কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(১৯)  

হৃদয় যেদিন উপমার জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি দিয়েছিল, সেদিন অনির্বেদ আসতে পারেনি। ওর বাবা তখন খুব অসুস্থ। কিন্তু ঠিকমতো চিকিৎসা করানোর পয়সা ছিল না ওর। অনির্বেদের বাবা প্রায় বিনা চিকিতসাতেই ছিলেন। সেদিন উনি অজ্ঞান হয়ে যান। অনির্বেদ বাবাকে নিয়ে ছোটে সরকারি হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেস ডাকার অর্থ ছিল না। একটা অটোয় ছেলে আর মা কোনওরকমে ধরাধরি করে তাঁকে নিয়ে যায়। হাসপাতালেও চরম অব্যবস্থা। একটাও বেড জোটে না অনির্বেদের বাবার। নোংরা মেঝেতে চাদর পেতে কোনওরকমে বৃদ্ধ মানুষটিকে শুইয়ে রাখা হয়। রাতের দিকে তিনি মারা যান। বাবার প্রতি তেমন কোনো টান ছিল না অনির্বেদের। এই লোকটি যেন ছিল ওর জীবনের দারিদ্র, দুর্দশা ও অশিক্ষার মূর্ত প্রতীক। বাবার পরিচয় ওর কাছে ছিল চরম অসম্মানের কারণ। সব জায়গায় নিজের বাবাকে লুকোতে চাইত ও।

বাবার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন অনির্বেদের চোখে এক ফোঁটাও জল আসেনি। কিন্তু রাগ হয়েছিল খুব। অর্থের অভাবে মানুষটা বিনা চিকিৎসায় মরে গেল। সে ভালো কোনও ডাক্তার দেখাতে পারেনি, ওষুধ কিনতে পারেনি, চিকিৎসা করাতে পারেনি। ওর বন্ধুরা সবাই পার্টিতে ব্যস্ত। ওদের কারো বাবা বা মা অসুস্থ হলে কি এরকম হত? অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে শেষ সময়ে কী টানাহেঁচড়াই না চলেছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স জোটেনি। উপযুক্ত ব্যবস্থা আছে এমন কোনও হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁকে। একটা বেডে পর্যন্ত শোয়ানো যায়নি।

অনির্বেদ বন্ধুদের কিছুই জানায় না। ওরা আনন্দ করবে করুক। ওদের জীবন আর তার জীবন এক নয়। বাবার মৃত্যু অনির্বেদকে একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল। হৃদয়ের কাছে এসে সে বলেছিল, আমি আর তোদের সঙ্গে থাকতে পারছি না।

হৃদয় যেন কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। এতটা ও ভাবেনি। অবশ্য অনির্বেদের কাছে এটাই প্রত্যাশিত। অতলান্তের মতো ঠারেঠোরে কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার লোক ও নয়। যা বলবে কটু হলেও মুখের ওপর স্পষ্ট করেই বলবে। আর সেটা যতটুকু দরকার ততটুকুই। যেটা ও গোপন করতে চায় সেটা কখনই প্রকাশ করবে না।

হৃদয় স্পষ্ট জানতে চাইল, কেন?

আমার এখন একটা চাকরির দরকার। অন্য কিছুতেই আমি মন দিতে পারব না। অনির্বেদ অকপটে জানাল।

হৃদয় ব্যাপারটা বুঝল। অনির্বেদ মনস্থির করেই এসেছে। এখন আর অন্য কোনও যুক্তিই ওর কাছে গ্রাহ্য নয়। চাকরিটা বেহাত হওয়ার জন্যই ও চাকরির জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। অবশ্য ওর মতো আর্থিক অবস্থায় থাকলে এটাই হয়ত খুব স্বাভাবিক। বিষণ্ণ মনে অনির্বেদকে বিদায় দিল হৃদয়।

অনির্বেদ সত্যিই আসা বন্ধ করে দিল। কয়েক মাস কেটে গেল এইভাবে। হঠাৎ একদিন আবার এল অনির্বেদ। ওর বোনের নিয়ে। হৃদয় অবশ্য একটু অবাকই হল। ওকে একাই নিমন্ত্রণ করেছে অনির্বেদ। ওর মাকে বাদ দিয়েছে। একবারও যেতে বলেনি। অথচ এই তো সেদিন পর্যন্ত এই বাড়ির ছেলে হয়েই যেন ছিল অনির্বেদ। যখন-তখন আসত, খেত। রাতে ঘুমিয়েছে কতদিন। ওর মায়ের কাছে কত যত্ন পেয়েছে। অনির্বেদের আর্থিক অবস্থা কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে?

অনির্বেদের বোনের বিয়েতে গিয়ে কিন্তু চমকে গেল হৃদয়। সেখানে সপরিবারে আমন্ত্রিত হয়েছে অতলান্ত আর প্রাইভেট সেক্রেটারি। অনির্বেদ তাদের খুব খাতির-যত্ন করছে। বরং হৃদয়ের প্রতি ওর ব্যবহার যেন একটু শীতল। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া মনোভাব নিয়েই মিশছে। কথা বলছে। দূরে দূরে থাকছে। হৃদয় অল্প কিছুক্ষণ থেকেই সেদিন ফিরে এলো।

এর কয়েকদিন পরেই ফুলের কোম্পানিতে চাকরিটা পেয়ে গেল অনির্বেদ। হৃদয়কে ফোন করে জানাল, তোর বাড়িতে যাব। দেখা করে আসব একদিন।

কয়েকদিন পর হৃদয়ই ফোন করল অনির্বেদকে। বলল, আমাদের ফুলের বাগানের জন্য তোর একটা চিঠি চাই। পারবি?

হ্যাঁ অবশ্যই। তবে আমি তো আর চিঠি লিখি না। জোকস লিখি। অনির্বেদ বলল।

ঠিক আছে, একটা জোকসই দিস তাহলে।

না একটা চিঠিই বরং চেষ্টা করে দেখি, অনেকদিন লিখি না তো...

কবে আসছিস? আগের মতোই সরলভাবে জানতে চাইল হৃদয়।

পরশু। আমি গিয়ে দিয়ে আসব। তুই থাকবি তো?

শুধু থাকব না, তোর জন্য অপেক্ষা করব।

পরশু কিন্তু এল না অনির্বেদ। ফোন করল। তারপর বলল, আমি যেতে পারছি না রে। তুই একবার আসতে পারবি?

খুব রাগ হয়ে গেল হৃদয়ের। স্পষ্ট জানিয়ে দিল, না।

ঠিক আছে, আমি বরং ওটা বিশ্রুতকে দিয়ে দেব।

বিশ্রুতের সঙ্গে রোজ লাঞ্চে দেখা হত অনির্বেদের। ওরা একই সঙ্গে যেত। বিশ্রুত যেত ডান্স কলেজে আর অনির্বেদ যেত কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখানেই ওর পোস্টিং হয়েছিল। প্রত্যন্ত এক দ্বীপে। বিশ্রুত পরে বলেছিল, প্রথম থেকেই ও তোর সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করে এসেছে। কিন্তু দারিদ্র ও অভাবের জন্য কখনও নিজেকে তোর প্রতিপক্ষ ভাবতে পারেনি। চাকরি পেয়ে ও বুঝিয়ে দিল, প্রতিপক্ষ হিসাবে ও কারো চেয়ে কম যায় না। সামান্য একটা লেখার কাগজ নিয়েও যেরকম দরাদরি করল! চিঠিটা পাঠিয়ে দিল কিন্তু আগের মতো তোর বাড়ি এল না। বরং তোকেই লেখাটা আনতে যেতে বলে বুঝিয়ে দিল ওর অধিকার এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।...

হৃদয়ের তখন মনে পড়ছিল ছোট্ট একটা ঘটনা। ওদের ফুলের বাগানে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। সবাই সেদিন হাজির ছিল। এই ফুলের বাগান গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে সকলেই কিছু না কিছু বক্তব্য রেখেছিল। সেদিন সবাই যখন চলে যাচ্ছে, থমকে দাঁড়াল অনির্বেদ। হৃদয়ের মনে হল সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু একটু যেন ইতস্তত করছে।

হৃদয় জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাল। অনির্বেদ বলল, আমার এক বন্ধু কী বলল জানিস...

কী? সরলভাবেই জানতে চাইল হৃদয়।

আমরা সবাই মিলে তোকে নায়ক বানিয়ে দিয়েছি।

কথাটা বলেই নিমেষে মিলিয়ে গেল অনির্বেদ। ওর যেমন স্বভাব। গুলিবিদ্ধের মতো চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল হৃদয়। মানুষ এভাবেও ভাবতে পারে! ওর তো কিছু মনে হয়নি। গোটা সময়টা ওকে নিয়ে অনেক প্রসঙ্গই উঠে এসেছে। বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। লজ্জাও করছিল একটু একটু। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিটা উল্লেখই তো প্রাসঙ্গিক। এরকমই তো ঘটেছে। কাউকে কিছু বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো সেখানে ছিল না। অনির্বেদের বন্ধুটির হয়তো বেশি বেশি উল্লেখ ভালো লাগেনি। কিন্তু তার কথাটা অমনভাবে লুফে নিল কেন অনির্বেদ? এমনকি ওকে সেটা জানিয়ে যেতেও ভুলল না? একেই কি বলে ঈর্ষা?

কিছুদিন পর প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা হল হৃদয়ের। লঞ্চে চেপে সে হৃদয়পুর ফিরছে। দূরে হৃদরপুরের বহু প্রাচীন ক্যাথিড্র্যালটা দেখা যাচ্ছে। কী এক রহস্য যেন লুকিয়ে আছে সেখানে। হৃদয় সেদিকে তাকিয়ে সেই রহস্যের ভেতরে ঢুকতে চাইছিল।

প্রাইভেট সেক্রেটারি বলল, আমাদের কোম্পানিত্ব দু-ধরনের ছেলে চাকরি করতে আসে। একদল আসে নিজেদের যোগ্যতা দেখিয়ে। আর একদল কাজ না শিখেই চলে আসে। কিছুই লিখতে পারে না। এদের আমরা করুণা করে চাকরি দিই। তোমাদের ওই অনির্বেদ ছেলেটা...

চাকরিটা খুব দরকার ছিল অনির্বেদের। কিন্তু করুণার হাত থেকে ওর রেহাই জোটেনি...

কথাটা ভাবতেই কেমন বিষণ্ণ বোধ করল হৃদয়।  

 

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন