ধারাবাহিক উপন্যাস
(প্রথম
পর্ব)
উৎপল চিত্রকর খুব একটা কথা বলে না। বাংলায় যাকে বলে প্রগলভ, সে মোটেও তা নয়। বরং যে কথাগুলো মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ দিয়ে উৎপাদিত হয়ে হৃদয় বেয়ে মুখ থেকে বের হয়, উৎপলের বেলায় সেটা হয় তুলি আর ক্যানভাসে। এই যেমন, বৃষ্টি থামার পরে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের কোলে যে আকাশ বাতাস আর মাটির গভীর থেকে এক রকমের নির্মলতা বিরাজ করে, চিত্রকর উৎপল তাদেরকে মনের ঘরে রংতুলি দিয়ে শিল্পের কথা বলায়। সে-সব চিত্রকল্পের দৃশ্যগত, ইন্দ্রিয়গম্য অনুভব থাকে। যারা গভীর অনুসন্ধিৎসু, তারা সেসব নিয়ে চর্চার ফলে ছবিগুলো প্রাণী হয়ে যায়। সেইসব প্রাণী নিজেদের মধ্যে নিজেরা কথা বলে। ওসব কথায় দেশ, কাল, সময়, পাপপুণ্য ইত্যাদি উঠে আসে।
বৃষ্টি হওয়ার পরেও আকাশের পূব পশ্চিম কোণে আবারও মেঘ জমতে শুরু করেছে। খবরে প্রকাশ, বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে আগামী চব্বিশ ঘন্টাতে প্রচন্ড বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি আর সঙ্গে ঝড়-ঝাপটা বয়ে যাবে বাংলার উপকুল অঞ্চলের ওপর দিয়ে। এর সাথে পশ্চিম বাংলার প্রায় সবকটি জেলাতেই চলবে প্রবল হাওয়ার সাথে বৃষ্টি।
উৎপলের ক্যানভাস এখন কালো আর মধ্যে মধ্যে নীল হয়ে থাকা আকাশ। সেইখানে কয়েকটি ফটিকজল পাখির এক্রেলিকের কাজ। এরা উৎপলের সৃষ্টি হলে-ও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অল্প উঁচুতে উড়তে পারা সেইসব পাখির দল বায়বীয় মন্ডলে এখন এক-একটা উড়ন্ত চলন।
খুব বেশি এরা উড়তে পারেনা। কয়েকটি
পাখির মধ্যে একটি ফটিক পাখি তো একেবারেই দলছাড়া। সে অনেকটা নীচে, অর্থাৎ বাদবাকি পাখিদের
থেকে বিচ্ছিন্ন।
নিজসৃষ্ট পাখি তো এরা! তাই, চিত্রকরের
কারুকাজে এরা প্রাণ পেলেও উৎপলের সাথে এদের মনোকথন চলতেই থাকে। এই যেমন নাতিউচ্চে চক্রের
মতো ঘুরন্ত পাখিটি মনে মনে ভূমন্ডলে ফেলে আসা তার পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম বাস্তবতাকে
মনে করে কাঁদছে। সেই কান্নার স্বর এ উৎপল সাংঘাতিক ভাবে বিদ্ধ হচ্ছে। এটা একটি পুরুষ
পাখি, উৎপল সেটা জানে। আর জানবেই বা না কেনো?
কারণ পৃথিবীর সমস্ত পাখিপ্রাণ যে তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে।
যখন পৃথিবী বলতে কেবল জল আর জল।
সেই জলে সূর্যের সাথে অন্য কোনো গ্রহের সংঘর্ষে একটুকরো জলন্ত ধাতব খন্ড খসে জলে পড়লো,
আর ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়ে গেলো সচলায়তনে নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে হাজার
হাজার বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া বৃদ্ধ এক ওস্তাদ মস্তিষ্কের ব্যাক্তি অথবা না-ব্যাক্তি
উৎপল নামক চিত্রকরের কারুকাজে পার্থিব জগতে প্রাণস্পন্দনের প্রসার ঘটানোর খেলা।
তা, এই নাতি উচ্চতায় ঘুরন্ত পাখিটির নাম যে নিমচাঁদ দাগা, তা, উৎপল শিল্পী বিলক্ষণ জানে। হরিপুরের দাগাবাবু, যার তিন তিনটি তেলের মিল সহ সুদের কারবার, সে-সব চিত্রকল্পের দৃশ্যগত ইন্দ্রিয়গম্য অনুভব যেমন উৎপলের আছে, তেমন, আজও, অর্থাৎ নিমচাঁদ দাগার মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরেও, হরিপুরের মল্লিক পাড়ায় শ্মশান যাত্রীদের ও প্রতিবেশীদের মধ্যেও সেই একই অনুভূতি প্রকাশিত হচ্ছে ।
জনারণ্যে একটা গুঞ্জন ভেসে আসছে,
অবশেষে ব্যাটা গেলো তাহলে ! দাগাবাড়ির অন্দরমহলে কান্নার রোল থামছে তো, কখনো আবারও
সে কান্নার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ততক্ষণে দাগা বাবুর পাখিপ্রাণ এক চক্কর মেরে আঁটকে গেলো
বাতাসে উড়ন্ত জাতীয় পতাকায়। আঁটকে যাওয়া মানে একেবারেই পতাকা দন্ডের সাথে লাগানো সুতলি
দড়ির সাথে।
ব্যাস! আর যায় কোথায়! দেহ বিচ্ছিন্ন একটি প্রাণ, অপলক তাকিয়ে
দেখছে, হরিপুরে তার সাজানো বাগানের মতো বাড়ির সামনে অসংখ্য মানুষের ঢল নেমেছে।
বিশেষত নিমচাঁদ দাগার স্ত্রী বিয়োগের
পর থেকে তিনি একরকম ভাবে একাই হয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই ব্যবসাপত্র দেখেন দাগা বাবুর
জৈষ্ঠপুত্র অভিষেক। কনিষ্ঠটির নাম অভিজিৎ। সে চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে বর্তমানে
বিদেশি।
নিস্তব্ধ হয়ে আছে বাড়িটি। উঠোনের তুলশী মঞ্চের সামনে সাদা থানে আবৃত নিমচাঁদ দাগার ছেড়ে যাওয়া শরীরকে দেখছেন জাতীয় পতাকা দন্ডের গায়ে আঁটকে থাকা পাখিপ্রাণা নিমচাঁদ দাগা নিজেই।
এ আবার কেমন কথা, যে, একজনের মৃত
শরীর দগ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত, সেই শরীর থেকে বেরিয়ে আসা বাতাস-প্রাণ তাকে-ই এবং তার-ই
তৈরি এতোদিনের সাজানো-গোছানো বাড়ির ও পরিবারের সবকিছুই দেখতে পাচ্ছেন!
( ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন