জীবনমৃত্যু
মৃত্যুর খবরটা মোটামুটি সবাই
জেনেছিল মৃত্যুর পরে পরেই। অথচ মৃত্যুর সম্ভাবনার খবরটা কারও জানা ছিল না। আসলে
বিদেশ কাউকে জানতে দেয়নি। কিন্তু সে প্রায় প্রতিদিনই একটু একটু করে প্রস্তুতি
নিচ্ছিল মনে মনে। শরীর তাকে ইঙ্গিত ও ইশারায় সমানেই জানান দিচ্ছিল। সে বুঝতে
পারছিল তার সময় ফুরিয়ে আসছে, খুব তাড়াতাড়ি তাকে চলে যেতে হবে। সে এটাও বুঝতে
পারছিল যে, তার এই চলে যাওয়ার আগাম খবরটা যদি কাউকে দেয়, তাহলে তারা কেউ তাকে
ছাড়তে চাইবে না, অথচ ধরে রাখার ক্ষমতাও কারও নেই। শুধু শুধু তার কথায় কেউ অবিশ্বাস করে হাসবে, কেউ
বিশ্বাস করে কাঁদবে, কেউ মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে বিদ্রুপ করবে, কেউ দার্শনিকের
ভঙ্গিমায় বলবে, জীবন-মরণ বলে কিছু নেই, এসবই মায়ার খেলা। বিদেশ তার মৃত্যুর আগের ও
পরের সব সম্ভাব্য ঘটনাগুলো নাড়াচড়া করে দেখেছে। তার
ভালোদিক ও মন্দদিক সব কিছুই খতিয়ে দেখেছে। সে এটা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিল যে, তার
অবর্তমানে তার স্ত্রী ও দু’ছেলের ভরণপোষণের কোনো অনিশ্চয়তা থাকবে না। কর্মজীবনের
প্রথম পর্যায় থেকে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, তাতে
তাদের জীবন আরামেই অতিবাহিত হবে। বড়ছেলে বারো ক্লাশে পড়ছে, কমপিউটর সায়েন্সে বি টেক করতে
আগ্রহী। কম্পিটিটিভ একজামিনেশনে যদি সুযোগ না পায়, যথেষ্ট টাকার ব্যবস্থা করে
রেখেছে অন্য কোনো কোটায় ভর্তির জন্য।
ছোটছেলে ক্লাশ টেনে। তার জন্যও সে গুছিয়ে রেখেছে অনেকটাই।
বিদেশ মোটামুটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিনগুলিও চোখ খোলা রেখেই ভেবে রেখেছিল। দু’ছেলে
পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর তাদের মায়ের পছন্দে অথবা নিজেদেরই
পছন্দে বিয়ে করে সংসারজীবন পালন করবে। তাদের মা মাঝে মাঝে তাদের সংসারে গিয়ে
কিছুদিন থাকবে আবার ফিরে আসবে। ছেলেরা দেশ ছেড়ে কর্মসূত্র বিদেশে গেলে সেখানেও থেকে আসতে পারে। তাদের মায়ের নিজের
সংসার এবং দু’ছেলের দুটি পৃথক সংসার, এই তিন সংসারের আবর্তনে ভালোই দিন কেটে যাবে
তার স্ত্রীর। বিদেশ শহরের প্রাণকেন্দ্রে খুব ভালো লোকেশনে যে বহুতল কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনেছে, তা যেমন মহার্ঘ, তেমনই সুন্দর।
এই রম্য ফার্নিশড ফ্ল্যাটে যেখানেই একটু শোয়া, বসা বা দাঁড়ানো যাক না কেন, খুব
তৃপ্তি লাগে। দুটো ব্যালকনি ও ঘরের খোলা দরজা জানালার সামনে দাঁড়ালেই সারা শহরটা
যেন মিনিয়েচারের মতো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। বিদেশ খুবই নিশ্চিন্ত, এই দুটো ব্যালকনিতে বসেই তার স্ত্রী অলিভিয়ার সঙ্গে
সারাটা সন্ধ্যে গল্প করে, আদর করে, ঘনিষ্ঠ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে সুরঞ্জন। হ্যাঁ,
তারই ছোটবেলার বন্ধু, বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে কলিগও, একমাত্র সুরঞ্জনকেই সে
জানিয়েছিল তার শরীরের গভীরে গোপনে ছড়িয়ে পড়া নির্মম মারণব্যাধির কথা। সুরঞ্জনের
নিজের সংসার আছে। স্ত্রী-কন্যাও আছে। তবুও কী এক অমোঘ টানে প্রচন্ড ভালোবাসে অলিভিয়াকে। শুধু বিদেশ ঠিক বুঝতে পারে নি, তার
অবর্তমানে সুরঞ্জন কি অলিভিয়ার জন্য তার
নিজের সংসারটা ভাসিয়ে দেবে?
দারুণ
উত্তরমুছুন