কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলী ৪



(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।  

পদাপদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

মাদাম তুভোঁআদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)

সত্যি সত্যিই সে ব্যাটাকে অনেকদিন দেখতে পাওয়া গেল না তারপর। নিশ্চিন্তেই ছিলাম বেশ, কিন্তু কদিন বাদে একটু একটু গা চুলকোতে লাগল। মানে, ওই ব্যাটার সঙ্গে একটু আধটু পিরীতিনা হলে তো জীবন আলুনি লাগবেই। তাই ভাবলাম, ওর বাড়ি গিয়ে বরং একটা খোঁজ নিয়ে আসি। উত্তর কলকাতার এক কুখ্যাত গলির তস্য গলির ভেতরে ওর বাড়ি। অনেক কষ্টে পৌঁছলাম সেখানে। বাড়ি বলতে সাদামাটা বারান্দা দেওয়া দুকামরার ঘর। আর ওই বারান্দাতেই রান্নার ব্যবস্থা। কিন্তু কড়া নাড়তে বেরিয়ে এল এক প্রায় বৃদ্ধা নারী। পদার কথা জিজ্ঞেস করতে বলল, তিনি নাকি পদার মাসি, মোক্ষদা মাসি। আর পদা নাকি কোথায় গেছে, আমার নামধাম জেনে নিয়ে জানাল, এলে সব বলে দেবে। পদার যে এমন কোন মাসি আছে আগে কখনও শুনিনি অবশ্য। ফেরার পথে ভাবছিলাম, নামকরণ মোক্ষম বটে এই মোক্ষদা মাসির। একে বিশাল বপু, তেমনি বাজখাঁই গলা, আর, আর... যা সবার আগে চোখে পড়বেই এই মাসিকে দেখলে... দুই বিশালাকৃতি ঝুলন্ত স্তনের দোদুল্যমান পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম বলেই বলছি... তারপরেই আমার কেন যেন তারকা রাক্ষসীর কথা মনে পড়ে গেল। সে যাক, রূপ তো ঈশ্বরের দান, এই বলে নিজেকেই বকুনি দিলাম খানিক।  



দিন কয়েক বাদে আবার পদা এল। এদিকে বর্ষাকালও আর পেছন ছাড়ছে না। এই মাঝভাদ্রেও সে ঢালছে তো ঢালছেই। এদিকে বৃষ্টি থামলেই কড়া রোদ, সঙ্গে প্যাচপ্যাচে গরম। এইরকম বিচিত্র ওয়েদারে মেজাজও বিচিত্র ভাব দেখায় বইকি! কখনও নরম, কখনও গরম। তো এখন যেমন সপ্তমে সুর চড়ে আছে, ঠিক সেই মুহূর্তে হাড় জ্বলানো পদা গাল চুলকোতে চুলকোতে সোফায় বসে পড়ল গা ছেড়ে। আমি তেড়ে গেলাম- বসছিস কেন আবার? কাজের সময় বিরক্ত করবি না, বেরো বেরো এখন’ এইরকম মধুর আপ্যায়নেও ওর কোন হেলদোল নেই। আমি  বুঝলাম ওকে এখন নড়ানো যাবে না। আমি নিজের কাজে মন দিলাম। একটু বাদে যখন ওর কথা প্রায় ভুলেই গেছি, হঠাৎ দেখি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘জানিস আজ ইয়া ব্বড় একটা ইলিশ মাছ দেখে এলাম বাজারে।আমি বলে আবার কাজ করছি। এরপর সিড়ির ওপর কয়েকটা ধাপ উঠে এসে বসল। তারপর শুরু করল ওর ভাষণ। এই ইলিশ মাছ গুলো বড় হচ্ছে কেমন করে বল তো? জানিস না তো! শোন তাহলে। এই ধর যখন তুই ছোট্টটি ছিলি, রোগা, খেঁকুরে আর কী বিচ্ছিরি চেহারাটাই না ছিল তোর! তা সেই অবস্থা থেকে এখন যে এতখানি ফুলেফেঁপে উঠেছিস, তার পেছনে তোর মায়ের অবদান অনেকখানি। তোকে ভালমন্দ খাইয়ে পরিয়েছিল বলেই না! তা সেই ইলিশ-মাও তার ছানাকে আজকাল সেরেল্যাক খাওয়ায়, ওজন বাড়ানোর জন্য পেডিয়াসিওর খাওয়ায়।আমি কটমট করে ওর দিকে তাকালাম। বিশ্বাস করছিস না তো? এ আমার স্বচক্ষে দেখা। সেদিন যখন চান করতে গঙ্গায় নেমেছি, জানিসই তোডুব সাঁতার দিতে পারি অনেকক্ষণ। তা আমি সাঁতার কাটছি, আমার সঙ্গে একটা ইলিশও সাঁৎরাচ্ছে। আমি ভাবলাম মওকা বুঝে খপাৎ করে ধরব ব্যাটাকে। কিন্তু তারপরেই দেখি ওর সঙ্গে কয়েকটা রোগা রোগা ছানা পোনা’।

এই পর্যন্ত বলে ক্লাইম্যাক্স তুঙ্গে তুলে দিয়ে পদা তুরীয় হল যেন। আমি তো সাসপেন্সে মরে যাচ্ছি এদিকে। আর পারলাম না। এক ধাক্কা দিলাম ওর গায়ে। হতভাগা, ঝিমোচ্ছিস কেন?  তারপর কী দেখলি বলবি তো!পদা খানিক কান চুলকে নিল। তারপর শুরু করল। সেই মা বেটি এরপর দেখি ভুস করে গভীর জলে চলে গেল। খানিক বাদে এক মুখ এঁটেল মাটি নিয়েও এল। আর সেই সেরেল্যাকই খাইয়ে দিল ছানাগুলোকে।‘ ‘ওঃ! এই তোর সেরেল্যাক! ঢপ মারার আর জায়গা পেলি না?’ ‘বল, তোকে ছাড়া আর কাকেই বা বলি! টিভিতে সেরেল্যাক খেতে দেখা বাচ্চা গুলোকে দেখি প্রায়ই, আর মুদির দোকানে ফলমূল আঁকা প্যাকেটটা দেখে হেব্বি খেতে লোভ হল। জীবনে তো আর খাইনি ওসব। আমি তো আর অত দামী ইলিশ খেতে চাচ্ছি না, সামান্য সেরেল্যাক, তাও এমন মুখ ঝামটা দিচ্ছিস!এরপরের পর্ব খুব সরল টাইপের। আমি ওকে দিয়েই একটা অ্যাপেল সেরেল্যাক কিনে আনালাম। মনে হল আপেলের সঙ্গে তবু বড়দের একটা অসভ্য রকম যোগ আছে। এটাই একমাত্র পদার জন্য স্যুট করতে পারে। আর তারপর বাটি নয়, এক কাঁসি সেরেল্যাক খেয়ে, ঘুমিয়ে সে ব্যাটা বিদেয় হল।

ভাদ্রমাস শেষ হতে চলল প্রায় প্রবল বিক্রমে তাসা, ব্যাঞ্জো আর লায়লা হো লায়লা সহ গণেশ রিটার্নস অ্যান্ড ভ্যানে চেপে বিশ্বকর্মার শুভাগমন। একই পথে মুখোমুখি হলেন তাঁরাযাওয়ার সময়েও গণেশকে একটুও দুঃখী মনে হল না, বরং লায়লার রিদম তাঁর ভারী পেট ও পশ্চাদ্দেশকেও যেন দুলিয়ে দিচ্ছে মনে হল। ওদিকে বিশ্বকর্মা যেমন আকারেও ছোট, যদিও হাতী তাঁর বাহন, তবুও কিঞ্চিৎ ম্রিয়মান। তবে এ নেহাত আজকের রাতটুকুই। কাল থেকে তিনিই সম্রাট। আবার তিনি গেলেই মহরমের তাজিয়া। হে পথ, না জানি আরও কত রিদম, ধামাকা আর লায়লার হো হো তোমাকে সহিতে হইবে! এইরকম যখন ভাবছি বসে বসে, সেই সময়েই বিশ্বকর্মার পিছু পিছু তিনিও এলেন। এসেই কোনরকম ভণিতা না করেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, সব কিছুতেই যখন আধার আর প্যান বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, তখন পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনে এবং ফেসবুক প্রোফাইলে ওই ছবি গুলি দেওয়া চালু করছেন না কেন মোদী?  তারপরে দেখব সুন্দর আর সুন্দরীদের কত ভাল বউ বা বর জোটে এবং কত হাজার লাইক পায় সবাই!’ ‘আমি ত্যারচা চোখে ওকে দেখে বললাম, ‘তা তোর আবার পাত্রপাত্রী নিয়ে চিন্তা মাথায় এলো কেন? বে করবি নাকি?’ পদাকে এই প্রথম লজ্জা পেতে দেখলাম। মিনমিন করে বলল, ‘ওই মোক্ষদা মাসি এমন ধরেছে... দিনরাত কানের পোকা বের করে দিচ্ছে বিয়ে বিয়ে করে, তাই ভাবলাম...’ ‘তাই ভাবলি একটা বিয়ে করেই ফেলি, তাই তো?’ উত্তর না দিয়ে আবার সে অন্যদিকে ফিরে রইল। আমি বুঝলাম, এ সেই অ্যাপেল সেরেল্যাক খাওয়ার প্রতিফল‘লোকে কেন বিয়ে করে রে পদা? দিল্লীর লাড্ডু বাদ দিয়ে বলবি!’ পদা মিউট করল দেখলাম চোখ গোল গোল করে!

এবার একদিন আমার খুব শাড়ি কিনতে ইচ্ছে হল। পদার বিয়ে লাগবে, শাড়ি না কিনলে হয়! তাই ওকেই ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুঝলি পদা, কাল দেখি মেসেজে 'মুন হ্যাণ্ডলুম শাড়ি' ওয়েভ দিচ্ছে আমাকে।'  "কালে কালে আর কত গুল মারবি?'  'বিশ্বাস কর, তিনসত্যি! তা মুশকিল হল, শাড়ি কিনতে এবার গড়িয়াহাট যাব ভাবছি।' 'তা যা! এতে মুশকিলের কী আছে?' 'না মানে, কলকাতা যেতে গেলে, সে ট্রেনেই যাই যদি হাওড়া ব্রিজ পেরতে হবে আর বাসে/গাড়িতে গেলে দ্বিতীয় হুগলী সেতু নয় দক্ষিণেশ্বর ব্রিজ ক্রশ করতে হবে।' 'তো?' 'বল না বাপ আমার, ব্রিজের ওপর না উঠে কীভাবে যাই কলকাতা?' ' সিম্পল, ব্রিজের তলা দিয়ে চলে যা!' ‘আরে ব্রিজ ভাঙলে তো সেই চাপাই পড়ব।' 'তাহলে সাঁতরে গঙ্গা পেরিয়ে নে।' বলুন এবার, এরপরেও পদাকে ডাকবে আর কেউ! এবার নিজের মনেই বলতে থাকল ও, ‘কেউ যদি খরচ কমাতে হেলিকপ্টারে অফিসে যায়, তাহলে বুঝবি সে ঠিকই করেছে। অন্যের যুক্তিবুদ্ধিতে আস্থা রাখতে পারে না যারা, তাদের আসলে হিংসুটে বলে। তারা বরং জগিং করুক। হ্যাঁ তুইও ওই ‘তারা’দের মধ্যে পড়িস। বরং তুইও জগিং করতে করতে গড়িয়াহাট চলে যা!’




এইরূপ অবস্থায় শুনিতে পাইলাম তারস্বরে কে যেন পদাকে ডাকিতেছেএ গলা একবার শুনিলে ভুলিবার নহে। মোক্ষদামাসি আসিয়াছেন বুঝিলাম। তিনি তাঁর দোদুল্যমান দুই লাউ সহ ঘরে উপস্থিত হইলেন যেই মাত্র, বাহিরে আবার মাদাম তুভোঁর লাঠির শব্দ। বুঝিলাম, আজি এক অনন্ত প্রলয় সম্মুখে হামার! কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহাকে আপ্যায়ন করিলাম। মোক্ষদামাসি তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসিলেন, ‘এ ক্যা রে পদা? আদদামড়া মাগী, ফরক পরে এয়ে বেলেল্লাপনা করচে? এদের য্যানো তোর বে’তে জোটাস না বাপু!’ ঘটনার আকস্মিকতায় মাদামের কাশির দমক প্রবল হইল। বুঝিলাম, এই সেই ক্ষণ... প্রলয় আসন্ন। কিঞ্চিৎ বাদে মাদাম ঊর্দ্ধ পানে চাহিয়া তাঁহার বাণী উচ্চারণ করিলেন, ‘বিয়ে অর্থাৎ দুটি জীবনের প্রশ্ন। এসব নিয়ে ছেলেখেলা কর না তোমরা। ছেলেখেলা করতে হলে ময়দানে যাও বরং। আর ভাষার গুরুত্বের কথা সর্বদা স্মরণে রেখ। যে, যে ভাষায় কথা বলে, সে তেমনই মানসিকতা ধারণ করে জানবে...’ মাদামের বাণী শেষ হইবার পূর্বেই মোক্ষদা মাসি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন...’ অ্যাঁ! বেটি বলচেটা কী? বিদেয় কর, বিদেয় কর ওকে!’ ঘরের অভ্যন্তরে যেন বাজ পড়িলআমি মূর্চ্ছা যাইলাম। ফলে ইহার পরবর্তী ঘটনা আমার জানা ছিল না। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন