কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি – ১




মাতৃগর্ভেই মানুষের প্রথম সমুদ্রদর্শন  নোনাজলের স্বাদগন্ধ অনেকটা রক্তের মতো অনঙ্গ অন্ধকারে হাত মেলে, পা ছড়িয়ে,  অন্ধকারের মতো শীতল চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মায়ারুধির শ্যাওলা মেখে পৃথিবীতে নেমে আসা  ক্রমশঃ  ট্রেনের বাঁশির স্বরে বেড়া ভাঙার আর্তকান্না, আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে...


(১)


."কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র ! তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস  অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র  সরে যাবে
শীতল সরে যাবে
মৃত্যু সরে যাবে 

তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে ...."

সমস্তিপুর থেকে যে রাস্তাটা মুশরিঘরারি হয়ে বরৌনির দিকে গেছে সেই পথেই মাঝামাঝি পড়ে দলসিংসরাই। আমি তখন দিন সাতেক ধরে দলসিংসরাই ব্রাঞ্চঅডিট করছি।ছোট্টো জায়গা।  দিগরে তামাক আর তিসি চাষের নাম সবাই নেয়। ক্যাশ ক্রপের দৌলতে এখানকার চাষীরা বেশ পয়সাওয়ালা।ব্রাঞ্চটাও  বসতিরতুলনায় বেশ বড়োই বলতে হবে। কারেন্সি চেস্ট আছে। সকালবেলা ব্রাঞ্চে এসে ইকনমিক টাইম্সটায় চোখ বুলাচ্ছি, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অনুভব শ্রীবাস্তব পাশেবসলো।
হাঁ  বতাও, কুছ মিলা ক্যা? বহুত খুশ নজর  রহে হো ...
সর, ইয়ে লোগ চেস্ট রিপোর্টিং মে বহুত দের কিয়া, কই বার... আর বি আই বড়কা জুর্মানাঠোকেগা...
হিসাব উসাব কুছ জোড়া?
হাঁ সর, কম সে কম সাড়ে তিন লাখ কা চুনা লগেগা ব্যাংক'কা।
য়ঁহা লাস্ট ইয়ার প্রফিট কিতনা রহা?
বত্তিস লাখ সর..
আরে করিবন  টেন পর্সেন্ট কা কল্যাণ হো জায়্গা লগতা হ্যায়... ঠিক হ্যাঁয় হিসাব য়ঁহি   ছোড়কে যাও, জরা চেক করতে হ্যাঁয়...

ক্যালকুলেটরটা নিয়ে ডুবে যাই হিসেবের জঙ্গলে।
মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যি এসব কার হিসেব, কার নিকেশ। তখনই  খাঁচার ভিতর অচিন পাখির মতো ডানা ঝাপটানো শুরু হয়ে যায়। আই নিড সাম চেঞ্জ।
"...কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়
অমৃতই বিষ !
মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ "





(২)


"বুকের মধ্যে চাষ করেছি একপো প্রেমের ধান
তার আবার খাজনা কতো
কার যে সর্বনাশ করেছি স্বতঃই সন্দিহান
সে ভুলের বাজনা কতো..."

ফোনটা যখন এলো, তখন আমি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বাবু গোপাল প্রসাদ সিংয়ের একটু ক্লাস নিচ্ছিলাম।
এই লোকটি বোধ হয় পাঁজি দেখে দাড়ি কামায়। কে জানে মাসে কবার? সব সময়ই তো দেখি  কাঁচা পাকা সজারুর কাঁটা সারা মুখে। গত সাত দিন ধরে একটাইকামিজ পরে আছে দেখছি, যেটা কোনওকালে হলদেটে রং   ছিলো বোধ হয়। পাতলুনটার ওরিজিনাল রং সে নিজেও বলতে পারবে না। পায়ে চটি। কিন্তু একেবারে বাস্তুঘুঘু। মুজঃফরপুরে  দোতলা বাড়ি ঠুকেছে। দুটো ছেলেই বিদেশে আছে, ভালো চাকরিবাকরি করছে বললো। একেকটার বিয়েতে লাখ চল্লিশ পঞ্চাশ তো নিশ্চিতউসুল করবে।
অডিটরসায়েবের সামনে সর্বদা ঝুঁকে দুহাত কচলে যাচ্ছে। আমি জানি,   যখন নিজের গাঁয়ে খাটিয়া টেনে পঞ্চায়ত করতে বসে, তখন  একেবারে তইমুর লং।
তো সিংসাব, ব্রঞ্চকা তো পুরা বাজা বজা দিয়ে...
সর, থোড়া গড়বড় হো গয়া...
থোড়া!!! সাড়ে তিন লাখকা চুনা লগায়ে মহারাজ... মুঝে তো অলগ রিপোর্টিং করনা   পড়েগা,
সর, থোড়া মেহরবানি করেঁ হুজুর... বিটিয়া কি শাদি করনা হ্যাঁয়...

এইসব দেখলে এখন আর রাগ হয়না, আগে হতো...
তখনই ফোনটা বাজলো।

গোপালবাবু ফোন ধরে আমাকে দিলো,
সর, আপকা...
ওদিক থেকে বিরেন্দর পান্ডের গলা। বিরেন্দর পাটনা হেড অফিসে অডিট অ্যালোকেট করে। আমার পুরোনো চ্যালা।
গুড মর্নিং বস,
হাঁ জি বিরেন্দর, মর্নিং ... বতাও,  সুবহ সুবহ কিস চিজ কা ইত্তিলা...
বস, ইয়ে ব্রঞ্চ তো অউর তিন রোজ মেঁ হো জানা চাহিয়ে,
হো জায়গা...
তো হোলি মেঁ কঁহা রহনা পসন্দ করেঙ্গে?
কঁহি ভি দে দো...
অপনা ঘর তরফ যাইয়েগা?
কঁহা ?
কিরিবুরু...?
মাথার ভিতর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজটা বেশ শুনতে পেলুম। হোলির সময় কিরিবুরু...
বসন্তের মাতাল সমীরণ যে কতোটা মাতাল,  সেটা বোঝাতে হোলির জ্যোৎস্নায়  মেঘাতুবুরুর শালবনে ঝরা পাতার গালচে  পাতা আছে।
-ঠিক বা, তোহার জইসন মর্জি...

সর, আপ টিকট লে লিজিয়ে। ম্যঁয় টেলিগ্রাম ভেজ দেতা  হুঁ।

-------------------

কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের  সাতশো নীল  পাহাড় চূড়াআর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের   খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে।  প্রায়আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ,  রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয়  অন্য লাল  সব রক্তই কি একই রকম লাল ? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া ? তবে   কেন বার বার ইঞ্চকেপ রকের ঘন্টা বলে যায়, আমায় তুই আনলি কেন...?

"সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে..."





(৩)


"যেতে-যেতে এক-একবার পিছন ফিরে তাকাই, আর তখনই চাবুক
তখনই ছেড়ে যাওয়া সব
আগুন লাগলে পোশাক যেভাবে ছাড়ে
তেমনভাবে ছেড়ে যাওয়া সব
হয়তো তুমি  কোনদিন আর ফিরে আসবে না -শুধু যাওয়া..."

প্রথম যখন চাকরিতে ঢুকি, আমার প্রথম পোস্টিং ছিলো চাইবাসায়। তা,  চাইবাসা তখন সিংভূম জেলার হেড কোয়ার্টার, ছোট্টো পুরোনো গ্রামীণ জনপদ  'শহর'বলতে বাধে, যদিও জামশেদপুরের থেকে প্রাচীন লোকবসতি।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে  জামশেদপুরের কিছু লোকজন অস্থায়ী ভাবে ওখানে পরিবারপাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে আমার ঠাকুরদাও ছিলেন। আমার বাবা তিনচার কেলাস চাইবাসা জিলা স্কুলে পড়েছিলেন। তার পর আবার জামশেদপুর ফিরে যানসকলে।  কিছুটা আপনঘরের ছোঁয়া  আমার সেখানেও ছিলো।

সমীর রায়চৌধুরী জেলা মৎস অধিকারী হিসেবে ওখানে পোস্টেড ছিলেন  সেই কালে। তাঁর টানে নিয়মিত সন্দীপন, শক্তি, সন্তোষকুমার ঘোষ, উৎপলকুমার বসু বা আরও 
অনেক কৃত্তিবাস পার্টি যারা হাংরিতে যোগ দেয়নি, নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন   চাইবাসায়। আমাদের নিজেদের লিট্ল কাগজ ছিলো, 'উইঢিবি' নিজেরা লিখতুম আর  কলকাতার এইসব  স্টার কবিদের পেলে জরিমানা হিসেবে কবিতা আদায়  হতো কাগজের জন্য। পারিশ্রমিক শুধু মেরিটোলার মহুয়া সেই সময় আমি সারান্ডা চিনেছিলুম প্রায় গাছ ধরে ধরে। সঙ্গে থাকতো বন্ধু মাধব, ওরফে মধু   চাইবাসার ছেলে। টাটা কলেজে ফিজিক্সের স্টার ছাত্র, গ্রামীণ পরিবারের প্রথম স্কুলের গন্ডি পেরোনো ছেলে। ওর বাবা রবিবাবুর নামও শোনেননি বোধহয়, কিন্তু এই নিয়মভোলা ছেলেটা ছবি আঁকে, গান গায় আর অদ্ভুত পদ্য লেখে।একেবারে নিজের মতো। আমার একটা অভ্যেস আছে কেউ পদ্য লিখলেই খুঁজি একে কোন কবি গ্রাস করতে চাইছে?  কিন্তু মধুর লেখায় কখনও কারও ছায়াদেখিনি। হয়তো খুব পাকা নয়, কিন্তু না ফোটানো মহুয়া ফুলের বাস থাকতো তার পদ্যে 

"তোমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো
সারা জীবন তুমি তার পাতা গুনতে ব্যস্ত থাকবে
সংসারের কাজ তোমার কম- 'অবসর আছে' বলেছিলে একদিন
'অবসর আছে -  তাই আসি..."

একটা ছুটির দিনে শীতের সকালে  গিয়েছিলুম নোয়ামুন্ডি পেরিয়ে মুর্গামহাদেও। আমি আর মধু,  আমার চিরসঙ্গী বাইকে  চড়ে।  এখানেই  আমার সঙ্গে  পর্ণার প্রথমদেখা  আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলো। নোয়ামুন্ডিতে ওর কোনও এক ঘনিষ্টজন থাকতেন  তাদের সঙ্গেই তার যাওয়া, নোয়ামুন্ডিপেরিয়ে মুর্গামহাদেও। কোথা থেকে পেয়ে আমাদের কাগজের একটা সংখ্যায় রবিবাবুকে নিয়ে আমার লেখা   একটা হাল্কা গদ্য পড়ে নিজেই আলাপ করেছিলো।
কাগজটার  সংখ্যাটিতেই  শক্তি একটা পদ্য পাঠিয়েছিলেন, তার শুরুটা এরকম,
' ভালোবাসা ছিলো প্রজাপতিটির নাম,
জানি, দিয়েছিলো বাগান অনেক দাম ...'
শক্তির বাঁহাতের লেখা কয়েকটি লাইন। তবে সেখানেও যেন কিছু থাকে। রেল লাইনের পাশে যত্নহীন বেড়ে ওঠা উজ্জ্বল আকন্দ ফুলের ঝাড় যেন। জীবন গিয়েছেচলে পঁয়ত্রিশ বছরের পার   বাহিরমহল আর ভিতরবাড়ির মধ্যে এখনও কোনো  গন্ডি নেই  আরশিনগরের মেয়ের জন্য  রয়ে গেছে কয়েক টুকরো নীলাভ স্ফটিক  মূহুর্তের ছিন্ন  রেশম জাল  মীর মোমিনের প্রিয় শ্যয়রি এলোমেলো গেয়ে যাওয়া দু'চার পশলা ঘুমভাঙানিয়া, ...
"ওহ নয়েঁ গিলে ওহ  শিকায়তেঁ
ওহ মজে মজে কি হিকায়তে
মুঝে সব হ্যাঁয় ইয়াদ জরা জরা
তুমহে ইয়াদ 




(সৌজন্যস্বীকার : গুরুচন্ডালি)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন