতে গর্ত করিয়া উপরে কিছু চাপাটাপা দিয়া লুকাইয়া রাখিত। কখনো ঘরের কোণে, কখনো শয্যার নিচে। রাত্রিতে দু-তিনটা চোরাগোপ্তা আক্রমণ হইয়া গেল। দেরি না করিয়া পরদিন কিনো, কোলে শিশু লইয়া হুয়ানা মুক্তার বাজারে যাইল। কত দাম ওঠে তাহা দেখিতে বহুলোক পিছন পিছন চলিল।

মুক্তার বাজারটি আমার চেনা লাগিল। অনেক দালাল বসিয়া আছে কিনিবার জন্য, কিন্তু ইহাদের সকলের টিকি একটি বড় ব্যবসায়ীর নিকট বাঁধা। দালালরা নিজেদের ভিতর সাঁট করিয়া অতি কম দামে মুক্তা কিনিয়া লয়। ডুবুরিরা ভাবে যে এতজন যখন একই দর বলিতেছে তখন ইহাই ন্যায্য মূল্য। দালাল ও বড় ব্যবসায়ীর অদৃশ্য একতা বড় মজবুত। এই একবিংশ শতকে ভারতদেশে তো তাহাই দেখিতে পাই।

অদৃশ্য একতার ফলে তিন-তিনটি দালাল অতি কম দাম বলিল। মুক্তাটি নাকি নিকৃষ্ট মানের! তাহারা দেড়-হাজার পেসো (মেক্সিকো মুদ্রা) পর্যন্ত দাম বলিল,  যেখানে দাম পঞ্চাশ হাজার মতো হওয়া উচিত ছিল।

কিনো রাগিয়া বিক্রি করিল না। মনস্থির করিল সে রাজধানী যাইবে এবং তাহা বিক্রি করিবে। কিন্তু সেসব করিবার আগেই পরের পর এমন ঘটনা ঘটিতে লাগিল যে কিনো-হুয়ানার অভাব-অনটনের সংসারে যেটুকু স্বস্তি ও সুখ ছিল তাহা তছনছ হইয়া গেল।

তাহাদের পাতা-ছাওয়া কুটির কে বা কাহারা জ্বালাইয়া দিল। এক অন্ধকার রাত্রিতে চোর আসিয়া ছুরি চালাইল, কিনো আহত হইয়া পড়িয়া গেল। অবশ্য অন্ধকারে কিছু না দেখিয়া সেও ছুরিকা চালাইয়া ছিল। প্রভাতে আলোক ফুটিলে সে সভয়ে দেখিল তাহার ছুরিকাঘাতে একটি তস্কর মারা গিয়াছে। অর্থাৎ সে  খুনি। পুলিস তাহাকে ছাড়িবে না। হুয়ানা ও শিশুপুত্রকে লইয়া সে পলাইল। এই পলায়ন-পর্বের বিবরণে আমার গায়ে কাঁটা দিতেছিল। কোটালের গুলিতে তাহাদের শিশুপুত্রটির মৃত্যু হইল। শেষে তাহারা গ্রামে ফিরিল এবং দুইজনে সাগরের সন্নিকটে আসিয়া  দাঁড়াইল। কী করিবে তাহারা মুক্তা লইয়া? যাহাকে ঘিরিয়া তাহাদের স্বপ্ন পাখা মেলিয়াছিল, সে আর নাই। তাহাদের জীবন এমনভাবে মুচড়াইয়া গিয়াছিল যে মনে হইতেছিল তাহাদের আর কিছুই চাহিবার বা পাইবার নাই। এই সমাজে তাহাদের মত মানুষের কাছে মুক্তা অভিশাপ বিশেষ। সুখের চাবিকাঠি কোথায় থাকে? এই রজতবর্ণা সুন্দরী মুক্তার ভিতরে তো কোনোমতেই নাই! কিনো মুক্তাটি ছুঁড়িয়া সাগর জলে ফেলিয়া দিল।

ঝিনুকের দেহে বালুকণা প্রবেশ করিলে তাহার অস্বস্তি হইতে থাকে ও শরীর হইতে লালারস বাহির হইয়া বালুকণাটিকে ঢাকিয়া ফেলে। কালক্রমে তাহা জমাট বাঁধিয়া মুক্তা হইয়া যায়।

কিনোর সহিত দেখা হইবা মাত্র দেশ-কালের ব্যবধান পার হইয়া যে পরিচিত মুখচ্ছবি আমি দেখিতেছিলাম তাহা বালুকণার মতই আমার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করিতেছিল। ইহার উপর বুঝি কিনো-হুয়ানার “জীবনের মধুমাসে কুসুম দিয়ে গাঁথা মালার শিশিরভেজা” কাহিনী, তাহাদের সরল স্বপ্ন, তাহাদের চারিদিকে হৃদয়হীন পৃথিবীর নাগপাশ, তাহাদের ট্র্যাজিডি – এসমস্ত যেন বালুকণাটির উপর স্তরের পর স্তর ফেলিতেছিল। ঠিক যেমন মুক্তার গঠন হইয়া থাকে।

সাগরের অগাধ জলে কিনোর মুক্তাটি কোন অতল গভীরে ডুবিয়া গেল তাহা কেহ জানে না। কিন্তু আমার মনে যে মুক্তাটি আকার লইল তাহা সম্ভবত রহিয়া যাইবে। কৃষ্ণা-দ্বাদশীর পিঙ্গল চন্দ্রাভার মতো মৃদু রশ্মি বিচ্ছুরণ করিয়া মেক্সিকো হইতে সিংভূমের মানুষজনকে একই আলোকে দেখাইতে থাকিবে।

(জন স্টাইনবেক রচিত ‘দ্য পার্ল’ বইটি পড়িতে পড়িতে লিখিত)

 

 

 

 

 

 

 


2 কমেন্টস্:

  1. প্রচলিত কথা যা দেখেন তাই লিখে থাকেন লেখক, এমন সময় এক প্রিয় বিষয় নিয়ে লেখা বই পড়া ।দুই চিন্তন প্রকাশ লেখাটিতে। মুক্তো প্রস্ফুটিত হওয়া দেখিলাম।

    উত্তরমুছুন