কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

অচিন্ত্য দাস




তুমি কি কেবলই


ক্লাস ফাইভ অবধি বাবুয়া, সুরঞ্জনা আর আমি একসঙ্গে ইস্কুল থেকে ফিরতাম। একই পাড়ায় থাকতাম কি না! খুব ভাব ছিল আমাদের। মনে আছে একদিন  রাস্তায় বৃষ্টি এসে পড়াতে, বাবুয়া নিজের ব্যাগটা সুরঞ্জনার মাথার ওপর ধরে রেখেছিল অনেকটা রাস্তা। সুরঞ্জনার মা বলতেন – “অতটা রাস্তা হেঁটে আসে, ভয় করে রিক্সা-টিস্কার ব্যবস্থা করো” বাবা হাসতেন – “পাশে দু-দুটো বালকবীর থাকতে ভয় কীসের!”

ক্লাস সিক্স থেকে প্রাইমারি স্কুল শেষ, সু মেয়েদের ইস্কুলে চলে গেল। এই সময় বাবুয়াকে নিয়ে একটা বড় কষ্টের ঘটনা দেখলাম, অবশ্য বছর খানেক ধরেই  একটু একটু বোঝা যাচ্ছিল। অনেক ডাক্তার-বদ্যি করেও কিছু হল না। বাবুয়ার নাকি ‘মস্তিস্কের বিকাশ’ বন্ধ হয়ে গেছে ও আর কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না। ইস্কুলের পড়া আর বুঝতে পারছিল না, ছাড়িয়ে দিতে হল। বাবুয়ার একটু আঁকার হাত ছিল, আঁকার টিচার রেখে, রঙ আর ড্রইংখাতা দিয়ে বহু চেষ্টা হয়েছিল। সেরকম উপকার হয়নি, তবে ছবি আঁকত খুব। ছবিগুলো খুব খারাপ যে হত তা নয়, কিন্তু ছোটরা যেমন আঁকে তেমন। ক্লাস নাইন-টেন অবধি আমি আর সু  ওদের বড়িতে প্রায়ই যেতাম আমার মনে হত বাবুয়ার ‘সময়’ যেন ক্লাস ফাইভে এসে থেমে রয়েছে।

সময় অবশ্য বয়েই চলে। ইস্কুল পাশ করে কলেজে ঢুকলাম। আমি বি-এসসি, সু বি-এ। সু না এলেও বাবুয়ার কাছে আমি মাঝেসাঝে আসতাম। শরীরে বেড়েছিল তবে দেখে বোঝা যেত ও স্বাভাবিক নয়, মুখ থেকে লালা পড়ত সময় সময়। রং ঘষেঘষে ছবি আঁকাটা কিন্তু ছাড়েনি।

একসময় আমাদের কলেজও ফুরোলভাবছিলাম এম-এসসি পড়ব কি না। সুরঞ্জনা অবশ্যি ভাবাভাবির সুযোগই পেল না। বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাত্র ভাল, মেয়েও তো গ্রাজুয়েট, আর দেরি কেন। খবরটা পেয়েই বাবুয়ার  কাছে গেলাম। “বাবুয়া, দারুণ খবর! সুরঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে”
বাবুয়া খুশি তো হলই না বরং চোখ নামিয়ে নিয়ে অদ্ভুত স্বরে জিগেস করল  “কেন?”
 “কেন কি রে ... মেয়েদের তো এই বয়সে অনেকেরই বিয়ে হয়”
“কিন্তু আমরা দুজন যে একসঙ্গে...”
 “মানে... এসব কী বলছিস্... সে তো সেই ইস্কুলে পড়তে। তারপরে সু তো কত বছর আসেইনি, তুইও যাসনি!”
বাবুয়া ওর মোটা ড্রইং খাতাটা আমার সামনে ধপাস করে ফেলল – “এই দ্যাখ্, আমাদের কতবার দেখা হয়েছে, রোজই কথা বলি...”

খাতায় অজস্র ছবি। বিষয় একটাই – ইস্কুলের স্কার্ট-ব্লাউজ পড়া একটা মেয়ে। কখনো দূরে, কখনো কাছে। একটাতে দেখলাম – মেয়েটা মাঠে দাঁড়িয়ে, সামনে  দুটো ব্যাগ। মানে পরিষ্কার, বাবুয়া কাছেই আছে। পিকাসো নাকি একবার ছবি আঁকতে আঁকতে বলেছিলেন – ‘আমাদের সব কল্পনাই সত্যি’ 

চুপ করে রইলাম। বাবুয়ার দুনিয়ায় আমাদের নিয়ম তর্ক হিসেব ক্যালেণ্ডার কিছুই চলে না। আমার হাত খামচে ধরে বাবুয়া বলল – “অন্যলোক কেন সু’কে বিয়ে করবে?”



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন