কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬৬


গত ৩০শে ও ৩১শে মার্চ দু’দিনব্যাপী লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী ও আলোচনাসভা আয়োজিত হয়েছিল কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে পরিষদের সভাঘরে। এই আয়োজন আমার কাছে কিছুটা অভাবনীয়  মনে হয়েছিল। কেননা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ একটি সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান, বিগত  একশ ছাব্বিশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য ও গৌরব বহন করে চলেছে  (স্থাপিত : ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দ)। সেই প্রতিষ্ঠান এই প্রথম বাংলা লিটল ম্যাগাজিনকে মর্যাদা দিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, যে লিটল ম্যাগাজিন জন্মসূত্রে শুধুমাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং প্রতিষ্ঠান বিরোধী। বস্তুতপক্ষে, যে কোনো প্রতিষ্ঠানই সমাজের সনাতন মতাদর্শে বিশ্বাসী ও আস্থাবান। প্রতিষ্ঠিত চিন্তাভাবনা ও মতবাদের বিরুদ্ধে তার কোনো অবস্থান নেই। অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিন এইসব সনাতন চিন্তাধারা ও প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শকে প্রায় নস্যাৎ করে তার বিপরীত ভূমিতে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে। নতুন সাহিত্যদর্শন ও শিল্পচেতনার গতানুগতিক ধারার বিরোধীতা করে তার সদম্ভ জয়যাত্রা। সুতরাং  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যখন অপ্রাতিষ্ঠানিক লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী ও আলোচনাসভার আয়োজন করে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, লেখক ও পাঠকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মান ও মর্যাদায় বরণ করে নেয়, তখন মনে হয়, লিটল ম্যাগাজিনের অপ্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান আজ কোনো ভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান থেকে আদৌ পিছিয়ে নেই, বরং প্রায় সমান সমান। এবং এজন্য আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতি কৃতজ্ঞ।


দু’দিনের এই প্রদর্শনী ও আলোচনাসভায় লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কিত বক্তব্য  রাখার জন্য প্রথমদিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক রূপে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। আমার সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্য এবং ‘শব্দহরিণ’ পত্রিকার সম্পাদক সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন নির্মলকুমার নাগ। দ্বিতীয় দিনে দুটি অধিবেশনে আমন্ত্রিত সম্পাদক রূপে বক্তব্য রেখেছিলেন প্রসূন বর্মন, গৌতম গুহরায়, সুব্রত রায়চৌধুরী, অপূর্ব সাহা, অরূপ দাস ও প্রশান্ত ধর। এই দুটি অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন সৌরীন ভট্টাচার্য এবং বারিদবরণ ঘোষ। প্রথমদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন পবিত্র সরকার। স্বাগত ভাষণে ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বর্তমান সম্পাদক রতনকুমার নন্দী, মূল সংকেত ভাষণে সন্দীপ দত্ত এবং সামগ্রীক অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বর্তমান সহ সভাপতি ড. সুবিমল মিশ্র। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি নির্মলকুমার নাগ।   


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ৬৬তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো বাংলা নতুন বছরের ঠিক আগে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই সবাইকে। ভালো থাকুন সবাই, এই কামনা করি।   
    

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :  
         
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অদ্বয় চৌধুরী




‘হোয়েন ফাইভ ইয়ারস্ পাস’ — সময়ের স্থিরচিত্র




ক্লোজশট। পিছনের খানিক গাঢ় শূন্যতা সহ ক্যামেরা দ্রুত নামতে থাকে একটি কাচের গ্লাসের মধ্যে। অর্ধেক জল। সেই জলে একটি রক্তমাখা বুলেট নেমে আসে। ডুবে যায়। ক্রমশ রক্ত ছড়িয়ে পড়ে জলে মৃত্যু। মৃত্যু নেমে আসে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার জীবনে ১৯শে অগাস্ট, ১৯৩৬। সেই মৃত্যুই, এভাবে, স্যুরিয়েল, ন্যয়ারিশ উপস্থাপনায়, প্রদর্শিত হয় মার্কোস জুরিনাগা’র ‘দ্য ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স অফ গার্সিয়া লোরকা’ সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যে

১৯শে অগাস্ট, ১৯৩১। লোরকার মৃত্যুর ঠিক পাঁচ বছর আগের দিন। সেদিন লোরকা তাঁর অন্যতম ‘ইমপসিবল্ প্লে’ ‘হোয়েন ফাইভ ইয়ারস পাস’ লেখা শেষ করেন যেখানে, হয়তো বা নিছক কাকতালীয় ভাবেই, ঠিক পাঁচ বছর পরে তাঁর ভবিতব্য মৃত্যুর সময় ও পদ্ধতির আভাস ও বর্ণনা প্রদত্ত হয় নিছক কল্পনা থেকে এক ভবিষ্যত ঘটনার মাধ্যমে রূঢ় বাস্তবে রূপান্তরের এই বীভৎসতা পরবর্তীকালে নাটকটির প্রতি আমাদের আবিষ্ট করে এক পরাবস্তবিক মোহে, এবং এই নাটকটিকে প্রদান করে এক প্রফেটিক আবহএখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, কল্পনা থেকে বাস্তবের দিকে গমনশীল এই ঘটনায় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে  ওঠে পাঁচ বছর সময়কাল যা বৃহত্তর অর্থে সময় নামক এক আপাতধ্রুব সত্যের এককএবং এই সময় নামক আপাতধ্রুব সত্যই হল ‘হোয়েন ফাইভ ইয়ারস্ পাস’ নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। নাটকের প্রোটাগনিস্ট ইয়ংম্যানকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু পাঁচ বছর পর তাদের আবার সাক্ষাৎ হলে দেখা যায় ইতিমধ্যে তার প্রেয়সী এক ফুটবল খেলোয়াড়ের প্রেমে পুরোপুরি নিমজ্জিতএরপর, ইতিমধ্যেই তার প্রতি আসক্তা প্রেমিকা সেক্রেটারির কাছে ইয়ংম্যান বিয়ের প্রস্তাব করলে সেই সেক্রেটারিও পাঁচ বছর অপেক্ষার শর্ত আরোপ করে। অপেক্ষার অন্তহীন প্রক্রিয়ায় পূর্ণতালাভ চিরকালীন মুলতুবী হয়ে যায়ইয়ংম্যান হয়ে ওঠে ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র ট্র্যাম্পযুগল যার কাছে একমাত্র মূর্ত সত্য হল অপেক্ষা। সেখানে ক্রমশ মূর্ত থেকে বিমূর্ত হয়ে ওঠে সময়; এবং, অন্তিম পর্যায়ে মূর্ত থেকে বিমূর্ত হয়ে ওঠে ইয়ংম্যান নিজেও।

‘আ লিজেন্ড অফ টাইম ইন থ্রি অ্যাক্টস অ্যান্ড ফাইভ সিনস্’ উপনামে ভূষিত এই নাটকের অন্যতম বিষয় রূপে উঠে আসে মূর্ত, নির্দিষ্ট, স্থিরীকৃত সত্তার পরিবর্তে সময়ের উপর এক বিমূর্ত, দ্রব সত্তা আরোপণ যা নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে বিচ্যুতির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা ও বোধে রূপান্তরিত হয়প্রথম অঙ্ক সময়ের নিরিখে স্থগিত অবস্থায় শেষ হয় — প্রথম দৃশ্যে ঘড়িতে ছ’টা বাজে। শেষ দৃশ্যে ইয়ংম্যানের চাকর, জন, ঘোষণা করে তখন ছ’টা বাজে। মনে হয়, গোটা অঙ্কে যে নিষ্ক্রিয়তা ইয়ংম্যানের জীবন প্রক্রিয়াকে ঘিরে থাকে সেই একই নিষ্ক্রিয়তা আরোপিত হয় সময়ের উপরেও। সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠেপ্রথম অঙ্ক ও দ্বিতীয় অঙ্ক পাঁচ বছরের সময়-ব্যবধান দ্বারা বিভাজিত, এবং দ্বিতীয় অঙ্ক ও তৃতীয় অঙ্ক বিভাজিত একটি চন্দ্রগ্রহণের মাধ্যমে। নাটকের শেষে ঘড়িতে ঘোষিত হয় বারোটা, কিন্তু তখনও জন দৃঢ়ভাবে সময় ঘোষণা করে ছ’টা। নাটকের সমস্ত ঘটনাবলী সংঘটিত হয় আলো-আঁধারিপূর্ণ সময়কালে — গোধূলি থেকে ঊষাকালের মধ্যে — যা অপরিজ্ঞেয়তা, অথবা এক বিকল্প ভাষায় ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়া সূচিত করে। এভাবেই বাস্তবকে এক নাছোড় ধৃষ্টতায় নির্দয় প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের দৃষ্টিপথে ক্রমাগত ভেসে উঠতে থাকা একের পর এক দৃশ্য। প্রথম দুটি দৃশ্য সংঘটিত হয় যথাক্রমে লাইব্রেরি এবং বেডরুমে। কিন্তু তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য উপস্থাপিত হয় বিশালাকার গাছের গুঁড়ি সজ্জিত জঙ্গলে — এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক সাবলীল ও স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় থিয়েটার রূপান্তরিত হয় মেটাথিয়েটারে, বাস্তব রূপান্তরিত হয় পরাবাস্তবে।

মেটাথিয়েটার হিসেবে ‘হোয়েন ফাইভ ইয়ারস পাস’ সময় নামক আপাতধ্রুব আপাতঅবিচল সত্য, সেই আপাতঅবিচল সত্যের আড়ালকে ছিঁড়ে আরও গভীর এক সত্যের দিকে নিয়ে যায় এক কাব্যময়, এবং ফলস্বরূপ কোমল ভঙ্গিমায় এখানে আরোপিত পূর্ব সত্যকে পেরিয়ে উঠে আসে এক পরাবাস্তবিক নতুন সত্য — ‘ফ্যামিলিয়ার, কনক্রিট অবজেক্টস’ অতিক্রম করে উঠে আসে ‘নিউ  কনটেক্সটস’ যেখানে “familiar actions become sinister and sinister actions become familiar”বাস্তব ও পরাবাস্তবের মধ্যে ক্রমাগত এই  যাতায়াত, নিয়ত এই স্থানবদল, এই ‘ইনভার্টেডইনফারেন্স’, এই অস্থিরতা মঞ্চে ঘটতে থাকা ঘটনাবলীর মাধ্যমে আমাদের মনে ক্রমশ নির্মিত প্রতিচ্ছবিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গঠন করে এক বিকল্প প্রতিচ্ছবি। ভেসে ওঠে অবিশ্বাস, ভেসে ওঠে প্রশ্ন। যা কিছু ক্রমশ ঘটে চলেছে মঞ্চের উপর তা কি সত্যিই ঘটছে সেখানে? নাকি অন্য কোথাও, অন্য কোনো এক স্তরে ঘটছে সেই সব ঘটনাবলী? মঞ্চের চরিত্রদের কোনো অতীত জীবন উপস্থাপিত হয় নাবর্তমানে, মঞ্চে, এরকম কোনো ঘটনাই ঘটছে না যা তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে প্রেরণা প্রদান করে। প্রথম অঙ্ক এবং একেবারে অন্তিম দৃশ্য সংঘটিত হয় একটি বই-বোঝাই ঘরে। অর্থাৎ লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরি-অবস্থান অনিবার্যভাবেই সূচিত করে এক ‘ইন্টারটেক্সচুয়াল স্পেস’ যাকে নিরূপণ করা যায় অন্যান্য সাহিত্যের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে, দৃষ্টান্তের সাপেক্ষে। দৃষ্টান্ত রূপে দৃঢ় ভাবে উঠে আসে দুটি টেক্সট — লেনোমঁ’র ‘টাইম ইজ আ ড্রিম’ এবং লোরকা’র নিজেরই ‘থিয়েটার অফ সোলস্’এছাড়াও ভেসে ওঠে আরও কিছু নাম — হোর্হেমানরিকে, জাঁ ককতো এবং লুইজিপিরানদেলো। বইয়ের প্রতি এহেন আসক্ত ইয়ংম্যান, স্বাভাবিক ভাবেই, নিয়ত নিমজ্জিত থাকে নিজস্ব কল্পনায়, চিন্তায়। কল্পনায় নিয়ত নিমজ্জিত অস্তিত্বকে কোনো এক গভীর সংকেতবাহী বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে নিলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এক বিকল্প ব্যাখ্যার সম্ভাবনা: ইয়ংম্যানের মনের অতলেই হয়তো বা সমস্ত ঘটনাবলী সংঘটিত হচ্ছে, বাস্তবে নয়এই বিকল্প ব্যাখ্যাকে মান্যতা প্রদানের মাধ্যমে আরও কিছুটা অগ্রসর হলে দেখা যায় বিভিন্ন চরিত্রেরা আসলে তার আপন নির্যাতিত সত্তার নানান বাহ্যিক রূপতার মনের অন্তরে নিয়ত বহমান বিক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন চিন্তা ক্রমাগত মিছিলাকারে অভিক্ষিপ্ত হতে থাকে মঞ্চে, এবং মূর্ত হয়ে ওঠে বাস্তবে। এখানে পরাবাস্তবিক ঘটনা প্রক্রিয়ার এক বিপরীত, যদিও বিরোধহীন, প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়: মূর্ত অবস্থা থেকে বিমূর্ত হয়ে ওঠার বদলে বিমূর্ত অবস্থা থেকে মূর্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ভাবনা বিমূর্ত অবস্থা থেকে মূর্ত হয়ে ওঠে; নিরাবয়ব, নিরাকার চিন্তা সাবয়ব ও সাকার রূপ ধারণ করে। কিন্তু এ এক আত্মধ্বংসরূপ প্রক্রিয়া। নিরন্তর আহূত অতীত এবং এক অসম্ভাব্য ভবিষ্যতের মিথষ্ক্রিয়ায় ইয়ংম্যান, যে এই সমগ্র প্রক্রিয়ার স্রষ্টা ও নিয়ামক, নিজেই ক্রমাগত বিজারিত হতে থাকে।

মানসিক স্তরে ক্রিয়াশীল ঘটনাবলীর অভিক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হল ওল্ডম্যান চরিত্রটির। ওল্ডম্যান আসলে দান্তের ভার্জিলের প্রতিরূপ যে ইয়ংম্যানকে চালিত করে তার আপন মনের অভ্যন্তরে। ওল্ডম্যান নির্মাণ করে এক ধারণা যেখানে বিবৃত হয় আন্তরজীবনের গুরুত্ব যা অনায়াস ভঙ্গিমায় অতিক্রম করে যায় “anything outside us, that’s exposed to the air and to death”‘রিমেম্বার’ শব্দটি বারংবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে যথার্থভাবে প্রকাশিত হয় তার অস্তিত্বের গঠনগত পরিচয়: তার মূর্ত সত্তা আসলে বিমূর্ত অতীতকাল দ্বারা নির্মিত। নিষ্ক্রিয়তার অপরিহার্য ফাঁদে বন্দী হয়ে সে ত্রিশঙ্কু অবস্থাপ্রাপ্ত হয় অতীত ও বর্তমান কালের মধ্যস্থলে: “one should remember with an eye to the futureঅতীতকালের আরোপিত ব্যক্তিরূপ ওল্ডম্যানের বিপরীত অবস্থানে অধিষ্ঠিত ফার্স্ট ফ্রেন্ড চরিত্রকল্পটি: সে শুধুমাত্র বর্তমানে, বর্তমানের জন্যে, বর্তমানের সাপেক্ষে জীবনধারণ করেআবার, প্রত্যক্ষ ভোগবাদী বিলাসযাপনের মাধ্যমে ফার্স্ট ফ্রেন্ড অনেকাংশেই অবদমিত যাপন প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত সেকেন্ড ফ্রেন্ডের বিপরীতার্থক অবস্থান গ্রহণ করে। সেকেন্ড ফ্রেন্ড আসলে ইয়ংম্যানের অলটার ইগো: স্বপ্ন ও জাগরণের অন্তঃস্থলে চিরস্থগিত। যুবকের, অথবা কোনো যুবতীর পোষাকে সজ্জিত সেকেন্ড ফ্রেন্ড অনির্ধারিত লিঙ্গ পরিচিতির মাধ্যমে ডেড চাইল্ডের সমরূপ হয়ে ওঠে: অনির্ণায়ক সময়সীমায় আবদ্ধ। সাবালকত্বের মাধ্যমে পূর্ণতাপ্রাপ্তি অলব্ধ থেকে যায় দু’ক্ষেত্রেই সময়ের আগ্রাসন সূচনাকারী শারীরিক ক্ষয়চিহ্ন সেকেন্ড ফ্রেন্ডকে ভয়ার্ত করে তোলে।

সেকেন্ড ফ্রেন্ডের আত্মরূপ ইয়ংম্যানকেও ভয়, এক অন্য রূপে, অন্য মাত্রায়, অন্য বিষয়ে, আচ্ছাদিত করে রাখে: নারীপ্রতিনিধির প্রতি ভয়। এই ভয় তাকে নারীদের বিষয়ে কল্পনাপ্রবণ করে তোলে যে কল্পনার মাধ্যমে প্রসবিত নিরাপদ আশ্রয়ে সে আত্মগোপন করেএই ঝুঁকিহীন নিরাপদ আশ্রয় সন্ধান তাকে রূঢ় বাস্তব থেকে দূরে কল্পনার আপাত মনোরম আপাত পেলব মখমলি আবরণে ঢেকে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় নাটকের সমস্ত নারীচরিত্র, কিছু পরিমাণে অন্তত, ইয়ংম্যান দ্বারা কল্পিত মায়ারঙে চিত্রিত হয়কামুক গার্লফ্রেন্ড থেকে সংযমী, লাজুক সেক্রেটারি সকলেরই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ইয়ংম্যানের নানাবিধ কল্পনাকে চিত্ররূপ প্রদান করা। পরবর্তীকালে, অন্তিম পর্যায়ে, ম্যানিক্যিন এবং মাস্ক অভিক্ষেপণের মাধ্যমে তুলে ধরে ইয়ংম্যানের “fossilization of the women he meets so that he can overcome his fear of them”

ম্যানিক্যিন ও মাস্ক আত্মপ্রকাশ করে প্রতীকী চরিত্র রূপে। হার্লেক্যিন ও ক্লাউনও একই উদ্দেশ্যে রূপায়িততবে, শেষ দুটি প্রতীকী চরিত্র বহন করে এক অন্য সত্তা ও পরিচয়: এরা ম্যাকিয়াভেলিয়ান শক্তির প্রতিভূ। এরা ইয়ংম্যানকে কোণঠাসা করে তোলে, ইয়ং গার্লের মৃত প্রেমের খোঁজ সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলে, এবং সেক্রেটারিকে পুতুলমাফিক চালনা করে। শেষ দৃশ্যে লাইব্রেরিতে উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা স্যুটকেস 
                                                  (মুয়েরতে এন গ্রানাদা - প্রারম্ভিক দৃশ্য)

নাটকের চরিত্রদের প্রস্থানের ইঙ্গিতবাহী। ইয়ংম্যান ততক্ষণে নিরাশ ও নির্জীব মৃতবৎ চরিত্রে রূপান্তরিতএরপর আবির্ভূত হয় ধ্বংসের দূত: তিনজন কার্ড প্লেয়ার ইয়ংম্যান তখন প্রেতসদৃশ। দেয়ালে অভিক্ষিপ্ত হরতনের টেক্কায় তিনজন মৃত্যুদূত দ্বারা পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত নীরব তীরগুলো গেঁথে যায়: ইয়ংম্যান মৃত্যু বরণ করেএই শেষ দৃশ্যটি শুধুমাত্র ইয়ংম্যানের অনস্তিত্ব সূচিত করে না, বরং সমগ্র বাস্তবতার অনস্তিত্বের  ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে আপাত বহমান সময় স্থবিরতাপ্রাপ্ত হয়। বাস্তব স্থবিরতালাভ করে সময়ের নিরিখে


                              (লোরকার বাস্তব মৃত্যু-দৃশ্য)

বাস্তব স্থবিরতা লাভ করে ফটোগ্রাফেও। কোনো একটি মুহূর্ত ধরা পড়ে ছবিতে। কোনো একটি চরিত্র অথবা অনেক চরিত্র, যারা ছবির ফ্রেমে বন্দি, যারা অতীতহীন, আন্তরজীবনহীন, ইঙ্গিত করে নানাবিধ ঘটনাবলী, চিন্তা, দর্শন, জীবনপ্রণালী, কিন্তু সেই ইঙ্গিত নিঃসন্দেহে গভীরতাহীন। ছবিতে বন্দি চরিত্র অথবা মুহূর্ত শুধুমাত্র বাস্তবের উপরিতলকে তুলে ধরে। রোলাঁ বার্ত ফটোগ্রাফকে ‘a kind of primitive theatre’ রূপে চিহ্নিত করেছেন এই গভীরতাহীন উপস্থাপনার কারণে যে উপস্থাপনার অকৃত্রিমতা পরীক্ষিত নয়। তাঁর মতে ফটোগ্রাফ হল ‘ডেড ইমেজ’ যেখানে চরিত্রেরা নানাবিধ ভঙ্গিমায় উপস্থিত হয় এবং সেই কৃত্রিম ভঙ্গিমাসহ  স্থবিরতা লাভ করে। ‘হোয়েন ফাইভ ইয়ারস পাস’ নাটকটিকেও এই তত্ত্বের আলোকে বিচার করা যায় নির্দ্বিধায়। এই নাটকটিও একই রকম ‘ডেড ইমেজ’। কিন্তু এখানেও থেকে যায় এক বিকল্প ব্যাখ্যার সম্ভাবনা। উঠে আসে এক বিকল্প, অথবা গভীরতর ও বিস্তৃততর বিশ্লেষণ, আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতের সাপেক্ষে। মনে হয় এখানে কোনো একটি ফটোগ্রাফ সম্প্রসারিত হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রায়নের উদ্দেশ্যে; সেই ফটোগ্রাফে পরিবেশিত বাস্তবের উপরিতল নিপুণরূপে পরিবর্তিত হয়েছে, নবরূপ প্রদত্ত হয়েছে কোনো একটি নির্দিষ্ট চিন্তা ও বিষয়ের দৃঢ় ও সুনিশ্চিত উপস্থাপনার উদ্দেশ্যেসেই চিন্তা ও বিষয়, অনিবার্যভাবেই, সময়ের স্থবিরতাপ্রাপ্তি, সময়ের বিমূর্তভবন


উৎস ও ঋণ
1.     Anderson, Reed (1984) Federico García Lorca (Macmillan Modern Dramatists), London: Macmillan.
2.     Barthes, Roland (1982) Camera Lucida: Reflections on Photography, trans. Richard Howard, London: Vintage.
3.     Bonaddio, Federico (Ed.) (2007) A Companion to Federico García Lorca
4.     Delgado, Maria M. (2008) Federico García Lorca, London: Routledge
5.     Edwards, Gwynne (1980) Lorca: The Theatre Beneath the Sand, London: Marion Boyars.
6.     Lorca, Federico Garcia (2011): When Five Years Pass.
7.     Morris, C. Brian (1972) Surrealism and Spain 1920–1936, Cambridge: Cambridge University Press.
8.     Stainton, Leslie (1999) Lorca: A Dream of Life, New York: Farrar, Straus, Giroux.
9.     Wright, Sarah (2000) The Trickster-Function in the Theatre of García Lorca, London: Tamesis


সুনীতি দেবনাথ




লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক : হুয়ান রুলফো




লাতিন আমেরিকার মেহিকোর বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুয়ান রুলফো
তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাসটি হচ্ছে 'পেদ্রো পারামো' হুয়ান রুলফোর জীবৎকাল ১৯১৭ থেকে ১৯৮৬ সাল অব্দি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো' নামক ক্ষীণকায় উপন্যাসটি একুশ শতকের গোড়ার দিকে উরুগুয়ের বিখ্যাত পত্রিকা El Paris লাতিন আমেরিকার লেখক, সমালোচকদের কাছে ভোটিং পোলে জানতে চায় ওখানকার  সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কোনটি? এই ভোটিংএ হুয়ান রুলফোর উপন্যাস 'পেদ্রো পারামো'র নাম উঠে আসে এই উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল স্প্যানিশ সাহিত্যে দন কিহেতোর লেখক সার্ভেন্তেজের (১৫৪৭- ১৬১৬) পর সবচেয়ে প্রভাবশালী মৌলিক কথাশিল্পী-কবি ছিলেন আর্হেন্তিনীয় হোর্হে লুই বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬) তাঁর অভিমত ছিলো,   এটি লাতিন আমেরিকা তো বটেই গোটা বিশ্বেরই উল্লেখযোগ্য গুটিকতক ভালো কাজের একটি একই মহাদেশীয় বিশ শতকের আরেক বিশ্বখ্যাত কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪)  বলেন যে, এই বইটি পড়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে 'One Hundred Years of Solitude' বইটি লেখা সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে মার্কেজের এই বইটি একটা মাস্টারপিস রুলফোকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার আরেক মহান কথাসাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তেস (১৯২৮-২০১২) ফুয়েন্তেস উপন্যাসটি অবলম্বনে একই শিরোনামে ১৯৬৭ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন স্পেনে 'দন কিহোতে' যেরূপ সম্মানজনক স্থানে অবস্থান করছে,  মেহিকোতে সেই অবস্থানে 'পেদ্রো পারামো' এমন কথা বলাই যায়
দান্তে (১২৬৫-১৩২১) রচিত মহাকাব্য 'ইনফারনো'তে  এই অলীক এবং বাস্তবতা যেভাবে মিশে একাকার হয়ে আছে, ঠিক তেমনি হুয়ান রুলফোর উপন্যাসে ঘটেছে উভয় ক্ষেত্রেই অলীক আর বাস্তবতাকে আলাদা করা যায় না অদ্ভুত এক কাহিনী যেখানে বাস্তবকে  অলীক মনে হয়, আর অলীক সামগ্রিকভাবে যেন বাস্তব বলে অনুভূত হয়

সমগ্র বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছিলেন ঔপন্যাসিক হুয়ান রুলফো
তাঁর উসন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে 'কমলা' নামে একটি গ্রামের গ্রামটি মৃতদের গ্রাম এ গ্রামে মৃতদের কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হুয়ান প্রিসিয়াদো মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের পূর্ব নির্দেশ মতো এখানে তার বাবাকে খুঁজতে আসে এ গ্রামে মানুষ আছে, কিন্তু তাঁরা যেন স্বাভাবিক নয় সব কিছু বিবৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন স্মৃতির ভিন্ন এক স্তর, অন্য এক জগৎ মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাতাসের শব্দ শুনে মনে হয় হুয়ানের এটা যেন জীবিত গ্রাম সে জানতে পারে তার বাবা হুয়ান পারমার আগেই মারা গেছেন গ্রামটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘sits on the coals of the earth, at the very mouth of hellএখানে আসার আগে হুয়ান মায়ের কাছে জেনেছিলো এখানে সে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে মা তাকে কথা দিয়েছিলেন

এখানে হুয়ান এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়
এই বৃদ্ধা হুয়ানকে দেখেই চিনতে পারে, সে সব কিছু হুয়ানের মায়ের কাছে  তাঁর মৃত্যুর আগেই জানতে পারে অথচ হুয়ানের গ্রাম এখান থেকে অনেক দূর কাহিনীর বিস্তার এভাবেই চলতে থাকে ত্রিকাল এখানে মিলে মিশে একাকার মৃতদের গ্রাম অনবদ্য কৌশলে জীবিতের  গ্রামের মত হয়ে যায়, স্থানিক দূরত্ব মিটে যায় অদ্ভুত এক মিশেলে কোনটা বাস্তব, কোনটা অলীক বুঝতে পারা যায় না এ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে যেন 'Magic Reality বা 'যাদু বাস্তবতা' 




উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে লেখা হলেও উত্তরাধুনিক (postmodern) উপন্যাসের নানা উপকরণ বা রচনাকৌশল এখানে বিদ্যমান
উপন্যাসের প্রথম দিকে ন্যারেটর হুয়ান প্রিসিয়াদো স্বয়ং কিন্তু খুব শিগগিরই ন্যারেটরের ভূমিকায় অন্য একজন চলে আসে আবার হুয়ানের মৃত মা বর্ণনাকারীর ভূমিকায়ও অংশ নেন ন্যারেশনে এই ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতির জন্যই উপন্যাসের সময়টা সঠিকভাবে স্থির করা যায় না এতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের নানা মুহূর্ত চলমান থাকে সক্রিয়তা সহকারে ফলশ্রুতিতে সেটিং বলে কিছু থাকে না কোনো-কোনো সমালোচক 'কমলা' গ্রামকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন ক্লাসিক মহাকাব্য ইনফারনোতে যেমন ভার্জিল গাইড হয়ে মূল চরিত্র দান্তেকে নরকের পথ চিনিয়ে দেয়, এই উপন্যাসেও তেমনি আবানদিও চরিত্র হুয়ানকে 'কমলা' গ্রামে পৌঁছে দেয় আরো অনেক অনেক ব্যাখ্যাও এই উপন্যাসের আছে ১৯৫৫ সালে লিখিত এই উপন্যাসে উত্তরাধুনিক বা postmodern উপন্যাসের নানা উপকরণ তথা রচনাশৈলী উপস্থিত আছে বলা যায় যে কারণে এই উপন্যাস পরবর্তীতে লিখিত কথাসাহিত্যে প্রত্যক্ষভাবে  বা পরোক্ষভাবে নানা  প্রভাব বিস্তার করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না এখানেই বিশ্ব কথাসাহিত্যে এই উপন্যাসের গুরুত্ব আর রুলফোকে যে মাস্টার কথাসাহিত্যিক বলা হয় তার কারণ হচ্ছে তিনি স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে জাগতিক বাস্তবতাকে তুরীয় বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম ছিলেন উপন্যাস ও ছোটগল্প দুটি বিষয়েই তাঁর এই দক্ষতা দেখা যায়

'পেদ্রো পারামো' উপন্যাসের পাশাপাশি রুলফো পনেরোটি গল্প নিয়ে লিখেছিলেন তাঁর একমাত্র ছোটগল্পের বই 'জ্বলন্ত প্রান্তর' (The Plain in Flames)
আর এসব দিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী লেখকদের শ্রেণীতে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গিয়েছে এই দুটি বই তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৩ ও ১৯৫৫ সালে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবৎকাল এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তেমন কিছু লেখেননি তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য একটা অসমাপ্ত উপন্যাস পাওয়া গেছে কিছু লোকসংস্কৃতি-বিষয়ক নিবন্ধ লেখেন তিনি, যেগুলি তিনি বেঁচে থাকতেই প্রকাশিত হয়েছিল এই না-লেখার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি নিজেই  বলেছেন, ‘In my life there are many silences,’  তাঁর এই নীরবতা যেন একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো হয়ে তাঁর সব লেখাতেই উঠে এসেছে আর বেশ কিছুটা তীব্র হয়ে উঠেছে ছোটগল্পগুলিতে একটা অব্যক্ত হতাশা, জীবনের অর্থহীনতা তাঁর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয় অল্পকথার মানুষ রুলফো কম কথাতেই কয়েক জীবনের কথা বলে দিতে পারতেন  শব্দ দিয়ে যতটা বলতেন, না-বলা (silence) দিয়ে বহুগুণ বেশি যেন বলে দিতেন তাঁর আখ্যানের গতি অতি মন্থর, প্রায় নিশ্চল অল্প চলে এদিক-সেদিক করে গদ্য সর্বত্র উচ্ছ্বাসহীন, পুকুরের জলের মত উত্তালতাহীন কিন্তু একঘেয়ে নয়, কারণ তাঁর অব্যক্ত উচ্চারণ প্রায় প্রতিটি শব্দে বা বাক্যের পেছনে সংযুক্ত থেকে যেত নীরবে অনেকটা যেন কবিগুরুর ভাষায় 'কত কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি...' এমন মেদহীন-আভরণহীন গদ্যে ঢেউ তোলার শিল্প যেন একমাত্র তাঁরই রপ্ত ছিল, যার পরিমিত উপস্থিতি রুলফোর অগ্রজ ফরাসি কথাসাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) সাহিত্যে পাই

রুলফোরভোরবেলায়গল্পটি ছোট পরিসরের গল্প, এক সকাল থেকে আরেক সকাল পর্যন্ত বিস্তৃত
দারিদ্র্য এবং শোষণের ফাঁদে আটকা পড়েছে গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ এসেত্মবান বৃদ্ধের বর্তমান যেন নেই, নেই স্মৃতিতে তার অতীত ভবিষ্যৎ? তাকে জেলে যেতে হচ্ছে তার মালিককে খুন করার অপরাধে গল্পের সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়বৃদ্ধ মনে করতে পারছে না, খুনটি সে আদৌ করেছে কিনা তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময় সে একটুও বিস্মিত-বিচলিত হয় না আত্মপক্ষও সমর্থন করে না স্মৃতিভ্রষ্টতার কী নিদারুণ অভিশাপে সে অন্যের অভিমতের উপর নির্ভরশীল 

আমরা ভীষণ গরিবএবংমাকারিওগল্পে অবচেতন-কাম একটা উপলক্ষ হয়ে এসেছে; আরভোরবেলায়উপলক্ষ হয়ে এসেছে অবচেতন-ক্রোধ
বুড়ো এসেত্মবান নিজে খুন করার পেছনের গল্পটা সাজাতে চেষ্টা করে আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-১৯৬০) The Stranger উপন্যাসের প্রধান চরিত্র Meursault-এর চেহারাটি তখন মনে পড়ে যায় পার্থক্য হচ্ছে, Meursault জানে সে খুন করেছে, কিন্তু এসেত্মবান জানে না খুনটা করেছে কিনা কিন্তু দুজনেরই নিরুত্তাপ অনুভূতি পাঠকের চেতনায় একইভাবে ধাক্কা দেয়

নিজের চেনাজানা জগতের কথাই বলেছেন তাঁর লেখায় রুলফো, এর বাইরে তিনি কিছুই বলেননি
এজন্য রুলফোকে বুঝতে হলে তাঁর জীবনী ও সমসাময়িক মেহিকোর সমাজবাস্তবতা জানা জরুরি রুলফোর জন্মগ্রাম হালিস্কোতে সবুজ তৃণভূমি বলে কিছু ছিল না বন্ধ্যা জমি আর পরিত্যক্ত পোড়ো গ্রাম তাঁর দেশ দেশের সাধারণ জনগণের ভবিষ্যৎ নিঃস্বতায় রুক্ষ কঠোর রুলফোর বাবা রক্ষণশীলদের গুলিতে নিহত জীবিতরাও মৃতবৎ হয়ে যায় তাদের অজান্তেই সবাই যেন পেদ্রো পারামো উপন্যাসের বায়বীয় গ্রাম 'কমলা'-র বাসিন্দা হয়ে ওঠে মরে ভুত হয়েছে বলেই হয়তো এরা মেহিকোর এই বিভীষিকার মধ্যে এখনো টিঁকে আছে!

ওরা আমাদের জমি দিয়েছিলএবংলুভিনাগল্পে বৃষ্টিহীন যে প্রান্তরের কথা বলা হয়েছে, সেই প্রান্তর  রুলফোর জীবনবাস্তবতারই অংশ এই বিশেষ অর্থে রুলফোকে জাদুবাস্তবতার আচ্ছাদনে খাঁটি বাস্তববাদী লেখক বলতে হয় ওরা আমাদের জমি দিয়েছিলগল্পে শুরুতে গল্পকথক ঘন্টার পর ঘন্টা বৃক্ষের ছায়াহীন, চারাগাছ এমনকি শেকড়বাকড়হীন পথে হেঁটে যাচ্ছিল এতক্ষণে কুকুরের ডাক শোনা গেল তার মনে হচ্ছিল ফুটিফাটা ধূ ধূ প্রান্তরের যেন শেষ নেই, যদি বা থাকে সেখানটায় কিচ্ছু নেই কিন্তু একটা গ্রাম আছে, সেখানে কুকুর ডাকছে, মানুষের গন্ধ মেশা ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে, যেন একটা আশা এখনো টিঁকে আছে তবে গ্রামটি বেশ দূরে, ঝড়ো বাতাসের টানে কাছে বলে মনে হচ্ছে

গল্পের সূচনার বুননশৈলী নিখুঁত, নিপাট এবং সুমিত
কথনে বাহুল্য নেই, আছে পরিমিতি ও শিল্প সৌকর্য এখানেই নিহিত রয়েছে রুলফোর কুশলতা আরো দেখা যেতে পারে

অনেক মানুষের মাঝে মাত্র চারজন টিঁকে আছে
গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে চাষের জন্য এই মস্ত অকেজো প্রান্তরটি দেওয়া হয়েছে সরকারি লোক এসে বলেছে, ‘এখান থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব জমিন তোমাদেরএই জমিতে বৃষ্টি হয় না কখনো এভাবে গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকানো হয়েছে গল্পকথক বলে
তো, ওরা আমাদের এই জমি দিয়েছে
আর এই তপ্ত পৃথিবীপৃষ্ঠে ওরা চায় আমরা কিছু বুনি, দেখতে চায় কোনো কিছু আদৌ গজায় কিনা কিন্তু এ মাটি থেকে কোনো কিছুই বের করে আনা সম্ভব নয় এমনকি বাজপাখিও এখানে দেখবে না তাদের তুমি দেখবে খুব উঁচুতে তড়িঘড়ি করে উড়ে যাচ্ছে, যত শিগগিরই সম্ভব এই অভিশপ্ত জমি থেকে পালিয়ে যেতে এখানে তুমি এমনভাবে হাঁটো যেন পদে পদে পা পিছলে পেছনে ফিরে যাচ্ছে উদ্ধৃত গল্পাংশে বড় নিদারুণভাবে হতদরিদ্র মানুষের নিঃস্ব জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে আরো দেখানো হয়েছে কিভাবে নিরীহ গ্রামীণ মানুষদের ঠকিয়ে যাচ্ছে দেশের সরকার ও পুঁজিপতিগণ মানবসমাজের একটা সার্বজনীন বঞ্চনা আর নিপীড়নের চিত্র এখানে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বে এমন চিত্র দেখা যায় তাই রুলফোর গল্পগুলির সার্ববজনীনতা স্বীকার করে নিতেই হয়



আমরা ভীষণ গরিবগল্পে গল্পকথকের পরিবার সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব
হঠাৎ বৃষ্টিতে পরিবারের শেষ অবলম্বন ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে বোনের বিয়ের যৌতুক হিসেবে দাবি করা গরুটি বন্যায় ভেসে গেছে এখন পরিবারের একমাত্র আশা হলো অবিবাহিত বোনটি কারণ নিশ্চিত করে বলা যায় গরু যৌতুক ছাড়া কেউ তাকে বিয়ে করবে না আর বিয়ে না হলে বড় দু’বোনের মতো সেও গণিকাবৃত্তি করে  সংসারে সহায়তা করতে পারবেকোনো কুকুর ডাকে নাগল্পে প্রাণহীন প্রান্তর ছেড়ে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে একটি বাসযোগ্য গ্রামের সন্ধানে পিতা মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে ছেলে পথে ডাকাতের চাকুতে আহত হয়েছে, দ্রুত চিকিৎসা দরকার ওর দীর্ঘক্ষণ চলার ফলে ছেলের পা বাবার কাঁধে গেঁথে গেছে বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করছে কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছে কিনা কারণ কুকুরের ডাক শুনতে পেলে তারা লোকালয়ের সন্ধান পাবে যখন বাবা সত্যি-সত্যি কুকুরের ডাক শুনতে পায়, তখন ছেলে আর জীবিত নেই অদ্ভুত সব কাহিনী, জনজীবনের বাস্তব সত্যের নিখুঁত চিত্রায়ন মনে হয় রুলফোই বুঝি একমাত্র এমন লিখতে পারেন

ছোটগল্পেও রুলফো কাল্পনিক গ্রামের প্রেক্ষিতে  তাঁর সমসাময়িক চরম বাস্তবতার বেদনাবহ ছবি এঁকেছেন
তারই সাথে শিল্পবোধ সমৃদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টি ও মানবিক জীবনবোধের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহান কথাশিল্পী তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে কয়েক প্রজন্মের লেখকদের কাছেওস্তাদকথাসাহিত্যিক হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও অমর হয়ে থাকবেন বলে বিশ্বাস