কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৯


শূন্যপুর ১৬

শহরে প্রথম এল মজিরান্নেসা। জয়নালের হাতখানি শক্ত করে ধরে। জয়নাল এসেছে আগে অবরে সবরে। তার মুখ তবুও ফ্যাকাসে। পাকা বাড়িটা দূর থেকে দেখা ইস্তক জালে পড়া মাছের মতো হাঁকপাকাচ্ছে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পেল্লাই অফিসের পাশে দুকামরা ছোট বাড়িটি ঘাপটি মেরে আছে। টানা সরু বারান্দা। দুইখানি ঘর পাশাপাশি। বারান্দায় পাতা বেঞ্চে ঠেসাঠেসি বসেছে লোক।  একখানি ঘরে কাগজপত্র জমা নিচ্ছে। ডাকছে নাম। অন্য ঘরটিতে ‘মেম্বারসাহেবা’ বসে। নাম ডাকলে মেম্বারসাহেবার ঘরে যেতে হবে, উকিল  বোঝায়। মজিরান্নেসা বেবাক ঘাড় নাড়ে। আরও কত কী বোঝায়! পাখিপড়া করায়। জয়নাল ঘামে। মজিরানবিবির মাথা ফাঁকা লাগে। জয়নালের হাত শক্ত করে ধরতে গিয়ে টের পায়, ঠাণ্ডা। এত ভয় কেন? চোখে হারায়, এমন তো নয়! তবে কিনা, নির্ভরতা। অভ্যাস। ত্রিশ বছর! ওষুধ খায় যেন! মনে করাবে কে?

জয়নালের নাম ছিল আগাগোড়া। মজিরানও ছিল, সাতানব্বুই-এ ‘ডি’ ছাপ্পা পড়ল কেন, জানে না কেউ। আধখানা চাঁদের মতো ডি অক্ষরখানা। বাকি আধখানা রাহু খেল কী? ব্লক অফিস বলল, তারাও জানে না। কী করে তোলা যায়? তাও জানে না। জয়নাল হাঁটেনি বারবার ব্লক আপিসে, এমন তো নয়!  কেউ জানে না ওই রাহুগ্রস্ত চাঁদের থেকে বিবির মুক্তি মিলবে কেমন করে। দুটো বছর পর সে ক্ষান্ত দিল।

ছেলেপিলে বড় হল। মেয়ে পরঘরে গেল। ডি-এর কথা ভুলে গিয়েছিল মজিরান।  ভোট দেওয়া যেত না। কে-ই বা দিতে চায়? সব শালা সমান। বিশ বছর এইমতো গেল। তারপর রটল, আধাচাঁদাদের ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। ডি ভোটার। ডাউটফুল। সন্দেহভাজন তারা।

নিরক্ষর মজিরুনের পরীক্ষা আজ ট্রাইবুনালে। প্রমাণ করতে হবে, সে সন্দেহভাজন নয়। নইলে নির্বাসন। ডাক পড়ে। ঠাণ্ডা হাতখানি তখনও হাতে ধরা। জয়নালের আঙুল খামচে ধরে বিবির শীর্ণ আঙুলদের। দ্বিতীয়বার ডাকে।  ঠাণ্ডা হাত খসে পড়ে হাত থেকে। মজিরানবিবি বিচারসভার চৌকাঠ পেরোয়।

নাম?

জন্মসাল?

নামের বানান?

বাপের নাম?

স্বামী?

বাপ বেঁচে? থাকে কোথা?

একের পর এক। প্রশ্ন চেনা। পাখিপড়া করানো উত্তর। এতটুকু ভুলচুক না হয়।

শেষ প্রশ্নের উত্তরে বাপ মরেছে শুনে মাথা নিচু মেম্বারসাহেবা থমকায়। ধীরে ধীরে মাথা তোলে। এইবার বাগে পাওয়া গেছে।

কত সালে?

এ প্রশ্নের প্রস্তুতি ছিল না। আন্দাজে বলে। মেম্বারসাহেবার ঠোঁটের কোণে হাসি কাঁপন ধরায়।

এইবার বলো দেখি, বাপ যখন মরল, তখন তোমার বয়স কত?

দুধ-জল আলাদা করার যাবতীয় কৌশল মেম্বারসাহেবা জেনেছেন এতদিনে। যোগবিয়োগ করে পাওয়া উত্তর যদি মেলে মজিরানের জবাবের সাথে, তবেই সে ছাড়পত্র পাবে।

মজিরুনের সামনে বাপের শ্মশানযাত্রা ভেসে ওঠে। কিছু খই ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। মায়ের কান্না শোনা যায়। কত বয়স তখন তার? সাত? ছয়? আট? কত? কত? এ বৃদ্ধবেলায় মজিরান খেই পায় না।

আধাচাঁদা এক অলঙ্ঘ্য ছাপ্পা পাকাপাকি হয়।

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন