কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

“শুধুহাসে মহাকাল” : রঙ্গব্যঙ্গের নিশানায় সুভাষচন্দ্র




যাঁরা নিজের চরিত্রের দীপ্তিতে, কর্মের প্রেরণায় বা কীর্তির গৌরবে দেশের  ইতিহাসকে অলঙ্কৃত করেন, সেই জাতির মানসপটে যে তাঁর ছবি আঁকা হয়ে থাকে অনপনেয় বর্ণসুষমায়, এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তাঁদের নিয়ে প্রায়শই মুখর হয়ে থাকে দেশের সংবাদ-মাধ্যম, কাব্যরচনা করেন কবি, শিল্পী আঁকেন তাঁর ছবি। কিন্তু তিনি যদি হন রাজনীতির জনপ্রিয় নায়ক বা নায়িকা, তা হলে তাঁর ওপর যে সর্বদাই শুধু প্রশস্তির পুষ্পই বর্ষিত হবে না, এ কথা বলাই বাহুল্য। আজ আমাদের মধ্যে সশরীরে না থাকলেও ভারতীয় তথা বাঙালি জাতির মনোজগতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের স্থান রয়ে গেছে তেমনই এক গগনচুম্বী উচ্চতায় তাঁর  জীবনকালেও যেহেতু তিনি ছিলেন সমকালীন রাজনীতির এক লোককান্ত ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নিয়েও সে কারণে সদাই আবর্তিত হয়েছে বিতর্কের ঘূর্ণি, নিক্ষিপ্ত হয়েছে  ব্যঙ্গবিদ্রূপের শরকার্টুনিস্টের ব্যঙ্গচিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছেন তিনি একেবারে তরুণ  বয়স থেকেই। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই পর্বের সমস্তটা জুড়েই সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেন অন্ত নেই! তাঁকে নিয়ে বাংলায় রচিত কিছু রঙ্গরচনা আর দেশবিদেশের ব্যঙ্গচিত্রীদের আঁকা ছবিগুলোর ভিত্তিতে আমাদের এই পরিক্রমা। আলোচনার সুবিধার জন্য এই সমগ্র পর্বটিকে আমরা খুব মোটাভাবে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নিতে পারি। প্রথম পর্বটি হতে পারে ১৯২৪ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ যতদিন তিনি ভারতে ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বটি হতে পারে তাঁর জীবনের বাকি অংশটুকু অর্থাৎ ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালে তাঁর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। এই পরিক্রমার শেষ ভাগটি ১৯৪৬ থেকে একেবারে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত, যখন নেতাজিকে প্রত্যক্ষ ভাবে সমালোচনা বা আক্রমণ না করা হলেও তাঁর প্রসঙ্গ নানা ভাবে ব্যঙ্গচিত্রের উপজীব্য হয়েছে। আপাতত এই পরিসরে আমরা শুধু প্রথম পর্বটিতেই [১৯২৪-৪০] পরিক্রমার চেষ্টা করব।

সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্য হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পর সুভাষচন্দ্রের প্রথম কারাবরণ ১৯২১ সালে। এর কয়েক বছর পরে ১৯২৪ সালে ইংরেজ সরকার সুভাষচন্দ্র, সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখ কংগ্রেসকর্মীদের ১৮১৮ সালের রেগুলেশন থ্রী বা ‘তিন আইনে’ গ্রেপ্তার করে ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে চালান করে। শরৎচন্দ্র পন্ডিত ওরফে দা’ঠাকুর তাঁর ‘বিদূষক’ পত্রিকায় এই ঘটনাটি নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র সহ কবিতা প্রকাশ করেন। কার্টুনটিতে দেখানো হয়, একটি উড়োজাহাজের গায়ে লেখা ‘R-3-1818’, সেটি থেকে দড়িতে ঝুলছে কয়েক জন বাঙালি যুবক, নিচে দাঁড়িয়ে এক হাবিলদার বলছে,  ‘‘উড় যা বাংগালি, উড় যা!” ছবির সঙ্গে ছাপা কবিতাটিতে সুভাষচন্দ্র বা তাঁর কারাবরণের উল্লেখ না থাকলেও তাঁর কারাদন্ডকে উপলক্ষ্য করে রচিত এই  কবিতায় ইংরেজের আইনকে যে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল, তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেইঃ- উড় যা বাংগালি, উড় যা/ ঘর সে বহুৎ দূর যা/ বেগর হাকিম কা পুর যা/ পুলিশ সব ঘর ঢুঁর যা।।/ কুত্তা বিল্লি শের/ পকড়া জায়গা ঢের,/ জলদি মত করো দের/ তেরা নসিব কা বহুৎ ফের!...”

সুভাষচন্দ্রের এই প্রথম কারাবরণের পেছনে ছিল বিপ্লবী দলের সঙ্গে তাঁর  যোগসাজসের অপ্রমাণিত অভিযোগ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দীর্ঘদিন বিনাবিচারে আটক রেখেছিল বলে বিলেতের পার্লামেন্টেও জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছিলেনতাঁর বিরুদ্ধে এই অপ্রমাণিত অভিযোগের ইঙ্গিত দা’ঠাকুরের এই কবিতায় সহজেই ধরা  যায়, যেখানে বলা হচ্ছে, ইংরেজের ‘লাট কা কানুন’ অতি সহজেই বাঙালিদের চোরডাকাত বানিয়ে নাজেহাল করতে পারে, শত উকিল-ব্যারিস্টার দিয়েও পার পাবার পাবার জো নেই, কেননা সরকারের মুখের কথাতেই বিচার পরিচালিত হবে:- “ওকিল বেলিস্টার/ সব হোগা নাচার,/ মেরা বাৎ দো চার/ ইস মেঁ হোগা বিচার।।/...ভাতুয়া বাংগালি মছলিখোর/ ছুট গিয়া অব তুঁহারা জোর,/ মেরা হাত মেঁ কানুন কা ডোর/ বানা দেউঙ্গা ডাকু-চোর।...” দুর্ভাগ্যবশত এই কার্টুনটি অবশ্য আমরা পাইনি, তবে কবিতার এই নমুনাটি পেয়েছি নলিনীকান্ত সরকারের ‘দাদাঠাকুর’ গ্রন্থটি থেকে।

মান্দালয় কারাবাস থেকে সুভাষ মুক্তি পান ১৯২৭ সালে। এই ঘটনার মাত্র এক বছর পরে ১৯২৮ সালের শুরুতে কলকাতায় সিটি কলেজের ছাত্রাবাসে সরস্বতী পূজার অনুমতি না মেলায় কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের মধ্যে যে বিরোধ বাধে, তাতে সুভাষচন্দ্র ছাত্রদের পক্ষ সমর্থন করলে প্রচুর আলোড়নের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ, সি এফ এন্ড্রুজ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কলেজের ব্রাহ্ম পরিচালকদের পক্ষে কলম ধরেন। অন্যদিকে সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ব্যঙ্গবাণের লক্ষ্য হয়ে পড়লেন সুভাষচন্দ্রএই কাগজটিতে তাঁকে ‘খোকা ভগবান’ নাম দিয়ে লেখা হলো :- “খোকা ভগবান নামে/ গজানন  বঙ্গধামে/ সম্প্রতি খুলেছে রাজ্যপাট।...” [‘মর্ত্য হইতে সরস্বতী বিদায়’]। পত্রিকাটির এ সময়কার সুভাষ বিষয়ক কবিতার কিছু নমুনা সম্পাদক সজনীকান্ত তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’তে সংকলিত করেছেন। এমনই একটি নমুনায় সুভাষচন্দ্রকে ‘হিন্দুয়ানির পান্ডা পাঁড়’ আখ্যা দিয়ে অ্যালবার্ট হলে তাঁর বক্তৃতাসভার বর্ণনাঃ- “খোকা ভগবান আসিল নিজে,/ চোখের জলেতে বেজায় ভিজে।/ বুকেতে কি জানি ঘটিল দোষ,/ সাক্ষী কুলীন বৈদ্য বোস।/ দেবদ্বিজে অতি ভক্তিমান/ সন্ধ্যা করিয়া তামাক খান/...গোটে গোটে ছোটে খোকার বাণী/ নববেদ বলে তারে বাখানি। ...বিবাহযোগ্যা পাননি কনে/ কেহ নাই বামে সিংহাসনে।.../ হিন্দুয়ানির পান্ডাপাঁড়/ জয়রব তাই উঠিল তাঁর ইত্যাদি [ ‘ধর্মরক্ষা’]

এই বছরেই ডিসেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে সামরিক কায়দায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে সুভাষচন্দ্র আবার আলোড়ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করলেন।



এই কাজ এক দিকে যেমন মুগ্ধ বিস্ময়ের চমক সৃষ্টি করল, তেমনই এই স্বেচ্ছাসেবীদলের পোশাক, কুচকাওয়াজ ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনাও শুরু হলোগান্ধী একে আখ্যা দিলেন ‘খালাসিদের তামাশা’ [সেলার্স সার্কাস] বলে আর  রবীন্দ্রনাথের মতেও এ ছিল প্রহসন বা ‘ভাঁড়ামি’! আনন্দবাজার পত্রিকার ‘নন্দীভৃঙ্গী’ অবশ্য নানা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রকে ‘সুভাষিনী’ বানিয়ে মশকরা করলেও এই ভলান্টিয়ার্স বাহিনীর শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য সুভাষচন্দ্রের প্রশংসাই করেছিল। কিন্তু অন্য পত্রিকাগুলির রঙ্গব্যঙ্গ ক্ষান্ত থাকেনি, যার কিছু নিদর্শন সংকলিত হয়েছে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র’ বইটির দ্বিতীয় খন্ডে। এই কলকাতা অধিবেশনেই যুব কংগ্রেসের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র যুবসমাজের ওপর সবরমতি ও পন্ডিচেরি আশ্রমের প্রভাবের সমালোচনা করে আর একটি বিতর্কেরও সূত্রপাত করেছিলেন। এই বক্তব্যকেও কটাক্ষ করেছিল আনন্দবাজার সহ অন্যান্য পত্রিকা। মাসিক বসুমতী-তে বের হয়েছিল সত্যেন্দ্রকুমার বসুর ‘ইনফ্যান্ট কংগ্রেস’ নামে এক সচিত্র ব্যঙ্গরচনা। ইয়ুথ কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের ভাষণকে লক্ষ্য করে ‘বয়স্কদের দ্বারা পীড়িত’ শিশুদের জবানিতে লেখা হয় –  “দেশের ইয়ুথগণকে ভবিষ্যতের আশাভরসা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। এই অপমান কি আপনারা চুষিকাঠি চুষিতে চুষিতে সহ্য করিবেন?... ইয়ুথেরা কল্যকার নাগরিক, আমরা তৎপরদিনের নাগরিক।... অতএব ...নাগরিক বা নাগরিকার অধিকার একমাত্র ইনফ্যান্ট পুরুষ ও ইনফ্যান্ট নারীগণের প্রাপ্য। ...ইহা হইতে বঞ্চিত করিতে আসিলে আমরা দন্ত-নখাদিরূপ অহিংস অসহযোগ অস্ত্র দ্বারা অথবা ক্রন্দন-কোলাহলরূপ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দ্বারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত করিব। ...পলিটিক্স বা রাজনীতি ক্ষেত্রে আমরা পিতা, অভিভাবক বা গুরুজনের শাসন মানিব না স্বাধীনতাই জীবন, ...স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে!...” ইত্যাদি।

আবার কলকাতা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবীদলকে উপলক্ষ্য করে সুভাষচন্দ্রকে ব্যক্তিগত  আক্রমণের মাধ্যমে সবচেয়ে কদর্য ব্যঙ্গের বন্যা বয়ে গেল ‘শনিবারের চিঠি’র পাতায়। সম্পাদক সজনীকান্ত, যাকে দা’ঠাকুর বলতেন ‘নিপাতনে সিদ্ধ’, তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতা নিয়ে আবির্ভূত হলেন সুভাষকে নিপাতিত করতে। এর ‘বিশেষ সাইমন সংখ্যা’তে সংবাদ সাহিত্য বিভাগে একটি কবিতায় সুভাষচন্দ্রের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি, গান্ধীনীতির বিরোধিতা ইত্যাদি থেকে শুরু করে  স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর পোশাক ইত্যাদি সব কিছুকেই ব্যঙ্গবাণের নিশানা করা হয়। শুধু এ-টুকুই  নয়, সুভাষচন্দ্রের বিদ্রোহকে একটা প্রাদেশিক চেহারা দেবার কেমন চতুর চেষ্টা করা হয়েছিল এই সব কবিতায় তার একটু নমুনাঃ- “সেলাম নেহরু, কেটে পড় বাছা,/ সেলাম বৃদ্ধ গান্ধী/ হাফপ্যান্টের নাই বটে কাছা/ তবুও কোমরে বান্ধি-/ বুকে জোর থাকে চলে এস সাথে/ স্বাধীনতা শুধু কাম্য-/ স্বাধীনতা ধ্বজা ধর এক হাতে/ আর হাতে ধ্বজা সাম্য,/ মুখে কহ শুধু জয়তু বঙ্গ, জয়তু সুভাষচন্দ্র,/ নতুবা দাও হে পৃষ্ঠভঙ্গ, যে হও তামিল অন্ধ্র!...”  এর সঙ্গে যোগ হয়েছে  সুভাষচন্দ্রকে লক্ষ্য করে সরাসরি বিদ্রুপঃ-“ হে চিরতরুণ ধন্য,/ গান্ধী নেহরু  হইল হদ্দ/ তুমি এলে সেইজন্য।/ শোভে ঝলমল জরির পোষাক/ রাবড়ি সেবিত অঙ্গে,/ শিখ মারাঠিরা বিষম অবাক/ মিলিটারি দেখে বঙ্গে!” উদ্ধৃত অংশে ‘বুকে জোর থাকে...’ ইত্যাদি ইঙ্গিতের অর্থ হলো সুভাষচন্দ্রের ‘বুকের অসুখ’ অর্থাৎ যক্ষ্মারোগের প্রতি কটাক্ষ, যা অন্য কবিতায়ও আমরা দেখেছি। এখানে ‘শনিবারের চিঠি’ থেকে আরো কিছু পদ্য ও গদ্য-নমুনা দেখা যেতে পারে। ‘সোনার বাংলা’  শীর্ষক এক কবিতার কিছুটা :-“হেথা জাতীয় সমরে যুবা সৈনিক/ যেন পারাবত লক্কা।/ কারো ভাঙা শিরদাঁড়া, সম্বল কারো/ ঘূণ ধরা বুকে যক্ষ্মা।” এর পর দেখা যেতে পারে ‘আবার উটরাম সাহেবের টুপি’ নামে একটি গদ্যরচনার অংশঃ- “ইতিমধ্যে কলিকাতা কংগ্রেস আসিয়া পড়িল। বিরাট আয়োজন, বিষম হট্টগোল, হৈ চৈ। বাংলা মায়ের কোলজোড়া ছেলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে বাংলার বজাগ্রত তরুণ সংঘের দুইজন বা ততোধিক একত্রিত হইলেই ফাঁকা জায়গা দেখিয়া লেফট রাইট ক্রমে তালে তালে পা ফেলিয়া চলিতে লাগিল। সুবিখ্যাত ‘দেশবন্ধু বাস’ তরুণী ভলান্টিয়ারদের লইয়া পাড়ায় পাড়ায় হানা দিতে আরম্ভ করিল। ‘নেশানাল’ সৈন্যদলের জন্য ৮০০০ জোড়া বুট ও হাজার হাজার জোড়া খদ্দরের মিলিটারি হাফ প্যান্ট ও সার্টের অর্ডার চলিয়া গেল। খদ্দরের ক্যাপ ও পিস্তল রাখার খাপ তৈয়ারী হইতে লাগিল। বিউগাল ও বংশীধ্বনিতে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিল। পথে ঘাটে নূতন জাতীয় সঙ্গীত ঐকতান-সহযোগে শ্রুত হইতে লাগিল- ‘কে আবার  বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে’! ‘ফরোয়ার্ড’ ও ‘বাংলার কথা’য় নোটিশের উপর নোটিশ। সেনাধ্যক্ষ সুভাষচন্দ্র নিজের বুকের দোষের কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়া ডাক্তারের সাহায্যে ভলান্টিয়ার সৈন্য বাছিতে লাগিলেন। যাহারা উচ্চতায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির চাইতে কম এবং যাহাদের বুকের মাপ ৩৪ ইঞ্চির বেশি নহে তাহারা অমনোনীত হইয়া কাঁদিতে লাগিল।...”

‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকায় সুভাষচন্দ্রকে মাইকেল কলিন্সের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল বলে সে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র মশকরা :- “মাইকেল কলিন্স আয়র্লন্ডের জাতীয় সৈন্যদলের নায়ক ছিলেন, সুভাষবাবু ভারতবর্ষের নবজাগ্রত জাতীয়তার মাংস-প্রতীক। মাইকেল কলিন্স গুলির আঘাতে মরিয়াছেন, সুভাষবাবু মরেন নাই বটে, কিন্তু বুকের দোষে মরিতে বসিয়াছিলেন। দুইজনের মধ্যে সাজের কিছু তফাত আছে, পিস্তল আর লাঠির তফাত মাত্র। জরীর কাজগুলি তরুণের নেতার পক্ষে তরুণীর শিল্পটীকা। মাইকেল কলিন্স মরিয়াছেন, সুভাষচন্দ্র বাঁচিয়া আছেন। সুভাষচন্দ্রের জয় হউক।” এই সব কলমের চিমটির সঙ্গে ব্যঙ্গচিত্রীর তুলির খোঁচাও পত্রিকাটি পরিবেশন করেছিল। একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে যে,সামরিক পোষাকে সজ্জিত সুভাষ বীরের ভঙ্গিমায় কংগ্রেস অধিবেশনের মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে লেখা- ‘বন্দে মাতরং’



ছবিটির ইঙ্গিত এতই  স্পষ্ট যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। আর একটি ছবিতে শুধু স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং [জিওসি]-এর ইউনিফর্ম পরিহিত সুভাষচন্দ্রকে চিত্রিত করা হয়েছে, নিচে লেখা ‘গক’।



এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এই ‘গক’ শব্দটি  সজনীকান্ত তৈরি করেছিলেন ভলান্টিয়ার বাহিনীর অধিনায়ক সুভাষের পদমর্যাদার ইংরেজি আদ্যাক্ষরগুলি [জি ও সি] থেকে। শনিবারের চিঠির এই লেখাগুলোর  প্রথম সমালোচক শঙ্করীপ্রসাদ বসু যথার্থই বলেছেন যে, মানুষের রোগব্যাধি নিয়ে ব্যঙ্গ করা যে সভ্যরীতি-বিগর্হিত, তা শনিবারের চিঠির সুসভ্য লেখকেরা ভুলে গিয়েছিলেন।

কংগ্রেসের এই স্বেচ্ছাসেবকদলে সুভাষচন্দ্র যে সমস্ত বিপ্লববাদীদের স্থান দিয়েছিলেন, তাদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে শনিবারের চিঠির ‘Goes অ্যাং Goes ব্যাং’ নামক  এক কবিতায় লেখা হলোঃ- “সেই শ্রীমান খোকারে ঘিরিয়া যতেক ডাকাতের হল  gang-/ পাকা গুরু হয়ে সেথা নয়া ভগবান/ বাড়াইয়া আছে ঠ্যাং।...” [‘শনিবারের চিঠি, ভাদ্র, ১৩৩৫]। এই সব কবিতায় হাস্য ও ব্যঙ্গরসের সঙ্গে কী  ভাবে “কিছু ভাবরসের মিশালও করা হয়েছিল”, শঙ্করীপ্রসাদ বসু তারও কিছু নমুনা উপস্থিত করেছেন রাবীন্দ্রিক ঢঙে রচিত এক কবিতায় গান্ধীকে যথাসাধ্য  মহিমান্বিত করে তাঁর মুখ দিয়ে সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশে নিম্নরূপ ভর্ৎসনাবাক্য উচ্চারিত হয়েছিল :- “আপন গৌরবে/ স্থাপিয়াছ আপনার বেদী,/ নহে দীনা জননীর।/ ..., বিচিত্র আলোকমালা/ সাজাইয়া দেশবন্ধুধামে/ দরিদ্রের অর্থ লয়ে/ খেলিছ পুতুলখেলা।.../ সেজেছ বিচিত্র বেশে,/ প্যান্টকোটে সুশোভিলে দেহ/ বহু মুদ্রা ব্যয় করি।...”

স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অধিনায়ক সুভাষচন্দ্রের পোশাকের বর্ণনায় শনিবারের চিঠি কলম বারবার প্রলুব্ধ হয়েছে, এমন কি, কুৎসিত ভাষায় তাঁকে ‘সিংহচর্মে শোভিত রাসভ’ আখ্যা দিতেও এই কাব্য-তীরন্দাজেরা কুন্ঠিত হননি! এরকম তীরন্দাজির আর একটি নিদর্শনঃ- “মহাবীর সেনাপতি/ কভু বা অশ্বে কভু সহাস্যে মোটরে উধাও গতি।/ স্বাধীনতা টুপি পড়েছেন শিরে,/ উপুড় কলসে কাপাসের বিঁড়ে/ অশ্বপৃষ্ঠে আঁখি ভাসে নীরে,/ রথে চলে মহারথী।...” কবিতাটির শেষে ‘নিয়তির  ঝোড়ো নিঃশ্বাস’ বইয়ে দিয়ে লেখা হয়েছিল - শুধু হাসে মহাকাল,/ জেলের  কয়েদী করিছে বিবাহ মুকুটে শোভিত ভাল!/ ফোঁটাচন্দন কাটিয়া ললাটে/ ভিখারী সহসা বসে রাজপাটে/ যেতেছে ভুলিয়া নিমেষের ঠাঁটে/ চিরদিবসের হাল।” ইত্যাদি। এই সূত্রে আমাদের আবার উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সঙ্গত মন্তব্যঃ- “হাঁ- শুধু হাসে মহাকাল! অবশ্যই! শনিবারের চিঠির সম্পাদক বহুদিন পরে অনুতপ্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে লিখবেন – একদিন সুভাষচন্দ্রকে ‘গক’ বানিয়ে  কতই কৌতুক করেছিশ্রদ্ধেয় সেই বিলম্বিত মহত্ত্ব!”  

এই ঘটনার পরেও আরও দশ বছর সুভাষচন্দ্র ভারতে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং এই সময়টিও ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। নির্বাসন, কারাবরণ কংগ্রেসের সভাপতিরূপে জাতীয় জীবনের শীর্ষে আরোহন ও সেই আসন ত্যাগ করেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গবিন্দুতে অবস্থান করে তিনি আগাগোড়া সংবাদের শিরোনাম হয়ে থেকেছেন। স্বাভাবিভাবেই ওই সব ঘটানাকে উপলক্ষ্য করে নিশ্চয়ই দেশের  সংবাদপত্রে যথেষ্ট সংখ্যক কার্টুনও প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো সংকলন ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত এ জাতীয় কাজ আমাদের দেশে তেমন চোখে পড়েনি। সুপরিচিত কার্টুনিস্ট কুট্টি এ বিষয়ে ‘আজকাল’ পত্রিকায় নেতাজির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি রচনায় জানিয়েছিলেন যে, তিনি ও তাঁর গুরু শঙ্কর সুভাষচন্দ্রকে  নিয়ে চল্লিশের দশকে হিন্দুস্থান টাইমস, ন্যাশনাল হেরাল্ড ইত্যাদি কাগজে অনেক কার্টুন এঁকেছেন। তিনি লিখেছিলেন, “গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতবিরোধে কংগ্রেস ভাঙল। আমি ও আমার বন্ধুরা সুভাষবাবুর ব্যক্তিত্ব ও প্রগতিশীলতায় উদ্বুদ্ধ হই। আমাদের যৌবন তাঁকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। মনে পড়ছে, আমার গুরু প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট শঙ্কর সে সময় বেশ কয়েকটি কার্টুন আঁকেন। আমিও সুভাষ বসুকে নিয়ে কিছু কার্টুন আঁকি।”

১৯৪০ সালে যখন কংগ্রেস থেকে গান্ধী ও তাঁর অনুগামীরা সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কার  করেন, তখন তা নিয়ে শংকর ‘হিন্দুস্থান টাইমসে’ একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। তার বর্ণনা শোনা যাক কুট্টির থেকেঃ- “শঙ্করের কার্টুনের প্রেরণা ছিল বিখ্যাত একটা চিত্রকর্ম। ‘বেলারোফান জাহাজে নেপোলিয়ন’। ইউরোপীয় দেশগুলোর দলবদ্ধ আক্রমণে ওয়াটারলুতে পরাস্ত হয়েছেন নেপোলিয়ন। হতমান, নিঃসঙ্গ সেই বীরকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। এই ছিল ছবিটা। শঙ্কর আঁকলেন সুভাষবাবুকে নেপোলিয়নের ভূমিকায়। একা দাঁড়িয়ে আছেন জাহাজের এক প্রান্তে। মাস্তুলের কাছেই কংগ্রেসের নেতারা। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। এঁরা নেতাজির বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন। একটা কার্টুনই সব বলে দেয়।” এই কার্টুনটিকে স্মৃতি থেকে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন কুট্টি, যা তাঁর ওই লেখাটির সঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছিল।



 [‘নেপোলিয়নের আদলে নেতাজি’/ আজকাল, ২৩-১-১৯৯৭] এখানে শঙ্করের কার্টুনের প্রেরণা হিসেবে নেপোলিয়নের যে ছবিটির কথা কুট্টি উল্লেখ করেছেন, সেটি ১৮৮০ সালে স্যার উইলিয়ম কুইলার অরচার্ডসনের আঁকা। 



এখানে আমাদের আলোচ্য সর্বশেষ ছবিটিও ১৯৪০ সালের, প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের কম্যুনিস্ট নেতা পি সি যোশির ‘whom, how & why does Bose fight?’ শীর্ষক একটি লেখার সঙ্গে, যা ছাপা হয়েছিল বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘Unmasked Parties and Politics’ নামে এক সঙ্কলনে। আমরা এই কার্টুনটি যে লেখাটিতে পেয়েছি সেটি হলো ‘দি ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’তে প্রকাশিত  [১-৪-১৯৮৪] অরুণ শৌরির ‘The great betrayal’এতে দেখা যাচ্ছে, যোগাসনে বসে আছেন গান্ধী, আর তাঁর কাছ থেকে একটা ভেড়া নিয়ে যাচ্ছেন  সুভাষচন্দ্র, তাঁর মাথায় গ্রীক কায়দায় ফুলের মুকুট, ভেড়াটার গায়ে লেখা ‘সত্যাগ্রহ’ আর সুভাষ গান্ধীকে বলছেন, “Not You! But ME! And the Goat I take over!” [ছবি-৫] যেহেতু লেখাটিতে এই কার্টুনটি সম্পর্কে কোনও আলোচনাই নেই, তাই ঠিক কি প্রসঙ্গে এটি আঁকা, তা পরিষ্কার বোঝা যায় না। সাধারণ ভাবে মনে হতে পারে, গান্ধীর সংগ্রামবিমুখতা নিয়ে সুভাষচন্দ্রের  অভিযোগকে কটাক্ষ করা হয়েছে। 


এটি যদি ত্রিপুরী কংগ্রেস পর্বে সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের কাছে গান্ধীপন্থীদের পরাজয় উপলক্ষ্যে আঁকা হয়ে থাকে,  তবে সুভাষের মাথায় মুকুটের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আর যদি এটি ১৯৪০ সালের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে আঁকা হয়ে থাকে, তবে মনে রাখতে হবে, এ সময় ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে শামিল হবার জন্য গান্ধীর ওপর চাপ দিচ্ছিল কংগ্রেসের  সোশ্যালিস্ট দল, কিষাণ সভা, সুভাষচন্দ্রের নবগঠিত ফরোয়ার্ড ব্লক, কম্যুনিস্ট  পার্টি প্রভৃতি। কিন্তু গান্ধী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের চেয়ে বেশি কিছু করতে প্রস্তুত  ছিলেন না। কম্যুনিস্টরা সুভাষচন্দ্র-সংগঠিত বাম সমন্বয় কমিটিতে অল্প কিছুদিনের জন্য যোগ দিলেও পরে তারা তাঁর নানারকম সমালোচনা শুরু করে। ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র যখন রামগড়ে আপোষবিরোধী সম্মেলন করছেন, অক্লান্তভাবে ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন, কলকাতায় পরিচালনা করছেন হলওয়েল মনুমেন্ট তুলে দেবার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে, তখনও কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রতি প্রায়ই তোপ দাগা হচ্ছে ও তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনীহা ও শুধু শ্লোগান-নির্ভরতার অভিযোগ আনা হচ্ছে! কার্টুনের সঙ্গে ছাপা যোশির এই লেখাটি আমরা উদ্ধার করতে না পারলেও এর শিরোনাম থেকে আন্দাজ করা যায় যে, এটির বক্তব্যও ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রতি সমালোচনামূলক।

এর পরবর্তী পর্বে যখন সুভাষচন্দ্র অক্ষশক্তির সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ বিতারণের পরিকল্পনায় জাপানে উপস্থিত হন ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন করেন, তখন ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির লেখাপত্রে ও ব্যঙ্গচিত্রে আরও তীব্র ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেগুলি ভারতের ইতিহাসের একটি পরিচিত অধ্যায় ও আমাদের বর্তমান আলোচনার পরিসরের বাইরে।
       














1 কমেন্টস্:

  1. সংযোজন:-
    শনিবারের চিঠিতে সুভাষচন্দ্রের প্রতি এইসব আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় সজনীকান্ত দাসের 'আত্মস্মৃতি'-র দ্বিতীয় খন্ডে। সেখানে তিনি লিখেছেন, সিটি কলেজের ওই ঘটনাকে কটাক্ষ করে তিনি 'হিন্দু রিলিজিয়ন ইনসাল্টেড (স্বপ্নদর্শন)' নামে একটি ব্যঙ্গরচনা লিখেছিলেন, যা পরে তাঁর 'মধু ও হুল' নামে গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়। ওই একই বিষয়ে নিয়ে লেখা 'ধর্মরক্ষা' কবিতাটি পরে 'বঙ্গরণভূমে' গ্রন্থের অন্তৰ্ভুক্ত হয়েছিল। আলবার্ট হলের সভায় যেসব নেতারা বক্তৃতা করেছিলেন, ( জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ), কবিতাটির সঙ্গে তাঁদের ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন হরিপদ রায়।

    উত্তরমুছুন