চারানা আটানা
২৮) জনগণের সেবা
জীবে প্রেম করে যেই
জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর – গোটা গোটা করে ফটোফ্রেমে লিখে বাঁধিয়ে রাখত বাড়িতে
আগেকার দিনে। লেখা হতো স্টিচ করে, কাপড়ের জমিতে, রঙ বেরঙের সুতো দিয়ে। ঘরের মধ্যে ঘুরতে
ফিরতে দেখা যেত সেই ঐশ্বরিক বাণী। কেউ কেউ এর নিচে লিখে দিতেন –
বিবেকানন্দ।
বিবেকানন্দ
প্রেম-ট্রেম কেমন কী করেছেন উনিই জানেন, তবে জীবে এবং জিভে প্রেম করতেন নিশ্চয়, না
হলে এ রকম বললেন কী করে? আমরা যখন খুব ছোট, তখন অবশ্য সেবিছে বুঝতে পারতাম না,
ভাবতাম ‘সে বিছে’! সেবা করিতেছে অর্থে সেবিছে যখন বুঝলাম, তখন সেবা করার একটা
প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল।
তবে আমি আবার একটা
মানুষ, আমার আবার ইচ্ছে!
এই গল্পটা তাই আমার
না। একজন পরিব্রাজকের। পরিব্রাজক শুনলেই পাছে বিবেকানন্দই মনে হয়, কেননা
‘পরিব্রাজক বিবেকানন্দ’ নামে একটা বেশ জনপ্রিয় বই আছে, তাই আমি এটাকে পরিব্রাজিকা
করে দিচ্ছি। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে না। বিবেকানন্দর জীবনী আমি আর কী শোনাবো? আপনারা
তো সব জানেনই। প্লাস এখন আবার কেচ্ছালেখকরাও বিবেকানন্দ নিয়ে, হেঁ হেঁ, যাগগে...
তো হয়েছে কী, সেই
পরিব্রাজিকা তো সারা দেশময় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনো আসামের জঙ্গলে হাতির পিঠে,
কখনো রাজস্থানের মরুভূমিতে উটের পিঠে, কখনো পাঞ্জাবের গমক্ষেতে মোষের পিঠে, কখনো
বাংলায় ইয়ের পিঠে। ঘুরছেন আর দেখছেন। দেখছেন আর শিখছেন। শিখছেন আর নোট করে
নিচ্ছেন। বোম্বে ঘুরতে এসে দেখলেন সারা শহরে সাইকেল চেপে একদল লোক টিফিন ক্যারিয়ারে
করে খাবার বিক্রি করে। ওরা নাকি দারুণ অর্গানাইজড। অর্ডার দিলে খাবার পৌঁছাবেই,
কোনোদিন তা গড়বড় হয় না। শুনলেন, ওদের বলা হয় – ডাব্বাওয়ালা। নোটবুকে টুকে নিলেন –
ডাব্বা। সাউথে কর্ণাটকে এসে দেখলেন বিরাট জলসা। রাজ্যের লোক ডেকে মোচ্ছব হচ্ছে,
নাচা গানা হচ্ছে, রাজ্যোৎসব, লোকাল ভাষায় তার নাম হাব্বা। নোটবুকে টুকে নিলেন –
হাব্বা। ডাব্বা-হাব্বা, বেশ মজার ব্যাপার তো! একটা কবি কবি ভাব এসে গেলো পরিব্রাজিকার। ভাবলেন বড় হয়ে
এই নিয়ে কবিতা টবিতা লেখা যাবে।
তবে এখন ওসব না। এখন
স্রেফ দেখে যাওয়া, শিখে যাওয়া। স্বাধীনতা দিবসের দিন কর্ণাটক-তামিলনাড়ুর
সীমান্তে এক রাস্তা দিয়ে ঘুরছেন। একা একা, পদব্রজে। ফাটানো গরম। দরদরিয়ে ঘামছেন।
সমস্যা হচ্ছে, ওখানকার লোকাল লোক ওঁর মাতৃভাষা জানে না, দেশের অধিকাংশ লোক যে
ভাষায় কথা বলে সেই হিন্দীও ওরা বলতে নারাজ। তমিড় আর কন্নড় ভাষায় কথা বলে তারা, আর
সেই একই অ্যাকসেন্টে ইংরাজী। উনি ইংরাজীটা বোঝেন, বলতে গেলে অবশ্য একটু পব্লেম হয়।
তো যাই হোক, পরিব্রাজিকাদের হাজারটা সমস্যা থাকে, তা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারেন।
ওঁর পাশ দিয়েই বাইক
চড়ে যাচ্ছিল একজোড়া যুবক-যুবতী। মেয়েটার বিগলিত ভাব। টাইটানিকের মতো দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে সে
নিজের স্বাধীনতা ব্যক্ত করতে করতে যাচ্ছে। হঠাৎ
ছন্দপতন। ট্রাফিক পুলিশের পোশাকে একজন তার রুল তুলে থামিয়ে দিলো ওদের। মেয়েটা তো রেগে ফায়ার। ওর
কথাবার্তা কিছু বোধগম্য হচ্ছে না পরিব্রাজিকার, তবে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন,
মেয়েটা যা বলছে, তার মর্মার্থ হচ্ছে – ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে
বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’ টাইপেরই কিছু। আর পুলিশটা দাঁত বের করে বলছে – হেলমেট ইল্লা?
যুবক-যুবতী কারো
মাথাতেই হেলমেট নেই। এই মাত্রই কিছুদিন আগে এ অঞ্চলে ডিক্রি জারি হয়েছে, বাইক চড়লে
হেলমেট মাস্ট। চালকের শুধু না, পিলিয়ন রাইডারেরও।
লাইসেন্সা! পুলিশ
ছোঁড়াটার লাইসেন্স দেখতে চাইলো। পরিব্রাজিকার চোখের সামনে এখন দৃশ্যটা। উনি স্পষ্ট দেখলেন, ছেলেটা
লাইসেন্সের সঙ্গে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো
পুলিশটার দিকে।
অ্যান্ডেরা-ব্যান্ডেরা
করে কী সব বলতে লাগলো পুলিশটা, ছেলেটা মাথা নাড়াচ্ছে, হঠাৎ আর একজন বাইক নিয়ে
অকুস্থলে হাজির। পুলিশটার শাগরেদ! এসেই ছেলেটার বাইক থেকে চাবি বের করে নিলো সে।
তার কান্ড দেখে তো ছেলে-মেয়েদুটোর হাওয়া নিকলে গেল।
ওয়ালেট বের করে
ছোকরা আরও একটা একশো টাকার নোট ওদের দিকে বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু না, তার পুরো মানিব্যাগটাই
কেড়ে নিয়ে একগোছা নোট বের করে নিলো সেই শাগরেদ। মানিব্যাগ ফেরত দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে
তার নিজের বাইকে হাওয়া হয়ে গেল সে। এদের বাইকের চাবি তার পকেটে নিয়েই। ছেলেটার তো
কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
চোখের সামনে ঘটে
যাওয়া এই অনাচার পরিব্রাজিকার সহ্য হলো না। তিনি পুলিশটাকে এসে বললেন – ইউ ক্যান নট ডু দিস।
দিস কাইন্ড অফ থিং ইজ পোশ্চিমবঙ্গো। ইন আসাম। ইন মণিপুর। ইন মিজোরাম। ইন তিপুরা।
ইন নাগাল্যান্ড। আই পোটেস্ট।
পুলিশটা কী বুঝলো,
সেই জানে। সে হেসে হেসে আম্মা, আম্মা করে তার ভাষায় কী সব বলতে লাগলো।
মিনিট আষ্টেক পরে
সুদূর দিগন্তে পুনরায় আবির্ভূত হলেন আমাদের এই ট্রাফিক পুলিশের সেই শাগরেদ। তার
বাইকে দু’ দু’খানা নয়া হেলমেট
সঙ্গে নিয়ে। এসেই বাইক দাঁড় করিয়ে
প্রথমে মেয়েটার, পরে ছেলেটার মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিয়ে হেলমেট দুটোর দাম ছাড়া বাকি
চেঞ্জ আর বাইকের চাবি ফেরৎ দিয়ে সে বলল, সেফ রাইডিং! ছেলেটা চাবি ফেরৎ পেয়ে হাতে
যেন স্বর্গ পেলো। সঙ্গিনীকে পেছনে চাপিয়ে তারা উধাও হয়ে গেল মুহূর্তেই।
পরিব্রাজিকা ঘটনার
আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। বিগলিতচিত্তা হয়ে তিনি পুলিশটাকে থ্যাঙ্কিউ
থ্যাঙ্কিউ করতে লাগলেন। বাংলার পুলিশ ঘুষ খেয়ে খেয়ে ফুলছে, সাউথের পুলিশ জনগণের
সেবা করছে, ভাবা যায়! অথচ একই দেশ। সইত্যো সেলুকস!
এদিকে পরিব্রাজিকার
প্রচুর খিদে পেয়ে গেছে, মহত্ত্ব দর্শনেও ক্ষুধানিবৃত্তি বিশেষ হয় না। একটা উডিপি
রেস্টুরেন্টে গিয়ে ইডলি ধোসা খাওয়া দরকার অবিলম্বে। একটু ভাত পেলে মন্দ হতো না। তার ভাবভঙ্গী
বুঝতে পেরে পুলিশটা তাকে বলল, আম্মা, গো টু বাবাজীস
টেম্পলা। ইউ গেট গুড ফুডা।
ডিরেকশন টিরেকশন
নিয়ে বাবাজীর টেম্পলে হাজির হলেন পরিব্রাজিকা। ঘটনাস্থল থেকে তেমন কিছু দূরে না। বহুদিন ধরে ঘুরছেন,
বাবাজীর সাথে দর্শন হতে তিনি দিন তিনেক মন্দিরের আতিথ্যে থেকে যেতে বললেন।
পরিব্রাজিকা এক কথায় রাজি। ঘর মিলে গেল থাকার।
বিকেলের দিকে
মন্দিরের সামনেই ঘুরতে বেরিয়েছেন, হঠাৎ চোখে পড়ল, ট্রাফিক পুলিশের সেই শাগরেদ,
হাতে তার দু’খানা নতুন হেলমেট। একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল হেলমেটের দোকান। বিশাল এরিয়া জুড়ে পুরো এলাকাটা
মন্দিরের সম্পত্তি, এদিকে দোকানপাট তেমন নেই, অথচ এখানে হেলমেটের দোকান! কৌতূহল
হতে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, সেই দোকানের মালিক পুলিশের সেই শাগরেদটাই।
তার পেছনে আছে হেলমেটের বিরাট গোডাউন। তার মালিক বাবাজী। পুলিশের শাগরেদ হচ্ছে
বাবাজীর এক নম্বর চ্যালা। দিনে দুশো হেলমেট এই দোকান থেকে বিক্রি করে সে। আশেপাশের
বিভিন্ন দোকানে হেলমেট সাপ্লাই যায় গোডাউন থেকে।
কিন্তু মন্দিরের
পুরোহিত বাবাজী হেলমেটের ব্যবসায় কেন, এই ব্যাপারটা খোলসা হচ্ছিল না পরিব্রাজিকার।
বাবাজী এমনিতে খুবই আধ্যাত্মিক, সারাদিন নাকি অনাহারে থাকেন, ভক্তরা জানে উনি
সূর্যের আলো খেয়ে বেঁচে আছেন। দিনান্তে লোকচক্ষুর অন্তরালে উনি ক্যাডবেরি খান আর কী
সব যেন পান করেন। নৈশাহারের পর গল্পচ্ছলে একথা সেকথায়
পরিব্রাজিকার প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়ে গেল। পুলিশের শাগরেদের মতো চুনোপুঁটি চ্যালা
বাবাজীর যেমন আছে, রাঘব বোয়ালও কম নেই। সে রকম এক বোয়ালের কাছ থেকেই অগ্রিম খবর
পেয়েছিলেন, রাজ্যে চালু হতে চলেছে নতুন আইন – বাইক চালালেই হেলমেট পরা অবশ্য কর্তব্য। আইন চালু
হবার আগে এই খবর শুনেই হেলমেটের এজেন্সি বুক করেন তিনি। এ তো কিছুই না। নতুন যে
এয়ারপোর্টটা তৈরি হবে অনন্তপুরের কাছে, সে খবর বাবাজীকে দিল্লী
থেকে ফোন করে জানিয়েছিল
এখানকার এম পি। শুনেই অনন্তপুরের পাশের যাবতীয় ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল বাবাজী কিনে
নিয়েছেন। করিৎকর্মা উদ্যোগী পুরুষ। এ রকম না হলে কি জনসেবা করা যায়?
পরিব্রাজকের হৃদয়ে
তীব্র তৃষা জেগে উঠলো জনসেবা করার। কালান্তরে মৃত্তিকাদল নামে তিনি একটা দল গঠন
করে জনগণের সেবায় ব্রতী হলেন। তাঁর সেবা পেয়ে জনগণ ধন্য ধন্য করতে লাগল। বিউটি পেজান্টের মতো তারা দল বেঁধে এসে
তাঁর মাথায় মুকুট পরিয়ে বলল, আপনিই আমাদের দেখভাল
করুন এখন থেকে। উনি বললেন, তথাস্তু।
দল গড়লেই তো হয় না।
দলের ব্র্যান্ডিং চাই, মার্কেটিং চাই, সেসব তিনি সারাদেশ ঘুরে ঘুরে শিখে ফেলেছেন
কিছু কিছু। এক চ্যালা যেই বলল, আমাদের এই অঞ্চলটা বড্ড নোংরা, ভাবছি এখানে রঙ
বেরঙের ফুলের চাষ করব, উনি এক ধমক দিয়ে বললেন, বেরো আমার সামনে থেকে, মর্কট! আমার দলের নাম
মৃত্তিকা। মৃত্তিকা মানে মাটি। এখানে সব
কিছু হবে মেটে কালারের।
তাকে উনি কেটে কেটে
বললেন – শোন, কাগজে লিখে দে, আমি বলেছি, আমার এরিয়ায়
সবাইকে বাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে মেটে রং লাগাতে হবে। সমস্ত বিল্ডিং হবে মেটে রঙের।
দোকান, মল, ইস্কুল, হাসপাতাল, সুলভ শৌচালয়, রেলভবন, সব। বাস, অটোট্যাক্সি সব
মেটে রং করতে বলবি। গ্যাসের সিলিন্ডার –
চ্যালাটা গাঁই গুঁই
করে বলতে যাচ্ছিল, গ্যাসের সিলিন্ডার তো লাল রঙের হয়! উনি তেড়েফুঁড়ে বললেন, লাল? মানে রক্ত? খুনখারাপি?
জনগণ খুনখারাপির রং লাল বর্জন করেছে জানিস না? আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওদের সেবা
করার। আমি যা বলব তাই হবে।
চ্যালাটা চলে
যাচ্ছিল। হেঁকে ডাকলেন তাকে – যাচ্চিস কোথায়?
-
এই যে বললেন, রিপোর্টারদের বলতে, আপনি বলেছেন –
-
আমি বললাম আর অমনি ল্যাজ দুলিয়ে ছুটলি? মাথায় কিছু আছে
তোদের যে জনগণের সেবা করবি? যত্ত সব মূর্খ আহাম্মকের দল। অভিজিৎকে ডাক। বলবি, আমি বলেছি, এক্ষুণি যেন একটা রঙের
বিজনেসের লাইসেন্স বের করে নেয় আমাদের দপ্তর থেকে। একটা বড়সড় গোডাউন ভাড়া নিতে বলে
দে, কেউ দিতে না চাইলে তাকে উঠিয়ে দে। আর দেশের যেখানে যত মেটে রঙ আছে, ওকে কিনে
গোডাউনে ভরে ফেলতে বল সাতদিনের মধ্যে। দশ দিন পরে খবরের কাগজের ওদের বলবি আমি যা
বলতে বলেছি, এগুলো কমপ্লীট হয়ে গেলেই। বুঝলি?
বেশ লাগলো, কিন্তু একটু অন্য গন্ধ পাওয়া গেল যে............ আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন তো............ অম্বিকেশ, শিলাদিত্য ...................
উত্তরমুছুন:D
উত্তরমুছুন