কালিমাটি অনলাইন / ৬৯
বেশ কিছুদিন হলো রামনামের চলন
খুব বেড়েছে। তা বাড়ুক, কারোর আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেভাবে ও যে
অনুপ্রেরণায় তা ক্রম বর্ধিত হচ্ছে, তাতে রামের মাহাত্ম্য কি আদৌ বর্ধিত হচ্ছে?
আমাদের অগ্রজরা এবং আমরা নিতান্ত শৈশব থেকে ভারতবাসী হওয়ার সুবাদে যে রাম ও
রামায়ণের সঙ্গে নিত্য পরিচিত ও সংপৃক্ত হয়ে এসেছি, আজকের প্রজন্মের শিশুরা কি সেই
পরিচিতি ও সংপৃক্তি লাভের কোনো সুযোগ পাচ্ছে? খুব ছোটবেলা থেকে রামের নামে যেসব
উচ্চারণ শুনে এসেছি, যেমন ‘জয় সিয়ারাম’, ‘রামনাম সত্য হ্যায়’, ‘রঘুপতি রাঘব রাজা
রাম’, ‘পতিত পাবন সীতারাম’, জয় রামজী কী’ ইত্যাদি ইত্যাদি, তা কিন্তু সত্যি সত্যিই শ্রুতিমধুর ছিল। মনের মধ্যে
একটা প্রসন্নতা বয়ে আনত। ‘রামায়ণ’এ বর্ণিত পুরুষোত্তম রামের প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়
আমরা আপ্লুত হতাম। কিন্তু ইদানীং রামের নামে যে ধ্বনি শ্লোগানের কায়দায় ধ্বনিত হয়,
সেই ‘জয় শ্রীরাম’ নির্দিষ্টি একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভূতিশীলদের ব্যতিরেকে আর কারও কাছে রামের কোনো মাহাত্ম্য
বয়ে নিয়ে আসে না। বরং বলা যেতে পারে, এই
শ্লোগান ক্রমশ অনেকের কাছেই আশঙ্কা ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত এই শ্লোগান
চিৎকার করে বলার জন্য যেভাবে বলপ্রয়োগ করে কিছু মানুষকে বলতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং
অরাজী হলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে পীড়ন করা হচ্ছে, তাতে রামের মহিমা নিশ্চিতভাবে
খর্ব করা হচ্ছে। এই প্রাসঙ্গিকতায় আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি রবীন্দ্রনাথের রচনা
থেকে, যেখানে রাম ও রামায়ণ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য
বক্তব্য রেখেছেন।
“প্রাচীন আর্যসভ্যতার এক ধারা য়ুরোপে এবং
এক ধারা ভারতে প্রবাহিত হইয়াছে। য়ুরোপের ধারা দুই মহাকাব্যে এবং ভারতের ধারা দুই মহাকাব্যে
আপনার কথা ও সংগীতকে রক্ষা করিয়াছে। ... রামায়ণে ভারতবর্ষ কী বলিতেছে, রামায়ণে
ভারতবর্ষ কোন্ আদর্শকে মহৎ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, ইহাই
বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের সবিনয়ে বিচার করিবার বিষয়। বীররসপ্রধান কাব্যকেই এপিক বলে
এইরূপ সাধারণের ধারণা, তাহার কারণ যে দেশে যে কালে বীররসের
গৌরব প্রাধান্য পাইয়াছে সে দেশে সে কালে স্বভাবতই এপিক বীররসপ্রধান হইয়া পড়িয়াছে।
রামায়ণেও যুদ্ধব্যাপার যথেষ্ট আছে, রামের বাহুবলও সামান্য
নহে, কিন্তু তথাপি রামায়ণে যে রস সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ
করিয়াছে তাহা বীররস নহে। তাহাতে বাহুবলের গৌরব ঘোষিত হয় নাই, যুদ্ধঘটনাই তাহার মুখ্য বর্ণনার বিষয় নহে।
দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে।
কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন—পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে
নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস
হইত, সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই
রামচরিত্র মহিমান্বিত।
আদিকাণ্ডের প্রথম সর্গে বাল্মীকি তাঁহার কাব্যের
উপযুক্ত নায়ক সন্ধান করিয়া যখন বহু গুণের উল্লেখ করিয়া নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন–
সেমগ্রারূপিণী লক্ষ্মীঃ কমেকং সংশ্রিতা
নরম্।
কোন্ একটি মাত্র নর'কে আশ্রয় করিয়া সমগ্রা
লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করিয়াছেন? তখন নারদ কহিলেন–
দেবেষবপি ন পশ্যামি কশ্চিদেভির্ংগুণৈর্সযুতম্।
শ্রূয়তাং তু গুণৈরেভির্যোযুক্তো
নরচন্দ্রমাঃ।
এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না, তবে
যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এইসকল গুণ আছে তাঁহার কথা শুন। রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা,
দেবতার কথা নহে। রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই,
মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন। মানুষেরই চরম আদর্শ-স্থাপনার
জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন। এবং সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই
আদর্শচরিত-বর্ণনা ভারতের পাঠকমণ্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছে। রামায়ণের
প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া
দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামীস্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি-ভক্তির
সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি
সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশজয়, শত্রুবিনাশ,
দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচণ্ড আঘাত-সংঘাত, এই-সমস্ত
ব্যাপারই সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনার সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু
রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই; সে
যুদ্ধঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষমাত্র।
পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ,
পতিপত্মীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার
কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে। এইরূপ ব্যক্তিবিশেষের
প্রধানত ঘরের সম্পর্কগুলি কোনো দেশের মহাকাব্যে এমনভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য
হয় নাই। ইহাতে কেবল কবির পরিচয় হয় না, ভারতবর্ষের পরিচয় হয়।
গৃহ ও গৃহধর্ম যে ভারতবর্ষের পক্ষে কতখানি, ইহা হইতে তাহা
বোঝা যাইবে। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল, এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাশ্রম আমাদের নিজের সুখের জন্য,
সুবিধার জন্য ছিল না; গৃহাশ্রম সমস্ত সমাজকে
ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয়
আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য। এই গৃহাশ্রম-ধর্মকেই রামায়ণ
বিসদৃশ অবস্থার মধ্যে ফেলিয়া বনবাসদুঃখের মধ্যে বিশেষ গৌরব দান করিয়াছে। কৈকেয়ী
মনথরার কুচক্রান্তের কঠিন আঘাতে অযোধ্যার রাজগৃহকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দিয়া
তৎসত্ত্বেও এই গৃহধর্মের দুর্ভেদ্য দৃঢ়তা রামায়ণ ঘোষণা করিয়াছে। বাহুবল নহে,
জিগীষা নহে, রাষ্ট্রগৌরব নহে, শান্তরসাস্পদ গৃহধর্মকেই রামায়ণ করুণার অশ্রুজলে অভিষিক্ত করিয়া তাহাকে
সুমহৎ বীর্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে”। (রবীন্দ্রনাথ লিখিত
শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত)
ইতিমধ্যে বর্ষাকাল প্রাকৃতিক নিয়মেই এসে গেছে। কিন্তু
বৃষ্টির প্রাবল্য এখনও পর্যন্ত সেভাবে দেখা যায়নি। আমরা কামনা করি ঘনঘোর বর্ষা
আসুক। প্রকৃতি সজল ও সবুজ হয়ে উঠুক। জলকষ্ট এখন পৃথিবীর একটা অন্যতম কঠিন সমস্যা।
পৃথিবীবাসী এই সমস্যা থেকে মুক্ত হোক।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com
/ kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ :
08789040217 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand,
India
কালিমাটি অনলাইনের সম্পাদকীয়টি খুবই ভাল হয়েছে। এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ।
উত্তরমুছুনবর্তমানে বাঙালিরা অর্থাৎ নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষরা এসব আর পড়েনা। লাইব্রেরি তে যায় না। জীবনযুদ্ধে এতটাই ব্যস্ত যে উণবিংশ শতাব্দীর মানবিকতার উজ্জ্বল দিকটা ক্রমশ ফিকে হয়ে গেছে। এটা বাঙালির সামগ্ৰিক দুর্ভাগ্য।
উত্তরমুছুনজয়শ্রীরাম - এই চীৎকার শুনলে রক্ত হিম হয়ে যায়। মনে হয় লড়াই বাধবে এখনই।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী