প্রযত্নে আকাশ
এখানে আমার আফটার শাওয়ারের গন্ধ কারো নাকে আসে না। অ্যাক্স-এর কোন বডি স্প্রেটা দিলুম, তাতেও নৈব নৈব চ। গলায় আইডেন্টি কার্ড ঝুলিয়ে, ছোট এল.ই.ডি র ব্যাকগ্রাউন্ডে
সেলফি তোলার সুযোগও তাই কম। থাকার মধ্যে
ঝুল মাখানো পাখার চোখরাঙানি, এক হাতলের চেয়ার আর সংখ্যাতত্ত্ব। মাস দুয়েক হলো জয়েন করেছি। ছোটবেলায়
একবার ডাকঘর নাটক করেছিলাম। আর এখন
রিয়েল লোকেশানে শ্যুট!
খাস কলকাতার ছেলে। ঘন্টা দেড়েকের ট্রেন জার্নিতে নাইটহুডের শার্টটা মাঝে মাঝে নাইটমেয়ার হয়ে আসত। কিন্তু শেষ স্টেশনের আগাছা মোড়া স্বভাব, কীরকম যেন হিলিং পাওয়ার-এর কাজ করত। দিনের গ্রাফটার অ্যাক্সিস ওখানেই টানা হয়ে যেত। বাকি প্লটিংটার
জন্য, খুব সুন্দর ভাবে অপেক্ষা
করত, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু এলোমেলো স্বপ্ন।
ইদানীং পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে বা ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটনগুলোতে
একটু হলেও আমি এগিয়ে আছি।
দু’মাসের মতো হলো জয়েন করেছি। এতদিনে এইসব কিছুই অভ্যেসের মতোন লাগছে। এক অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে। এখানে সবাই প্রায় আমার সিনিয়র। শেখা তাই সবসময় হয়। আর যেটা
বেশি হয়, সেটা হচ্ছে দেখা...! একটা
পাসবুকের মলাটে লাল-সাদা ছাড়াও আরো কত রঙ মিশে থাকে। একটু একটু করে গাঢ় হয়ে মিশতে থাকা স্বপ্নের রঙ। ‘খাতায়’ পড়ে থাকার সংখ্যাটা যখন বেশি হয়, তখনকার সেই উজ্জ্বল মুখ বা কয়েকটা শূন্যের এদিক-ওদিকে ওলোট-পা্লোট হয়ে যাওয়া কিছু অভিব্যক্তি। সবাই লুকোনোর চেষ্টায় থাকত। কিন্তু গ্রিলের ওপার থেকে আমি কেমন করে যেন সবটা ধরে
ফেলতাম। ঘাম মুছতাম,আর বাইরে
দেখতাম মাসের প্রথম দিকে পেনশনের জন্য লাইন।
লোমকূপটা মাঝে মাঝে শিফট হয়ে যেত, কিছু কিছু মানুষের অ্যাপ্রোচে। এইভাবে হাজার অ্যাপ্লিকেশন্-এর মাঝে চাপা পড়ে থাকত ছোট ছোট ভালোলাগা
খারাপলাগাগুলো।
একদিন একজন ভদ্রলোকের একটা কেস হাতে এলো।
মানিঅর্ডার রিলেটেড। টাকাটা
আটকে ছিল। বেশ কিছু ফর্মালিটিসএর দরকার ছিল। বেশ কমপ্লিকেটেড কেস। ভেতরে ডেকে সব কিছু
বোঝানোর দায়িত্ব পড়ল আমার। ভদ্রলোক
মিশুকে। কী সুন্দর মিশে গেলেন! কত কথা শেয়ার করলেন! ছেলের পাঠানো
টাকা। প্রথম দিকে একটু বিরক্তই লাগত। কিন্তু পরের দিকে বুঝেছিলাম,
টাকাটা বড় ব্যাপার নয়। কিছু যে আসছে সেটাই বড় কথা।
প্রতিদিন কত যত্ন করে আসতেন। কোনো ক্লান্তি ছিল না, কোনো বিরক্তি ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল শুধু অপেক্ষা... ‘ওই কিছুর’ জন্যে।
আমি কি কিছুটা ইচ্ছে করে ঢিলেমি করছিলাম
কাজটায়! উনি পাওয়ার জন্য অস্হির ছিলেন, আর আমি বোধহয় হারানোর ভয়ে স্থির ছিলাম। তো এই স্থির-অস্থিরের খেলা আস্তে আস্তে গুটিয়ে আসছিল। কাজটাও অনেকটাই হয়ে এসেছিল। এই
সময় হঠাৎ করে প্রায় বিনা নোটিশে শরীর ভালোবেসে ফেলল টাইফয়েডকে। দশ-পনেরো দিন বিছানা আঁকড়ে রইলাম। ওদিকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। হয়তো এতদিনে কাজটা হয়েও গেছে। তবুও ঘোরের মধ্যে বারেবার ফিরে এসেছে লাইন-ঘাম-মধ্যবিত্ত স্বপ্ন।
ডেস্কের ফাইলগুলোর ধুলো মনে মনে অনেকটা পুরনো
করে দিয়েছে আমায়। মাত্র তো সপ্তাহ দুই... তাতেই...
চেয়ারের আরেকটা হাতলও নেই... তবু ভালো। একা একা ক্ষয়ে যাওয়াটা বরং কম ক্ষয়ের।
“এই বাবলুদা, ওই মানি অর্ডারের কেসটা মিটে
গেছে তো?”
“হ্যাঁ, ওইটা তো, হয়েছে বোধহয়!
মাঝখানে ওনার ছেলে এসেছিলেন একবার। বিদেশ থেকে ফিরেছে বলল।
ছেলে?
কেন?
ছেলের তো আসার...
উচিতও নয়...
শুধু টাকা আসবে...
আর কিচ্ছু নয়...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন