কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>



কালিমাটি অনলাইন / ৪৯


আমাদের সবারই কিছু কিছু নিয়মিত অভ্যেস আছে, যা আমরা কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই নিশ্চিন্ত মনে পালন করে যাই। অবশ্য তারও কিছু শ্রেণীবিভাগ আছে। গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো অভ্যেস যেমন দৈনিক, তেমনি অন্যান্য অভ্যেস সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, বাৎসরিক ইত্যাদি। যেমন আমাদের প্রাতঃকৃত্যের ব্যাপারটা নিতান্তই দৈনিক। সেটা সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক অভ্যেসে কখনই পরিবর্তিত করা যায় না। অথবা যেমন সাপ্তাহিক অভ্যেস সারা সপ্তাহ চুটিয়ে কাজ করে মালিকপক্ষের মুনাফার ভান্ডার মজবুত করে সপ্তাহান্তে একদিন ছুটির মেজাজে – ‘মেজাজটাই আসল রাজা’ – ভেবে রাজত্ব করার ব্যাপারটা দৈনিক অভ্যাসে পরিবর্তিত করলেও সমূহ বিপদ। আর তাই অভ্যেসের বিভিন্ন বৈচিত্রগুলো  যথাযথ জায়গায় ব্যবহার করাই সবার পক্ষে মঙ্গল। এই ধরুন আপনার প্রতিদিনের অভ্যেস সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে বা না ধুয়ে এক কাপ গরম চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে চোখ বোলানো। এটা আপনার না হলেই নয়। কেননা এর পরই আপনি নিশ্চিন্তে পটি করার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করবেন এবং যা কিছু অবাঞ্ছিত পদার্থ তা হাল্কা মনে ত্যাগ করতে পারবেন। অথচ মজার কথা হচ্ছে, তার আগে যদি কোনো কারণবশত চা এবং খবরের কাগজ থেকে আপনি বঞ্চিত থাকেন, তাহলে সেদিন সেই অবাঞ্ছিত পদার্থ ত্যাগ করা যে কতটা বিড়ম্বনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তা ভুক্তভোগীরা বিলক্ষণ জানেন। তবে এইসঙ্গে একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, সময় পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের অনেক অভ্যেসের পরিবর্তন ঘটায়। আমরা এক অভ্যেস থেকে অন্য অভ্যেসে চলে যাই, বা কোনো কোনো অভ্যেস আর বজায় রাখাও সম্ভব হয় না। এই যেমন কিছুদিন আগেও আমাদের ছিল নিয়মিত চিঠি লেখার অভ্যেস। পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খাম বা এনভেলাপ কত কিছুই ব্যবহার করতাম চিঠি লেখার জন্য। এমনও হয়েছে, কাউকে হয়তো সারা বছর কোনো চিঠি লেখা হয়নি, কিন্তু বাৎসরিক অভ্যেসে তাকে শুভ বিজয়ার প্রীতি শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা বা প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখতে ভুল হয়নি। আজও আমরা দুর্গাপুজোর দশমীর পরে অনেককেই প্রীতি শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা বা প্রণাম জানাই ঠিকই, কিন্তু তা চিঠি লেখার মাধ্যমে নয়। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, বেশ কিছুদিন আগে  প্রতি বছর শারদ উৎসবের প্রাক্কালে বাংলা গানের বিশিষ্ট শিল্পীদের পুজোর গান হিসেবে অসাধারণ সব গানের রেকর্ড বাজারে কিনতে পাওয়া যেত। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম সেইসব অবিস্মরণীয় গান শোনার জন্য। এটাও ছিল আমাদের একটি বাৎসরিক অভ্যেস। দুঃখের কথা, এই অভ্যেসটাও সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এইভাবে হারিয়ে গেছে অনেক অনেক কিছুই। পুরনো অভ্যেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা প্রবেশ করেছি নতুন নতুন সময়োপযোগী বিভিন্ন অভ্যেসের মধ্যে। বলা বাহুল্য, নতুন বা নতুনতর প্রজন্মের জীবনে তার কোনো প্রভাব পড়েনি, তারা তো সেইসব পুরনো অভ্যেসের সঙ্গে আদৌ পরিচিতই নয়! কিন্তু আমরা যারা এই দুটি সময়েরই সাক্ষ্য বহন  করছি, তাদের এই নস্টালজিক ব্যাপার স্যাপারগুলো বড্ড উদাস করে দেয় মন বিশেষত এই শারদ উৎসবের দিনগুলিতে। এসব অবশ্য আদৌ নতুন কিছু কথা নয়, আপনারা সবাই এসব জানেন, বোঝেন। সময় ও সমাজ এই খাতেই নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কিন্তু দুঃখটা তো দুঃখই হয়ে থাকেকিছুদিন আগে ক্যাসেটে,  সিডিতে এবং এখন ইউ টিউবে সারা বছর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার ঢালাও সুযোগ ও সুবিধে আছে। শোনেনও অনেকেই। কিন্তু একটা সময় প্রতি বছর মহালয়ার দিন ভোরবেলায় তা শোনার যে বাৎসরিক অভ্যেস ছিল আমাদের, তার যে আকর্ষণ ও আনন্দ, তা কি হারিয়ে যায়নি আমাদের জীবন থেকে! সেই দুঃখ আমরা রাখব কোথায়! আসলে আজকের এই সদা ব্যস্ত জীবনে মহালয়ার ভোরে উঠে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার অভ্যেসটাই হারিয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তে যা অতি সহজলভ্য, তার প্রতি কি আর কোনো আকর্ষণ থাকে!

এ বছর শরতের এবার বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। হেমন্ত আসার জন্য প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :            
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India



<<<< কথনবিশ্ব >>>>


সুনীতি দেবনাথ

বহুভাষাবিদ্ মনীষী হরিনাথ দে




উনিশ শতকে ভারতে রেনেসাঁ চলার সময়ে এই রেনেসাঁর কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বলা যায় বাংলা। আর বাংলায় তখন এমন এক অদ্ভুত আশ্চর্য সময় অদ্ভুত উত্তাল আর উদ্বেল হয়ে ওঠে। এ সময় আশ্চর্য নক্ষত্রের মত সব মানুষের জন্ম ও জীবন ভারত তথা বাঙালির নবজাগরণকে সার্বিকভাবে বিপুল গতিতে অন্য এক দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এক বিস্ময়কর সময়, যখন বিপুল প্রাণশক্তিতে বাংলাকে বাংলা সমৃদ্ধ জীবন ও ইতিহাসকে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে দিতে যেন আশ্চর্য সব মানুষ এক মহাপ্রাণতায় আবির্ভূত হচ্ছিলেন। এত নক্ষত্রের সমাবেশ এর আগে বা পরে বাংলা দেখেনি। বিশেষ করে উনিশ শতকে জন্মে বিশ শতক অবধি জীবনের ব্যাপ্তিকালকে প্রসারিত করে বহু বহু প্রতিশ্রুতিবান মনীষী জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা মাত্রা ও পরিধি সংযোজন করে যেভাবে বাংলার সর্বকালের জীবনযাত্রায় আশ্চর্য সময়কালের পত্তন করেছিলেন, সেই প্রেক্ষিতে আজকের বাংলার দিকে তাকালে হতাশায় বিদ্ধ হতে হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, উনিশ শতকের ১৮৬০ সাল থেকে শুরু করে  ১৮৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণদীপ্ত বেশ কজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে বাংলাকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি দিলেন বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  

এই বিচিত্র সময়েই বাংলার চিরবিস্ময় এক বঙ্গসন্তান মহামনীষী, বহুভাষাবিদ্, আশ্চর্য প্রতিভাধর সুপণ্ডিত, শিক্ষাবিদ্ ও ভাষাবিজ্ঞানের বঙ্গভাষায় উদ্গাতা হরিনাথের দে জন্মগ্রহণ করেন। হরিনাথের দের প্রতিভা ও কর্মময়তা আর অবদান সম্পর্কে বলা যায় বাঙালি আলোচক, সমালোচক ও লেখকেরা কিছুকাল সরব আলোচনা করে গেলেও, পরবর্তীতে যথোচিত বিচার-বিশ্লেষণ তেমনভাবে করেছেন বলে মনে হয় না। অথচ এই বিস্ময় মানুষটি তাঁর অপরিসীম জ্ঞানবত্তা, বহুভাষাবেত্তা, নিষ্ঠা ও প্রতিভা নিয়ে একসময় সারা পৃথিবীতে প্রভূত সম্মান লাভ করেছিলেন এবং পৃথিবীবাসীকে স্বল্পস্থায়ী জীবনে চিরস্থায়ী বহু সম্পদ দান করে বিস্মিত করে গেছেন। বঙ্গভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা ও কৃতিত্ব বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে, বিশেষ করে ভাষাবিজ্ঞানের ভারতীয় পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর কার্যকলাপ অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি দিতে পেরেছে। এই বঙ্গবাসী ও সম্মানিত বঙ্গসন্তানের জন্য আমরা যুগপৎ সম্মান ও গৌরব অনুভব করি। আর বহু ভাষাবিদ হিসেবে অপার বিস্ময়।

হরিনাথের দে পশ্চিমবঙ্গের কামারহাটির আড়িয়াদহ গ্রামে ১২ আগস্ট ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার কাছাকাছি এই গ্রাম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত। তাঁর পিতা ভোলানাথ দে রাইপুর সেন্ট্রালের (বর্তমান ছত্তিশগড়) ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের একজন পদস্থ অফিসার ছিলেন। রাইপুরে যে বাড়িতে শৈশবে হরিনাথের দে বসবাস করেন, সে বাড়িতে ১৮৭৭ সাল থেকে ১৮৭৯ সাল অব্দি তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত বাস করেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ রূপে বিশ্ব বন্দিত হন।

হরিনাথের শৈশবের পড়াশোনা রাইপুর হাই স্কুলে করেন এবং পরবর্তী পড়াশোনার জন্য কলকাতা যান। এখানে এসে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে  হরিনাথের প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যটিন ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে ষান্মাসিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং এই বছরই তিনি কলিকাতা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান নিয়ে পাশ করে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষালাভের জন্য বিলাতে গেলেন। সেখানে ক্রাইস্ট'স কলেজে ভর্তি হন। কেম্ব্রিজে পড়ার সময়েই হরিনাথের গ্রীক ভাষায় এম.এ.-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। এই পরীক্ষা তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে দিয়েছিলেন। ঠিক একই সময়ে হরিনাথ প্যারিসে গিয়েছিলেন, সেখানে সরবোনস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা শেখেন। এরপর ইজিপ্ট গিয়ে আরবি ভাষা শেখা শেষ করেন।

আরবি ভাষা শেখা শেষ করে হরিনাথের জার্মানির মারমুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য গেলেন। এখান থেকে তিনি সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান আহরণ করেন।

১৯০০ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত 'ক্লাসিক্যাল ট্রাইপস্' পরীক্ষার প্রথম ভাগ দিলেন এবং এই পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। পরের বছরই তিনি মধ্যযুগীয় আধুনিক ভাষায় ট্রাইপস্ পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করলেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিনাথের দে গ্রীক, লাতিন, হিব্রু ভাষায় শিক্ষালাভ করে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।

১৯০১সালের শেষ দিকে হরিনাথ দে দেশে ফিরে এলেন। সে সময় পর্যন্ত ভারত সরকারের শিক্ষাবিভাগে উচ্চপদের বৃত্তিতে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতো না। হরিনাথ বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর তাঁকে ঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এক নীরব বিপ্লবে নিজের যোগ্যতা দিয়েই সেদিন জয়ী হলেন এই বহুভাষাবিদ্ ভারত সন্তান। তিনি বিদেশী শাসকের শিক্ষা বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয়।

১৯০৫ সালে হরিনাথের বদলি হলেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপকরূপে। অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকলেও তিনি ছিলেন  চিরপিপাসু এক শিক্ষার্থী। বিশ্বের বহু বিচিত্র ভাষা, তাদের উদ্ভব, গতি ভঙ্গিমা আর সম্পদের প্রাচুর্য হরিনাথকে একদিনের জন্যও আকর্ষণ বিমুক্তি করেনি। এই মৌলভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি একটার পর একটা ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চায় নিরত থেকেছেন, একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেছেন, সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোধহয় একটা সত্যের কাছাকাছি আমরা যেতে পারবো ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি কেন বারবার পরীক্ষার সামনাসামনি হলেন, কেনই বা সেসব পরীক্ষায় সর্বোত্তম হতে চাইলেন, এই বিষয়টা। ভাষাচর্চা কি তাহলে কেবল পরীক্ষা নির্ভর মাত্র? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, ভাষাচর্চা ব্যক্তির  স্বকীয় প্রয়াস, নিষ্ঠা এবং নিরলস সাধনার উপর উৎকর্ষতার জন্য নির্ভরশীল হতে পারে সত্য, তবে পরীক্ষার মাধ্যমে যখনই এই চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তখন পূর্বজদের সমৃদ্ধ চিন্তা ভাবনার নিরীখে একটা সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা একটা গণ্ডীরেখার মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যপথে আরো সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হতে পারে। প্রসঙ্গত আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. রণেন্দ্রনাথ দেবের একটা মূল্যবান কথা মনে পড়ছে। তিনি একদিন নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি কোনদিনই মানুষের শিক্ষার ব্যাপারে শেষ কথা বলতে পারে না। আসলে পরীক্ষা মানুষের মনের দরজা জানালাগুলো খুলে দেয় মাত্র। এই খোলা পথে বিচরণ করে আমরা বিশ্বব্যাপ্ত শিক্ষালয়ের অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাই মাত্র। পরীক্ষার শেখাটা হচ্ছে পাসপোর্ট এ নিয়ে মানুষ জ্ঞানের উন্মুক্ত জগতে একা চলার, সংগ্রহ করার অধিকার অর্জন করে। আর তখনই সে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের, সাঙ্গীকরণের সুযোগ পায়।

হরিনাথের দে সম্পর্কে আলোচনাকালে আনুষঙ্গিকভাবে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. দেবের কথা বারবার মনে পড়ছে। ১৯০৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালে হরিনাথ আবারো পরীক্ষার্থী হয়েছেন। সংস্কৃত, আরবি ও ওড়িয়া ভাষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমনকি সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পারিতোষিক লাভ করেন। আজকের দিনে এই টাকার মূল্য হাস্যকর। কিন্তু যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন তা বিশাল।

পরের বছরই ১৯০৬ সালে প্রাইভেট ( স্বাধীন) পরীক্ষার্থী হয়ে হরিনাথের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ.পাশ করেন। ১৯০৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুনভাবে শুরু হলো ভাষাবিজ্ঞানীদের  Linguistics এই বিভাগেও মনীষী হরিনাথের দে’কে প্রথম অধ্যাপকরূপে নিয়োগ  দেওয়া হলো। কলকাতায় ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী স্থাপিত হবার পর এতে বিলাত থেকে জন ম্যাকফারসন প্রথম লাইব্রেরীয়ান হয়ে যোগদান করেন। তিনি লণ্ডনে ব্রিটিশ  মিউজিয়ামে সহকারী গ্রন্থাগারিক ছিলেন। কলকাতার ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরী এখন ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়া’জন ম্যাকফারনেল পরলোকগত  হলে দ্বিতীয় লাইব্রেরীয়ান হলেন হরিনাথ দে। সেকালের ও একালের সম্মানিত এই লাইব্রেরী অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার যেখানে স্তরে স্তরে সজ্জিত থেকে জ্ঞান মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার গভীর নির্ঘোষ উচ্চারণে মুখরিত। ভারতীয় হিসেবে পরাধীন দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি শ্লাঘার। কারণ হরিনাথ দে হচ্ছেন সেই বিদগ্ধ ভারতীয় যিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই বিরল সম্মান পেলেন। আরেকটু ব্যাখ্যা করে  বলা যায়, হরিনাথের দে’র মত বহুভাষাবিদ্, অগাধ পাণ্ডিত্যের সমুদ্র, ভাষাবিজ্ঞানীরই উপযুক্ত  এই পদে নিয়োগ পদটির সম্মান যেমন বাড়ালো, তেমনি ভারতীয় প্রতিভা বিশ্ববিদ্বদ্ সমাজে স্বীকৃতি পেলো।

ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরীতে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করার সময়েও হরিনাথের কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ভাষার দুটি বিভাগে এম.এ.পরীক্ষা দেন। দুটিতেই প্রথম বিভাগে প্রথম হন। একজন ইতিহাসবিদ্, বিদ্বান ও বহুভাষাবিদ্ হরিনাথ দে তখনকার ইম্পিরীয়্যাল লাইব্ররি আর বর্তমান ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইণ্ডিয়ার প্রথম লাইব্রেরিয়ান হয়ে ১৯০৭ সাল  থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। চৌদ্দটি ভাষায় এম.এ.পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। চৌদ্দটি ভারতীয় ভাষা, এশীয় ও ইউরোপীয় ভাষাসমূহের ২০টি ভাষায় ছিল তাঁর পারদর্শিতা। অর্থাৎ সর্বমোট চৌত্রিশটি ভাষায় তাঁর কিংবদন্তীতুল্য অধিগম্যতা ছিলভারতে প্রথম  ভাষাবিজ্ঞান বা Linguistics-এর পথিকৃৎ ছিলেন হরিনাথ দে।  এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। বহুভাষাবিদ্ হরিনাথের দে সম্পর্কে একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তিনি যেসব ভাষা শিখেছিলেন, সেসব ভাষার মর্মস্থলে তিনি প্রবেশও করেছিলেন। মাতৃভাষার মত প্রতিটি ভাষায় সাবলীলভাবেই তিনি বার্তালাপ, লেখালেখি ও চিন্তাভাবনায় সক্ষম ছিলেন। মোদ্দাকথা প্রতিটি ভাষার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তাঁকে ভাষার অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। আরও উল্লেখ করতে হয় অতীত ভাষাসমূহের উৎপত্তি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির বিষয়েও তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। বলতে হয় তিনি শুধু ভাষাবিদ্ ছিলেন না ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানীও, আর এ বিষয়ে তিনি ভারতীয়দের পথিকৃৎ।

সুপণ্ডিত হরিনাথ দে ম্যাকুলে'স এসে অন মিল্টন ( Macaulay's Essay on Milton) গ্রন্থের একটি নতুন সংস্করণ ১৯০২ সালে প্রকাশ করলেন। পরের বছর তিনি আরেকটি বিস্ময়কর প্রকাশনার কাজ সম্পন্ন করলে প্যালগ্র্যাভস্ম গোল্ডেন  ট্রেজারি (Palgrave 's Golden Treasury) বইটির নবরূপায়ন করে সম্পাদনা ও প্রকাশনা দুটিই করলেন। এরপর হরিনাথের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইবন বতুতা রচিত বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী ‘রিহলা’ ( Rihla) - এর ইংরেজী অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ।  তিনি জালালউদ্দিন আবু জাফর মোহাম্মদের গ্রন্থ ‘আল্ ফাকরি’ ( Al Fakhri) - এরও ইংরেজী অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি আরবি ভাষার ব্যাকরণ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখেন।

হরিনাথ দের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির অন্যতম হচ্ছে ইংরেজী –পার্শিয়ান  অভিধান রচনা। তিব্বতী ভাষারও একটি অভিধান তিনি রচনা করেন। হরিনাথ ঋকবেদের একটা অংশ উপনিষদ ও মূল শ্লোক সহ টীকাভাষ্য ভাষ্য সহকারে তিনটি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন।

হরিনাথ দে এছাড়াও বহু বিখ্যাত গ্রন্থের টীকাকরণ, সম্পাদনা  ও অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। বহু গ্রন্থ ও সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ক পার্শিয়ান, চীনা, তিব্বতী ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত রচনাসমূহের সম্পাদনা, টীকাভাষ্য রচনা ও অনুবাদ কর্মেও সাবলীলভাবে করেছেন। বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত ‘লঙ্কাঅবতার সূত্র’ ও ‘নির্বাণ ব্যাখ্যা শাস্ত্রম্’ সম্পাদনা করে তিনি প্রকাশ  করেছিলেন। বহু আরবি, ফারসি, পার্শিয়ান, পালি ও বাংলা গ্রন্থেরও পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকটি সংস্কৃত নাটকেরও ইংরেজি অনুবাদ করে তিনি প্রকাশ করেন। যেমন সংস্কৃত নাট্যকার সুবন্ধু রচিত ‘বাসবদত্তা’  নাটক। মহাকবি কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞানম শকুন্তলম’ ইত্যাদি। তাঁর স্বকীয় সৃষ্ট সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞানীদের, ও হিন্দুধর্ম বিষয়ক নানা রচনায় অষ্টাশিটি ভল্যুম ‘Harinath Details Collection নামে পরিচিত এবং তা কলকাতার ন্যাশনাল  লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়াতে সংরক্ষিত অতি মূল্যবান সম্পদ। বহু পত্রপত্রিকায় হরিনাথ দে রচিত অনেকানেক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো। তার কিছু সংখ্যক ১৯৭২ সালে সংকলিত ও সম্পাদনা করে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার থেকে প্রকাশ করেছেন। এই সংকলন গ্রন্থটির  নামকরণ করা হয়েছে Select Papers, Mainly Idiologicalইংরেজিতে রচিত এই সংকলন অত্যন্ত  মূল্যবান সংগ্রহ। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ কলকাতায় সংরক্ষিত, ‘সেন্টিনারী ভল্যুম, হরিনাথ দে, জাতীয় গ্রন্থাগার, ১৯৭৭’, অত্যন্ত মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ সংগ্রহ, যা কৌতূহলী পাঠকের কাছে মনীষী হরিনাথ দে সম্পর্কে মূল্যবান আকর গ্রন্থ বলে পরিগণিত হয়।  

জাতীয় গ্রন্থাগারে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালে ৩০ আগস্ট তারিখে বাংলা তথা ভারতের এই মহিমান্বিতর্ক প্রতিভার বিমূর্ত মূর্তি হরিনাথের দে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে পরলোকগত হন। একটা কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স  চৌত্রিশ বছর, আর পৃথিবীর উন্নত ভাষাসমূহের চৌত্রিশটি ভাষা সম্পর্কে তাঁর কিংবদন্তীতুল্য অপার জ্ঞান!

এই প্রবাদপ্রতীম বহু ভাষাবিদ্ কেবলমাত্র বাংলা বা ভারতের সীমানায় তাঁর খ্যাতি নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিশ্ব জোড়া ভাষার বিস্তৃত পরিসরে ও বিশ্ববাসীর নিকট  অভূতপূর্ব ভাষাজ্ঞানী, বহুভাষাবেত্তা এবং অপার পাণ্ডিত্য নিয়ে সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেছিলেন-
“যাচ্ছে পুড়ে নতুন করে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থমালা”
হরিনাথের দে’র প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানাতে কবি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমরাও কণ্ঠ  মেলাবো।





  

শিবাংশু দে

জন্মদাগ মানুষী বিপদ


সব মানুষই নানা জন্মদাগ নিয়ে জন্মায় তার ভাষা, তার ধর্ম, তার বর্ণ, তার ভূগোল, তার সংস্কৃতি, তার অসহায়তা সব কিছুই সে সঙ্গে নিয়ে আসে ভূমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে সে নানা ছাঁচে ঢালাই হতে শুরু করে ভিন্ন জন্মদাগের সঙ্গে তার লড়াই সেদিন থেকেই শুরু কারণ নশ্বর পৃথিবীতে সব কিছু বদলে যায় শুধু জন্মদাগ বদলায় না

এই তো কিছুদিন আগেই বেশ ঘনিষ্টভাবে দেখলুম কী বিকট জন্মদাগের লড়াই এক ধর্ম, এক বর্ণএক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক ভূগোল তা সত্ত্বেও অন্ধ্র আর তেলেঙ্গানার লোকজন কী হিংস্রভাবে নিজেদের  হেঁসেল আলাদা করে  নিলো তফাতটা কী? তটীয় অন্ধ্রপ্রদেশে ইংরেজ রেললাইন তৈরি করে দিয়েছিলো কলকাতা থেকে তৎকালীন ম্যাড্রাসশহর পৌঁছোনো সহজ করতে এর ফলে ইছাপুরম থেকে বিজয়ওয়াড়া পর্যন্ত দেশের সমগ্র অংশটা পেয়ে গেলো ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ সরকারি চাকরি আর বিকশিত হবার নানা সুযোগ কিন্তু নিজামের রাজত্বের অংশ তেলেঙ্গানা আর বিদর্ভ এলাকা এই উন্নতির বাইরে থেকে গেলো দেশ স্বাধীন হবার পর নিজামের অন্ত হতেই বিদর্ভ আর তেলেঙ্গানার লোকজন তুমুল ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের ঘর 'আলাদা' করে নেবার দাবি জানাতে শুরু করেন একদল সফল হয়েছেন আরেকদল এখনও হননি সেই সময় দীর্ঘকাল দেশের অংশে বসবাসের সূত্রে কাছ থেকে দেখেছি, কীভাবে মানুষ কষ্টকল্পিত, ভিত্তিহীন জন্মদাগের সন্ধান করে হয়রান হয়ে যায় সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো বোঝা যায় না কিন্তু বেশ কিছু রাজনীতিকের চতুর্দশ পুরুষের ব্যবস্থা হয়ে গেলো



এদেশের পূর্বপ্রান্তে যখন ইংরেজ তাদের রাজত্ব শুরু করে, তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলো য়ুরোপিয় জাতীয়তাবাদের নিজস্ব মডেল, যেটা আমাদের দেশের থেকে আলাদা য়ুরোপে একটা এথনিক জাতি একটা নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদের মডেল অনুসরণ করে পরে যেটা সর্বনেশে 'নেশনতত্ত্ব' হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ফলত বিশ্বযুদ্ধের রমরমা আরো অনেক বিষয়ের মতো বাঙালি এই ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের পাঠও নিয়েছিলো ইংরেজের থেকে সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই  বাঙালিরা নিজস্ব জাতীয়তাবাদের একটা মডেল তৈরি করে ফেলেছিলো পরবর্তীকালে গুরুমারা চেলার মতো সেই জাতীয়তাবাদের পথেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় ইতিহাস বলছে, ইংরেজসংসর্গ করে বাঙালিরা বুঝতে পারে তারাও সাহেবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে পারে প্রায় সমানে সমানে সরকারি চাকরি, নানা অর্থকরী পেশা, নতুন সময়ে তৈরি হওয়া নানা সুযোগের সদ্ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে সেই পর্বটারই নাম বঙ্গীয় রনেশাঁস যুগ বাংলা জাতীয়তাবাদের শিকড় ছিলো তার মধ্যেই বঙ্গীয় 'জাতীয়তাবাদ' সেই হিন্দুমেলা, বঙ্কিমচন্দ্র ইত্যাদি নানা পর্ব পেরিয়ে বেশ বলিষ্ঠ একটা মাত্রা পেয়ে যায় বেশ মসৃণভাবেই তা বাঙালি অহমেরও ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় উত্তর পূর্ব ভারতে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনও এদেশীয় শক্তি ছিলো না তখন কিন্তু ইংরেজ বিদায় হবার সঙ্গে সঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা অসমে (যেসব জায়গায় ইংরেজি শিক্ষা প্রশ্রয়ের সূত্রে সমাজজীবনে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির একটা বেশ প্রকট প্রতিপত্তি ছিলো) প্রচ্ছন্ন স্থানীয় জাতীয়তাবাদ (পুরো বঙ্গীয় মডেলেই) মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ছয়ের দশকের শুরু থেকেই এই সব প্রদেশে আমরা নানাভাবে বাঙালিবিরোধী সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠতে দেখি তার মধ্যে ওড়িশা আর অসমে ব্যাপারটা ছিলো বেশ প্রকট

বঙ্গীয় জাতীয়তাবাদের যে মডেলটি অনুসারে ওড়িশায় মরাঠি বর্গিদের উত্তরসূরি মধুসূদন রাও প্রমুখ এবং অসমে লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া  নিজস্ব জাতীয়তাবাদের ছাঁচটি প্রস্তাব করেছিলেন, তার শিকড় ছিলো উনিশ শতকে তাঁদের  কলকাতায় পড়াশোনা করার সময়কালে অধীত অভিজ্ঞতা ধ্যানধারণায় আলোকিত হবার তাড়নায় মধুসূদন রাও ব্রাহ্মধর্মও গ্রহণ করেছিলেন সেকালে অনেক বাঙালির মতো লক্ষ্মীনাথ তো স্বয়ং ঠাকুরবাড়ির জামাই ছিলেন অসমিয়া আর বাংলা ভাষার স্বরূপ প্রভেদ নিয়ে তাঁর এবং খুড়শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের বাদানুবাদ তো সর্বজানিত নিজস্ব জন্মদাগের খোঁজে এইসব মনীষী সদাব্যস্ত থাকতেন ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধ তৈরি করার পদ্ধতিটি অসম ওড়িশার মানুষ বাঙালিদের থেকেই শিখেছিলেন ইংরেজদের থেকে জাতীয়তাবাদের পাঠ নিয়ে যেভাবে বাঙালি ইংরেজের বিরুদ্ধেই তা ব্যবহার করেছিলো একদিন, তার পুনরাবৃত্তি আমরা অসম আর ওড়িশার  মানুষদের মধ্যেও দেখেছি তবে এই দুই প্রদেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিলো বাঙালির সামাজিক প্রাধান্য প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক অস্তিত্ত্ব তবে এই বর্ণাশ্রমের দেশে যাবতীয় জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত জাতিবাদে পর্যবসিত হয়

হয়তো সবাই নয়, কিন্তু বাঙালিদের একটা বৃহৎ অংশ কিন্তু ‘উড়ে-মেড়ো-খোট্টা-ছাতু’ সংস্কৃতির অঙ্গ ইংরেজদের ঔপনিবেশিক অহংকারকে অনুকরণ করে  বাঙালিও একসময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো তার অন্যান্য প্রান্তের স্বদেশবাসীর কাছে সব জাতিকেই এই অহমিকার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিরা ছাড়া ইংরেজ রাজশক্তির কাছের লোক ছিলেন তামিল সম্প্রদায় উগ্র মহারাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ বম্বে থেকে তামিলদের বিতাড়ন করেছিলো পুনে’কে কেন্দ্র যখন নানা ভারিশিল্প গড়ে উঠতে থাকে তখন মরাঠিরা অন্য প্রান্তের মানুষদের সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে অনেক বাধা সৃষ্টি করেছিলেন নদীর জলকে কেন্দ্র করে তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষ কর্ণাটকের সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের  নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন পঞ্জাবে একসময় কী হয়নি? এদেশে কেউই ব্যতিক্রম ' শুরু হয় স্থানিক জাতীয়তাবাদ থেকে কিন্তু অচিরেই তা পৌঁছে যায় জাতিবাদের অন্ধত্বে

রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকালের উজ্জ্বলতম ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা বিষয়ে অতি বড় শত্রুরও কোনও সন্দেহ নেই স্বাধীনভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ কিন্তু কলকাতায় ছাত্রজীবনে ‘খোট্টা’ হবার অপরাধে নিয়মিত কটাক্ষের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতেন  পাটনায় থাকাকালীন দেখেছি যখন বাঙালি সিবিআই ডিরেক্টর উপেন বিশ্বাসের উদ্যোগে হাইকোর্টের বাঙালি বিচারক সুধাংশুজ্যোতি মুখোপাধ্যায় লালুপ্রসাদের কারাদণ্ড আদেশ করেন, তখন লালুর দলের গুণ্ডারা গুলজারবাগ, পাটনা সিটি এলাকার দুশো বছরের পুরনো বঙ্গালি মহল্লায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে অনেক গুণ্ডামি করেছিলো উত্তরভারতের (বিহার উত্তরপ্রদেশে) অনেক কায়স্থ ব্রাহ্মণরা বাঙালিদের সম্বন্ধে বেশ বিরূপ মনোভাব পোষণ করে কারণটি নিতান্ত অর্থনৈতিক ইংরেজ আসার পর বাঙালিরা সরকারি কাজে কায়স্থদের এবং শিক্ষা অন্যান্য লাভদায়ক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছিলো বিশেষত সিপাহি বিদ্রোহের পর

কিছুদিন আগে একটি লেখায় মূলত ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীত প্রতিভা তাঁর জীবনের অন্য কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলুম লেখাটি পড়ার পর লক্ষ্য করলুম কয়েকজন মান্য বাঙালি পাঠক তাঁর সঙ্গীত ক্ষমতা বিষয়ে সন্দিগ্ধ না হলেও ব্যক্তি ভূপেনের রাজনৈতিক মানবিক রংবদল নিয়ে বিরূপ অবস্থান নিয়েছেন ভূপেন নবরূপ অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একজন আইকন জন্মদাগ খোঁজার লড়াইটা যখন হবে বঙ্গীয় জাতীয়তাবাদ তার অসমিয়া প্রতিভাগীর মধ্যে, তখন ভূপেনের অবস্থানটি নিয়ে কোনও রকম সন্দেহের অবকাশ কী করে  থাকতে পারে? ‘বঙ্গাল খেদা’ নানা রূপে এদেশে অনেক প্রদেশেই হয়েছে স্থানিক  জাতীয়তাবাদের আগুন যখন বিশেষ একটি  সম্প্রদায়ের দিকে ধাবিত হয় তখন তা দুঃখজনক হলেও বিরল নয় সারাদেশে অনেক মেধাবী, সৃজনশীল মানুষ এই রকম মনোভাব পোষণ করেন বাঙালিরাও ব্যতিক্রম ' বিচ্ছিন্নতাবাদী অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আগুনে শুধু বাঙালিদের নয় অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের আঙুল পুড়েছে কিন্তু ভূপেনের বিরুদ্ধে অভিযোগটি অনেক জোরালো কারণ তিনি প্রথমজীবনে বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং জীবনের একটা বৃহৎ অংশ বাঙালিদের সঙ্গে কাটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টি বাঙালিদের দীর্ঘকাল মুগ্ধ করেছে কিন্তু নব্য অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে তিনি অসমিয়া অস্মিতাকে বাঙালি আনুগত্যের উপরে রেখেছেন এটা কী অস্বাভাবিক? কেউ কেউ তাঁকে ‘নিমকহারাম’ও মনে করেন তাঁকে এসব বলার আগে একটু ভেবে  নেওয়া দরকার তাঁকে প্রদত্ত  ‘নিমকটি তাঁর উপার্জন না বাঙালিরদয়ার দান?  বাঙালিরা দেশের অন্য প্রান্তের সমস্ত ভারতীয়দের শিল্পকৃতির প্রতি একটা উচ্চমন্য পিঠচাপড়ানো অবস্থান নিয়ে থাকেন এখনও ভূপেনের গান ভালোবেসে বাঙালি শ্রোতা শিল্পীকে কৃপাধন্য করেছিলো নাকি? বাঙালির এই মনোভাব আমি সারাদেশে দেখেছি পাটনা, ভুবনেশ্বর, গুয়াহাটি, তিরুবন্থপুরম বা হায়দরাবদের গুণী সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রশিল্পীরা বাঙালির এই মুহূর্তের সৃষ্টির প্রতি   সতত সজাগ থাকেন কিন্তু বাঙালিরা কতটা জানেন তাঁদের সৃষ্টিজগতের খবর? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন তাঁরা আপনহারা মাতোয়ারা হয়ে থাকতেই অধিক অভ্যস্ত

প্রথম জীবনের ‘জাতীয়তাবাদী’ রবীন্দ্রনাথ যখন পরিণত বয়সে পৌঁছে এই  সেন্টিমেন্টের অসারতা অনুভব করেন তখন অক্লান্তভাবে এই মনোভাবের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠেন এই কারণেই আজ নানা প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল থেকে রবীন্দ্রনাথকে কালোতালিকাভুক্ত করার জন্য প্রবল প্রয়াস চলেছে বাঙালিদের সৌভাগ্য এতদিন আগেই আমাদের একজন এই বিষয়ে বাঙালিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন আমাদের জন্মদাগ আনুগত্যের বিপদ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন কিন্তু আমরা বোধহয় যথেষ্ট সচেতন হইনি

ভূপেনের মৃত্যুর পর একটি লেখা পড়েছিলুম। সেখানে ভূপেনের যাত্রাটি সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার আংশিক উদ্ধৃতি এখানে রাখছি। হয়তো ভূপেনের সম্বন্ধে কিছু বাঙালির মনোভাবের সঙ্গে তা মিলবে না। কিন্তু সত্য যে কঠিন!  

 “...Contradictions and ambiguities also followed his engagement with the six yearlong anti-immigrant Assam movement which started in 1979. On the one hand Hazarika would, supporting the mass character of the movement, also attest to its principal aim of the expulsion of peasant migrants from Bangladesh led by the All Assam Students Union (AASU). And on the other, it was precisely during its heydays, when sentiments were sharpening against ‘migrants’ conflated with Muslims as a whole, that he composed and sang ‘Mohabahu Brahmaputra’ where he painted the long history of migration and assimilation of diverse people which built a composite culture in the region, singing ‘podda nodir dhumuhat pori, koto xotojon aahiley; luit’or duyu parote kotona atithik ado riley … kisu lobo lagey, kisu dibo lagey, jin jaboloi holey… Robindranatheo koley’ (‘caught on the storm of river Podda, hundreds came, and the banks of the Brahmaputra welcomed them as guests … take some, give some, to melt into each other…also said Rabindranath’). Though often interpreted as a liberal plea, this can be read as a warning of the danger of a sectarian politics of essential sing, of the aggressive upper-caste Assamese Hindu colour of the movement, which sought to violently erase this myriad history into extinction. His assertion that ‘we all have a history of migration and thus we (including the migrants from the erstwhile East-Bengal, now Bangladesh) must strive to live together’, baffled both the supporters as well as the opponents of the movement. Many within AASU began to suspect his support for the movement, as despite his apparent avowal that the Assamese people are in the danger of becoming homeless in their own land (the official AASU line), all he had to offer as a solution was a narrative of migration- hardly a satisfactory answer to the requirements of a sharp anti-immigrant tenor.” (Taking the Jajabor’s Journey Forward: Remembering Bhupen Hazarika: Radical Notes: Mayur Chetia & Nayanjyoti: Nov 11, 2001)


‘পলিটিক্সের ধূলিচক্র’ অতল পাঁক যখন মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে তখন শিল্পের  অক্সিজেন তাকে বাঁচিয়ে রাখে ভূপেনের পলিটিক্সে কী কী বিচ্যুতি ছিলো (অবশ্যই ছিলো) তা ইতিহাস বিচার করবে তিনি সারাজীবন ক্রমাগত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতের দোলাচলে উদ্ব্যস্ত ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁকে দেখতে পাই নির্দ্বিধায় হাত মিলিয়েছিলেন অতি দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে
“With the ever more naked rightist turn in the political life of Assam’s middle classes in the late 1990s, Hazarika followed suit. With the formation of the NDA government (Asom Gana Parishad or AGP was part of the coalition) in 1998, his political journey came to its culmination with viewing the rabidly communal RSS as the authentic agent of social transformation. He even contested a Lok Sabha seat from Guwahati (which he fortunately lost) on a BJP ticket in 2004, with its cadres blaring his humanist plea ‘mahuhe manuhor babey, jodihe okonu nabhabey…bhabibo kunenu kuwa, xomonia’ (‘if man doesn’t think of man … who will?’) on their election vans. Under the pressure of RSS, he even tried to replace the word Axom with Bharat (as Axom is only to be subsumed within the larger Indian national discourse) in some of his old compositions, but these modifications never became popular. Hazarika’s use of rhetorical forms, like of the ‘virgin earth’ and ‘nation as the mother’ and thus someone to be protected, have been used by patriarchal chauvinists, and this tinge in his content had itself perhaps led to his ‘straying’ into the right wing fold who today find it easy to appropriate him as their own." (ibid) 

এই দোলাচলের ট্র্যাজেডি হয়তো  কিছু সৃজনশীল শিল্পীর অনভিপ্রেত স্বভাবলক্ষণ স্বয়ং বব ডিল্যান একসময় শুদ্ধ খ্রিস্টিয়তার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন বাঙালির একান্ত সুমনও এই প্রবণতার ব্যতিক্রম ' এই বিচ্যুতি শিল্পক্ষেত্রে তাঁদের অবদান তুচ্ছ করে দিতে পারে না

কিন্তু এর সঙ্গে  আমাদের জন্য অন্য একটি প্রশ্নও সমান তাৎপর্যপূর্ণ  সারা উত্তর পূর্বভারতে যখন বাঙালিরা ক্রমাগত প্রতাড়িত হতে থাকে তখন তার জন্য কি শুধু স্থানীয় মানুষেরাই দায়ী? বাঙালির কোনও দায় নেই? স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রদেশেরই ভাষাভিত্তিক গঠন হওয়ার জন্য নিজস্ব অস্মিতার রাজনীতি দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার প্রতি যথাসময় সচেতন না হতে পারার জন্যই বাঙালিরা সেই সব জায়গায় একঘরে হয়ে পড়েছে, যেখানে তাদের এককালে বহুমুখী আধিপত্য ছিলো এমন কী এই মুহূর্তের  মোকাম কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয় শ্রমবিমুখ, বাণিজ্যবিমুখ বাঙালিজাতির একমুখী সাদাজামার চাকরির আকাঙ্ক্ষা তাকে যাবতীয় পরিশ্রমকেন্দ্রিক অথবা  ব্যবসামুখী উদ্যম থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছে ভিন্ন প্রদেশের যেসব মানুষ দীর্ঘকাল ধরে এই সব পেশা থেকে বাঙালিকে প্রতিস্থাপিত করেছেন তাঁরাও আজ এই শহরে নিজস্ব প্রভাব দেখাতে শুরু করেছেন বিশেষত রাজনৈতিক আপরাধিক জগতে তাঁদের স্বচ্ছন্দ  গতিবিধির সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি আর পাল্লা দিতে  পারছে না ফেসবুকে গালমন্দ করে তাঁদের বশীভূত করা যাবে না প্রভাবচ্যুত বাঙালির ক্ষুব্ধ হবার কারণ হয়তো রয়েছে  কিন্তু দোষটা কার? প্রতিষেধক হিসেবে কিছু দুর্জন লাঠি-তলওয়ার নাচিয়ে ক্ষুব্ধ বাঙালিকে রাজপথে মিছিল করতে প্ররোচনা দিচ্ছে ঈশ্বর আছেন কি না জানি না যদি ভুলক্রমেও কেউ থেকে থাকেন তিনি বাঙালিকে এই দুর্যোগ থেকে বাঁচান এই জন্মদাগের অভিশাপ বাঙালি বহন করতে পারবে না


ভূপেন বিষয়ে অনেক বাঙালির মনোভাবটিও এই ক্ষোভেরই প্রকাশ ভূপেনের রাজনৈতিক অবস্থান কোনও ব্যক্তিগত মাত্রা নয়, অসমের নব্য অস্মিতার মুখ বাঙালিকে যেন এজাতীয় ‘অস্মিতা’র শিকার না হতে হয়