কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন /


শরৎকাল আমাদের বাঙালি জীবনে যে উৎসবের সূচনা করে, তা মোটামুটি মসৃণ গতিতে প্রবাহিত হয়ে চলে গ্রীষ্মকালের বৈশাখ মাস পর্যন্ত। প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবই শুধু নয়, হরেকরকম সাংস্কৃতিক উৎসবের পাশাপাশি সাহিত্য উৎসবও। শরতের সূচনাতেই ঢল নামে অসংখ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকার। তার সঙ্গে আয়োজিত হয় আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতাপাঠ, গল্পপাঠ, শ্রুতিনাটক, নাটক, যাত্রা,  সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান আরও কত কী! আর এইসব কিছুর পাশেই জমজমাট লিটল ম্যাগাজিন মেলা এবং বইমেলা। হ্যাঁ বেশ কিছুদিন হলো, বইমেলা বাঙালি জীবনে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। বাংলাভাষী মানুষেরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকেন বইমেলার দিনগুলির জন্য। এবং এই বইমেলা যেমন আয়োজিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তেমনই আয়োজিত হয় ভারতে এবং বাংলাদেশেও। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে বইমেলা যেভাবে উৎসবের আলোয় ও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তা সত্যিই অতুলনীয়। আর এই উৎসবের জোয়ারে এ বছরও ১১ জানুয়ারী থেকে ১৫ জানুয়ারী কলকাতায় নন্দন চত্বরে আয়োজিত হয়েছিল বাংলা লিটল ম্যাগাজিন মেলা। আবার আগামী ২৭ জানুয়ারী থেকে ৭ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় মিলন মেলা প্রাঙ্গনে শুরু হবে কলকাতা বইমেলা। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের অনুরাগী পাঠক-পাঠিকাদের জানাই, এই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকার ১০২তম সংখ্যা আমরা তুলে দিতে পেরেছি মননশীল পাঠক-পাঠিকাদের হাতে। আবার আগামী কলকাতা বইমেলাতেও সংখ্যাটি সংগ্রহ করা যাবে অনায়াসেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘কালিমাটি’ ১০২তম সংখ্যার বিষয় – সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, চিত্রনাট্য, কবিতা, গল্প ও চিত্রশিল্পের আয়োজনে এই স্পর্শকাতর বিষয়টির ওপর গভীরভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। স্বল্পজানা ও না-জানার দরুন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে ভুল ও বিকৃত ধারণা পোষণ করেন, আযৌক্তিক দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন। আমরা মনে করি, নিবিড় অধ্যয়ন ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ যে কোনো বিষয়কে সঠিক ভাবে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে। আর তাই ‘কালিমাটি’ পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাই হয়ে উঠছে গবেষণামূলক সৃজন সম্ভার।
আমরা গত বছর আকস্মিক ভাবে হারিয়েছি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রশিল্পী ভূদেব ভকতকে। ভূদেবদা শুধুমাত্র আলোকচিত্রশিল্পীই ছিলেন না, বরং একইসঙ্গে ছিলেন অঙ্কনশিল্পী, তবলাশিল্পী এবং সাহিত্যিক। দীর্ঘদিন তিনি ‘কালিমাটি’ পত্রিকা ও ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন যথার্থ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিল্পী এবং অত্যন্ত সহৃদয় সজ্জন। আর আমাদের একান্ত আপনজন ভালোবাসার মানুষ। তাঁকে হারিয়ে আমরা সত্যি সত্যিই অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। ভূদেবদার ছবি ও লেখা নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘কালিমাটি অনলাইন’এ। সম্প্রতি তাঁর বেশ কিছু অপ্রকাশিত লেখা আমাদের হাতে এসেছে। আমরা ঠিক করেছি, প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই তাঁর সেই অপ্রকাশিত লেখা প্রকাশ করব। ‘কালিমাটি অনলাইন’ ৩২তম সংখ্যাতেও একটি লেখা প্রকাশ করা হলো। এবং এভাবেই আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই সম্মান ও শ্রদ্ধার্ঘ।
ইংরেজি নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানাই সবাইকে। ভালো থাকুন সবাই।   
     
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

      

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

“শুধুহাসে মহাকাল” : রঙ্গব্যঙ্গের নিশানায় সুভাষচন্দ্র




যাঁরা নিজের চরিত্রের দীপ্তিতে, কর্মের প্রেরণায় বা কীর্তির গৌরবে দেশের  ইতিহাসকে অলঙ্কৃত করেন, সেই জাতির মানসপটে যে তাঁর ছবি আঁকা হয়ে থাকে অনপনেয় বর্ণসুষমায়, এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তাঁদের নিয়ে প্রায়শই মুখর হয়ে থাকে দেশের সংবাদ-মাধ্যম, কাব্যরচনা করেন কবি, শিল্পী আঁকেন তাঁর ছবি। কিন্তু তিনি যদি হন রাজনীতির জনপ্রিয় নায়ক বা নায়িকা, তা হলে তাঁর ওপর যে সর্বদাই শুধু প্রশস্তির পুষ্পই বর্ষিত হবে না, এ কথা বলাই বাহুল্য। আজ আমাদের মধ্যে সশরীরে না থাকলেও ভারতীয় তথা বাঙালি জাতির মনোজগতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের স্থান রয়ে গেছে তেমনই এক গগনচুম্বী উচ্চতায় তাঁর  জীবনকালেও যেহেতু তিনি ছিলেন সমকালীন রাজনীতির এক লোককান্ত ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নিয়েও সে কারণে সদাই আবর্তিত হয়েছে বিতর্কের ঘূর্ণি, নিক্ষিপ্ত হয়েছে  ব্যঙ্গবিদ্রূপের শরকার্টুনিস্টের ব্যঙ্গচিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছেন তিনি একেবারে তরুণ  বয়স থেকেই। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই পর্বের সমস্তটা জুড়েই সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেন অন্ত নেই! তাঁকে নিয়ে বাংলায় রচিত কিছু রঙ্গরচনা আর দেশবিদেশের ব্যঙ্গচিত্রীদের আঁকা ছবিগুলোর ভিত্তিতে আমাদের এই পরিক্রমা। আলোচনার সুবিধার জন্য এই সমগ্র পর্বটিকে আমরা খুব মোটাভাবে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নিতে পারি। প্রথম পর্বটি হতে পারে ১৯২৪ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ যতদিন তিনি ভারতে ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বটি হতে পারে তাঁর জীবনের বাকি অংশটুকু অর্থাৎ ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালে তাঁর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। এই পরিক্রমার শেষ ভাগটি ১৯৪৬ থেকে একেবারে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত, যখন নেতাজিকে প্রত্যক্ষ ভাবে সমালোচনা বা আক্রমণ না করা হলেও তাঁর প্রসঙ্গ নানা ভাবে ব্যঙ্গচিত্রের উপজীব্য হয়েছে। আপাতত এই পরিসরে আমরা শুধু প্রথম পর্বটিতেই [১৯২৪-৪০] পরিক্রমার চেষ্টা করব।

সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্য হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পর সুভাষচন্দ্রের প্রথম কারাবরণ ১৯২১ সালে। এর কয়েক বছর পরে ১৯২৪ সালে ইংরেজ সরকার সুভাষচন্দ্র, সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখ কংগ্রেসকর্মীদের ১৮১৮ সালের রেগুলেশন থ্রী বা ‘তিন আইনে’ গ্রেপ্তার করে ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে চালান করে। শরৎচন্দ্র পন্ডিত ওরফে দা’ঠাকুর তাঁর ‘বিদূষক’ পত্রিকায় এই ঘটনাটি নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র সহ কবিতা প্রকাশ করেন। কার্টুনটিতে দেখানো হয়, একটি উড়োজাহাজের গায়ে লেখা ‘R-3-1818’, সেটি থেকে দড়িতে ঝুলছে কয়েক জন বাঙালি যুবক, নিচে দাঁড়িয়ে এক হাবিলদার বলছে,  ‘‘উড় যা বাংগালি, উড় যা!” ছবির সঙ্গে ছাপা কবিতাটিতে সুভাষচন্দ্র বা তাঁর কারাবরণের উল্লেখ না থাকলেও তাঁর কারাদন্ডকে উপলক্ষ্য করে রচিত এই  কবিতায় ইংরেজের আইনকে যে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল, তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেইঃ- উড় যা বাংগালি, উড় যা/ ঘর সে বহুৎ দূর যা/ বেগর হাকিম কা পুর যা/ পুলিশ সব ঘর ঢুঁর যা।।/ কুত্তা বিল্লি শের/ পকড়া জায়গা ঢের,/ জলদি মত করো দের/ তেরা নসিব কা বহুৎ ফের!...”

সুভাষচন্দ্রের এই প্রথম কারাবরণের পেছনে ছিল বিপ্লবী দলের সঙ্গে তাঁর  যোগসাজসের অপ্রমাণিত অভিযোগ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দীর্ঘদিন বিনাবিচারে আটক রেখেছিল বলে বিলেতের পার্লামেন্টেও জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছিলেনতাঁর বিরুদ্ধে এই অপ্রমাণিত অভিযোগের ইঙ্গিত দা’ঠাকুরের এই কবিতায় সহজেই ধরা  যায়, যেখানে বলা হচ্ছে, ইংরেজের ‘লাট কা কানুন’ অতি সহজেই বাঙালিদের চোরডাকাত বানিয়ে নাজেহাল করতে পারে, শত উকিল-ব্যারিস্টার দিয়েও পার পাবার পাবার জো নেই, কেননা সরকারের মুখের কথাতেই বিচার পরিচালিত হবে:- “ওকিল বেলিস্টার/ সব হোগা নাচার,/ মেরা বাৎ দো চার/ ইস মেঁ হোগা বিচার।।/...ভাতুয়া বাংগালি মছলিখোর/ ছুট গিয়া অব তুঁহারা জোর,/ মেরা হাত মেঁ কানুন কা ডোর/ বানা দেউঙ্গা ডাকু-চোর।...” দুর্ভাগ্যবশত এই কার্টুনটি অবশ্য আমরা পাইনি, তবে কবিতার এই নমুনাটি পেয়েছি নলিনীকান্ত সরকারের ‘দাদাঠাকুর’ গ্রন্থটি থেকে।

মান্দালয় কারাবাস থেকে সুভাষ মুক্তি পান ১৯২৭ সালে। এই ঘটনার মাত্র এক বছর পরে ১৯২৮ সালের শুরুতে কলকাতায় সিটি কলেজের ছাত্রাবাসে সরস্বতী পূজার অনুমতি না মেলায় কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের মধ্যে যে বিরোধ বাধে, তাতে সুভাষচন্দ্র ছাত্রদের পক্ষ সমর্থন করলে প্রচুর আলোড়নের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ, সি এফ এন্ড্রুজ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কলেজের ব্রাহ্ম পরিচালকদের পক্ষে কলম ধরেন। অন্যদিকে সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ব্যঙ্গবাণের লক্ষ্য হয়ে পড়লেন সুভাষচন্দ্রএই কাগজটিতে তাঁকে ‘খোকা ভগবান’ নাম দিয়ে লেখা হলো :- “খোকা ভগবান নামে/ গজানন  বঙ্গধামে/ সম্প্রতি খুলেছে রাজ্যপাট।...” [‘মর্ত্য হইতে সরস্বতী বিদায়’]। পত্রিকাটির এ সময়কার সুভাষ বিষয়ক কবিতার কিছু নমুনা সম্পাদক সজনীকান্ত তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’তে সংকলিত করেছেন। এমনই একটি নমুনায় সুভাষচন্দ্রকে ‘হিন্দুয়ানির পান্ডা পাঁড়’ আখ্যা দিয়ে অ্যালবার্ট হলে তাঁর বক্তৃতাসভার বর্ণনাঃ- “খোকা ভগবান আসিল নিজে,/ চোখের জলেতে বেজায় ভিজে।/ বুকেতে কি জানি ঘটিল দোষ,/ সাক্ষী কুলীন বৈদ্য বোস।/ দেবদ্বিজে অতি ভক্তিমান/ সন্ধ্যা করিয়া তামাক খান/...গোটে গোটে ছোটে খোকার বাণী/ নববেদ বলে তারে বাখানি। ...বিবাহযোগ্যা পাননি কনে/ কেহ নাই বামে সিংহাসনে।.../ হিন্দুয়ানির পান্ডাপাঁড়/ জয়রব তাই উঠিল তাঁর ইত্যাদি [ ‘ধর্মরক্ষা’]

এই বছরেই ডিসেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে সামরিক কায়দায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে সুভাষচন্দ্র আবার আলোড়ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করলেন।



এই কাজ এক দিকে যেমন মুগ্ধ বিস্ময়ের চমক সৃষ্টি করল, তেমনই এই স্বেচ্ছাসেবীদলের পোশাক, কুচকাওয়াজ ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনাও শুরু হলোগান্ধী একে আখ্যা দিলেন ‘খালাসিদের তামাশা’ [সেলার্স সার্কাস] বলে আর  রবীন্দ্রনাথের মতেও এ ছিল প্রহসন বা ‘ভাঁড়ামি’! আনন্দবাজার পত্রিকার ‘নন্দীভৃঙ্গী’ অবশ্য নানা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রকে ‘সুভাষিনী’ বানিয়ে মশকরা করলেও এই ভলান্টিয়ার্স বাহিনীর শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য সুভাষচন্দ্রের প্রশংসাই করেছিল। কিন্তু অন্য পত্রিকাগুলির রঙ্গব্যঙ্গ ক্ষান্ত থাকেনি, যার কিছু নিদর্শন সংকলিত হয়েছে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র’ বইটির দ্বিতীয় খন্ডে। এই কলকাতা অধিবেশনেই যুব কংগ্রেসের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র যুবসমাজের ওপর সবরমতি ও পন্ডিচেরি আশ্রমের প্রভাবের সমালোচনা করে আর একটি বিতর্কেরও সূত্রপাত করেছিলেন। এই বক্তব্যকেও কটাক্ষ করেছিল আনন্দবাজার সহ অন্যান্য পত্রিকা। মাসিক বসুমতী-তে বের হয়েছিল সত্যেন্দ্রকুমার বসুর ‘ইনফ্যান্ট কংগ্রেস’ নামে এক সচিত্র ব্যঙ্গরচনা। ইয়ুথ কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের ভাষণকে লক্ষ্য করে ‘বয়স্কদের দ্বারা পীড়িত’ শিশুদের জবানিতে লেখা হয় –  “দেশের ইয়ুথগণকে ভবিষ্যতের আশাভরসা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। এই অপমান কি আপনারা চুষিকাঠি চুষিতে চুষিতে সহ্য করিবেন?... ইয়ুথেরা কল্যকার নাগরিক, আমরা তৎপরদিনের নাগরিক।... অতএব ...নাগরিক বা নাগরিকার অধিকার একমাত্র ইনফ্যান্ট পুরুষ ও ইনফ্যান্ট নারীগণের প্রাপ্য। ...ইহা হইতে বঞ্চিত করিতে আসিলে আমরা দন্ত-নখাদিরূপ অহিংস অসহযোগ অস্ত্র দ্বারা অথবা ক্রন্দন-কোলাহলরূপ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দ্বারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত করিব। ...পলিটিক্স বা রাজনীতি ক্ষেত্রে আমরা পিতা, অভিভাবক বা গুরুজনের শাসন মানিব না স্বাধীনতাই জীবন, ...স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে!...” ইত্যাদি।

আবার কলকাতা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবীদলকে উপলক্ষ্য করে সুভাষচন্দ্রকে ব্যক্তিগত  আক্রমণের মাধ্যমে সবচেয়ে কদর্য ব্যঙ্গের বন্যা বয়ে গেল ‘শনিবারের চিঠি’র পাতায়। সম্পাদক সজনীকান্ত, যাকে দা’ঠাকুর বলতেন ‘নিপাতনে সিদ্ধ’, তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতা নিয়ে আবির্ভূত হলেন সুভাষকে নিপাতিত করতে। এর ‘বিশেষ সাইমন সংখ্যা’তে সংবাদ সাহিত্য বিভাগে একটি কবিতায় সুভাষচন্দ্রের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি, গান্ধীনীতির বিরোধিতা ইত্যাদি থেকে শুরু করে  স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর পোশাক ইত্যাদি সব কিছুকেই ব্যঙ্গবাণের নিশানা করা হয়। শুধু এ-টুকুই  নয়, সুভাষচন্দ্রের বিদ্রোহকে একটা প্রাদেশিক চেহারা দেবার কেমন চতুর চেষ্টা করা হয়েছিল এই সব কবিতায় তার একটু নমুনাঃ- “সেলাম নেহরু, কেটে পড় বাছা,/ সেলাম বৃদ্ধ গান্ধী/ হাফপ্যান্টের নাই বটে কাছা/ তবুও কোমরে বান্ধি-/ বুকে জোর থাকে চলে এস সাথে/ স্বাধীনতা শুধু কাম্য-/ স্বাধীনতা ধ্বজা ধর এক হাতে/ আর হাতে ধ্বজা সাম্য,/ মুখে কহ শুধু জয়তু বঙ্গ, জয়তু সুভাষচন্দ্র,/ নতুবা দাও হে পৃষ্ঠভঙ্গ, যে হও তামিল অন্ধ্র!...”  এর সঙ্গে যোগ হয়েছে  সুভাষচন্দ্রকে লক্ষ্য করে সরাসরি বিদ্রুপঃ-“ হে চিরতরুণ ধন্য,/ গান্ধী নেহরু  হইল হদ্দ/ তুমি এলে সেইজন্য।/ শোভে ঝলমল জরির পোষাক/ রাবড়ি সেবিত অঙ্গে,/ শিখ মারাঠিরা বিষম অবাক/ মিলিটারি দেখে বঙ্গে!” উদ্ধৃত অংশে ‘বুকে জোর থাকে...’ ইত্যাদি ইঙ্গিতের অর্থ হলো সুভাষচন্দ্রের ‘বুকের অসুখ’ অর্থাৎ যক্ষ্মারোগের প্রতি কটাক্ষ, যা অন্য কবিতায়ও আমরা দেখেছি। এখানে ‘শনিবারের চিঠি’ থেকে আরো কিছু পদ্য ও গদ্য-নমুনা দেখা যেতে পারে। ‘সোনার বাংলা’  শীর্ষক এক কবিতার কিছুটা :-“হেথা জাতীয় সমরে যুবা সৈনিক/ যেন পারাবত লক্কা।/ কারো ভাঙা শিরদাঁড়া, সম্বল কারো/ ঘূণ ধরা বুকে যক্ষ্মা।” এর পর দেখা যেতে পারে ‘আবার উটরাম সাহেবের টুপি’ নামে একটি গদ্যরচনার অংশঃ- “ইতিমধ্যে কলিকাতা কংগ্রেস আসিয়া পড়িল। বিরাট আয়োজন, বিষম হট্টগোল, হৈ চৈ। বাংলা মায়ের কোলজোড়া ছেলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে বাংলার বজাগ্রত তরুণ সংঘের দুইজন বা ততোধিক একত্রিত হইলেই ফাঁকা জায়গা দেখিয়া লেফট রাইট ক্রমে তালে তালে পা ফেলিয়া চলিতে লাগিল। সুবিখ্যাত ‘দেশবন্ধু বাস’ তরুণী ভলান্টিয়ারদের লইয়া পাড়ায় পাড়ায় হানা দিতে আরম্ভ করিল। ‘নেশানাল’ সৈন্যদলের জন্য ৮০০০ জোড়া বুট ও হাজার হাজার জোড়া খদ্দরের মিলিটারি হাফ প্যান্ট ও সার্টের অর্ডার চলিয়া গেল। খদ্দরের ক্যাপ ও পিস্তল রাখার খাপ তৈয়ারী হইতে লাগিল। বিউগাল ও বংশীধ্বনিতে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিল। পথে ঘাটে নূতন জাতীয় সঙ্গীত ঐকতান-সহযোগে শ্রুত হইতে লাগিল- ‘কে আবার  বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে’! ‘ফরোয়ার্ড’ ও ‘বাংলার কথা’য় নোটিশের উপর নোটিশ। সেনাধ্যক্ষ সুভাষচন্দ্র নিজের বুকের দোষের কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়া ডাক্তারের সাহায্যে ভলান্টিয়ার সৈন্য বাছিতে লাগিলেন। যাহারা উচ্চতায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির চাইতে কম এবং যাহাদের বুকের মাপ ৩৪ ইঞ্চির বেশি নহে তাহারা অমনোনীত হইয়া কাঁদিতে লাগিল।...”

‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকায় সুভাষচন্দ্রকে মাইকেল কলিন্সের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল বলে সে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র মশকরা :- “মাইকেল কলিন্স আয়র্লন্ডের জাতীয় সৈন্যদলের নায়ক ছিলেন, সুভাষবাবু ভারতবর্ষের নবজাগ্রত জাতীয়তার মাংস-প্রতীক। মাইকেল কলিন্স গুলির আঘাতে মরিয়াছেন, সুভাষবাবু মরেন নাই বটে, কিন্তু বুকের দোষে মরিতে বসিয়াছিলেন। দুইজনের মধ্যে সাজের কিছু তফাত আছে, পিস্তল আর লাঠির তফাত মাত্র। জরীর কাজগুলি তরুণের নেতার পক্ষে তরুণীর শিল্পটীকা। মাইকেল কলিন্স মরিয়াছেন, সুভাষচন্দ্র বাঁচিয়া আছেন। সুভাষচন্দ্রের জয় হউক।” এই সব কলমের চিমটির সঙ্গে ব্যঙ্গচিত্রীর তুলির খোঁচাও পত্রিকাটি পরিবেশন করেছিল। একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে যে,সামরিক পোষাকে সজ্জিত সুভাষ বীরের ভঙ্গিমায় কংগ্রেস অধিবেশনের মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে লেখা- ‘বন্দে মাতরং’



ছবিটির ইঙ্গিত এতই  স্পষ্ট যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। আর একটি ছবিতে শুধু স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং [জিওসি]-এর ইউনিফর্ম পরিহিত সুভাষচন্দ্রকে চিত্রিত করা হয়েছে, নিচে লেখা ‘গক’।



এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এই ‘গক’ শব্দটি  সজনীকান্ত তৈরি করেছিলেন ভলান্টিয়ার বাহিনীর অধিনায়ক সুভাষের পদমর্যাদার ইংরেজি আদ্যাক্ষরগুলি [জি ও সি] থেকে। শনিবারের চিঠির এই লেখাগুলোর  প্রথম সমালোচক শঙ্করীপ্রসাদ বসু যথার্থই বলেছেন যে, মানুষের রোগব্যাধি নিয়ে ব্যঙ্গ করা যে সভ্যরীতি-বিগর্হিত, তা শনিবারের চিঠির সুসভ্য লেখকেরা ভুলে গিয়েছিলেন।

কংগ্রেসের এই স্বেচ্ছাসেবকদলে সুভাষচন্দ্র যে সমস্ত বিপ্লববাদীদের স্থান দিয়েছিলেন, তাদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে শনিবারের চিঠির ‘Goes অ্যাং Goes ব্যাং’ নামক  এক কবিতায় লেখা হলোঃ- “সেই শ্রীমান খোকারে ঘিরিয়া যতেক ডাকাতের হল  gang-/ পাকা গুরু হয়ে সেথা নয়া ভগবান/ বাড়াইয়া আছে ঠ্যাং।...” [‘শনিবারের চিঠি, ভাদ্র, ১৩৩৫]। এই সব কবিতায় হাস্য ও ব্যঙ্গরসের সঙ্গে কী  ভাবে “কিছু ভাবরসের মিশালও করা হয়েছিল”, শঙ্করীপ্রসাদ বসু তারও কিছু নমুনা উপস্থিত করেছেন রাবীন্দ্রিক ঢঙে রচিত এক কবিতায় গান্ধীকে যথাসাধ্য  মহিমান্বিত করে তাঁর মুখ দিয়ে সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশে নিম্নরূপ ভর্ৎসনাবাক্য উচ্চারিত হয়েছিল :- “আপন গৌরবে/ স্থাপিয়াছ আপনার বেদী,/ নহে দীনা জননীর।/ ..., বিচিত্র আলোকমালা/ সাজাইয়া দেশবন্ধুধামে/ দরিদ্রের অর্থ লয়ে/ খেলিছ পুতুলখেলা।.../ সেজেছ বিচিত্র বেশে,/ প্যান্টকোটে সুশোভিলে দেহ/ বহু মুদ্রা ব্যয় করি।...”

স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অধিনায়ক সুভাষচন্দ্রের পোশাকের বর্ণনায় শনিবারের চিঠি কলম বারবার প্রলুব্ধ হয়েছে, এমন কি, কুৎসিত ভাষায় তাঁকে ‘সিংহচর্মে শোভিত রাসভ’ আখ্যা দিতেও এই কাব্য-তীরন্দাজেরা কুন্ঠিত হননি! এরকম তীরন্দাজির আর একটি নিদর্শনঃ- “মহাবীর সেনাপতি/ কভু বা অশ্বে কভু সহাস্যে মোটরে উধাও গতি।/ স্বাধীনতা টুপি পড়েছেন শিরে,/ উপুড় কলসে কাপাসের বিঁড়ে/ অশ্বপৃষ্ঠে আঁখি ভাসে নীরে,/ রথে চলে মহারথী।...” কবিতাটির শেষে ‘নিয়তির  ঝোড়ো নিঃশ্বাস’ বইয়ে দিয়ে লেখা হয়েছিল - শুধু হাসে মহাকাল,/ জেলের  কয়েদী করিছে বিবাহ মুকুটে শোভিত ভাল!/ ফোঁটাচন্দন কাটিয়া ললাটে/ ভিখারী সহসা বসে রাজপাটে/ যেতেছে ভুলিয়া নিমেষের ঠাঁটে/ চিরদিবসের হাল।” ইত্যাদি। এই সূত্রে আমাদের আবার উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সঙ্গত মন্তব্যঃ- “হাঁ- শুধু হাসে মহাকাল! অবশ্যই! শনিবারের চিঠির সম্পাদক বহুদিন পরে অনুতপ্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে লিখবেন – একদিন সুভাষচন্দ্রকে ‘গক’ বানিয়ে  কতই কৌতুক করেছিশ্রদ্ধেয় সেই বিলম্বিত মহত্ত্ব!”  

এই ঘটনার পরেও আরও দশ বছর সুভাষচন্দ্র ভারতে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং এই সময়টিও ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। নির্বাসন, কারাবরণ কংগ্রেসের সভাপতিরূপে জাতীয় জীবনের শীর্ষে আরোহন ও সেই আসন ত্যাগ করেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গবিন্দুতে অবস্থান করে তিনি আগাগোড়া সংবাদের শিরোনাম হয়ে থেকেছেন। স্বাভাবিভাবেই ওই সব ঘটানাকে উপলক্ষ্য করে নিশ্চয়ই দেশের  সংবাদপত্রে যথেষ্ট সংখ্যক কার্টুনও প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো সংকলন ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত এ জাতীয় কাজ আমাদের দেশে তেমন চোখে পড়েনি। সুপরিচিত কার্টুনিস্ট কুট্টি এ বিষয়ে ‘আজকাল’ পত্রিকায় নেতাজির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি রচনায় জানিয়েছিলেন যে, তিনি ও তাঁর গুরু শঙ্কর সুভাষচন্দ্রকে  নিয়ে চল্লিশের দশকে হিন্দুস্থান টাইমস, ন্যাশনাল হেরাল্ড ইত্যাদি কাগজে অনেক কার্টুন এঁকেছেন। তিনি লিখেছিলেন, “গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতবিরোধে কংগ্রেস ভাঙল। আমি ও আমার বন্ধুরা সুভাষবাবুর ব্যক্তিত্ব ও প্রগতিশীলতায় উদ্বুদ্ধ হই। আমাদের যৌবন তাঁকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। মনে পড়ছে, আমার গুরু প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট শঙ্কর সে সময় বেশ কয়েকটি কার্টুন আঁকেন। আমিও সুভাষ বসুকে নিয়ে কিছু কার্টুন আঁকি।”

১৯৪০ সালে যখন কংগ্রেস থেকে গান্ধী ও তাঁর অনুগামীরা সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কার  করেন, তখন তা নিয়ে শংকর ‘হিন্দুস্থান টাইমসে’ একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। তার বর্ণনা শোনা যাক কুট্টির থেকেঃ- “শঙ্করের কার্টুনের প্রেরণা ছিল বিখ্যাত একটা চিত্রকর্ম। ‘বেলারোফান জাহাজে নেপোলিয়ন’। ইউরোপীয় দেশগুলোর দলবদ্ধ আক্রমণে ওয়াটারলুতে পরাস্ত হয়েছেন নেপোলিয়ন। হতমান, নিঃসঙ্গ সেই বীরকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। এই ছিল ছবিটা। শঙ্কর আঁকলেন সুভাষবাবুকে নেপোলিয়নের ভূমিকায়। একা দাঁড়িয়ে আছেন জাহাজের এক প্রান্তে। মাস্তুলের কাছেই কংগ্রেসের নেতারা। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। এঁরা নেতাজির বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন। একটা কার্টুনই সব বলে দেয়।” এই কার্টুনটিকে স্মৃতি থেকে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন কুট্টি, যা তাঁর ওই লেখাটির সঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছিল।



 [‘নেপোলিয়নের আদলে নেতাজি’/ আজকাল, ২৩-১-১৯৯৭] এখানে শঙ্করের কার্টুনের প্রেরণা হিসেবে নেপোলিয়নের যে ছবিটির কথা কুট্টি উল্লেখ করেছেন, সেটি ১৮৮০ সালে স্যার উইলিয়ম কুইলার অরচার্ডসনের আঁকা। 



এখানে আমাদের আলোচ্য সর্বশেষ ছবিটিও ১৯৪০ সালের, প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের কম্যুনিস্ট নেতা পি সি যোশির ‘whom, how & why does Bose fight?’ শীর্ষক একটি লেখার সঙ্গে, যা ছাপা হয়েছিল বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘Unmasked Parties and Politics’ নামে এক সঙ্কলনে। আমরা এই কার্টুনটি যে লেখাটিতে পেয়েছি সেটি হলো ‘দি ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত  [১-৪-১৯৮৪] অরুণ শৌরির ‘The great betrayal’এতে দেখা যাচ্ছে, যোগাসনে বসে আছেন গান্ধী, আর তাঁর কাছ থেকে একটা ভেড়া নিয়ে যাচ্ছেন  সুভাষচন্দ্র, তাঁর মাথায় গ্রীক কায়দায় ফুলের মুকুট, ভেড়াটার গায়ে লেখা ‘সত্যাগ্রহ’ আর সুভাষ গান্ধীকে বলছেন, “Not You! But ME! And the Goat I take over!” [ছবি-৫] যেহেতু লেখাটিতে এই কার্টুনটি সম্পর্কে কোনও আলোচনাই নেই, তাই ঠিক কি প্রসঙ্গে এটি আঁকা, তা পরিষ্কার বোঝা যায় না। সাধারণ ভাবে মনে হতে পারে, গান্ধীর সংগ্রামবিমুখতা নিয়ে সুভাষচন্দ্রের  অভিযোগকে কটাক্ষ করা হয়েছে। 


এটি যদি ত্রিপুরী কংগ্রেস পর্বে সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের কাছে গান্ধীপন্থীদের পরাজয় উপলক্ষ্যে আঁকা হয়ে থাকে,  তবে সুভাষের মাথায় মুকুটের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আর যদি এটি ১৯৪০ সালের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে আঁকা হয়ে থাকে, তবে মনে রাখতে হবে, এ সময় ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে শামিল হবার জন্য গান্ধীর ওপর চাপ দিচ্ছিল কংগ্রেসের  সোশ্যালিস্ট দল, কিষাণ সভা, সুভাষচন্দ্রের নবগঠিত ফরোয়ার্ড ব্লক, কম্যুনিস্ট  পার্টি প্রভৃতি। কিন্তু গান্ধী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের চেয়ে বেশি কিছু করতে প্রস্তুত  ছিলেন না। কম্যুনিস্টরা সুভাষচন্দ্র-সংগঠিত বাম সমন্বয় কমিটিতে অল্প কিছুদিনের জন্য যোগ দিলেও পরে তারা তাঁর নানারকম সমালোচনা শুরু করে। ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র যখন রামগড়ে আপোষবিরোধী সম্মেলন করছেন, অক্লান্তভাবে ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন, কলকাতায় পরিচালনা করছেন হলওয়েল মনুমেন্ট তুলে দেবার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে, তখনও কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রতি প্রায়ই তোপ দাগা হচ্ছে ও তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনীহা ও শুধু শ্লোগান-নির্ভরতার অভিযোগ আনা হচ্ছে! কার্টুনের সঙ্গে ছাপা যোশির এই লেখাটি আমরা উদ্ধার করতে না পারলেও এর শিরোনাম থেকে আন্দাজ করা যায় যে, এটির বক্তব্যও ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রতি সমালোচনামূলক।

এর পরবর্তী পর্বে যখন সুভাষচন্দ্র অক্ষশক্তির সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ বিতারণের পরিকল্পনায় জাপানে উপস্থিত হন ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন করেন, তখন ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির লেখাপত্রে ও ব্যঙ্গচিত্রে আরও তীব্র ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেগুলি ভারতের ইতিহাসের একটি পরিচিত অধ্যায় ও আমাদের বর্তমান আলোচনার পরিসরের বাইরে।
       














অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

সহিষ্ণুতা, আধাসহিষ্ণুতা, অসহিষ্ণুতা বিষয়ে কিছু প্রলাপ  


                                                                                                         গভার্নিং ইন্ডিয়া শীর্ষক একটি আধা-আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে চেয়ার করার সময় প্রায়শঃই টলার‍্যান্স কথাটি ঘুরে ফিরে আসছিল। আসবেই! কেননা সহিষ্ণুতা/অসহিষ্ণুতা এখন বহু আলোচিত বিষয়, আর আজকের স্মার্ট কর্পোরেট সমাজবৈজ্ঞানিক ভাষায় তার ‘টেমপ্লেট’গুলিও বহু চেনা। যেমন গরু বনাম ছাগমাংস ভক্ষণ, গজেন্দ্র বনাম ভালো কেউ পুণে ফিল্ম ইন্সটিটুটে, আমির বনাম অমিতাভ ইনক্রেডিব্‌ল ইণ্ডিয়ায়। এক  অংশগ্রাহী বিশ্ববিদ্যালয়  অধ্যাপক এই আলোচনায় একটা খুব দামি কথাও বললেন — যে সহিষ্ণুতা কোনো স্থৈতিক (আমার নিজস্ব বাংলায়, উনি বলেছিলেন স্ট্যাটিক) ব্যাপার নয়। যে কোনো দেশে যে কোনো সময় তার ওঠাপড়া আছে। এটা আমারো খুব পছন্দের কথা। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, তার প্রধান দলের আর তুতো ভাইদের অনেক কথায়, কার্যকলাপে অসহিষ্ণুতার কথা বারবার উঠছে। সত্যি হয়তো এই কালে অসহিষ্ণুতার দাপট বেড়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পরমপ্রিয় ম্যারিকান দাদা পর্যন্ত তা নিয়ে মন্তব্য করতে ছাড়েননি। আর ‘কানগ্রেস’ থেকে বাম অনেক দলই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে অনেক কথা বলছে। এমনকি সহিষ্ণুতা আর অসহিষ্ণুতা প্রত্যাসন্ন বিধানিক নির্বাচনগুলিতে আর বেশ কিছু দূরে লোকসভা নির্বাচনে জোটগঠনে বেশ একটু প্রভাব ফেলবে, রাজনৈতিক বর্ণালীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেশ কিছু অস্বভাবী দলকে চমকপ্রদভাবে কাছে এনে দেবে, এমনও বোঝা যাচ্ছে।

ছাত্রজীবনে উত্তর মুখস্থ করার থেকে বই পড়ার ভুল সিদ্ধান্ত (যার শাস্তি বহুভাবে পেয়েছি আর যার জন্য বুদ্ধদেব বসুর নায়কদের ও তাদের স্রষ্টাকে দুষি আর ভালোবাসি) আমাকে আলোচনাচক্রে, কনফারেন্সে আর লেখার পাতায় চটজলদি ‘কোট’ করার বেশ কিছু সুবিধা দেয় তার সাহায্য নিয়ে আমি ওই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের কথা চেয়ার থেকে লুফে নিয়ে বললাম, যে কোনো দেশে আর যে কোনো সময়ে সহিষ্ণুতা আর অসহিষ্ণুতার একটি গ্রাফ থাকে। বলা ভালো একটি রৈখিক স্কেল, যার লাইনের একদিকে দুপ্রান্তে থাকে জিরো টলার‍্যান্স আর হান্ড্রেড ইনটলার‍্যান্স, আর  অন্যদিকে থাকে ইনটলার‍্যান্স আর হান্ড্রেড টলার‍্যান্সএকটা দেশকে, কিম্বা এই দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশকে এই রৈখিক স্কেলে তার রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ‘প্লট’ করা যায়। যে পশ্চিমকে বিশেষতঃ ইংল্যাণ্ডকে আমরা টলার‍্যান্স বা সহিষ্ণুতার পীঠভূমি মনে করি সেখানেও রাজনৈতিক চিন্তায় কি ব্যবহারিক রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার সীমা কখনোই অসীম ছিল না

চেয়ার থেকে বক্তিমা মানায় না বলেই আমার চিন্তার বাকি অংশটি মনে রেখেছিলাম কোথাও লেখার জন্য। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমার কালিমাটির কিস্তি বাকি। লাস্ট  ডেট প্রত্যাসন্নএখানেই আমার সীমিত পাঠকদের জ্বালানো যাক! তো যা বলছিলাম। সহিষ্ণুতা/অসহিষ্ণুতা চিন্তায় পশ্চিমি দুনিয়ায় যে সব মাইলপ্রস্তর আছে, তাদের মধ্যে  অনেকগুলি ভুল নামেতে বা ভুল মানেতে চলে। আবার কিছু বই আছে যেগুলি সীমিত পাঠের ভিত্তিতে আংশিক অনুধাবনে চলে। যেমন একটি কথা যা পরমতসহিষ্ণুতার চুম্বক হিসেবে পরিচিত যথা I do not agree with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it  চলে ভলটেয়ারের নামে কিন্তু এই বিশেষ কোটটি Evelyn Beatrice Hall (1868-1956)-এর আত্মজীবনী থেকে এক ‘মিসকোট’ Hall সেখানে নাকি বলছেন যে Helvetius-এর De L’Esprit বা On The Mind বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর শত্রুরা যখন তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, তখন Helvetius-এর অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত সমস্ত অন্যায় মাপ করে দিয়ে ভলটেয়ার নাকি বলেছিলেন, ‘What a fuss about an omelette! How abominably unjust to persecute a man for such an airy trifle as that এ কথা ধরিয়ে দেওয়ার এই অর্থ নয় যে ভলটেয়ার সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং পরমতসহিষ্ণুতার অন্য নাম বলেই বোধহয় ভলটেয়ারের নামে এই ‘কোট’ চলে গেছে। ভলটেয়ারের Treatise on Tolerance on the Occasion of the Death of Jean Calas from the Judgment Rendered in Toulouse (1763) বইতে আছে নিজের ছেলেকে ক্যাথলিক চার্চে যোগ দেওয়া থেকে আটকাতে তাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত প্রোটেস্ট্যাণ্ট পাদ্রী Jean Calas-এর বিচার এবং প্রাণদণ্ডকে নিয়ে আলোচনায় ভলটেয়ারের কিছু অসাধারণ কথা। যেমন:

ইউরোপে প্রায় চল্লিশ মিলিয়ন অধিবাসী আছে যারা চার্চ অভ রোমের সদস্য নন। আমরা কি তাঁদের সকলকে বলব, মশায়, যেহেতু আপনারা অভ্রান্তভাবে অভিশপ্ত  অতএব আমি আপনাদের সঙ্গে খাবো না, বাক্যালাপ করব না, কিম্বা অন্য কোনো রকমের সংস্রব রাখব না? 
ওহে এক শান্তিপূর্ণ ঈশ্বরের বিভিন্ন পূজক! তোমাদের হৃদয় সত্যি নিষ্ঠুর। কেননা তোমরা সেই ঈশ্বরের পূজা করতে করতে অন্যদের কষ্ট দাও, যেকালে তাঁর সমস্ত  নীতিনির্দেশ এই কটি কথা দিয়ে তৈরি “ঈশ্বরকে আর তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”
  
আমি দেখি আমাদের যুগের সঙ্গে সমস্ত মৃত অতীত যুগকে তাঁর উপস্থিতির মধ্যে আবির্ভূত হতে। তুমি কি নিশ্চিত যে আমাদের স্রষ্টা জ্ঞানী এবং পুণ্যাত্মা কনফুসিয়াস, আইনদাতা সোলন, পিথাগোরাস, যালেউকাস, সোক্রাতিস, প্লেটো, দিব্য অ্যান্টোনিয়াস, সদাশয় ট্রাজান, মানুষদের সব আনন্দ, এপিক্টিটাস আর অন্য সব দৃষ্টান্তপ্রতিম মানুষদের বলবেন, “যাও দানবরা, সেই সব নিপীড়ন ভোগ কর যারা তীব্রতা আর কালিক ব্যাপ্তিতে আমার মতোই শাশ্বত। কিন্তু তোমরা আমার প্রিয় জন চাতেল, র‍্যাভেইল্যাক,   দামিয়েন্স, কার্তুস ইত্যাদি যারা আমার আমার বলে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী মরেছো, তারা আমার ডাইনে বস আর আমার সাম্রাজ্য আর সুখ ভাগ করে নাও” এই কথাগুলো শুনেই তোমরা ভয়ে শিহরিত হয়ে পিছিয়ে যাও, আর এগুলি আমার মুখ থেকে নির্গত হয়ে যাওয়ার পর আমার আর কিচ্ছু বলবার নেই তোমাদের। এই সবই পরমতসহিষ্ণুতার, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভালো ভালো কথা, আর বলার জন্যে ভলটেয়ারকে বাধাই! কিন্তু পরমতসহিষ্ণুতার আরেক বিখ্যাত দিগ্দর্শক  বই জন লকের A Letter Concerning Tolerance (1689)-তে সহিষ্ণুতাকে সমাজের সব অংশে, সব ধর্মের প্রতি পরিব্যাপ্ত করা হলেও মহম্মদীয়রা এই সহিষ্ণুতা বলয়ের বাইরে তাদের রাষ্ট্রাতিগ আনুগত্যের জন্য। লক এমনকি যারা পৌত্তলিক ও পেগ্যান তাদেরকেও সহিষ্ণুতা দিতে রাজি। তাঁর কথায়, ‘Now, whosoever maintains that idolatry is to be rooted out of any place by laws, punishments, fire and sword, may apply this story to himself. For the reason of the thing is equal, both in America and Europe and neither Pagans there, nor any different Christians here, can, with any right be deprived of their worldly goods, by the predominant faction of a court-church, nor are any civil rights to be either changed or violated on account of religion in one place more than anotherএমনকি যদি কেউ পৌত্তলিকতাকে ‘পাপ’ বলে শাস্তি দেওয়াতে চায় সেও সমর্থনীয় নয়। কারণ ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার নেই ‘to make use of his sword in punishing  everything indifferently, that he takes to be a sin against God’যেমন লোভ, অ-বদান্যতা, আলস্য, মিথ্যাভাষণ, শঠতা, শপথভঙ্গ এইসব সমস্ত মানুষের সম্মতিক্রমে  পাপ। তবুও তা অন্যদের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনা বলে অথবা সমাজের সার্বজনিক শান্তি লঙ্ঘন করেনা বলে ম্যাজিস্ট্রেট তার বিচার করতে পারেন না।


কিন্তু এই সহিষ্ণুতা মহম্মদীয়দের বরাতে জুটবে না, যেহেতু যে কোন ধর্মব্যবস্থা যা এমন ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে যে যারা এতে প্রবেশ করে তারা নিজেদের অন্য রাজনের সেবা এবং সুরক্ষার সামিল করে, তার অধিকার নেই ম্যাজিস্ট্রেটের সহিষ্ণুতা পাওয়ার। কারণ তাদের সহিষ্ণুতা দেওয়ার অর্থ ম্যাজিস্ট্রেট নিজের দেশে বিদেশী এখতিয়ারকে কায়েমি বা থিতু হতে দেবেন। রাজসভা এবং চার্চের লঘু ও চপল পার্থক্য এখানে অনুমত নয়, যেখানে ‘both the one and the other are subject to the absolute  authority of the same person who has not only power to persuade the members of his church to whatever he lists, (either as purely religious or as in order thereunto) but can also enjoin it on pain of eternal fire’ লকের মতে এটা হাস্যকর যে কোনো মহম্মদীয় নিজেকে কেবল ধর্মীয় ব্যাপারে ‘Mahometan’ আর সব ব্যাপারে কো্নো খ্রিস্টান ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি বিশ্বস্ত  বলছে, যেকালে একই সময়ে সে নিজেকে কনস্ট্যান্টিনোপ্‌ল এর মুফতির প্রতি অন্ধ আনুগত্যে আবদ্ধ বলে স্বীকার করে নিচ্ছে, যিনি আবার অটোমান সম্রাটের প্রতি বাধ্য আর নিজের ভাণ করা ধর্মীয় নির্দেশগুলি তাঁরই মর্জিমাফিক জারি করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে লকের সহিষ্ণুতার ধারণা সমসাময়িক ইউরোপের মহাদেশীয় রাজনীতিতে  খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের লড়াইয়ের দ্বারা কতখানি প্রভাবিত, আর তাঁর সহিষ্ণুতার তত্ত্বও খ্রিস্টীয় ও চার্চ স্টেটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দ্বারা কতখানি প্রভাবিত ছিল।

ব্রিটেনে সহিষ্ণুতার সীমা কেবল A Letter Concerning Tolerance বইয়ের এরকম দুয়েকটি গোলমেলে বাক্যে, কেবল ধর্মীয়  সহিষ্ণুতার মধ্যে না খুঁজে যদি বাস্তব সমাজে, রাজনীতিতে, পরমত বা ‘অপর’-এর ব্যাপারে সহিষ্ণুতার মধ্যে খুঁজি, তবে দেখব  আজকের ব্রিটেনে পরমতসহিষ্ণুতার বিখ্যাততম টেমপ্লেট, হাইড পার্ক; এবং তাতে যার যা কিছু বিষয়ে বক্তিমার অধিকার, এমনকি যখন তা কখনো কখনো একটু পারসোন্যাল হয়ে যায়, তখনো তাতে বাধা দেওয়ার রেওয়াজ নেই! কিন্তু এই অধিকার মসৃণভাবে আসেনি! ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি ভোটাধিকারের প্রসারণ বিষয়ে বিলের প্রথম খসড়া পার্লামেন্টে পরাস্ত হবার পর রিফর্ম  লীগ নামে এক সংস্থার নেতৃত্বে যে দেশব্যাপী আলোড়ন হয়, তাতে শ্রমিকরা হাইড পার্কে জমায়েত হতে চাইলে তাদের ছলে-বলে-কৌশলে আটকাতে সব্বাই সামিল হন। জন স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত সেই বিশাল মিটিং করা হয় ইসলিংটনের অ্যাগ্রিকালচারাল হলের সীমিত পরিসরে, চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে। বিখ্যাত ইংরেজ কবি ম্যাথিউ আর্নল্ড তাঁর Culture and Anarchy বইতে তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেন: ‘just asserting his personal liberty a little, going where he likes, assembling where he likes, bawling as he likes, hustling as he likes’ অনেক আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই হাইড পার্ক আজকের হাইড পার্ক হয়ে উঠেছে! বিশ্বাস না হয় দেখুন রেমণ্ড উইলিয়ামসের Problems in Materialism and Culture (1980) বইয়ের ‘A Hundred Years of Culture and Anarchy’ প্রবন্ধ! এর থেকে অন্য কিছু হওয়ার ছিলো! ‘Survival of the fittest’ নামে যে ভুল কোট Herbert Spencer-এর হওয়া সত্ত্বেও Darwin-এর আধ-বোঝা ‘natural selection’ তত্ত্বের কারণে তাঁর নামে চলে আসছে, যার থেকে ‘Social Darwinism’ নামের ঘৃণ্য তত্ত্বের উৎপত্তি, যার ফলে যারা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বঞ্চনার ফলে বুদ্ধি তথা মেধা নামের বস্তুগুলির ক্ষেত্রে পিছিয়ে, তাদের ক্ষেত্রে চরম উপেক্ষা ও অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়েছিলো! Darwin নিজেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে পুরোপুরি মেনে নেননি, যার ফলে একটি চিঠিতে তাঁর সম্পর্কে এক সংবাদপত্র নিবন্ধে ভুল প্রশংসাকে শ্লেষ করে’ তিনি লিখেছিলেন শক্তিই যদি সর্বদা ঠিক হয় তবে নাপোলিয়ঁ ঠিক করেছেন এবং প্রত্যেক ঠক দোকানদার ঠিকই করেতাতে করে কিন্তু অসহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি ‘Social Darwinism’-এর বাড়বাড়ন্ত কমেনি। বিখ্যাত মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ W. G. Sumner ১৮৮০-র দশকে বলতে শুরু করেন সভ্যতা যদি ‘Survival of the fittest’ হয়  তবে ‘Survival of the unfittest’ ‘anti-civilization’ John D. Rockefeller বৃহৎ ব্যবসায়ের বৃদ্ধির স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যবসায়কে সঙ্কুচিত করার লক্ষ্যে যে যুক্তি দেন তাতে অসাধারণ প্রস্ফুটিত একটি গোলাপকুঁড়ির উপমা দেওয়া হয়, যার জন্য কাছে ফোটা ছোটোখাটো গোলাপকুঁড়িগুলিকে ছেঁটে বাদ দিতে হবে শল্যবিদের দক্ষতায়। ‘Social Darwinism’ বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে মেধাতন্ত্রের নামে একটা প্রবল বৈধতা নিয়ে কায়েমি। এই বাতাবরণে সহিষ্ণুতার অবকাশ খুউব বেশি আছে?

কেউ বলতে পারেন এই ধর্মীয়  সহিষ্ণুতার, পরমতসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গে আমি এইসব অবান্তর কথা আসছে কেন। কারণ সহজেই বোধগম্য। তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অন্যায় হয়তো চলেছে বহুদিন ধরেই, মূলতঃ তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের ‘creamy layer’-এর মধ্যে সংরক্ষণের সুযোগ আটকে থাকার জন্য। কিন্তু শিক্ষা ও চাকুরিতে এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের ছেলে মেয়েদের যে তীব্র ঘৃণা ‘সোনার চাঁদ’, ‘সোনার টুকরো’ কথাগুলোর মধ্যে ঠিকরে বেরোয়, তার কারণ কি কেবল এই ‘creamy layer’-এর মধ্যে সংরক্ষণের আটকে থাকা? সম্প্রতি একটি ‘Kapil Sharma V/S CID  Jokes’s Photo’ নামের পোস্ট  ফেসবুকে ভীষণ ভাইর‍্যাল হয়ে গেছে। সেখানে একটি গৌরাঙ্গী সুন্দরী এক ভুটকালো বা ভুতকালো বরের সঙ্গে বিয়ের রিসেপশনে বসে’। পোস্টটির অজস্র শেয়ারে একটির ক্যাপশন হোলো ভালো পড়লে এমনই হয়!   ঠাট্টা করে লেখা এই মন্তব্যটিকে ঠাট্টা হিসেবেই দেখেছি! তবুও এই মাল্টিলেয়ার্ড পোস্টের একটি মানে অবশ্যই এই যে  নেকাপড়া করলে একটি ভুটকালো পাত্তরও এমন ফর্সা সুন্দরীকে পেতে পারে। এক মন্তব্যকারী লিখলেন মেয়েটি নেকাপড়া করেনি  বলেই এমন হয়েছে এটা কি বলা যায়না? আমাদের ব্যাপক, সংখ্যাগুরু কালোদের দেশে কালোদের প্রতি এত অসহিষ্ণুতা কেন? এই নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি অসাধারণ কবিতাই আছে! এই গাত্রবর্ণের অসহিষ্ণুতাই তো তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের শিক্ষিত অংশের প্রতি ঘৃণায় দৃশ্যমান! প্রাচীন ভারতে তাদের ‘মায়াতি’ বলে বলি দেওয়া হতো। এখন ঘৃণা ছাড়া  উচ্চবর্ণের হাতে আর কিবা আছে?
আবার মোদির ভারতে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আরো বড় পাখা মেলেছে তার বিরুদ্ধে চিৎকৃত রাজনৈতিক প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলের ও শাসক দলের অবিসংবাদী নেত্রী অগ্রগণ্য/গণ্যা! কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকেই এই রাজ্যেই যে প্রধান বিরোধী দল ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল, আজ কেবল ২০০৮ সাল থেকে একাদিক্রমে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে ভোটে হারায়, তার  নেতাদের মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাতে বলেছেন প্রধান নেত্রী। অন্যান্য বড়, মাঝারি, ছোটো, খুচরো নেতারা বিরোধী দলের নেতা ও  সদস্যদের বাড়িতে চলে আসা কেউটে সাপের মত, ইঁদুরের মত পিটিয়ে মারতে বলেছেন। বিবাহে, শ্রাদ্ধে, অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের একঘরে, বয়কট ও বর্জন করতে বলেছেন তা প্রায় সব্বাই জানেন! সব সাপকে মেরে ফেলার জৈববৈচিত্র্যহানিকর কুপ্রস্তাবের কথা না তুলেই বলছি, এই প্রবল সামাজিক অসহিষ্ণুতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য লড়াই করা যায়?    
এই কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি এই কারণে যে ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে হিন্দুদের মুসলিমদের প্রতি, আর মুসলিমদের হিন্দুদের প্রতি যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব বেড়েছে বলা হচ্ছে তা কিন্তু বহুদিন ধরেই, মানে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সামাজিক অসহিষ্ণুতারই পরিণতি। আর রবীন্দ্রনাথ বারে বারে এই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন যে এর রাষ্ট্রনৈতিক সমাধান গোড়া কেটে আগায় জল ঢালবার মতই অফলপ্রসূ হবেবলেছেন ‘আমাদের রাষ্ট্রসমস্যার ... একটা কঠিন গ্রন্থি রয়ে গেল, হিন্দুমুসলমানের ভেদ ও বিরোধ। এই বিচ্ছেদটা নানা কারণে আন্তরিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে থেকে রাষ্ট্রনৈতিক প্রলেপ দিয়ে এর ফাটল নিবারণ করা যাবে না; কোনো একটু তাপ বেড়ে উঠলেই আবার ফাটল ধরবে।’  আমার একটি বইয়ের একটি প্রবন্ধে (‘In the Voice of Cassandra: Tagore on Hindus and Muslims in India and their Relations’) রবীন্দ্রনাথের  হিন্দুমুসলমান সম্পর্ক চিন্তার প্রকৃত, আধুনিক তাৎপর্যের আমি বিশদ আলোচনা করেছি, সুধী পাঠক ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন [Politics, Society and Colonialism: An Alternative Understanding of Tagore’s Responses (New Delhi: Cambridge University Press, Foundation Imprint, 2010), ] কিন্তু এখানে আমার বক্তব্য হিন্দুমুসলমানের প্রসঙ্গ পেরিয়ে আরো একটু আলাদা। এখানে আমি এই কথা বলতে চাই যে  সহিষ্ণুতা শব্দটাই বড্ড গোলমেলে। তার বদলে সমব্যথা,  সহানুভূতি ইত্যাদি চলবে না? সহিষ্ণুতা কথাটা যে বড় কৃপণ!  রফা/ অ্যাডজাস্টমেণ্ট ইত্যাদির মত! আমার এক ছাত্র বহুদিন আগে আমাকে শুধিয়েছিল সে বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে  অ্যাডজাস্ট করতে পারবে কিনা। তাকে বিয়ে করতে বারণ করে’ আমি বলেছিলাম ‘Love expands the sphere of adjustment’ভুল জায়গায় শুরু করে লাভ নেই! ঐ যে  রবীন্দ্রনাথের কথা আছে ‘খোকা বলেই ভালোবাসি, ভালো বলেই নয়’! এইটাই আসল কথা! যদি ধনী দরিদ্রকে, উচ্চমেধা নিম্নমেধাকে, শাদা কালোকে, সুন্দর অসুন্দরকে,  উচ্চবর্ণ অধোবর্ণকে, এক রাজনৈতিক দলের মানুষ অন্য রাজনৈতিক দলের মানুষদের একটু মানুষ হিসেবে ভালো না বাসতে পারে, কেবল সহিষ্ণুতা দিয়ে এগোবার কথা ভাবে, তবে সহিষ্ণুতা আসবেনা। ভালোবাসাই তো সহিষ্ণুতার জননী!