কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬৯  


বেশ কিছুদিন হলো রামনামের চলন খুব বেড়েছে। তা বাড়ুক, কারোর আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেভাবে ও যে অনুপ্রেরণায় তা ক্রম বর্ধিত হচ্ছে, তাতে রামের মাহাত্ম্য কি আদৌ বর্ধিত হচ্ছে? আমাদের অগ্রজরা এবং আমরা নিতান্ত শৈশব থেকে ভারতবাসী হওয়ার সুবাদে যে রাম ও রামায়ণের সঙ্গে নিত্য পরিচিত ও সংপৃক্ত হয়ে এসেছি, আজকের প্রজন্মের শিশুরা কি সেই পরিচিতি ও সংপৃক্তি লাভের কোনো সুযোগ পাচ্ছে? খুব ছোটবেলা থেকে রামের নামে যেসব উচ্চারণ শুনে এসেছি, যেমন ‘জয় সিয়ারাম’, ‘রামনাম সত্য হ্যায়’, ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’, ‘পতিত পাবন সীতারাম’, জয় রামজী কী’ ইত্যাদি ইত্যাদি, তা  কিন্তু সত্যি সত্যিই শ্রুতিমধুর ছিল। মনের মধ্যে একটা প্রসন্নতা বয়ে আনত। ‘রামায়ণ’এ বর্ণিত পুরুষোত্তম রামের প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় আমরা আপ্লুত হতাম। কিন্তু ইদানীং রামের নামে যে ধ্বনি শ্লোগানের কায়দায় ধ্বনিত হয়, সেই ‘জয় শ্রীরাম’ নির্দিষ্টি একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভূতিশীলদের  ব্যতিরেকে আর কারও কাছে রামের কোনো মাহাত্ম্য বয়ে নিয়ে আসে না। বরং  বলা যেতে পারে, এই শ্লোগান ক্রমশ অনেকের কাছেই আশঙ্কা ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত এই শ্লোগান চিৎকার করে বলার জন্য যেভাবে বলপ্রয়োগ করে কিছু মানুষকে বলতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং অরাজী হলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে পীড়ন করা হচ্ছে, তাতে রামের মহিমা নিশ্চিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। এই প্রাসঙ্গিকতায় আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে, যেখানে রাম ও রামায়ণ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন।
প্রাচীন আর্যসভ্যতার এক ধারা য়ুরোপে এবং এক ধারা ভারতে প্রবাহিত হইয়াছে। য়ুরোপের ধারা দুই মহাকাব্যে এবং ভারতের ধারা দুই মহাকাব্যে আপনার কথা ও সংগীতকে রক্ষা করিয়াছে। ... রামায়ণে ভারতবর্ষ কী বলিতেছে, রামায়ণে ভারতবর্ষ কোন্‌ আদর্শকে মহৎ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, ইহাই বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের সবিনয়ে বিচার করিবার বিষয়। বীররসপ্রধান কাব্যকেই এপিক বলে এইরূপ সাধারণের ধারণা, তাহার কারণ যে দেশে যে কালে বীররসের গৌরব প্রাধান্য পাইয়াছে সে দেশে সে কালে স্বভাবতই এপিক বীররসপ্রধান হইয়া পড়িয়াছে। রামায়ণেও যুদ্ধব্যাপার যথেষ্ট আছে, রামের বাহুবলও সামান্য নহে, কিন্তু তথাপি রামায়ণে যে রস সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহা বীররস নহে। তাহাতে বাহুবলের গৌরব ঘোষিত হয় নাই, যুদ্ধঘটনাই তাহার মুখ্য বর্ণনার বিষয় নহে।

দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেনপণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত, সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত।
আদিকাণ্ডের প্রথম সর্গে বাল্মীকি তাঁহার কাব্যের উপযুক্ত নায়ক সন্ধান করিয়া যখন বহু গুণের উল্লেখ করিয়া নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন
সেমগ্রারূপিণী লক্ষ্মীঃ কমেকং সংশ্রিতা নরম্‌।
কোন্‌ একটি মাত্র নর'কে আশ্রয় করিয়া সমগ্রা লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করিয়াছেন? তখন নারদ কহিলেন
দেবেষবপি ন পশ্যামি কশ্চিদেভির্ং‌গুণৈর্স‌যুতম্।
শ্রূয়তাং তু গুণৈরেভির্‌যোযুক্তো নরচন্দ্রমাঃ।

এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না, তবে যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এইসকল গুণ আছে তাঁহার কথা শুন। রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা, দেবতার কথা নহে। রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন। মানুষেরই চরম আদর্শ-স্থাপনার জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন। এবং সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই আদর্শচরিত-বর্ণনা ভারতের পাঠকমণ্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছে। রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামীস্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি-ভক্তির সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশজয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচণ্ড আঘাত-সংঘাত, এই-সমস্ত ব্যাপারই সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনার সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই; সে যুদ্ধঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষমাত্র। পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতিপত্মীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে। এইরূপ ব্যক্তিবিশেষের প্রধানত ঘরের সম্পর্কগুলি কোনো দেশের মহাকাব্যে এমনভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য হয় নাই। ইহাতে কেবল কবির পরিচয় হয় না, ভারতবর্ষের পরিচয় হয়। গৃহ ও গৃহধর্ম যে ভারতবর্ষের পক্ষে কতখানি, ইহা হইতে তাহা বোঝা যাইবে। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল, এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাশ্রম আমাদের নিজের সুখের জন্য, সুবিধার জন্য ছিল না; গৃহাশ্রম সমস্ত সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয় আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য। এই গৃহাশ্রম-ধর্মকেই রামায়ণ বিসদৃশ অবস্থার মধ্যে ফেলিয়া বনবাসদুঃখের মধ্যে বিশেষ গৌরব দান করিয়াছে। কৈকেয়ী মনথরার কুচক্রান্তের কঠিন আঘাতে অযোধ্যার রাজগৃহকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দিয়া তৎসত্ত্বেও এই গৃহধর্মের দুর্ভেদ্য দৃঢ়তা রামায়ণ ঘোষণা করিয়াছে। বাহুবল নহে, জিগীষা নহে, রাষ্ট্রগৌরব নহে, শান্তরসাস্পদ গৃহধর্মকেই রামায়ণ করুণার অশ্রুজলে অভিষিক্ত করিয়া তাহাকে সুমহৎ বীর্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে”(রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত)

ইতিমধ্যে বর্ষাকাল প্রাকৃতিক নিয়মেই এসে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির প্রাবল্য এখনও পর্যন্ত সেভাবে দেখা যায়নি। আমরা কামনা করি ঘনঘোর বর্ষা আসুক। প্রকৃতি সজল ও সবুজ হয়ে উঠুক। জলকষ্ট এখন পৃথিবীর একটা অন্যতম কঠিন সমস্যা। পৃথিবীবাসী এই সমস্যা থেকে মুক্ত হোক।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




स्वच्छता के बारे में बात करने से पहले पहले इसे समझ लें



                                                                                                একটি গোলাকার চশমা সারা ভারতকে দেখছে। চশমাটা গান্ধীর। এটাই ভারতের নয়া আমোদিত স্বচ্ছতার আদর্শের ইমেজ বা প্রতীকস্বচ্ছতার অর্থ এখানে খুব সীমিত, পরিচ্ছন্নতা। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর খান কয়েক চশমা ছিল। তাদের মধ্যে একটি ছিল ১৮৯০-এর দশকে আইন পড়ার সময় লন্ডনে কেনা, দামি। সেটি গান্ধী ব্যবহার করতেন না। যেগুলি করতেন, সেগুলি ছিল গোলাকার স্টিলের ফ্রেমের, শস্তা বলেই বাছা। দামি চশমাটার কী হল? ২০০৯ সালে মানহাটানে নিলামে মহামতি বিজয় মাল্য কিনলেন ৪,১৮৮,৩৬৩ টাকায়। এক মহাত্মার চশমা আরেক মহামতির আয়ত্তে। এই গল্পটাও ভারতের নয়া স্বচ্ছতার পক্ষে প্রতীকী (https://www.indiatoday.in/education-today/gk-current-affairs/story/items-owned-by-mahatma-gandhi-260643-2015-09-01, অদ্য ২৯শে জুন, ২০১৯ প্রবিষ্ট/উদ্ধৃত।)

এই নয়া স্বচ্ছতার স্থূল লক্ষ্যটা কী? এককথায় ভারতবাসীর যত্রতত্র খোলা হাওয়ায় হাগামোতা বন্ধ করা। সেই ১৯৬৪ সালে নইপল ভারত ঘুরতে এসে লিখে গিয়েছিলেন, ‘Indians defecate everywhere. They defecate, mostly, besides the railway tracks. But they also defecate on the beaches; they defecate on the hills, theydefecate on river banks; theydefecate on the streets; they never look for cover’ (V. S. Naipaul, An Area of Darkness (London: Andre Deutsch, 1964), p. 70) কী সত্যি ছিল এই কথা এই হালে পর্যন্ত, তা বচ্চনজীর আর বালানজীর স্বচ্ছভারতের বিজ্ঞাপনেই মালুম। কিন্তু ওই মানুষটি পরিচ্ছন্নতাকে কীভাবে বুঝেছিলেন সেটা একটু বড়ো  করে জানা দরকার নয়? একমত হোন আর নাই হোন! তারই একটু অবতারণা


শারীরিক পরিচ্ছন্নতা

Key to Health নামক বইতে (trans. Sushila Nayar,Ahmedabad: Navajivan Publishing House, 1948) গান্ধী নিজের শরীর সম্বন্ধে বলছেন মানুষযন্ত্রের ভিতরের কার্যধারা বিস্ময়কর। মানবশরীর ক্ষুদ্রাকারে বিশ্বজগৎ। মানবশরীরে যা নেই বিশ্বজগতেও তা নেই! তাই আমরা যদি নিজের শরীরকে জানতে পারি তবে বিশ্বজগৎকেও জানতে পারবো। এ কারণে পঞ্চভূতের গতিশীল আন্তঃক্রিয়া কীভাবে মানব শরীরকে আর বিশ্বজগৎকে গঠন করে তার আলোচনার আগে গান্ধী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রকৃতির বিশুদ্ধতা আর মানব শরীরের স্বাভাবিক অখণ্ডতার উপরে জোর দেওয়া সত্ত্বেও গান্ধী একদিক থেকে প্রকৃতি সম্পর্কে নিজের বিশ্বজাগতিক বীক্ষণে আর নিজের প্রাকৃতিক চিকিৎসার বা নেচারোপ্যাথির অনুশীলনে ধুলোময়লা ও নোংরাকে জায়গা দিতে পারেননি নৃতত্ত্ববিদ মেরি ডগলাসের ভাষায় বলতে গেলে ‘Uncleanness is matter out  of place’; dirt হলো ‘matter out of place’,এমন জিনিস যাকে  সরাতেই হবে (Mary Douglas, Purity and Danger: An Analysis of Concepts of Pollution and Taboo, New York: Routledge, ARK Edition, 1984, p. 41)এই কারণেই গান্ধী  অবিরত ল্যাট্রিন, কিচেন, ক্লিনিক বা মানব শরীরে সুচারুতা এবং পরিচ্ছন্নতার উপরে জোর দিয়েছেন (Key, পৃঃ ৬-৮)ইয়ারভাদা জেল থেকে আশ্রমের সত্যাগ্রহীদের প্রতি চিঠিতে আশ্রমিকদের সত্যাগ্রহ সম্পর্কে তিনি বলছেন — সোজা হয়ে দাঁড়াও, সোজা হয়ে বসো, তোমাদের প্রত্যেক কাজে সুচারু এবং পরিচ্ছন্ন হও, এবং সেগুলোকে তোমাদের ভিতরের অবস্থার অভিব্যক্তি হতে দাও। তোমাদের খাবার, জল এবং হাওয়া পরিচ্ছন্ন হবে, আর তোমরা কেবল ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় তৃপ্ত হবে না। বরং নিজেদের জন্যে যে ত্রিবিধ পরিচ্ছন্নতা কামনা করো, তাকে তোমাদের অব্যবহিত প্রতিবেশে সঞ্চারিত ও সংক্রামিত করবে

এই ময়লাবিহীন শরীরের জন্যে কামনার প্রেক্ষিত থেকেই গান্ধীর কোষ্ঠকাঠিন্য সম্পর্কে উদ্বেগ আর নিয়মিত এনিমা ব্যবহারকে ব্যাখ্যা করা যায়। অস্যার্থ মানব শরীরকে নিষ্কলুষভাবে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। Key to Health বইতে তিনি খোলাখুলি বলছেন মানবশরীর ধুলোময়লার খনি। সঠিক প্রেক্ষিত থেকে এটা  দেখলে এর মধ্যে কোনো অতিরঞ্জন নেই। শরীর যদি এ ছাড়া আর কিছু না হতো, তবে একে নিয়ে মাথা ঘামানোর কষ্ট করার দরকার ছিল না। কিন্তু যদি এই তথাকথিত ময়লার খনিকে যথার্থ ব্যবহার করা যায়, তবে আমাদের দায়িত্ব হলো তাকে পরিষ্কার করে’ তাজা অবস্থায় রাখতে হবে। রত্ন ও সোনার খনিরও উপরিভাগে ধুলো ময়লা থাকেA Guide to Health বইতে (Part II, Chapter V) গান্ধী তাই আরো সোজাসুজি বলছেন, ‘নিজেকে তরতাজা অবস্থায় রাখতে কাউকে নিয়মিত কোষ্ঠসাফ করতে হবে। ঠিক যেমন শরীরের স্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি আত্মার স্বাস্থ্যের জন্য আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণের দরকার (Joseph S. Alter, Gandhi’s Body: Sex, Diet, and the Politics of Nationalism Philadelphia: University of Pennsylvania Press, 2000)

শারীরিক পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে গান্ধী নিত্যস্নান, পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান, ব্যক্তিগত সুস্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ, দূষণের ছোঁয়াচ এড়ানো ইত্যাদির উপদেশ দিলেও পরিচ্ছন্নতার এই চামড়াগভীর সংজ্ঞার বাইরে গান্ধীর কাছে পরিচ্ছন্নতার অর্থ দঃ এশিয়ায় চালু শুদ্ধতাও দূষণের সাধারণ দ্বৈত রূপকের বাইরে অন্য অর্থে এসেছে। তাঁর কাছে দূষণ মানব প্রজাতির এক সহজাত এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্য শুদ্ধতা সামাজিক প্রতিষ্ঠা বা মর্যাদার লক্ষণ নয়, নিশ্চয়ই সনাতনপন্থী আচারের ফল নয়। আয়ুর্বেদিক অর্থে গুণ বা দোষের ফল নয়। মূর্ত দূষণ ভক্ষণ ও পরিপাক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছাড়াও কোনো কোনো ধরনের গোষ্ঠির খাবারের সহজাত  ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক ধরনের খাবার সহজাতভাবে শুদ্ধ হলেও তার পরিপাক ক্রিয়া শরীরকে নোংরা করে, কেবল একে ভর্তি করে দিয়ে নয়, মুখে স্বাদের সৃষ্টি করা ছাড়াও, পরিপাক ক্রিয়া অন্য সকল ইন্দ্রিয়ানুভুতির এবং ইন্দ্রিয়জ তৃপ্তির বোধ সৃষ্টি করে। শেষতঃ এই সবই মলের পরিশিষ্ট দূষণের জন্ম দেয়, যা নির্গত হওয়ার আগে শরীরের মধ্যে দিয়ে পথ করে নেয়

এই দিক থেকে গান্ধী শরীরের পুষ্টির প্রয়োজন সম্বন্ধে খুবই দোদুল্যমান (ambivalent) মনোভাব পোষণ করতেন, আর কখনও কখনও প্রজননের মতো ভোগের সম্পর্কেও সমস্যাকীর্ণ ছিলেন। তিনি যৌনতা ত্যাগ করতে এবং তার থেকে আত্মসংযমের মূল্য নিষ্কাশিত করতে পারতেনকিন্তু শরীরের পুষ্টির জন্য খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে পুষ্টির নিয়তিকে এড়াতেই তাঁকে নিয়মিত উপবাসের প্রয়োজন হতো। এ যেন Orphic Priest-এর মুখে গ্রিক নাট্যকার Euripides-এর বসানো স্বীকারোক্তি: ‘Robed  in pure white I have/ borne me clean/ From man’s vile birth and/ coffined clay./And exiled from my lip away/ Touch of all meat where Life/ hath been’



আভ্যন্তরিক এবং বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার সম্পর্ক

গান্ধী আভ্যন্তরিক এবং বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতাকে অব্যবহিত ও নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কযুক্ত বলে ভাবতেন। ২২শে জানুয়ারি ১৯৪৫-এ তিনি বলেছিলেন যিনি ভিতরে সত্যিকার পরিচ্ছন্ন, তিনি বাইরে অপরিচ্ছন্ন থাকতেই পারেন না (Bapu-Ka-Ashirvad: January 22, 1945)১৯৪৬-এর ২৪শে মার্চ তিনি বলেন, মনের অপরিচ্ছন্নতা শরীরের অপরিচ্ছন্নতা থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক, (Bapu-Ka-Ashirvad: March 24, 1946,Anil Dutt Misra, Inspiring Thoughts Of Mahatma Gandhi, New Delhi, India: Concept Publishing Company, 2008, p. 19)১৯৪৬-এর ১৬ই জুন হরিজন পত্রিকায় তিনি লিখলেন, কেবল নিজের শরীরগত নয়, নিজের চারধারের প্রতিবেশের সব কিছু সম্পর্কে একটি আনুপুঙ্খিকভাবে সমগ্র পরিচ্ছন্নতার বোধ সামষ্টিক জীবনের আলফা থেকে ওমেগা। এই প্রেক্ষিত থেকেই ইয়ারভাদা জেল থেকে আশ্রমের সত্যাগ্রহীদের প্রতি চিঠিতে আশ্রমিকদের সত্যাগ্রহ সম্পর্কে তিনি বলছেন সোজা হয়ে দাঁড়াও, সোজা হয়ে বসো, তোমাদের প্রত্যেক কাজে সুচারু এবং পরিচ্ছন্ন হও, এবং সেগুলোকে তোমাদের ভিতরের অবস্থার অভিব্যক্তি হতে দাও। তোমাদের খাবার, জল, এবং হাওয়া পরিচ্ছন্ন হবে, আর তোমরা কেবল ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় তৃপ্ত হবে না। বরং নিজেদের জন্যে যে ত্রিবিধ পরিচ্ছন্নতা কামনা করো, তাকে তোমাদের অব্যবহিত প্রতিবেশে সঞ্চারিত ও সংক্রামিত করবে


আভ্যন্তরিক এবং শারীরিক পরিচ্ছন্নতার সাদৃশ্য আর পার্থক্য

গান্ধীর কাছে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা আভ্যন্তরিক পরিচ্ছন্নতার ভৌত দিক। The Health Guide বইতে গান্ধী তাই আরো সোজাসুজি বলছেন, ‘নিজেকে তরতাজা অবস্থায় রাখতে কাউকে নিয়মিত কোষ্ঠসাফ করতে হবে। ঠিক যেমন শরীরের স্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক  শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি আত্মার স্বাস্থ্যের জন্য আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণের দরকার


পরিচ্ছন্নতা ও স্বরাজের সম্পর্কায়ন

১৮৯৬ সালে দেশে ফেরেন গান্ধী, চিন থেকে আসা সমুদ্রবাহিত বিপুল বিউবোনিক প্লেগের আতঙ্কের মধ্যে। ফিরেই গান্ধী প্রথমেই রাজকোট স্যানিটেশন কমিটিতে মনোনীত ও নিযুক্ত হন। এরপর থেকেই নির্মলীকরণ তাঁর প্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০১-এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঠিক সময়ে বম্বেতে ফেরেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের দুর্দশার খবর জানাতে কলকাতায় কংগ্রেসের সপ্তম অধিবেশনে যোগ দিতে। পার্সি কোট আর ট্রাউজার পরা গান্ধী ফিরোজশাহ মেহতা, আর সভাপতি মনোনীত ডি.. ওয়াচার সঙ্গে একই ট্রেনে এসে গান্ধী মেহতার থেকে শোনেন যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধিকার সম্পর্কে প্রস্তাব অবশ্যই পেশ করবেন। কিন্তু এর বাইরে কিছুই হয়তো করতে পারবেন না, কারণ ভারতীয়দের নিজেদের দেশেই কোন অধিকার নেই। কলকাতায় গান্ধী তিলক এবং অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে রিপন কলেজে ওঠেন। সেখানে কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষকে নিজের সেবার প্রস্তাব দিয়ে গান্ধী কিছু করণিকের কাজ পান। কিন্তু নিজে থেকে নেন টয়লেটহীন রিপন কলেজের প্রাঙ্গনের কোণে প্রতিনিধিদের ত্যক্ত মলমূত্র সাফ করার দায়িত্ব। এই কাজে কংগ্রেসের অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান করেও গান্ধী কোনো সাড়া পান নি। দঃ আফ্রিকার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ গান্ধী হয়তো এখান থেকেই বোঝেন যে ভারতের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও স্বরাজের কেবল গভীর আন্তঃসম্পর্ক আছে তা নয়, এটাই স্বরাজের প্রথম কাজ। ভারতের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যদি পরিচ্ছন্নতার, আবর্জনা পরিষ্কারের, ময়লা নিষ্কাশনের ও নির্মলীকরণের গুরুত্ব না বোঝে তবে স্বাধীনত্তোর  সবল রাষ্ট্র কীভাবে সম্ভব হবে? ফলে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্যানিটেশন-এর  উপরে গান্ধী তাঁর রাজনীতির প্রথম থেকেই জোর দেন।

১৯১৬-র ফেব্রুয়ারিতে, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে ইংরাজ রাজপুরুষ, দেশীয় রাজামহারাজা, উদ্যোক্তা আনি বেসান্ত ইত্যাদির সামনে গান্ধী তাঁর জীবনের যে প্রথম পাবলিক স্পিচ দেন, সেখানে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দেন, সেখানে ইংরেজদের গায়ে জ্বালা ধরানো অজস্র কথার মধ্যে তিনি ভারতীয়দের আত্মসমালোচনামূলক যেকটি কথা বলেন তাদের মধ্যে একটি ছিল কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের চারধারের সরু নোংরা গলিগুলির আর ইতস্ততঃ যেমন তেমন ভাবে তৈরি বাড়িগুলির কথা। তিনি বক্তৃতায় বলেন, ‘এমনকি যদি আমাদের পবিত্র মন্দিরগুলিও প্রশস্ততা ও পরিচ্ছন্নতার আদর্শ না হয় তবে আমাদের স্বশাসন কেমন হবে? যে মুহূর্তে ইংরেজরা নিজের মর্জিতে অথবা বাধ্য হয়ে ভারত ছেড়ে যাবে, সে মুহূর্তে আমাদের মন্দিরগুলি কি পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা আর শান্তির আবাস হয়ে উঠতে পারবে?’

এই কারণেই ১৯১৫ সালের মে এবং ১৯১৭-র ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রায় ৫৫টি গন্তব্য আর ১০,০০০কিমি ভ্রমণের পর গান্ধী তৃতীয় শ্রেণির কামরা কীভাবে আম  ভারতীয়রা, এমনকি নরফোক জ্যাকেট পরা শিক্ষিত, ইংরিজি-বলিয়ে ছাত্ররাও থুতু ফেলে, মলত্যাগের পর ল্যাট্রিন সাফ না করে নোংরা করে, আর আমরা যে পরিচ্ছন্নতার প্রাথমিক নিয়মগুলোও জানি না, তা নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ১৯১৬-র জুলাই রেলোয়ে প্যাসেঞ্জার নামের একটি নোটে, লীডার নামের সংবাদপত্রে ভারতীয় রেলপথে তৃতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণ নামের একটি লেখাতে, তিনি এই ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কথাও বলেন।

প্রায় প্রত্যেক প্রধান কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধী স্যানিটেশনের প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে আনেন। ১৯২৪-এ তিনি দোহাদ, এখন দাহোদ, শহরের সুন্দর পরিচ্ছন্নতার জন্য কংগ্রেস কর্মীদের ধন্যবাদ দেন, আর এই পরিচ্ছন্নতাকে অস্পৃশ্যদের অধ্যুষিত এলাকায় প্রসারিত করতে বলেন। ১৯২৫ সালের কানপুর কংগ্রেসের স্যানিটারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে তাঁর প্রশংসা ১৯২৬-এর ৩রা জানুয়ারির নবজীবন পত্রিকায় উল্লেখ করেন। ১৯২৫-এর ২৫শে অগাস্ট YMCA-তে ‘Value and Possibility of Personality’ নামের যুবকদের চরিত্রগঠন সম্পর্কে একটি বক্তৃতায় যুবকদের তিনি বলেন যে গ্রামে গেলে গ্রামীণদের পেট্রন সেন্ট হিসেবে নয়, ঝাড়ুদার হিসেবে হাতে ঝাঁটা নিয়ে যেতে হবে। গ্রামে অপরিচ্ছন্নতা, দারিদ্র্য এবং আলস্যের ত্রিত্বের মোকাবিলা করতে হবে ঝাঁটা, কুইনিন, ক্যাস্টর অয়েল, আর তারা তাঁকে বিশ্বাস করলে, চরকা সম্বল করে। আমেদাবাদ, বেলগাঁও, টুঙ্কুর, দাভনগেরে, মায়াভরম, ত্রিচিনাপল্লি, শ্রীরঙ্গম এবং অন্য বহু অঞ্চলে সম্বর্ধিত হওয়ার পরে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি পরিচ্ছন্নতা ও নির্মলীকরণ কংগ্রেস কাউন্সিলরদের প্রধান কাজ এবং দক্ষতা হিসেবে ধরেন। ১৯২৪-এ আমেদাবাদ পুরসভার বক্তৃতায় তিনি দেখান দঃ আফ্রিকায় তিনি কীভাবে পরিচ্ছন্নতা বিধানকে নিজের প্রধান নাগরিক  সেবা হিসেবে নিয়েছিলেন। পশ্চিমি সভ্যতার প্রবল শত্রু হয়েও ১৯২৪-এর ২১শে ডিসেম্বর বেলগাঁও পুরসভায় তিনি বলেন যে পৌর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে পশ্চিম আমাদের শিক্ষা দিতে পারে। একই গুরুত্ব দিয়ে ১৯২৭-এ দঃ ভারতে মায়াভরমে বক্তৃতায় এক পচা, দুর্গন্ধময় পুকুরের জল এক মহিলা মাথায় করে পেয় জল হিসেবে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার উল্লেখ করে বিশুদ্ধ জলের অব্যাহত যোগানকে তিনি পৌর জীবনের প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন।




অজস্র দৈনিকে (নবজীবন, ইয়ং ইন্ডিয়া, এবং পরে হরিজন) গান্ধী পরিচ্ছন্নতা নিয়ে লিখেছিলেন। খেদা সত্যাগ্রহের সময় নবজীবন–এ ১৯১৯-এর ২রা নভেম্বরে, পরে জগৎ নো তাত নামের একটি সিরিজে, তিনি ওই নইপল কথিত ওপেন ইভ্যাকুয়েশনের সমস্যার উল্লেখ করেছেন। নবজীবনএর ১৯ নভেম্বর, ১৯২৫ সংখ্যায় তিনি বলছেন ভারতের সর্বত্র ঘুরে অপরিচ্ছন্নতার প্রাবল্য থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগে তাঁর আস্থা না থাকলেও তিনি নিজেকে প্রায় মানিয়ে নিয়েছেন ‘to compulsion in this most important matter of insanitation’দঃ আফ্রিকা থেকে গান্ধীর সুহৃৎসি এফ এণ্ড্রুজ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে চরখার উপর বেশি ঝোঁক দিতে গিয়ে গান্ধী গ্রামের স্যানিটেশন-এর ইস্যুটিকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছেন। এর উত্তরে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার ২৭ অগাস্ট, ১৯২৫ সংখ্যায় গান্ধী যা লেখেন তাতে তাঁর নৈরাজ্যবাদী ভাবনা সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রের এবং আইনের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন। নিজে চরখা আবিষ্কারের অনেক আগেই যে স্যানিটারি সংস্কারক ছিলেন আর নাটালে ফিনিক্স ফার্মে নিজেরাই, মেথর ছাড়া রাত্রের মাটি তুলে তাকে জৈবসারে পরিণত করার যে পরীক্ষণ তাঁরা চালাচ্ছিলে, সেটাই যে সাবরমতী আশ্রমে এখনও চলছে একথা জানিয়ে গান্ধী বলেন যুগব্যাপী পুরনো ভাবনা এবং অভ্যাসের বিরুদ্ধে এই লড়াই যে স্থায়ী শিক্ষণের দাবি করে তা রাষ্ট্রের সাহায্য আর আইনের জোর ছাড়া সম্ভব নয়! সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে ১৯৩৫-এর জানুয়ারির এক সন্ধ্যায় ডজন খানেক ছাত্রের সঙ্গে কথাবার্তার সময় তিনি বলেন গ্রামে ওষুধ বিতরণের চেয়ে অনেক বেশি দরকার নির্মলীকরণের আর রোগের পরে আফটার কেয়ারের বন্দোবস্ত। আর গ্রামের লোককে থ্রি আর্স-এর শিক্ষাদান দরকার। কিন্তু তাকে ফেটিশ না করে তুলে হাইজিন আর স্যানিটেশন-কে শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ করে তুলতে হবে। ১৯৩৬-এর মার্চে গান্ধী সেবা সঙ্ঘের পঞ্চম সম্মেলনে ভলান্টিয়ারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তিনি বলেন সেবককে সবার আগে স্যানিটারি কর্মী হতে হবে। তাঁরা আর গ্রামের লোকরা যতদিন একে অন্যকে না বোঝেন ততদিন তাঁদের জন্যে ‘স্ক্যাভেঞ্জ’ করে যেতে হবে। (Sudarshan Iyenger, In the Footsteps of Mahatma: Gandhi and Sanitation, New Delhi:Publications Division Ministry of Information & Broadcasting, 2017, Chapter4)

সত্যাগ্রহ যদি স্বরাজের অপরিহার্য পদ্ধতি হয়, তবে স্যানিটেশন সত্যাগ্রহের এক আবশ্যিক অঙ্গ। গান্ধীর ঘনিষ্ঠতম অনুসারীদেরও এ ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। Joseph Lelyveld তাঁর Great Soul: Mahatma Gandhi and His Struggle with India (New York: Knopf Doubleday Publishing Group, 2011) নামের Pulitzer জয়ী বইয়ে উল্লেখ করেছেন অনুসারীদের একজন প্রশ্ন করেন এতে লাভ কী? এতে গ্রামের উপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। বরং তারা নিজেরা চারদিক নোংরা করে’ আমাদের বিভিন্ন জায়গা সাফ করার আদেশ দিচ্ছে। তাতে গান্ধী বলেন, তার মানে তোমরা ইতিমধ্যেই ক্লান্ত? আমি যদি হতাম তাহলে কেউ মলত্যাগ করার পর সেখানে তক্ষুনি গিয়ে সেই মল দেখতাম। তাতে পচা কিছু থাকলে তাকে বলতাম তোমার পেট ঠিক নেই। কোনো ওষুধ খাও। এইভাবে তাকে জিতে নিয়ে সেই মলের উপর একটা ফুলগাছ বসাতাম। পরিচ্ছন্নতা শিল্পও হতে পারে। তবুও নিজের কল্পনা বিলাসিতার তুঙ্গবিন্দুতেও কখনও কখনও তিনি বিষণ্ণ ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, যেন এই মহান ব্যর্থতার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নিজেকে শক্ত করতে। বলেছেন, গ্রামবাসীরা আমাদের গালাগাল দিলে এসো আমরা সহ্য করি। ওরা যেখানে খুশি নিজেদের পেট খোলসা করুক। কোনো জায়গা বেছে দেবো না। কোনো জায়গা এড়াতেও বলবো না। কেবল ওরা বাহ্যে করার পর নীরবে সাফ করে দেব। এতেও যদি কাজ না হয় তবে অহিংস সত্যাগ্রহ বলে কিছু নেই! এর পদ্ধতি কী হবে একজন জানতে চাইলে গান্ধী বলেন নীরব খাটুনি। কিন্তু গান্ধী জানতেন যে এর জন্যে যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার তা তিনি করতে পারেন নি। আক্ষেপ করছেন, ভারতের সাত লক্ষ গ্রামের প্রত্যেকটির জন্য আমাদের অন্ততঃ একজন স্বেচ্ছাসেবক চাই। কিন্তু আমাদের সদস্য সংখ্যা এখনও মাত্র ৫১৭! 

অমরাবতীপুর নামে এক স্থানে গান্ধী এক বক্তৃতা দেন যেটি হিন্দু কাগজে ২৯শে আগস্ট ১৯২৭-এ প্রকাশিত হয়। সেখানে গান্ধী স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক সংস্কার আর রাজনৈতিক ক্রিয়ার আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কিছু অন্তর্দর্শী সিদ্ধান্ত টানেন। তিনি বলেন আমাদের শহরগুলিকে অমরাবতী করে’ তুলতে গেলে আমাদের সবাইকে ভিতরে ও বাইরে উভয়তঃই পরিচ্ছন্ন হতে হবে। যদি আমরা নিজেদের মধ্যে সৎভাবে ভাবি, তবে আমাদের প্রত্যেকেই দেখতে পাব যে স্বরাজের মতোই পরিচ্ছন্নতাও আমাদের জন্মগত অধিকার। স্বরাজের পথ গেছে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সংযমের পথ ধরে, আর আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা (সম্পূর্ণ Collected Works, Volume 35, pp. 24-5)




গ্রামে ও শহরে সার্বজনিক নির্মলীকরণ সম্পর্কে গান্ধীর চিন্তাপ্রকল্পের স্তম্ভগুলি

১৮৯৬ সালে দেশে ফেরেন গান্ধী, চিন থেকে আসা সমুদ্রবাহিত বিপুল বিউবোনিক প্লেগের আতঙ্কের মধ্যে। ফিরেই গান্ধী প্রথমেই রাজকোট স্যানিটেশন কমিটিতে মনোনীত ও নিযুক্ত হন। এরপর থেকেই নির্মলীকরণ তাঁর প্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। গান্ধীর নির্মলীকরণ প্রকল্পে গ্রামের স্থান সবার উপরে। এর জন্য তিনি যে প্রকল্প করেছেন তার মধ্যে আছে, গ্রামের পানীয় জলের পুকুরকে অন্য মানুষ পশুর স্নানাদি কার্যে ব্যবহার না করা থেকে (হরিজন, ১৯৩৫), গ্রামের ভাঙ্গিকে আদর্শ ভাঙ্গিতে উন্নীত করা ও তার প্রাপ্য সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া, বসতিস্থলে ওভারক্রাউডিং দূর করা, পঞ্চায়তকে এই ব্যাপারে কাজে লাগানোসার্বজনিক নির্মলীকরণ ব্যাপারে গান্ধী ভারতে যে বিধান দেন তার উপরে দঃ আফ্রিকায় তাঁর অভিজ্ঞতার প্রভাব ছিল

গান্ধী নাকি চরখা নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নিজের কার্যক্রমকে পিছনে ফেলে দিচ্ছেন, এন্ড্রুজের এই ইঙ্গিতের উত্তরে গান্ধী ইয়ং ইন্ডিয়া  পত্রিকার ২৭ অগাস্ট, ১৯২৫ সংখ্যায় গান্ধী লেখেন চরখা আবিষ্কারের অনেক আগেই স্যানিটারি সংস্কারক ছিলেন আর নাটালে ফিনিক্স ফার্মে নিজেরাই, মেথর ছাড়া রাত্রের মাটি তুলে তাকে জৈবসারে পরিণত করার পরীক্ষণ তাঁরা চালাচ্ছিলেন।সেটাই সাবরমতী আশ্রমে এখনও চলছেMy Experiments with Truth বইয়ের‘Sanitary Reform and Famine Relief’ অধ্যায়ে গান্ধী দেখিয়েছেন কীভাবে নাটালে থাকার পর থেকেই তিনি  ভারতীয়দের সম্পর্কে অপরিচ্ছন্নতা, নিজেদের চারপাশ নোংরা রাখার অভ্যাস ইত্যাদির অভিযোগ, যেটা হয়তো পুরোটা মিথ্যেও নয়, তাকে দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কথাতেই নাটালে নির্মলীকরণের উদ্যোগে ভারতীয় অধিবাসীদের তরফে কখনও ভদ্র অবজ্ঞা ও উদাসীনতার বা কখনও গালাগাল ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ট্রান্সভালের মিডলবার্গে এক ভারতীয় বিউবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে’ মারা গেছে, এই গুজবের পর দঃ আফ্রিকান সরকার সেটা ভালো করে খতিয়ে না দেখেই ভারতীয়দের উপর যে কঠোর কুয়ারান্টাইন চাপিয়ে দেয়, এবং সমগ্র দঃ আফ্রিকায় সতর্কতা ঘোষণা করে, যার ফলে মরিশাস, মাদাগাস্কার অথবা ভারত থেকে আসা ভারতীয়দের দঃ আফ্রিকা প্রবেশ আটকে দেওয়া হয়, গান্ধী তার ব্যাপারে বহু কারণে টাইম্‌স অভ ইন্ডিয়া কাগজে এক লেখায় আপত্তি করেন। এই কুয়ারান্টাইন‘stringent’, ‘unreasonable’, ‘oppressive’, ‘unbusinesslike’ হওয়া ছাড়াও গান্ধীর মতে  চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকের উচ্চ চাহিদার এই দেশে ‘indentured labour’ ছাড়া অন্য ভারতীয়দের গতিবিধির উপরে এই সঙ্গরোধ স্ববিরোধী। ফলে গান্ধীর ব্রত হয়েছিল ভারতীয়দের এই অপরিচ্ছন্নতার দুর্নাম ঘোচানো। ‘A Lesson from the Plague’ নামের প্রবন্ধে গান্ধী লিখছেন, যে এই নিষেধাজ্ঞা যতই কঠোর হোক, সেটা আমাদের ক্রুদ্ধ করা ঠিক নয়। বরং আমাদের উচিত নিজেদের আচরণ এমনভাবে সংশোধিত করা যাতে এই অন্যায় শাস্তির দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি না হয়। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের আক্ষরিক এবং আলংকারিক দুই অর্থেই নিজেদের ঘর আগে গুছোনো উচিৎ। আপাততঃ আমাদের ওভারক্রাউডিং দূর  করতে হবে, নিজেদের প্রতিবেশে রোদ-হাওয়া অবাধে ঢুকতে দিতে হবে। ইংরেজরা যেমন বলে, পরিচ্ছন্নতা ঐশ্বরিকতার পরেই, সেটাকে জীবনে সত্য করে তুলতে হবে। সেটা সহজে হবে না। সুনাম একবার গেলে তার পুনররর্জন সহজ নয়। কিন্তু তাকে নিয়ে ভেবে কী লাভ? পরিচ্ছন্নতা নিজেই কি নিজের পুরস্কার নয়? এই চিন্তা থেকেই গান্ধী পরিচ্ছন্নতাকে ভারতেও স্বরাজের প্রথম সোপান ভেবেছিলেন। (Shrirupa Prasad, ‘Introduction’, in Prasad, Cultural Politics of Hygiene India, 1890-1940: Contagions of Feeling (New York: Palgrave Macmillan, 2015)

ব্যাপারটা কেবল ঠিক আড়ালে আবডালে হাগামোতার নয়, তাই না?





শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি – ১




মাতৃগর্ভেই মানুষের প্রথম সমুদ্রদর্শন  নোনাজলের স্বাদগন্ধ অনেকটা রক্তের মতো অনঙ্গ অন্ধকারে হাত মেলে, পা ছড়িয়ে,  অন্ধকারের মতো শীতল চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মায়ারুধির শ্যাওলা মেখে পৃথিবীতে নেমে আসা  ক্রমশঃ  ট্রেনের বাঁশির স্বরে বেড়া ভাঙার আর্তকান্না, আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে...


(১)


."কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র ! তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস  অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র  সরে যাবে
শীতল সরে যাবে
মৃত্যু সরে যাবে 

তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে ...."

সমস্তিপুর থেকে যে রাস্তাটা মুশরিঘরারি হয়ে বরৌনির দিকে গেছে সেই পথেই মাঝামাঝি পড়ে দলসিংসরাই। আমি তখন দিন সাতেক ধরে দলসিংসরাই ব্রাঞ্চঅডিট করছি।ছোট্টো জায়গা।  দিগরে তামাক আর তিসি চাষের নাম সবাই নেয়। ক্যাশ ক্রপের দৌলতে এখানকার চাষীরা বেশ পয়সাওয়ালা।ব্রাঞ্চটাও  বসতিরতুলনায় বেশ বড়োই বলতে হবে। কারেন্সি চেস্ট আছে। সকালবেলা ব্রাঞ্চে এসে ইকনমিক টাইম্সটায় চোখ বুলাচ্ছি, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অনুভব শ্রীবাস্তব পাশেবসলো।
হাঁ  বতাও, কুছ মিলা ক্যা? বহুত খুশ নজর  রহে হো ...
সর, ইয়ে লোগ চেস্ট রিপোর্টিং মে বহুত দের কিয়া, কই বার... আর বি আই বড়কা জুর্মানাঠোকেগা...
হিসাব উসাব কুছ জোড়া?
হাঁ সর, কম সে কম সাড়ে তিন লাখ কা চুনা লগেগা ব্যাংক'কা।
য়ঁহা লাস্ট ইয়ার প্রফিট কিতনা রহা?
বত্তিস লাখ সর..
আরে করিবন  টেন পর্সেন্ট কা কল্যাণ হো জায়্গা লগতা হ্যায়... ঠিক হ্যাঁয় হিসাব য়ঁহি   ছোড়কে যাও, জরা চেক করতে হ্যাঁয়...

ক্যালকুলেটরটা নিয়ে ডুবে যাই হিসেবের জঙ্গলে।
মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যি এসব কার হিসেব, কার নিকেশ। তখনই  খাঁচার ভিতর অচিন পাখির মতো ডানা ঝাপটানো শুরু হয়ে যায়। আই নিড সাম চেঞ্জ।
"...কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়
অমৃতই বিষ !
মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ "





(২)


"বুকের মধ্যে চাষ করেছি একপো প্রেমের ধান
তার আবার খাজনা কতো
কার যে সর্বনাশ করেছি স্বতঃই সন্দিহান
সে ভুলের বাজনা কতো..."

ফোনটা যখন এলো, তখন আমি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বাবু গোপাল প্রসাদ সিংয়ের একটু ক্লাস নিচ্ছিলাম।
এই লোকটি বোধ হয় পাঁজি দেখে দাড়ি কামায়। কে জানে মাসে কবার? সব সময়ই তো দেখি  কাঁচা পাকা সজারুর কাঁটা সারা মুখে। গত সাত দিন ধরে একটাইকামিজ পরে আছে দেখছি, যেটা কোনওকালে হলদেটে রং   ছিলো বোধ হয়। পাতলুনটার ওরিজিনাল রং সে নিজেও বলতে পারবে না। পায়ে চটি। কিন্তু একেবারে বাস্তুঘুঘু। মুজঃফরপুরে  দোতলা বাড়ি ঠুকেছে। দুটো ছেলেই বিদেশে আছে, ভালো চাকরিবাকরি করছে বললো। একেকটার বিয়েতে লাখ চল্লিশ পঞ্চাশ তো নিশ্চিতউসুল করবে।
অডিটরসায়েবের সামনে সর্বদা ঝুঁকে দুহাত কচলে যাচ্ছে। আমি জানি,   যখন নিজের গাঁয়ে খাটিয়া টেনে পঞ্চায়ত করতে বসে, তখন  একেবারে তইমুর লং।
তো সিংসাব, ব্রঞ্চকা তো পুরা বাজা বজা দিয়ে...
সর, থোড়া গড়বড় হো গয়া...
থোড়া!!! সাড়ে তিন লাখকা চুনা লগায়ে মহারাজ... মুঝে তো অলগ রিপোর্টিং করনা   পড়েগা,
সর, থোড়া মেহরবানি করেঁ হুজুর... বিটিয়া কি শাদি করনা হ্যাঁয়...

এইসব দেখলে এখন আর রাগ হয়না, আগে হতো...
তখনই ফোনটা বাজলো।

গোপালবাবু ফোন ধরে আমাকে দিলো,
সর, আপকা...
ওদিক থেকে বিরেন্দর পান্ডের গলা। বিরেন্দর পাটনা হেড অফিসে অডিট অ্যালোকেট করে। আমার পুরোনো চ্যালা।
গুড মর্নিং বস,
হাঁ জি বিরেন্দর, মর্নিং ... বতাও,  সুবহ সুবহ কিস চিজ কা ইত্তিলা...
বস, ইয়ে ব্রঞ্চ তো অউর তিন রোজ মেঁ হো জানা চাহিয়ে,
হো জায়গা...
তো হোলি মেঁ কঁহা রহনা পসন্দ করেঙ্গে?
কঁহি ভি দে দো...
অপনা ঘর তরফ যাইয়েগা?
কঁহা ?
কিরিবুরু...?
মাথার ভিতর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজটা বেশ শুনতে পেলুম। হোলির সময় কিরিবুরু...
বসন্তের মাতাল সমীরণ যে কতোটা মাতাল,  সেটা বোঝাতে হোলির জ্যোৎস্নায়  মেঘাতুবুরুর শালবনে ঝরা পাতার গালচে  পাতা আছে।
-ঠিক বা, তোহার জইসন মর্জি...

সর, আপ টিকট লে লিজিয়ে। ম্যঁয় টেলিগ্রাম ভেজ দেতা  হুঁ।

-------------------

কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের  সাতশো নীল  পাহাড় চূড়াআর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের   খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে।  প্রায়আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ,  রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয়  অন্য লাল  সব রক্তই কি একই রকম লাল ? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া ? তবে   কেন বার বার ইঞ্চকেপ রকের ঘন্টা বলে যায়, আমায় তুই আনলি কেন...?

"সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে..."





(৩)


"যেতে-যেতে এক-একবার পিছন ফিরে তাকাই, আর তখনই চাবুক
তখনই ছেড়ে যাওয়া সব
আগুন লাগলে পোশাক যেভাবে ছাড়ে
তেমনভাবে ছেড়ে যাওয়া সব
হয়তো তুমি  কোনদিন আর ফিরে আসবে না -শুধু যাওয়া..."

প্রথম যখন চাকরিতে ঢুকি, আমার প্রথম পোস্টিং ছিলো চাইবাসায়। তা,  চাইবাসা তখন সিংভূম জেলার হেড কোয়ার্টার, ছোট্টো পুরোনো গ্রামীণ জনপদ  'শহর'বলতে বাধে, যদিও জামশেদপুরের থেকে প্রাচীন লোকবসতি।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে  জামশেদপুরের কিছু লোকজন অস্থায়ী ভাবে ওখানে পরিবারপাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে আমার ঠাকুরদাও ছিলেন। আমার বাবা তিনচার কেলাস চাইবাসা জিলা স্কুলে পড়েছিলেন। তার পর আবার জামশেদপুর ফিরে যানসকলে।  কিছুটা আপনঘরের ছোঁয়া  আমার সেখানেও ছিলো।

সমীর রায়চৌধুরী জেলা মৎস অধিকারী হিসেবে ওখানে পোস্টেড ছিলেন  সেই কালে। তাঁর টানে নিয়মিত সন্দীপন, শক্তি, সন্তোষকুমার ঘোষ, উৎপলকুমার বসু বা আরও 
অনেক কৃত্তিবাস পার্টি যারা হাংরিতে যোগ দেয়নি, নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন   চাইবাসায়। আমাদের নিজেদের লিট্ল কাগজ ছিলো, 'উইঢিবি' নিজেরা লিখতুম আর  কলকাতার এইসব  স্টার কবিদের পেলে জরিমানা হিসেবে কবিতা আদায়  হতো কাগজের জন্য। পারিশ্রমিক শুধু মেরিটোলার মহুয়া সেই সময় আমি সারান্ডা চিনেছিলুম প্রায় গাছ ধরে ধরে। সঙ্গে থাকতো বন্ধু মাধব, ওরফে মধু   চাইবাসার ছেলে। টাটা কলেজে ফিজিক্সের স্টার ছাত্র, গ্রামীণ পরিবারের প্রথম স্কুলের গন্ডি পেরোনো ছেলে। ওর বাবা রবিবাবুর নামও শোনেননি বোধহয়, কিন্তু এই নিয়মভোলা ছেলেটা ছবি আঁকে, গান গায় আর অদ্ভুত পদ্য লেখে।একেবারে নিজের মতো। আমার একটা অভ্যেস আছে কেউ পদ্য লিখলেই খুঁজি একে কোন কবি গ্রাস করতে চাইছে?  কিন্তু মধুর লেখায় কখনও কারও ছায়াদেখিনি। হয়তো খুব পাকা নয়, কিন্তু না ফোটানো মহুয়া ফুলের বাস থাকতো তার পদ্যে 

"তোমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো
সারা জীবন তুমি তার পাতা গুনতে ব্যস্ত থাকবে
সংসারের কাজ তোমার কম- 'অবসর আছে' বলেছিলে একদিন
'অবসর আছে -  তাই আসি..."

একটা ছুটির দিনে শীতের সকালে  গিয়েছিলুম নোয়ামুন্ডি পেরিয়ে মুর্গামহাদেও। আমি আর মধু,  আমার চিরসঙ্গী বাইকে  চড়ে।  এখানেই  আমার সঙ্গে  পর্ণার প্রথমদেখা  আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলো। নোয়ামুন্ডিতে ওর কোনও এক ঘনিষ্টজন থাকতেন  তাদের সঙ্গেই তার যাওয়া, নোয়ামুন্ডিপেরিয়ে মুর্গামহাদেও। কোথা থেকে পেয়ে আমাদের কাগজের একটা সংখ্যায় রবিবাবুকে নিয়ে আমার লেখা   একটা হাল্কা গদ্য পড়ে নিজেই আলাপ করেছিলো।
কাগজটার  সংখ্যাটিতেই  শক্তি একটা পদ্য পাঠিয়েছিলেন, তার শুরুটা এরকম,
' ভালোবাসা ছিলো প্রজাপতিটির নাম,
জানি, দিয়েছিলো বাগান অনেক দাম ...'
শক্তির বাঁহাতের লেখা কয়েকটি লাইন। তবে সেখানেও যেন কিছু থাকে। রেল লাইনের পাশে যত্নহীন বেড়ে ওঠা উজ্জ্বল আকন্দ ফুলের ঝাড় যেন। জীবন গিয়েছেচলে পঁয়ত্রিশ বছরের পার   বাহিরমহল আর ভিতরবাড়ির মধ্যে এখনও কোনো  গন্ডি নেই  আরশিনগরের মেয়ের জন্য  রয়ে গেছে কয়েক টুকরো নীলাভ স্ফটিক  মূহুর্তের ছিন্ন  রেশম জাল  মীর মোমিনের প্রিয় শ্যয়রি এলোমেলো গেয়ে যাওয়া দু'চার পশলা ঘুমভাঙানিয়া, ...
"ওহ নয়েঁ গিলে ওহ  শিকায়তেঁ
ওহ মজে মজে কি হিকায়তে
মুঝে সব হ্যাঁয় ইয়াদ জরা জরা
তুমহে ইয়াদ 




(সৌজন্যস্বীকার : গুরুচন্ডালি)