কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

মারিও বেনিদিত্তি




প্রতিবেশী সাহিত্য



মারিও বেনিদিত্তি’র গল্প   

(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী)




লেখক পরিচিতি :   

১৯২০ সালে উরুগুয়েতে জন্ম কবি ঔপন্যাসিক সাংবাদিক মারিও বেনেদেত্তির। ৮০টির বেশি গ্রন্থ প্রণেতা মারিওর লেখা ২০টি ভাষায় এতাবৎ অনূদিত হয়েছে। ‘ত্রেগুয়া’ বা ‘চুক্তি’ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত মারিও প্রয়াত হন ২০০৯ সালে। 



La noche de los feos (কুৎসিত লোকেদের রাত)


(১)


আমরা দুজনেই কুৎসিত। আমরা এমনকী কদর্য ও কুরূপও নই। মেয়েটার চিবুকটা একটু বসা, থ্যাবড়া মত। আট বছর বয়সে একটা অপারেশন হয়েছিল, তারপর থেকেই। আর আমার মুখের বীভৎস দাগ এসেছিল আমার বয়সঃন্ধি থাকাকালীন এক সাংঘাতিক পোড়ার ঘটনার পর থেকে। আমাদের চোখগুলোয় নরম ভাব আছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। সৌন্দর্যের ধারকাছ দিয়ে যাবার এমন হাতে চাঁদ পাবার মত ভাগ্য কস্মিনকালেও হয় নি। না কোনভাবেই না। যেমনটা ওর তেমনটাই আমার চোখ এক্কেবারে অসন্তোষে ভরা, পরিষ্কার দেখা যায় আমাদের দুর্ভাগ্যের কাছে মাথা নত করতে আমরা কিছুতেই রাজী নই। মনে হয় এ ব্যাপারটাই আমাদের মধ্যে একতা এনেছে। নয় ঐক্যবদ্ধ বলা যেতে পারে, আমি ঠিক উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা সবাই যার যার মুখ সম্পর্কে যে নির্মম ঘেন্না অনুভব করি, ব্যাপারটা ঠিক সেরকমই।

প্রেক্ষাগৃহের দরজায় আমরা দেখা করলাম। সুন্দর দুজন মানুষকে দেখব সে আশায় সিনেমার লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম টিকিটের জন্য। সেখানেই প্রথমবার আমরা একে অন্যকে দেখি, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে নিই। কোনরকম সহানুভূতি ছাড়াই দেখি তবে শক্তপোক্ত সংহতি নিয়ে। সেখানেই প্রথম দেখার পর থেকেই আমরা খেয়াল করি একে অন্যের একাকীত্বকে চিনতে পারছি। লাইনে সবাই জোড়ায় জোড়ায় ছিল, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বাগদত্ত নরনারী, দাদু-দিদিমা  ইত্যাদি প্রথাগত জোড়ারা তো বটেই, তবে তাদের ছাড়াও এমন দুজন ছিল যাদের একে অন্যকে জানা বাকী। সবাই হাত ধরে আছে কারো না কারো অথবা বাহু। কেবল মেয়েটার আর আমার এই দুজনের হাত ঝোলানো।

আমরা একে অন্যের কদাকার চেহারাগুলোকে বেশ খুঁটিয়ে কিন্তু তাচ্ছিল্যের সাথে, কৌতূহলহীনভাবে দেখলাম। আমার চিমড়ে বসা চিবুক নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই ওর চিবুকের ওই চিড় ধরা থ্যাবড়ানো জায়গাটা দেখলাম। মেয়েটা লজ্জা পেল না। আমার ভাল লাগল ও কটমট করে চাইল দেখে। আর আমারও মজা লাগল যখন দেখলাম ও আমার মাকুন্দ চকচকে চালু পুরনো পোড়া চিবুকের জায়গাটা চোখ ছোট করে দেখে নিল।

শেষমেশ ঢুকলাম। দুজনে আলাদা কিন্তু একসাথে জোড়া আসনে বসলাম। ও আমায় দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু আমি, যদিও বিকেল হয়ে এসেছিল, ওর ঘাড়ে  লেপটানো সোনালি চুল, ওর ঠাণ্ডা সুগঠিত কান দেখছিলাম। ওদুটো দুপাশেই ছিল স্বাভাবিক আকারের।

একঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে আমরা নায়কের রুক্ষ সৌন্দর্য আর নায়িকার নরম রূপের তারিফ করে গেলাম। আমি অন্তত সুন্দরের প্রশংসা করার হিম্মত রাখি। আর আমার বিদ্বেষ মুখর কথা শুনেই হয়ত ওর চোখ একবার আমার  মুখে, আর একবার কে বলতে পারে, বোধহয় ভগবানের মুখের দিকে আটকে রইল। কিংবা হয়ত আরো অন্যান্য কুৎসিত দর্শন বা অদ্ভুতুড়ে মুখগুলোর দিকে। ওর হয়ত মনে মনে করুণা হচ্ছিল, তবে আমি তা পারি না। সত্যিটা হল ওগুলো  কিছুটা আয়না দেখার মত ব্যাপার। মাঝে মাঝে নিজের মনে প্রশ্ন উঠছিল কী ভাগ্যই না হত আমার যদি উপকথায় থাকত যে নার্সিসাসের ভোঁতা চিবুক ছিল, অথবা একটা অ্যাসিড তার চিবুক পুড়িয়ে দিয়েছিল কিংবা নাকের অর্ধেকটা তার ছিলই না, অথবা কপালে একখানা সেলাই ছিল!  

প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোবার দরজায় ওর  জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কয়েক মিটার ওর সঙ্গে হাঁটলামও। তারপর ওর সঙ্গে কথা বললাম। ও যখন থামল, আমার দিকে চাইল, চোখের দৃষ্টি ভাসাভাসা। এককাপ কফি নিয়ে আড্ডায় বসার আমন্ত্রণ জানালাম। অথবা আমরা যদি কোন মিষ্টির দোকানে বসি! সঙ্গে সঙ্গে সেটা ও গ্রহণ করল।  
  
মিষ্টির দোকান ভর্তি ছিল, তবে ঠিক সেইসময় একটা টেবিল খালি হল। লোকজনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় আমাদের পিঠ বুক ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছিল, একটু অবাক হচ্ছিলাম। আমার অ্যান্টেনা আবার এইসব মর্ষকামী ব্যাপার স্যাপারে বেশ সজাগ। সেই ঝলমলে মুখগুলোর অবচেতনের স্যাডিস্ট মুখগুলো আশ্চর্যজনক ভাবে এক ধরনের থাকে। কিন্তু এইবার এসব ঠিক আমার শিক্ষাপ্রাপ্ত মনের মত হল না। কানগুলো যদিও খাড়া হয়ে ছিল কে কী বলছে,  ফিসফিসানি, খুক খুক কাশি, নকল গলা খাঁকারি ইত্যাদি শোনার জন্য। একটা একা পড়ে যাওয়া বীভৎস মুখের পক্ষে নিজস্ব আগ্রহের বিষয় তো থাকবেই। কিন্তু দুটো কদাকার মুখ নিজেরাই একসঙ্গে একটা দর্শনীয় বিষয়। হয়ত সাজানো গোছানো নয় তবু দর্শনীয় তো বটেই। তারা এতটাই একরকম যে তাদের একে অন্যের সঙ্গে মিলে একসাথে (নারী পুরুষ নির্বিশেষে) দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়া কাম্য।  

আমরা বসলাম। আইসক্রীম অর্ডার দিলাম। আর মেয়েটা সাহস করে (এটাও আমার ভাল লাগল) ব্যাগ থেকে আয়না বের করল। চুলটা ঠিক করে নিল। সুন্দর চুল তার।
কী ভাবছেন? - ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
ব্যাগে আয়নাটা রেখে ও হাসল। গালের গর্তটা অন্যরকম হয়ে গেল।
এখানে অনেকে আসে - বললাম- একে অন্যের জন্য একদম মানানসই।
অনেকসময় ধরে আমরা কথা বললাম। দেড়ঘন্টা ধরে আলাপ করে আমাদের আড্ডা দেবার ছুতোটাকে মান্যতা দেবার জন্য আমরা কফির অর্ডার দিলাম। আমরা এতটাই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলাম যে একটা পর্যায়ে গিয়ে সেটা প্রায় হিপোক্রেসি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক করলাম গভীরে যাব।
‘আপনার নিজেকে দুনিয়া ছাড়া লাগে, তাই না?’
‘হ্যাঁ’- তখনও নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললাম আমি।
‘আপনি সুন্দর দেখলে তারিফ করেন, স্বাভাবিক দর্শনধারীদের দেখলেও। আপনি আপনার ডানপাশে বসে থাকা মেয়েটার মত মুখ হোক তেমনটা চান, যদিও আপনার যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা মাথা আছে, আর মেয়েটা, ওর হাসি শুনলেই বোঝা যায় বোকা’।
‘হুম।’
প্রথমবার আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।
‘আমিও এমনটাই চাইতাম। কিন্তু তাতে একটা সম্ভাবনা আছে, বুঝলেন? আপনি আর আমি, আমরা একটা বিষয়ে পৌঁছতে পারি।’
‘সেটা কী?’
‘নিজেরা নিজেদের ভালবেসে। কিংবা স্রেফ মেলামেশা করে। ওকে ডেকে দেখুন চাইলে, তবে একটা সম্ভাবনা আছেই।’
মেয়েটা ভ্রূ নাচাল। আশা করতে চাইছিল না।
‘কথা দিন, আমায় বুদ্ধু ভাববেন না!’
‘দিলাম’।
‘রাতে দেখা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। গভীর রাতে। ঘন নিকষ কালো অন্ধকারে। বুঝলেন?’
‘না।’
‘আপনাকে বুঝতেই হবে! নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। যেখানে আমি আপনাকে দেখতে পাব না, আপনিও পাবেন না আমায়। আপনার শরীর ভীষণ সুন্দর। একথা জানতেন না?’
মেয়েটা হাসল। গালের গর্তটা আচমকা লাল হয়ে গেল।
‘আমি একা থাকি একটা অ্যাপার্টমেন্টে, কাছেই হবে।’
সে মাথা তুলল, তারপর আমার দিকে প্রশ্নের চোখে তাকাল। আমাকে বুঝতে চাইছিল। মরীয়া হয়ে আমায় চিহ্নিত করতে চাইছিল কোনো।
বললাম - ‘চলুন, যাওয়া যাক!


()


শুধু বাতিগুলোই নেভালাম না, উপরন্তু দুসারি পর্দাও টেনে দিলাম। আমার পাশে  ও নিশ্বাস নিচ্ছিল। শ্বাসের সে ওঠাপড়ায় কোনো উৎকণ্ঠা ছিল না। আমি চাইছিলাম ও নিজেই নিজের পোশাক খুলুক।
কিছু দেখতে পারছিলাম না, কিচ্ছু না। কিন্তু সে অবস্থাতেই খেয়াল করলাম ও থমকে গেছে, অপেক্ষায় অধীর। ওর বুকের দিকে সাবধানে বাড়ালাম একটা হাত। ছোঁয়ামাত্র আমার হাত বেয়ে শিহরণ উঠল। রীতিমত জোরালো। এভাবেই ওর পেট দেখলাম, ওর যোনি। ওর হাতগুলোও আমায় দেখছিল।

ঠিক সে মুহূর্তেই বুঝলাম আমাকে শুরু করতে হবে এক্ষুনি, সেই মিথ্যেটাকে  ছিঁড়ে ফেলতে হবে যা আমি নিজেকে বলে এসেছি বরাবর। অথবা বলা যায় যে মিথ্যেটাকে বানানোর চেষ্টা করেছি, সেটা যেন এক বিদ্যুৎ ঝিলিক। আমরা তেমন ছিলাম না। আমরা তো তেমন ছিলাম না।

আমার সমস্ত সঞ্চিত সাহস আমায় তুলে আনতে হচ্ছিল, তবে আমি তা আনতেও পারলাম। আমার হাত ধীরে ধীরে ওর মুখে চলাফেরা করতে লাগল। সেই আতঙ্কের সুড়ঙ্গের মুখোমুখি হলাম। একটা শান্ত ধীর গতির, কিন্তু বেশ  আত্মবিশ্বাসী ও বিশ্বাস যোগানো আদর আমায় ঘিরে ফেলছিল। বাস্তবে আমার আঙুলগুলোই, (প্রথমে একটু কাঁপছিল ওরা, আসতে আসতে দৃঢ় হয়ে উঠতে  শুরু করল) ওর চোখের জলের ওপরে বুলিয়ে দিল সে আঙুল।
তখন আমি ওকে যত কমই কামনা করি না কেন, ওর হাতও আমার মুখ পর্যন্ত  পৌঁছল ওর পোশাকের ওপর বারবার হাত বুলালাম, ওর ছেড়ে রাখা চুলে,   আমার সেই দাড়িহীন অপয়া দাগের দ্বীপের ওপরে... 
 
ভোর হওয়া পর্যন্ত আমরা কেঁদেছিলাম। হতভাগ্য, অসহ্য সুখী দুজন মানুষ। তারপর আমি উঠলাম, গিয়ে পর্দাটা হাট করে খুলে দিলাম।


2 কমেন্টস্: