কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 



কালিমাটি অনলাইন / ১২০ / একাদশ বর্ষ : দশম সংখ্যা





গণিতশাস্ত্রে ক্যালকুলাস অধ্যায়ে দুটি বিভাগের একটি হচ্ছে – ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস, অন্যটি হচ্ছে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস। যদি আমরা এই দুটি শব্দ অর্থাৎ ডিফারেন্সিয়াল ও ইন্টিগ্রালকে রঙ ও আলোর প্রেক্ষিতে আলোচনা করি, তাহলে বলা যায়, আলোর ডিফারেন্সিয়েশন করলে রঙ পাওয়া যায়, আর রঙের ইন্টিগ্রেশন করলে পাওয়া যায় আলো। পাতি কথায় বিভিন্ন রঙ যখন মিলেমিশে একান্নবর্তী পরিবারের মতো থাকে, তখন তাকে আলো বলা হয়, আর যখন যৌথপরিবারের তোয়াক্কা না করে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে চায়, তখন  তাকে রঙ বলে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের চারপাশে যে এত বিভিন্ন রঙ দেখি, তাহলে তাদের মোট সদস্যসংখ্যা কত? অসংখ্য? বিজ্ঞান বলছে, না,   মৌলিক রঙ মাত্র তিনটি – লাল, নীল, হলুদ (নাকি সবুজ?)। বাকি যাবতীয় রঙ এই তিনটি মৌলিক রঙের পারমুটেশন কম্বিনেশন। যদিও বর্ণালীতে মাত্র সাতটি রঙের কথা বলা হয়েছে – বেগুনী, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল – কিন্তু প্রকৃতিতে আমরা এত অসংখ্য রঙের মুখোমুখি হই, যা গুণে শেষ করা অসম্ভব। আবার এত রঙের রমরমা দেখে যদি আমরা রঙবাজি শুরু করি, প্রত্যেকটি রঙকে কাটাছেঁড়া করে তার অন্তর্নিহিত রঙের  অনুসন্ধান করি, তাহলে খুব হতাশ হয়ে দেখব, রঙের অন্তরমহলে কোনো রঙই নেই, যা আছে তা হলো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ ও কম্পাঙ্ক। সেইসব তরঙ্গ যখন কোনো বস্তুর ওপর পতিত হয়, তখন সেই বস্তু তার নিজস্ব গুণ ও ধর্মে সেই তরঙ্গগুলোকে শোষণ করে নেয়, আর যে তরঙ্গকে শোষণ করতে পারে না, তা প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়ে এবং আমরা সেই তরঙ্গদৈর্ঘের রঙ প্রত্যক্ষ করি। আবার কোনো বস্তু যখন সব তরঙ্গদৈর্ঘকেই শোষণ করে নেয়, কোনো তরঙ্গদৈর্ঘকে প্রতিফলিত করে না, তখন সেই বস্তুকে আমরা প্রত্যক্ষ করি কালো বর্ণ রূপে, আসলে কালো কোনো রঙই নয়।

আর বিজ্ঞানের এইসব সূত্র ও নিয়মকানুনকে যখন আমরা প্রয়োগ করি আমাদের জীবন ও যাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং তারই সূত্র ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি স্তরে ও চিন্তাভাবনায়, তখন সেখানেও আমরা মুখোমুখি হই অসংখ্য রঙের আর তারই ছত্রছায়ায় জন্ম নেওয়া রঙবাজির। সমাজশিক্ষা পাঠ করে আমরা জেনেছি, মানুষ সামাজিক জীব, কেননা  মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। তবে যেহেতু বিশ্ব অনেক বড় ও প্রসারিত, তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ও স্থানে বিকশিত হয়ে ওঠা সমাজের রূপ ও রঙ অর্থাৎ চরিত্র কখনই এক হতে পারে না। একই বিশ্বে অসংখ্য সমাজের তাই চারিত্রিক রঙ আলাদা আলাদা। বিশেষত সভ্যতার বিকাশ সারা বিশ্বে একই সময়ে একই রকমভাবে হয়নি, তাই সেইসব সমাজের গঠন হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। আর সেই প্রত্যেক সমাজের প্রেক্ষিতেই তার অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন, ব্যক্তিচরিত্র, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির রঙ আলাদা আলাদা। কারও সঙ্গে কারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়   না। আবার একথাও উল্লেখ করতে হয় যে, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হলেও তার আইডেনটিটি শুধুমাত্র সেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই নির্ধারণ করা যায় না, বরং তার আইডেন্টিটি নির্ধারিত হয় তার নিজস্ব অর্জিত শিক্ষা, চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সংস্কৃতিমনস্কতা এবং আরও আরও অনেক উপাদান ও সংসাধনের ওপর। আর তাই প্রতিটি মানুষ ভিন্ন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন, তার মনের রঙ ভিন্ন। আবার মনের এই ভিন্নতাই সৃষ্টি করে বৈচিত্র্য, বহুরৈখিকতা।

‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১১০তম সংখ্যার আলোচ্য বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছে ‘রঙ ও রঙবাজি’। ২০২৪ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। আমার জানা নেই, এই  নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে ইতিপূর্বে আরও কী কী কাজ হয়েছে। পাঠক-পাঠিকার অবগত থাকলে অবশ্যই আমাদের তা জানাবেন, আমরা সমৃদ্ধ হব। আমরা এই সংখ্যায় লেখার জন্য যাঁদের অনুরোধ করেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং লেখা পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাঁদের অভিজ্ঞতায় জারিত করে এই সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে সম্পাদক হিসেবে একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হয়, এবার এবং ইতিপূর্বে যেসব নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ‘কালিমাটি’ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছি, তা সেই সেই বিষয়ে কাজের সূত্রপাত মাত্র করতে পেরেছি। আরও বিশদভাবে কাজ করার প্রচুর সুযোগ ও অবসর আছে। বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম এইসব অসম্পূর্ণ কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তবেই তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com                

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 



<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৬



নতুন বছর শুরু হল। এই পর্বে আমাদের লেন্সে তুলে আনব হলিউডে স্বর্ণযুগ পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভ করা পাঁচজন পরিচালককে, যাদের নিয়ে আলোচনা বাকি রয়ে গেছে - ১) ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা, ২) মার্টিন স্করসেসি, ৩) স্টিভেন স্পিলবার্গ, ৪) কোয়েন্টিন টারান্টিনো ও ৫) ক্রিস্টোফার নোলান।

তবে শুরুতেই আগের পর্বে যে পাঁচজনকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, তাদের নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত রি-ক্যাপ করে নেব। তাহলে খেই ধরে রাখতে সুবিধে হবে। ভিক্টর ফ্লেমিং-এর ছবি মানে আলোর খেলা, রঙের সাবলীল ব্যবহার, আউটডোর সিন, অনবদ্য অভিনয় ও লং শট। আরো বৈশিষ্ট্য, তার শুরুর ছবিগুলো সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবি। বাস্টার কিটোন ছিলেন মূর্তিমান স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ফ্রাঙ্ক কাপরা-র ক্যামেরা ছিল হলিউডের শুরুর দিকের ক্যামেরা যেখানে একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং আরেকদিকে গ্রাম্য আমেরিকা ফুটে উঠেছিল। ক্লোজ শটে স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স উনি প্রথম শিখিয়েছিলেন। আলফ্রেড হিচকক এত বহু বছর পরেও মাস্টার অব সাসপেন্স। এবং অরসন ওয়েলেস মানেই নন লিনিয়ার বর্ণনা, অদ্ভুত লাইট, বেয়াড়া রকমের ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, অফবিট ক্যামেরার জায়গা, লং শট, মন্তাজ এবং অবশ্যই ডিপ ফোকাস। এবার এই পাঁচজন মৃত পূর্বসূরীর রাস্তা ধরে তাদের জীবিত উত্তরসূরীরা কোথায় কোথায় স্বতন্ত্র, সেটাই দেখার বিষয়।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা (১৯৩৯- ) শুরু করেছিলেন স্বর্ণযুগ পরবর্তী সাড়া জাগানো প্যাটন (১৯৭০) লিখে, কিন্তু যে ছবি ওনাকে সঠিক অর্থে লাইমলাইটে আনে, তা হল দ্য গডফাদার (১৯৭২) এবং দ্য গডফাদার 2 (১৯৭৪)। এছাড়াও দ্য কনভার্সেশন (১৯৭৪), অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ (১৯৭৯), কটন ক্লাব (১৯৮৪), ড্রাকুলা (১৯৯২), দ্য রেইনমেকার (১৯৯৭) ইত্যাদি সিনেমার জন্যও উনি বিখ্যাত। তবে দেখুন, কোপালা বললে, অস্বীকার করে লাভ নেই, প্রথমেই ‘দ্য গডফাদার। উনি এই ছবির মাধ্যমে গ্যাং-ওয়ার ছবির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। সাধে কি ‘AFI’s 100 years…100 movies’ এই ছবিকে ‘সিটিজেন কেন আর ‘কাসাব্লাঙ্কা ছবির পরেই রেখেছিল! পাঠক, কোপালা-কে বাছাই করার পেছনে আমার প্রাথমিক যে উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হল হলিউডের স্বর্ণযুগ পরবর্তীকালে উনি প্রথম পরিচালক যাকে সমালোচক এবং বক্স অফিস দুজায়গা থেকেই ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং ওনার পূর্বসূরীদের থেকে এক স্বতন্ত্র ধারায় ওনার ছবি, যা ষাট ও সত্তরের দশকের আমেরিকার অপরাধ জগতকে, যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনার যে ছবিকে সবার আগে এগিয়ে রাখব, তা হল অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গায়ে কাঁটা দেওয়া এক মিশন, অফিশিয়ালি যার কোন অস্তিত্ব নেই। এবং গোটা সিনেমা ধবংস ক্ষয় ক্ষতি যুদ্ধের পর দর্শক বুঝতে পারে, কি দরকার এত যুদ্ধের? কোপালা এই ছবি নিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন ‘my movie is not about Vietnam…my movie is Vietnam’। একজন সাধারন দর্শক হিসেবে যে ব্যাপারটা কোপালার মধ্যে ভাল লাগে, তা হল উনি রিস্ক নিয়ে ছবি করতে ভালবাসেন, বাছাই করেন সেইসব বিষয় যা বিতর্কমূলক। এবং ওনার হাতে তা সঠিক অর্থে ফুটে ওঠে।

মার্টিন স্করসেসি (১৯৪২- ) যে যে সিনেমার জন্য বিখ্যাত, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬), নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক (১৯৭৭), রেজিং বুল (১৯৮০), দ্য কিং অব কমেডি (১৯৮২), গুডফেলাজ (১৯৯০), কেপ ফিয়ার (১৯৯১), ক্যাসিনো (১৯৯৫), গ্যাঙ্গস অব নিউ ইয়র্ক (২০০২), দ্য অ্যাভিয়েটর (২০০৪), দ্য ডিপার্টেড (২০০৬), শাটার আইল্যান্ড (২০১০), হুগো (২০১১), উলফ অব ওয়াল স্ট্রীট (২০১৩)। কোপালার মত আমেরিকান সমাজব্যবস্থায় সন্ত্রাস ও তার প্রভাব নিয়ে স্করসেসি-ও কাজ করেছেন এবং সমান্তরাল সিনেমা নয়, মেনস্ট্রিমেই কাজ করেছেন, কিন্তু যে কারনে উনি আলাদা, তা হল ওনার ছবির ভেতর অস্তিত্ববোধ, পাপবোধ, নিহিলিজম আর মুক্তির ধারনা। এই যে হিন্দি সিনেমায় আজকাল একটা ব্যাপার দেখা যায় – কোন এক বিখ্যাত অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্সে দেখা (খুব ছোট্ট একটা রোল, মাত্র এক সিনে), এটা কিন্তু প্রথম শুরু করেছিলেন স্করসেসি। এবং এটাও সঠিক যে উনি দুজন অভিনেতাকে স্টার বানিয়েছেন – রবার্ট ডি-নিরো ও লিওনার্দো দিকাপ্রিও। যাইহোক, স্করসেসির ক্যামেরার কথা উঠলে প্রথমেই স্লো মোশনের কথা আসবে। এবং তারপরেই হঠাৎ হঠাৎ ফ্রেম ফ্রিজ করে দেওয়া। এই দুটো টেকনিক ছাড়াও এক পুরুষ হিসেবে আমার আরেকটা ব্যাপারও বেশ লেগেছে। ওনার বিভিন্ন সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় থাকা অভিনেত্রীরা প্রথমবার ফ্রেমে আসার সময় সাদা আঁটোসাঁটো পোষাকে স্লো মোশনে আসেন। নয়নাভিরাম। সিবিল শেফার্ড, ক্যাথি মরিয়র্টি, শ্যারন স্টোন...এই লিস্টে একে একে নাম। পাঠিকা, ক্ষমা চাইছি, কিন্তু বলুন, চোখে পড়ার মত ভাল কিছু থাকলে পুরুষ হিসেবে চোখ তো আটকাবেই, তাই না! যেমন ধরুন, স্করসেসি আমার প্রিয় ব্যান্ড রোলিং স্টোন-কে বিভিন্ন ছবিতে নেপথ্যে ব্যবহার করেছেন। একটা গান ‘গিম্মি শেলটার...’ গুডফেলাজ ছবিতে কিভাবে, মনে আছে? আবার দেখুন, উনি ধর্মকেও বারবার টেনে এনেছেন। ধর্মীয় পাপবোধ। ভেতর থেকে অনুতপ্ত হওয়া। নির্বাক। যদিও আমি এই অংশ নিয়ে কিছু বলতে চাই না, কিন্তু এটা ওনার বিভিন্ন ছবির একটা দিক। তেমনি রাজনৈতিক দুর্নীতি। তবে আমার ব্যক্তিগত সেরা হল গুডফেলাজ, যদিও বেশিরভাগ সমালোচক বলবেন যে ট্যাক্সি ড্রাইভার ওনার সেরা। আসলে গুডফেলাজ দেখলে আমার মনে হয় স্করসেসি যেন নিজের বন্ধুদের নিয়ে তামাসা করতে করতে এগিয়ে চলেছেন, মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো দ্বিধা। কোপাকাবানা নাইটক্লাবে বান্ধবীকে নিয়ে ঢোকার মুখে হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে একটা লং শট, প্রায় তিন মিনিট, এবং পুরো সেটটা যেন ঐ শটের জন্যই বানিয়ে রাখা। ব্যক্তিগত ঘটনা দিয়ে, হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে, কিভাবে সৃষ্টি উঠে আসে, তা হয়ত স্করসেসির মত আর কেউ পারেননি।       

এই ধারাবাহিকের ৩ নম্বর পর্বে স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর (১৯৪৬- ) দুটো ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওনার কেরিয়ারে সফল ছবির মধ্যে সেই দুটো অবশ্যই একদম ওপরে থাকবে - জস (১৯৭৫), ক্লোজ এনকাউন্টার্স অব দ্য থার্ড কাইন্ড (১৯৭৭), ই-টি (১৯৮২), ইন্ডিয়ানা জোনস ট্রিলজি (১৯৮১-৮৯), দ্য কালার পার্পল (১৯৮৫), জুরাসিক পার্ক (১৯৯৩), সিন্ডলার্স লিস্ট (১৯৯৩), অ্যামিস্টাড (১৯৯৭), সেভিং প্রাইভেট রায়ান (১৯৯৮), এ-আই (২০০১), মাইনরিটি রিপোর্ট (২০০২), মিউনিখ (২০০৫), লিঙ্কন (২০১২), দ্য পোস্ট (২০১৭) ইত্যাদি। এর বেশ কয়েকটা সিনেমাকে ক্লাসিক বললে ভুল বলা হবে না। যেমন ‘দ্য কালার পার্পল, ‘সিন্ডলার্স লিস্ট, ‘অ্যামিস্টাড, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান ইত্যাদি। কালার পার্পল-কে যদি গল্পের বই থেকে তুলে বসানো পর্দার ছবি বলি, আর সিন্ডলার্স লিস্ট-কে যদি মন্দের ওপর ভালোর কাব্যময় জয়ের ছবি হিসেবে দেখি, তাহলে, অ্যামিস্টাড এদের দুয়ের মাঝে – খানিক মিস্ট্রি, খানিক থ্রিলার, আইনি জটিলতা, একাধিক সংস্কৃতির সংঘর্ষ। তবে স্পিলবার্গকে সবথেকে ভাল বোধহয় রজার এবার্ট বুঝেছেন। ওনার সমালোচনায় লিখেছেন – ‘Spielberg knows how to make audiences weep better than any director since Chaplin in ‘City Lights’, but weeping is an incomplete response, letting the audience off the hook’। তাহলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে কোন এক জায়গায় উনি কোপালা আর স্করসেসি-র থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কারন উনি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্ধকারের তুলনায় আলোর জয় দেখিয়েছেন, খারাপকে ঢেকে ভালোর মহত্ব দেখিয়েছেন। যে থিমটা ওনার বিভিন্ন সিনেমায় মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে এসেছে – ‘ordinary people in extraordinary circumstances’। তার ফলে সামান্য হলেও জীবনের এদিক ওদিক কিভাবে তফাৎ তৈরি হয়। এবং ওনার বেশিরভাগ ছবিতে ইমোশন যে দর্শকদের কাছে সূক্ষ্মভাবে ধরা দেয় তার প্রধান কারন স্পিলবার্গের ক্যামেরা। আরেক কারন জন উইলিয়ামসের সঙ্গীত। এবং তৃতীয় কারন অবশ্যই অভিনেতাদের থেকে সেরাটা আদায় করে নেওয়া। অবশ্য এটাও আপনারা জানেন যে একটা বিতর্ক আছে। ই-টি ছবির জন্য সত্যজিৎ রায় ওনার দিকে আঙুল তুলেছিলেন, ছবির থিম চুরির অভিযোগে। ব্যাপারটা এরকম, ১৯৬২ সালে লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু অনুসরন করে ১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ ও কলাম্বিয়া পিকচার্সের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল ‘The Alien’ নামক একটি ছবি তৈরি করা হবে। পরে যদিও নানা কারনে তা বাতিল হয়ে যায়। সেই প্রস্তাবিত ছবির পান্ডুলিপি সত্যজিৎ লিখেও রেখেছিলেন। অনুমান, সেই পান্ডুলিপি কোনভাবে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে, ই-টি ছবির প্রস্তাব সেই পান্ডুলিপি থেকেই হয়, ছবির স্ক্রিপ্ট শুনে স্পিলবার্গের ভাল লাগে এবং ব্যাকগ্রাউন্ড চেক না করেই উনি ছবিটি করতে রাজি হন। যাইহোক, ই-টি বাদ দিলেও ওনার বাকি ছবিগুলো ওনাকে সিনেমার ইতিহাসে অমর করার জন্য যথেষ্ট। 

ওপরের তিনজনকে যদি হলিউডের নিউ ওয়েভ ছবির তিন ঘরানার দিকপাল হিসেবে ধরা যায়, তাহলে তাদের পরবর্তীকালের শক্তিশালী পরিচালক হলেন কোয়েন্টিন টারান্টিনো (১৯৬৩- )। নয়ের দশক থেকে ওনার যাত্রা শুরু। রিজার্ভায়ার ডগস্ (১৯৯২), পাল্প ফিকশন (১৯৯৪), ফ্রম ডাস্ক টিল ডন (১৯৯৬), জ্যাকি ব্রাউন (১৯৯৭), কিল বিল (২০০৩-০৪), ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (২০০৯), জ্যাঙ্গো আনচেইনড (২০১২), ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড (২০১৯) অব্দি। টারান্টিনো মনে করেন তার ছবি আদপে ড্রামা, কিন্তু কেউ কেউ বলেন ব্ল্যাক কমেডি, আবার কোন সমালোচক বলেন মারামারির থ্রিলার। এটা ঠিক যে তার ছবি ফোকাস্ড এবং শক্তিভরা। কিন্তু যেটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই, তা হল তার ছবি হিংসা আর গালাগালে ভরা, যা এখন আমেরিকার জনপ্রিয় সংস্কৃতি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন, আমি তার নাম এই লিস্টে রাখলাম কেন? এর উত্তর আপনারা পাল্প ফিকশন আর ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস পাশাপাশি দেখলে পেয়ে যাবেন। সিনেমা বললে যদি নন-লিনিয়ার গল্প বোঝায়, যদি সাংঘাতিক বুদ্ধি আর বিনোদন বোঝায়, তাহলে এই দুটো ছবি না দেখলে আপনি বুঝবেন না, টারান্টিনো সিনেমা ব্যাপারটাকে সেই স্বর্ণযুগ থেকে ভাঙতে ভাঙতে কোথায় নিয়ে এসেছেন। এমনকি ওনার নন-লিনিয়ার গল্প বলার টেকনিককে আজকাল টারান্টিনো এফেক্ট বলা হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত মাত্র নটা ছবি বানিয়েছেন। বলেছেন দশম এবং শেষ ছবি বানাবেন ‘দ্য মুভি ক্রিটিক, তারপর আর নয়। আমরা, যারা চুনোপুঁটি সমালোচক, আধীর আগ্রহে সেই ছবির জন্য অপেক্ষা করছি। যেমন ড্যানিয়েল ডে-লুইস খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেন নি, এবং এক সময় অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে জুতো সারাই শিখতে ইতালি চলে গেছিলেন, যেমন বয়হুড ছবির পরিচালক রিচার্ড লিঙ্কলেটার ১২ বছর ধরে ছবিটা বানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি টারান্টিনোর এই সংযম দেখে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে, কারন উনি শুধু একজন পরিচালক নন, একজন লেখক, এবং নিজের আত্মতৃপ্তি থাকা কালীন অবসরে যাবার সিদ্ধান্ত, আমার মতে, সঠিক। যাইহোক, যেহেতু আমি নিজেও একজন লেখক, টারান্টিনোকে প্রধানত ভাল লাগে লেখক হিসেবে। গল্পটা উনি এমনভাবে সাজিয়ে নিয়ে বসেন যেখানে বলার স্টাইল থেকে বেশ কিছু সম্ভাবনা উঠে আসে। ধরুন ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস। যুদ্ধের ছবি, কিন্তু ডায়লগে ভর্তি, এমনভাবে, মনে হবে যুদ্ধে কি কি হতে চলেছে পুরোটাই বলা হয়ে যাচ্ছে, তারপর বাকিটা দর্শকের হাতে। ইউনিক। ফলে ক্লাসিক ছবির উত্তরাধিকার টারান্টিনোর হাতেই।     

ক্রিস্টোফার নোলান (১৯৭০- ) যে যে ছবির জন্য দর্শকদের কাছে বিখ্যাত, সেগুলো - ফলোয়িং (১৯৯৮), মেমেন্টো (২০০০), দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজি (২০০৫-১২), দ্য প্রেস্টিজ (২০০৬), ইনসেপশন (২০১০), ইন্টারস্টেলার (২০১৪), ডানকার্ক (২০১৭), টেনেট (২০২০), ওপেনহাইমার (২০২৩)। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, আমি গুয়াহাটিতে নোলানের মাত্র দুটো ছবি দেখেছিলাম – প্রেস্টিজ আর ইনসেপশন। ইনসেপশন দেখার পর আমার বেশ ভাল লেগেছিল, মনে হয়েছিল এই ছবির পরিচালক নিশ্চয় একজন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক, নইলে এই থিম আর থিমের ডিডাকশন এভাবে সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ওনার একে একে সব সিনেমাগুলোই দেখেছিলাম। নোলানের ছবিতে আমার যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যরকম মনে হয়, তার মধ্যে মেটাফিজিক্স যা দর্শনশাস্ত্রের এক অংশ, এপিস্টেমোলজি, অস্তিত্ববাদ (দেকার্তের সেই বিখ্যাত উক্তিঃ আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই একজিস্ট), স্ট্রিম অব কনসাসনেস, ন্যায়শাস্ত্র, টাইম-স্পেস ডুয়ালিটি, ব্যক্তি পরিচয়, স্মৃতি এবং চেতনা ও যুক্তির দোটানা...এইসব খুঁজে পাই। আরেকটু গুছিয়ে বললে, ওনার ছবিতে একদিকে কল্পবিজ্ঞান অন্যদিকে অস্তিত্ববাদ-পরিচয়ের দোটানা আমায় টানে, ভীষণভাবে টানে। আর এই কারনেই, আজ যতজন পরিচালকের কথা বললাম, নোলান সবার থেকে আলাদা। নোলানের শেষ ছবি, ৩ ঘন্টার ওপেনহাইমার, যারা নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক পড়েছেন, গুরুত্ব ও টান বুঝবেন। এবং আরো বড় কথা, এই AI-VFX এর যুগে, নোলান আজো বেশিরভাগ কল্পবিজ্ঞান ছবির সেট নিজে হাতে তৈরি করেন। ছবির প্রতি পা মাটিতে রেখে চলেন। বুঝতে দেন না, এই ছবি আকাশে কবে উড়বে। ফলে এক সূক্ষ্ম স্ফূলিঙ্গ থেকে কি করে হলিউডের ব্লকবাস্টার তৈরি হয়ে যায়, সেই উড়ন তুবড়ি, একমাত্র নোলানের হাতেই। কিছুদিন আগে দেখলাম, ডেল-টোরো নোলানকে বলেছেন ‘an emotional mathematician’। বুঝলাম, আমি গুয়াহাটিতে খুব একটা ভুল কিছু ভাবিনি।    

পাঠক, সামনের পর্বে আমাদের এক শক্ত কাজ শুরু হবে, বেশ শক্ত। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের নিয়ে কাটাছেঁড়া। তৈরি থাকুন। দেখুন, নিজের লিস্টের সঙ্গে আমারটা কতটা মেলে।  

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – প্রাক-ইতিহাস থেকে (২য় পর্ব)  


১৯৬৩-র ডিসেম্বরে স্কুলে প্রথম শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষা শুরু হবে। নভেম্বরে, মা লিখছেন, আমার টার্জান-প্রীতি দেখে মন অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য আমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই পূর্ণতে, রবিবার সকালে Scaramouche ছবির অসাধারণ তরোয়াল-খেলা দেখাতে।  রাফায়েল সাবাতিনির ১৯২১ সালের উপন্যাসের ওপর আধারিত ১৯৫২ সালের এই জমাটি ছবিটি অবশ্য উৎস-আখ্যান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে, যা জেনেছি ১৯৭০/৭১ সালে ছবিটির পুনর্মুক্তির সময় বইটি পড়ে, যদিও ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট দুটিতেই আছে। ৬৩-তে সঙ্গে ছিলেন মা, মাসিমা, আর দাদা। সত্তরের দশকে মেট্রোতে আবার দেখলাম বাবা-মার সঙ্গে। ঐ একই দশকে এক রবিবার সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রেক্ষাগৃহে তৃতীয়বার ‘স্ক্যারামুশ দেখলাম, মা ও এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে। ছবির চরম সময়ে নায়ক অঁদ্রে ও প্রতিপক্ষ দ্য মেইনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নাকি চলচ্চিত্রে দীর্ঘতম, প্রায় সাত মিনিট ধরে, যা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয়! চাইলে ইউ-টিউবে এই যুদ্ধ দেখে নিতে পারেন।

তবে, সেই ১৯৬৩-তে, মূল ছবির আগে তো সেই টার্জানের ছবির ট্রেলরঃ Tarzan’s Fight for Life (১৯৫৮)! টার্জান লড়ছে এক প্রকাণ্ড অজগরের সঙ্গে! কিন্তু বিধি বাম! দাদা গম্ভীরভাবে বললেন, ওটা দেখানো হবে রবিবার ৮ তারিখে, আর তোমার পরীক্ষা শেষ সোমবার ৯ই! অতএব দেখা হবে না! সে দুঃখ ঘুচলো ৮০-র দশকে ব্রিটিশ টেলিভিশনে ছবিটি দেখে!

১৯৬৪ সালে দাদা ও আমার এক কাকার সঙ্গে লাইটহাউসে দেখলাম আমার প্রথম হারকিউলিসের ছবি, Hercules in the Center of the Earth (১৯৬১, এখন ছবিটি Hercules in the Haunted World নামেই বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়)।  হারকিউলিস (অভিনয়ে রেগ পার্ক) থিসিয়াসের সঙ্গে নরকে যাচ্ছেন বিস্মৃতির পরশপাথর আনতে যা দিয়ে তাঁর প্রায়-অচেতন প্রেমিকা ডিয়ানিরার চেতনা ফেরানো যাবে। প্রতিপক্ষ রাজা লিকো (রূপায়নে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সারুমান আর কাউন্ট ডুকু, আর আমাদের কাছে ড্র্যাকুলা-রূপে-খ্যাত অসামান্য অভিনেতা ক্রিস্টোফার লী)। পরিচালক মারিও বাভা। দাদা নাক সিঁটকে রেগ পার্ক সম্বন্ধে বললেন, “স্টীভ রিভসের কাছে কিস্যু না!” পরে স্টীভ রিভসকে হারকিউলিস-রূপে দেখব।

হারকিউলিস সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে এবার দাবী করলাম, ঐ লাইটহাউসেই (নাকি তার পাশে নিউ এম্পায়ারে?) আমাকে Jason and the Argonauts (১৯৬৩) দেখানো হোক। জেসন কিভাবে সুবর্ণ ভেড়ার লোম উদ্ধার করবে, তার গল্প, তার দলে আছেন হারকিউলিস (যদিও এখানে তিনি পার্শ্বচরিত্র) । কোন অজ্ঞাত কারণে (ছবিটি নাকি ভালো হয় নি!) আমার ইচ্ছে মঞ্জুর হলো না। বরং মাসতুতো বড়দার সঙ্গে পাঠানো হলো সেই পূর্ণতে স্যর ওয়ালটার স্কটের উপন্যাস-আধারিত ১৯৫২ সালের Ivanhoe দেখতে। আচ্ছা, বিদেশী ছবির একটা ব্যাপার কি আমার সমবয়সী পাঠকদের, ছোটবেলায় আমার যেমন অস্বস্তিকর লাগত তেমনই লাগেনি? একাধিক চুম্বনদৃশ্য! ‘আইভানহোতে তো বটেই, এর আগে ‘স্ক্যারামুশও বড়দের সঙ্গে বসে দেখতে এই কারণে কিরকম যেন লাগতো! এখনকার দর্শকরা হয়তো এ কথা শুনে খানিকটা কৌতুকই বোধ করবেন! ‘আইভানহোর তারকা সমাবেশ কিন্তু দেখার মতোঃ রবার্ট টেলর, জোন ফনটেন, এলিজাবেথ টেলর, এবং প্রতিপক্ষের চরিত্রে জর্জ সান্ডার্স!

ভালো কথা, সত্তরের দশকে মিনার্ভায় (পরে ‘চ্যাপলিন) Jason and the Argonauts দেখার সাধ মিটিয়েছিলাম একাই!

১৯৬৪ বছরটি আমার ইংরেজী সিনেমা দেখার ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ! বাংলা ছবি দেখার স্মৃতিচারণে বলেছি যে আমার প্রথম দু-বার দেখা ছবি ছিল ১৯৬০-৬১-তে শেষ পর্যন্ত । এই ৬৪-তে দাদা স্কুলের ‘ফাদার-এর কথা শুনে আমায় নিয়ে গেলেন লাইটহাউসে ১৯৬২ সালের ছবি Hatari দেখতে! ছবির তিনটি ‘চরিত্র আমার ঘুম কেড়েছিলঃ অভিনেতা জন ওয়েন, এবং তিনি যে গাড়ীতে আছেন সেটি ঢুঁ মেরে ওল্টাবার প্রচেষ্টারত দুটি গণ্ডার! এদের মধ্যে গণ্ডার-দুটিই প্রাধান্য পেয়েছিল অনেকদিন ধরে! প্রথম দেখার পর আবার পাশের নিউ এম্পায়ারে যাই বাবার সঙ্গে গণ্ডার-দর্শনে! ১৯৬৬-তে বসুশ্রী সিনেমায় রবিবার সকালে বাবার সঙ্গে তৃতীয়বার ছবিটি দেখি। এরপর সত্তরের গোড়ার দিকে ‘হাটারি পুনর্মুক্তি পায় ‘এলিট সিনেমায়। আবার গেলাম বাবার সঙ্গে! আবার ৭৩/৭৪-এ মিনার্ভায় পঞ্চমবার! ৯ই ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখ দিয়ে মা লিখেছেন যে ‘মাথায় হাটারির বীজ পুঁতে গেছে, এবার গাছ গজাবে। ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫-তে মা লিখছেন যে মন্ত্র পড়ে গণ্ডারকে দেবতা বানিয়ে পূজাও করা হয়েছে। ‘রাত্রে শোবার সময়, “নমঃ গণ্ডারং – ভূতের হাত থেকে বাঁচাও গণ্ডার,” বলে শোয়!’ ঐ বছরে আমার জন্মদিনের কেকের ওপর একটি ছোট গণ্ডারের আকৃতি রেখে বাবা আমায় চমকে দিয়েছিলেন! ছবিটি এত হিট করেছিল যে ত্রিকোণ পার্কের উল্টোদিকে সেই সময় ‘হাটারি নামে যে রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছিল, তা তো আজও আছেই, কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে এখন তার অনেক শাখাও গজিয়ে উঠেছে, যেমন আমার বাসস্থান বিধান নগর-সল্ট লেক-এ!

ছবির কথা অনেক হলো, আরও হবে। এবার প্রেক্ষাগৃহ-সম্বন্ধে কিছু বলি। লাইটহাউসে দেখলাম প্রথমে চকোলেট-রঙের পর্দা সামনে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেটা দু-দিকে দু-ভাগ হয়ে সরে গেলো সামনে এলো বিশেষ ‘ডিজাইন-করা, লাল আলোয় উদ্ভাসিত আরেকটি পর্দা, আর বেজে উঠলো এক বিশেষ signature tune। মানে, প্রদর্শনী এবার শুরু হবে। সুরটি শেষ হলেই লাল পর্দা দু-দিকে সরে গিয়ে শো শুরু হতো – বিরতির আগে এবং বিরতির পরেও, মূল ছবি শুরুর আগে এই একই ভাবে দুটি পর্দা আর সুরের ইঙ্গিত চলতো। লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ার, এবং চৌরঙ্গীর ওপর টাইগার – এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল একক মালিকানাধীন, নাম ‘হুমায়ুন থিয়েটার্স। লাইটহাউস ছিল সবচেয়ে বিলাসবহুল, হলের মধ্যে মেঝের ঢাল ছিল স্ক্রীনের দিকে উঁচু, সেখান থেকে ঢাল ছিল নীচের দিকে। লাইটহাউসের দো-তলায় একটি পথ ছিল যা দিয়ে পাশের নিউ এম্পায়ারে যাওয়া যেত। নিউ এম্পায়ার ছিল অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল, একটিই লাল-আলো-ফেলা ডিজাইন করা দু-ভাগ হয়ে যাওয়া পর্দা দিয়ে স্ক্রীন ঢাকা থাকত। আর স্ক্রীনের পেছনে ছিল মঞ্চ। অনেক সময়, রাতের শো বাদ দিয়ে হতো নাটক বা সঙ্গীত/নৃত্যানুষ্ঠান। সবচেয়ে অভিনব ব্যাপার, অন্যান্য সিনেমা-হলে সবচেয়ে সস্তা আসন (তখনকার ভাষায় ‘দশ আনার সীট) থাকতো একেবারে স্ক্রীনের সামনে। নিউ এম্পায়ারে এই আসনগুলি ছিল তিন তলায়! তাই, ইংরেজী ছবি দেখার জন্য এই হলের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের বাঁধা ১ টাকা ৪০ পয়সার সীট নিউ এম্পায়ারে খানিকটা মহার্ঘ হয়ে যেত। টাইগার ছিল সস্তার হল – বেতের চেয়ার, মাথার ওপর ঘুরতো পাখা। লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ারের মতো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের বালাই ছিল না! সাধারণত, লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ারে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবিই টাইগারে পুনর্মুক্তি পেত, যেমন পেয়েছিল ‘হাটারি’। এছাড়া দেখানো হতো অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে আগে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবি। টাইগারেও একটি ডিজাইন-করা পর্দা ছিল – আর স্ক্রীন সাধারণ চতুষ্কোণ থেকে ‘সিনেমাস্কোপে’ পরিণত হবার সময় টাইগারের স্ক্রীন জোরে ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠত! Signature tune অন্য দুটি হলের মতোই বাজত। লাইটহাউস, অন্যান্য সিনেমা-হলের মতো দো-তলা, সবচেয়ে দামী আসন ছিল দ্বিতলে। ত্রিতলিকা নিউ এম্পায়ারের কথা আগেই বলেছি। টাইগার ছিল একতলা!

(ক্রমশ)


শিবাংশু দে

 

 

মদমত্তা মোহিনীমায়া




মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে ফরসা অশ্বারোহী জনজাতির লোকজন খেপে খেপে পূর্বদিকে আসতে শুরু করে প্রায় চারহাজার বছর আগে থেকে। আজকের দিনে যে জায়গাগুলো নিয়ে উক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান নামের দেশগুলি তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে।  সিন্ধুসভ্যতার তখন শেষ অবস্থা। বহিরাগত এই সব গোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষরা সংখ্যায় ছিলো বেশি। তারা স্থানীয় আদি অধিবাসী নারীদের সঙ্গে বসবাস ও সন্তান উৎপাদন করতে শুরু করে। নিজেদের গোষ্ঠীর নারীদের নিয়ে বিশেষ অধিকারপ্রবণ ছিলো তারা। স্থানীয় অধিবাসীদের সংস্পর্শ থেকে তাদের দূরে রাখতে চাইতো। প্রথম যুগে তাদের সামাজিক পরিচয় ছিলো যাযাবর, অর্ধসভ্য জাতি। ইন্দো-ইরানিয় ভাষায় কথা বলতো। অন্যদিকে এদেশে তখন স্থানীয় অধিবাসীদের সভ্যতা ছিলো বিশেষ ভাবে আলোকপ্রাপ্ত। ভূমি দখলের লড়াইতে বহিরাগত জনজাতিরা তাঁদের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। অশ্বের ব্যবহার জানার ফলে নবাগতদের সামরিকশক্তি ছিলো স্থানীয় লোকজনদের থেকে বেশ খানিকটা বেশি । যদিও এদেশীয় রাজাদের বিক্রম  কোনও অংশে কম ছিলো না। যেমন, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরভ্রাতা ছিলেন একটি রাজ্যের একছত্র অধীশ্বর। তাঁরা ছিলেন বীর্যবান ও পরাক্রমশালী রাজা। পরম তপস্বী হিসেবেও  তাঁদের খ্যাতি ছিলো। বলা হয়, তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁদের বর দান করেছিলেন। যদিও হিসেব মতো 'ব্রহ্মা' তাঁদের দেবতা ছিলেন না। দেবতার বর অনুযায়ী কোনও মানব, দেবতা  বা দানব তাঁদের সংহার করতে পারতেন না। এই গুণী রাজা  দেবী পার্বতীর রূপমুগ্ধ হয়ে পড়েন। লক্ষণীয়, সব অসুর রাজাদের সম্বন্ধেই আর্যমূলের কবিরা এই 'ত্রুটি'টির  উল্লেখ করেছেন। তেজস্বী অসুররাজদের আর্যমূলের নারীদের প্রতি 'দুর্বলতা', কালক্রমে তাঁদের বিনাশের কারণ হতে দেখা যায়।  মনে হয় বহিরাগত আর্য সংস্কৃতির লোকজনই এদেশে প্রথম উদ্দিষ্ট পুরুষদের  চরিত্রহনন করতে 'নারীঘটিত' স্খলনের অভিযোগ আনা শুরু  করে। শুম্ভ-নিশুম্ভও কোনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। যুদ্ধের মাধ্যমে পার্বতীকে অধিকার করার প্রয়াসে রাজা শুম্ভ ক্রমান্বয়ে তাঁর সেনাপতি চণ্ড আর মুণ্ড, সুগ্রীব, ধূম্রলোচন, রক্তবীজ এবং ভাই নিশুম্ভকে হারান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত শুম্ভকে বিনাশ করার জন্য ‘নতুন দেবী'র প্রয়োজন হওয়ায় পুরাণকাররা পার্বতীর দেহ-কোষ থেকে 'কৌষিকী' নামের  দেবীকে সৃজন করার কল্পনা করেন। অন্যমতে, আজকের হিমাচল বা কাশ্মীরের অধিবাসী 'কুষিক' জনজাতির আরাধ্যা ছিলেন  দেবী কৌষিকী। ঘটনা যাইহোক, 'দেবীমাহাত্ম্যম' অনুযায়ী দেবী কৌষিকী অসুররাজ শুম্ভকে বধ করেছিলেন। তারপর এই দেবী আবার পার্বতী বা দুর্গার দেহে বিলীন হয়ে যান।

বিভিন্ন রাজ্যের  স্থানীয় রাজাদের মধ্যে রাজা মহিষ ছিলেন তিনভুবনের সেরা পুরুষ। সুপুরুষ, বীর্যবান, সৎ,  স্বাভাবিক একজন মানুষ। এতোগুলো গুণ যাঁর থাকে, তিনি বহিরাগতদের অভিযোগ মতো  স্রেফ  'চরিত্রহীন' হতে পারেন না। না হয় তিনি এদেশেরই ভূমিপুত্র। না হয় বিশ্বাস করতেন, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। তাঁকে বাহ্লীক,  হিন্দুকুশ পেরিয়ে এদেশে প্রতাপ বিস্তার করতে আসতে হয়নি। গায়ের রংটা একটু শ্যামলা। কোত্থেকে ঘোড়ায় চড়ে একগাদা ফর্সা লোকজন এসে এদেশে এন আর সি চালু করার ঢের আগে থেকেই তিনি মস্তো রাজা। এই বহিরাগতের দল তখন নিজেদের 'দেবতা' বলতে শুরু করেছেন। যতক্ষণ তাঁরা ঝামেলা করেননি ততক্ষণ মহিষ তাঁদের কিছু বলেননি। কিন্তু নাল্পে সুখমস্তি। ফর্সা জনতা সিন্ধুসরস্বতী পেরিয়ে এসে মহিষকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে দেন। তখন মহিষ তাঁদের এমন মার দিলেন, তাঁরা রীতিমতো কেঁদেকেটে পালালেন পাহাড়পর্বতের দিকে। যতোরকম গালাগালি ছিলো তাঁদের ভাষায়, সব কিছু দাগতে লাগলেন মহিষের নামে। কিন্তু বৃহৎ বৃহৎ দেবতারা, যেমন, ইন্দ্র, বিষ্ণু, যম, বরুণ, ব্রহ্মা, বিশ্বামিত্র ইত্যাদি এমন নাকাল হয়েছিলেন যে সবাই মিলেও আবার রাজা মহিষের সঙ্গে লড়াই করার হিম্মত করেননি। শেষে একজন জাঁদরেল সুন্দরী, বীর্যবতী নারী, যিনি ফর্সা দেবতাদের নিজের জাতেরও ন'ন, সবাই মিলে তাঁকে ধরে পড়লেন।

“তত্র ত্বিষা ব্যপ্ত লোকত্রয়ম অতুলং

সর্ব্বদেবশরীরজং তৎ তেজঃ একস্থং নারী অভূৎ।"

যদিও এই দেবী নবাগতদের এদেশে আসার আগে থেকেই রাজত্ব করতেন। দেবতাদের নিরুপায় অনুরোধে রীতিমতো দ্বিধার পড়ে শেষপর্যন্ত  রাজিও হয়ে গেলেন। সেই নারীর মধ্যে নাকি সব দেবতার তেজ। তিনি শর্ত দিলেন নিজের নারীসেনাদের নিয়েই যুদ্ধু করবেন। অপদার্থ পুরুষ দেবতারা যেন এর মধ্যে না পড়েন। পুরুষ দেবতারা তো খুব বেঁচে গেলেন। নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম সবকিছু ঐ সুন্দরী, বীর্যবতী কন্যাকে সোপর্দ করে সোমরস পান করতে করতে লম্বা ঘুম দিতে গেলেন। সে নারী আবার মধুপান না করলে লড়তে পারেন না। কুবেরদেবতা তখন এমন একটা কলস সাপ্লাই করলেন যার থেকে সুরা কখনও ফুরোবে না।

এই নারীর  রূপ আর ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে রাজা মহিষ তাঁকে বলেছিলেন, হে নারী, আমি কখনও কারো কাছে কিছু প্রার্থনা করিনি। কিন্তু তোমার কাছে আমি প্রেম যাচ্ঞা করছি। তুমি তা স্বীকার করো। দেবী বললেন, তবে তুমি দেবতাদের হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দাও। রাজা বললেন, তা তো সম্ভব নয়। ও তো আমার দেশ। দেবী বলেছিলেন, তবে যুদ্ধ করো। সে কী ভয়ানক লড়াই! বিরাট মার্কণ্ডেয়চণ্ডী জুড়ে তার বিশদ বর্ণনা করেছেন কবিরা। লিখেছেন, মহাপরাক্রমী রাজা মহিষের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দুর্গা খুব রেগে গিয়ে বারবার মদ্যপান করতে করতে রক্তনেত্র হয়ে অট্টহাস্য করছিলেন।

"ততঃ জগন্মাতা চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা উত্তমং পানং (মদ্যং)

পুনঃ পুনঃ পপৌ অরুণলোচনা রক্তনয়না জহাসঃ চ।।"

যে বীর রাজা জীবনে কোনও যুদ্ধে পরাজিত হননি, দেবী তাঁর প্রতি মায়াজাল বর্ষণ করে বশীভূত করে ফেলেছিলেন। তিনি যে মহামায়া। তিনি বলেছিলেন, সব মেয়েদের মধ্যেই তাঁর অংশ রয়েছে। মোহগ্রস্ত পুরুষ মেয়েদের মায়াজালে তাদের সব বীর্য হারিয়ে ফেলবে এটা তো 'দেবতা'র বিধান। কে তাকে জয় করবে?

সেই সুরামুগ্ধা, মদমত্তা, পরমনারীরত্নের অস্ত্রাঘাতে প্রাণ দেওয়া ভিন্ন পুরুষের কাছে আর কিছু বিকল্প থাকে না। এই জায়গায় মহাবিক্রমী মহিষ আর ম্যাদামারা মেধো কেরানির কোনও তফাত নেই। আমাদের আয়ু বলতে তাঁর মধুপানের বিরতিটুকু মাত্র। তার পর কী হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বিশদে ব্যাখ্যান করে গেছেন,

গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়, মধু যাবৎ পিবাম্যহম।

ময়া ত্বয়ি হতে ঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।

যোদ্ধা দেবীদের মধুপানের পরম্পরাটি এসেছিলো কৌমসমাজের আরাধ্য দেবীচেতনার থেকে। হিমালয়নন্দিনী পার্বতীকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ কালক্রমে এই দেবীরা  সংস্কৃত পুরাণ  ও সাহিত্যে পার্বতীরই অংশ হয়ে যান। নানা স্থানে কালী বা কালিকা  নামে এক রক্তলোলুপা, ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাই, যিনি মদ্যমাংসপ্রিয়া, শবর, বর্বর, পুলিন্দগণের আরাধ্যা (খিল হরিবংশ)। পুরাণ যুগের মধ্যবিন্দু সপ্তম শতকে বাণভট্টের 'কাদম্বরী' এবং সমসাময়িক ভবভূতির 'মালতীমাধব' নাটকে যে দেবীর কথা শোনা যায় তাঁকে শবরজাতি মদ্যসহ নরমাংস নিবেদন করতেন। এর সঙ্গে ছিলেন  রক্তলোলুপা চণ্ডী বা করালা দেবী। এঁরা  কৃষ্ণবর্ণা, উগ্রা, মদমত্তা, চামুণ্ডার উপদেবী। বনের কাছে শ্মশানে অধিষ্ঠান করেন। পরবর্তীকালে এঁরা কালী বা কালিকা দেবীর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। সেকালে মূলস্রোতের আর্য লেখকদের রচনায় দেবী কালীর প্রতি মর্যাদাকর মন্তব্য পাওয়া যেতো না। তাঁদের মনোভাব দেখলে বোঝা যাবে কালী তখনও ব্রাহ্মণ্য দেবীর সম্মান লাভ করেননি। মার্কণ্ডেয় পুরাণের 'চণ্ডী' অধ্যায়ে চামুণ্ডা, কালী, কালিকা, কৌষিকী (ইনি গৌরী, তারও দীর্ঘ গল্প আছে ), অম্বিকা প্রভৃতি দেবীর সঙ্গে পার্বতীর গুণ ও লক্ষণ সমন্বিত  করে করালবদনা কালীর রূপকল্প প্রস্তুত করা হয়েছিলো। যদিও এই সব দেবীর প্রধান স্বভাব-লক্ষণের মধ্যে একটি ছিলো তাঁদের মদ্যপ্রিয় রুচি।  বামাচারী তন্ত্রসাধনার  আবশ্যিক অঙ্গ পঞ্চ-ম'কারের প্রথম উপচারই মদ্য। আর্য পরম্পরার পার্বতীর মাহাত্ম্য সেখানে 'ম্লান' হয়ে যায়।

দেবভাষায় 'মদ' শব্দটির পরিভাষার সীমা নেই। হর্ষ, মত্তভাব, তৃপ্তি, মদ্য, সুরা, মধু, কস্তুরী, সোম, 'মত্ততাজনক পেয়', অনুরাগ, কল্যাণকর বস্তু, গর্ব, অহংকার, নায়িকার অলংকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত আমরা 'আগমসার' নামের সংকলনটি থেকে এই শ্লোকটিই পড়ি,

''সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে ।

পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ।।''

''হে পার্বতী! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক।" বিশ্বজননীর ইচ্ছেমতো মদমত্তা মোহিনীমায়া আমাদের চিরকাল অভিভূত করে রাখুন।

(সঙ্গের ছবিটি বীরভূমের ইলামবাজারে রামেশ্বর শিবমন্দিরে তোলা)

 


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি: আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি…



প্রতি, 

শীতকলকাতায় থিয়েটার করিয়ে শিল্পীজন মুখিয়ে থাকেন। উৎসব উৎসব ভাবখানা দেখেই আহ্লাদে আটখানা আমাদের একাডেমি চত্বর। হালকা কুয়াশ মাথায় তখন। সাদা বাড়ির ওপাশে এপাশে থিয়েটারের পোস্টার। দেখে মনে হয় থিয়েটার চলছে চলবে। একটা দুটো পোস্টারের মুখগুলো চেনা। থিয়েটারে সুবর্ণ জয়ন্তী পালন! একটি বিশেষ তকমা দেয়। তকমা মানে আর কিছুই নয় টিকে থাকাটিকে থাকা না লিখে, লেখা ঠিক হবে ভালো থিয়েটার করব, ভাল করে করব। এই ভাল করে করা মানে? থিয়েটারের এক অন্য ভাষা রয়েছে। সেই ভাষা লড়াইয়ের। থিয়েটার করেন যারা, তাদের সাধারণ, অতি সাধারণ চেহারা দেখলে সেই লড়াইয়ের আভাস মেলে না বটে। কিন্তু সাধারণ হয়ে কাজ করে চলাটাই বড় লড়াই। উৎসব মানে শুধু আড়ম্বর তো নয়। তাতে আড়ম্বরের সঙ্গে প্রলেপ থাকে অফুরান ভাল লাগার। নাহ, ভাল লাগা নয়, থিয়েটার মানে আবেগ। এই রে, কোন কোন বোদ্ধা নিশ্চয় এই ভাষাকে এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন। কী করে থিয়েটার থিয়েটার লিখছে___ নাট্যকলা বা নাট্য চলতে পারে। এ আদরের কথ্যনামে ডাক, সেখানে ডাকের মধ্যেই আবেগ থাকে। তো, যা লিখছিলাম। থিয়েটারের উৎসববর্ণাঢ্য ধন নেই। নেই অপ্রতুল ঐশ্বর্য।  তবুও, লড়াই লড়াই করেন থিয়েটারে থেকে যাওয়ার জন্যে আজীবন। তাঁরাই থিয়েটারের আত্মজন। একটি শো দেখতে গেলে অনেকদূরে ঠেকেও বুকিং করে ফেলা যায়। যেমন, ভূত দেখার জন্যে শান্তিনিকেতন থেকে বুকিং করে ফেলা গেল। এবারে নিশ্চিত। যাক, আমাদের দুই প্রিয় শিল্পী অভিনয় করছেন। একত্রে ভাগ করে নেব সেই সময়ের থিয়েটার।

আজকের নিবেদনে দলের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে আমন্ত্রণ। একাডেমি মঞ্চে সায়ক সুবর্ণ জয়ন্তী নাট্য উৎসবের শেষ নাটক: উষ্ণিক প্রযোজিত, দেবশংকর হালদার এবং শুভাশিস মুখোপাধ্যায় অভিনীত ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের নাটক "ভূত!" অনলাইন টিকিট হলে টিকিট দুপুর ১টা থেকে। এসব দেখতে বলেই ওই পাড়ায় তাড়াতাড়িই যাই।

সায়ক নাট্যদল ৫০এমন এক গতিকে স্পর্শ করতে চাই। এমন এক সত্য যা গভীর জীবনবোধের। হ্যাঁ, চেনা মুখের আমরা সায়কের হয়ে গেছি। থইথই থিয়েটারে। মানুষের ইচ্ছের মন্তাজ। একাডেমি সেজেছে ফুলে ফুলে। খোলা মনের এই উৎসবের আমেজ একাডেমির প্রবেশ দুয়ারে। যেখানে উৎসবের মেজাজ মানে থিয়েটারে দিগন্ত প্রসারিত রূপ। আমরা তো দেখে এসেছি, মেঘনাদ ভট্টাচার্য কীভাবে থিয়েটার নিয়ে কাজ করেছেন। খুব সরল। খুব মিশুকে। খুব কঠিন কাজের দায়বদ্ধতাথিয়েটারির নৈপুণ্য শুধু যে নিজে থিয়েটার করতে পাড়ায় নয়। অন্যদেরও দক্ষতার সঙ্গে টেনে ধরা। এবং ধরে রাখা। বড় দলের চালকএকমুঠোয় থিয়েটারকে ধরে, অন্যমুঠোয় সামলাচ্ছেন দর্শককূল।

একাডেমি উপচে। অনেকদিন পর দেখা গেল যে একাডেমি-র দ্বিতলেও মানুষের গন্ধ। আমাদের গন্ধ হাসি মজা ঠাট্টা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের থিয়েটার। তবুও তাতে লোক টেনে আনা হয় না। বিশেষ প্রচার যান্ত্রিক যুগের কত শত মাধ্যম। সেখানে শতফুল বিকশিত হোক এর মতন থিয়েটারের প্রচার হতে পারত। পারত, হয়নি। যতজন মানুষ একাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে ধূমায়িত সময় পার করেন, ইচ্ছে করে তাঁদের ডেকে বলি

'দেখবেন আমাদের থিয়েটার।' আমাদের। মানে একান্নবর্তী পরিবার যেমন হয়। আমরা মানে থিয়েটার-করিয়েরাযারা স্বপ্ন দেখি শুধু নিজে অভিনয় করে অভিনেতা হব না। শুধু অভিনয় নয়, সমাজকে পাল্টে দেব যোগেযোগ দেব। যারা দীর্ঘদিন থিয়েটার করে চলেছেন যারা দল করেছেন তাঁদের সবারই একটা ভূত চেপে থাকা।  

একসঙ্গে জানাই যে, বন্ধুরা ছুটির দিনে বেড়াতে যায়। যখন ডেকে বলে, যাবি। আমি বলি, দলে যেতে হবে। রিহার্সালউত্তর আসে, কী করিস এত? কিছুই তো দেখলাম না উন্নতি?

হেসে বলি, ঠিকই। উন্নতি হল না রে। কিন্তু অবনতি তো হয়নি।

রিনরিনে একটা যুদ্ধ যেতাআহা এসব সংলাপ লেখ। নাটক জমে যাবে। হিট করবে।

দূরভাষে দূরত্ব কমে। তাইই হল বোধকরি। যেমন, কথা শেষে। ভাবতে থাকা। একাই মঞ্চে ঘুরি। সংলাপ বলি, মাননীয় বন্ধুরা, আমাদের থিয়েটার করা। হিট করা, উন্নতি করা, গাড়ি বাড়ি করার লক্ষ্যে কবেই বা ছিল? কবেইবা কোন শিল্পীকে দেখেছেন যে বাড়িগাড়ির সম্পদে লোভে থিয়েটার করেছেন। আর অবধারিত সত্য এই যে, আমরা কাজ করি। ওই যেমন করে ওরা কাজ করেশহর জুড়ে ব্রিজ হয়। হয় উন্নতি। আমাদের থিয়েটারের ব্রিজ হয় চিন্তা ভাবনাকে পরিস্রুত করার লক্ষ্যে। আমাদের থিয়েটার হল সেতু সেই সেতু, যেখান থেকে মানুষ মানুষে সেতুবন্ধন হয়। আর মানুষের সঙ্গে মানুষের আর এই "ভূত" হল থিয়েটারের।

মঞ্চে দেখতে পাওয়া থিয়েটার-এর নাম "ভূত"আগেই বলেছি। আর এদিকে শয়েশয়ে এসেছেন দর্শক। যারা একত্রে থিয়েটারের ভূত লালন করেছেন, তাঁদের সমর্থন করতে। মঞ্চে থিয়েটার দেখার যে অভিজ্ঞতা তা লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে, নেপথ্যে ঘটতে থাকা এক থিয়েটারের কথা লেখা যায়।

দেখার পর থিতিয়ে গেলেও, যখন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়-এর মঞ্চে ভূত সেজে চলা মনে পড়লে হাসি পায়। তখনই থিয়েটারের সঙ্গে সালোকসংশ্লেষ ঘটে। সায়ক-এর দৌলতে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে একটা নাটক দেখাও কম নয়। কারণ এক উৎসবের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে জারিত হয় আরেক উৎসব। সেই উৎসবের নাম ভূত। আমাদের আগের সময়ের অর্থাৎ ভূতকালে যারা থিয়েটার করতে এসেছিলেন। তারা এরকম কিছু ভূত-মায়া রেখে গেছেন। যার সঙ্গে থিয়েটার পাগল একজনের কথা মনে পড়ে গেল কেয়া চক্রবর্তী। থিয়েটারের জন্যে চাকরি ছেড়ে দেওয়া। চাকরি থেকে পূর্ণ সময়ের থিয়েটার কর্মী হতে চাওয়া। আবার থিয়েটারের সঙ্গে সিনেমা, সিনেমা থেকে উপার্জন শেষে অকস্মাৎ মৃত্যু। সেই ভূতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের ভূতের রাজার কথা মনে রয়ে গেছে ছোটবেলা থেকেই। তাই মনে পড়ে গেল। যদি এমন বর মিলতযেখানে বলা যেত প্রতিটা থিয়েটার হল ভরে থাকবে, শো চলাকালীন। এমন ভূত আমার মাথায় বাস করছে। ভেবে যারা পাঠক হয়ে ভাবছেন, কেমন ভূতের মতন লিখেছেন রেতাঁদের সাধুবাদ জানাই। এখনও ভূতটা চেপে রয়েছে আমাদের। তাই থিয়েটার নিয়ে ফ্ল্যাশব্যাক।

থিয়েটারের ভূত নামটাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল কিনা? প্রশ্ন জানাই ছিল। উত্তর, না, ভূত নাটকের দুই অভিনেতা টেনে নিয়ে গিয়েছেন। দেবশঙ্কর হালদার এবং শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। একই মঞ্চে অভিনয় করছেন। হ্যাঁ, জীবন্ত দুই অভিনেতার রসায়ন, মঞ্চে। যে দেখেছেন তিনিই জানেনএকরকমের ভূত-ই তো হবে। যে এঁরা থিয়েটারের ভূত ঘাড়ে চাপিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ সময়? হ্যাঁ,  তিন দশক তো হবেই। তবেই না অমন অভিনয়_ভূত মঞ্চে দাপিয়ে বেরাল। একটা দৃশ্য মনে পড়ল। লিখি... মঞ্চে দেবশঙ্কর হালদার নিজের চরিত্রের সংলাপে, অভিনয়ে দেখতে চেষ্টা করছেন পাহাড়, তার চারদিকের দৃশ্যাবলী। আর তাঁকে প্রাতঃরাশ দিয়েছেন সংলগ্ন মঞ্চাভিনেত্রী, ওই পার্ট করছিলেন যিনি। তিনিও অনবদ্য অভিনয় করেছেন।  আর প্রাতরাশে রয়েছে ডিম। সেই ডিম চুরি করছেন "ভূত"রূপী শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। তাঁর মঞ্চে হেঁটে চলা। তাঁকে দেখা মঞ্চের অন্যান্য চরিত্রে ... চোখে ভাসল। তারপর একটু কমেডিয়ানা উঁকি দিল। সাদা ভূত বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল বলি, আরেকটু ভাবলে হত না পোশাক নিয়ে। মেকআপ, চুল মহাভারতের চরিত্রের মতন লাগছিল। অবশ্য বলার থাকবে নির্দেশকের পক্ষে যে, ভূতের আদল কীরকম হবে? বলতে পারেন? বলতে পারেন ভূত একুশ শতকের জিন্স পরবে নাকি ধুতিপাঞ্জাবি নাকি খদ্দর পাজামা। এই যে ভূত, তাঁর বয়স ছিল মৃত্যুকালে চরিত্র অনুযায়ী সত্তর ঊর্ধ্ব। ফলে সেই চরিত্রে অভিনেতার পোশাক হবে ওইরকম, তাঁর সমাজজীবন অনুসারে।

ভালই হল... একদিকে ডিম চুরির দৃশ্য ফের দেখলাম ফিরে। ফিরে দেখা মানে, ফ্ল্যাশ ব্যাক। থিয়েটারে এমন দেখা বিরল ও স্মৃতি নির্ভর তো বটেই। যারমধ্যে আবছা হয়ে থাকছে হলদে আলো, একটা বেঞ্চ, দুটো সিঁড়ি, আলমারি, টেবিল, চেয়ার, একটা ডেস্ক, কিছু অভিনয়ের সরঞ্জাম সব মিলে...

এখানে একটু থামতেই হবে। "ভূত" নাটকের আরেকটা দৃশ্যের সংলাপে, যেখানে এক ভূতের সঙ্গে বাস করার কথোপকথন চলছে। 'উষ্ণিক' এর নতুন নাটক 'ভূত'...

সংলাপ থেকেই বোঝা যাবে যে একজন ছুটি কাটাতে এসেছেন পাহাড়ে। হ্যাঁ, দার্জিলিং। উঠেছেন এক হোম স্টে-টে। আগেই বুকিং করা। যিনি বেড়াতে এসেছেন, তাঁর নাম দীপ্তেশ। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবশঙ্কর হালদার। দীপ্তেশ-এর ভালই লাগছে, রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে পাহাড়ে। সংলাপে সংলাপে, মুখের পেশির ওঠানামায়, চোখের ব্যবহারে _- বুঝিয়ে দিচ্ছেন অভিনেতা।

এখানে এসেই ভূতের সঙ্গে দেখা। যেখানে সে রয়েছে সেখানেই যত কাণ্ড! রহস্যময়। বাংলোয় বাস করে এক অদ্ভুতুড়ে ভূত। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন #শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। নাম তাঁর #মোহন মনোহর শোভন সুন্দর মুরলী বদন শাস্ত্রী। নামের যে রসিকতা, তা শুভাশিস বলার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করেছেন। আহা, কি সুন্দর ভূত! এরপর নাটকের প্লট জুড়ে আসবে তাদের দেখা হওয়ার ঝগড়া, আনন্দ, রসিকতা থেকে জীবনের চরম কোনও ঘটনায় ঘটবে এক্সপোজিশান। জীবনে তো সব থাকে _ আবেগ ভরা জীবনে কোন রোগ আসে। তারপর কেমন যেন পালটে যায় ভালোবাসার গল্প। সেই গল্পের সঙ্গে জুড়ে ভূতের গল্প। ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, সন্ধ্যে ৬:৩০ টা-তে দেখে নেওয়া এই থিয়েটার। আর উল্লেখের নয় যে, আকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-র সায়কের নাট্য উৎসবের মহল জমজমাট অনেক মাথা ভর্তি প্রেক্ষাগৃহ।

মজার সংলাপ, নাহ মনে পড়ল কই... আরেকবার দেখতে হবে। মনে রাখার জন্যে দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয়, কিছু এমন স্বরক্ষেপন রয়েছে _ যা অভিনয় শিখতে চাওয়াদের জন্যে দেখার। আর দুই অভি নেতার অভিনয়, কীভাবে মঞ্চ স্পেস ব্যবহার করবেন, শিখতে শিখতে দেখুন। আর দেখতে দেখতে শিখুন।

এরপর তো বইমেলা। আরেকটা উৎসব শুরু হতে চলেছে। সেই উদযোগে শীতের সঙ্গে থিয়েটারের যোগও রয়েছে। জেলায় জেলায় হচ্ছে থিয়েটার উৎসব। শুধু কলকাতায় এসে দেখতে কেন হবে। তাই নাট্যদলগুলো চলেছে জেলায়, উপজেলায়, শহরতলির ভূগোলে।  

ভূত একেও বলে! আমাদের ৭৫ বছর পার হওয়া থিয়েটারের নাম গ্রুপ থিয়েটার। যেখানে,  থিয়েটার/নাট্য = দর্শকের রুচি তৈরি করা। যে বা যারা দর্শকের আসনে থাকবেন, তাদের জন্যে থিয়েটারের মঞ্চে নানান শারীরিক কসরত/ বিবিধ চমকের আমদানি নয়। ভাল থিয়েটার করার আবেগ + আন্তর্জালিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন = আমাদের থিয়েটার। শুধু একুশ শতকের দর্শকের কাছে অনুরোধ এই যে, একটু ছড়িয়ে দিন_ থিয়েটারআপনাদের ব্যবহৃত মুঠোয় মুঠোয় কত যে ফোন, কত যে স্বীয়-ছবির বন্যা। আসুন না একটা নতুন ভাবনার ছবি তুলতে থিয়েটার পাড়ায়। আবেগ আন্তর্জালিক মাধ্যমে দর্শকের কল্যাণ-মুঠোয় এক থিয়েটারের জোগান দেয়। যে থিয়েটারে সব জীবন্ত চলমান। হে দর্শক, ভাসমান অবস্থান থেকে আসুন থিয়েটার দেখতে। থিয়েটার পার্থিব। থিয়েটার লৌকিক। থিয়েটার ব্যবহারিক পর্যায়ের।

শেষে, থিয়েটারের ভূত অদৃশ্য নয়। থিয়েটারি এক অন্যরকম ভূতের গল্প। না, ধারাবাহিক...যেখানে থিয়েটার নিয়ে 'ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার' নামক পুনরায় ভাবনার গদ্যের জন্ম। কবি রেখেছেন আহ্বান, "আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি" আসলে বেঁধে থাকা, বন্ধন হল এক উৎসব যে বন্ধন মানবিক ছায়ায় থিয়েটারের সঙ্গে আরও বেঁধে রাখে অলক্ষ্যে ভূতের মতন এর অস্তিত্ব যেন বয়ে চলেছে আগামীর লক্ষ্যে

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী