কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান




 (৬)  

 

আগে ছিল পাটগাছের রূপকথা। কারণ পাটগাছের গল্পটা হচ্ছে বেশ পুরনো দিনের কথা। তখন বিঘার পর বিঘা পাটগাছ বিঘা প্রতি বিক্রি হয়ে যেত ফরেদের কাছে দশ-পনের হাজারে। চাষিদের আর বাড়তি পরিশ্রম করে পাটগাছকে নিকটবর্তী নয়নজুলি বা ডোবা অথবা নদী কিংবা বিলের জলে নিয়ে গিয়ে জাগ দিতে অর্থাৎ পচাতে হত না। তারাও অত পরিশ্রম থেকে বেঁচে যেত। শুধু কেটে মুঠো বেঁধে দেওয়া অবধিই তাদের কাজ। হয়তো পরবর্তীকালে এতে কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। আর তখন থেকেই শুরু হয় কলাগাছের গল্প। এটাও বেশ মজার। সবাই দেখে বা জানে যে আমেনুল ভাই শুধু থোরের ব্যবসা করে। আর তাই তার এত কলাগাছের প্রয়োজন। কলাগাছের পাতাগুলো চলে যায় অবলাদের পেটে। পড়ে থাকে শুধু গাছটা। আর সেটাই তখন কাজে লেগে যায় মান্দাস বানাতে।

যে লোকটি সুবলকে তাড়ির নেশায় মান্দাসের গল্প শুনিয়েছিল সে হাসতে হাসতে বলেছিল, এটা কুন বেহুলার মান্দাস লয় গো শিউলি। এটায় কোন দেবতাদের  কথা নাই। কোন বাঁচার কাহানি নাই। সবটাই যমের দুয়ারের গল্প। মিত্যুর গল্প।

-আরে কী সব কহিছ! খুইলে কহ না। হামি তুমার হেঁয়ালি বুঝি না। সুবল অবাক  হয়ে বলে।

-আরে হামার কথা তো গজুয়া লোকেও বুইঝবে। তুই বুইঝতে পারছিস না? বেহুলার কাহানি তো হামরা সক্কলেই জানি। উয়ার মরা ভাতার লখাইকে লিয়ে গিয়েছিল স্বর্গে দেবতাদের ঠিনে। উখানে নাইচে কুঁদে দেবতাদের মন ভুলায় ফের লখাইকে বাঁচায় লিয়ে নিজের বাড়ি ফিরল কিনা?

-হাঁ তা তো ঠিকই। এটা তো বেবাক মাইনষেই জানে।

-হাঁ ঠিকই কহিছিস। কিন্তু হামরা যে মান্দাস বানাই তাতে আর লখাই-বেহুলা যায় না। তাতে যায় অবলারা। তবে তারা কিন্তু মান্দাসে চইড়া যায় না। তারা যায় ভাইসা। বুঝলি কিছু?

শিউলি সুবল মাথা নেড়ে বলে, তোর খুব লেশা চইড়েছে। তাই উল্টা-পাল্টা কহিছিস। খুইলে কহ। তবে না বুইঝবো।

লোকটি ওর গলায় গেলাস উপুড় করে দেখল এক ফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। তখন  সুবল ওর চারটে হাঁড়ির তলানিগুলো গেলাসে ঢেলে দেখল প্রায় এক গেলাস হয়েছে। তবে ওতে শুধু তাড়িই নেই, সাথে রয়েছে মিষ্টি রসেরও তলানি। যা কিনা নেশা বাড়াতে সাহায্য করবে বলেই সুবলের মনে হয়।

প্রায় এক গেলাস তাড়ি পেয়ে লোকটি তাড়াতাড়ি গেলাসটা গলায় ঢেলে বলল, আর নাই?

সুবল মাথা নেড়ে বলে, তা তুই মান্দাসের ব্যাপারে কি কহিছিলি?

-কুন মান্দাস? লোকটির নেশা হতে শুরু করেছে।

-আবে বেহুলার মান্দাসের কথা কহিছিলি না! সুবল ওকে খেঁই ধরিয়ে দেয়।

-হাঁ ইবার বেহুলা সুন্দরির কথা মনে পইড়েছে আহা! হামার মাগটা যদি অমনটা হইত! এই তো সেদিনকা বিহা করনুরে। আর ইয়ার মধ্যেই শালি হামার দশ  বিয়ানো গাইয়ের মতন বুড়ি চেহারার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে ধরে কইষে শালিক এক লাথ মারি।

-তুই কি বেহুলাক দেখছু? দেখিস নাই তো। ওসব ছাড়ে ইবার আসল কথাখান কহ। সুবল বলে।

-হাঁ ইবার মনে পইড়েছে। কথাখান ছিল মান্দাস লিয়ে। তা একখান বয়েলের দু’দিকে দু’খান কইরা কলা গাছ আর বাঁশ দিয়া শক্ত কইরা ওর শরীলের সাথে  বাঁইন্ধা দেয়া হয়। তারপর একসাথে স্রোতের মুখে একসাথে জলত নামায় দিলেই ওরা সাঁতরায় সাঁতরায় ঠিক উলটা দিকের ঘাটে চইলে যাবে। আর তখন বাংলা দেশের মানুষগুলান আগে থাইকতেই নাও নিয়া জলে পাহারা দেয়। নিজেদের সীমানায় ঢুইকলেই আর কুন ভয় নাই। হামাদের এদিককার জল বিএস এফ ভুটভুটি লিয়ে অদের সীমানায় যাতে পাইরবে না।

-কিন্তু এমন যদি হয় যে দু’একটা অবলা তো ভাইসতে ভাইসতে স্রোতের টানে  অন্য দিকে চইলে যাতে পারে! তখন কী হবে শুনি! সুবল একটু ভেবে বলে।

-তোক হামি যে কহনু কি অদের দিকের পদ্মায় আগে থাইকতেই লোকেরা নাও নিয়া খাড়ায় থাকে। আর যে সব অবলা স্রোতের টানে অন্যদিকে ভাইসে যায় তাদের ওরা নাও নিয়া ফিরায় আনে। ব্যস! একবার ঘাটে উঠায় লিলেই কাম শ্যাষ। কেল্লা ফতে। লোকটি হাসলেও মাথাটা একটু সামনে ঝুলে পড়ে।

-তাহলে তোরা কুন কামে লাগিস? সুবল লোকটির হাত থেকে গেলাসটি নিয়ে জানতে চায়।

-হামাদের কাম হল ঐ অবলাদের দু’দিকে দু’খান কলাগাছ শক্ত কইরে রশি দিয়ে বাঁইন্ধে জলে ভাসায় দেওয়া। লোকটি এবার প্রায় হাঁটু দুটোর মাঝে নিজের মাথাকে গুঁজে দিয়েছে।

-মালিকের সাথে তোদের হিসাবটা কেমন? সুবল জানে লোকটিকে আর বেশিক্ষণ কথা বলানো যাবে না। তলানিতেই যদি ওর এমন অবস্থা হয় তাহলে আসল তাড়ি পেটে পড়লে কী হত!

-খুব বেশি টাকা নাই। একশো অবলায় দু’হাজার মাত্র। হামরা দু’জনেই দু’শো অবলাকে সামটে লিতে পারি।

-উরে বাপরে! তাহলে একদিনেই তগো এক একজনের দু’হাজার করে কামাই! সুবল বিস্মিত হয়।

-এ কামের খুব রিস্ক আছে। অবলার শিঙের গুঁতা আর পায়ের চাট খালে না  কারোর বাপের নাম আর মনে পইড়বে না। হামাকে দু’বার চাট মাইরেছে। হাঁসপাতালে যাইতে হয়েছিল। বুঝলি কিনা?

-তাতো বুইঝলাম। কিন্তু অত কলাগাছের কী হয়?

-আরে ওগুলানকে ভেলা বানায় রাইতের বেলায় একখান নাও নিয়া ওপারের লোক অদের জল সীমানা পর্যন্ত আসে। আর এদিককার নাওয়ের সাথে ঐ রশি বাঁইন্ধা দিলে ফের হামাদের এদিককার মাঝি ঘাটে নাও ভিড়ায় দিলে সব মান্দাস ডাঙায় তুলে। লোকটি আর কথা বলতে পারে না। একেবারে গড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে।

সুবল জানে ওর পকেটে গতকাল রাতের কামাই করা টাকা আছে। যে কেউ তা নিয়ে নিতে পারে। সুবল লোকটির জামার পকেট থেকে টাকাটা বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যদিও তাকে একটু বেশিই হাঁটতে হবে। তবু সে লোকটির গ্রামে  গিয়ে ওর বউয়ের হাতে টাকাগুলো দিয়ে বলে আসে যে তার ভাতার অমুক জায়গায় তাড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে। লোকটির বউয়ের অবশ্য এমন কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে টাকাটা একবার গুনে দেখে। পুরো দু’হাজারই রয়েছে। বউটি মুচকি হেসে বলে, বইসবেন না?

-না। বেলা অনেক বাইড়েছে। ঘরে ফিরতে হবে। অকে গিয়ে লিয়ে আস। সুবল বলে ।

-আপনার মতন লোক ছিল বইলাই না এতগুলান টাকা এই পথম চোক্ষে দেইখলাম! সারা রাইত কাম কইরা টাকা তো কম পায় না। কিন্তু ওর তাড়ি- মদের লেশায় সব উইড়ে যায়। ওরে মাইনষে ঠকায় নেয়। সংসার ঠিক মত চলে না। ঘরে এত্তগুলান প্যাট। আপনাকে সংসারের দুঃখের কথা কয়ে দিলাম। কিছু আবার মনে কইরলেন না তো? বউটি লজ্জা পেয়ে বলে।

সুবল হেসে মাথা নেড়ে বলে, না। মনে কইরবো কেন। গ্রামে-গঞ্জের ঘরে ঘরে উঁকি দিলেই শোনা যাবে অভাবের গল্প বাতাসে ভাসে। সামান্য কাম কইরলেও তো লোকে কিছু একটা করে। কেউ তাতেই একবেলা চালায়। আবার কেউ কুলাইতে পারে না। এই আমারে দেখ। নিজে তাড়ি-মিষ্টি রস বেঁচি বটে কিন্তু হামি এসব খাই না।

বউটি এবার হেসে বলে, আপনি তো গজুয়া মানুষ না, আপনি চালাক আছেন। অন্যকে লেশা ধরালেই আপনার লাভ। তাহলে নিজে আর খাইবেন কেন!

এ কথার কোন উত্তর হয় না। তাই শিউলি সুবল ওর বাঁক কাঁধে তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে ওদের বাড়ি ছেড়ে নিজের গ্রামের পথে হাঁটা দেয়। আর মনে মনে ভাবে এবার সোলেমানদের গদিতে গিয়ে ওর পারিশ্রমিকটাকে বাড়াতে বলবে। এতগুলো জওয়ানকে তাড়ির লোভ দেখিয়ে আটকে রাখা কি চাট্টিখানি কথা নাকি! নেহাত এরা সবাই তাড়িখোর। তবে ওরা মিষ্টি রস খেতেও ভালোবাসে। এত বড় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এরা আসে। সবাই যে তাড়ি খেতে অভ্যস্ত এমনটা নয়। কারণ অনেকের জেলাতে তাড়ির চলন হয়তো নেই। কিন্তু এখানে অন্য সব বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম প্রথম মুখ বিকৃত করে নাক টিপে তাড়ির গেলাস মুখে ঢেলে দিয়ে যখন দেখে এত কম পয়সায় এমন ভালো নেশা করা যায়, তখন আর সে ছাড়তে পারে না। এক একজনের ভাষা এক একরকম। সুবলের কাছে সবই দুর্বোধ্য মনে হয়। তবে সে চালিয়ে নেয়। আর মনে মনে বেশ গর্ব বোধ হয়। এদের সব থেকে বড় অফিসার সাহেব যেদিন আসে সেদিন এরা কেউ মুখে তাড়ির গেলাস তোলে না। সেদিন এরা সবাই দিব্বি সুবোধ বালক হয়ে যায়। অবশ্য বড় সাহেবের আসার কথা সুবলকে এরা আগেই দিয়ে দেয়। ফলে সুবল সেদিন এ মুখো হয় না। বরং এই গোপন কথাটা সে চট করে সোলেমানদের গদিতে গিয়ে বলে আসে। ফলে সেদিন সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো একেবারে শান্ত থাকে। শুধু গৃহস্থেরা নিয়মিত যেমন নিজের নিজের জমিতে হাল-বলদ নিয়ে যায় তেমন ছবিতে কোন বিঘ্ন ঘটে না । তবে সেদিন আর গোক্ষুর ধুলোয় গ্রামের আকাশ ঢেকে যায় না। ছুটছাট গৃহস্থের অবলা প্রাণী ছাড়া গঙ্গার তীর সংলঙ্গ চারণভূমি একেবারে ফাঁকাই পড়ে থাকে।

এসব দিনে শিউলি সুবলকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। মিষ্টি রস থেকে তাড়ি সবই দূর দূর গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতে হয়। তাও কিছুটা লুকিয়ে। মিষ্টি রসের হাঁড়ি শেষ হতে বেশি দেরি হয় না। কিন্তু তাড়ির হাঁড়ি দেখলেই গ্রামের বউয়েরা নাকে শুধু আঁচল চাপাই দেয় না, নিজেদের স্বামীর এ ব্যাপারে সামান্য দোষ থাকলেই সুবলকে তাড়াতাড়ি গ্রাম ছাড়তে বলে। বউয়েরা জানে এসব ছাইভষ্ম খেলে তাদের স্বামীরা কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। তাই তাদের সারা শরীরেই এক অজানিত ভয় খেলে যায়। সুবলও ওদের আপত্তিকে যথেষ্ট আমল দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ে।

ফুল যে বাগানেই ফুটুক না কেন বা তা যত দূরেই হোক না কেন মৌ্মাছির ঝাঁকের সেখানে পৌছাতে খুব একটা দেরি হয় না। ওদের ঘ্রাণশক্তির কোন তুলনা নেই। ফুলের গন্ধে গন্ধে সে অনেক পথে ভাঙতেও রাজি। কাজেই শিউলি সুবলের হাঁড়িতে যে মধু রয়েছে তা তাড়িখোর মৌমাছিদের নাকে যেতে বেশি সময় লাগে না। আর একজনের নাকে বা নজরে গেলে তারপর আরো পাঁচজনের জুটে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

গ্রামের অদূরে যে বিশাল প্রাচীন বটগাছটা রয়েছে সেখানেই বসেছে তাড়ির আসর। মধ্যমণি হচ্ছে শিউলিগ্রামের সুবল। ওকে ঘিরেই বাকি মৌমাছিরা বসে রয়েছে। বিভিন্ন গ্রামের বউ-ঝিদের উচিত কথা শুনে বা বলা ভালো মৃদু ধমক শুনে সে ভেবেছিল আজ কপাল মন্দ। সব তাড়ি হয়তো ফেলেই দিতে হবে। কিন্তু ঠিক মৌমাছির দল ধেয়ে এসে ওকে নিয়ে গিয়েছে বটগাছের পেছনে। এমন ভাবে সবাই বসেছে যে তারা ঢাকা পড়ে গেছে গাছের মোটা গুঁড়ির আড়ালে। সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর হলুদের মেলবন্ধনে সুবিশাল চাদরের মতো শুয়ে রয়েছে সরষে খেত। আর তার মাথাতেও ভনভন করছে হাজার হাজার মৌমাছি। এরাও মধুলোভী। তবে নিজেদের জন্য নয়। সবটাই চলে যাবে বাসায়। যেখানে একমাত্র রানী তাদের অপেক্ষায় সময় গুনছে।

সেই সকাল থেকে এত বেলা পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘোরায় তাড়ি আরো গেঁজে গেছে। এমন তাড়ি মাত্র এক গেলাস পেটে পড়লে সবাই নিজেকে রাজা-বাদশা বা স্বয়ং ভোলানাথ ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সংশয় একটা জায়গায়। আর তা হল বাবা মহেশ্বর কোনদিন তাড়ি খেয়েছেন কি না! তিনি শ্মশানেই প্রায় শুয়ে থাকেন। আর গঞ্জিকা সেবন করেন। অথচ তাড়ি কোনদিন খেয়েছেন কিনা তা এখানে উপস্থিত কেউ বলতে পারল না। এমনকি শিউলি সুবলও না। সে তার দীর্ঘ শিউলির জীবনে বহু তাড়িখোরদের দেখেছে। তাদের মধ্যে মারামারিও দেখেছে। কখনও তাকে তাড়ির হাঁড়ি ফেলে শুধু বাঁক নিয়েই পালিয়ে যেতে হয়েছে। এমন অভিজ্ঞতার অন্ত নেই! মাতাল হয়ে গেল মানুষের আর ভালো-মন্দের জ্ঞান থাকে না। তাই ইদানীং তাড়ি খাওয়া শুরুর আগেই সে সবার কাছ থেকেই দাম চেয়ে নেয়। কেউ পরে দিচ্ছি বললে সে তাকে একেবারেই না করে দেয়। সে যতই তার পরিচিত লোক হোক না কেন। কারণ শিউলির জাত ব্যবসা হল রস-তাড়ি বিক্রি করা। আর রুটম্যানের কাজটা হল একেবারে বাড়তি ব্যাপার। সে তো আর রোজ রোজ নয়। মাসে দু’দিনও হয় আবার তিনদিনও। তবে কুয়াশার সময়ে একটু বেশি হয়। কারণ তখন কারোর চোখই বেশিদূর পর্যন্ত চলে না। আর বর্ষার সময় পাটগাছ বাড়লে তার সুযোগটাই নিয়ে থাকে সোলেমানের মতো লোকেরা।

শিউলি সুবল পর পর দুটো গ্রামের বউদের কাছে মৃদু তাড়া খেয়ে গ্রাম ছেড়ে একেবারে কোণাকুণি মাঠের আল পথ ধরেছিল তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌছানোর  জন্য। আর তখনই ওকে পেছন থেকে কয়েকজন ডেকে দাঁড় করিয়ে তাড়ি খাওয়ার বায়না করে। ওরাই তাকে মাঠের মাঝে একটা প্রাচীন বটগাছের নিচে নিয়ে যায়। এখন সবার তাড়ি খাওয়া শেষ হলেও কেউ আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। কেউ দুই ঠ্যাঙে মাথা গুঁজেছে, কেউ বটগাছকে বেষ্টন করে চারদিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে, আবার কেউ একেবারে সটান ঘাসের মধ্যেই লুটিয়ে পড়েছে।  এই দৃশ্যের কথা গ্রামে পৌছালে তার আর রক্ষা নেই। মহিলারা তাহলে ঝাঁটা নিয়ে ওকে তাড়া করবে। তার চেয়ে এখান থেকে সটকে পড়ার এটাই উপযুক্ত সময়। সুবল ওর বাঁকে হাঁড়ি ঝুলিয়ে যেমনি এক পা বাড়িয়েছে অমনি এক মাতাল ওর লুঙ্গিটা টেনে ধরল। সুবল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যে ধরেছে সে শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলছে, এই শালা, আমাকে ছেড়ে পালাচ্ছিস কোথায় বল? আমাকে তাহলে কে নিয়ে যাবে?

সুবল জানে এদের সাথে যত কথা বলা যাবে এরা ততই বকবক করে যাবে। সুবল আলতো করে বলল, এই তো তোমার জন্য গাড়ি আনতে যাচ্ছি।

-ঠিক আছে তাড়াতাড়ি যা। আমার মাগকে তো তুই চিনিস না, টের পেলে তোকেই ঝাঁটাপেটা করবে। লোকটি এ কথা বলে সুবলের লুঙ্গি ছেড়ে দেয়।

সুবল প্রায় একলাফে বটতলা থেকে নিচে নেমে আল ধরে দ্রুত পা চালায়। একেবারে গ্রামের লোক হলেও সুবল চট করে আলের পথ মাড়ায় না। ও জানে জমির এই সব আলের নিচেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে কাল কেউটে। একটু মৃদু পায়ের শব্দ পেলেই একেবারে ছোবল দিয়ে বসবে। আর এক ছোবলেই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। ও খুব দ্রুত আলপথ পার হয়ে একেবারে বড় রাস্তায় গিয়ে ওঠে।

এখন আর সুবলের বাঁকের হাঁড়িতে একবিন্দুও মিষ্টিরস বা তাড়ি নেই। তাই কাঁধেও কোন ভার নেই। মনটাও ভীষণ ফুরফুরে হয়ে গেছে। তাই আর খুব একটা দ্রুত পা চালাতে ইচ্ছে করছে না। বরং হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে শীতের নরম দুপুরে সুবল সেই পুরনো গানটাই আবার প্রথমে গুনগুন করে, তারপরে বেশ জোরে জোরে গেয়ে ওঠে, ‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁন্ধো মন / না বাঁন্ধিলে অন্ন কষ্টে কাটিবে সারা জীবন’।

শিউলি সুবল জানে তার যখন কোন গানের সঠিক লাইন মনে পড়ে না, তখন সে নিজের মতো করেই সেই গানটিকে মিলিয়ে দিয়ে গাইতে পারে। এক বিস্মৃত গানের লাইনের সাথে নিজের মন গড়া একটা বাক্যবন্ধ তৈরি করতে সে বেশ পটু। আর এটা তার অহংকার। এতে ওর বউ মুচকি হাসতে হাসতে বলে, রামের কাঁধে শ্যামকে বসায় দিলেও শুইনতে ভালই লাইগছে। তুমি ভজা মাস্টারের মনসার দলে নাম লিখালেই পার। ওরা তুমাকে লুফে লিবে।

-না, লিবে না। সুবল বিড়ি টানতে টানতে বলে।

-কেন লিবে না শুনি? পাঁচ-দশ গাঁয়ে ক’জন গান বাঁধনদার আছে? বউ যুক্তি খাড়া করে।

-আরে বাবা মনসা গানের একখান নিজস্ব চলন আছে। উয়ার পুঁথি আছে। কেউ তার বাহিরে যাবে কীভাবে শুনি? তবে হ্যাঁ, হামি আর একখান নয়া মনসা পালাগান লিখতেই পারি। কিন্তু তাতেও বিপদ আছে। উলটো পালটা লিখা যাবেনি। তাহলে মায়ের চ্যালারা রাগে যাবে। সুবল সেদিন বউয়ের কথায় সায় দেয়নি। তবে সে এটাও জানে, যে কোন প্রচলিত গানে সে ইচ্ছে মতো নতুন কথা বসিয়ে মিলিয়ে দিতেই পারে আর এটা তার সহজাত গুণ।

শিউলি সুবল দাস নিজের বাড়িরে ঢুকতে গিয়ে থমকে যায়। বাঁশের প্লকা বেড়াটা একেবারেই শুয়ে পড়েছে। এরপরে যে কোনদিন বাইরের কুকুর নিশ্চিন্তে ঢুকে যেতে পারে। তাই এবার সোলেমানকে রুটম্যানের কাজের জন্য টাকা বাড়াতে বলতেই হবে। আর সেই টাকায় সে আগে বাড়ির সদর দরজাটা বেশ পাকা পোক্ত করে তৈরি করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন