কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

অন্তরা চৌধুরী




ভাগ্যিস তখন এত বুদ্ধিজীবী খাবার ছিল না




বুদ্ধিজীবী খাবারের ভিড়ে ছোটবেলার সেই খাবারগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মিসিং ডায়রি করলেও তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোটবেলাকে তো কমবেশি সবাই মিস করে কিন্তু ছোটবেলার সেই বিশেষ খাবারগুলো! আমরা বড় হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু তারা তো ছোটদের সঙ্গী হয়েই থেকে গিয়েছিল। বাড়ন্ত বয়সে একটা সময়ের পর তাদেরকে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। তাই তারাও বহু বেদনায়, অভিমানে বিদায় নিয়েছে।
  
স্কুলে যখন পড়তাম, তখন এক বয়স্ক মাসি আসত টিফিনের সময় একটা ঐতিহাসিক ঝুড়ি নিয়ে তার ওপরে ঢাকা দেওয়া থাকত শতজীর্ণ এক গামছা ওই ঝুড়ির ভেতরে থাকত অদ্ভুত সব খাবার তাই ওই ঝুড়িকে ঘিরে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না একটাকায় বেশ অনেকটা সিঁয়াকুল দিত মোটা নুন মাখিয়ে আহা! তার কী স্বাদ! মাত্র পঁচিশ পয়সায় পাওয়া যেত কুলগুঁড়ো

টিফিনের পর ক্লাস শুরু হত কিন্তু হাতের মুঠোয় থাকত কুলগুঁড়ো দিদিমণি পড়াচ্ছেন ভাবটা এরকম যেন কত মনোযোগ দিয়েই শুনছি কিন্তু মন কুলগুঁড়োর দিকে একবার করে মাথা নীচু করছি আর একবার করে চেটে নিচ্ছি

গ্রীষ্মকালের দিনে তখন স্কুল ছুটি বাড়িতে সবাই দরজা বন্ধ করে ভাতঘুম দিচ্ছে সেই দুপুর রোদে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আম কুড়োতে যেতাম সঙ্গে নিয়ে যেতাম নুন লঙ্কাগুঁড়ো আমগাছ মহাশয় খুব সদয় ছিলেন আমার জন্য বেশ কিছু আম গাছের তলায় ছড়িয়ে রাখতেন সেই আমগুলো দেওয়ালে ঘষে ঘষে তার ছাল চামড়া উঠিয়ে দিতাম আশে পাশেই প্রচুর পলাশ গাছ ছিল তারা তখন ‘দেখো আমি বাড়ছি মামি’র প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকত। সেই পলাশ পাতার ওপর  আমগুলো নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে খেতাম। এখন মনে পড়লেই জিভে জল আসে। 




বিকেল দিকে একটা বিহারী লোক পিঠে লাল কাপড়ে বাঁধা একটা ঝোলা নিয়ে আসত। সুর করে কী বলে যে বিক্রি করত মনে নেই। কিন্তু তার সেই ঝোলার  ভেতরে থাকত অদ্ভুত একটা জিনিস। ছোলাবাঁটা। বাঁটা না বলে ছেঁচা বলাই ভাল। একটা কাগজে কিছুটা ছোলাবাঁটা আর তার সঙ্গে পেঁয়াজ নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে দিত।  সেই স্বাদ জন্ম জন্মান্তরেও বোধহয় ভুলতে পারব না। তারপর কোথায় যে সে একদিন হারিয়ে গেল!

কুলপি তখনও বিক্রি হত। এখনো বিক্রি হয়। দুধে এলাচ মিশিয়ে সহজ সরল কুলপি কচি শালপাতায় করে দিত এখনকার কুলপিগুলো ভীষণ স্মার্ট। কিন্তু আনস্মার্টের পেটে কি আর স্মার্ট কুলপি সহ্য হয়? আবার দুপুর বেলায় ঐ প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মাথায় গামছা বেঁধে সেই ছোট্ট ছোট্ট হলুদ কাঠের গাড়িতে বিক্রি করতে আসত আইসক্রিম। কোম্পানির নাম নারায়ণ। একটাকায় নারকেল দেওয়া আইসক্রিম। পঞ্চাশ পয়সায় চিড়ে আইসক্রিম। পঁচিশ পয়সায় পেপসি। একটা আইসক্রিম কিনে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া যেত। মা বকত। বলত – ‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে’ আমি বলতাম - ‘চিন্তা করো না। আমি সোয়েটার পরে খাব’। এখনকার আইসক্রিম তো শুরু হবার আগেই শেষ

গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যেবেলায় লোডশেডিং হত। বাইরের উঠোনে আমরা সবাই বসে থাকতাম। চার্জার বা ইনভাটারের চল তখনও হয়নি। কাজেই অন্ধকারকে যথেষ্ট উপভোগ করতাম। সেই সন্ধ্যেবেলায় লণ্ঠন নিয়ে একটা লোক আসত ঘুগনি বিক্রি করতে। বাতাস বইছে। নারকেল গাছের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে। ঘুগনিওয়ালার লন্ঠনটা প্রায় নিভে যাবার আগেই সে তালপাতার খোলায় তালপাতার চামচ দিয়ে  ঘুগনি দিত। কি অপূর্ব যে লাগত। এখনও সে কথা মনে পড়লে মনে হয় ঠিক যেন  রূপকথা।

আমাদের বাড়িতে অনেক পেয়ারা ও আমড়াগাছ ছিল। বর্ষাকালের দুপুরে ছোটকা পেয়ারা আর আমড়া ছেঁচা করত। তার সঙ্গে বাঁটত কাঁচালঙ্কা। ঝালে হু হা করতাম।  কিন্তু খাবার লোভ সংবরণ করতে পারতাম না। ঝালের চোটে ঠোঁট ফুলে যেত। তাও খেতাম।

কালবৈশাখির বিকেলে ছাদের চিলেকোঠায় বসে তেঁতুল খাওয়া আর ঝড়ের তাণ্ডবরূপ দেখা দুটো একসঙ্গেই চলত।

চৈত্র মাসের বিকেলে গাজন দেখতে যেতাম। আর গাজন দেখতে গেলে আলুকাটা খেতেই হবে। ফেরার পথে কিনতাম দু’ টাকার চানাচুর। তবে সেই চানাচুর  এখনকার মত ব্র্যাণ্ডেড কোম্পানীর নয়। বাড়িতে তৈরী মধ্যবিত্ত চানাচুর। কাগজের চোঙায় করে দিত। আর কখনো সেই চানাচুরের স্বাদ পাইনি। এছাড়া মামাচাটনী, ল্যাবেনচুস তো ছিলই।

আমার ছোটজেঠিমা কর্মসূত্রে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতেন। আমি তখন নিতান্তই ছোট। কিন্তু অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায় দিনই ছোটমা বিভিন্ন ফল নিয়ে আসত। যেমন কেন্দ, কুসুমফল, বুনোখেজুর, গাছ সহ ছোলা। কুসুমফলটা ভারি অদ্ভুত। সবুজ রঙের ছোট্ট ফল। ওপরের খোসাটা ছাড়ালে ভেতরটা হলুদ, ডিমের কুসুমের মত। হালকা টক মিষ্টি।

চৈত্র মাসের ঝড়ের কাছে চটরা তার ঠিকানা হারাত। কোন দূর দূরান্তে সে উড়ে চলত-
              হেথা নয় হেথা নয়
              অন্য কোথা অন্য কোনখানে
চটরার ভেতরে একটা বাদাম থাকে। মাটি থেকে কুড়িয়ে আমরা সেই বাদামটা বের করে খেতাম।




হঠাৎ করে কেমন যেন বড় হয়ে গেলাম। আমার চারপাশটাও কেমন যেন দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল। এখন বাইরে বেরোলে প্রচুর খাবারের হাতছানি। কিন্তু তারা বড় বেশি কর্পোরেট। সেই খাবারে কোন নস্টালজিয়া নেই। নেই কোন প্রাণের স্পর্শ। এখনকার বাচ্ছাদের জন্য বড় কষ্ট হয়। এরা পিজ্জা বার্গারের বাইরে এসব খাবারের স্বাদ পেল না। এদের ছোটবেলায় কোন নস্টালজিয়া তৈরি হল না। এরা জানল না গাছ থেকে আম, পেয়ারা চুরি করে খাবার কী স্বাদ, কী আনন্দ!

অপু দুর্গা শুধু ‘পথের পাঁচালী’তেই শেষ হয়ে যায়নি। আরও অনেক অপু দুর্গার কাহিনি বিভূতিভূষণ লিখে যেতে পারেননি। এখন এসব কথা ভাবলে মনে হয় ঠিক যেন রূপকথা। ছোটবেলার সেই আধো আধো বুলির সঙ্গে সবুজ সুরটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

জীবনের পশ্চিম সীমান্তে এসে অনেকেই স্মৃতিনির্ভর হয়ে পড়েন। কিন্তু মাত্র কয়েক  বছরেই ছবিটা এতটা বদলে গেছে যে আমরা মাঝ বয়সে এসেই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। মাঝে মাঝেই বলতে ইচ্ছে করে, দাও ফিরে সেই ছেলেবেলা বলতেই পারতাম, দাও ফিরে সে কুলগুঁড়ো, লহ এ বার্গার। কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। আমরা যেমন কুলগুঁড়ো বা আম ছেঁচাকে মনে রেখেছি, ওরাও আমাদের তেমনভাবে মনে রেখেছে তো?

            
  

  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন