কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৯




প্রায় ঘুমন্ত  মানকাটো ছেড়ে যখন স্টেট হাইওয়ে MN-60 W ধরলাম তখনও শহরের দোকান পসার বন্ধ। বাফেলো ওয়াইল্ড উইংস শুনশান। গাড়ি চলেছে ব্লু আর্থ কাউন্টি (Blue Earth County) দিয়ে। নীল মাটির এলাকায় এক শহরের নাম দেখলাম  লেক ক্রিস্টাল। আমি মনে মনে ফটিকজল ফটিকজল বলতে বলতে  যাচ্ছিলাম। ফটিকজল যদিও চাতকপাখি তবু আমার মনের ভাষায় লেক ক্রিস্টাল হল স্ফটিক জল। গেরস্থ উচ্চারণে সেটিই হলো ফটিকজল। সকালের আলোয় ঝকঝকে স্ফটিকের মত উজ্জ্বল সেই জলাশয়। তারপরে এলো ওয়াটোনওয়ান নদীর  (Watonwan river) তীর ঘেঁষে মাডেলিয়া শহর। তারপর সেন্ট জেমস হ্রদের পাশে  সেন্ট জেমস শহর। এলো ভুট্টা আর গমের ক্ষেত বরাবর বাটারফিল্ড টাউনশিপ। হাওয়া বইছে ভুট্টা ক্ষেতে শনশন শনশন। রাস্তায় গাড়িঘোড়া প্রায় নেই বললেই চলে। বিশাল বিশাল গমের সাইলোগুলি যেন নীল আকাশের গায়ে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করছে-

'অবনী বাড়ি আছো?'

খানিক বাদে কোথা থেকে নীল আকাশে মেঘ করে এলো। আমার এমন হয়। কথা নেই বার্তা নেই মন আঁধার করে নাম বিষণ্ণতা।

 'বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস

এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে

পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস

দুয়ার চেপে ধরে–

‘অবনী বাড়ি আছো?’

ভুট্টা ক্ষেতে হাওয়া বইছে শনশন শনশন। ঘাসবনে ফিসফাস ফিসফাস...

'কে যায়... কে যায়?'

ফিসফাস  ফিসফাস...

'কে যায়... কে যায়?'

ফিসফাস ফিসফাস...

'মধুবাণী যায়'

ফিসফাস ফিসফাস...

ফিসফাস ফিসফাস...

 



'একটি মেয়ে ছিলো

কবিতা লিখতে লিখতে কবিতা লিখতে লিখতে

তার সাঁঝ ফুরিয়ে সকাল হয়ে যায়

সকাল মিলিয়ে যায় রাত্তিরে

একদিন এলো এক রাজপুত্তুর

মেয়েটাকে বসিয়ে নিলো তার পক্ষীরাজে

বললো, এসো, বললো, চলে এসো

তোমার কবিতা নিয়ে তোমার দিন নিয়ে

তোমার রাত্রি নিয়ে

আমার কাছে চলে এসো

আমার কাছে দিনও পাবে

আমার কাছে সব কিছুই কবিতা…

মেয়ে খুব খুশি

কলম নামিয়ে রাখলো

সঙ্গে সঙ্গে তার চাঁপার কলি আঙুল

আঙুলগুলি সব ঝরে পড়লো

যেমন ঝরে যায় ফুলে পাপড়িরা

টুপটাপ শব্দহীন

ওই কলমটার ওপরেই'

ফিসফাস  ফিসফাস...

ফিসফাস ফিসফাস...

এইসব গন্ডগোলের ফিসফাসে  বাজ বাহাদুর বেশ বিরক্ত। তার তেল ফুরিয়ে আসছে। তাছাড়া প্যেচুফেস ডেরাইভার তার বিলকুল নাপসন্দ। অগত্যা ইন্টারস্টেট ৯০তে উঠে লুভের্ন বলে একটা ছোট্ট শহরে তেল ভরলাম। গাড়ি থেকে নেমে  হাত পা মেলে, মুখ চোখ ধুয়ে,  মগ ফ্লাস্কের গরম দার্জিলিং চা আর সেই ব্লুবেরি মাফিনের সদগতি করে আবার রওনা দিলাম পশ্চিমপানে।

বাজ বাহাদুর গাইছে ...

'बावरा मन देखने चला एक सपना

बावरे से मन की देखो बावरी हैं बातें

बावरी सी धड़कनें हैं बावरी हैं साँसें

बावरी सी करवटों से नींदिया दूर भागे

बावरे से नैन चाहे बावरे झरोखों से

बावरे नज़ारों को तकना

बावरा मन देखने चला एक सपना...'

বিভার ক্রিক (Beaver Creek) নামে  আর একটা ছোট্ট অচেনা শহরের গা ঘেঁষে আবার রাজ্যবদল করে মিনেসোটা থেকে সাউথ ডাকোটা। এই রাজ্যে স্পিড লিমিট ঘণ্টাপ্রতি ৮০ মাইল। বাজ বাহাদুর চলেছে তীরবেগে। পেরিয়ে যাচ্ছি ছোট ছোট শহরগুলি হামবোল্ট, এমেরি টাউনশিপ, মিচেল, বেটস, হোয়াইট লেক, কিম্বল। আমি চোখ ভরে দেখছি সেই সুদূরপ্রসারী সবুজ আর নীল আর হৃদয় ভরে অনুভব করছি  সেই চলমানতা।

 


'চৈত্রের দিনে ওড়ে তার কালো চুল

সেগুন-কাননে ফুটেছে শিমুল ফুল

কেন যে ব্যাপক সাফল্য নিয়ে আসা?

মন বলে : চলো চাইবাসা চাইবাসা ||

 

সেখানে কে আছে? মন জানে, পাখি জানে

ঘরে-বন্দরে ঘুরে বেড়াবার মানে

সব পেয়ে সব হারানোর ভালোবাসা

আজো মন বলে : চাইবাসা চাইবাসা।'

এমনি করে পথ চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমি আর বাজ পৌঁছলাম মিসৌরি নদীর তীরে। শহরের নাম চেম্বারলেন। মিসৌরি আমেরিকার দীর্ঘতম নদী। রকি মাউন্টেনে এই নদীর জন্ম। তারপর প্রায় ২৩৪১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ভেসে গিয়ে এই নদী মিশে যায় মিসিসিপির সঙ্গে। মিসৌরি নাম এসেছে মিসৌরি ট্রাইবের নামে  যার অর্থ কাঠের ভেলার মানুষ। বহু বছর যাবৎ এই নদীই ছিল এই অঞ্চলের জীবনধারণ এবং নৌ-বাণিজ্যের ধমনী। নদী বেয়ে রমরমিয়ে চলতো পশমের ব্যবসা। নদীর পার্শবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তরে থাকতো বিশাল বিশাল বাইসনের দল আর তাদের চামড়া আর মাংসে ভরণ পোষণ করত সেই সব তেজস্বী অশ্বারোহী মানুষেরা। তারপরে সোনার খনির সন্ধান, রেলগাড়ির ইস্টিশান আর একটা জীবনযাপনের অবসান। চেম্বারলেনকে লাকোটা প্রজাতির নেটিভ আমেরিকানরা বলত মাটির ঘর ( Earth dwelling)। পরে রেল কোম্পানির বড়কর্তা সেলা  চেম্বারলেনের  নামে এই শহরের পুনরায় নামকরণ।

 


এইখানে একটা খুব  সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আর রেস্ট স্টপ দেখে একটু সময় বিশ্রাম নিলাম। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মিসৌরি নদী। আকাশে বাদলের ঘন মেঘ। আর নদীর তীরে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় গায়ের চাদর বাতাসে মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৫০ ফুট লম্বা এক বিশালাকৃতি নেটিভ আমেরিকান মহিলা। তার নাম ডিগনিটি (Dignity: Of Earth & Sky)। চাদরের নীল বরফি কাটা নকশায় সূর্যের আলো ঠিকরোচ্ছে। তার মুখ প্রশান্ত এবং দৃষ্টি স্থির। তার নাম সম্ভ্রম... পৃথিবীর প্রতি... আকাশের প্রতি। সে একা এবং অদ্বিতীয়।



(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন