কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৭৩






ঝাড়খন্ড রাজ্যে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন করা হয়েছিল ধানবাদে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুন মাসে। এবছর ছিল মেলার দ্বিতীয় বছর। গত ৮ই নভেম্বর থেকে ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত। ধানবাদের শতাব্দী প্রাচীন লিন্ডসে ক্লাবের সহযোগিতায় ক্লাবেরই মঞ্চ ও মাঠে বসেছিল মেলার আসর। শুধু বাংলা লিটল ম্যাগাজিন নয়, মেলায় উপস্থিত ছিল হিন্দী, সাঁওতালি, কুড়মালি, খোট্টা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন। যদিও এই মেলাকে ‘বহির্বঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলা’ শিরোনামে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু বহির্বঙ্গের পাশাপাশি মূল বঙ্গেরও অনেক লিটল ম্যাগাজিন মেলায় যোগদান করেছিল। তবে একথা স্বীকার করতেই হয় যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর মেলা ছিল অনেকটাই নিষ্প্রভ, যদিও সংগঠকদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। অবশ্য এ বছর পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মেলার শেষ দিনে অনেক আলাপ আলোচনার পর গঠন করা হলো ‘বহির্বঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’, যার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রায় সবাই সহমত পোষণ করেন। আগামী বছর থেকে ধানবাদে বহির্বঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন করবে ‘ফোরাম’। এবং এই উদ্দেশ্যে একটি কার্যকারিণী সমিতিও গঠন করা হয়, সেইসঙ্গে বঙ্গ-বহির্বঙ্গ নির্বিশেষে উপস্থিত সব লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের সাধারণ সদস্য হিসেবে সমিতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লিটল ম্যাগাজিন মেলার পাশাপাশি ‘ফোরাম’এর দায়িত্ব থাকবে বিভিন্ন সাহিত্য ও ভাষা কেন্দ্রিক আলোচনা সভা, সেমিনার এবং লিটল ম্যাগাজিনের স্বার্থে আরও কিছু অনুষ্ঠান  ও কাজ। এছাড়া যেসব লিটল ম্যাগাজিন বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে অপারগ, সেইসব লিটল ম্যাগাজিনের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াও ফোরামের নৈতিক দায়িত্ব। আশা করা যেতে পারে, ফোরাম তার দায়িত্ব ও কর্তব্যে আন্তরিক থাকার চেষ্টা করবে।   


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


ফারহানা রহমান




লুই বুনুয়েল : চলচ্চিত্রের মহত্তম শিল্পী 






God and Country are an unbeatable team; they break all records for oppression and bloodshed.” –  Luis Bunuel

নৈতিক সত্যের গভীরতা অন্বেষণই যদি একজন প্রকৃত শিল্পীর মানদণ্ড হয়ে থাকে তাহলে চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলকে অবশ্যই একজন মহত্তম শিল্পী বলা যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি সারাজীবনব্যাপী অসাধারণ সব চিত্রকল্প সৃষ্টি করার অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাঁর চিত্রকল্পগুলো তাঁর সময়কার স্পেনের সমষ্টিগত মানসিকতার সঙ্গে এবং মানবজাতির আত্মপ্রতারণার রহস্যজনক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ১৯০০ খৃষ্টাব্দের ২২সশে ফেব্রুয়ারী  স্পেনের তেরুয়েল রাজ্যের তৎকালীন ক্ষুদ্র শহর কালান্দার একটি উদার সংস্কারমুক্ত ভূম্যধিকারী বুর্জোয়া পরিবারে লুই বুনুয়েল পোর্টোলেস জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক পর্যায় পর্যন্ত একদিকে শিল্পে যৌন উদ্দীপনা-দ্দীপক সমৃদ্ধির ধারণায় এবং অন্যদিকে সুগভীর মৃত্যুকেন্দ্রিক নিবিষ্টতার  ধারণায় যতদিন স্পেন নিবিড়ভাবে আবিষ্ট হয়ে ছিল, বুনুয়েলের জীবদ্দশায় তিনি ততদিন এদুটো ব্যাপারকেই প্রতিধ্বনিত করে গেছেন যদিও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন একটি কঠোর ধর্মীয়  পরিমণ্ডলে, তথাপি কোন এক বিচিত্র কারণে খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি তাঁর বিরূপ ধারণা জন্মায়। তবে ১৯০৬ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত সারাগোসায় জেসুইটদের পরিচালিত স্কুলে পড়ালেখা করাকালীন সময়ে তাঁর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি সম্পর্কে এক ধরনে ভয়ানক বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্মায়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নানা কাজে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ধর্মের  অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাও তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তাই বাকি জীবন তিনি গির্জা, রাষ্ট্র ও তার মধ্যে প্রোথিত সামাজিক কাঠামোকে আক্রমণ করে গেছেন। তাঁর মতে, তথাকথিত ভদ্রসমাজ মানুষের  স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে রাখে, যার ফলে সমাজে  নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

সিনেমাটিক স্যুরিয়েলিজমের জনক এই স্প্যানিশ পরিচালক তাঁর সারাজীবন ধরে ক্যারিয়ার বা কাজের মাধ্যমে বিদ্রোহ করে গেছেন। বুনুয়েলের কথায়, ‘আমাদের এ  দুনিয়া এতটাই বাজে যে, এখানে শুধু সামনে একটা পথই খোলা আছে বিদ্রোহ।উক্তিটির মধ্যেই এ কিংবদন্তি পরিচালকের জীবন ও  কর্মকাণ্ডের সারসংক্ষেপ পাওয়া যায়।


একজন বলিষ্ঠ শিল্পীর মতোই লুই বুনুয়েল আধুনিক বিশ্বের বুর্জোয়া শ্রেণীর  সমস্ত রকমের কৃত্রিম নৈতিকতা আর পতনের মুখোশটা বারবার টেনে হিঁচড়ে খুলে দিয়েছেন। বাইরে থেকে আমরা যে সভ্যসমাজকে দেখি, বুনুয়েলের মতে সেটা হচ্ছে আপাত পরিচ্ছন্ন পোশাকে আবৃত একদল কুৎসিত মানুষের আবাস। অথচ এর অন্তরালে রয়েছে অত্যাচার, দুর্দশা, নিরাশা, নাস্তিকতাসুলভ অসারতা  এবং উচ্চবিত্ত মানুষের অমার্জিত আচরণ। আর তারই তলায় রয়েছে অবহেলিত দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার তাড়না, দুর্ভোগ আর ফেটে পড়ার বাসনা। তিনি আমাদেরকে দেখিয়েছেন সভ্যতার এই অদ্ভুত বৈষম্য আর কদর্যতার প্রকৃতরূপ এবং আধুনিক বস্তুবিশ্বের এই সর্বাত্মক বিনাশ আর ক্ষয়কে। স্পেনের চরম আবহাওয়া আর সংস্কৃতি, সমুদ্রে ঘেরা পরিবেশের এক উত্তাল জীবনে বুনুয়েল জন্মেছিলেন। এই পরিবেশের পাশবিক নৃশংসতা আর সৌজন্যমূলক মর্যাদার অদ্ভুত মিশ্রণ একধরনের বৈপরীত্যের জন্ম দিয়েছিল। অন্যান্য সব স্যুরিয়ালিস্টিক শিল্পীদের মতোই বুনুয়েলের কাজগুলোতেও আমরা দেখতে পাই  নম্র-শোভন, সুকুমার প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি প্রচণ্ড এক তীব্রতার অদ্ভুত প্রতিভাস।  

তিনি ১৯১৭-২০ সাল পর্যন্ত মাদ্রিদের রেসিদেন্সিয়া দে এস্তদিয়ান্তেস- পড়াশোনা করেন। ১৯২২ সালের শুরু থেকেই তিনি নিজেকে সাহিত্যের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন এবং নানা পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন।  ১৯২৪ সালে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর (১৯২৫) পর তিনি জ্যাঁ এপস্তারের আমন্ত্রণে তাঁর ছবির সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য পারিতে যান। এ সময় তিনি জড়িত হন সে-সময়কার স্প্যানিশ কবিদের দল লা জেনারেশন ডেল ২৭’ (১৯২৩-১৯২৭) এর সঙ্গে। এই দলেই পরিচিত হন কবি ফেডিরিকো গারসিয়া লোরকা, র‍্যামন গমেজ ভিলাসেরনসে, আলবেরতি ও সালভাদর দালিসহ সে-সময়ের স্পেনের তরুণ সৃজনশীল শিল্পীদের সঙ্গে। এখানেই মূলত আঁভগার্দ আন্দোলনের অন্যান্য শিল্পতত্ত্বের সঙ্গে পরাবাস্তববাদের ব্যাপারেও বুনুয়েলের জানাশোনা শুরু হয়। সেসময় লোরকা ও দালির সঙ্গে বন্ধুত্ব বুনুয়েলের জীবন ও ক্যারিয়ারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে করা হয় 


স্যুরিয়ালিজম হলো আঁভগার্দ-এর একেবারে প্রথম দিককার ধারা। বিশের দশকে ফ্রান্সের আঁদ্রে ব্রেতো মূলত এই ধারার সূচনা করেনঅযৌক্তিক মনের স্বপ্ন, সত্য, গোপন কল্পনা, ইমেজের আবেগ, ব্যক্তিগত কামনা বা যৌনতা প্রভৃতিই পরাবাস্তববাদের স্বাভাবিক লক্ষণ বলে  ধরে নেওয়া হয়। পরাবাস্তববাদ আধুনিক শিল্প আন্দোলনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এরই আলোকে বাস্তবতাকে দেখার জন্য যেসব শিল্প আন্দোলন শুরু হয় তা হচ্ছে কিউবিজম, ফিউচারিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তববাদএছাড়াও অভিব্যক্তিবাদসহ আরও নানা বিষয়কে  শিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, চিত্রকলায় প্রয়োগ ও বিকশিত করার যে প্রক্রিয়া তাকেই আঁভগার্দ হিসেবে বর্ণনা করা যায়  

১৯২৮ সালে মা’র কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে তিনি এবং সালভাদর দালি ‘অ্যান আন্দালুসিয়ান ডগ’ নামে একটি  নির্বাক সিনেমা তৈরি করেন। এটিকে বলা হয় চেতনা–অবচেতনার যুক্তিনিষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত একটি ছবি। সিনেমাটিতে ব্লেড দিয়ে চোখ কাটার একটা দৃশ্য ছিল। সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুনুয়েল জানান যে তিনি একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে বসে বন্ধু দালিকে এক অদ্ভুত স্বপ্নের কথা জানালেন সেটি হচ্ছে, তিনি দেখলেন ‘চাঁদকে নাকি একফালি মেঘ এসে চিড়ে দিয়েছিল এমনভাবে, ঠিক যেন ক্ষুরের ব্লেড চিড়ে দিচ্ছে কারও চোখ।জবাবে দালি জানালেন, তিনিও আজব এক স্বপ্ন দেখেছেন, অগুনতি পিঁপড়ের ভেতর  হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে একটি হাত। দালির স্বপ্নের কথা শোনা মাত্রই বুনুয়েল বলে উঠলেন, ‘এটাই তো সিনেমা; চলো, বানিয়ে ফেলি!বুনুয়েল মূলত এ সিনেমা দিয়ে বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত তরুণদের অপমান করতে চেয়েছিলেন । এছবি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আঁদ্রে ব্রেতো বলেছিলেন, ‘ভালোবাসার এই ভয়ঙ্কর, নিষেধহীন মুখকে নির্মোক থেকে নগ্ন করার জন্য আধুনিক শিল্পের প্রাণপণ প্রয়াস এটি’।

এরপর ১৯৩০ সালে তিনি ‘লা’জ দ্য’ বা ‘দ্য গোল্ডেন এজ’ ছবিতি তৈরির পর এম যে এম থেকে ছবি করার আমন্ত্রণ আসে, ফলে তিনি হলিউডে চলে যান।
‘দ্য গোল্ডেন এজ’ ছবিটি আধুনিক জীবনের উন্মত্ততা, বুর্জোয়া সমাজের যৌনবিকৃতি ও ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার মূল্যবোধের এক তীর্যক চিত্র, এক অন্যতর প্রতিবাদনামা। এ ছবিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন সমাজের প্রকৃত ইতিহাস। যেখানে  অপ্রাসঙ্গিক কারণে মানুষের অচেতন আকাঙ্ক্ষাগুলো চিরন্তন হয়ে থাকে। যৌন কামনাকেই ‘দ্য গোল্ডেন এ’এ মানুষের একমাত্র গতিশীল শক্তি হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে সে সভ্যতাকে অস্বীকার করে। সভ্যতার নিজের কোন ইতিহাস বা শক্তি নেই। ইতিহাস কতগুলো নিপীড়ক শক্তির সমাহার যাকে সামগ্রিক অভ্যুত্থান নাড়াতে পারে না। এ সিনেমায় দেখা গেল পরিবার, গির্জা ও সমাজের নানা ভণ্ডামিকে মোকাবেলা করে একটি যুগল তাদের সম্পর্ককে চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। সিনেমার প্রিমিয়ারে হামলা করেছিল ফ্যাসিস্টরা। তারা সিনেমা হলের পর্দায় কালি লেপে দেয়, আসন ছিঁড়ে ফেলে এবং অনেক থিয়েটারে বোমা হামলা পর্যন্ত করে। ভ্যাটিকান সিটি থেকে  বুনুয়েলকে খ্রিস্টান সমাজ থেকে বহিষ্কার করার হুমকিও দেওয়া হয়। সিনেমাটির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হয়। বহুবছর পর ১৯৭৯ সালে সিনেমাটির প্রদর্শনী আবার শুরু হয়। ১৯৩১ সালে তিনি আবারো হলিউড থেকে পারিতে ফিরে আসেন।


বুনুয়েলের পরবর্তী কাজ ছিল স্যুররিয়েলিস্ট প্রামাণ্যচিত্র ‘লা হার্দে’। ১৯৩৩ সালে তিনি পারিতে প্যারামাউন্ট প্রযোজক সংস্থার হয়ে কাজ করেন। ‘লা হার্দেস সিনামাটিতে দেখানো হয় স্পেনের উত্তরাঞ্চলের সমাজবিচ্ছিন্ন একটি হতদরিদ্র অঞ্চলকে। এই অঞ্চলটিকে বুনুয়েলের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পালাবদল থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। এই অঞ্চলের কৃষকদের শ্রম হচ্ছে প্রথমবারের জন্যে এক বিরোধী প্রকৃতিকে বস করার চেষ্টা, যে প্রচেষ্টা অনিবার্যভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তাদের অসম্পূর্ণ সমাজ আবার শূন্যাবস্তায় ফিরে যায়। কৃষকদের জীবন যেন ক্ষুধা ব্যাধি থেকে পঙ্গুতা ও মৃত্যু পর্যন্ত এক ভয়ঙ্কর ক্রমপরিণতি। এখানে সময় কোন সমৃদ্ধি আনে না, আনে না মৃত্যু ব্যতীত কোন সংবাদ।

এরপর অর্থাৎ ১৯৩২ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছর বুনুয়েল নিজেকে নানারকম কাজের সাথে জড়িয়ে রাখেন। ১৯৩৫ সালে মাদ্রিদের ফিল্মোফোনো সংস্থার কার্যনির্বাহী প্রযোজক হিসেবে মিউজিক্যাল ও কমেডি ছবির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৬- ৩৯ পর্যন্ত স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকান সরকারের হয়ে কাজ করেন। হলিউডে যান যুদ্ধ বিষয়ে তথ্যচিত্রের কাজে তত্ত্বাবধানের জন্য। সে সময়কার ছবিগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের হয়ে ১৯৩৯-৪২ সাল পর্যন্ত লাতিন আমেরিকায় দেখানোর জন্য ছবির পুনরসম্পাদনা, শব্দ পুনরযোজনা ও পরিচালনার কাজ  করেন। মাঝেমধ্যে ছবির ডাবিং করেন। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগ আছে সন্দেহে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট থেকে বরখাস্ত হন। ৪৪ সালে হলিউডে এসে ওয়ারনার ব্রাদার্সের হয়ে স্পেনে থাকাকালীন সময় চারটি ছবি পরিচালনা করেন। ১৯৪৬ সালে মেক্সিকো ফিরে যান। ১৯৪৭ এ এল সিনেমাটি তৈরি করার বাসনা নিয়ে মেক্সিকোতে গেলেন ।  সেখানে তিনি বন্ধু লোরকার ‘লা কেস দ্য বারনারড আলবা’ নামক একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়ে ‘গ্র্যান্ড ক্যাসিনো’ নামক একটি সঙ্গীতবহুল কমার্শিয়াল ছবি বানালেন। তবে তা ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখল না। অবশ্য দুবছর পর ‘এল গ্রান ক্যালাভেরা’ নামের মঞ্চাভিনীত একটি নাটককে চলচ্চত্রি রূপ দান করেন। বুনুয়েলের অতিপ্রিয় সহযোগী লুই আলকোরিজা সিনেমাটির চিত্রনাট্যটি রচনা করেছিলেন এবং ছবিটি সেসময়  বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। এরপর ১৯৫০ সালে বুনুয়েল তার অন্যতম মহৎ ছবি ‘লস অলভিদাদোস’ তৈরি করেন। এটি করার পর তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলে আবারো সাড়া জাগিয়েছিলেন।  ৪৭-৬০ সাল পর্যন্ত মেক্সিকোতে ‘লা হাইজা দেল এঞ্জানো’ ‘ সুসানা’ দুটি ব্যবসাসফল ছবি করেন। পরবর্তীতে  নির্মাণ করেন ‘সুবিদা আল সিয়েলো’। ১৯৫২তে সিনেমাটি কান উৎসবে সেরা  আঁভগার্দ পুরষ্কার পান। ৫১ সালে ‘লস  অলভিদাদোসে’র জন্য কান চলচিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরষ্কার এবং আন্তর্জাতিক সমালোচক সংস্থার পুরষ্কার পান। ১৯৫২তে এসে তৈরি করেন ‘দ্য এডভেঞ্চার অব রবিনসন ক্রুসো’ এবং  ১৯৬০এ ‘দি ইয়াং ওয়ান’। আর এইসব মহান চলচ্চিত্রের জন্য আমরা খুঁজে পেলাম এই পরিণত মহতি শিল্পীকে।  


আমরা ‘লস অলভিদাদোস’ সিনামাটিকে বুনুয়েলের পরিণত শিল্প আঙ্গিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে দেখতে পাই। মেক্সিকোর কোন একটি বস্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠে সিনেমাটির পটভূমি। বস্তি অঞ্চলের একদল বখাটে ছেলের  দৈনন্দিন কার্যকলাপ, তাদের মানসিক গঠন, স্নেহভালোবাসাহীন ছন্নছাড়া ছেলেদের জীবনকাহিনী নিয়ে তিনি এক অদ্ভুত বৈপরীত্য আর সমতার সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরি করেছেন সিনেমাটি। এখানে আমরা যেমন দেখতে পাই না কোন কৃত্রিম সহানুভূতি মেশানো চরিত্র, তেমনি উপলব্ধি করতে পারি মানুষের  পাশবিক চরিত্র, হিংসা ও বিদ্বেষমাখা নিষ্ঠুরতা। পেদ্রো, পেদ্রোর মা, ওচিতোস, জৈবো, মেকি - এরা হচ্ছে বস্তির ক্রমবর্ধমান বিধ্বংসী অপরাধ আর ভায়োলেন্স  প্রকাশ করার এবং ভুক্তভোগী চরিত্রসমূহ।  

এখানে দেখতে পাই নানা নিষ্ঠুরতার অঙ্গারে পুড়ে একটি নির্মম পাশবিক মানুষে পরিণত হওয়া পেদ্রোকে যার তৈরি করা একটি গুণ্ডার দল একদিকে একটি ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করে, আবার দেখা যায় খোঁড়া একটি লোককে ঠেলাগাড়ি থেকে টেনে নামাচ্ছে, অন্ধ ভিখারিকে ঢিল মারছে। আবার সেই অন্ধ ভিখারিটিকেই দেখা যায় ওচিতোসের সাথে প্রতারণা করে কিশোরী মেকীকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হচ্ছে। এইসব বস্তিতে থাকা মানুষ যাদের জীবন ঘিরে থাকে ঘৃণা, ভয়, বঞ্চনা, নিপীড়ন আর রিক্ততার নিদারুণ ক্লেদ। আর এরাই একসময়  অন্ধকার জীবনের বর্বরতা, নৃশংসতা আর পশুসুলভ যৌনকামনাকে ঘিরেই গড়ে তোলে তাদের পতনের জীবন।


ক্ষুধার্ত পেদ্রো একদিন বাড়ি ফিরে খাবার পায় না নিয়ে মার সঙ্গে ভয়ানক বিবাদে জড়িয়ে পরে বেকার বাউন্ডুলে পেদ্রো। সে মায়ের হাত থেকে এক টুকরো মাংস কেড়ে নিয়ে দৌড়ে চলে যায়। সে রাতেই সে স্বপ্ন দেখে মা তাঁকে এক টুকরো মাংস খেতে দিচ্ছে। পর্দা জুড়ে মায়ের হাত, তাতে এক টুকরো মাংস দেখা যায়। অদ্ভুত দৃশ্যকল্পে মায়ের মুখমন্ডল ভেসে ওঠে, তার চুল হাওয়ায় উড়ছে, চোখ দুটি বন্ধ। হাতে এক টুকরো মাংস নিয়ে হাসছে মা। ক্ষুধার্ত পেদ্রো মাংসটা  তুলে নিতেই বিছানার তোলা থেকে বদমাশ গুন্ডা জৈবো একটি ভয়ঙ্কর দর্শনের হাত এসে মাংসটিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।                                    

গৃহযুদ্ধ শেষে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর বুনুয়েল এবার হলিউডে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি বাণিজ্যিক ধারার হলিউডি সিনেমায় বিভিন্ন ভাষায় সাব-টাইটেলের কাজ করতেন। এরপর হঠাৎই চাকরি পেয়ে যান মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে, ফলে তাঁকে  হলিউড ছেড়ে নিউইয়র্কে চলে আসতে হয়। সেখানে কিছু সমস্যা হওয়ায় তিনি আবার হলিউডে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ডাবিং বিভাগে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। এরপর ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে-বছরই বুনুয়েল পাড়ি জমান মেক্সিকোতে। বাকি জীবন মেক্সিকোতেই ছিলেন বুনুয়েল। তবে সিনেমা নির্মাণ করেছেন ফ্রান্স ও স্পেনেও।  

১৯৫৩ সালে ‘দ্য ক্রিমিনাল লাইফ অব আরচিবল্ডো দিলা ক্রুজ’এর পর উল্লেখযোগ্য ছবি হিসেবে বলা যায় ‘নাজারিন’ এই ছবি দেখে সিনেমার দর্শকরা আবারো ভীষণভাবে ধাক্কা খেলো। এটি তাঁর শিল্পকরমের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত  ছবি। এ ছবিটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঋত্বিক ঘটক মন্তব্য করেছিলেন,
‘বুনুয়েলের এই ছবিটি একটি সভ্যতার মিথ্যাচরণের চরম দলিল’বুনিতো পেরেজ গালদোসের বিখ্যাত উপন্যাস নাজারিনকে উপলক্ষ করে লুই বুনুয়েল  এবং জুলিও আলেজান্দ্রোর যৌথ উদ্যোগে নাজারিন চিত্রনাট্যটি লিখেন। লুই বুনুয়েল এটিকে ১৯৫৯ সালে ম্যাক্সিকান চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন যা ১৯৫৯ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৩২তম একাডেমি এওয়ার্ডসে শ্রেষ্ঠ বৈদেশিক ভাষা চলচ্চিত্রের জন্য মেক্সিকান এন্ট্রি হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। যদিও নাজারিন বুনুয়েলের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম নয়, তথাপি এটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি সিনেমা প্রখ্যাত  চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি নাজারিনকে তার প্রিয় ১০টি সিনেমার একটি হিসেবে বিবেচনা করেন


‘নাজারিন’এ আমরা দেখতে পাই পাদ্রী নাজারিও স্প্যানিস ঐতিহ্যের একজন রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত যিনি শহরের দরিদ্রতম এলাকার একটি হোটেলে থাকেনঈশ্বরের প্রতি গভীর ভরসা ও বিশ্বাস নিয়ে তিনি সকলের সাহায্যে এগিয়ে যান এবং ধৈর্য সহকারে অন্যায়কারীকে নানা উপদেশ দিতে থাকেন। নানা ঘটনার পরিপেক্ষিতে তিনি একসময় শহরের জেলহাজতে আটক হন। বিনা কারণে পাদ্রী নাজারিওকে চোররা মারতে থাকলে একজন বড় চোর এসে তাঁকে উদ্ধার করে। রাতে শুয়ে শুয়ে নাজারিও ভাবে যে, বড় চোরটা যত খারাপ কাজই  করুক না কেন আসলে সে একজন ভালোমানুষ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁটতে থাকলে একজন ফলওয়ালির তাঁকে দেখে মায়া হয় এবং তাঁকে একটি আনারস খেতে দেয়। প্রথমে নিতে না চাইলেও ক্ষুধার্ত নাজারিও অশ্রুসজল চোখে ফলটি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনের এ পর্যায়ে এসে ঈশ্বর বিশ্বাসে ভরপুর নাজারিওর ভিতর থেকে যিশুখ্রিস্ট সুলভ ইমেজটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এবং তাঁর প্রকৃত মনুষ্যোচিত চেহারাটা বেরিয়ে আসে। এ ছবিতে বুনুয়ে ধর্মান্ধতা,  মূর্খতা, আর প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধের অন্তর্নিহিত সত্যটাকে অসাধারণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন।

এরপর ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত এই উনিশ বছরে আরও এগারোটি ছবি নির্মাণ করেন। ১৯৬১তে স্পেনের সরকারের আমন্ত্রণে স্পেনে গিয়ে তৈরি করেন ভিরিদিয়ানা’, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্পেনে ছবিতি প্রদর্শিত হতে দেওয়া হয় না।  তবে একই সালে ছবিটির জন্য যুগ্মভাবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পুরস্কার পান। ৬৫তে সাইমন অফ দ্য ডেজারটএর জন্য ভেনিস উৎসবে রৌপ্য সিংহ পান। ১৯৬৭ বেল দ্য জ্যুএর জন্য ভেনিস উৎসবে স্বর্ণ সিংহ পান। ১৯৬০ থেকে ৭০ এ সময়টিতে বুনুয়েল মূলত ফ্রান্স ও ইতালিতে ছবি করেন। যদিও বা তিনি বাস করেন ম্যাক্সিকোয়। ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন তাঁর আলোচিত  ফরাসি সিনেমা ডিসক্রিট চার্ম অব দ্য বুর্জোয়াএকদল ধনী একসঙ্গে খেতে গিয়ে নানা ঝামেলা করছেন তাদের চরিত্রকে নানাভাবে দেখানোই ছিল বুনুয়েলের এ সিনেমার গল্প। এ সিনেমা সেরা বিদেশী সিনেমার ক্যাটাগরিতে অস্কার পেয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর শেষ ছবি দ্যাট অবসকিওর অবজেক্ট অব ডিজায়ারনামক এক অসাধারণ ছবি তৈরি করেন। চরম নৈপুণ্যতা এবং দক্ষতার সাথে তিনি তাঁর শেষ ছবিটি পরিচালনা করেন।  ছবিটি দর্শকে প্রথম থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট করে রাখে। এটিকে তাঁর চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিস্ময়কর অগ্রগতির অন্যতম চূড়ান্ত  মনোমুগ্ধকর ছবি হিসেবে ধরা হয়। এটি হল যৌনতার রাজনীতি ও বুর্জোয়া নৈতিকতার কাঙ্ক্ষিত কাহিনীকে নাগালের বাইরে রেখে কষ্ট পাওয়ার এক বিশেষ অনুভূতিসম্পন্ন ছবি।

মহান এই বিচিত্রমনা চলচ্চিত্রনির্মাতা ১৯৮৩ সালের ২৯ জুলাই মেক্সিকোতে মৃত্যুবরণ করেন। ৫৩ বছর ধরে চলচ্চিত্রের পর্দায় রূপ-অরূপের দ্বন্দ্বে মানবসভ্যতা আর মানুষের জীবনের সত্যটাকে খুঁজে ফিরেছেন নানা আঙ্গিকে।  আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজীবন সাধারণভাবে চলা বিশ্ববরেণ্য এই মানুষটির সৎকারের সময়টিতেও ছিলো না কোন আড়ম্বর। এই অনুষ্ঠানে স্ত্রী, পুত্রসহ কাছের মাত্র ৫০জন লোক অংশ নিয়েছিলো। জীবনের শেষ সপ্তাহগুলো তিনি মেক্সিকোয় কাটিয়েছিলেন। এ সময়টা এক ক্যাথলিক পাদ্রির সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নানাধরনের আলোচনায় মত্ত হয়েছিলেন তিনি।

নিজের আত্মজীবনী ‘মাই লাস্ট ব্রিদ’এ নিজের জীবনদর্শন সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে চিরবিদ্রোহী লুই বুনুয়েল বলেন যে,  সুযোগ আর রহস্যের মাঝেই কোথাও কল্পনা লুকিয়ে থাকে। এ কল্পনাই আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে, যদিও মানুষ তাদের কল্পনাকে ঝেড়ে ফেলতে চায় আবার অনেকে কল্পনাকে একেবারে কবর দিতে চায়।

(গ্রন্থসূত্র- 1. My Last Breath, 2. The Criterion Collection -1977, 3. The World of Luis Bunuel -1978 , 4. Wikipedia, 5. ধীমান দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের অভিধান )




রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়




ত্রিমূর্তি : স্পেস এন্ড দ্য ফোর্থ ডায়মেনশান


প্রথম মুখঃ সব্যসাচী ও তার ল্যাবরেটরিতে সম্ভাব্য টিলিবিসিপ



এক হাতে গান উঠছে - প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। অন্য হাতে ফুটছে টিলিবিসিপ। দুহাতেই নিহিত শিল্পের বিভঙ্গ। উলটে পালটে দেখতে গেলেই দৃশ্যে বেজে ওঠে অপার সম্ভাবনার সুর। প্রচ্ছদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আঙুলে উঠে আসে পসিবিলিটির মুখ। ব্যাপক উচ্চারণের মুখ। যেন কোনো কবিতাগারে আবিষ্কারের উল্লাস। যেন কোনো উপসনালয়ে শব্দউৎসব শুরু হয়েছে। এক বিস্তীর্ণ উন্মুক্তির উদ্‌ঘাটন। বিশ্বপ্রবাহের কেন্দ্রে বসে কবি সব্যসাচী হাজরার  অনন্য এক কবিতা উন্মাদনা-

দান্তের পয়লা-বৈশাখে
    দান্তের বয়স এখন
      ‘+;-;*;/’
ডিসিশন
   ইকুয়েশনের চেলো
     ঠুন
        ধিক
দুই-মা
   ফ্রিক
       স্বামী
         ধিন
          আজান
                 হিং
                   হ্যাশ
                   খুলি
             আধুলি ধুলি লি
জাতিস্মর আমাকে লিও করে রাখে
              ব্যানার্জীর আদরে
                     ইনকায়
                      ডাকতে র হো
                      জাগতে র হো...    (দান্তের পয়লা-বৈশাখে-১৪)

পাঠক আপনি ইকুয়েশন নিয়ে জাগতে থাকুন (সামান্য সূত্র - ২০১৪ এ বসে সংখ্যাগুলো নিয়ে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে থাকুন, হাতে উঠে আসবে দান্তের বয়স ৭৪৯)। আমি ভাবি কেন দান্তে কেন পয়লা বৈশাখ? ফাদার অফ ইতালিয়ান ল্যাঙ্গয়েজ, ও তার শুভারম্ভ। টিলিবিসিপেও যে জন্ম শুরুর ইঙ্গিত। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভাষা। কবির কলমে লেবার পেন। এক নতুনের আবাহনে মেতেছে বাংলা ভাষা। কবি যে বানান সেঁকে খান আমি তার ধ্বনির আত্মবৃত্ত খুলে খুলে বাজাই। বাজাতে থাকি। বাজাতে থাকি। কেন যে কানে গান ভাসছে – সখি ভালোবাসা কারে কয়... এই তো এই তো ভালোবাসা – ভাষার প্রতি কবির ভালোবাসা, শব্দের প্রতি কবির ভালোবাসা। যাকে এমন করে ভালোবাসা যায় তাকেই তো এমন করে বাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এমন করে নাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ওই শুনি যেন চরণধ্বনিরে শুনি আপনমনে... 

সবুজ সবুজ চেকে
       ওদিকে দেখি না, দেশলাই ভূমিকম্পে বসে আছো...
ফিতে মাপা চিৎকার
                     লাট্টুতে ঘুরছে চিড়িয়া,
অবাধ পেয়ারায় ঘুমিয়ে থাকল যারা
              বেঁটে বেঁটে লোটাদের কোল...
অনাব্রেক,
       চৌকো অথচ ভি
              দুঃস্থ দুঃস্থ কাকলির চাপ,
কত খুঁড়ে আবলুশ পাই
       দুটো দিলখুশ বালিশে ঝিমোয়...  (চৌকো অথচ ভি-২১)

এই যে কবির আপনভোলা খেলা, এর কোনো নিয়মাবলী নেই। সাফল্যের জন্য চিৎকার নেই। অসাফল্যের জন্য হাহাকারও নেই। উদ্দেশ্য খুঁজতে গেলেই আঙুলে জড়িয়ে যায় উদ্দেশ্যহীনতা। প্রতিবাদ বলতে গেলেই অপ্রতিবাদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। এ এক অনির্দেশ্য যাত্রা। নিয়মভাঙার খেলা। ধর্মাধর্ম একাকার করে এক আত্মজগৎ। অসংলগ্ন তার আত্মনিবেশ। সৃষ্টি অভিমুখি এক অনাসৃষ্টির বৃষ্টিমুখর চঞ্চলতা। স্বীকারেও নেই। অস্বীকারেও। আবার গান উঠছে হে... আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসি... এই যে পিয়াস, এই যে অপার উধাও সম্ভাবনা তারই ভেতর ফুটছে টিলিবিসিপ। সংলগ্ন ভাষা থেকে কবি ধ্বনিকে ছুটিয়ে দিয়েছেন অসংলগ্ন অনিঃশেষ যাত্রার দিকে। দূরে কোথায় দূরে দূরে সেই পসিবিলিটি ডাক দিয়েছে –

পসিবিলিটি ও নম্বর একটি টিলিবিসিপ,
মাসুদা ছুঁলেই রম্বন ওঠে থঁ পায় পাহাড়ীদের
       নেকুয়া ঢলায় কুঁয়ো জুড়ে
 এবার মনাই ঘুরলো কুড়ি বার... বার কুড়ি নয়
কৃষ্ণা আজ চতুর্থবার
       ভীম + নিউট্রন কেননা পার্থ খোঁজে(২০ ১২ - ৬২)

কবি হিলিয়াম-৩কে বেছে নিলেন কেন? আবার সেই পসিবিলিটি। ওইখানে যে ফিউসানের অপার সম্ভাবনা। আগামী আলোর সম্ভাব্য টিলিবিসিপ। হেবি হাইড্রোজেন, একটা নিউট্রন – আহা সেই অনন্ত শক্তির খোঁজ। পাঠক আপনি বিজ্ঞান ছেড়ে কাব্যও ধরতে পারেন। মহাকাব্য। পঞ্চস্বামী পরিবৃত দ্রৌপদী। দুটি কোলের- নকুল সহদেব। তিনটি মাথার মুকুট-যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন। হেবি ওয়েট ভীমকে কতবার (হয়ত চারবারও হতে পারে) ব্যবহার করেছেন পার্থের আশায়। ওইখানে যে তার আকাঙ্ক্ষা। এ সবই পসিবিলিটির ধারণামাত্র। কেন না কবির ল্যাবরেটরিতে হয়ত অন্য কোন টিলিবিসিপ। কবি যে আমার তোমার এই সমস্ত রংকে নিজের রঙে অত্মবিলীন করতে চান। বিন্যাস থেকে অবিন্যাসের জোয়ারে ভেসেছেন। আহা সেই ধ্বনিমগ্ন নিরুদ্দেশের যাত্রী দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...  


দ্বিতীয় মুখঃ পারদের সোমনাথ শাসন ও তার তাপমাত্রা



নির্জনতা মুছে ফেললে একটা শাসন আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকে আর ওইপারে চড়তে থাকে কবি সোমনাথ সেনের পারদস্তম্ভ। লাল দাগে পৌঁছবার আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলে নির্জনতা। নৈঃশব্দ্যের শব্দ ওঠে না আর। অথচ শব্দের কাছেই আমাদের যেটুকু আশ্রয় যেটুকু নিরাময়। এক টুকরো নির্জনতা।তুমি তো কৃপণ নও প্রভু। তবু কেন এই ঝনাৎকার। বাহুবলের। বুদ্ধিবলের। কীভাবে এই অনুপ্রবেশ কীভাবে এই বিভাজন। শাসনের নিচে যতটা অনাস্থা ততটাই জরুরি অবস্থা।অবস্থানের বিস্ময় মুছতে মুছতে জড়ো করে তুলছি এই জীবন, আভূমি নতমুখ আর অনুভূমিক জল বা জলকেন্দ্রিকতা।

আর তুমিও হরফ পালটে উন্মুক্ত শরীর দেখালে সারাদিন। পরিখার আশেপাশে জমে ওঠল প্রবাহের জলকণা। যেনবা বৃষ্টিপাতের ধারণা থেকেই এই খনন। কিছুটা আত্মগোপনের হরফ। অথচ উন্মুক্ত করলেই একটা ধ্বংসস্তূপের ধারণা, যেখানে পরিবর্তিত হয় মাটি আর সূর্যাস্তের রং। যেন এই আত্মগোপনের অন্ধকার থেকেই বিস্তৃত হয়ে পড়ছে ক্যামোফ্লাজের আড়াল। জলছাপের দাগে ঘনিয়ে উঠছে পৃথিবীর ঠিকানা। যে ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতি আর পিচ্ছিল রক্তপাতের মুখ। শহরকেন্দ্রিক এই আরামকেদারা আর শরীরকেন্দ্রিক এই হরফ পালটাতে পালটাতে ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আঘাতের দিকে। আয়নার ধারণা থেকে জমে উঠছে ঘুমজ্বর। ঘুমন্ত শহরের শীত ভেঙে জেগে উঠছে লিঙ্গ, বিস্তৃত হয়ে উঠছে যৌনতার ক্যামোফ্লাজ।

শুধুমাত্র কাচ নামানো ছিল বলে এতক্ষণ বুঝতে পারিনি নিষ্ক্রিয়তা। একটা শূন্য থেকে আরেকটা শূন্য পর্যন্ত এই নিষ্ক্রিয়তা আর একটা তাপপ্রবাহের পর গুটিয়ে যাওয়া স্নায়ুপ্রবাহ জন্মান্তরের প্রশস্ত মুহূর্ত। যেখানে এক বিম্বিত মুখ ঢলে পড়ে প্রতিবিম্বের দিকে। পারদের গায়ে লেগে থাকা শাসন থেকে উপচে ওঠে অনিয়মের পরিচর্যা। যেন অবস্থান পাল্টালেই স্নায়ুপ্রবাহে উন্মুক্ত মুখ ঠেলে দেবে হিংস্রতার দিকে। আর ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠবে ঝুলন্ত সেতু পেরোনো স্বাভাবিকতা।

এখানে আরও একটা মসৃণতা গোলাকার হতে থাকে। আর অমসৃণ পরিখা থেকে উঠে আসে এক বৃত্তের আড়াল। যেখানে পরিবর্তিত হয় আমাদের অবস্থান। আসলে পূর্ণতা এক অলীক ধারণামাত্র। প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় শুরু হয় আমাদের আঁধার আর ব্যক্তিগত অনুচ্ছেদ। অণু থেকে উন্মুক্ত হয় যেসব অনুরণন তাদের অবস্থানগুলো এমন আপেক্ষিক এমন সূত্রহীন যেন গাঁথতে বসলেই অনিশ্চয়তার দিকে আরো এক পা। আমি সাবমেরিনের পথেঘাটে ন্যটিক্যাল মাইলের নিয়ন্ত্রণ খুঁজি। কম্পার্টমেন্টের তালিকায় তখন চাপের অন্তর্বাস। আর অন্দরমহলে ক্রমশ বেড়ে ওঠে তাপপ্রবাহ। অণু ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ আইনস্টাইনের আলোয়।

আমাদের প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে প্রিয় বলয়ের দিকে। যেখানে আলো থেকে খুলে যায় আঁধারের জ্যামিতি। জ্যা টেনে টেনে একটা পরিখা খুঁড়তে থাকি। জলজ পরিধি ঘিরে পরিস্ফুট হতে থাকে গোপন অবয়ব। স্পর্শযোগ্য হতে থাকে আত্মবীক্ষণে। আলোকে আধেয় বললে শরীরী শব্দগুলো পেরিয়ে যায় নিরুত্তাপ সুড়ঙ্গ। ভাঁজে ভাঁজে জমতে থাকে লীনতাপ। গ্রহণকালের গর্ভদশা কাটতে থাকলে আমরা পৌঁছে যাই অনুভূতির শীর্ষে যেদিকে প্রিয় বলয় প্রিয় স্মৃতির আলোকপ্রপাত।

স্কার্ট তুলে যেই দেখালে একটা ব্রহ্মাণ্ডের করুণ আকুতি। এক মহাশূন্য অস্থিরতা টলমল করে উঠল ঘর্মাক্ত কোষের কক্ষে কক্ষে। রক্তকণিকার মুখ ঘুরে গেল ঈশ্বরকণার দিকে আর পরিমাপে বসল অবস্থানের ভারসাম্যগুলো। যেন ওই জন্মকণার উৎসমুখেই লেগে আছে আমাদের পরিচয়পত্রের ঘ্রাণ। যেন ওই দুরন্ত কণার যাত্রাশেষেই বিবর্তনের বিকেল বসবে। যেখানে আমাদের একান্ত আলাপচারিতা। যেখানে আমাদের আধেয় ঘিরে জলজ সমাগম। স্থবির প্রাচীর ভেঙে তিরতির কেঁপে যাবে শব্দতরঙ্গ।

এক এক করে খসে পড়ে নক্ষত্রের বিলাপ। আর মন্থনপাত্রে ছায়া এসেপড়ে। ঐ যে হেঁটে আসছে আঁচল, এক বিপজ্জনক ঢেউ তুলে ক্রমশ ঢলে পড়বে হৃদয়রহস্যের দিকে। যেভাবে সম্পর্ক এক অপ্রত্যাশিত অভিনয় থেকে প্রত্যাশিতের দিকে। আড়াল থেকে অনেকটা ভেতরে, এক উন্মুক্ত নগ্নতায়। আর এভাবেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়বে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো। প্রত্নগুহার উপস্থিতি পেরিয়ে শুরু হবে এক রহস্যযাত্রা। যেন খুব প্রাসঙ্গিক এই নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে দূর, আর সুদূর থেকে হেঁটে আসা নারকেল গাছের বিকেল।

এই অবসাদ প্রসঙ্গে তোর স্মৃতিচিহ্ন পরিস্ফুট হয়। আর স্মৃতির ভেতর লুকিয়ে পড়ে এক বিরামহীন বৃত্ত। বৃত্ত ভেঙে তুই উপমা হলেই খুলতে থাকে সত্ত্বাচিহ্ন।আমি পাহারায় থাকা পাঁচিল থেকে খুঁটে তুলি শ্যাওলার সবুজ। তোর মুখাবয়বের নিচে নগ্ন মোমবাতির নিঃসঙ্গ আলোতে দেখি খসে পড়া জানলার অবশ্যম্ভাবী দৃশ্যসকল।

আর সেই প্রলেপ থেকে একে একে দারুচিনি গাছের ফাঁক দেখা যায়। তার ছায়ার সর্বাঙ্গীণতায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ওড়নার রং পাল্টাতে থাকে। পাল্টাতে পাল্টাতে সম্ভাবনার করিডোর থেকে ওই দারুচিনি সকাল তার সময়চিহ্ন মুছে হেঁটে যায় উদ্ভাসনে। বিলুপ্ত বাগানের অবস্থান সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের ভেতর সম্ভাব্য যৌনতা ও তার অস্থির উচ্চারণে নিঃসঙ্গ অণুবীক্ষণ। এ সবই এক রূপান্তরের গল্প বলে। এক দরজা খোলার মুহূর্ত। প্রসারিত আকাশের বিশ্বপ্রবাহে এক আবহমানের অন্তর্লীন শিকড়। সম্ভাবনার নিকটবর্তী আড়াল থেকে প্রখর হয়ে ওঠে অনিবার্য দাগ।

কবির আত্মগোপনের পরিখা খুঁড়লে আঙুলে উঠে আসে যে পঙ্‌ক্তিগুলো -  

নির্জনতা মুছে ফেললে একটা শাসন আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকে
আর তুমিও হরফ পালটে উন্মুক্ত শরীর দেখালে সারাদিন
শুধুমাত্র কাচ নামানো ছিল বলে এতক্ষণ বুঝতে পারিনি নিষ্ক্রিয়তা
এখানে আরও একটা মসৃণতা গোলাকার হতে থাকে
আমাদের প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে প্রিয় বলয়ের দিকে
স্কার্ট তুলে যেই দেখালে একটা ব্রহ্মাণ্ডের করুণ আকুতি
এক এক করে খসে পড়ে নক্ষত্রের বিলাপ
এই অবসাদ প্রসঙ্গে তোর স্মৃতিচিহ্ন পরিস্ফুট হয়
আর সেই প্রলেপ থেকে একে একে দারুচিনি গাছের ফাঁক দেখা যায়
পাথরের সামনে এসে দাঁড়াই
শেষরাতে আদরের গতিপথ বেয়ে নেমে আসে রুমালের দাগ
তবুও তো এক অভাবনীয় কার্নিশের ওপর পাল তুলে দিলাম আমরা
শেষ রাতে আদরের গতিপথ বেয়ে নেমে আসে রুমালের দাগ
ছুরিতে লেগে যাচ্ছে মাংস রান্নার দাগ
এই জঙ্গল, এই ঘুমভাব কাটিয়ে অনেকটা ফিরে আসা


তৃতীয় মুখঃ নেমেসিস ও অর্জুনমঞ্চ



সীমান্তবর্তী যুদ্ধ ও মর্টারের শব্দ প্রথম অবস্থান আর সেখান থেকেই টেবিল ও খাতার সঙ্গে সংঘর্ষ দ্বিতীয় জেগে থাকা। ছুটন্ত ট্রেনের হু হু হাওয়ার মধ্যে জেগে উঠছে দ্বিতীয় অবস্থান, শোকের চিহ্ন নিয়ে সাইপ্রাস গাছের শাখা। খুব ব্যক্তিগত, খুব একান্ত এক সলিটারি সেল থেকে জেগে উঠছে কবি অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেমেসিস। কার পাপ কার মৃত্যু কার প্রতিশোধ। আমি সেই দ্বিতীয় অবস্থান থেকে সাপেদের ঢলে পড়া দেখি। আর সেই সীমান্ত যেখানে ছড়িয়ে আছে গ্ল্যাডিয়েটারের বর্ম আর সীজারের ছায়া। সেই ধোঁয়াদেশে অবাক কবির অপরিহার্য দ্বন্দ্বমুখর তন্ময়তা। কবিরই তো থাকে এই অন্তহীনতা আর তার একান্ত নিভৃতি। এইখানেই জেগে ওঠে উপমহাদেশ আর তার মেঘমরিচার আলো। এই দ্বিতীয় জাগরণ থেকে নড়ে ওঠে রুমাল। কোলাহলের দিকে তাকিয়ে থাকা টেবিল থেকে এক অভাবনীয়ের বীজমন্ত্র।

খোঁজ। এক অপরিকল্পিত অন্বেষণ। কীসের খোঁজ কবি জানেন না। সামনে খোলা থাকে শুধু আর্কিমিডিসীয় খাতা যেখানে অপেক্ষা করে আছে এক আত্মমগ্ন আবিষ্কার। কবির যাত্রা রাতভর্তি নৌকো নিয়ে। কোথায়। জানা নেই। তবু সেই যাওয়া। আগুনের স্কেচ থেকে রণজিৎ দাশের বাঘ থেকে নিরীহ ব্যাথ্যা থেকে অ-নিরীহ ঘটনা থেকে যাওয়া এবং যাওয়া। নিরুদ্দেশ চলন অথচ জাগ্রত নিবিষ্টতা। এমন নির্মোহ ছবি যেখানে কোনো রঙের প্রলেপ নেই। অথচ জীবনযাপনের সিঁড়িগুলো জেগে উঠছে নগ্ন স্কেচে। রেখা থেকে অরেখায় যাত্রা। অক্ষর ফুটছে আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের প্রিন্টিং মেশিনে। অশব্দে শব্দ বসাচ্ছে ১০৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের শাইলুন -

ফাঁক দিয়ে পুকুরে যাওয়া, আর যে ঠোঁট জোড়া, ফুটবলবাবু তুমি জানো তার মহিমাও আছে। পুণ্যতোয়া লোশন তোমার দরজা অবধি যায়। যেতে যেতে পৌঁছে দাও শাখা, ভাড়াটিয়া দিন। আর আমার টেবিলে পুকুর... (নেমেসিস-১৬)

সাইকোলজির ডাক্তারের চেম্বারে বসে কবি এক দ্রুত অপস্রিয়মা দৃশ্যের মুখোমুখি। উড়ে যাওয়ার বিভঙ্গে রচিত হচ্ছে কল্পজগৎ। সেই কল্পলোকের নিঃসীম নির্ভারে দৃশ্য ও বস্তু একাকার। নিঃসঙ্গ যাত্রা আলো আলো করে পৌঁছে যায় আরো গাঢ়তম অন্বেষণে। গভীর নিস্তরঙ্গ শূন্যতায় আমলকি গড়িয়ে যায়। গড়াতে গড়াতে নির্বিকার অচৈতন্যে স্থির হয়ে ওঠে ব্যথার শব্দ। কাব্যের ব্যথা। দোঁহারের পদ। পদাবলী। যেন খুব অর্থহীন উন্মাদনা। যেন খুব অস্বাভাবিক আত্মনির্মাণ। অথচ অর্থকে উপেক্ষা করলে, স্বাভাবিকতাকে পিছনে ফেলে এলে অনুভূতির কম্পাঙ্কে রণিত হয় এক ধ্বনিমুখর রহস্যলোক। যার পরতে পরতে জীবনগন্ধ মাখা সোহিনী সুর। আর সেই সুরের আবহে শুরু হয়ে যায় কবির গল্প। খুংখার পিরানহার লোভে পড়ার গল্প। মঞ্চালোকে নির্মিত হচ্ছে কার্নিশে ঝুঁকে থাকা এক নিবিড় সোনাটিয়া যাপন। সে দৃশ্যের শুধু মুখটুকু আলোকিত। আর বুকের ভেতর নিঃশব্দ দ্রিদিম। দ্রিম দ্রিম। আলোকিত অবাস্তবের ঘন্টা বাজছে। শুনতে পাচ্ছি সেই তন্ময় অন্বেষণের মন্ত্র –

 ...ছায়াকে ডালিয়া বলি...
...সেতুকে মধ্য বলি...
...পরতে উচ্ছাস বলি...
...মুকুলে দক্ষিণ বলি...
...সোলোকে রাত্রি বলি...
...রোদকে মাধব বলি...
...ফিরৎকে ছুটবি বলি...
...জীবনকে গোঁসাই বলি...  (নেমেসিস-১৬)

প্রত্যাবর্তন অর্থাৎ ফেরা। যেন প্রতিটি যাত্রাই শুরু হয়েছিল এই একান্ত ফেরার স্বপ্নে। যেখানে বসত রয়েছে গড়ানো। যেখানে বনবাস সচল রাখার টেনশন। আর সেখান থেকেই স্পার্ক। মাথার বাসায় জমাট স্পার্ক। সেমিকোলনহীন। কমাহীন। মাঝিমাল্লাহীন নৌকো। কবিকে শেষমেশ উঠে পড়তেই হয়। তারপর স্পার্কিত সংসারে ডুব দেয় আ-গ্রাস। গ্রাসে গ্রাসে হাওয়াবাহী কাগজে নামে লিপি। উড়ে যায় উড়ে আসে অবয়বহীন প্রাণের গন্ধ খুঁজে। বস্তুর প্রতিটি মৌল সত্তা একে একে জড়ো হয়ে ওঠে অতি স্পর্শসচেতন বাড়ির ভেতর। যেখানে ফেরা। দৃশ্যের প্রতিটি রেখা প্রতিটি স্কেচ নির্মিত হয়ে ওঠে নিরপেক্ষ তন্ময়তায়। যার বীজ অবধারিত নিহিত ছিল সামগ্রিক অস্তিত্বে। এই সমগ্রতায় অন্তর্লীন কবির যাওয়া। কবির ফেরা। একাগ্র নির্নিমেষ সেই চলন। উদ্দেশ্যহীন নিরুদ্দেশ চলন। যার কেন্দ্রে কখনো ঝলকে ওঠে নীলাভবর্ণের ভুল কখনো অমূর্ত দ্যুতি কখনো গোপন রহস্যের ইঙ্গিত। আর সেই অন্তহীন প্রাণস্রোতের জোয়ারে কবি দেন –

দরজাকে জামরুল কথা
মজাকে জরুরির কথা
কুৎসাকে খগোল কথা
যাবতীয়কে গভীর কথা
ভিতরকে বাহির কথা
কফিনকে ঝলক কথা
প্রস্তুতিতে কিচির কথা
চড়াইকে মিচির কথা
দ্বন্দ্বকে যাহোক কথা
ছুটিকে তপোবন কথা
থতকে মতোর কথা
ঠুঁটোকে জগন্নাথ কথা
কষ্টকে যাঃ...   (নেমেসিস-২০)

জীবনমঞ্চ জুড়ে এক নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে। আমরা সবাই এক একজন কুশীলব। কারোর মাথা ভায়োলেট শাওয়ার এসে পড়েছে। কারো মুখে মেদুর হয়ে উঠছে সবুজ বেবী। আমাদের নাটক চলতে থাকে। ঘুরে ঘুরে যায় এক অপরিসীম বৃত্তে। উড়ে উড়ে যায় তার অনির্ণেয় বিন্যাস। খুলে খুলে যায় তার অনির্দেশ্য লক্ষ্য। আর সেই খেলা শুঁকে শুঁকে চোখের নীচে সমীরণ এসে নক্‌ করে হাওয়া। মঞ্চ জুড়ে দীর্ঘ হতে থাকে তার ছায়া। স্টেজের পর্দা নেমে এলেও অভিনয় কিন্তু শেষ হয় না। কথা বলতে থাকে এক অন্তর্লীন জেগে থাকা। গমগম করে ওঠে তার প্রতিধ্বনি। এলোমেলো উতরোল উচ্ছ্বাসে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকে নিরবধি সময়। পায়ে তার নিমগ্ন স্তব্ধতা। জিনজার সীমা ফেলতে চায় তরণী শেষে। উদাসীন অন্যমন অনর্থে আগুনে। বাড়ি ফেরার সময় হয় যেখানে দরজা খোলার কোনো প্রতিষ্ঠিত ডোরবেল নেই। সমস্তটাই ঘোষনাহীন আত্মজাগরণ। অস্বীকৃত অনিশ্চয়ের দিকে অলীকভ্রমণ।   

যে কবিদের গ্রন্থশালায় আমার এই ফিরে দেখা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়-

সব্যসাচী হাজরাঃ জন্ম ১৯৮৬, পেশা শিক্ষকতা, শখ কবিতাপাঠ ও গান শোনা, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- তৃতীয় ফ্লাওয়ার শো(২০১০), ওভ্যানোর ওভেনে(২০১১), পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ(২০১৩), উটবিকার(২০১৫), ৯ আঁকা ০(২০১৬), আনুপাহাড়ের জলছবি(২০১৭)। কবি মনে করেন “লেখায় অনুভব ও পর্যবেক্ষণ বেজে ওঠার প্রয়োজনীয় তরঙ্গটুকু থাকা দরকার কারণ এগুলোই পথ, যার লোকাস লেখকের মগজেবেজে ওঠা যেকোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে একমাত্র সাধারণ যোগাযোগবেজে ওঠার তারটাই মস্তিষ্কে বাঁধাআর সবকিছুর ওপরে নতুনের দাবিলেখার আনন্দই লেখালেখির সম্পদসেই আনন্দ যদি লেখায় ছড়িয়ে থাকে তবে একজন না একজন তা টের পাবেইরচনার রহস্য আর দেখার বিস্ময় ফুরোলে সৃষ্টি ফুরোয়”


সোমনাথ সেনঃ জন্ম ১৯৮৩, বিজ্ঞানে স্নাতক। জন্ম বাঁকুড়ায়, বর্তমানে কলকাতাবাসী। কলেজ জীবনেই কবিতার সংস্পর্শে আসা। তারপর চাকরিসূত্রে দেশে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্রমপরিবর্তনশীল স্থান-কাল-সমাজের ভাবাবেশেই পরীক্ষা কবিতার হাতেখড়ি। আন্তর্জালে ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু। প্রথম বই পারদ শাসন (২০১৪)।


অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ শূন্য দশকের কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-২০ মিনিটের জন্য সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, উন্নয়ন বিরোধী যেসব ক্রিয়াকলাপ এখন শহরে হচ্ছে(ইবুক); বাংলা-লেখা সংকলন- ডাক্তারকে যা বলেছিলাম, সারং থেকে জৈতকল্যাণ যত দূরে; গল্পসংগ্রহ-ডি মেজর; অনুবাদ- খাঁচার ভেতর খাঁচা (মহসিন মখমলবাফের নাটকের অনুবাদ)। ধারাকবিতার বহুকিছুকে গরিমায় বহন করেও নতুনের দিকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া শব্দস্রোতে গড়ে তোলেন নিজের বিমূর্ত পৃথিবী যেখানে নাগরিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক জটিলতার স্পর্শ থাকে বিনির্মিত ভাবনায়। অথচ সে কখনও উচ্চকিত নয়, দার্শনিকতার ভারে ন্যুব্জ নয় বরং ক্রমাগত নতুনের সম্প্রসারণ ভাবনায়, চেতনায়।